পরিবার ও দাম্পত্য

সন্তান আল্লাহ প্রদত্ত আমানত

সন্তান-সন্ততি আল্লাহ তাআলার দেয়া উপহার। তারা পৃথিবীর ক্ষণস্থায়ী জীবনের সৌন্দর্য। আল্লাহ তাআলা বলেন:

“সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি পার্থিব জীবনের শোভা। আর স্থায়ী সৎকাজ তোমার রবের নিকট প্রতিদানে শ্রেয় এবং প্রত্যাশাতেও উত্তম।” (সূরা আল কাহফ, ১৮ : ৪৬)

সন্তান মা-বাবার জীবনে অবর্ণনীয় সুখ বয়ে আনে। সন্তান যদি নেককার হয়, তবে সে হয় তার বাবা-মায়ের চক্ষু শীতলকারী। আল্লাহ তাআলা রহমানের নৈকট্যশীল বান্দাদের দোয়া হিসেবে আল কুরআনে উল্লেখ করেছেন যে তারা বলে:

“…হে আমাদের রব, আপনি আমাদেরকে এমন স্ত্রী ও সন্তানাদি দান করুন যারা আমাদের চোখ জুড়াবে। আর আপনি আমাদেরকে মুত্তাকীদের নেতা বানিয়ে দিন।” (সূরা আল ফুরকান, ২৫ : ৭৪)

এই সন্তান-সন্ততি যেমন নেয়ামত, তেমনি তারা পিতা-মাতার নিকট আমানতও বটে। সন্তানকে ইসলামের ওপর বড় করার গুরুদায়িত্ব বাবা-মায়ের ওপর অর্পিত। মা-বাবা তাদের সন্তানদেরকে আল্লাহর পথে বড় করলে এর ব্যাপক সুফল তারা নিজেরাই লাভ করবেন। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:

“যখন মানুষ মৃত্যুবরণ করে, তার আমল তার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে; কেবল তিনটি বিষয় ছাড়া –

অবিরত সাদকা, উপকারী জ্ঞান অথবা সৎকর্মশীল সন্তান যে তার জন্য দোয়া করে।” মুসলিম(১৬৩১)

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:

“জান্নাতে একজন ব্যক্তির স্তর উন্নীত করা হলে সে প্রশ্ন করবে এই মর্যাদা কিভাবে অর্জিত হল? বলা হবে: তোমার সন্তান তোমার জন্য ইসতিগফার করার কারণে।” ইবনে মাজাহ (৩৬৬০)

এর বিপরীতে এই সন্তান বিপথে গেলে মা-বাবার জীবনে যে দু:খ বয়ে আনে – সেটাও অবর্ণনীয়। একজন সন্তান যখন নৈতিক অধ:পতনের শিকার হয়, তার জন্য একটি পরিবার ভেঙ্গে পড়ে। তার মা-বাবা তাকে সুপথে ফেরানোর জন্য জীবনের সব সঞ্চয়, সবটুকু সময়, সবটুকু প্রচেষ্টা দিয়ে দিতে প্রস্তুত থাকেন। মাতৃভূমি ছেড়ে অন্য কোথাও গিয়ে বসবাস করতেও পিছপা হন না। নিজেদের জীবনকে নি:শেষ করে দিয়ে হলেও তাদের একটাই চাওয়া – আমার সন্তান ভাল মানুষ হোক।

যেদিন এই সন্তান একজন অচেনা মানুষ হয়ে যায় – সেদিন মা-বাবা ঘুম থেকে জেগে ওঠেন। তারা যেন এক অলীক সুখ-স্বপ্নে বিভোর ছিলেন! এই স্বপ্নে তারা সন্তানকে পড়িয়েছেন দেশের শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠানে, সন্তানকে নাচ-গান-ছবি আঁকা সবই শেখানো হয়েছে, এমনকি বাসায় মৌলবী রেখে কুরআন খতমও দেয়ানো হয়েছে। নামাযশিক্ষা দেয়া হয়েছে। পাঁচওয়াক্ত নামায না হোক – প্রতি জুমাতে তাকে মসজিদে পাঠানো হয়েছে! কিন্তু ঘুম থেকে জেগে উঠে তারা একদিন আবিষ্কার করেন – তার সন্তান পরিণত হয়েছে এক বিষক্ষতে!

“প্রত্যেক নবজাতক ফিতরাতের ওপর [অর্থাৎ সত্যের প্রতি জন্মগত ঝোঁক নিয়ে] জন্মগ্রহণ করে, অতঃপর তার বাবা-মা তাকে ইহুদী, খ্রীস্টান কিংবা মাজূসী বানায়।” বুখারী(১৩৫৮), মুসলিম(২৬৫৮)

আজ যদি সন্তানদেরকে ইসলাম, ঈমান, কুরআন-সুন্নাহর শিক্ষা দেয়া না হয়, আল্লাহর প্রতি ভালবাসা এবং ভয়ের অনুভূতি তার অন্তরে প্রোথিত করা না হয়, আখিরাতের বাস্তবতা তাঁর সামনে তুলে ধরা না হয়, তবে একদিন তাদের জন্য মা-বাবাকে কাঁদতে হবে, আপসোস করতে হবে। জীবনের সবকিছু দিয়েও হয়ত সেদিন আর তাদেরকে ফেরানো যাবে না।

সন্তান স্কুলে ধর্মেনিরপেক্ষতা শিখেছে, ছেলেমেয়ে একসাথে বন্ধু হিসেবে অন্তরঙ্গ হতে শিখেছে। কলেজে বন্ধুদের কাছে মদ-জুয়া-মাদক সেবন শিখেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে নাস্তিকতা শিখেছে। বিয়ে বহির্ভুত সম্পর্কে জড়িয়েছে। কর্মজীবনে দুর্নীতি করেছে, কিংবা সৎ থেকে বহু সম্পদ উপার্জন করেছে – যেটাই হোক – কেননা অবিশ্বাস সবচেয়ে বড় নৈতিক অধ:পতন – যা তাকে জাহান্নামে স্থায়ী করবে। এ সবকিছুর জন্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে যারা দায়ী, তারা হলেন মা-বাবা।

মা-বাবা যদি সন্তানকে ইসলামের ওপর গঠন না করেন; তাকে নামায, পর্দার শিক্ষা না দেন; তাকে আল্লাহ-দ্রোহী করে বড় করেন; তাকে নাচ-গান শেখান; বেপর্দা হতে শেখান; তার হাতে অশ্লীলতার উপকরণ তুলে দেন; ইন্টারনেট, টেলিভিশনের মাধ্যমে তাকে অনৈতিক ও মন্দ বিষয় দেখার সুযোগ করে দেন; তবে এই মা-বাবার জন্য অপেক্ষা করছে দুনিয়া ও আখিরাতের দুর্ভোগ ও কঠিন পরিণতি। কেননা তারা তাদের সন্তানদের ব্যাপারে দায়িত্বশীল। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:

“…আর ব্যক্তি তার ঘরের লোকেদের ওপর রক্ষণাবেক্ষণকারী এবং সে তাদের ব্যাপারে দায়িত্বশীল। এবং নারী তার স্বামীর ঘর এবং তার সন্তানের রক্ষণাবেক্ষণকারী এবং সে তাদের ব্যাপারে দায়িত্বশীল।…” বুখারী(৮৯৩), মুসলিম(১৮২৯)

এ কথা বোঝা সহজ যে আল্লাহদ্রোহী সন্তান সবার আগে তার বাবা-মাকেই কষ্ট দেবে। সে আল্লাহকে ভয় না করার কারণে ইসলামে পিতা-মাতার মর্যাদা সম্পর্কে সচেতন নয়, ফলে যেদিন সে সবল ও স্বাবলম্বী হবে, সেদিন তাদের প্রতি সদাচরণ করার তাগিদ অনুভব করবে না। এভাবেই সন্তানকে ইসলামের ওপর বড় করার গুরুদায়িত্বে অবহেলার প্রথম তিক্ততা স্বয়ং মা-বাবাকেই আস্বাদন করতে হয়:

“আর যে ব্যক্তি তার মাতা-পিতাকে বলে,

তোমাদের জন্য আফসোস! তোমরা কি আমাকে এই প্রতিশ্রুতি দাও যে, আমি পুনরুত্থিত হব অথচ আমার পূর্বে অনেক প্রজন্ম গত হয়ে গেছে? আর তারা দুজন আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করে বলে, দুর্ভোগ তোমার জন্য! তুমি ঈমান আন। নিশ্চয় আল্লাহর ওয়াদা সত্য। তখন সে বলে, এটা কেবল অতীতকালের কল্পকাহিনী ছাড়া আর কিছু নয়।” (সূরা আল আহকাফ, ৪৬ : ১৭)

তেমনি আখিরাতে এই সন্তান যখন জাহান্নামের পথে পা বাড়াবে, তখন সে কি তার পিতা-মাতার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনবে না যে তারা তাকে দ্বীন শিক্ষা দেননি? তারা তাকে নাচ-গান শিখিয়েছেন? তারা তাকে এমন স্কুল-কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন যেখানে নাস্তিকরা তাদেরকে নাস্তিক হতে শিখিয়েছে? এমন দেশে পড়তে পাঠিয়েছেন যেখানে অন্যায়-অশ্লীল কাজ করা সহজ, যেখানে একজন মানুষের দ্বীন ও আকীদা সংরক্ষণ করা সম্ভব নয়? আখিরাতে এই মা-বাবার পরিণতি কী হবে আল্লাহই ভাল জানেন! তারা যে জাহান্নামে সন্তানের সমপরিমাণ বা অধিক শাস্তি পাবেন না তার কী নিশ্চয়তা আছে?

একজন মা কিংবা বাবার পক্ষে যদি সন্তানের দেহের কোথাও ক্ষুদ্রতম অগ্নিস্ফুলিংগের স্পর্শ সহ্য করাও সম্ভব না হয়, তবে কিভাবে তিনি নিজ হাতে সাজিয়ে তার ছেলে কিংবা মেয়েটিকে জাহান্নামের গাড়িতে তুলে দিচ্ছেন! তিনি তার সন্তানের ক্যারিয়ার নিয়ে বিচলিত, কিন্তু সে যে জাহান্নামের আগুনে অনন্তকাল প্রজ্জ্বলিত হবে কিংবা বহুকাল শাস্তি পাবে – তাতে তাঁর মাথাব্যাথা নেই!

সন্তানকে শয়তানের পথে তুলে দিয়ে, তাকে আল্লাহ সম্পর্কে, কুরআন-হাদীস, ঈমান-ইসলাম, জান্নাত-জাহান্নাম সম্পর্কে কোন জ্ঞান না দিয়ে কিংবা অসম্পূর্ণ জ্ঞান দিয়েও অনেক মা-বাবা আশা করেন – একদিন কোন না কোন অলৌকিক উপায় সে আল্লাহর রাস্তায় চলে আসবে! বয়সকালে তওবা করে নিয়ে, হজ্জ্ব করে নিয়ে নামায ধরবে – সেই ‘সামাজিক নামায’ যে নামায মানুষের মধ্যে কোন পরিবর্তন আনে না অথচ আল্লাহ তাআলা বলেন:

“নিশ্চয়ই সালাত গুরুতর অপরাধ ও সকল অন্যায় থেকে বিরত করে…।” (সূরা আনকাবুত, ২৯ : ৪৫)

সঠিক প্রতিপালন ছাড়াই মা-বাবার শেখানো কিছু প্রচলিত নীতিবাক্যের প্রভাবে একদিন সন্তান ঠিকই বদলে যাবে – এই আশা নেহায়েত অলীক স্বপ্ন!

মা কিংবা বাবা হয়ে সন্তানকে জাহান্নামের আগুনে ঠেলে ফেলে দেয়ার চেয়ে বড় নিষ্ঠুরতা কী হতে পারে?

আল্লাহ তাআলা আল-কুরআন নাযিলের প্রথম পর্যায়ে যে আয়াতগুলো নাযিল করেছেন, তাতে সে যুগে বিদ্যমান এক অমানবিক এবং ভয়াবহ অপকর্মের উল্লেখ পাওয়া যায় – সন্তানকে জীবন্ত কবর দেয়া! নৈতিক অধ:পতনের চরম সীমানায় পৌঁছানো কঠিন হৃদয়ের মানুষগুলো এ কাজ করত। এরপর আল-কুরআনের মর্মস্পর্শী বাণী তাদেরকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়ে গড়ল সোনার মানুষ।

মানুষ ভাবে আজ তারা সভ্য। সন্তানদেরকে জীবন্ত কবর দেয়ার কোন চল কোথাও নেই। অনেকেই উপলব্ধি করেন না যে যখন কেউ সন্তানকে আল্লাহর পথে না নিয়ে শয়তানের পথে ঠেলে দেয় – তাকে হত্যা করার চেয়েও জঘন্য এক কাজ সে করে। যদি তাকে হত্যা করা হত, তবে সে শুধুই দুনিয়া হারাতো। কিন্তু যদি তাকে জাহান্নামী করা হয়, তবে তাকে অনন্ত যন্ত্রনায় প্রবেশ করানো হয়, যেখানে সে বারবার মৃত্যুকামনা করেও মরবে না!

আজ সমাজের সমস্ত অন্যায়, রাহাজানি, যুলুম-নির্যাতনের জন্য যদি অপরাধী ব্যতীত অন্য কাউকে শাস্তি দেয়া বৈধ হয়, তবে তারা হলেন সেই মা-বাবারা যারা এই সন্তানকে পৃথিবীতে নিয়ে এসে এরপর তাদের প্রতি অর্পিত দায়িত্ব পালন না করে সমাজকে এক দানব উপহার দিয়েছেন – সন্তানকে ধ্বংস করেছেন, সমাজকে ধ্বংস করেছেন, ধ্বংস হয়েছেন নিজেরা।

যাদের সন্তান এখনও ধ্বংসের পথে চলে যায় নি, তাদের উচিৎ আল্লাহ তাআলার শুকরিয়া আদায় করা এবং এই মুহূর্ত থেকে সন্তানকে সুপথ প্রদর্শন করার কাজটিকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য হিসেবে নির্বাচন করা। আপসোস ও মর্মবেদনার অনন্ত আগুনে পোড়ার ঝুঁকি থেকে বাঁচতে চাইলে সতর্ক হওয়ার এখনই সময়।

কেউ সন্তানকে সম্পদশালী করে যেতে না পারলেও যদি তাকে অন্তত: দ্বীনের মৌলিক পাঠ দিয়ে যেতে পারেন যা তাকে জাহান্নাম থেকে বাঁচাবে, জান্নাতে সুখী করবে, তাহলেও সন্তানের প্রতি তিনি অনেক বড় ইহসান করলেন, সবচেয়ে বড় দায়িত্বটি পালন করলেন।

সন্তান যেন সবকিছুর বিনিময়ে হলেও সর্বাগ্রে একজন ভাল মুসলিম হয়, আল্লাহ তাআলার কাছে প্রিয় একজন মানুষ হয়, আর আমাদের আখিরাতের পাথেয় হয়! সকলের উচিৎ সন্তানদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করা। আল্লাহ তাআলা সন্তানদের ব্যাপারে উপদেশ দিয়ে বলেন:

“আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের সন্তানদের সম্পর্কে ওসীয়ত করছেন…” (সূরা আন নিসা, ৪ : ১১)

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:

“নিশ্চয়ই তোমার সন্তানের তোমার ওপর হক রয়েছে।” মুসলিম(১১৫৯)

আল্লাহ তাআলা অনবদ্য বাণী স্মরণ করে আলোচনার ইতি টানছি:

“হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদেরকে ও তোমাদের পরিবার-পরিজনকে আগুন হতে বাঁচাও যার জ্বালানি হবে মানুষ ও পাথর; যার তত্ত্বাবধানে রয়েছে নির্মম ও কঠোর ফেরেশতাকূল, যারা আল্লাহ তাদেরকে যে নির্দেশ দিয়েছেন সে ব্যাপারে অবাধ্য হয় না। আর তারা তা-ই করে যা তাদেরকে আদেশ করা হয়।” (সূরা আত তাহরীম, ৬৬ : ৬)

– মুহাম্মাদ নাসীল শাহরুখ

মন্তব্য করুন

Back to top button