মানবাধিকার ও ইসলাম : চলাফেরা ও বসবাসের অধিকার

Article-13 : 1. Everyone has the right to freedom of movement and residance within the borders each state. ‘প্রত্যেকেরই স্বীয় রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে যেকোন স্থানে অবাধে চলাফেরা এবং বসবাস করার অধিকার রয়েছে’।
অর্থাৎ জাতিসংঘ মানবাধিকার সনদের এই ধারার (১) এ বলা হয়েছে যে, পৃথিবীর প্রত্যেক রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের নিজ দেশে স্বাধীনভাবে চলাচল এবং বসবাস করার অধিকার রয়েছে। সে যে ধর্ম-মতের লোক হোক না কেন। এক্ষেত্রে কেউ কারো উপরে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।
2. Everyone has the right to leave any country including his own and to return to his country.[1] ‘প্রত্যেকেরই অধিকার রয়েছে স্বেচ্ছায় নিজ দেশ ত্যাগ করার এবং নিজের দেশে ফিরে আসার’।
অর্থাৎ জাতিসংঘ সনদের এই ধারার (২) এ উল্লেখ করা হয়েছে যে, রাষ্ট্রের মধ্যে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার রয়েছে, যেকোন বৈধ প্রয়োজনে নিজ দেশ ত্যাগ করতে পারবে এবং পুনরায় ফিরে আসতে পারবে। এতে কেউ বাধা দিতে পারবে না। যদিও বর্তমান যুগে মানুষের সে অধিকার নেই। যেমন মুসলমানদের অপরিহার্য ইবাদত পবিত্র হজ্জ-ওমরা পালনেও বাধা আসছে। সব ঠিক থাকা সত্ত্বেও অনেক সময় বিমানবন্দর থেকে ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে। দেশ ভ্রমণে যেতেও বাধা রয়েছে। অথচ অন্য ধর্মের অনুসারীদের কোন বাধা নেই। তবে প্রকৃত অপরাধীদের কথা ভিন্ন। দেশ-বিদেশে কখনও কখনও এ ধারাকে মানুষ নিজ স্বার্থে অথবা রাজনৈতিক স্বার্থে কাজে লাগাচ্ছে। এ ধারার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে কিছুটা আলোচনা প্রয়োজন রয়েছে।
ইসলামের আলোকে বিশ্লেষণ :
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদের ১৩ (১) ধারায় মানুষের নিজ রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে যে স্বাধীনভাবে চলাচল ও বসবাসের স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে, ইসলাম অনেক পূর্বেই তা বলে দিয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ রাষ্ট্রের মধ্যে স্বাধীনভাবে চলাচল এবং বসবাস করার অধিকার রাখে। ধর্ম-বর্ণ, গোত্র ভেদে এর কোন পার্থক্য নেই। যেমন- আল্লাহ পাক বলেন, هُوَ الَّذِيْ جَعَلَ لَكُمُ الْأَرْضَ ذَلُوْلاً فَامْشُوْا فِي مَنَاكِبِهَا وَكُلُوْا مِن رِّزْقِهِ وَإِلَيْهِ النُّشُوْرُ ‘তিনিই সেই সত্তা, যিনি পৃথিবীকে তোমাদের জন্য সুগম করেছেন। কাজেই তোমরা তাঁর দিকে যাতায়াত কর এবং তাঁর দেয়া জীবিকা আহরণ কর’ (মুলক ৬৭/১৫)।
মহান আল্লাহ আরও বলেন, قُلْ سِيْرُوْا فِي الأَرْضِ ثُمَّ انْظُرُواْ كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الْمُكَذِّبِيْنَ ‘তুমি বল, তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ কর, তারপর দেখ, মিথ্যাবাদীদের কেমন পরিণত হয়েছে’ (আন‘আম ৫/১১)। তিনি আরো নির্দেশ করেছেন, أَلَمْ تَكُنْ أَرْضُ اللهِ وَاسِعَةً فَتُهَاجِرُواْ فِيْهَا ‘আল্লাহর পৃথিবী কি প্রশস্ত ছিল না, যেথায় তোমরা হিজরত করতে’ (নিসা ৪/৯৭)।
এ বিষয়ে তিনি আরো বলেন, وَمَنْ يُهَاجِرْ فِي سَبِيْلِ اللهِ يَجِدْ فِي الأَرْضِ مُرَاغَماً كَثِيْراً وَسَعَةً وَمَنْ يَخْرُجْ مِن بَيْتِهِ مُهَاجِراً إِلَى اللهِ وَرَسُولِهِ ثُمَّ يُدْرِكْهُ الْمَوْتُ فَقَدْ وَقَعَ أَجْرُهُ عَلى اللهِ وَكَانَ اللهُ غَفُوْراً رَّحِيْماً ‘আর যে কেউ আল্লাহর পথে দেশ ত্যাগ করবে, সে পৃথিবীতে বহু প্রশস্ত স্থান ও স্বচ্ছলতা প্রাপ্ত হবে এবং যে কেউ গৃহ থেকে বহির্গত হয়ে আল্লাহ ও রাসূলের উদ্দেশ্যে দেশ ত্যাগ করে, তৎপর সে মৃত্যুমুখে পতিত হয়, তবে নিশ্চয়ই এর প্রতিদান আল্লাহর ওপর ন্যস্ত রয়েছে এবং আল্লাহ ক্ষমাশীল, করুণাময়’ (নিসা ৪/১০০)।
পবিত্র কুরআনে আরও বলা হয়েছে, وَاللهُ جَعَلَ لَكُم مِّن بُيُوْتِكُمْ سَكَناً وَجَعَلَ لَكُم مِّنْ جُلُوْدِ الأَنْعَامِ بُيُوتاً تَسْتَخِفُّونَهَا يَوْمَ ظَعْنِكُمْ وَيَوْمَ إِقَامَتِكُمْ ‘আর আল্লাহ তোমাদের গৃহকে করেন তোমাদের আবাসস্থল এবং তিনি তোমাদের জন্যে পশু-চর্মের তাঁবুর ব্যবস্থা করেন, তোমরা তা সহজ মনে কর ভ্রমণকালে এবং অবস্থানকালে’ (নাহল ১৬/৮০)।
অত্র আয়াতগুলো থেকে বুঝা যায়, মানুষ তার সৃষ্টিকর্তার যমীনে প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে শুধু নিজ দেশে নয়; সকল দেশে সে অবাধে চলাফেরা ও বসবাস করতে পারবে। অথচ বর্তমানে মানুষকে অন্যায়ভাবে নিজ বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে, যা ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এমর্মে আল্লাহ বলেন,ثُمَّ أَنتُمْ هَـؤُلاء تَقْتُلُوْنَ أَنفُسَكُمْ وَتُخْرِجُوْنَ فَرِيْقاً مِّنكُم مِّن دِيَارِهِمْ تَظَاهَرُوْنَ عَلَيْهِم بِالإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ وَإِن يَأتُوكُمْ أُسَارَى تُفَادُوْهُمْ وَهُوَ مُحَرَّمٌ عَلَيْكُمْ إِخْرَاجُهُمْ ‘তোমরা তোমাদের সমগোত্রীয় কিছু সংখ্যক লোককে তাদের বসতি থেকে উচ্ছেদ করেছ, তাদের বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে পরস্পরের পৃষ্ঠপোষকতা করেছ এবং তারা যখন যুদ্ধবন্দী রূপে তোমাদের সামনে উপস্থিত হয় তখন তোমরা তাদের থেকে মুক্তিপণ আদায় কর, অথচ তাদের বসতি থেকে বহিষ্কৃত করাই তোমাদের জন্য হারাম ছিল’ (বাক্বারাহ ২/৮৫)।
তবে কখনও কোন মানুষ বা মানবগোষ্ঠী সাধারণ অন্যের উপর অন্যায়-অত্যাচার, যুলুম-নিপীড়ন বা কোন ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ডের মাধ্যমে ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি করলে ইসলাম সে ক্ষেত্রে তাদের স্থান ও দেশ ত্যাগে বাধ্য করার নির্দেশ দিয়েছে। যেমন পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, إِنَّمَا جَزَاء الَّذِيْنَ يُحَارِبُوْنَ اللهَ وَرَسُوْلَهُ وَيَسْعَوْنَ فِي الأَرْضِ فَسَاداً أَن يُقَتَّلُواْ أَوْ يُصَلَّبُواْ أَوْ تُقَطَّعَ أَيْدِيْهِمْ وَأَرْجُلُهُم مِّنْ خِلافٍ أَوْ يُنفَوْا مِنَ الأَرْضِ ذَلِكَ لَهُمْ خِزْيٌ فِي الدُّنْيَا وَلَهُمْ فِي الآخِرَةِ عَذَابٌ عَظِيْمٌ ‘যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং জনপদে বিশৃংখলা সৃষ্টি করে, তাদের শাস্তি এটাই যে, তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা শূলীতে চড়ানো হবে অথবা তাদের হাত-পা বিপরীত দিক থেকে কেটে দেওয়া হবে অথবা দেশ থেকে বহিষ্কার করা হবে। এটা তাদের জন্য দুনিয়াবী লাঞ্ছনা। আর আখেরাতে তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি।’ (মায়েদাহ ৫/৩৩)।
উপরোক্ত আয়াতগুলো থেকে বুঝা যায়, রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিকের আভ্যন্তরীণ এবং বহির্দেশে স্বাধীনভাবে বসবাস ও চলাচলের স্বাধীনতা রয়েছে। তবে অত্যাচারী ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে কিছু ব্যতিক্রম রয়েছে। এ সম্পর্কে হাদীছে এসেছে, সাহল ইবনু আনাস আল-জুহানী (রাঃ) তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন তিনি বলেন, غَزَوْتُ مَعَ نَبِىِّ اللهِ صلى الله عليه وسلم غَزْوَةَ كَذَا وَكَذَا فَضَيَّقَ النَّاسُ الْمَنَازِلَ وَقَطَعُوا الطَّرِيقَ فَبَعَثَ نَبِىُّ اللهِ صلى الله عليه وسلم مُنَادِيًا يُنَادِى فِى النَّاسِ أَنَّ مَنْ ضَيَّقَ مَنْزِلاً أَوْ قَطَعَ طَرِيقًا فَلاَ جِهَادَ لَهُ ‘আমি নবী করীম (ছাঃ)-এর সঙ্গে অমুক অমুক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি। এতে লোকজন (সৈনিকগণ) বাসস্থান সংকুচিত করে ফেললে এবং চলার পথ বন্ধ করে দিলে নবী করীম (ছাঃ) উক্ত লোকজনের মধ্যে একজন ঘোষক পাঠিয়ে ঘোষণা করে দিলেন, যে ব্যক্তি বাসস্থান সংকুচিত করে ফেলল অথবা চলার পথ বন্ধ করে দিল, তার জিহাদ করার প্রয়োজন নেই’।[2]
মানুষের যাতায়াতের পথে কোনরূপ বাধা-প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা যাবে না। সে যেকোন ধরনের রাস্তা হোক না কেন। অপর এক বর্ণনায় আধুনিক নগর বা বসতিস্থাপনের ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, اتَّقُوا اللَّعَّانَيْنِ، قَالُوْا وَمَا اللَّعَّانَانِ يَا رَسُوْلَ اللهِ قَالَ : الَّذِىْ يَتَخَلَّى فِىْ طَرِيْقِ النَّاسِ أَوْ فِى ظِلِّهِمْ ‘তোমরা দু’টি অভিশাপের ক্ষেত্র হ’তে বেঁচে থাক। তারা জিজ্ঞেস করলেন, উক্ত অভিশাপের ক্ষেত্র দু’টি কি কি ইয়া রাসূলাল্লাহ (ছাঃ)? উত্তরে তিনি বললেন, ‘যে ব্যক্তি মানুষের যাতায়াতের পথে অথবা মানুষের ছায়া গ্রহণের স্থানে পায়খানা-প্রস্রাব করে (এ দু’টি অভিশাপের ক্ষেত্র)’।[3] যাতায়াতের পথ নিষ্কণ্টক করা শুধু মুমিনের কর্তব্যই নয়, বরং এটি ঈমানের অন্যতম শাখাও বটে। এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘ঈমানের সত্তরের অধিক শাখা-প্রশাখা রয়েছে। এগুলোর মধ্যে উৎকৃষ্টতম হচ্ছে আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই বলা এবং নিম্নতম হচ্ছে যাতায়াতের পথ থেকে কষ্টদায়াক বস্ত্ত অপসারণ করা’।[4]
অথচ আমাদের দেশে হরতাল, অবরোধ, ধর্মঘট, জ্বালাও পোড়াও প্রভৃতির মাধ্যমে মানুষের চলাচলের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হচ্ছে তথাকথিত গণতান্ত্রিক এবং অন্যান্য অধিকার রক্ষার নামে। বাংলাদেশ ও অন্যান্য দেশের সংবিধানের আলোকে এগুলো কোন অপরাধ নয় (!) আবার এগুলোর নামই নাকি গণতান্ত্রিক অধিকার। যখন যে সরকার আসে সকলে প্রায় একই পথের অনুসারী। অথচ ইসলামে এগুলোর স্থান তো নেই; বরং এসব কষ্টদায়ক বস্ত্ত অপসারণের প্রতি জোরালোভাবে উৎসাহিত করা হয়েছে। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, لَقَدْ رَأَيْتُ رَجُلاً يَتَقَلَّبُ فِى الْجَنَّةِ فِى شَجَرَةٍ قَطَعَهَا مِنْ ظَهْرِ الطَّرِيقِ كَانَتْ تُؤْذِى النَّاسَ ‘আমি এক ব্যক্তিকে একটি গাছের কারণে জান্নাতে চলাফেরা করতে দেখেছি। অর্থাৎ সে পথের উপর থেকে ঐ গাছটি কেটে ফেলেছিল যা মুসলমানদের কষ্ট দিত’।[5]
বর্তমানে বাংলাদেশে সরকারী-বেসরকারী ও দুর্বল শ্রেণীর মানুষের জায়গা-জমি অবৈধভাবে দখল কিংবা উচ্ছেদের জয়জয়কার চলছে। মিডিয়াতে যাদের নাম দেয়া হয়েছে ভূমিদস্যু। এদের অধিকাংশ হ’ল শিল্পপতি, সমাজনেতা অথবা সরকারী দলের নেতা-কর্মী। অথচ ডিজিটাল দেশের রাজধানী খোদ ঢাকাতেই প্রায় ৪০% লোক উদ্বাস্ত্ত। আর বসবাস ও চলাচলের জন্য ঢাকা এখন বিশ্বের সবচেয়ে নিম্নশ্রেণীর শহর হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছে। এখানে মানুষ যেভাবে বসবাস ও চলাচল করে তা জাতিসংঘ সনদের এ ধারার লংঘন ছাড়া কিছুই নয়। আর সারা দেশের ভূমিহীন মানুষের হার প্রায় ৫০%। এদের বসবাসের জন্য নিজস্ব জায়গা নেই। অথচ অভিজাত শ্রেণী, রাজনীতিবিদ ও মন্ত্রী-এম.পিগণের ঠিকই দেশে-বিদেশে অসংখ্য বিলাস বহুল বাড়ীর খবর পাওয়া যায়। ঢাকার কিছু আবাসিক এরিয়া দেখলে মনেই হয় না যে, বাংলাদেশ একটি দরিদ্র দেশ।
বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র সংখ্যালঘু বিশেষ করে হিন্দু-ইহুদী-খৃষ্টান চক্র মুসলমানদেরকে তাদের বসবাসের স্থান ও পৈত্রিক ভিটাবাড়ী থেকে উচ্ছেদ করছে। অথবা নিজ দেশের ঘরবাড়ি, মসজিদ জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে, মানুষ হত্যা করে তাদেরকে সমূলে উচ্ছেদ করা হচ্ছে এবং উদ্বাস্ত্ত বানানো হচ্ছে। এভাবে তারা নিঃসম্বল হয়ে দেশ ত্যাগ করছে। কোথাও হয়ে যাচ্ছে নিজ ভূমে পরবাসী। অথচ এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কারো জমির কোন অংশ অন্যায় ভাবে দখল করে নেয়, (কিয়ামতের দিন) এর সাত স্তবক (স্তর) যমীন তার গলায় লটকিয়ে দেয়া হবে’।[6] অন্য হাদীছে এসেছে, ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি কারো জমির সামান্য অংশ বিনা অধিকারে দখল করে নেয়, কিয়ামতের দিন সাত স্তবক যমীন পর্যন্ত তাকে ধসিয়ে দেয়া হবে’।[7]
সুতরাং যারা বসবাসের জন্য সামান্যতম জায়গাটুকু পাচ্ছে না অথবা কেউ পেলেও অন্যায়ভাবে যাতায়াতের পথ বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে, তাদের অবস্থা কত দুর্বিসহ হ’তে পারে উপরোক্ত হাদীছদ্বয় থেকে তা বুঝা যায়। পক্ষান্তরে কোন মানুষ যদি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কোন মানুষকে বসবাস ও যাতায়াতের জন্য জায়গা অথবা রাস্তা করে দেয়, তবে আল্লাহ পাক জান্নাতে তার জন্য সে পরিমাণ জায়গা দিবেন। এখানে সুস্পষ্ট বলা যায়, ইসলাম মানুষের স্বাধীনভাবে চলাফেরা কিংবা বসবাসের জন্য কত সুন্দর ব্যবস্থা রেখেছে। কিন্তু এদেশের কর্ণধর ও বিশ্বমোড়লেরা তা বুঝেও যেন না বুঝার ভান করে চলেছে।
পর্যালোচনা :
জাতিসংঘ মানবাধিকার সনদের ১৩ (১) ধারায় প্রত্যেক মানুষকে তার নিজ দেশের অভ্যন্তরে স্বাধীনভাবে চলাফেরা ও বসবাসের অধিকার দেয়া হয়েছে এবং ১৩ (২) ধারায় বলা হয়েছে, যে কোন নাগরিকের নিজ প্রয়োজনে দেশ ত্যাগ এবং পুনরায় ফিরে আসার অধিকার রয়েছে। এই ধারা-উপধারাগুলোর পর্যালোচনা করতে গিয়ে জানা যায়, ইসলাম বহু বছর পূর্বেই মানুষের এ অধিকারগুলো দিয়েছে। জাতিসংঘ সনদের এই লিখিত ধারাগুলো কেবল কাগজে-কলমে রয়েছে। এখানে এ বিধান লংঘনের কারণে ভুক্তভোগীরা কি প্রতিকার পাবে তার স্পষ্ট বক্তব্য নেই। আবার এ ধারার আলোকে কেউ যদি স্বাধীনভাবে চলাচলের ও বসবাসের কথা বলে নগ্নতা, অশ্লীলতার সাথে বেপরোয়া ভাবে চলাচল করে তাহ’লে তা মানবাধিকার লংঘন হবে না। কি চমৎকার আইন?
প্রথমে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যদি দেখি, তাহ’লে দেখা যাবে এই ধারার সঠিক প্রয়োগ নেই। এখন একজন সাধারণ মানুষের পক্ষে স্বাধীনভাবে চলাফেরা ও বসবাস করা অত্যন্ত কঠিন ও দুরূহ হয়ে উঠেছে। তাছাড়া কোন জ্ঞানী-গুণী, ভদ্র ও শান্তিপ্রিয় মানুষের স্বাধীন ও নিরাপত্তার সাথে চলাফেরা ও বসবাসের গ্যারান্টি নেই। কে, কখন চাঁদাবাজ ও সন্ত্রাসীদের কবলে পড়বে একজন নীরিহ পথিককে রীতিমত সে দুঃশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে বাড়ী থেকে বের হ’তে হয়। আবার সড়ক, ট্রেন, নৌ, বিমান প্রভৃতি দুর্ঘটনায় প্রতি বছর যে হারে মানুষ মারা যাচ্ছে তার প্রতিকারে সরকারী কোন প্রকার উদ্যোগ নেই। এজন্য সরকার দায়ী। এসব মানবাধিকারের লংঘন। অপর দিকে চোর-ডাকাত, ছিনতাইকারী, অপহরণকারী আর ইভটিজারদের দৌরাত্ম্য এখন সকলকে শংকিত করে তুলেছে। আবার কখনও সরকারী পোশাকধারী সাদা বাহিনী কর্তৃক নামে-বেনামে ডাকাতি-ছিনতাই, গুম-হত্যা ঘটানো হচ্ছে, যা পত্রিকায় প্রায় প্রতিদিন দেখা যায়। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে অপহরণ করে গুম বা ক্রস ফায়ারে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। গত ২৭ এপ্রিল নরায়ণগঞ্জে এম.পি’র কর্মীগণ এবং আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী র্যাব কর্তৃক দিনে-দুপুরে ৬ কোটি টাকার বিনিময়ে প্যানেল মেয়র নযরুল ইসলাম সহ ৭ জন গুম, অতঃপর হত্যার মর্মান্তিক ঘটনা দেশবাসী ও বিশ্ব বিবেককে হতবাক করেছে। এটাকে শুধু মানবাধিকার লংঘন বললে কি যথেষ্ট হবে?
বর্তমানে দেশের মানুষ চরম নিরাপত্তাহীনতাহীনতায় ভুগছে। এক রিপোর্টে দেখা যায়, জানুয়ারী ২০১২ সালে সারাদেশে ৩৪৩ টি হত্যাকান্ড ঘটেছে। এ হিসাবে প্রতিদিন গড়ে ১১ জন খুন হয়েছে। প্রতিদিন যে দেশে এত পরিমাণ মানুষ নিহত হয় সেখানে সাধারণ মানুষের চলাচল ও বসবাসের নিরাপত্তা কোথায়? শুধু তাই-ই নয়, এখন নেশাখোর-সন্ত্রাসী ছেলে-মেয়েদের হিংস্র ছোবলে পিতা-মাতাও নিজ ঘরে নিরাপদ নয়। নেশাখোররা নিজ ভাই-বোন, পিতা-মাতাকেও হত্যা-নির্যাতন করতে দ্বিধা করছে না। এই তো কিছু দিন পূর্বে নিজ কন্যা ঐশী কর্তৃক পুলিশ কর্মকর্তা দম্পতির নির্মম হত্যাকান্ড বিশ্ববিবেককে নাড়া দিলেও বাংলাদেশের সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের ঘুম ভাঙ্গছে না। আমরা কোথায় পৌঁছেছি? এখন এদেশের প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীর ব্যর্থতার কারণে পিতা-মাতারা সন্ত্রাসী, নেশাখোর ছেলেদেরকে পুলিশের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হচ্ছে। যেমন পুলিশের তালিকায় চৌমহনীর শীর্ষ সন্ত্রাসী জাফর আহমাদ (৩৪)-কে তার বৃদ্ধ পিতা হাজী আব্দুস সুবহান পুলিশের হাতে তুলে দেন। সন্ত্রাসী পুত্রের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে নিজেই বাদী হয়ে বেগমগঞ্জ থানায় মামলা করেন। জানা যায়, গত ২৬ সেপ্টেম্বর চৌমহনীস্থ নোলাবাড়ী থেকে র্যাব তাকে গ্রেফতার করে। সে কয়েকদিন পরে জেল থেকে জামিন পায়।[8] লক্ষ লক্ষ পরিবার যে এ রকম অশান্তির আনলে পুড়ছে তার হিসাব নেই। দেশের শহর-বন্দর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে মাদকতার বিষবাষ্পে আক্রান্ত পরিবারগুলো কত যে অসহায় ও অমানবিক জীবন যাপন করছে কোন ইয়ত্তা নেই। কোথায় মানবাধিকার রক্ষাকারী বাহিনী? ইসলামী ব্যবস্থাপনায় মুহূর্তেই এসব মাদকতা, সন্ত্রাস, দুর্নীতি প্রভৃতি নির্মূলের মাধ্যমে মানুষকে নির্বিঘ্নে চলাফেরা ও শান্তিতে বসবাসের নিশ্চয়তা দিতে পারে।
বিশ্বের অন্যতম গণতন্ত্রপন্থী দেশ ভারতের কাশ্মীরের দিকে তাকালে দেখতে পাব, সেখানকার নাগরিকদের মানবাধিকার পরিস্থিতির ভয়াল চিত্র। একটি রিপোর্টে প্রকাশ, ভারত অধিকৃত কাশ্মীরের উত্তরাঞ্চলের তিনটি এলাকায় ৩৮টি গণকবরে ২ হাযার ১৬৫টি লাশ পাওয়া গেছে। কাশ্মীরের মানবাধিকার গ্রুপগুলো দাবী করেছে, আট হাযারের বেশী কাশ্মীরী যুবক নিখোঁজ রয়েছে। আশংকা করা হচ্ছে, এসব হতভাগাকে নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করে সেখানে পুঁতে রাখা হয়েছে।[9] বর্তমানে সেখানে সাধারণ যুবক-যুবতীরা স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারে না। অপরদিকে ইরাকে ৮ বছরে ৬ লাখ বেসামরিক লোক নিহত হয়েছে। বুঝা গেল, আজ দেশ-বিদেশে যুদ্ধ-বিগ্রহ, সন্ত্রাসী, বাঁদাবাজী সহ নানা কারণে মানুষের চলাচলের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা নেই। অথচ ইসলামী জীবন বিধানে এ রকম হওয়ার প্রশ্নই উঠে না। উদাহরণস্বরূপ এখনও গোটা সঊদী আরবে ইসলামী অনুশাসনে মানুষের নির্বিঘ্ন চলাচল ও জীবন যাত্রার নিরাপদ ব্যবস্থা দেখতে পাওয়া যায়।
অন্যদিকে দেখা যায়, জাতিসংঘ সনদের এই ধারা মানুষের চলাচলের স্বাধীনতার নামে ছেলে-মেয়েদেরকে উন্মুক্ত ময়দানে নামিয়েছে। যে কারণে শিক্ষাঙ্গন, হোটেল, রেঁস্তোরা, হাসপাতাল, পার্ক, সীবিচ, বিমান বন্দর, কর্মক্ষেত্র সহ প্রায় সর্বত্র অবাধ চলাফেরা ও মেলামেশার মাধ্যমে অশ্লীলতা ও বেলেল্লাপনার সয়লাব চলছে। সুস্থ-বিবেকবান কোন মানুষ তা মেনে নিতে পারেন না। ইদানীং আমাদের দেশে এই ব্যক্তিস্বাধীনতার নামে ইভটিজিং, ধর্ষণ, মাদক সেবন, সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি আরও বেড়ে গেছে। প্রশাসন রীতিমত হিমসিম খাচ্ছে ঐসব প্রতিরোধ করতে। আর প্রশাসন কিভাবে পারবে তা নিয়ন্ত্রণ করতে? কোন কোন মন্ত্রী-এমপিরা যদি এসবকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয় ও উসকে দেয়, তাহ’লে এসব কি করে নিয়ন্ত্রিত হবে? তাছাড়া বাংলাদেশের আইন তৈরীর সুতিকাগার সংসদ ভবনের সামনে-পিছনে খোদ এম.পি-পুলিশের সামনেই যদি ছেলে-মেয়ের অবাধ চলাফেরা, মেলামেশা ও অশ্লীলতার সয়লাব চলে, তাহ’লে দেশের হতভাগা নাগরিকেরা আর কোথায় যাবে? এক কথায় বলব, এসবই স্বাধীন চলাচলের নামে ধর্মীয়, পারিবারিক ও পরিবেশগত চরম মানবাধিকারের লংঘন। পক্ষান্তরে ইসলাম বহু পূর্বেই সুস্পষ্টভাবে এসব অশ্লীলতা বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে। ইসলাম বলে দিয়েছে, মুসলিম নারী-পুরুষ, ছেলে-মেয়ে কিভাবে ঘরে বাইরে চলাফেরা করবে, কার সাথে মিশতে পারবে ও কার সাথে পারবে না। শুধু মুসলিম কেন যেকোন ধর্মই সম্ভবত এ ধরনের স্বাধীনতার ঘোর বিরোধী।
এই ধারার আরেকটি অংশ হ’ল স্বাধীনভাবে বসবাস করার অধিকার। আমরা বলব, এই ধারার আলোকে পৃথিবীর সমস্ত রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিকের স্বাধীনভাবে ঘর-বাড়ি স্থাপন করে বসবাস করার অধিকার রয়েছে। কিন্তু প্রচলিত মানবাধিকারের রূপকারগণ এ ধারায় উল্লেখ করেননি যে কোন মানুষ যদি বসবাসের স্বাধীনতা না পায় অথবা বসবাসের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় তবে তার প্রতিকারের ব্যবস্থা কি? আবার কেউ যদি এ ধারা ব্যবহার করে স্বাধীনভাবে বসবাসের নামে সরকারি সার্টিফিকেট নিয়ে পতিতাবৃত্তি, মদ-জুয়ার আসর, অশ্লীল নাইট ক্লাব এবং আবাসিক হোটেলের জন্য বাড়িগুলো কাজে লাগায় অথবা দেশে-বিদেশে বন্ধু-বান্ধবী নিয়ে লিভ টুগেদার করে অথবা সমকামী হয়, এ সবকে স্বাধীন বসবাসের স্থান বলা হবে কি? এটাই কি মানবাধিকার? ইসলামে এসব সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
প্রচলিত এই আইন লংঘন হ’লে শুধুই আছে সান্ত্বনা, বিবৃতি অথবা বড় জোর নিন্দা। একটি রিপোর্টে জানা যায়, ২০১০ সালে পৃথিবীর উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রাকৃতিক দুর্যোগে ৪ কোটি ২০ লাখেরও বেশী মানুষ নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। এর ফলে ভারত, ফিলিপাইন, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, চীন এবং পাকিস্তানে বিপুল সংখ্যক উদ্বাস্ত্ত হয়েছে। বিশ্বে ধনী দেশগুলো যে পরিমাণ বর্জ্র ও রাসায়নিক পদার্থ উৎপাদন করছে, এর পরিণতিতে বায়ুমন্ডলে কার্বন নির্গমনের কারণে আবহাওয়ায় উঞ্চতা খুব দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে। এর প্রভাব বাংলাদেশের উপর বেশী পড়ছে। নিউইয়র্ক টাইম ৫-৬ এপ্রিল ২০১৪ সাপ্তাহিক সংস্করণের প্রথম পৃষ্ঠায় এসব ভয়ংকর তথ্য প্রকাশ করেছে। এ প্রসঙ্গে ভারতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত তারিক এ করিম বলেছেন, বর্তমানে যে হারে সমুদ্র জলপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে তাতে হিসাব করে দেখা গেছে, ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের অন্তত পাঁচ কোটি অধিবাসীকে বাস করার মত ভূমি হারিয়ে বিদেশে পালাতে হবে। প্রতিবেদনে বিজ্ঞানীরা বলেছেন, ২০৫০ সাল নাগাদ সমুদ্র পৃষ্ঠের ক্রমাগত উচ্চতা বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ ভূখন্ডের ১৭ শতাংশ পানিতে তলিয়ে গিয়ে এক কোটি ৮০ লাখ বাংলাদেশী ভূমিহারা ও আশ্রয় হারা হবে। এ আশঙ্কায় ইতিমধ্যে বহু অধিবাসী সমুদ্রোপকূল এলাকা থেকে সরে যেতে শুরু করেছে।[10] এই প্রতিবেদনের বরাতে মানবাধিকার কর্মীগণ বলেছেন, পৃথিবীর আবহাওয়া উঞ্চতার জন্য ধনী দেশগুলো দায়ী। এর জন্য ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র দেশগুলোকে ধনী দেশের ক্ষতিপূরণ দেয়া উচিত। এখানে এ কথা স্পষ্ট যে, বিশ্বের ধনী দেশগুলোর ক্ষমতার স্বেচ্ছাচারিতা, বিলাসিতা, মারণাস্ত্র উৎপাদন সহ নানা কারণে বুভুক্ষু-পীড়িত-দারিদ্রক্লিষ্ট দেশগুলোর অসহায়-হতভাগা মানুষেরা বসবাসের ক্ষেত্রে মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন; যা নিঃসন্দেহে মানবাধিকার লংঘনের শামিল। অথচ ইসলামের দৃষ্টিতে এরূপ স্বেচ্ছাচারিতা ও মানবজীবনের বসবাসের জন্য ক্ষতিকর কাজের কোনরূপ সুযোগ নেই।
বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর আধিপত্য বিস্তারের জন্য যুদ্ধ-বিগ্রহ বা দুর্নীতির কারণে আজ কোটি কোটি মানুষ উদ্বাস্ত্ত হয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছে। তাদের বসবাসের জন্য কোন আশ্রয় নেই। বিশেষ করে অপশক্তিগুলো চায় মুসলমানদেরকে উদ্বাস্ত্ত ও নিঃস্ব বানাতে। এটা কয়েকটি রিপোর্ট দেখলে বুঝা যাবে। ১৯৯৯ সালে পূর্বতিমুর, ইন্দোনেশিয়া হ’তে পৃথক হওয়ার পর থেকে সেখানকার শত শত মুসলমানকে অবৈধভাবে ইন্দোনেশিয়ায় বিতাড়িত করেছে। বাংলাদেশের প্রতিবেশী রাষ্ট্র মিয়ানমারের ৮ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে বেশি হয়রানির শিকার বলে স্বীকার করেছে জাতিসংঘ। এই স্বীকারুক্তিই শেষ। অথচ গরীব রাষ্ট্র বাংলাদেশের উপর বিরাট বোঝাস্বরূপ কক্সবাজারে অবস্থানরত লক্ষ্য লক্ষ্য রোহিঙ্গাদের নিজ ভূমিতে ফিরে যাওয়ার জন্য কেউ ব্যবস্থা করছে না। অন্যদিকে মধ্য প্রাচ্যের ফিলিস্তীন থেকে ১৯৬৭ সালে ইহুদী-খৃষ্টান গং প্রায় ১০-১২ লক্ষ্য মুসলিমকে নিজ দেশ-বসতি থেকে বিতাড়িত করে উদ্বাস্ত্ত করেছে। এখনও সেখানে নীরিহ ফিলিস্তিনীদের হত্যা, নির্যাতন করা হচ্ছে। তাদের ঘর-বাড়ী ভেঙ্গে দিয়ে ইহুদীরা বসতবাড়ী নির্মাণ করছে। অথচ বিশ্বের মানবাধিকারের কথিত বাস্তবায়নকারী (?) দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ন্যক্কারজনকভাবে তাদেরকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। প্রশ্ন হ’ল মানবাধিকারের এই সনদটিকে এখন কে মূল্যায়ন করবে? এভাবে মিশর, সিরিয়া, লিবিয়া, আফগানিস্তান, কাশ্মীর, আসাম, ক্রিমিয়া, মধ্য আফ্রিকার দেশসহ সারা বিশ্বে কোটি কোটি মানুষ এখন বসত-বাড়ি বিহীন অবস্থায় জীবন-যাপন করছে। যা এই সনদের লংঘন। কিন্তু ইসলাম কখনও এ বিষয়টিকে সমর্থন করেনি। হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান যে জাতিই হৌক না কেন কাউকে অন্যায়ভাবে উচ্ছেদ, স্বাধীন চলাচল ও বসবাসের উপর হস্তক্ষেপে ইসলাম বিশ্বাসী নয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কর্তৃক মদীনা সনদের ভিত্তিতে সব জাতিকে নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার এক অনুপম দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে অবিস্মরণীয় হয়ে আছে।
জাতিসংঘ মানবাধিকার সনদের ১৩ (২) উপধারা অনুযায়ী মানুষের এক দেশ থেকে অপর দেশে চলাচলের স্বাধীনতা রয়েছে। ইসলাম গোটা বিশ্বকে এক খলীফার/আমীরের অধীনে পরিচালনা করার নির্দেশ দিয়েছে। সে হিসাবে গোটা বিশ্বটা একটা দেশ। তবে ব্যবসা-বাণিজ্য, বিধি-নিষেধ সব কিছু ঠিক রেখে প্রত্যেক দেশের নাগরিক বিভিন্ন দেশে স্বাধীনভাবে যেতে এবং আসতে পারেন। যেহেতু আল্লাহ পাক গোটা বিশ্বকে মানুষের জন্য রিযিকের, ব্যবসা-বাণিজ্যের স্থান করেছেন। অথচ আমাদের দেশসহ বিশ্বের প্রায় সকল রাষ্ট্রই মানুষের এরূপ স্বাধীন চলাচল, যাতায়াতের উপর হস্তক্ষেপ করে চলেছে, যা ইসলামে নেই।
এখন মানুষের বিদেশে যাতায়াত তো দূরের কথা, শীর্ষ ও সম্মানিত ব্যক্তিগণ চিকিৎসা নিতে যাবেন, সেখানেও তাঁর জীবনের কোন গ্যারান্টি নেই। যেমন ইহুদীবাদী ইসরাঈলের প্রেসিডেন্ট শিমন প্যারেজ শেষ পর্যন্ত স্বীকার করেছেন যে, পি.এল.ও’র সাবেক প্রধান ইয়াসির আরাফাত হত্যায় তাদের হাত ছিল। তিনি বলেছেন, ইয়াসির আরাফাতকে হত্যা করা ঠিক হয়নি। কারণ তাঁর সাথে সহযোগিতার সম্পর্ক সৃষ্টির সুযোগ ছিল। উক্ত স্বীকারোক্তির মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদের ক্ষেত্রে ইসরাঈলের অবস্থান বিশ্ববাসীর সামনে আরেকবার স্পষ্ট হয়ে উঠল। সন্ত্রাসবাদের ক্ষেত্রে আল-কায়েদার সাথে ইসরাঈলের পার্থক্য হ’ল আল-কায়েদার কোন রাষ্ট্রীয় ভিত্তি নেই। আর ইসরাঈল হচ্ছে বিশ্বের বুকে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের উৎকৃষ্ট উদাহরণ।[11]
এখান থেকে একটি দিক ফুটে উঠে। তাহ’ল কোন সাধারণ বা বিশিষ্ট ব্যক্তি বিশেষ করে মুসলমানদের স্বাধীনভাবে দেশ ত্যাগ করা বা ফিরে আসাটা শুধু বাধা নয়; অতি ভয়ংকর। অথচ এই ইহুদী-খৃষ্টানরা সারা বিশ্বে স্বাধীনভাবে চষে বেড়াচ্ছে। তাদের কোন সমস্যা নেই। এগুলো কি মানবাধিকার লংঘন নয়?
পক্ষান্তরে ইসলামে মুসলমান, হিন্দু-খৃষ্টান বলে কোন কথা নেই। মুসলমানের প্রতিবেশী হিন্দু-খৃষ্টান-বেŠদ্ধ, ফকীর-বাদশাহ যেই হৌক তাদের প্রতি সকল অধিকার প্রদানে উদারতা দেখিয়েছে, যা অন্য কোন ধর্মে নেই। সুতরাং আমরা বলতে পারি, ইসলাম ছাড়া অন্য কোন মানবাধিকার সনদ ও ধর্মে মানুষের স্বাধীনভাবে চলাচল, বসবাস ও দেশ-বিদেশে যাতায়াতের ব্যাপারে পূর্ণাঙ্গ অধিকার নেই?
অতএব জাতিসংঘ সার্বজনীন মানবাধিকার সনদের বিভিন্ন ধারা অস্পষ্ট ও ত্রুটিযুক্ত প্রমাণিত হওয়ায় তা সংশোধন করার আহবান জানাই। সাথে সাথে উক্ত বিষয়ের প্রতি ইসলাম মানবাধিকারের যে দৃষ্টান্ত দেখিয়েছে, আমরা নির্ভুল ও চিরন্তন সেই মানবাধিকার সনদের অনুসরণ করি। আল্লাহ বিশ্ব সম্প্রদায়কে সে জ্ঞান দান করুন- আমীন!!
– শামসুল আলম