নারী অঙ্গন

নারীর অধিকার ও মর্যাদায় ইসলাম – ১

মহান আল্লাহর নিকট ইসলামই একমাত্র মনোনীত দ্বীন (আলে ইমরান ১৯) । আর এই দ্বীনে মহান আল্লাহ নারীর মর্যাদাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন। নর-নারীর সমন্বয়েই মানব জাতি। নারী জাতি হ’ল মহান আল্লাহর এক বিশেষ নে‘মত। আল্লাহ তা‘আলা নারীকে পুরুষের জীবন সঙ্গিনী হিসাবে মানব জীবন পরিচালনার জন্য পারস্পরিক সহযোগী করেছেন। ইসলাম মর্যাদার দিক দিয়ে নারীকে পুরুষের থেকে ভিন্ন করে দেখেনি। বরং ইসলামের আগমনেই নির্যাতিত, নিপীড়িত, অবহেলিত নারী সমাজ পেয়েছে মুক্তির সন্ধান। সারা দুনিয়াতে যখন নারীরা নিদারুণ অবস্থায় কালাতিপাত করছিল, আরব, ইউরোপ ও অন্যান্য দেশে তাদেরকে জন্তু-জানোয়ার বলে মনে করা হ’ত এবং মানুষ হিসাবে তাদের কোন মর্যাদা ও অধিকার স্বীকার করা হ’ত না, তখন ইসলাম নারীর যথাযথ অধিকার ও মর্যাদা প্রদান করে নারী জাতিকে সম্মানের সুউচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা পুরুষদের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, ﻫُﻦَّ ﻟِﺒَﺎﺱٌ ﻟَّﻜُﻢْ ﻭَﺃَﻧْﺘُﻢْ ﻟِﺒَﺎﺱٌ ﻟَّﻬُﻦَّ

‘তারা তোমাদের পোশাক এবং তোমরা তাদের পোশাক’ (বাক্বারাহ ১৮৭) । তিনি আরো বলেন,

ﻳَﺎ ﺃَﻳُّﻬَﺎ ﺍﻟﻨَّﺎﺱُ ﺍﺗَّﻘُﻮﺍْ ﺭَﺑَّﻜُﻢُ ﺍﻟَّﺬِﻱْ ﺧَﻠَﻘَﻜُﻢ ﻣِّﻦ ﻧَّﻔْﺲٍ ﻭَﺍﺣِﺪَﺓٍ ﻭَﺧَﻠَﻖَ ﻣِﻨْﻬَﺎ ﺯَﻭْﺟَﻬَﺎ ﻭَﺑَﺚَّ ﻣِﻨْﻬُﻤَﺎ ﺭِﺟَﺎﻻً ﻛَﺜِﻴْﺮﺍً ﻭَﻧِﺴَﺎﺀَ ﻭَﺍﺗَّﻘُﻮﺍْ ﺍﻟﻠّﻪَ ﺍﻟَّﺬِﻱْ ﺗَﺴَﺎﺀَﻟُﻮْﻥَ ﺑِﻪِ ﻭَﺍﻷَﺭْﺣَﺎﻡَ ﺇِﻥَّ ﺍﻟﻠّﻪَ ﻛَﺎﻥَ ﻋَﻠَﻴْﻜُﻢْ ﺭَﻗِﻴْﺒﺎً –

‘হে মানব সকল! তোমরা তোমাদের স্বীয় প্রতিপালককে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে একই আত্মা (আদম) হ’তে সৃষ্টি করেছেন এবং ঐ আত্মা হ’তে তাঁর জোড়া (হাওয়া)-কে সৃষ্টি করেছেন এবং এতদুভয় হ’তে বহু নর ও নারী বিস্তার করেছেন। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যাঁর নামে তোমরা পরস্পরের নিকট (স্বীয় হকের) দাবী করে থাক এবং আত্মীয়তা (এর হক বিনষ্ট করা) হ’তেও ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের সকলের খবর রাখেন’ (নিসা ১) ।

ইসলামে নারীর অধিকার ও মর্যাদা

মর্যাদা অর্থ- গৌরব, সম্ভ্রম, সম্মান, মূল্য ইত্যাদি। আর নারীর মর্যাদা বলতে নারীর ন্যায়-সঙ্গত অধিকারকে বুঝায়। আর অধিকার অর্থ প্রাপ্য, পাওনা ইত্যাদি। কারো অধিকার প্রদানের অর্থ হচ্ছে তার প্রাপ্য বা পাওনা যথাযথভাবে প্রদান করা। আর এ প্রাপ্য বা পাওনা বলতে তার অধিকারের স্বীকৃতি, কর্তব্যের সঠিক বিশ্লেষণ ও সামাজিক জীবনে তার অবদানের যথার্থ মূল্যায়নই বুঝানো হয়। সুতরাং নারী অধিকার বলতে পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক তথা সকল ক্ষেত্রে নারীর যথার্থ মূল্যায়নকেই বুঝানো হয়। অতএব যদি কারো ন্যায্য অধিকার স্বীকার না করা হয়, অথবা তার কর্তব্যে বাধা দান বা তার সামর্থ্যের অধিক কোন দায়িত্ব-কর্তব্য তার উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়, কিংবা তার অবদান সমূহের সঠিক মূল্যায়ন না করা হয়, তাহ’লে তার অধিকার ও মর্যাদা খর্ব করা হবে এবং তার প্রতি অবিচার করা হবে। আর যখন তার অধিকার সমূহ স্বীকার করা হয়, তার সামর্থ্য অনুসারে তাকে দায়িত্ব-কর্তব্য আদায় করার পূর্ণ সুযোগ দান করা হয় এবং সামাজিক জীবনে তার অবদান সমূহের মূল্যায়ন করা হয়, তখন তার উপযুক্ত মর্যাদা দান করা হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায়।

ইসলাম পূর্ব যুগে নারীর অবস্থান

ইসলাম পূর্ব যুগে নারী ছিল সবচেয়ে অবহেলিত, লাঞ্চিত, বঞ্চিত, নির্যাতিত এবং অধিকার হারা জাতি। সে সময় নারীকে ভোগ-বিলাসের উপকরণ এবং বাজারের পণ্য হিসাবে গণ্য করা হ’ত। সেই সময়ে নারীদেরকে মানুষ হিসাবে যথাযোগ্য মর্যাদা দেয়া হ’ত না এবং তাদের কোন সামাজিক অধিকার স্বীকৃত ছিল না। এমনকি মানব জাতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে সমাজে বেঁচে থাকার অধিকারটুকুও ছিল না। তাদের প্রতি খুবই কঠোর আচরণ করা হ’ত। সে যুগে নারীদেরকে মনে করা হ’ত দাসী এবং ভারবাহী পশু হিসাবে। যাদেরকে ক্রয়-বিক্রয় করা হ’ত। সে আমলে স্বামী যত খুশি স্ত্রী গ্রহণ করত এবং ইচ্ছা করলে তার স্ত্রীকে অপরের কাছে বিক্রি করে দিতে পারত কিংবা স্ত্রীকে দিয়েই কেউ ঋণ পরিশোধ করত। আবার কেউ উপহার হিসাবে কাউকে এমনিই দিয়ে দিত। তারা কন্যা সন্তান জন্মকে লজ্জাজনক মনে করে স্বীয় নিষ্পাপ কন্যা সন্তানকে জীবন্ত কবর দিতেও কুণ্ঠিত হ’ত না। তাদের এমন বিবেক বর্জিত কর্ম সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ﻭﺍَﺫِﺇَ ﺍﻟْﻤَﻮْﺅُﻭْﺩَﺓُ ﺳُﺌِﻠَﺖْ، ﺑِﺄَﻱِّ ﺫَﻧْﺐٍ ﻗُﺘِﻠَﺖْ، ‘আর যখন জীবন্ত সমাধিস্থ কন্যাকে জিজ্ঞেস করা হবে, কি অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছিল’? (তাকভীর ৮-৯) ।

সেযুগে তারা পিতা-মাতা বা স্বামীর মৃত্যুর পর পরিত্যক্ত সম্পত্তি থেকেও বঞ্চিত হ’ত। পিতৃহীনা সুন্দরী-ধনবতী বালিকার অভিভাবক যথাযথ মোহর দানে তাকে বিবাহ করতে সম্মত হ’ত না। আবার অন্যত্র বিবাহ দিতেও অসম্মতি প্রকাশ করত। সুন্দরী বাঁদী দ্বারা দেহ ব্যবসা করিয়ে অর্থ উপার্জন করা হ’ত। এ গর্হিত কাজ হ’তে বিরত রাখার উদ্দেশ্যে আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াত অবতীর্ণ করেন, ﻭَﻻَ ﺗُﻜْﺮِﻫُﻮْﺍ ﻓَﺘَﻴَﺎﺗِﻜُﻢْ ﻋَﻠَﻰ ﺍﻟْﺒِﻐَﺎﺀِ ﺇِﻥْ ﺃَﺭَﺩْﻥَ ﺗَﺤَﺼُّﻨﺎً ﻟِّﺘَﺒْﺘَﻐُﻮْﺍ ﻋَﺮَﺽَ ﺍﻟْﺤَﻴَﺎﺓِ ﺍﻟﺪُّﻧْﻴَﺎ، ‘আর তোমরা দুনিয়ার ধন-সম্পদ লাভের উদ্দেশ্যে তোমাদের যুবতী দাসীদেরকে ব্যভিচারে লিপ্ত হ’তে বাধ্য করবে না। যখন তারা পাপমুক্ত থাকতে চায়’ (নূর ৩৩)। উল্লিখিত যুগে একের অধিক নারী বিবাহ করে তাদের ন্যায্য পাওনা হ’তে বঞ্চিত করা হ’ত। তাদেরকে তালাক দিয়ে অন্যত্র স্বামী গ্রহণের অবকাশও দেওয়া হ’ত না। এ জাতীয় অমানবিক ও অমানুষিক যুলুম অত্যাচার নারী জাতির উপর করা হ’ত।

বিভিন্ন ধর্ম ও সভ্যতায় নারী

বিভিন্ন ধর্ম ও সভ্যতায় নারীদের অবস্থান নিম্নে তুলে ধরা হ’ল-

হিন্দু ধর্মে : নারীদেরকে বলী দেওয়া হ’ত এবং এ ধর্মে সতীদাহ প্রথা প্রচলিত ছিল। এছাড়াও এ ধর্মে নারীরা পিতার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত। হিন্দু ধর্মে নারীদের অতীব হীন ও নীচু স্তরের প্রাণী মনে করা হ’ত। এ দিকে ইঙ্গিত করেই Professor India গ্রন্থে বলা হয়েছে, There is no creature more sinful than woman. Woman is burning fire. She is the sharpedge of the razor she is verily all there in a body. অর্থাৎ ‘নারীর ন্যায় এত পাপ-পঙ্কিলতাময় প্রাণী জগতে আর নেই। নারী প্রজ্জ্বলিত অগ্নি স্বরূপ। সে ক্ষুরের ধারালো দিক। এই সমস্তই তার দেহে সন্নিবিষ্ট’। নারীদের প্রতি ঘৃণাভরে বলা হয়েছে, Men should not love their অর্থাৎ ‘নারীদেরকে ভালবাসা পুরুষদের উচিৎ নয়’।

বৌদ্ধ ধর্মে : বৌদ্ধ ধর্মে নারীকে সকল পাপের জন্য দায়ী করা হ’ত। এ সম্পর্কে ঐতিহাসিক ওয়েষ্টমার্ক বলেন, Woman are of all the snares which the tempter has spead for man, the most dangerous; in woman are embodied all the powers of infatuation which blined the mind of the world. অর্থাৎ ‘মানুষের জন্য প্রলোভনের যতগুলি ফাঁদ বিস্তার করে রেখেছে, তন্মধ্যে নারীই সর্বাপেক্ষা বিপজ্জনক। নারীর মধ্যে সকল মোহিনী শক্তি অঙ্গীভূত হয়ে আছে, যা সমস্ত বিশ্বের মনকে অন্ধ করে দেয়’।

ইহুদী ধর্মে : এ ধর্মে নারীর প্রকৃতি সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘সতী নারীর চেয়ে পাপিষ্ট পুরুষও শতগুণে ভাল’। তারা নারীকে যাবতীয় পাপ ও মন্দের মূল কারণ হিসাবে গণ্য করেছে।

খৃষ্টান ধর্মে : খৃষ্টধর্ম মতে নারীরাই নরকের প্রবেশ দ্বার। সপ্তদশ শতাব্দীতে ‘কাউন্সিল অব দ্যা ওয়াইজ’-এর অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় ‘Woman has no soul’ ‘নারীর কোন আত্মা নেই’।

চীন সভ্যতায় : চীন দেশের নারীদের অবস্থার বিবরণ দিতে গিয়ে জনৈকা চীনা নারী বলেন, ‘মানব সমাজে নারীদের স্থান সর্বনিম্নে। অদৃষ্টের কি নির্মম পরিহাস! নারী সর্বাপেক্ষা হতভাগ্য প্রাণী। জগতে নারীর মত নিকৃষ্ট আর কিছু নেই’।

গ্রীক সভ্যতায় : বিশ্বখ্যাত গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিস বলেন, ‘Woman is the greates source of chaose and disruption in the world’ ‘নারী জগতে বিশৃংখল ও ভাঙ্গনের সর্বশ্রেষ্ঠ উৎস’।

রোম সভ্যতায় : রোম সভ্যতায় পরিবারের নেতা ও পরিচালক পিতা বা স্বামী নিজের স্ত্রী ও সন্তানদের উপর নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী ছিল। তারা যখন ইচ্ছে তখনই নারীকে ঘর থেকে বহিষ্কার করে দিত।

বর্তমান বিশ্বে নারীর অধিকার ও মর্যাদা

বর্তমান বিশ্বেও নারীর যথাযথ অধিকার দেওয়া হচ্ছে না। তাদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার হ’তে তাদেরকে বঞ্চিত করার মাধ্যমে তাদের উপর অত্যাচার করা হচ্ছে। পাশ্চাত্যবাদীরা নারী স্বাধীনতার নামে নারীদেরকে ঘরছাড়া করেছে। ইসলাম নারীদেরকে মর্যাদার যে উচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করেছিল, পাশ্চাত্যবাদীরা তা ক্ষুণ্ণ করে নারীদের আবার অনাচার আর দুষ্কর্মের শৃংখলে বন্দী করে ফেলেছে।

পাশ্চাত্যবাদীরা পারিবারিক বন্ধনকে ভেঙ্গে নারীদেরকে নিজেদের অর্থ উপার্জনের মাধ্যম হিসাবে গড়ে তুলছে। আমেরিকা ও ইউরোপীয় দেশগুলোতে এমনকি আমাদের দেশেও ৮৫% নারী ধনতন্ত্রবাদের সেবায় নিজেদের বিলিয়ে দেয়। পাশ্চাত্য সভ্যতা আজ নারীদেরকে অপরের ইচ্ছার পুতুল বানিয়ে তাদেরকে বাজারের পণ্য ও ফ্যাশনের প্রতীক হিসাবে ব্যবহার করছে এবং খদ্দেরদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য নারীদের বিভিন্নভাবে উপস্থাপন করছে। যেমন- নারীদের নগ্ন ও অশ্লীল ছবি, নারী বিষয়ক নানান অশ্লীল গল্প, কবিতা, উপন্যাস, অশ্লীল সিনেমা ইন্টারনেট সহ বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছে। ফলে যুব সমাজ এমনকি বৃদ্ধদেরও মানষিক বিকৃতি ঘটছে। এভাবে পাশ্চাত্য সভ্যতা নারীদেরকে তাদের উন্নত মর্যাদার আসন থেকে টেনে নীচে নামিয়ে আনছে। অল্প কথায়, নারীর মর্যাদা দানের পরিবর্তে নারী জাতির প্রতি দিন দিন অমর্যাদা ও অবমাননাই বৃদ্ধি পাচ্ছে।

নারীর অধিকার ও মর্যাদা রক্ষায় ইসলামের ভূমিকা

মানব সৃষ্টির প্রথম দিকে আল্লাহ তা‘আলা আদি পিতা আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি করার পর তাঁর সহধর্মিনী হিসাবে তাঁরই বাম পাঁজরের একটি হাড় হ’তে আদি মাতা হাওয়া (আঃ)-কে সৃজন করেন। অতঃপর তাঁদের হ’তে অসংখ্য নর-নারী সৃষ্টি করেছেন। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ এরশাদ করেন, ﻳَﺎ ﺃَﻳُّﻬَﺎ ﺍﻟﻨَّﺎﺱُ ﺇِﻧَّﺎ ﺧَﻠَﻘْﻨَﺎﻛُﻢ ﻣِّﻦْ ﺫَﻛَﺮٍ ﻭَﺃُﻧْﺜَﻰ ‘হে মানবজাতি! আমি তোমাদেরকে একজন পুরুষ ও একজন নারী হ’তে সৃষ্টি করেছি’ (হুজুরাত ১৩) ।

মহান আল্লাহ এ বিশ্ব জগতে অসংখ্য মাখলূকাতের মধ্যে মানব জাতিকে শ্রেষ্ঠ জাতি হিসাবে মর্যাদা দান করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

ﻭَﻟَﻘَﺪْ ﻛَﺮَّﻣْﻨَﺎ ﺑَﻨِﻲْ ﺁﺩَﻡَ ﻭَﺣَﻤَﻠْﻨَﺎﻫُﻢْ ﻓِﻲ ﺍﻟْﺒَﺮِّ ﻭَﺍﻟْﺒَﺤْﺮِ ﻭَﺭَﺯَﻗْﻨَﺎﻫُﻢْ ﻣِّﻦَ ﺍﻟﻄَّﻴِّﺒَﺎﺕِ ﻭَﻓَﻀَّﻠْﻨَﺎﻫُﻢْ ﻋَﻠَﻰ ﻛَﺜِﻴْﺮٍ ﻣِّﻤَّﻦْ ﺧَﻠَﻘْﻨَﺎ ﺗَﻔْﻀِﻴْﻼً –

‘আর আমি বনী আদমকে সম্মানিত করেছি এবং তাদেরকে জলে ও স্থলে আরোহণ করিয়েছি এবং উত্তম বস্ত্তসমূহ প্রদান করেছি। আর আমি তাদেরকে আমার বহু সৃষ্টির উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি’ (বনী ইসরাঈল ৭০) ।

আল্লাহ তা‘আলা নারী-পুরুষ উভয়কেই সম্মান দিয়েছেন, পুরুষের থেকে নারীকে ভিন্ন ভাবে দেখেননি। বরং যুগ যুগ ধরে অবহেলিত ও উপেক্ষিত নারী সমাজকে পুরুষের সমমর্যাদা এবং কোন কোন ক্ষেত্রে তার চেয়ে অধিক মর্যাদা দান করেছেন। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন, ﻭَﻟَﻬُﻦَّ ﻣِﺜْﻞُ ﺍﻟَّﺬِﻱْ ﻋَﻠَﻴْﻬِﻦَّ ﺑِﺎﻟْﻤَﻌْﺮُﻭْﻑِ ﻭَﻟِﻠﺮِّﺟَﺎﻝِ ﻋَﻠَﻴْﻬِﻦَّ ﺩَﺭَﺟَﺔٌ

‘স্ত্রীদেরও পুরুষদের উপর ন্যায় সঙ্গত অধিকার রয়েছে। আর নারীদের উপর পুরুষদের শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে’ (বাক্বারাহ ২২৮) ।

ইসলাম নারীর প্রতি সকল প্রকার অত্যাচার, অবিচার নিষিদ্ধ ঘোষণা করতঃ নারীকে সর্বক্ষেত্রে অধিকার ও মর্যাদা প্রদান করেছে। ইসলাম বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর যে অধিকার ও মর্যাদা প্রদান করেছে সেগুলো নিম্নে আলোচনা করা হ’ল-

(ক) বিবাহের মাধ্যমে নারীকে অধিকার ও মর্যাদা দান :

জাহিলী যুগে বৈবাহিক ক্ষেত্রে নারীদের কোনরূপ অধিকার ছিল না। তারা শুধু পুরুষের ভোগের সামগ্রী ছিল। ইসলাম এহেন ঘৃণিত প্রথার মূলোৎপাটন করতঃ নারী ও পুরুষের বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের নির্দেশ দিয়েছে। এ মর্মে আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন,

ﻓَﺎﻧْﻜِﺤُﻮﺍْ ﻣَﺎ ﻃَﺎﺏَ ﻟَﻜُﻢ ﻣِّﻦَ ﺍﻟﻨِّﺴَﺎﺀِ ﻣَﺜْﻨَﻰ ﻭَﺛُﻼَﺙَ ﻭَﺭُﺑَﺎﻉَ ﻓَﺈِﻥْ ﺧِﻔْﺘُﻢْ ﺃَﻻَّ ﺗَﻌْﺪِﻟُﻮﺍْ ﻓَﻮَﺍﺣِﺪَﺓً ﺃَﻭْ ﻣَﺎ ﻣَﻠَﻜَﺖْ ﺃَﻳْﻤَﺎﻧُﻜُﻢْ ﺫَﻟِﻚَ ﺃَﺩْﻧَﻰ ﺃَﻻَّ ﺗَﻌُﻮْﻟُﻮﺍْ –

‘তবে যেসব নারী তোমাদের পসন্দ হয়, তাদের মধ্য থেকে দুই দুই, তিন তিন, চার চার জনকে বিবাহ কর। কিন্তু তোমাদের মনে যদি আশংকা জাগে যে, তোমরা তাদের সাথে ইনসাফ করতে পারবে না। তাহ’লে একজন স্ত্রী গ্রহণ কর অথবা তোমাদের দাসীদেরকে স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ কর। অবিচার হ’তে বাঁচার জন্য এটাই অধিক সঠিক কাজ’ (নিসা ৩) ।

(খ) স্বামী নির্বাচনের স্বাধীনতায় নারীকে অধিকার ও মর্যাদা দান :

ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে নারীদের পসন্দমত স্বামী গ্রহণের কোন অধিকার ছিল না। যখন-তখন তাদেরকে পাত্রস্থ করা হ’ত। কিন্তু ইসলাম নারীকে স্বামী নির্বাচনের স্বাধীনতা দিয়েছে। যে কেউ ইচ্ছা করলে বলপূর্বক কোন নারীর স্বামী হ’তে পারবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ﻓَﻼَ ﺗَﻌْﻀُﻠُﻮْﻫُﻦَّ ﺃَﻥ ﻳَﻨْﻜِﺤْﻦَ ‘হে পুরুষরা! তোমরা মহিলাদেরকে (স্বীয় স্বামী নির্বাচন করে) বিয়ে করাতে বাধা প্রদান করো না’ (বাক্বারাহ ২৩২) ।

হাদীছে এরশাদ হয়েছে,

ﻋِﻦْ ﺃَﺑِﻲْ ﻫُﺮَﻳْﺮَﺓَ ﻗَﺎﻝَ ﻗَﺎﻝََ ﺭَﺳُﻮْﻝُ ﺍﻟﻠﻪِ ﺻَﻠَّﻰ ﺍﻟﻠﻪُ ﻋَﻠَﻴْﻪِ ﻭَﺳَﻠَّﻢَ ﻻَ ﺗُﻨْﻜَﺢُ ﺍﻟْﺄَﻳِّﻢُ ﺣَﺘَّﻰ ﺗُﺴْﺘَﺄْﻣَﺮَ ﻭَﻻَ ﺗُﻨْﻜَﺢُ ﺍﻟْﺒِﻜْﺮُ ﺣَﺘَّﻰ ﺗُﺴْﺘَﺄْﺫَﻥُ ﻗَﺎﻟُﻮْﺍ ﻳَﺎ ﺭَﺳُﻮْﻝَ ﺍﻟﻠﻪِ ﻭَﻛَﻴْﻒَ ﺇِﺫْﻧُﻬَﺎ ﻗَﺎﻝَ ﺃَﻥْ ﺗَﺴْﻜُﺖَ –

আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘স্বামীহীনা নারীর বিবাহ তার অনুমতি ব্যতীত দেওয়া যাবে না। কুমারীর বিবাহ তার সম্মতি ব্যতীত দেওয়া চলবে না। তারা (উপস্থিত ছাহাবায়ে কেরাম) জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! কুমারীর সম্মতি কিরূপে (নেওয়া যাবে)? উত্তরে তিনি বললেন, তার নীরবতাই সম্মতি’।

(গ) স্ত্রী হিসাবে নারীকে অধিকার ও মর্যাদা দান :

ইসলাম পারিবারিক জীবনে নারীকে দিয়েছে তার ন্যায্য অধিকার। সংসার জীবনে নারী-পুরুষ পরস্পরের পরিপূরক। কোন একজনের একক প্রচেষ্টায় সংসার জীবন পূর্ণতা লাভ করতে পারে না। মহান আল্লাহ এরশাদ করেন,

ﻫُﻦَّ ﻟِﺒَﺎﺱٌ ﻟَّﻜُﻢْ ﻭَﺃَﻧْﺘُﻢْ ﻟِﺒَﺎﺱٌ ﻟَّﻬُﻦَّ ‘তারা তোমাদের পোশাক এবং তোমরা তাদের পোশাক’ (বাক্বারাহ ১৮৭) ।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে সেই উত্তম চরিত্রের অধিকারী, যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম। আর আমি তোমাদের মধ্যে নিজ স্ত্রীদের কাছে উত্তম’।

শুধু তাই নয় নবী করীম (ছাঃ) তাঁর বৈবাহিক জীবনে বাস্তব দৃষ্টান্ত পেশ করে পুরুষদের শিক্ষা দিয়েছেন যে, স্ত্রীর সম্মান ও অধিকার কিভাবে প্রদান করতে হবে। আর স্ত্রীদের প্রতি সদাচরণ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ﻭَّﻦُﻫْﻭُﺮِﺷﺎَﻋَ ﺑِﺎﻟْﻤَﻌْﺮُﻭْﻑِ ‘তোমরা তাদের সাথে সদ্ভাবে জীবন-যাপন করো’ (নিসা ১৯) ।

(ঘ) মোহর দানের মাধ্যমে নারীর অধিকার ও মর্যাদা :

ইসলাম নারীর মর্যাদার স্বীকৃতি স্বরূপ বিবাহের ক্ষেত্রে মোহর প্রদান অপরিহার্য করে দিয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ﻭَﺁﺗُﻮﺍ ﺍﻟﻨِّﺴَﺎﺀَ ﺻَﺪُﻗَﺎﺗِﻬِﻦَّ ﻧِﺤْﻠَﺔً ‘তোমরা তোমাদের স্ত্রীদেরকে মোহর দিয়ে দাও সন্তুষ্টির সাথে’ (নিসা ৪) । রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘যে শর্তটি পূরণ করা সবচেয়ে যরূরী তাহ’ল ঐ শর্ত- যা দ্বারা তোমরা (স্ত্রীর) লজ্জাস্থান হালাল করো’। অর্থাৎ ‘মোহর’।

(ঙ) সহবাসের ক্ষেত্রে নারীকে অধিকার ও মর্যাদা দান :

সহবাসের ক্ষেত্রে নারীর শারীরিক কষ্টের বিষয়টি খেয়াল রেখে ঋতুস্রাব অবস্থায় স্ত্রীর সাথে মেলামেশা ইসলাম নিষিদ্ধ করেছে। আল্লাহ বলেন,

ﻭَﻳَﺴْﺄَﻟُﻮْﻧَﻚَ ﻋَﻦِ ﺍﻟْﻤَﺤِﻴْﺾِ ﻗُﻞْ ﻫُﻮَ ﺃَﺫًﻯ ﻓَﺎﻋْﺘَﺰِﻟُﻮﺍْ ﺍﻟﻨِّﺴَﺎﺀَ ﻓِﻲ ﺍﻟْﻤَﺤِﻴْﺾِ ﻭَﻻَ ﺗَﻘْﺮَﺑُﻮْﻫُﻦَّ ﺣَﺘَّﻰَ ﻳَﻄْﻬُﺮْﻥَ ﻓَﺈِﺫَﺍ ﺗَﻄَﻬَّﺮْﻥَ ﻓَﺄْﺗُﻮْﻫُﻦَّ ﻣِﻦْ ﺣَﻴْﺚُ ﺃَﻣَﺮَﻛُﻢُ ﺍﻟﻠﻪُ ﺇِﻥَّ ﺍﻟﻠﻪَ ﻳُﺤِﺐُّ ﺍﻟﺘَّﻮَّﺍﺑِﻴْﻦَ ﻭَﻳُﺤِﺐُّ ﺍﻟْﻤُﺘَﻄَﻬِّﺮِﻳْﻦَ –

‘হে রাসূল (ছাঃ)! লোকেরা আপনার নিকট মহিলাদের স্রাব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। আপনি বলে দিন, এটা অশুচি জনিত কষ্টদায়ক বিষয়। অতএব তোমরা ঋতুস্রাব চলাকালীন মহিলাদের সাথে সহবাস থেকে বিরত থাক। তারা পবিত্র হওয়া পর্যন্ত তোমরা তাদের নিকটে যেও না। যখন তারা (সম্পূর্ণরূপে) পবিত্র হবে তখন তোমরা তাদের কাছে যাও, যেভাবে আল্লাহ তা‘আলা তোমাদেরকে হুকুম করেছেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবাকারী ও পবিত্রতা অর্জনকারীকে ভালবাসেন’ (বাক্বারাহ ২২২) ।

পায়ুপথে সহবাস করা হারাম। তবে পুরুষরা স্ত্রীদের যৌনাঙ্গে যেদিক থেকে ইচ্ছা সহবাস করতে পারে। আল্লাহ এ প্রসঙ্গে বলেন, ﻧِﺴَﺂﺅُﻛُﻢْ ﺣَﺮْﺙٌ ﻟَّﻜُﻢْ ﻓَﺄْﺗُﻮْﺍ ﺣَﺮْﺛَﻜُﻢْ ﺃَﻧَّﻰ ﺷِﺌْﺘُﻢْ

‘তোমাদের স্ত্রীরা তোমাদের জন্য শস্যক্ষেত্র স্বরূপ। অতএব তোমাদের যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে শস্যক্ষেত্রে গমন কর’ (বাক্বারাহ ২২৩) ।

হাদীছে এসেছে,

ﻋَﻦْ ﺟَﺎﺑِﺮِ ﺑْﻦِ ﻋَﺒْﺪِ ﺍﻟﻠﻪِ ﻗَﺎﻝَ ﻛَﺎﻧَﺖِ ﺍﻟْﻴَﻬُﻮْﺩُ ﺗَﻘُﻮْﻝُ ﺇِﺫَﺍ ﺃَﺗَﻰ ﺍﻟﺮَّﺟُﻞُ ﺍﻣْﺮَﺃَﺗَﻪُ ﻣِﻦْ ﺩُﺑُﺮِﻫَﺎ ﻓِﻲْ ﻗُﺒُﻠِﻬَﺎ ﻛَﺎﻥَ ﺍﻟْﻮَﻟَﺪُ ﺃَﺣْﻮَﻝَ ﻓَﻨَﺰَﻟَﺖْ ﻧِﺴَﺎﺅُﻛُﻢْ ﺣَﺮْﺙٌ ﻟَﻜُﻢْ ﻓَﺄْﺗُﻮْﺍ ﺣَﺮْﺛَﻜُﻢْ ﺃَﻧَّﻰ ﺷِﺌْﺘُﻢْ –

জাবির (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, ইহুদীরা বলত, পুরুষ যদি পশ্চাৎদিক হ’তে স্ত্রীর যৌনাঙ্গে সঙ্গম করে তাহ’লে সন্তান ট্যারা হয়। (তাদের এ ভ্রান্ত ধারণা নিরসনের উদ্দেশ্যে) কুরআন মাজীদের এ আয়াত ﻧِﺴَﺂﺅُﻛُﻢْ ﺣَﺮْﺙٌ ﻟَّﻜُﻢْ ﻓَﺄْﺗُﻮﺍْ ﺣَﺮْﺛَﻜُﻢْ ﺃَﻧَّﻰ ﺷِﺌْﺘُﻢْ ‘তোমাদের স্ত্রীগণ তোমাদের শস্যক্ষেত্র। অতএব তোমরা তোমদের শস্যক্ষেত্রে যেভাবে ইচ্ছা গমন করতে পার’ (বাক্বারাহ ২২৩) ’।

পরবর্তী অংশ পড়ুন: নারীর অধিকার ও মর্যাদায় ইসলাম – ২

– জেসমিন বিনতে জামীল

____________________

১ . আব্দুল খালেক, নারী (ঢাকা : দীনী পাবলিকেশন্স, দ্বিতীয় প্রকাশ : ১৯৯৯), পৃঃ ৪।
২ . সাইয়্যেদ জালালুদ্দীন আনসারী ওমরী, ইসলামী রাষ্ট্রে নারীর অধিকার, অনুবাদ : মাওলানা কারামত আলী নিজামী (ঢাকা : সালাউদ্দিন বইঘর, প্রথম প্রকাশ : ১৯৯৮ ইং), পৃঃ ২২।
৩. Nazhat Afza and khurshid Ahmad, The position of womanin Islam, Kuwait Islamic Book publishers, 1982), p. 9-10.
৪ . সাপ্তাহিক আরাফাত, নভেম্বর ১৯৯৯ ইং, পৃঃ ৩৫।
৫. নারী, পৃঃ ৯।
৬ . ঐ, পৃঃ ৫।
৭ . ঐ, পৃঃ ২।
৮. ইসলামী রাষ্ট্রে নারীর অধিকার, পৃঃ ১৩।
৯ . বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত হা/৩১২৬।
১০ . তিরমিযী, মিশকাত হা/৩২৫২, সনদ ছহীহ।
১১. বুখারী ও মুসলিম, বুলূগুল মারাম, হা/৯৮৯।
১২ . ১২. বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত হা/৩১৮৩; ইবনু মাজাহ হা/১৫৬২।

মন্তব্য করুন

আরও দেখুন
Close
Back to top button