মানবাধিকার ও ইসলাম : যোগাযোগ, গোপনীয়তা, সম্মান ও সুনাম রক্ষার অধিকার
Article-12 : No one shall be subjected to arbitrary interference with his privacy, family, home or correspondence, nor to attacks upon his honour and reputation. Everyone has the right to the protection of the law against such enterference or attacks.[1] ‘কোন ব্যক্তির পরিবারের, বাসস্থানের চিঠি আদান-প্রদানের উপর কিংবা অন্যান্য যোগাযোগ মাধ্যমের উপর অথবা ব্যক্তিগত গোপনীয়তার উপর কোন ধরনের বিঘ্ন সৃষ্টি করা যাবে না বা তার ব্যক্তিগত সম্মান এবং সুনাম ক্ষুণ্ণ হ’তে পারে এমন কিছু করা যাবে না। যারা এসব বিষয়ে বিপত্তির শিকার হবেন তারা প্রচলিত আইনে প্রতিকার ও বিচার দাবী করতে পারবেন’।
অর্থাৎ জাতিসংঘ সার্বজনীন মানবাধিকার সনদের এই ধারায় মানুষের ব্যক্তিগত বিষয় যেমন- পরিবার ও বাসস্থানের সাথে পরস্পর যোগাযোগের উপর এবং তার ব্যক্তিগত কোন গোপনীয়তার ওপর বাধা সৃষ্টি করা যাবে না অথবা ব্যক্তিগত সম্মান এবং সুনাম ক্ষুণ্ণ হ’তে পারে এমন কিছু করা যাবে না। যদি কেউ তা করে সেক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইনানুযায়ী উক্ত ভুক্তভোগী তার প্রতিকার পেতে পারেন। বাংলাদেশ সংবিধানের মৌলিক অধিকার অধ্যায়ের ৪৩ ধারায় এ অধিকারের কথা উল্লেখ রয়েছে। যদিও অভিযোগকারীর জন্য এই সনদ অনুযায়ী প্রতিকারের কোন সুনির্দিষ্ট বিধান নেই।
ইসলামের আলোকে বিশ্লেষণ :
জাতিসংঘ মানবাধিকার সনদের এ ধারায় মানুষের ব্যক্তিগত কাজে পরিবারের সাথে যে কোন ধরনের যোগাযোগের অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। পত্র যোগাযোগ সহ আধুনিক যুগের নানা প্রযুক্তিগত যোগাযোগের সুযোগও করে দেয়া হয়েছে। একই সাথে যে কোন মানুষের সুনাম ও সম্মান রক্ষা করার অধিকার দেয়া হয়েছে। ইসলামে বহু পূর্বেই এ সকল বিষয়ে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। ইসলাম এ অধিকার অর্জনের পথকে যেমন সহজ ও সুন্দর করেছে, তেমনি তা সুরক্ষার জন্য মানব সম্প্রদায়কে অত্যন্ত সতর্কতামূলক বাণী উচ্চারণ করেছে। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوا اجْتَنِبُوْا كَثِيْراً مِّنَ الظَّنِّ إِنَّ بَعْضَ الظَّنِّ إِثْمٌ وَلَا تَجَسَّسُوْا وَلَا يَغْتَب بَّعْضُكُم بَعْضاً أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ أَن يَأْكُلَ لَحْمَ أَخِيْهِ مَيْتاً فَكَرِهْتُمُوْهُ وَاتَّقُوا اللهَ إِنَّ اللهَ تَوَّابٌ رَّحِيْمٌ.
‘হে মুমিনগণ! তোমরা অধিক ধারণা হ’তে বিরত থাক। কারণ কোন কোন ধারণা পাপ এবং তোমরা একে অপরের গোপনীয় বিষয় অনুসন্ধান কর না এবং তোমাদের কেউ যেন অন্যের গীবত না করে। তোমাদের মধ্যে কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত ভক্ষণ করতে ভালবাসো? বস্ত্ততঃ তোমরা এটাকে ঘৃণাই কর। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। আল্লাহ তওবা কবুলকারী, দয়ালু’ (হুজুরাত ৪৯/১২)।
এ আয়াতে মানুষের গোপনীয় বিষয় অনুসন্ধান না করা এবং গীবত না করার জন্য কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করা হয়েছে।
একইভাবে ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষকে খারাপ নামে ডাকা অথবা কাউকে বিদ্রূপাত্মকভাবে ডাকা উচিত নয়; বরং এর পরিবর্তে সুন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষের সুনাম, মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য যথাযথ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। যেমন মহান আল্লাহ বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا يَسْخَرْ قَومٌ مِّن قَوْمٍ عَسَى أَنْ يَكُوْنُوْا خَيْراً مِّنْهُمْ وَلَا نِسَاءٌ مِّنْ نِّسَاءٍ عَسَى أَن يَكُنَّ خَيْراً مِّنْهُنَّ وَلَا تَلْمِزُوْا أَنفُسَكُمْ وَلَا تَنَابَزُوْا بِالْأَلْقَابِ بِئْسَ الاِسْمُ الْفُسُوْقُ بَعْدَ الْإِيْمَانِ وَمَن لَّمْ يَتُبْ فَأُوْلَئِكَ هُمُ الظَّالِمُوْنَ.
‘হে মুমিনগণ! কোন পুরুষ যেন অপর কোন পুরুষকে বিদ্রূপ না করে। কেননা তারা তাদের চেয়ে উত্তম হ’তে পারে এবং কোন নারী অপর কোন নারীকেও যেন বিদ্রূপ না করে, কেননা তারা তাদের চেয়ে উত্তম হ’তে পারে। তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ কর না এবং একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না। ঈমান আনার পরে মন্দ নামে ডাকা গর্হিত কাজ। যারা এ ধরনের আচরণ পরিত্যাগ করে না তারাই অত্যাচারী’ (হুজুরাত ৪৯/১১)।
একে অপরের গৃহে প্রবেশ করার বিধান সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا لَا تَدْخُلُوْا بُيُوْتاً غَيْرَ بُيُوْتِكُمْ حَتَّى تَسْتَأْنِسُوْا وَتُسَلِّمُوْا عَلَى أَهْلِهَا ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُوْنَ. ‘হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদের গৃহ ব্যতীত অপরের গৃহ সমূহে প্রবেশ কর না, যে পর্যন্ত না তাদের অনুমতি গ্রহণ কর এবং তার বাসিন্দাদেরকে সালাম প্রদান কর। এই পন্থাই তোমাদের জন্য কল্যাণকর যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর’ (নূর ২৪/২৭)।
এ বিষয়ে অন্য আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, إِنَّمَا الْمُؤْمِنُوْنَ الَّذِيْنَ آمَنُوْا بِاللهِ وَرَسُوْلِهِ وَإِذَا كَانُوْا مَعَهُ عَلَى أَمْرٍ جَامِعٍ لَمْ يَذْهَبُوْا حَتَّى يَسْتَأْذِنُوْهُ. ‘মুসলিম তো কেবল তারাই যারা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান রাখে এবং রাসূলের সঙ্গে সমষ্টিগত ব্যাপারে একত্রিত হ’লে তারা অনুমতি ব্যতীত সরে পড়ে না’ (নূর ২৪/৬২)।
ইসলামে মানুষের ব্যক্তিগত সুনাম ও সম্মান নষ্ট করা তো দূরের কথা বরং তা রক্ষা করার জন্য নিকট ও দূর আত্মীয়সহ সকলের সাথে সদয় আচরণ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যেমন পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে,
وَاعْبُدُواْ اللهَ وَلاَ تُشْرِكُواْ بِهِ شَيْئاً وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَاناً وَبِذِي الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِيْنِ وَالْجَارِ ذِي الْقُرْبَى وَالْجَارِ الْجُنُبِ وَالصَّاحِبِ بِالجَنبِ وَابْنِ السَّبِيْلِ وَمَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ إِنَّ اللهَ لاَ يُحِبُّ مَنْ كَانَ مُخْتَالاً فَخُوْراً.
‘তোমরা আল্লাহর ইবাদত করবে ও কোন কিছুকে তাঁর সাথে শরীক করবে না এবং পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম, অভাবগ্রস্ত, নিকট প্রতিবেশী, দূর প্রতিবেশী, সঙ্গী-সাথী, পথচারী এবং অধিকারভুক্ত দাস-দাসীদের প্রতি সদাচরণ করবে। আল্লাহ দাম্ভিক ও আত্মগর্বীকে পসন্দ করেন না’ (নিসা ৪/৩৬)।
সম্মানিত ব্যক্তিবর্গকে উত্তম নামে ডাকা ইসলামের নির্দেশ। বরং মন্দ নামে ডাকতে আল্লাহ নিষেধ করেছেন’ (হুজুরাত ৪৯/১১)। কিন্তু দুর্ভাগ্য বর্তমান যুগে মর্যাদাবান মানুষকে আর সুনামের সাথে ডাকা হয় না; বরং দলীয় স্বার্থ পরিপন্থী হলে তাকে সন্ত্রাসী, জঙ্গী অথবা ইহূদীদের দালাল প্রভৃতি নামে অভিহিত করা হয় এবং জাতীয় আন্তর্জাতিক সংবাদ ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে ফলাও করে প্রচার করা হয়। আবার কখনও জ্ঞানী-গুণীদেরকে গ্রেফতার করে জেলখানায় বছরের পর বছর আটকিয়ে রাখা হচ্ছে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে অনেককে মিথ্যা মামলায় মৃত্যুদন্ডও দেয়া হচ্ছে। এসব মানবাধিকার পরিপন্থী। নবী-রাসূলগণকেও এভাবে মন্দ নামে আখ্যায়িত করা হ’ত। নূহ (আঃ)-কে তাঁর সম্প্রদায় মিথ্যাবাদী হিসাবে আখ্যায়িত করেছিল। যেমন তিনি (নূহ) বলেন, قَالَ رَبِّ إِنَّ قَوْمِي كَذَّبُوْنِ، فَافْتَحْ بَيْنِيْ وَبَيْنَهُمْ فَتْحاً وَنَجِّنِيْ وَمَنْ مَّعِيْ مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ. ‘হে আমার প্রতিপালক! আমার সম্প্রদায় তো আমাকে মিথ্যাবাদী বলেছে। সুতরাং তুমি আমার ও তাদের মধ্যে ফায়ছালা করে দাও। আর আমার ও আমার সঙ্গে যেসব মুমিন আছে তাদের রক্ষা কর’ (শু‘আরা ২৬/১১৭-১১৮)।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে কাফির-মুশরিকরা মিথ্যাবাদী, যাদুকর, পাগল, কবি প্রভৃতি উপাধি দিয়েছিল। এখনও তাদেরই দোশররা রাসূল (ছাঃ)-এর নামে কার্টুন, ছবি এঁকে তাঁকে ন্যাক্কারজনকভাবে চিত্রিত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। মুসলিম নামধারী ব্যক্তি, ইহুদী-খৃষ্টান অথবা মুশরিকরা কখনও ধর্ম, কখনও বা অধর্মের নামে, কখনওবা ধর্মনিরপেক্ষতার নামে, কখনও রাজনীতির নামে রাসূল (ছাঃ)-কে মিথ্যা অ্যাখ্যা ও খেতাব দিয়ে যাচ্ছে। যা মানবাধিকার পরিপন্থী।
রাসূল (ছাঃ) ছাহাবীদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘তোমরা যদি মানুষের গোপনীয় বিষয়াদি উদঘাটনে লেগে যাও তবে তোমরা তাকে ধ্বংস করে দিবে কিংবা অন্তত ধ্বংসের পর্যায়ে পৌঁছে দিবে’।[2]
রাসূল (ছাঃ) আরও বলেন, ‘তোমরা এক জায়গায় তিন জন থাকলে একজনকে বাদ দিয়ে দু’জনে কোন কথা বলবে না, যতক্ষণ না তোমরা বেশী সংখ্যক মানুষের সাথে মিশে যাও। কেননা তা করা হ’লে তৃতীয় ব্যক্তি চিন্তান্বিত হয়ে পড়তে পারে’।[3] এরূপ নিষেধ করার কারণ হ’ল এতে একজনের মানবাধিকার উপেক্ষিত হয়। যা ইসলামের দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ। তেমনি কাউকে তার স্থান থেকে তুলে দিয়ে সেখানে বসা মানবাধিকারের লংঘন। এটা রাসূল (ছাঃ) নিষেধ করেছেন। রাসূলুল্লাহ, ‘একজনকে তার আসন থেকে তুলে সেখানে অন্য একজনকে বসতে নিষেধ করেছেন’।[4]
একদা বিশিষ্ট সাহাবী আবু যার ও বেলাল হাবাশী (রাঃ) ক্রোধান্বিত হয়ে পরস্পরকে গাল-মন্দ করলেন এবং রাগের মাথায় আবু যার বেলাল (রাঃ)-কে উদ্দেশ্য করে বললেন, হে কালোর সন্তান! অতঃপর বেলাল (রাঃ) এ ব্যাপারে রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে অভিযোগ করলে রাসূল (ছাঃ) আবু যার (রাঃ)-কে ধমক দিয়ে বললেন, يَا أَبَا ذَرٍّ أَعَيَّرْتَهُ بِأُمِّهِ إِنَّكَ امْرُؤٌ فِيكَ جَاهِلِيَّةٌ ‘হে আবু যর! তুমি তাকে তার মায়ের নামে তাচ্ছিল্য করলে? তোমার মধ্যে জাহেলিয়াত রয়েছে’।[5]
ইসলামে যেকোন ব্যক্তির সম্মান ও সুনাম রক্ষা করা একটা পবিত্র বিষয় যা অলংঘনীয়। এ সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) বিদায় হজ্জের ভাষণে বলেন, ‘তোমাদের রক্ত, তোমাদের সম্পদ এবং তোমাদের সম্মান তোমাদের জন্য ঠিক তেমনি পবিত্র, যেমন তোমাদের আজকের এই দিন এই মাস এই শহর পবিত্র’।[6]
আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘তোমরা অবশ্যই ধারণা থেকে বেঁচে থাক। কেননা ধারণা সবচেয়ে বড় মিথ্যা কথা। কারো দোষ খুঁজে বেড়িও না, গোয়েন্দাগিরিতে লিপ্ত হয়ো না এবং (বেচা-কেনায়) একে অপরেরকে ধোঁকা দিয়ো না। পরস্পরে হিংসা করো না, একে অন্যের প্রতি বিদ্বেষ ভাব রেখো না, একজন থেকে আর একজন বিচ্ছিন্ন হয়ে যেও না। বরং সবাই এক আল্লাহর বান্দা হয়ে ভাই ভাই হয়ে যাও’।[7]
ইসলামের দৃষ্টিতে একজন মুসলমান কর্তৃক অন্যের সুনাম, মর্যাদাকে নষ্ট করা তো দূরের কথা; বরং সর্বদা সে আল্লাহর ভয়ে ভীত থাকে যে, কখনও সে অন্যকে কষ্ট দিচ্ছে কি-না। যেমন হযরত ইকরামা (রাঃ) বলেন, ‘আমার যতদূর মনে পড়ে আয়েশা (রাঃ)-কে বলতে শুনেছি, তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে হাত তুলে দো‘আ করতে দেখেছেন। তিনি এই দো‘আ করছিলেন, اللَّهُمَّ إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ فَأَىَّ عَبْدٍ مِنْ عِبَادِكَ ضَرَبْتُ أَوْ آذَيْتُ فَلاَ تُعَاقِبْنِى بِهِ ‘হে আল্লাহ! আমি মানুষ, মানুষসুলভ দুর্বলতাবশতঃ আমি যদি তোমার কোন মুমিন বান্দাকে যদি কোনভাবে আঘাত দিয়ে থাকি বা কোনরূপ কষ্ট দিয়ে থাকি তবে এজন্য আমাকে শাস্তি দিও না’।[8]
তিনি সর্বদা মানুষের কল্যাণ বা হেদায়াত কামনা করেছেন। এ সম্পর্কে আবু হুরায়রাহ (রাঃ) বলেন, দাওস গোত্রের তোফায়েল ইবনে আমর রাসূলাল্লাহ (ছাঃ)-এর খিদমতে হাযির হয়ে আরয করলেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)! দাওস অবাধ্যতা ও আল্লাহর দ্বীনকে অস্বীকার করার পথ বেছে নিয়েছে। সুতরাং তাদের জন্য বদদো‘আ করুন। নবী করীম (ছাঃ) তখন কেবলামুখী হয়ে দো‘আ করার উদ্দেশ্যে তাঁর পবিত্র হস্তদ্বয় উঠালেন। লোকের ধারণা হ’ল যে, নবী করীম (ছাঃ) তাদের জন্য বদদো‘আ করবেন। তিনি তখন বললেন, হে আল্লাহ! আপনি দাওস গোত্রকে হেদায়াত দান করুন এবং তাদেরকে আমার কাছে এনে দিন’।[9]
সুতরাং ভাল-মন্দ সকল মানুষের প্রতি উদারতা ও দয়া দেখানো উচিত। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে মানুষের প্রতি দয়া করে না, আল্লাহ তার প্রতি দয়া করেন না’।[10]
ইসলামী রাষ্ট্রে শাসকের জন্য কারো আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতা কতটুকু এবং এই ক্ষেত্রে নাগরিকের অধিকার কতটুকু ওমর (রাঃ)-এর একটি ঘটনা থেকে তা সহজে অনুমান করা যায়। আব্দুর রহমান ইবনু আওফ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, একদা তিনি ওমর (রাঃ)-এর সাথে মদীনার প্রজা সাধারণের খোঁজ-খবর নেয়ার জন্য বের হ’লেন। হাটতে হাটতে হঠাৎ একটি বাড়ির মধ্যে প্রদীপ তাদের দৃষ্টিগোচর হল। অতঃপর তারা সেদিকে যেতে লাগলেন। তারা বাড়ির নিকটবর্তী হয়ে দেখলেন দরজা আটকানো একটি ঘরের মধ্যে একদল লোক রয়েছে এবং সেখানে উচ্চস্বরে আওয়াজ হচ্ছে। তখন ওমর (রাঃ) আব্দুর রহমানের হাত ধরে বললেন, তুমি কি জান এ বাড়ীটি কার? তিনি বললেন, না। ওমর (রাঃ) বললেন, এ বাড়ীটি রাবী‘আহ বিন উমাইয়া ইবনে খালাফের। হয়তো তারা মদ পান করছে, তুমি কি মনে কর? আব্দুর রহমান বললেন, আমি মনে করি, আমরা আল্লাহর নিষেধকৃত পন্থায় এখানে এসেছি। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে নিষেধ করে বলছেন, ‘তোমরা গোয়েন্দাগিরি কর না’ (হুজুরাত ৪৯/১২)। অথচ আমরা গোয়েন্দাগিরি করছি। একথা শুনে ওমর (রাঃ) তাদের ছেড়ে ফিরে আসলেন।[11]
খলীফা ওমর (রাঃ)-এর যুগের অপর একটি ঘটনা। ইমাম শা‘বী (রহঃ) বলেন, জনৈক ব্যক্তি ওমর (রাঃ)-এর নিকটে এসে বললেন, জাহেলী যুগে আমি আমার কন্যাকে জীবন্ত কবরস্থ করেছিলাম। কিন্তু পরে (মারা যাওয়ার পূর্বেই) তাকে বের করেছিলাম। পরবর্তীতে সে ইসলাম গ্রহণ করে। একসময় (অন্যায়ে লিপ্ত হওয়ায়) তার উপর হদ আবশ্যক হ’ল। অতঃপর সে একটি চাকু নিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করল। আমি তাকে কণ্ঠনালীর কিছু শিরা কর্তিত অবস্থায় দেখতে পেলাম। আমি তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করলাম। ফলে সে বেঁচে গেল এবং ধার্মিক হয়ে গেল। পরে সর্বদা সে কুরআনী বিধান অনুযায়ী জীবন পরিচালনা শুরু করল। এখন সে বিবাহ করার ইচ্ছা পোষণ করছে। এক্ষণে আমি কি তার পূর্ববর্তী ঘটনা প্রকাশ করব? তখন ওমর (রাঃ) তাকে বললেন, তুমি কি এমন একটি বিষয় প্রকাশ করতে চাও, যা আল্লাহ গোপন রেখেছেন? আমি যদি জানতে পারি যে, তুমি তার ঘটনা কিছু প্রকাশ করেছ, তাহ’লে তোমাকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করব। বরং তুমি তাকে একজন পূতপবিত্র মুসলিম রমণীর ন্যায় বিবাহ দাও।[12]
অন্য হাদীছে এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবনে বুশর (রাঃ) বলেন, ‘যখন কারো দ্বারপ্রান্তে কোন ব্যক্তি উপনীত হবে এবং অনুমতি প্রার্থনার উদ্দেশ্যে দাঁড়াবে তখন একেবারে দরজার মুখোমুখি দাঁড়াবে না, বরং একটু ডান পাশে বা বাম পাশে সরে দাঁড়াবে। যদি অনুমতি দেয়া হয়, তবে ঢুকবে, নতুবা চলে যাবে’।[13]
শুধু তাই নয় ঘরে প্রবেশের অনুমতির পূর্বে ঘরের ভিতরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করাও নিষিদ্ধ। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘কোন মুসলিমের জন্য অনুমতি পাওয়ার পূর্বে কোন গৃহের অভ্যন্তরে দৃষ্টিপাত করা জায়েয নয়’।[14]
কেউ যদি কারো ঘরে উঁকি মারে তাহ’লে তার চোখ ফুটা করার কথা হাদীছে এসেছে। কারো ঘরে বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করার কারণে তার গোপনীয়তা প্রকাশিত হয়, যা প্রকারন্তরে মানবাধিকারের পরিপন্থী।
পর্যালোচনা : জাতিসংঘ সার্বজনীন মানবাধিকার সনদের ১২ নং ধারায় মানুষের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন যোগাযোগের জন্য স্বাধীনতা প্রদান করা হয়েছে, তেমনি সকল নাগরিকের মর্যাদা রক্ষা করার অধিকারেরও স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। ইসলামও এ বিষয়ে বহু বছর পূর্বে সুন্দরতম ব্যবস্থা দিয়েছে; যা পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের উদ্ধৃতি থেকে সহজে অনুমেয়।
বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তি তথা ইন্টারনেট, স্যাটেলাইট, মোবাইল প্রভৃতি ব্যবহারের মাধ্যমে যোগাযোগের নামে তরুণ-তরুণী, ছাত্র-ছাত্রীর চরিত্র নষ্ট হচ্ছে। তাছাড়া মানুষের পারিবারিক জীবন সহ গোটা সমাজ ব্যবস্থা এখন প্রায় ধ্বংসের পথে। যা ইসলাম কখনও সমর্থন করে না।
জাতিসংঘ মানবাধিকার সনদে মানুষের যোগাযোগ মাধ্যমে বিঘ্ন ঘটলে ও তাদের সুনাম-মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হ’লে সে তার প্রতিকারের দাবী করতে পারে। তবে সে দাবীর প্রেক্ষিতে কি প্রতিকার পাবে তা সুস্পষ্টভাবে বলা নেই। আর এ সকল অধিকার যারা লংঘন করে তাদেরও কেমন বিচার হ’তে পারে তারও কোন সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা নেই। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা হ’ল মানবাধিকার রক্ষার দাবীদার (?) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক অন্যান্য রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও রাষ্ট্রপ্রধানগণের টেলিফোন ও যোগাযোগের ওপর অাঁড়ি পাতার ঘটনা। এর উদ্দেশ্য হ’ল তাঁরা কোথায়, কার সাথে কথা বলছে, কেন যোগাযোগ করছে সকল গোপন খোঁজ-খবর নেয়া। এতে বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউরোপীয় মিত্র রাষ্ট্রগুলো যেমন ইংল্যান্ড, জার্মানী, ফ্রান্স সহ অন্যান্য রাষ্ট্রপ্রধানগণ মনঃক্ষুণ্ণ হন। অনাকাঙ্খিত ও অযৌক্তিক এই হস্তক্ষেপে বিশ্বব্যাপী হৈ চৈ ও নিন্দার ঝড় ওঠে। এতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা চরম সমালোচনার পাত্র হয়ে উঠেন। শুধু তাই নয়; মানবাধিকার কর্মীদের মতে, এটা নিঃসন্দেহে মানবাধিকার পরিপন্থী কাজ, যাতে আলোচ্য ধারা লংঘিত হয়েছে। অথচ এর কোন শাস্তি নেই। বিশ্বের কোন গরীব রাষ্ট্র যদি এরকম কাজ করতো তাহ’লে হয়ত শাস্তি হ’ত। কিন্তু ধনী-গরীব ব্যক্তি বা রাষ্ট্র যেই হৌক না কেন এ ধরনের সুযোগ ইসলামে নেই।
বর্তমান যুগের কোন সম্মানী মানুষ তার ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ব্যাপারে গোপনীয়তা রক্ষা করতে পারেন না। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হ’লে তো কথাই নেই। এরপর যুলুমবাজরা তাঁর অর্জিত ব্যক্তিগত মর্যাদা ও সুনামকে মুহূর্তের মধ্যে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে পারে। যেমন- এদেশে যখন যে সরকার আসে তারা ভিন্ন মতালম্বী আলেম-ওলামা, শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবি, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদসহ বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গকে নানাভাবে নির্যাতন করে থাকে। আর এর সাথে সহযোগী হিসাবে যুক্ত হয় সরকারী গোয়েন্দা বাহিনী, সংবাদকর্মী, ইলেকট্রনিক মিডিয়া প্রভৃতি সংস্থার মিথ্যা রিপোর্ট পেশের মাধ্যমে মানসিক নির্যাতন করে থাকে।
এসব জাতিসংঘ মানবাধিকার সনদের ১২ নং ধারা এবং বাংলাদেশ সংবিধানের মৌলিক অধিকারের ৪৩ ধারানুযায়ী তারা নিঃসন্দেহে মানবাধিকার লংঘন করছে। দুনিয়াতে তাদের বিচার না হ’লেও আল্লাহর দরবারের বিচার থেকে কেউ নিষ্কৃতি পাবে না।
ইসলাম এসব সমর্থন করে না। কারো অপরাধ প্রকাশিত হ’লে নিয়মতান্ত্রিকভাবে তার শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু তার মর্যাদার উপর কখনও হস্তক্ষেপ করে নয়। রাসূল (ছাঃ) কোন ত্রুটিযুক্ত মানুষকে যেমন- খোড়া, বেটে, কানা, ল্যাংড়া প্রভৃতি নামে ডাকতে নিষেধ করেছেন। এমনকি ইহুদী, খৃষ্টান বা অন্য ব্যক্তি-জাতিকেও কটাক্ষ বা বিদ্রূপ করে ডাকতে নিষেধ করা হয়েছে। কারণ ইসলাম সাম্যের ধর্ম, পরস্পরের মর্যাদা ও গোপনীয়তা রক্ষার ধর্ম। এটা অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী ও ধর্মের মত নয়।
মোদ্দাকথা জাতিসংঘের এই ধারা শুধু আইনেই লেখা রয়েছে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে এর যেমন প্রয়োগ নেই, তেমনি যদি কেউ লংঘন করে তার শাস্তির প্রকৃতি কেমন হবে তারও কোন উল্লেখ নেই। কিন্তু ইসলাম এ বিষয়ে স্পষ্ট করে দিয়েছে। সুতরাং জাতিসংঘ সনদের উক্ত ধারা ভাষাগত দিকে কিছুটা তুলে ধরলেও প্রায়োগিক ক্ষেত্রে বাস্তব কোন লক্ষণ নেই, যা ইসলামে বর্ণিত রয়েছে। সুতরাং এ কথা বলা যায় যে, মুসলমানরা কেবল মানুষের ভয়ে এই মানবাধিকার ও অন্যান্য মূল্যবোধকে প্রতিষ্ঠিত করেন না; বরং তারা যা করেন একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই করেন। ফলে এ বিষয়ের কোন পরিবর্তন, সংশোধনের প্রয়োজন পড়ে না। তাই এটা শাশ্বত, চিরন্তন ও সার্বজনীন। সুতরাং বিশ্বের বুকে যদি মানুষকে তার ব্যক্তিগত যোগাযোগ, গোপনীয়তা রক্ষা, সুনাম ও মর্যাদা রক্ষার জন্য কোন সনদ এবং স্থান খুঁজতে হয়, তাহ’লে তাকে ফিরে আসতে হবে ইসলামের পতাকা তলে। যা মানবাধিকারের একমাত্র গ্যারান্টি।
– শামসুল আলম