অধিকার ও মর্যাদা

ইসলামে প্রবীণদের মর্যাদা

মানুষ জন্মের পর শৈশব-কৈশোর ও যৌবন পার করে এক সময় বার্ধক্যে উপনীত হয়। এ জীবনটা কারো জন্যই শতভাগ সুখকর হয় না। কারো জন্য সুখকর হ’লেও অধিকাংশের নিকট সময়টা হয়ে উঠে তিক্ত ও অসহ্য। এ সময় তাদের প্রয়োজন হয় যথাযথ সহযোগী, যার সাথে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে। এখানে আমরা সংক্ষেপে ইসলামে প্রবীণদের  মর্যাদা ও অধিকার সম্পর্কে আলোকপাত করার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।

সাধারণ অর্থে প্রবীণ বলা হয়, اَلرَّجُلُ الْكَبِيْرُ বা বয়স্ক ব্যক্তিকে। ইংরেজীতে Elderly, Aged, Old ইত্যাদি বলা হয়। ইবনু মানযূর বলেন, اَسَنُّ الرَّجُلِ  বয়োবৃদ্ধ বা প্রবীণ লোক। অন্য অর্থে,  اَلْكَهْلُ- الْهَرِمُ অর্থাৎ বয়োবৃদ্ধ, প্রেŠঢ়। আর এটা হ’ল اَقْصَي الْكِبَرِ ‘বয়োবৃদ্ধের শেষ প্রান্ত’।[1] পারিভাষিক অর্থে ঐ সকল ব্যক্তিকে বৃদ্ধ বা প্রবীণ বলে যার বয়স বেশী হয়ে শারীরিক ও মানসিক শক্তি দুর্বল হয়ে পড়েছে। ফলে নিজের দেখাশুনা ও পরিচর্যা নিজে করতে অক্ষম। মহান আল্লাহ বলেন,

يَاأَيُّهَا النَّاسُ إِنْ كُنْتُمْ فِي رَيْبٍ مِنَ الْبَعْثِ فَإِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ تُرَابٍ ثُمَّ مِنْ نُطْفَةٍ ثُمَّ مِنْ عَلَقَةٍ ثُمَّ مِنْ مُضْغَةٍ مُخَلَّقَةٍ وَغَيْرِ مُخَلَّقَةٍ لِنُبَيِّنَ لَكُمْ وَنُقِرُّ فِي الْأَرْحَامِ مَا نَشَاءُ إِلَى أَجَلٍ مُسَمًّى ثُمَّ نُخْرِجُكُمْ طِفْلًا ثُمَّ لِتَبْلُغُوا أَشُدَّكُمْ وَمِنْكُمْ مَنْ يُتَوَفَّى وَمِنْكُمْ مَنْ يُرَدُّ إِلَى أَرْذَلِ الْعُمُرِ لِكَيْلَا يَعْلَمَ مِنْ بَعْدِ عِلْمٍ شَيْئًا وَتَرَى الْأَرْضَ هَامِدَةً فَإِذَا أَنْزَلْنَا عَلَيْهَا الْمَاءَ اهْتَزَّتْ وَرَبَتْ وَأَنْبَتَتْ مِنْ كُلِّ زَوْجٍ بَهِيجٍ-

‘হে মানুষ! যদি তোমরা পুনরুত্থান সম্পর্কে সন্দেহে পতিত হও, তবে (ভেবে দেখ) আমরা তোমাদেরকে (প্রথমে) মাটি থেকে সৃষ্টি করেছি (অর্থাৎ আদমকে)। অতঃপর (পিতা-মাতার মিশ্রিত) শুক্র হ’তে; অতঃপর জমাট রক্তপিন্ড হ’তে; অতঃপর পূর্ণাকৃতি বা অপূর্ণাকৃতি বিশিষ্ট গোশতপিন্ড হ’তে; তোমাদেরকে (আমার সৃষ্টিক্ষমতা) বুঝিয়ে দেবার জন্য। অতঃপর আমরা তা মাতৃগর্ভে রেখে দেই নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত যা আমরা ইচ্ছা করি। অতঃপর আমরা তোমাদেরকে শিশুরূপে বের করে আনি। যাতে তোমরা পরিণত বয়সে উপনীত হ’তে পার। অতঃপর তোমাদের কারো মৃত্যু ঘটানো হয় ও কাউকে কর্মশক্তিহীন বয়স পর্যন্ত পৌঁছানো হয়। যখন সে তার জানা বিষয়েও জ্ঞান রাখে না। আর (দ্বিতীয় প্রমাণ) তুমি যমীনকে দেখ শুষ্ক বিরাণভূমি। অতঃপর যখন আমরা তাতে বৃষ্টি বর্ষণ করি, তখন তা সতেজ হয়, স্ফীত হয় এবং তা থেকে চোখ জুড়ানো উদ্ভিদসমূহ উদগত হয়’ (হজ্জ ২২/৫)

অত্র আয়াতে মানুষের নিষ্কর্মা বয়স ও জ্ঞানহারা সময়ের কথা উল্লেখ করে মহান আল্লাহ প্রবীণদের জরাগ্রস্ততাকে বুঝিয়েছেন। মানুষের যখন বয়স বেশী হয় তখন সে أَرْذَلِ الْعُمُرِ বা জরাগ্রস্ত বয়সে এসে পৌঁছে। আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন,وَاللهُ خَلَقَكُمْ ثُمَّ يَتَوَفَّاكُمْ وَمِنْكُمْ مَنْ يُرَدُّ إِلَى أَرْذَلِ الْعُمُرِ لِكَيْ لَا يَعْلَمَ بَعْدَ عِلْمٍ شَيْئًا إِنَّ اللهَ عَلِيمٌ قَدِيرٌ ‘আল্লাহ তোমাদের সৃষ্টি করেন। অতঃপর তোমাদের মৃত্যু ঘটান। আর তোমাদের মধ্যে কেউ পৌঁছে যায় জরাগ্রস্ত বয়সে। ফলে জানার পরেও সে আর কিছুই জানবে না (অর্থাৎ জানা জিনিস ভুলে গিয়ে শিশুর মত হয়ে যাবে)। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান’ (নাহল ১৬/৭০)

এই বৃদ্ধ বয়সের দুর্বলতা ও শুভ্র-সাদা চুলের অবস্থার বর্ণনা দিয়ে মহান আল্লাহ বলেন,

اللهُ الَّذِيْ خَلَقَكُمْ مِنْ ضَعْفٍ ثُمَّ جَعَلَ مِنْ بَعْدِ ضَعْفٍ قُوَّةً ثُمَّ جَعَلَ مِنْ بَعْدِ قُوَّةٍ ضَعْفًا وَشَيْبَةً يَخْلُقُ مَا يَشَاءُ وَهُوَ الْعَلِيْمُ الْقَدِيْرُ-

‘তিনিই আল্লাহ, যিনি তোমাদের সৃষ্টি করেন দুর্বল অবস্থায়। অতঃপর দুর্বলতার পর শক্তি দান করেন। অতঃপর শক্তির পর দেন দুর্বলতা ও বার্ধক্য। তিনি যা চান তাই সৃষ্টি করেন। তিনিই সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান’ (রূম ৩০/৫৪)

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, عُمْرُ أُمَّتِيْ مِنْ سِتِّيْنَ سَنَةً إِلَى سَبْعِيْنَ سَنَة، ‘আমার উম্মতের বয়স ৬০ থেকে ৭০ বছর’।[2] তবে এটা দ্বারা বৃদ্ধ বয়সের শুরু ও শেষ বুঝানো হয়নি। কারণ বিভিন্ন দেশের আবহাওয়ার কারণে বার্ধক্যও ভিন্ন বয়সে আসতে পারে।

ইসলামে প্রবীণদের মর্যাদা :

আল্লাহ তা‘আলা বনী আদমকে সম্মানিত করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন,وَلَقَدْ كَرَّمْنَا بَنِيْ آدَمَ وَحَمَلْنَاهُمْ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ وَرَزَقْنَاهُمْ مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَفَضَّلْنَاهُمْ عَلَى كَثِيْرٍ مِمَّنْ خَلَقْنَا تَفْضِيلًا- ‘আমরা আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি এবং তাদেরকে স্থলে ও সাগরে চলাচলের বাহন দিয়েছি। আর আমরা তাদেরকে পবিত্র রূযী দান করেছি এবং যাদেরকে আমরা সৃষ্টি করেছি তাদের অনেকের উপর আমরা তাদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি’ (বনী ইসরাঈল ১৭/৭০)

শুভ্রকেশী প্রবীণদের  মর্যাদা : শুভ্র কেশ বিশিষ্ট মুসলিমের বিশেষ মর্যাদার কথা রাসূল (ছাঃ) বর্ণনা করেছেন। আমর বিন শু‘আইব তার পিতা ও দাদা থেকে বর্ণনা করেন,

 نَهَى رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنْ نَتْفِ الشَّيْبِ، وَقَالَ : هُوَ نُوْرُ الْمُؤْمِنِ، وَقَالَ : مَا شَابَ رَجُلٌ فِي الْإِسْلاَمِ شَيْبَةً، إِلاَّ رَفَعَهُ اللهُ بِهَا دَرَجَةً، وَمُحِيَتْ عَنْهُ بِهَا سَيِّئَةٌ، وَكُتِبَتْ لَهُ بِهَا حَسَنَةٌ-

‘রাসূল (ছাঃ) সাদা চুল উঠাতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেছেন, এটা মুমিনের নূর। তিনি আরো বলেন, ইসলামে যদি কেউ সাদা চুল বিশিষ্ট হয় আল্লাহ তার একটি মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন, একটি পাপ মোচন করে দেন এবং একটি পুণ্য লিখে দেন’।[3] রাসূল (ছাঃ) বলেন,مَنْ شَابَ شَيْبَةً فِي الْإِسْلاَمِ كَانَتْ لَهُ نُوْرًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ، ‘যে মুসলিম সাদা চুল বিশিষ্ট হবে, ক্বিয়ামতের দিন এটা তার জন্য জ্যোতি বা আলো হবে’।[4]

প্রবীণদের দ্বারা সাহায্যপ্রাপ্ত হওয়া : রাসূল (ছাঃ) বলেন, اَلْبَرَكَةُ مَعَ أَكَابِرِكُمِ، ‘প্রবীণদের সাথেই তোমাদের কল্যাণ, বরকত রয়েছে’।[5] অন্যত্র রাসূল (ছাঃ) বলেন,ابْغُوْنِي الضَّعِيفَ فَإِنَّكُمْ إِنَّمَا تُرْزَقُوْنَ وَتُنْصَرُوْنَ بِضُعَفَائِكُمْ، ‘তোমরা আমাকে দুর্বলদের মাঝে খোঁজ কর। কেননা তোমাদের মধ্যে যারা দুর্বল তাদের অসীলায় তোমরা রিযিক ও সাহায্য প্রাপ্ত হয়ে থাক’।[6] তিনি আরো বলেন,إِنَّمَا يَنْصُرُ اللهُ هَذِهِ الْأُمَّةَ بِضَعِيْفِهَا بِدَعْوَتِهِمْ وَصَلَاتِهِمْ وَإِخْلَاصِهِمْ، ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা এই উম্মতকে তাদের দুর্বল লোকদের দো‘আ, ছালাত ও ইখলাছের মাধ্যমে সাহায্য করে থাকেন’।[7] কারণ দুর্বলদের ইবাদতে ও দো‘আয় প্রবল একনিষ্ঠতা থাকে, থাকে দুনিয়ার সৌন্দর্য থেকে অন্তরের পরিচ্ছন্নতা। তাদের আগ্রহ, মনোযোগ ও অভিপ্রায় একই দিকে হয়ে থাকে। সেকারণ তাদের দো‘আ কবুল হয়ে থাকে। তাই প্রবীণ যেই হোক না কেন তাকে সর্বাবস্থায় সম্মানের চোখে দেখতে হবে। উপযুক্ত পানাহার, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা, যথাযোগ্য পোষাক ও মানসম্মত আবাসনের ব্যবস্থা করে তাদের কাছ থেকে দো‘আ নেওয়া প্রয়োজন।

অধিক বয়সীদের বিশেষ মর্যাদা : রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,

أَلَا أُنَبِّئُكُمْ بِخَيْرِكُمْ؟ قَالُوا : نَعَمْ يَا رَسُوْلَ اللهِ قَالَ : خِيَارُكُمْ أَطْوَلُكُمْ أَعْمَارًا، وَأَحْسَنُكُمْ أَعْمَالاً-

‘আমি কি তোমাদের মধ্যে উত্তম ব্যক্তির সংবাদ দিব না? তারা বলল, হ্যাঁ আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! তিনি বললেন, তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি উত্তম যে দীর্ঘ আয়ু লাভ করে এবং সুন্দর আমল করে’।[8] অন্য হাদীছে রয়েছে, জনৈক ব্যক্তি প্রশ্ন করল,

يَا رَسُوْلَ اللهِ أَيُّ النَّاسِ خَيْرٌ؟ قَالَ : مَنْ طَالَ عُمْرُهُ وَحَسُنَ عَمَلُهُ، قَالَ : فَأَيُّ النَّاسِ شَرٌّ؟ قَالَ : مَنْ طَالَ عُمْرُهُ وَسَاءَ عَمَلُهُ-

‘হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! উত্তম ব্যক্তি কে? তিনি বললেন, যে দীর্ঘ জীবন পেয়েছে এবং তার আমল সুন্দর হয়েছে। সে আবার প্রশ্ন করল, মানুষের মধ্যে নিকৃষ্ট কে? তিনি বললেন, যে দীর্ঘ জীবন পেয়েছে এবং তার আমল খারাপ হয়েছে’।[9]

রাসূল (ছাঃ) আরো বলেন,إِنَّ مِنْ إِجْلَالِ اللهِ إِكْرَامَ ذِي الشَّيْبَةِ الْمُسْلِمِ ‘নিশ্চয় শুভ্র চুল বিশিষ্ট মুসলিমকে সম্মান করাই আল্লাহকে সম্মান করার শামিল’।[10]

যারবী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আনাস বিন মালিক (রাঃ)-কে আমি বলতে শুনেছি,

جَاءَ شَيْخٌ يُرِيدُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَأَبْطَأَ الْقَوْمُ عَنْهُ أَنْ يُوَسِّعُوا لَهُ فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَيْسَ مِنَّا مَنْ لَمْ يَرْحَمْ صَغِيْرَنَا وَيُوَقِّرْ كَبِيْرَنَا-

‘একজন বয়স্ক লোক রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে দেখা করতে আসল। লোকেরা তার জন্য পথ ছাড়তে বিলম্ব করে। তা দেখে রাসূল (ছাঃ) বললেন, যে ব্যক্তি আমাদের ছোটদের স্নেহ করে না এবং আমাদের বড়দের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে না সে আমাদের দলভুক্ত নয়’।[11]

তালহা বিন ওবায়দুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, দু’জন মুসলমানের মধ্যে একজন শহীদ হ’ল এবং অপরজন এক বছর পরে মারা গেল। তালহা (রাঃ) স্বপ্নে দেখলেন, পরে মারা যাওয়া লোকটি শহীদের আগে জান্নাতে চলে গেল। তারা বিস্মিত হয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট ঘটনাটি বর্ণনা করলেন। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন,

أَلَيْسَ قَدْ مَكَثَ هَذَا بَعْدَهُ سَنَةً قَالُوْا بَلَى قَالَ وَأَدْرَكَ رَمَضَانَ فَصَامَ وَصَلَّى كَذَا وَكَذَا مِنْ سَجْدَةٍ فِي السَّنَةِ قَالُوْا بَلَى قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَمَا بَيْنَهُمَا أَبْعَدُ مِمَّا بَيْنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ-

তিনি বললেন, অপর লোকটি কি তারপর এক বছর বেঁচে থাকেনি? ‘ছাহাবীগণ বললেন, হ্যাঁ। রাসূল (ছাঃ) এও বলেন, সে একটি রামাযান মাস পেয়েছে, ছওম পালন করেছে এবং এক বছর যাবত এত এত ছালাত কি পড়েনি? তারা বলল, হ্যাঁ। তখন আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বললেন, আসমান-যমীনের মধ্যে যে ব্যবধান রয়েছে তাদের দু’জনের মধ্যে তার চেয়ে অধিক ব্যবধান রয়েছে’।[12] অত্র হাদীছ দ্বারা বুঝা যায়, বয়স বেশী পেয়ে বেশী ইবাদত করে শহীদের চেয়েও অগ্রগামী হওয়া সম্ভব।

ইবাদতে বিশেষ মর্যাদা : প্রবীণদের ইবাদতের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। যেহেতু শেষ ভাল যার সব ভাল তার। সাহল বিন সা‘দ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, কোন এক যুদ্ধে এক ছাহাবী বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করছিল। এক পর্যায়ে রাসূল (ছাঃ) বললেন, কেউ যদি কোন জাহান্নামীকে দেখতে চায় তবে সে যেন এই ব্যক্তির দিকে লক্ষ্য করে। এ কথা শুনে এক লোক তার পিছু নিয়ে দেখল, মুশরিকদের আঘাতে তার শরীরে ক্ষতের সৃষ্টি হওয়ায় সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করল। এজন্যই  রাসূল (ছাঃ) বললেন,

إِنَّ الْعَبْدَ لَيَعْمَلُ عَمَلَ أَهْلِ النَّارِ وَإِنَّهُ مِنْ أَهْلِ الْجَنَّةِ وَيَعْمَلُ عَمَلَ أَهْلِ الْجَنَّةِ وَإِنَّهُ مِنْ أَهْلِ النَّارِ وَإِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالْخَوَاتِيمِ-

‘কোন বান্দা জহান্নামীদের কাজ করে অথচ সে জান্নাতী। আবার কেউ জান্নাতীদের কাজ করে অথচ সে জাহান্নামী। নিশ্চয়ই শেষ আমলের উপরই পরিণাম নির্ভরশীল’।[13]  সেহেতু শেষ বয়সে ইবাদতের মাত্রা যথাসাধ্য বাড়িয়ে দিতে হবে। কারণ এ সময় ইবাদতে অনীহা এসে যাওয়ার ফলে কাফির হয়ে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

আব্দুল্লাহ বিন মাস‘ঊদ (রাঃ) বলেন,

قَرَأَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ النَّجْمَ بِمَكَّةَ فَسَجَدَ فِيْهَا وَسَجَدَ مَنْ مَعَهُ غَيْرَ شَيْخٍ أَخَذَ كَفًّا مِنْ حَصًى أَوْ تُرَابٍ فَرَفَعَهُ إِلَى جَبْهَتِهِ وَقَالَ يَكْفِيْنِي هَذَا فَرَأَيْتُهُ بَعْدَ ذَلِكَ قُتِلَ كَافِرًا-

‘নবী করীম (ছাঃ) মক্কায় সূরা নাজম তিলাওয়াত করে সিজদা করলেন। তখন এক বৃদ্ধ ব্যতীত সকলেই সিজদা করল। সে এক মুষ্টি কংকর বা মাটি তুলে নিয়ে তাতে কপাল ঠেকাল এবং বলল, আমার জন্য এরূপ করাই যথেষ্ট। ইবনে মাস‘ঊদ (রাঃ) বললেন, পরবর্তীকালে আমি তাকে কাফের অবস্থায় নিহত হ’তে দেখেছি’।[14]

প্রবীণ পিতা-মাতার প্রতি করণীয় : মহান আল্লাহ পিতা-মাতার প্রতি যথাযোগ্য মর্যাদা প্রদানের নির্দেশ দিয়ে বলেন,

وَقَضَى رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِنْدَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلَاهُمَا فَلَا تَقُلْ لَهُمَا أُفٍّ وَلَا تَنْهَرْهُمَا وَقُلْ لَهُمَا قَوْلًا كَرِيمًا, وَاخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ وَقُلْ رَبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيْرًا-

‘আর তোমার প্রতিপালক আদেশ করেছেন যে, তোমরা তাঁকে ছাড়া অন্য কারু উপাসনা করো না এবং তোমরা পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণ কর। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়ে যদি তোমার নিকট বার্ধক্যে উপনীত হন, তাহ’লে তুমি তাদের প্রতি উহ শব্দটিও কর না এবং তাদেরকে ধমক দিয়ো না। আর তাদের সাথে নরমভাবে কথা বল। আর তাদের প্রতি মমতাবশে নম্রতার পক্ষপুট অবনমিত কর এবং বল, হে আমার প্রতিপালক! তুমি তাদের প্রতি দয়া কর যেমন তারা আমাকে ছোটকালে দয়াবশে প্রতিপালন করেছিলেন’ (বনী ইসরাঈল ১৭/২৩-২৪)

অনেক সন্তান বৃদ্ধ পিতা-মাতার সাথে খারাপ আচরণ করে থাকে। এমনকি মারধর পর্যন্ত করে। স্ত্রীকে খুশী করার জন্য বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে অচেনা জায়গায় ফেলে আসা, দূরপাল্লার গাড়ীতে তুলে দিয়ে পালিয়ে আসা, ডাক্তার দেখানোর কথা বলে জমি দলীল করে নিয়ে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় বের করে দেয়া, হাসপাতালে ভর্তির কথা বলে বৃদ্ধাশ্রম নামক কারাগারে বন্দী করে রাখার মতো ন্যক্কারজনক ঘটনার কথা মাঝে-মধ্যে পত্র-পত্রিকায় দেখা যায়। অথচ মহান আল্লাহর নির্দেশ হ’ল তাদের সাথে এমন আচরণ তো দূরের কথা ‘উহ’ শব্দও করা যাবে না। বরং শ্রদ্ধাভরে নম্রভাবে তাদের সাথে কথা বলতে হবে। সর্বক্ষণ তাদের জন্য আল্লাহর শেখানো দো‘আ করতে হবে; যেন তাদের উভয়ের প্রতি মহান আল্লাহ রহম করেন।

পিতা-মাতার হক বুঝাতে নিম্নোক্ত হাদীছটির প্রতিও লক্ষ্য করা যেতে পারে। আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন,

جَاءَ رَجُلٌ إِلَى رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ يَا رَسُوْلَ اللهِ مَنْ أَحَقُّ النَّاسِ بِحُسْنِ صَحَابَتِيْ قَالَ أُمُّكَ قَالَ ثُمَّ مَنْ قَالَ ثُمَّ أُمُّكَ قَالَ ثُمَّ مَنْ قَالَ ثُمَّ أُمُّكَ قَالَ ثُمَّ مَنْ قَالَ ثُمَّ أَبُوْكَ-

‘এক লোক রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট এসে জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসূল! আমার কাছে কে উত্তম ব্যবহার পাওয়ার বেশী হকদার? তিনি বললেন, তোমার মা। সে বলল, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। সে বলল, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার  মা। সে বলল, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার পিতা’।[15]

এ পর্যন্তই শেষ নয়; পিতা-মাতা অমুসলিম হ’লেও তাদের সাথে সু-সম্পর্ক বজায় রাখার নির্দেশ ইসলামে রয়েছে। যেমন আসমা বিনতে আবু বকর (রাঃ) বলেন,

قَدِمَتْ عَلَيَّ أُمِّيْ وَهِيَ مُشْرِكَةٌ فِيْ عَهْدِ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَاسْتَفْتَيْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قُلْتُ وَهِيَ رَاغِبَةٌ أَفَأَصِلُ أُمِّيْ قَالَ نَعَمْ صِلِيْ أُمَّكِ-

‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যুগে আমার মা মুশরিক অবস্থায় আমার নিকট এলেন। আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট ফৎওয়া চেয়ে বললাম, তিনি আমার প্রতি খুবই আকৃষ্ট, আমি কি তার সঙ্গে সদাচরণ করব? তিনি বললেন, হ্যাঁ, তুমি তোমার মায়ের সাথে সদাচরণ কর’।[16]

আমর বিন শু‘আইব তার পিতা ও দাদা থেকে বর্ণনা করেন যে,

أَنَّ رَجُلاً أَتَى النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ يَا رَسُوْلَ اللهِ إِنَّ لِيْ مَالاً وَوَلَدًا وَإِنَّ وَالِدِيْ يَحْتَاجُ مَالِيْ قَالَ أَنْتَ وَمَالُكَ لِوَالِدِكَ إِنَّ أَوْلَادَكُمْ مِنْ أَطْيَبِ كَسْبِكُمْ، فَكُلُوْا مِنْ كَسْبِ أَوْلَادِكُمْ-

‘একজন লোক রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমার সম্পদ ও সন্তান আছে। আমার পিতা আমার সম্পদের মুখাপেক্ষী। তিনি বললেন, তুমি ও তোমার সম্পদ উভয়ই তোমার পিতার। তোমাদের সন্তান তোমাদের জন্য সর্বোত্তম উপার্জন। সুতরাং তোমরা তোমাদের সন্তানের উপার্জন থেকে খাও’।[17]

প্রবীণদের যথাযথ শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করা মুসলমানদের দায়িত্ব। তাদের প্রয়োজন পূরণ করা সকলের কর্তব্য। বিশেষ করে নিকটাত্মীয়দের এটা মানবিক দায়িত্বও বটে। এমনকি কেউ যদি মনে করে যে, আমার উপার্জিত সম্পদ আমারই, পিতা-মাতাকে কেন দিব? এর জবাব রাসূল (ছাঃ) আগেই দিয়ে রেখেছেন, ‘তুমি ও তোমার সম্পদ সবই তোমার পিতার’। সুতরাং তাদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নিতে সন্তান বাধ্য।

চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন : সাধারণত প্রবীণদের অসুস্থতার চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে তার সন্তান-সন্ততি অথবা আত্মীয়-স্বজন। কারো যদি দায়িত্ব গ্রহণ করার মত আত্মীয় না থাকে তবে এলাকার সমাজপতি, মেম্বার, চেয়ারম্যান অথবা যে কোন বিত্তশালী ব্যক্তি দায়িত্ব গ্রহণ করবে। তবে বার্ধক্যের কোন ঔষধ নেই। যেমন ওসামা বিন শারীক বলেন,

قَالَتِ الْأَعْرَابُ يَا رَسُوْلَ اللهِ أَلَا نَتَدَاوَى قَالَ نَعَمْ يَا عِبَادَ اللهِ تَدَاوَوْا فَإِنَّ اللهَ لَمْ يَضَعْ دَاءً إِلاَّ وَضَعَ لَهُ شِفَاءً أَوْ قَالَ دَوَاءً إِلاَّ دَاءً وَاحِدًا قَالُوْا يَا رَسُوْلَ اللهِ وَمَا هُوَ قَالَ الْهَرَمُ-

‘বেদুঈনরা বলেছিল, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা কি চিকিৎসা গ্রহণ করব না? তিনি বললেন, হ্যঁা, আল্লাহর বান্দারা! চিকিৎসা গ্রহণ কর। কারণ আল্লাহ এমন কোন রোগ সৃষ্টি করেননি যার চিকিৎসা বা ঔষধ তৈরী করেননি। তবে একটি রোগ ব্যতীত। তারা বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! সেটা কি? তিনি বললেন, বার্ধক্য’।[18] কিন্তু তাই বলে বৃদ্ধদের বিনা চিকিৎসায় ফেলে রাখা যাবে না। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

সালামে অগ্রাধিকার : রাসূল (ছাঃ) বলেন,يُسَلِّمُ الصَّغِيْرُ عَلَى الْكَبِيْرِ وَالْمَارُّ عَلَى الْقَاعِدِ وَالْقَلِيلُ عَلَى الْكَثِيْرِ- ‘ছোটরা বড়দের, চলমান ব্যক্তি বসা ব্যক্তিকে এবং কম সংখ্যক বেশী সংখ্যককে সালাম প্রদান করবে’।[19]

ছালাত আদায়ে বিশেষ সুবিধা প্রদান : দাঁড়িয়ে ছালাত আদায় করতে অক্ষম প্রবীণ ব্যক্তিদের সুবিধাজনকভাবে ছালাত আদায়ের অনুমতি প্রদান করেছে ইসলাম। ইমরান বিন হুসাইন (রাঃ) বলেন, আমি অর্শ্ব রোগে ভুগছিলাম। এমতাবস্থায় রাসূল (ছাঃ)-কে ছালাত আদায় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন,صَلِّ قَائِمًا فَإِنْ لَمْ تَسْتَطِعْ فَقَاعِدًا فَإِنْ لَمْ تَسْتَطِعْ فَعَلَى جَنْبٍ، ‘দাঁড়িয়ে ছালাত আদায় কর। যদি অক্ষম হও তবে বসে পড়। যদি তাতেও অক্ষম হও তবে শুয়ে শুয়ে পড়’।[20] এমনকি প্রবীণদের সম্মানে রাসূল (ছাঃ) ইমামকে ছালাত সংক্ষিপ্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন। আবূ মাস‘ঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,

أَنَّ رَجُلاً قَالَ وَاللهِ يَا رَسُوْلَ اللهِ إِنِّي لَأَتَأَخَّرُ عَنْ صَلاَةِ الْغَدَاةِ مِنْ أَجْلِ فُلَانٍ مِمَّا يُطِيْلُ بِنَا فَمَا رَأَيْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي مَوْعِظَةٍ أَشَدَّ غَضَبًا مِنْهُ يَوْمَئِذٍ ثُمَّ قَالَ إِنَّ مِنْكُمْ مُنَفِّرِيْنَ فَأَيُّكُمْ مَا صَلَّى بِالنَّاسِ فَلْيَتَجَوَّزْ فَإِنَّ فِيْهِمْ الضَّعِيْفَ وَالْكَبِيْرَ وَذَا الْحَاجَةِ-

‘একজন ব্যক্তি এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আল্লাহর কসম আমি অমুকের কারণে ফজরের ছালাতে অনুপস্থিত থাকি। তিনি ছালাতকে খুব দীর্ঘ করেন। আবূ মাসউদ (রাঃ) বলেন, আমি আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-কে নছীহত করতে গিয়ে সেদিনের ন্যায় এত অধিক রাগান্বিত হ’তে কখনো দেখিনি। অতঃপর তিনি বলেন, তোমাদের মাঝে বিতাড়নকারী বা বিরক্তকারী রয়েছে। তোমাদের মধ্যে যে কেউ ছালাতে ইমামতি করবে, সে যেন সংক্ষেপ করে। কেননা তাদের মধ্যে দুর্বল, বৃদ্ধ ও হাজতওয়ালা লোকও  থাকে’।[21]

ইমামতিতে অগ্রাধিকার : ইমাম হওয়ার দিক দিয়ে রাসূল (ছাঃ) প্রবীণদের অগ্রাধিকার দিয়েছেন। আবূ মাসঊদ (রাঃ) বলেন,

قَالَ لَنَا رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَؤُمُّ الْقَوْمَ أَقْرَؤُهُمْ لِكِتَابِ اللهِ وَأَقْدَمُهُمْ قِرَاءَةً فَإِنْ كَانَتْ قِرَاءَتُهُمْ سَوَاءً فَلْيَؤُمَّهُمْ أَقْدَمُهُمْ هِجْرَةً فَإِنْ كَانُوْا فِي الْهِجْرَةِ سَوَاءً فَلْيَؤُمَّهُمْ أَكْبَرُهُمْ سِنًّا-

‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদেরকে বললেন, আল্লাহর কিতাব কুরআন মাজীদের জ্ঞান যার সবচেয়ে বেশী এবং যে কুরআন তিলাওয়াতও সুন্দরভাবে করতে পারে, সে-ই ছালাতের জামা‘আতে ইমামতি করবে। সুন্দর কিরাআতের ব্যাপারে সবাই যদি সমান হয় তাহ’লে তাদের মধ্যে যে হিজরতে অগ্রগামী সে ইমামতি করবে। হিজরতের ব্যাপারেও সবাই যদি সমান হয় তাহ’লে তাদের মধ্যে যে বয়সে প্রবীণ সেই ইমামতি করবে’।[22]

ছওম পালনের ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা প্রদান : অতি বৃদ্ধ বা প্রবীণ ব্যক্তি ছওম পালনে অক্ষম হ’লে প্রতিদিনের ছওমের বিনিময়ে একজন করে মিসকীনকে খাদ্য খাওয়াবে। আত্বা (রহঃ) বলেন, তিনি ইবনু আববাস (রাঃ)- কে পাঠ করতে শুনেছেন যে, তিনি পাঠ করছিলেন,

وَعَلَى الَّذِينَ يُطَوَّقُونَهُ فَلاَ يُطِيقُونَهُ فِدْيَةٌ طَعَامُ مِسْكِينٍ قَالَ ابْنُ عَبَّاسٍ : لَيْسَتْ بِمَنْسُوخَةٍ هُوَ الشَّيْخُ الكَبِيرُ، وَالمَرْأَةُ الكَبِيرَةُ لاَ يَسْتَطِيعَانِ أَنْ يَصُومَا، فَيُطْعِمَانِ مَكَانَ كُلِّ يَوْمٍ مِسْكِينًا-

‘আর যাদের জন্য এটি (ছিয়াম পালন) খুব কষ্টকর হবে, তারা যেন এর পরিবর্তে একজন করে অভাবীকে খাদ্য দান করে’- এর ব্যাখ্যায় ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, ‘ছিয়াম পালনে অক্ষম বৃদ্ধ-বৃদ্ধার প্রত্যেক দিনের (প্রতিটি ছিয়ামের) পরিবর্তে একজন মিসকীনকে খাদ্য খাওয়ানোর বিধান সম্বলিত উক্ত আয়াতটি রহিত হয়নি’।[23]

হজ্জের ক্ষেত্রে বিশেষ সুযোগ : অক্ষম প্রবীণ বা বৃদ্ধ ব্যক্তির পক্ষ থেকে সক্ষম ব্যক্তির মাধ্যমে হজ্জ করানো ইসলামে বৈধ। ইবনে আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,

جَاءَتْ امْرَأَةٌ مِنْ خَثْعَمَ عَامَ حَجَّةِ الْوَدَاعِ قَالَتْ يَا رَسُوْلَ اللهِ إِنَّ فَرِيْضَةَ اللهِ عَلَى عِبَادِهِ فِي الْحَجِّ أَدْرَكَتْ أَبِيْ شَيْخًا كَبِيْرًا لَا يَسْتَطِيْعُ أَنْ يَسْتَوِيَ عَلَى الرَّاحِلَةِ فَهَلْ يَقْضِيْ عَنْهُ أَنْ أَحُجَّ عَنْهُ قَالَ نَعَمْ-

‘বিদায় হজ্জের বছর খাছ‘আম গোত্রের একজন মহিলা এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর তরফ হ’তে বান্দার উপর যে হজ্জ ফরয হয়েছে তা আমার বৃদ্ধ পিতার উপর এমন সময় ফরয হয়েছে যখন তিনি সওয়ারীর উপর ঠিকভাবে বসে থাকতে পারেন না। আমি তার পক্ষ থেকে হজ্জ করলে তার হজ্জ আদায় হবে কি? তিনি বললেন, হবে’।[24]

রাসূল (ছাঃ)-এর নৈকট্যে অগ্রাধিকার : রাসূল (ছাঃ) বলেন,لِيَلِنِي مِنْكُمْ أُولُو الْأَحْلَامِ وَالنُّهَى ثُمَّ الَّذِيْنَ يَلُوْنَهُمْ ثُمَّ الَّذِيْنَ يَلُوْنَهُمْ- ‘তোমাদের মধ্যকার প্রবীণ ও জ্ঞানী লোকেরা যেন আমার কাছাকাছি দাঁড়ায়। তারপর পর্যায়ক্রমে দাঁড়াবে যারা তাদের কাছাকাছি, তারপর দাঁড়াবে যারা তাদের কাছাকাছি তারা’।[25]

বসার দিক দিয়ে অগ্রাধিকার : ওবায়দুল্লাহ বিন ওমর বলেন,

كُنْتُ عِنْدَ سُلَيْمَانَ بْنِ عَلِيٍّ، فَدَخَلَ شَيْخٌ مِنْ قُرَيْشٍ، فَقَالَ سُلَيْمَانُ : انْظُرَ الشَّيْخَ، فَأَقْعِدْهُ مَقْعَدًا صَالِحًا-

‘আমি সুলায়মান বিন আলীর নিকট ছিলাম। এ সময় কুরাইশ গোত্রের জনৈক প্রবীণ ব্যক্তি প্রবেশ করল। সুলায়মান বললেন, এই প্রবীণ ব্যক্তির দিকে লক্ষ্য কর, তাকে উপযুক্ত আসনে বসাও’।[26]

কথা বলায় অগ্রাধিকার : একবার আব্দুল্লাহ ইবনু সাহ্ল ও মুহাইয়াছা খাদ্যের অভাবে খায়বারে আসেন। ঘটনাক্রমে আব্দুল্লাহ নিহত হ’লে রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট ঘটনাটি বলার জন্য মুহাইয়াছা অগ্রসর হয়। তখন রাসূল (ছাঃ) মুহাইয়াছাকে বললেন, كَبِّرْ كَبِّرْ يُرِيْدُ السِّنَّ ‘বড়কে কথা বলতে দাও বড়কে কথা বলতে দাও। তিনি এতে উদ্দেশ্য করেছেন বয়সে প্রবীণ ব্যক্তিকে’।[27] এতে বুঝা যায়, বৈঠকে কথা বলার সময় বড় বা প্রবীণ ব্যক্তিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

বৃদ্ধ বয়সে প্রবীণদের করণীয় : বৃদ্ধ বয়সে ইবাদতে মশগূল থাকা আবশ্যক। এ সময় অনেকাংশে প্রবীণদের মেজায খিটখিটে থাকে। তাই সর্বদা ইবাদতে মশগূল থাকলে মনের অবস্থা পরিবর্তন হওয়ার রাস্তা খুলে যেতে পারে। এ সময় বেশী বেশী তাসবীহ-তাহলীল, দো‘আ-দরূদ, ইসতিগফার পাঠ করতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا تُوْبُوْا إِلَى اللهِ تَوْبَةً نَصُوْحًا عَسَى رَبُّكُمْ أَنْ يُكَفِّرَ عَنْكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ وَيُدْخِلَكُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ يَوْمَ لَا يُخْزِي اللهُ النَّبِيَّ وَالَّذِيْنَ آمَنُوْا مَعَهُ نُوْرُهُمْ يَسْعَى بَيْنَ أَيْدِيْهِمْ وَبِأَيْمَانِهِمْ يَقُوْلُوْنَ رَبَّنَا أَتْمِمْ لَنَا نُوْرَنَا وَاغْفِرْ لَنَا إِنَّكَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ-

‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর কাছে তওবা কর, খাঁটি তওবা। আশা করা যায়, তোমাদের রব তোমাদের পাপসমূহ মোচন করবেন এবং তোমাদেরকে এমন জান্নাতসমূহে প্রবেশ করাবেন যার পাদদেশে নদীসমূহ প্রবাহিত, নবী ও তার সাথে যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে সেদিন আল্লাহ লাঞ্ছিত করবেন না। তাদের আলো তাদের সামনে ও ডানে ধাবিত হবে। তারা বলবে, ‘হে আমাদের রব! আমাদের জন্য আমাদের আলো পূর্ণ করে দিন এবং আমাদেরকে ক্ষমা করুন; নিশ্চয়ই আপনি সর্ববিষয়ে সর্বক্ষমতাবান’ (তাহরীম ৬৬/৮)

রাসূল (ছাঃ) বলেন,كُلُّ بَنِيْ آدَمَ خَطَّاءٌ وَخَيْرُ الْخَطَّائِيْنَ التَّوَّابُوْنَ،  ‘প্রত্যেক বনী আদমই ভুলকারী। আর উত্তম ভুলকারী হচ্ছে তওবাকারীগণ’।[28] আল্লাহ বলেন,إِنَّ اللهَ يُحِبُّ التَّوَّابِيْنَ وَيُحِبُّ الْمُتَطَهِّرِيْنَ ‘নিশ্চয় আল্লাহ তওবাকারীদেরকে ভালোবাসেন এবং ভালোবাসেন অধিক পবিত্রতা অর্জনকারীদেরকে’ (বাক্বারাহ ২/২২২)

মুস‘আব ইবনু সা‘দ ও আমর ইবনু মায়মূন হ’তে বর্ণিত, তারা উভয়ে বলেন,كَانَ سَعْدٌ يُعَلِّمُ بَنِيْهِ هَؤُلاَءِ الْكَلِمَاتِ كَمَا يُعَلِّمُ الْمُكَتِّبُ الْغِلْمَانَ وَيَقُوْلُ إِنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يَتَعَوَّذُ بِهِنَّ دُبُرَ الصَّلَاةِ- ‘সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাছ (রাঃ) তার সন্তানদেরকে নিম্নোক্ত বাক্যগুলো এমনভাবে শিক্ষা দিতেন, যেমনভাবে মক্তবে শিক্ষক শিশুদেরকে শিক্ষা দেন। আর তিনি বলতেন, রাসূল (ছাঃ) ছালাতের পর এগুলো দ্বারা আল্লাহ তা‘আলার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করতেন,

اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوْذُ بِكَ مِنْ الْجُبْنِ وَأَعُوْذُ بِكَ مِنْ الْبُخْلِ وَأَعُوْذُ بِكَ مِنْ أَرْذَلِ الْعُمُرِ وَأَعُوْذُ بِكَ مِنْ فِتْنَةِ الدُّنْيَا وَعَذَابِ الْقَبْرِ،

‘হে আল্লাহ! তোমার কাছে আমি ভীরুতা হ’তে আশ্রয় চাই, তোমার কাছে কৃপণতা হ’তে আশ্রয় চাই, তোমার কাছে অতি  বার্ধক্যে পৌঁছার বয়স হ’তে আশ্রয় চাই এবং তোমার কাছে দুনিয়ার ঝগড়া-বিবাদ ও কবরের শাস্তি হ’তে আশ্রয় চাই।[29]

এছাড়াও প্রবীণদের কর্তব্য হ’ল আত্মীয়-স্বজনদের যথাসম্ভব খোঁজ-খবর নেওয়া ও দো‘আ করা। যেমন ইবরাহীম (আঃ) বৃদ্ধ অবস্থায় তাঁর ছেলে ইসমাঈল (আঃ)-এর সাথে সাক্ষাত করতে যান। এক সাথে কা‘বা ঘর নির্মাণ করেন এবং তাদের জন্য ও পরবর্তী বংশধরের জন্য দো‘আ করেন।[30]

উপরোক্ত আলোচনায় প্রবীণদের অধিকার ও মর্যাদার সংক্ষিপ্ত বিবরণ পেশ করা হয়েছে। প্রত্যেককে প্রবীণদের অধিকার ও মর্যাদা এবং তাদের প্রতি করণীয় সম্পর্কে সচেতন হ’তে হবে। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে প্রবীণদের যথাযথভাবে সম্মান করার এবং তাদের অধিকার প্রদানের মাধ্যমে জান্নাতবাসী হওয়ার তাওফীক দান করুন-আমীন!

মুহাম্মাদ খায়রুল ইসলাম


[1]. লিসানুল আরব ১২/৬০৭, ১৩/২২২।

[2]. তিরমিযী হা/২৩৩১, সনদ ছহীহ

[3]. আহমাদ হা/৬৯৩৭; আবূদাউদ হা/৪২০২; ইবনু মাজাহ হা/৩৭২১, সনদ ছহীহ

[4]. তিরমিযী হা/১৬৩৪; ইবনে হিববান হা/২৯৮৩।

[5]. ইবনে হিববান হা/৫৫৯ সনদ ছহীহ; হাকেম হা/২১০।

[6]. নাসাঈ হা/৩১৭৯; আবূদাউদ হা/২৫৯৪; আহমাদ হা/২১৭৩১, ছহীহ

[7]. নাসাঈ হা/৩১৭৮, সনদ ছহীহ।

[8]. আহমাদ হা/৭২১২, ইবনু হিববান হা/৩০৪৩, সনদ ছহীহ।

[9]. তিরমিযী হা/২৩৩০, সনদ ছহীহ।

[10]. আবূদাউদ হা/৪৮৪৩, সনদ হাসান।

[11]. তিরমিযী হা/১৯১৯, সনদ ছহীহ

[12]. ইবনু মাজাহ হা/৩৯২৫; ছহীহুল জামে‘ হা/১৩১৬।

[13]. বুখারী হা/৬৬০৭।

[14]. বুখারী হা/১০০৫

[15]. বুখারী হা/৫৯৭১; মুসলিম হা/২৫৪৮

[16]. বুখারী হা/২৬২০; মুসলিম হা/১০০৩।

[17]. আবূদাউদ হা/৩৫৩০; ইবনু মাজাহ হা/২২৯২, সনদ ছহীহ।

[18]. তিরমিযী হা/২০৩৮, সনদ ছহীহ

[19]. বুখারী হা/৬২৩১।

[20]. বুখারী হা/১১১৭।

[21]. বুখারী হা/৭০২।

[22]. মুসলিম হা/৬৭৩।

[23]. বুখারী হা/৪৫০৫।

[24]. বুখারী হা/১৮৫৪; মুসলিম হা/১৩৩৫।

[25]. মুসলিম হা/৪৩২; আবূদাউদ হা/৬৭৪

[26]. আহমাদ হা/৪৬০, হাসান লি গায়রিহী।

[27]. বুখারী হা/৭১৯২; মুসলিম হা/৩১৬০

[28]. ইবনু মাজাহ হা/৪২৫১; তিরমিযী হা/২৪৯৯, হাসান।

[29]. বুখারী হা/২৮২২।

[30]. বুখারী হা/৩৩৬৪

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button