পরিবার ও দাম্পত্য

শিশু প্রতিপালন : কতিপয় পরামর্শ

আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। ‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে’। শৈশব ও কৈশোর শিশুর মানুষের মতো মানুষ হয়ে গড়ে ওঠার সময়। এ সময়ে শিশুকে প্রশিক্ষণ দিতে ইসলাম অভিভাবককে আদেশ দেয় ও উদ্বুদ্ধ করে। সন্তান মানুষের উৎকৃষ্টতম সম্পদ, অমূল্য ধন এবং পিতার নিকট রাখা এক আমানত। যার প্রতি অবজ্ঞা, অবহেলা ও অনবধানতা ইসলাম আদৌ পসন্দ ও বৈধ করে না। কারণ সন্তানরা সবাই ভবিষ্যতের নাগরিক, মুসলিম সমাজের এক একটা সভ্য। তারাই আগামী দিনের আল্লাহর প্রিয় বান্দা এবং এ পৃথিবীর শান্তিপ্রিয় ও উন্নত মানুষ।

প্রত্যেক পিতা-মাতারই প্রয়াস থাকে যে, তাদের সন্তানরা যেন কোন প্রকার কষ্ট না পায়। পৃথিবীতে ধন-ঐশ্বর্যের মাঝে মাথা উঁচু করে বসবাস করে। অন্ততঃপক্ষে তাদের কোন প্রকার অভাব-অনটন না দেখা দেয়। পার্থিব সীমিত ও ক্ষণস্থায়ী জীবনে সন্তানের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের কথা চিন্তা করলেও পরকালীন অনন্ত জীবনে সন্তান সুখে থাক এ চিন্তা পিতা-মাতা কমই করে থাকেন। অথচ এ কথা পিতা-মাতাকে সর্বাগ্রে খেয়াল রাখা প্রয়োজন ছিল। সন্তানরা যাতে পরকালে কোন কষ্ট না পায়, সেদিকে লক্ষ্য রাখা প্রত্যেক পিতা-মাতারই কর্তব্য।

মহান আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে বলেছেন,  يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا قُوْا أَنْفُسَكُمْ وَأَهْلِيْكُمْ نَاراً وَقُوْدُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُ- ‘হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে সেই জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা কর, যার ইন্ধন মানুষ ও পাথর’ (তাহ্রীম ৬৬/৬)।

ইহজগতে পিতামাতা সচেষ্ট থাকে, যাতে সন্তান শীত-গ্রীষ্মে কষ্ট না পায়। এমনকি দুর্ঘটনাক্রমে লেগে যাওয়া আগুন থেকে সন্তানকে রক্ষার জন্য পিতামাতা জীবন বিলিয়ে দেয়। কিন্তু তারা জাহান্নামের মহা অগ্নি হ’তে সন্তানকে রক্ষা করতে ততটা যত্নবান নয়! যদিও সে আগুন দুনিয়ার আগুন থেকে ৭০ গুণ অধিক দাহিকাশক্তি সম্পন্ন (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত, হা/৫৪২১)  এবং যেখানে কোন বিনিময়ে কাউকে রক্ষা করা আদৌ সম্ভব নয়। মূলত নিজেকে, নিজের পরিবারকে ও সন্তান-সন্ততিকে  উত্তম  জ্ঞান  শিক্ষা এবং তাদেরকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার মাধ্যমে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।

নরম কাঁদা মাটি সদৃশ শিশুরা শৈশবে যে পরিবেশে বেড়ে উঠে, তার প্রভাব তার জীবনে স্থায়ী হয়ে যায়। এ কারণে পরিবার হচ্ছে শিশুর প্রথম বিদ্যালয়। এ সময় মাতা-পিতা নিজেদের ব্যক্তিত্ব দিয়ে এবং ধর্মীয় নির্দেশনার মাধ্যমে তাদের প্রতিপালন করবেন।

মানব শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এক্ষেত্রে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি হ’ল ব্যক্তিত্বের যথাযথ বিকাশের মাধ্যমে ইনসানে কামেল বা পরিপূর্ণ মানুষে পরিণত করা। তাই জন্ম পরবর্তী সময় তো বটেই, জন্মপূর্ব কালেও ইসলাম বিভিন্নভাবে নির্দেশনা প্রদান করেছে। জন্ম-পূর্ববর্তীকালের দায়িত্ব-কর্তব্য হ’ল একটি সুশৃঙ্খল পরিবার গড়ে তোলা। আর জন্ম-পরবর্তীকালে নবজাতকের প্রশিক্ষণের ব্যাপারেও ইসলাম দিয়েছে যথোপযুক্ত দিক-নির্দেশনা। মানুষের জীবনকালকে পাঁচটি পর্যায়ে ভাগ করা যেতে পারে। যেমন- শৈশব, কৈশোর, যৌবন, মধ্যবয়স এবং বার্ধক্যকাল। এখানে প্রথম তিনটি পর্যায় নিয়ে আলোচনা করব। মানব শিশুর বেড়ে ওঠার প্রাথমিক কালগুলোকে সাধারণত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পর্বে ভাগ করা যায়।

  •  শিশুরা প্রথম সাত বছরে হ’ল স্বাধীন,

 

  •  দ্বিতীয় সাত বছরে হ’ল আনুগত্যকারী
  •  তৃতীয় সাত বছরে হ’ল দায়িত্বশীল।

 

একুশ বছর বয়স পর্যন্ত একটি সন্তানের বেড়ে ওঠার পর্বগুলোকে শিশুকাল, কিশোরকাল এবং যৌবনকালের বৃত্তে ফেলা যেতে পারে। শিশুকালটিকে যদি কর্তৃত্বের অর্থে ধরে নিই, তাহ’লে তার অর্থ দাঁড়াবে, শিশু এ সময় যা খুশি তা-ই করবে। এ সাত বছর শিশু সম্পূর্ণ স্বাধীন। তার সকল কর্তৃত্ব মেনে নিতে হবে। এভাবেই শিশু সাত বছর কাটিয়ে দ্বিতীয় সাত তথা আনুগত্য ও আদেশ পালন করার পর্বে উপনীত হবে। এ পর্বে শিশুকে আর স্বাধীনভাবে কর্তৃত্ব করতে দেয়া যাবে না। বরং তাকে বাবা-মা বা অন্যান্য গুরুজনদের কথা মেনে চলতে হবে। এ সময় থেকে চৌদ্দ বছর পর্যন্ত যদি একটি শিশু যথাযথ নির্দেশনা মেনে বেড়ে ওঠে, তাহ’লে তৃতীয় সাত বছর অর্থাৎ একুশ বছর বয়সকাল পর্যন্ত শিশুটি হয়ে উঠতে পারে সংসার পরিচালনায় বাবা-মায়ের একজন যথার্থ সহযোগী। এ পর্ব তিনটিতে সন্তানদের প্রশিক্ষণ এবং বাবা-মায়ের করণীয় আরো পরিস্কারভাবে ফুটে উঠেছে। সন্তানদেরকে সাত বছর পর্যন্ত খেলাধূলা করতে দেওয়া, পরবর্তী সাত বছর তাদেরকে সংশোধনীমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং পরবর্তী সাত বছর তাদেরকে পরামর্শদাতা ও সহযাত্রী হিসাবে তৈরি করা। জীবনের প্রথম সাতটি বছরে একটি শিশুর অনুধাবনশক্তি ও স্মৃতিশক্তি থাকে একেবারেই অপক্ক। তার শারীরিক অবস্থাও থাকে অত্যন্ত নাজুক পর্যায়ে। তাই এ সময়টায় বাবা-মায়ের উচিত সন্তানের প্রতি সদয় ও সহানুভূতিশীল আচরণ করা। তার চাহিদাগুলোকে সাধ্যমতো পূরণ করা এবং তাঁর জিজ্ঞাসাগুলোর ইতিবাচক জবাব দেয়া।

জীবনের প্রাথমিক পর্বের বছরগুলো যেকোন মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রভাব সৃষ্টিকারী। কারণ এ সময়টাই মানুষের ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠার সময়। অতীতে মনে করা হ’ত যে, শৈশবে একটি শিশুর শারীরিক সুস্থতার প্রতিই কেবল মনোযোগী হওয়া দরকার। এর বাইরে শিশুর আবেগ-অনুভূতি, সামাজিকতা এবং তার মেধাকে প্রতিপালনের ক্ষেত্রে কোন গুরুত্বই দেয়া হ’ত না। কিন্তু শিশু যদি অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে টানাপোড়েনে না ভোগে, তাহ’লে তার শারীরিক, মানসিক এবং মেধার বিকাশ অন্যদের তুলনায় দ্রুত লাভ হবে। শিশুর বেড়ে ওঠার সকল পর্যায়েই শুধুমাত্র শারীরিক বিকাশ নয়; বরং তার আবেগ-অনুভূতি, বোধ-উপলদ্ধি, তার কল্পনা-স্মরণশক্তি এবং সেই সাথে শিশুর কথা বলার দক্ষতার ব্যাপারেও সচেতন দৃষ্টি রাখা অনিবার্য।

শিশুদের বেড়ে ওঠার সময় তাদের শারীরিক এবং আচার-আচরণে যেসব অসংলগ্নতা দেখা দেয়, তার বেশীরভাগই ঘটে থাকে শিশুর বৃদ্ধির পর্যায়গুলো সম্পর্কে যথার্থ ধারণার অভাবে এবং পর্যায়ক্রমিক সঠিক ব্যবস্থা ও পদক্ষেপ গ্রহণ না করার কারণেই। যৌবনে পৌঁছে মানুষ সন্ত্রাসী-মাস্তানী, রাহাজানীসহ যেসব অসামাজিক ও অনৈতিক কার্যকলাপ করে থাকে, গবেষণায় দেখা গেছে জীবনের প্রাথমিক পর্যায়গুলোতে যথার্থ দেখাশুনার অভাবই এ ধরনের ক্রিয়াকলাপের মূল কারণ।

তাই শিশুর প্রতিপালনে বাবা-মায়ের সচেতনতা খুবই যরূরী। এক্ষেত্রে ইসলামী বিধান সম্পর্কে আমরা ধীরে ধীরে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করব। বলাবাহুল্য এ ব্যাপারে ইসলামী নির্দেশনা যে অকাট্য, তাঁর পরিচর্যারীতি যে বিজ্ঞাসম্মত, তা আধুনিক বিশ্বের গবেষকরাও প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন। তাই আমরা ইসলামের নির্দেশনাকে সর্বাধিক প্রাধান্য দেব।

ভোরের নরম আলোর মতো শিশুর গালে সুপ্রভাতের প্রথম আদরটি দিয়ে, বিকাশমান ফুলের মতো অনাবিল হাসিটি দেখতে কার না ভাল লাগে? কিন্তু শিশুর এ নির্মল হাসিটিকে তার প্রাপ্ত বয়স পর্যন্ত ছড়িয়ে দিতে পিতা-মাতার অনেক করণীয় রয়েছে। বিশেষ করে জীবনের প্রথম সাত বছরের পর্বটি হ’ল তার মানস বিকাশের সময়। নবীন কিশলয় সুগন্ধিময় নতুন পাতার মতো বয়স তার, নবীন পাতাটির মতোই সে নাজুক এবং স্বচ্ছ। অন্যভাবে বলা যায়, জীবনের প্রথম পর্বটি কাঁচা মাটির মতো। এ মাটি দিয়ে বাবা-মায়ের মতো কুশলী শিল্পীরা যা গড়তে চান, তাই পারবেন।

একটি শিশুর জীবনকে তিনটি ‘সপ্তবর্ষে’ ভাগ করা হয়েছে। শিশুর জন্মের পর প্রথম সাত বছর তার মেধা যেহেতু পর্যাপ্ত পরিমাণ বিকাশ লাভ করে না, সেহেতু এ বয়সে একটি শিশুর মেধা নিয়ে বিশ্লেষণ না করে বরং তার পঞ্চ-ইন্দ্রিয়ের অনুভূতি এবং প্রতিক্রিয়ার প্রতিই মনোযোগী হওয়া উচিত। শিশুরা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য কাজে এ সময় ব্যাপক তৎপর হয়ে ওঠে। সে দৌড়াতে পসন্দ করে, খেলাধূলা পসন্দ করে, কোন বিষয়ে কৌতূহলী হয়ে পড়লে প্রশ্ন করতে পসন্দ করে, সর্বোপরি নতুন নতুন বিষয়কে তার অভিজ্ঞতার ভান্ডারে জমাতে পসন্দ করে। আর এ কারণেই সে তার চারপাশে যা কিছুই দেখে, তা-ই ধরতে চায় এবং নিজস্ব অনুভূতি দিয়ে তাকে বুঝতে চায়, শিখতে চায়, অভিজ্ঞতা অর্জন করতে চায়। শিশুর স্বাধীনতা মানে তার অনুভূতির স্বাধীনতা, তার মাংসপেশীর স্বাধীনতা। এ দুয়ের যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে শিশুর চলাফেরা, তার সৃজনশীলতা এবং তার ইন্দ্রিয়ের বিকাশের ভিত্তিভূমি রচিত হয়। তাই শিশুর প্রথম সাত বছরে তার সাথে এমন কোন কাজ করা উচিত নয়, যাতে তার স্বাধীনতা বিঘ্নিত হয় এবং পরিণামে তার ইন্দ্রিয় ও সৃষ্টিশীলতা বিকাশের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। মনে রাখতে হবে, শিশুর মানসিক তথা সৃজনশীলতার বিকাশ যদি বাধাগ্রস্ত হয়, তাহ’লে শিশুর মনোবিকার ঘটতে পারে। আর তা যদি একবার ঘটেই যায়, তাহ’লে তার ভবিষ্যত হবে অপ্রত্যাশিত। তাই বাবা-মাকে সচেতন হ’তে হবে। শিশু যখন তার সঙ্গী-সাথী এবং খেলার সাথীদের সাথে আমোদ-প্রমোদ বা খেলাধূলায় ব্যস্ত থাকে, তখন তাকে কোন ব্যাপারে আদেশ দেয়া উচিত নয়। এমনও বলা উচিত নয় যে, এটা কর না, ওটা কর না ইত্যাদি। তাকে তার আনন্দের ভুবন থেকে হুট করে ফিরিয়ে নেয়াটাও ঠিক নয়।

একটি শিশু যদি তার বেড়ে ওঠার জন্য একটা মুক্ত পরিবেশ পায় এবং যথার্থ শক্তি বা এনার্জি লাভের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ ও গাইড লাইন পায়, তাহ’লে তার মানসিক, শারীরিক এবং আচার-আচরণগত বিকাশ বিজ্ঞানসম্মতভাবেই অর্জিত হবে। বাবা-মায়ের এ বিষয়গুলোর প্রতি মনোযোগী হওয়া বাঞ্ছনীয়। শিশুর সাথে বাবা-মায়ের সংবেদনশীল আচরণ করা উচিত। অর্থাৎ   সন্তানের আরাম-আয়েশ এবং স্বাধীনতার বিষয়টি অনুভব করা উচিত। তাকে অতি যত্নের সাথে ঘুম পাড়ানো, ঘুম থেকে জাগানো, খাবার খাওয়ানো, তার ময়লা করে দেওয়া পোশাক পরিস্কার করা প্রভৃতি কাজ আন্তরিকতার সাথে আঞ্জাম দেওয়া উচিত। এমনকি শিশু যদি কান্নাকাটিও করে, তবুও তার ওপর রেগে যাওয়া ঠিক নয়; বরং কান্না বন্ধের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে। শিশুর বেড়ে ওঠার প্রাথমিক পর্যায়ে বাবা-মা যদি শিশুর সাথে যথাযথ ব্যবহার করে, তাহ’লে ভবিষ্যতে শিশুর চারিত্রিক বিকাশ, মানস গঠন এবং তার ব্যক্তিত্বের ওপর বাবা-মায়ের ব্যবহার ও প্রতিক্রিয়ার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। আর যথার্থ ব্যবহার করা না হ’লে তার নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া পড়বে শিশুর ভবিষ্যত জীবনের ওপর।

একটি শিশু তার প্রথম সাত বছর বয়সে ভাবে, বাবা-মায়ের কাছে সে যা চাইবে, তাই পাবে। সেজন্য এ সময় বাবা-মায়ের প্রতি শিশুর বিশ্বাস থাকে অগাধ। বাবা-মাকে সে তার বন্ধু, সহযোগী এবং তার একান্ত আশ্রয় মনে করে। তাদেরকে সে নিরাপদ মনে করে এবং সেজন্যই তাদেরকে সে ভীষণ ভালবাসে। শিশু যখন বড় হয় তখনও সে বাবা-মায়ের ভালবাসার কথা ভোলে না। বাবা-মা তাকে যে কী পরিমাণ ভালবাসত, আদর-যত্ন করত, সে তা উপলদ্ধি করে এবং তাদের ভালবাসার কাছে যে ঋণী সে তা অনুভব করে। বড় হয়ে তাই এ সন্তান বাবা-মায়ের কথা বেশ মনোযোগের সাথে শ্রবণ করে। তাদের দিক-নির্দেশনায় সে লাভবান হয়। যে কোন জটিল ও বিরূপ পরিস্থিতিতে বাবা-মাকেই সে একান্ত আপন ভাবে ও তাদেরকেই নিজের একান্ত পৃষ্ঠপোষক বলে মনে করে। তাদের সাথে সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা ও পরামর্শ করে। বাবা-মায়ের সকল যুক্তি ও পরামর্শ আন্তরিকতার সাথে গ্রহণ করে। তাদের যথাযথ আনুগত্য করে এবং সর্বাবস্থায় তাদের নির্দেশ মেনে চলে। শৈশবকালের প্রথম পর্বে বাবা-মায়ের আচরণগত ত্রুটিই যুব সমাজের অধিকাংশ সমস্যার জন্য দায়ী। বাবা-মা সন্তানের আত্মিক ও মনস্তাত্ত্বিক চাহিদাগুলোর প্রতি কোন রকম মনোযোগ না দেয়ার কারণে সন্তানও বাবা-মায়ের প্রতি আস্থাহীন হয়ে পড়ে। আর বাবা-মায়ের প্রতি সন্তান যদি আস্থা-বিশ্বাস ও নির্ভর করতে না পারে, তাহ’লেই বাবা-মায়ের সাথে তার দূরত্ব সৃষ্টি হয়। এ দূরত্ব সন্তানকে বিপথগামী করে ফেলে। তাই সন্তানকে ভালবাসতে হবে। তার আত্মিক এবং মনস্তাত্ত্বিক চাহিদাগুলো পূরণের ব্যাপারে আন্তরিক হ’তে হবে। তার বেড়ে ওঠার যথার্থ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। সর্বোপরি শিশুর ভবিষ্যত যে পিতা-মাতার ওপরই নির্ভর করে তা মনে-প্রাণে উপলদ্ধি করতে হবে।

আসলে শিশুদের সমস্যাগুলো বাবা-মায়েরই সৃষ্টি। তাই শিশুর সমস্যা এড়াতে বাবা-মায়ের করণীয় :

  • সন্তানের জন্য একটা সময় নির্দিষ্ট করা। তার সমস্যা, তার জিজ্ঞাসা, তার কৌতূহলের যথাযথ উত্তর দেয়া।

 

  • তার বেড়ে ওঠার জন্য যথাযথ পরিবেশ নিশ্চিত করা এবং সন্তানের চাহিদাগুলো পূরণে সচেষ্ট হওয়া।
  • শিশুর ওপর খবরদারী করা থেকে বিরত থাকা। এটা কর না, ওটা ধর না, এটা কর, সেটা ধর- এসব করা ঠিক নয়। তার চেয়ে বরং এসব কথা যাতে বলতে না হয়, সে ব্যাপারে আগেই সচেতন থাকা উচিত। এসব করা হ’লে শিশুর সুপ্ত প্রতিভা বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে।
  • শিশুর জন্য যেসব জিনিস ক্ষতিকর ও ভয়াবহ, সেসব জিনিস তার হাতের নাগালে রাখা অনুচিত। অন্যথা শিশু ঐসব জিনিস দিয়ে কোন যরূরী কিছু নষ্ট করলে তার জন্য শিশুর উপর কোনভাবেই রাগ দেখানো যাবে না।
  • বাবা-মায়ের উচিত বাড়িতে তাদের যরূরী জিনিসগুলো যথাযথ জায়গায় রাখা। ছুরি-চাকু বা এ ধরনের ধারালো জিনিস, বিষাক্ত ঔষধপত্র, কীটনাশক, কাঁচের জিনিসপত্র, দামী তৈজসপত্র, যরূরী কাগজপত্র প্রভৃতি শিশুর নাগালের বাইরে রাখা উচিত।
  • শিশু যখন জেগে থাকে, তখন এমন কোন জিনিস বের করা বা মেরামত করার জন্য খোলা ঠিক নয়, যার ছোট্ট একটি যন্ত্রাংশ হারালে বা নষ্ট হ’লে পুরো জিনিসটাই নষ্ট হয়ে যাবে। শিশু এসব যন্ত্রপাতি নষ্ট করলে তার ওপর রেগে যাওয়া ঠিক নয়। কারণ শিশু কৌতূহলী হবে এটাই স্বাভাবিক। তার কৌতূহল থেকে তাকে নিবৃত্ত করা যাবে না। পরিবারে স্কুলগামী কোন সন্তান থাকলে তার বই-পুস্তকসহ অন্যান্য শিক্ষা-উপকরণ এমনভাবে রাখতে হবে, যাতে শিশু সেগুলো ধরতে ও নষ্ট করতে না পারে। মায়ের যদি সেলাই কাজের অভ্যাস থাকে, তাহ’লে তা করতে হবে শিশু যখন ঘুমায় তখন, অথবা এমন কোন জায়গায় যেখানে শিশুর উপস্থিতির সম্ভাবনা নেই। আর সুঁই-সূতা-ব্লেড ইত্যাদি রাখতে হবে নিরাপদ দূরত্বে।

 

বহু সতর্কতার পরও শিশু ব্লেড বা ছুরি-চাকু জাতীয় কিছু একটা হাতে নিলে কোন অবস্থাতেই চীৎকার-চেঁচামেচি না করে; বরং তার সামনে এমন অন্য একটা জিনিস এনে হাযির করতে হবে, যাতে শিশুর মনোযোগ সেদিকে যায় এবং সুযোগমতো ঐ ভয়ানক বস্তুটি তার হাত থেকে সরিয়ে নেয়া যায়। এমনভাবে নিতে হবে যাতে শিশুটি একদম টের না পায়।

বাবা-মায়ের এত সতর্কতার কারণ হ’ল, এ সময়টা শিশুর পরিপূর্ণ স্বাধীনতার পর্ব। তার যা খুশী তা-ই করবে সে। তাকে আদেশ দেয়া যাবে না, বারণও করা যাবে না। শিশুর মেধা বিকাশের স্বার্থে বাবা-মা ভালবেসে, আদর করে এটুকু ছাড় দেবেন-এটাই প্রত্যাশা।

‘আজ যে শিশু পৃথিবীর আলোয় এসেছে, আমরা তার তরে একটি সাজানো বাগান চাই’ কিংবা ‘এ পৃথিবীকে শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি’- কবির এই যে আকুলতা, এই যে প্রতিশ্রুতি, তা শিশুর প্রতি আন্তরিক ভালবাসা এবং তার সুন্দর ভবিষ্যত নিশ্চিত করারই প্রয়াসমাত্র। সমস্যা হ’ল শিশুর ভবিষ্যত গড়ার স্বপ্ন সবারই আছে। কিন্তু কিভাবে তা গড়তে হবে, সেটা যথার্থভাবে অনেকেরই জানা নেই। তাই এখানে আমরা শিশু জীবনের দ্বিতীয় পর্ব অর্থাৎ সাত থেকে চৌদ্দ বছর বয়সে তার আচার-আচরণগত বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করব।

শিশু জীবনের দ্বিতীয় পর্বটি হ’ল সাত থেকে চৌদ্দ বছর বয়স পর্যন্ত। এ পর্ব হ’ল শিশুর আনুগত্যের কাল। এ সময় শিশুর শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন লংঘনীয় পর্যায়ে যায়। তার শরীর আগের তুলনায় একটু শক্ত হয়, স্মৃতিশক্তি বিকশিত হয়, তার জ্ঞান-বুদ্ধি এবং উপলব্ধি শক্তিও বৃদ্ধি পায়। একটা নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত শিশু ভাল-মন্দও বুঝতে পারে। এ কারণে শিশু মুরববীদেরকে তার কৌতূহল মেটানোর জন্যে বিভিন্ন প্রশ্ন করে বেড়ায়। তবে তার বুদ্ধির যেহেতু পূর্ণ বিকাশ ঘটেনি, সেহেতু কিসে তার কল্যাণ ও অকল্যাণ তা যথার্থভাবে বুঝে উঠতে পারে না। আর বুঝতে পারে না বলেই বাবা-মা বা মুরববীদের উচিত হ’ল এ সময় তাকে বোঝানো, শেখানো। অর্থাৎ তার কোনটা করা উচিত, আর কোনটা করা উচিত নয় সে ব্যাপারে তাকে দিক-নির্দেশনা দেয়া এ মুহূর্তে অভিভাবকদের কর্তব্য। শিশু এ সময় বাবা-মায়ের কথাবার্তা শুনবে ও আনুগত্য করবে এটাই স্বাভাবিক। বাবা-মা এ সময় শিশুকে ভদ্রতা-শিষ্টাচার এসব শেখাবে। শিশুকে জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ দানের উপযুক্ত বয়সই হ’ল এই সাত বছর। এ পর্বের শুরু থেকেই শিশুর আনুষ্ঠানিক শিক্ষাজীবনের সূচনা ঘটবে। শিশু বিদ্যালয়ে যেতে শুরু করলে তার ওপর পাঠ অনুশীলনসহ সীমিত পর্যায়ের কিছু কিছু দায়িত্ব ছেড়ে দিতে হবে। শিশু যদি তার জীবনের প্রথম পর্বটি যথার্থ পরিবেশের মধ্যে কাটাতে সক্ষম হয়ে থাকে, তাহ’লে আনুগত্যের পর্বে তার এক ধরনের মানসিক ভারসাম্য সৃষ্টি হবে। তাই অত্যন্ত আন্তরিকতা ও আনন্দের সাথে সে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব গ্রহণ করবে এবং আরো বেশী অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য শিশু তার বাবা-মা বা মুরববীদের আনুগত্য করবে। তারা যা বলেন, তা শুনবে। যা আদেশ করেন, তা পালন করবে। একটা শিশু যখন তার দ্বিতীয় সপ্তবর্ষে পা দেয়, তখন সে উপলব্ধি করতে পারে যে, অভিভাবকদের তুলনায় জ্ঞান এবং যোগ্যতায় সে অনেক পিছিয়ে আছে। অর্থাৎ বাবা-মা যা জানে, সে তা জানে না। তখনই তার মনে নানা রকম প্রশ্ন জাগে। কিন্তু শিশু যেহেতু তার ক্ষুদ্র জ্ঞানের মাধ্যমে সেসব প্রশ্নের সমাধান করতে পারে না, তাই তার প্রয়োজন পড়ে এমন কাউকে যে তার প্রশ্নগুলোর জবাব দেবে। শিশু চায় যে, তার কৌতূহলগুলোর জবাবদাতা যেন তার প্রতি পরিপূর্ণ মনোযোগী হয়, সে যেন কোন রকম দ্বিধা-সংকোচ ছাড়াই তাকে প্রশ্ন করতে পারে এবং জবাব পেতে পারে। সাত থেকে চৌদ্দ বছর বয়সে একটা শিশুর মেধা, জ্ঞান-বুদ্ধি কিছুটা বৃদ্ধি পায়। ফলে তার চাহিদা, তার প্রত্যাশাও আগের তুলনায় কিছুটা উৎকর্ষ লাভ করে। আগের মতো একেবারে শিশুসুলভ আর থাকে না। তাই এ সময়টায় শিশুকে শিক্ষা প্রশিক্ষণ দেয়া যায়। তাকে আর পুরোপুরি স্বাধীনতা দেয়া যাবে না। বরং তার সকল কর্মসূচী ছকে বেঁধে দিতে হবে, যেন সে শৃঙ্খলা শিখতে পারে। এ সময় তথা সাত বছর বয়স থেকেই তাকে ছালাতের জন্য নির্দেশ দিতে হবে (আবুদাউদ হা/৪৯৫)।

শিশু জীবনের দ্বিতীয় সপ্তবর্ষে তার মেধা ও স্মৃতিশক্তির বিকাশ ঘটে। তাই এ সময়টাই হ’ল শিশুকে শেখানোর সময়। বিশেষ করে এ বয়সটাতেই শিশুকে আদব-কায়দা বা শিষ্টাচার এবং ইসলামী আচার-আচরণ পদ্ধতি শেখাতে হবে। বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের কাছ থেকে এবং বাসায় বাবা-মায়ের কাছ থেকে এই দ্বিতীয় সাত বছর অর্থাৎ ৭ থেকে ১৪ বছর বয়সকালে শিশু যেসব শিষ্টাচার শিখবে, তা কিশোর ও যৌবনকালে তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। শিশুর জ্ঞান-বুদ্ধি, স্মৃতিশক্তি, মেধার বিকাশ এবং শেখার গতি এ সময় খুব প্রখর থাকে। প্রাপ্ত বয়সে তার মানবিক বোধ, আবেগ-অনুভূতি, আচার-আচরণগত বৈশিষ্ট্য এই দ্বিতীয় সাত বছরের শিক্ষারই ফলাফল। ইসলামের আচরণ পদ্ধতি ও শিষ্টাচার সম্পর্কে হাদীছে যেসব বর্ণনা বা নির্দেশনা এসেছে, শিক্ষকদের উচিত ক্লাসে ছাত্রদের সামনে সেসব কৌশলে গল্পাকারে বা অন্য যেকোন আকর্ষণীয় উপায়ে বর্ণনা করা, যাতে কোমলমতী শিশু-ছাত্ররা সেসব শিখে তাদের স্বভাবগত উৎসাহেই নিজের জীবনে কাজে লাগাতে পারে।

দ্বিতীয় সপ্তবর্ষে কোমলমতী শিশু-ছাত্রদের শিক্ষালয়ে যেসব গুরুত্বপূর্ণ শিষ্টাচার শেখানো উচিত তা সংক্ষেপে তুলে ধরছি। সালাম প্রদানের নিয়ম, শৃঙ্খলা রক্ষা, আল্লাহর নামে সকল কাজ শুরু করা, খাদ্য-পানীয় গ্রহণের নিয়ম, পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা, বাবা-মা ও মুরববীদের সম্মান করা, অন্যদের সাথে মেলামেশার নিয়ম, কথাবার্তা বলার শালীনতা, ঘুমানোর পদ্ধতি, যেকোন কাজে অপরের অধিকার সংরক্ষণ, অযূ ও গোসলের পদ্ধতি প্রভৃতি শেখাতে হবে। ছালাত আদায় ও দো‘আ করার পদ্ধতির সাথে পরিচয় করানো যেতে পারে। তাকে ছিয়াম পালন, কুরআন তেলাওয়াত, ভ্রমণে যাবার ক্ষেত্রে করণীয় এবং বন্ধুত্বের বিষয়েও জ্ঞান দেয়া যেতে পারে। এসব শিষ্টাচার শেখানোর পাশাপাশি চারিত্রিক গুণাবলী ও উত্তম স্বভাব অর্জনের ক্ষেত্রেও শিশুকে দিক-নির্দেশনা দিতে হবে। তাকে সব ধরনের মন্দ কাজ থেকে দূরে রাখতে হবে, যাতে তার চরিত্রের ওপর ঐসব মন্দ কাজের প্রভাব পড়তে না পারে।
শিশুকে সুন্দর ও যথার্থভাবে গড়ে তোলার জন্য প্রথমতঃ নিজেরা প্রশিক্ষিত হবেন এবং তারপর শিশুদেরকে প্রশিক্ষণ দেবেন। মনে রাখতে হবে যথার্থ দিক-নির্দেশনার অভাবেই কিন্তু শিশুর ভবিষ্যত হয় অবাঞ্ছিত। এজন্য বাবা-মায়ের উচিত, শিশুর জীবন বিকাশের প্রকৃতি সম্পর্কে জানা এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া। সাত থেকে চৌদ্দ বছর বয়সে একটি শিশু স্কুলে যেসব আদব-কায়দা বা শিষ্টাচার শিখবে, সেগুলোকে সাথে সাথেই বাস্তবায়নের পরিবেশ তৈরী করতে হবে। এমনভাবে তাদেরকে শেখাতে হবে, যাতে তারা তাদের বাবা-মা বা অন্যান্য মুরববীদের সাথে কথাবার্তা বা আচার-আচরণ করতে গিয়ে সেসব শিক্ষাকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজে লাগায়। তাদেরকে যেসব শেখানো হয়, সেগুলোর ব্যবহারিক প্রয়োগ যদি না থাকে, তাহ’লে ঐসব শিক্ষা কোন কাজেই আসবে না। ফলে শিশুদের ব্যক্তিত্ব গঠনে এসব শিক্ষা বা প্রশিক্ষণের কোন প্রভাবই পড়বে না।

এ বয়সে শিশুর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে যে গুণগুলো থাকা উচিত, সেগুলো হ’ল সততা ও সত্য কথা বলা, ভাল কাজ ও পরোপকার করা, মিথ্যা কথা ও কাজ, হিংসা-বিদ্বেষ, গীবত বা পরনিন্দা, কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ ও গুজব রটনা থেকে বিরত থাকা, প্রয়োজনীয় কথাবার্তা বলা এবং অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা থেকে বিরত থাকা ইত্যাদি। এগুলো নিরন্তর অনুশীলনের ব্যাপার। বাবা-মাকে সর্বোচ্চ সতর্কতার সাথে খেয়াল রাখতে হবে এবং এগুলোর ব্যতিক্রম দৃষ্টিগোচর হ’লেই তা সংশোধন করার উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। রেগে ভয় দেখিয়ে কিছু করা ঠিক নয়। এ বয়সে শিশুর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে আরো কিছু গুণের সমাবেশ ঘটা উচিত। যেমন অন্যের প্রতি যুলুম-অত্যাচার, অন্যদেরকে বিরক্ত করা, যন্ত্রণা দেওয়া এবং অপচয় বা অপব্যয় থেকে বিরত থাকা, একগুঁয়েমি বা যেদি মনোভাব পরিহার করা, ওয়াদা রক্ষা করা, দান করা, দয়াশীল ও উদার হওয়া, ক্ষমা ও মহানুভবতা দেখানো, নিজ ও অন্যদের ব্যাপারে যথার্থ বিচারবোধ জাগা, যালিমের শত্রু ও মযলূমের বন্ধু হওয়া এবং সর্বাবস্থায় আল্লাহর স্মরণ নিজের মধ্যে জাগ্রত রাখা।

এসব গুণাবলী অর্জনে শিশুকে যথার্থ প্রশিক্ষণ দিতে হবে। যখনই শিশু এসব গুণাবলীর বিপরীত আচরণ করবে, তখনই বাবা-মায়ের উচিত হবে মনস্তাত্ত্বিক পরিচর্যার মাধ্যমে শিশুকে এমনভাবে সেগুলো সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান দেওয়া, যাতে শিশু বিরক্ত না হয়। জোর করে কোন কিছু শেখালে শিশুর মনে ভীতি কাজ করবে। ফলে প্রশিক্ষণ দেওয়ার মূল লক্ষ্যই ব্যাহত হ’তে পারে।

উদাহরণ স্বরূপ বাবা-মা যদি শিশুকে কোন কথা দিয়ে না রাখে, তাহ’লে শিশুও তা করতে শিখবে। ফলে শিশুকে শেখানোর আগে গুণগুলো বাবা-মায়ের ভেতরে অর্জিত হওয়া প্রয়োজন। ৭ থেকে ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত একটি শিশু আনুগত্যের পর্যায় অতিক্রম করে। এ সময় সে বাবা-মা, মুরববী ও শিক্ষকদের কথা মেনে চলে ও তাদের অনুকরণ করে। এটা একটা কঠিন পর্যায়, যা শিশু ও অভিভাবক উভয়ের জন্য কঠিন। শিশুর জন্য কঠিন; কারণ এ অবস্থায় শিশু সকলের আনুগত্য করে। আর বাবা-মা বা অভিভাবকদের জন্য কঠিন; কারণ শিশু এ সময় বাবা-মা ও মুরববীদেরকে আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করে। ফলে বাবা-মা, শিক্ষক ও অভিভাবকদের অবশ্যই আদর্শস্থানীয় হ’তে হবে।

শিশু যদি তার কোন শিক্ষক সম্পর্কে বাবা-মায়ের সামনে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে এবং বাবা-মা যদি তা শুনে নীরব থাকে তাহ’লে পরিণতি দাঁড়াবে এই যে, শিশুটি ঐ শিক্ষককে আর শ্রদ্ধা করবে না। ফলে পড়ালেখা থেকে তার মন উঠে যাবে। অন্যদিকে শিক্ষক সম্পর্কে কথা বলার অভ্যাস যেহেতু হয়ে গেছে, তাই ধীরে ধীরে অন্যদের ব্যাপারেও কথা বলতে অভ্যস্ত হয়ে পড়বে। পরিণতিতে এ শিশু ভবিষ্যতে বাবা-মায়ের অবাধ্য হয়ে যেতে পারে। বাবা-মাকে তাই সতর্ক থাকতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষকদেরও উচিত শিশুদের মানসিকতা বোঝা এবং নিজেদের ব্যক্তিত্ব বজায় রেখে শিশুদের সাথে আচরণ করা। সর্বোপরি নিজেদের মেধা কাজে লাগিয়ে শিশুদের মন জয় করা।

শিশু জীবনের প্রথম সাত বৎসর স্বাধীনতা ভোগ করার পর একটি শিশু আনুগত্যের পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছে। দ্বিতীয় সাত বছর আনুগত্য করার ফলে শিশুর জীবনে কিছুটা দায়িত্ব জ্ঞান, নৈতিকতাবোধ জাগ্রত হয়। শিশু যদি যথার্থভাবে তার আনুগত্যের পর্যায় অতিক্রম করে, তাহ’লে শিশুটি এমন কিছু মেধা ও জ্ঞান-বুদ্ধি অর্জন করতে সক্ষম হয়, যা দিয়ে সে তার মুরববীদেরকে কাজে-কর্মে সহযোগিতা করতে পারে। এভাবেই শিশুটি তার জীবনের তৃতীয় সপ্তবর্ষে এসে পৌঁছবে। এ পর্যায়টি শিশুর দায়িত্বশীলতার পর্যায়। এ সময়ে বাবা-মা বা পরিবারকে বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করার পর্যায়।

আজ যে শিশু, আগামী দিনে সেই হবে শিশুর পিতা, সেই জাতিকে নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাবে উন্নতির দিকে। তাই জাতির এ ভবিষ্যত নেতাকে গড়ে তোলার সময় হ’ল শিশুকাল। আর জাতির নেতার সবচেয়ে বড় শিক্ষক হ’লেন পিতা-মাতা। শিশু জীবনের তৃতীয় সপ্তবর্ষ শুরু হয় পনের বছর বয়স থেকে। এর শেষ সীমা হ’ল একুশ বছর পর্যন্ত। এ সময়টা শিশুর তারুণ্য ও যৌবন প্রাপ্তির কাল। বালেগ হওয়ার বিচিত্র সংকট শিশুটির জীবনে প্রথমবারের মতো দেখা দেয় এ বয়স সীমায়। যৌবন প্রাপ্তির কারণে তাই শিশুর ভেতরে বিভিন্ন ধরনের ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা, ঝোঁক-প্রবণতা দেখা দেয়। শিশুর মনে ইচ্ছা জাগে অন্যদের সাথে বন্ধুতেবর জালে জড়িয়ে পড়তে। তার আর একা একা ভাল লাগে না। বড় নিঃসঙ্গ লাগে নিজেকে। তাই শিশুকাল উত্তীর্ণ নব যৌবনপ্রাপ্ত তরুণ বন্ধু পরিবেষ্টিত থাকতে চায়, তার সময়গুলো বন্ধুদের সাথেই কাটাতে ভালবাসে। কখনও বন্ধু-বান্ধবের বৃত্তের বাইরে এ তরুণ নিজস্ব বৃত্তে থাকতেও পসন্দ করে। এ সময় তাই তার একটা নিজস্ব ভুবন সৃষ্টি হয়। সেই ভুবনের একাই সম্রাট সে। এতদিন বাবা-মার কাছে তার কোন বিষয়ই গোপন ছিল না বা সে গোপন রাখত না। এখন সে বাবা-মায়ের সাথে আলাপ-আলোচনায় অনেক বেশী সংযত ও ভারসাম্যপূর্ণ। কী চমৎকার পরিবর্তন। গতকালের উৎফুল্ল, হেসে-খেলে বেড়ানো শিশুটি আবেগ-অনুভূতি ও সংবেদনশীল যৌবনে এসে কেমন শান্ত হয়ে গেছে। কত দ্রুত সে মুক্ত পৃথিবী থেকে কণ্টকাকীর্ণ বর্তমানে এসে পৌঁছেছে। সেই সাথে দ্রুত শারীরিক পরিবর্তন তার অন্তরে, মন ও মননে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। বিপরীত লিঙ্গের প্রতিও তার আকর্ষণ সৃষ্টি হ’তে শুরু করে। নব যৌবনপ্রাপ্ত তরুণ-তরুণীর একটা বৈশিষ্ট্য গড়ে ওঠে। সেটা হ’ল তারা অতিমাত্রায় সংবেদনশীলতা ও স্পর্শকাতরতা। অন্যদের আচার-আচরণ, কথাবার্তা তাকে দ্রুত ভাবিয়ে তোলে। কখনো সে চিন্তার গভীর অতলে ডুবে যায়, আবার কখনো অন্যদের কথার্বাতা নিয়ে পর্যালোচনা করতে বসে যায়। সবকিছু নিয়েই সে গবেষণা করতে পসন্দ করে। তার সমবয়সী যারা, তারা যা করে, যা ভালবাসে, সেও তা করতে শেখে। এককথায় সমবয়সী বন্ধু-বান্ধবদের আদর্শে সেও উজ্জীবিত হয়। তাদের আচার-আচরণ, চলা-ফেরা, কথাবার্তা প্রভৃতি অনুসরণ করতে থাকে।

যৌবন প্রাপ্তির চলমান সংকটকালটি সন্তানের জন্য খুবই সংবেদনশীল এবং স্পর্শকাতর। এ সময়ে পিতা-মাতাকে সন্তানের প্রতি আন্তরিকতা, স্নেহ ও ভালবাসাপূর্ণ ব্যবহার দেখিয়ে তার আস্থা অর্জন করতে হবে। তাকে কাছে টানতে হবে, তাকে সময় দিতে হবে এবং তার আত্মিক ও আনুভূতিক চাহিদাগুলো মেটাতে হবে। তরুণের সাথে বাবা-মায়ের সঠিক আচার-ব্যবহারের ফলে নবযৌবন প্রাপ্ত এ সন্তানের মধ্য থেকে শিশুসুলভ বৈশিষ্ট্যগুলো ধীরে ধীরে দূর হয়ে যাবে। তরুণটিও বুঝতে পারবে, সে এখন আর ছোট্ট শিশুটি নেই, এখন তার বয়স হয়েছে, তার বুদ্ধি ও মেধার বিকাশ ঘটেছে। শিশুসুলভ আচরণ আর করা যাবে না। এভাবে মেধা এবং বুদ্ধিতে  সন্তানটি পরিপক্কতা লাভ করবে।

শিশু ঠিকমতো বেড়ে উঠছে কি-না সে ব্যাপারে সার্বক্ষণিক দৃষ্টি দিতে হবে। সন্তান চোখের আড়াল হ’লে খোঁজ খবর রাখতে হবে যে, জীবন বিধ্বংসী কোন কাজে জড়িয়ে পড়ছে কি-না কিংবা তার ভবিষ্যৎ বিনষ্টকারী কোন আড্ডায় সে গেল কি-না। বাবা মায়ের অসতর্কতা ও অসচেতনতার কারণে সন্তান বিপথগামী হয়ে পড়ে। আর সন্তানের বিপথগামিতা যে কেবল সংশ্লিষ্ট পরিবারটির জন্যই ক্ষতিকর তা নয়; বরং গোটা সমাজ তথা রাষ্ট্রের জন্যই ক্ষতিকর। তাই সন্তানের প্রতি যথার্থ দৃষ্টি দিয়ে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণও নিশ্চিত করা কাম্য।

শিশু তৃতীয় সপ্তবর্ষে পরিবার নামক রাষ্ট্রটির মন্ত্রী হিসাবে তার দায়িত্ব পালন করবে। পরিবার-রাষ্ট্রের রাজা-রাণী হ’লেন বাবা-মা। আর সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত সন্তানটির দায়িত্ব হ’ল রাজাকে রাষ্ট্র পরিচালনায় সার্বিকভাবে সহযোগিতা করা। এরই সাথে আরেকটি বিষয় পরিস্কার হয়ে যায়, তা হ’ল বয়োঃপ্রাপ্তির আগে পরিবারের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে সন্তানের কোন দায়-দায়িত্ব নেই। তবে প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার সাথে সাথেই সন্তানের উচিত পারিবারিক দায়িত্ব গ্রহণ করা এবং পরিবারের ভারী বোঝার একাংশ কাঁধে তুলে নেয়া। অন্যভাবে বলা যেতে পারে, সন্তান এ সময় বাবা-মায়ের উপদেষ্টা, বন্ধু ও সর্বক্ষেত্রে সহযোগী হবে। তাই সন্তানের সাথে বাবা-মায়ের সম্পর্ক নিবিড় হওয়া উচিত। সে বাবা-মাকে যেমন শ্রদ্ধা-সম্মান করবে, তেমনি বাবা-মারও উচিত সন্তানের ব্যক্তিত্বের প্রতি লক্ষ্য রাখা। এভাবে বিভিন্ন ব্যাপারে পরিকল্পনা গ্রহণের ক্ষেত্রে পরস্পরের মধ্যে মতবিনিময় হওয়া উচিত। অনেক বাবা-মা আছেন, নিজের সন্তান বলে বড় ভাবতে নারায। কেবল নারাযই নন, বরং কখনো কখনো এমনও বলে বসেন, ‘সেদিনের ছেলে তুই, কী আর জানিস’, ‘বড়দের ব্যাপারে নাক গলাবে না’ ইত্যাদি। এ রকম আচরণের ফলে সন্তানের ব্যক্তিত্বে আঘাত লাগে। পরিণতিতে বাবা-মাকে সে অশ্রদ্ধা করে বসতে পারে। অথচ সন্তানের ব্যক্তিত্ব বিকাশে বাবা-মায়ের আচরণে ছেলের যেন সন্তুষ্টি অর্জিত হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা উচিত। এ বয়সটা সন্তানের চিন্তার স্বাধীনতা ও ব্যক্তিত্ব গঠনের বয়স। একটি কথা সবার মনে রাখা উচিত যে, সন্তান যত ছোটই হোক না কেন, সেও কিন্তু পরিপূর্ণ একটি মানুষ। তার বোধ-বুদ্ধি, মেধা-মনন, চিন্তা ও বিবেক এবং স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব রয়েছে। তার ঐ ব্যক্তিত্বকে কোনভাবেই খাটো করে দেখা ঠিক নয়। সন্তানের ব্যক্তিত্বকে খর্ব করা হ’লে সন্তানও বাবা-মায়ের ব্যক্তিত্ব  খর্ব করতে দ্বিধা করবে না। ফলে সন্তান হয়ে যাবে বাবা-মায়ের অবাধ্য। অথচ প্রাপ্ত বয়সে সন্তানকে বেশ কিছু বিষয় চর্চা করতে হবে, যা বাবা-মা-ই শেখাবে। সন্তান অবাধ্য হ’লে তাকে আর পথে সম্ভব হবে না।

এ সময় ধর্মীয় বিষয়গুলো তাকে পালন করতে হবে। তাই বাবা-মাকে এমন পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে, যাতে সন্তান ধর্মীয় বিধি-বিধান, আইন-অনুশাসন পুরো মেনে চলে। আগেই বলেছি, সন্তানের সকল সঙ্গতি-অসঙ্গতির ব্যাপারে প্রথমতঃ বাবা-মা-ই দায়ী। তাই সন্তানের পরিশুদ্ধি, ধর্মের অনুশীলন ইত্যাদির ব্যাপারে প্রথমে বাবা-মাকেই পরিশুদ্ধ হ’তে হবে। ধর্মকর্ম পালন করতে হবে। বাবা-মা যদি ধর্মীয় ব্যাপারে উদাসীন হন, তাহ’লে সন্তান কিছুতেই এ ব্যাপারে বাবা-মায়ের নির্দেশ মানবে না। তাই বাবা-মায়ের মধ্যে ধর্মীয় ব্যাপারে কোন ত্রুটি থাকলে দ্রুত তা ঠিক  করে ফেলা উচিত। নিজেরা ত্রুটিমুক্ত হ’লে সন্তানও ত্রুটিমুক্ত হবে।  আর  বাবা-মা যা  করে না, তা সন্তানকে করতে বললে সন্তান সাথে সাথেই বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবে এটাই স্বাভাবিক। সন্তানের এ প্রতিক্রিয়া দেখানো থেকে মুক্ত থাকা প্রত্যেক বাবা-মায়ের কর্তব্য।

সুস্থ জাতি গঠনের মূলে রয়েছে সন্তানের যথার্থ লালন, প্রশিক্ষণ ও বিকাশ। শিশু জীবনের তৃতীয় সপ্তবর্ষে তার যৌবনপ্রাপ্তি সংক্রান্ত জটিলতা। এ সময়ে তার জীবনে এক ধরনের  পরিবর্তন সূচিত হয়,  তাই  বাবা-মায়ের  উচিত সন্তানকে একটি গাইড-লাইন দেয়া। সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত তরুণের আত্মোপলব্ধি তথা নিজের সম্পর্কে ভাল করে জানা এবং পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সাথে পরিচিত হবার জন্য তাকে দিক-নির্দেশনা দেবার প্রয়োজন রয়েছে। এ সময় প্রাকৃতিকভাবেই সন্তানের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ঘটতে থাকে। বিশেষ করে সন্তানটি না চাইলেও শারীরিকভাবে সে বিকশিত হ’তে থাকে। আর এ শারীরিক বিকাশের সাথে সমান্তরাল গতিতে তার মানসিক ও আত্মিক বিকাশও ঘটতে থাকে। শারীরিক বিকাশের সাথে এগুলোর সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। তাই মনোদৈহিক বিকাশকালে বিশ্ব প্রকৃতি ও সৃষ্টি প্রক্রিয়ার অমোঘ বিধান তথা অহি-র বিধান সম্পর্কে যথার্থ একটা ধারণা তাকে দেওয়া উচিত। স্বাভাবিকভাবেই তার এমন একজন অভিভাবকের সাহচর্য প্রয়োজন, যিনি নিজে সৎ, জ্ঞানী এবং কল্যাণকামী। ব্যক্তিগত জীবন চর্চার ক্ষেত্রে তরুণের আত্মচেতনা, নিজের আচার-আচরণ, কাজ-কারবার, দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রতিক্রিয়ার ক্ষেত্রে বোধ-বুদ্ধি ও চিন্তা-ভাবনার প্রয়োজন রয়েছে। কিভাবে জীবন যাপন করতে হবে তা তার জানা প্রয়োজন। বিশেষ করে যখন সে নিজেকে বুঝতে শেখে আমি কে, কোথায় আছি, এই পৃথিবীতে আসার উদ্দেশ্য কি? এ পৃথিবীতে কিভাবে থাকা উচিত ইত্যাদি তার জানা উচিত। এ সকল প্রশ্নের যথার্থ উত্তরও তার পাওয়া বা জানা উচিত। যাতে তার জীবনে ভারসাম্য আসে, জীবনকে সে মূল্যায়ন করতে শেখে এবং একটি সুন্দর ভবিষ্যত নির্মাণে সক্ষম হ’তে পারে। ইংল্যান্ডের একজন বিখ্যাত চিকিৎসক ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ড. উস্টাস সেশার বলেছেন, ‘মানুষের মানসিক অশান্তি ও অস্বস্তির কারণ সম্পর্কে আমি বহু গবেষণার পর এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে, মানসিক অশান্তিগ্রস্ত ব্যক্তিরা শিশুকাল ও তরুণ বয়সে জীবনযাপন পদ্ধতি সম্পর্কে ভাল কোন গাইড বা দিক-নির্দেশনা পায়নি এবং তাদেরকে যথোপযুক্ত প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়নি। তাদের অনেকেই  এখন  নিজেরাই  বিবাহ  করেছেন।  এমনকি সন্তানেরও  অধিকারী  হয়েছেন।  তাঁরা তাদের মনের অজান্তেই নিজেদের মানসিক ও আত্মিক অশান্তি ও অস্বস্তিগুলো সন্তানদের ভেতর সংক্রমিত করছেন’।

অভিজ্ঞতা এমন একটি জিনিস, জীবনের ক্ষেত্রে যার কোন বিকল্প নেই। শিল্প বলুন, সাহিত্য বলুন, কবিতা-গল্প যাই বলুন না কেন, এ জীবন-অভিজ্ঞতারই ছান্দিক রূপায়ন মাত্র। অভিজ্ঞতার ওপরে বড় কোন শিক্ষা নেই। প্রশিক্ষকও নেই। আর শিক্ষা হচ্ছে প্রতিবন্ধকতা, জিজ্ঞাসা, প্রশ্ন বা সমস্যার সমাধান। জীবন চলার পথে যিনি যত বেশী সমস্যার সম্মুখীন হবেন, তিনি তত বেশী অভিজ্ঞতা অর্জন করবেন এটাই স্বাভাবিক। ফলে বয়স যার যত বেশী, তাঁর অভিজ্ঞতার ভান্ডারও ততটাই বেশী সমৃদ্ধ। একজন তরুণ যেহেতু বয়সের দিক থেকে বড়দের চেয়ে অনেক ছোট, তাই জীবনের অসঙ্গতি আর সমস্যার মোকাবেলাতেও সে অপরিপক্ক। বড়দের তুলনায় তার জ্ঞানের ভান্ডার যেমন অসমৃদ্ধ, তেমনি অভিজ্ঞতার ভান্ডারও শূন্য প্রায়। তরুণ ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ এ পৃথিবীর চড়াই-উৎরাইয়ের সম্মুখীন বড়দের তুলনায় কম হয়েছে। এমনকি জীবন চলার পথে বাধা-বিপত্তি বা সমস্যা সে কমই মোকাবেলা করেছে। অবশ্য তরুণের জন্য এ অবস্থার ভাল ও মঙ্গলজনক একটা দিকও রয়েছে। তাহ’লে তার অভিজ্ঞতার ভান্ডার পূত-পবিত্র অর্থাৎ কোনরকম সমস্যা বা বাজে ঘটনা তার অভিজ্ঞতাকে কলুষিত করেনি। অন্যদিকে তরুণের সহজ-সরল স্মৃতি ভান্ডারটিও এখন পর্যন্ত কোনরকম কালিমালিপ্ত হয়নি। তা এখনো পূত-পবিত্র আছে। এর ভাল দিকটা হ’ল শিশু জীবনের সাথে তার দূরত্ব যেহেতু বড়দের তুলনায় কম, সেহেতু এখন সে তার শৈশবের স্মৃতিগুলো স্মরণ করতে পারে এবং তার কিছু কিছু আচার-আচরণ ও অনুভূতির কারণ সে এখন উপলব্ধি করতে পারে, বুঝতে পারে। যার ফলাফল হ’ল যখনই সে বুঝতে পারে যে, তার অমুক ব্যবহারটি পসন্দনীয় নয়, তখনই সে খুব সহজেই আত্মসংশোধন করে নিতে পারে।

তরুণদের সামনে যেহেতু জীবনের বহু পথ পাড়ি দেবার অবকাশ রয়েছে, তাই নিজেকে আরো ভালভাবে চেনারও অবকাশ রয়েছে। আর আত্মোপলব্ধি দৃঢ় হ’লে তার সামনে আসা অনাগতকালের জটিল ও কঠিন পরিস্থিতিগুলোকে সে যথার্থভাবে মোকাবেলা করতে সক্ষম হবে। পরিস্থিতি বা সমস্যা যতই জটিল বা কঠিন হোক না কেন, ধীর-স্থিরভাবে বুদ্ধিমত্তার সাথে তা সমাধানের চেষ্টা করতে হবে- এ দীক্ষা পিতামাতাই তাকে দিবে। তারা তাদের তরুণ সন্তানকে এমন পরামর্শ দিবে, যাতে জীবন সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রেও সন্তান বহির্মুখী চিন্তা না করে। ইংরেজীতে বলা হয়ে থাকে, Life is not a bed of roses. ‘জীবন কোন ফুলশয্যা নয়’ বরং কণ্টকাকীর্ণ। তাই জীবনপথে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে চলার পরামর্শ সন্তানকে দিতে হবে।

স্বাস্থ্য সুরক্ষার অভাবে মানুষের রোগ-ব্যাধি হ’তেই পারে। এ রোগ-ব্যাধি চিকিৎসাযোগ্য। কিন্তু পারিবারিক শান্তি-শৃঙ্খলা সুরক্ষার অভাবে যেসব রোগ-ব্যাধি দেখা দেয়, তার পরিণতি ভয়াবহ। এ রোগ ঘর ছেড়ে বাইরে, সমাজ থেকে রাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়ে। এর প্রতিকার সহজসাধ্য নয়। তাই প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেওয়াই একমাত্র উপায়। এ ব্যবস্থা ছোটবেলাতেই নিতে হবে। বিশেষ করে সন্তান যখন যৌবনে পা দেয়, তখন বাবা-মাকে অনেক বেশী সচেতন থাকতে হবে।

যৌবনে পদার্পণ করার পর সন্তানের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হ’ল তার আশপাশের পরিবেশের সাথে পরিচিত হবার আগে নিজের সাথে পরিচিত হওয়া অর্থাৎ নিজেকে জানা। এটা সৃষ্টি জগতের একটা বিস্ময়। সৃষ্টি প্রক্রিয়ার স্বাভাবিক নিয়মেই মানুষের ভেতরে দু’ধরনের জ্ঞান বিদ্যমান থাকে। একটি হ’ল প্রত্যক্ষ জ্ঞান, অপরটি পরোক্ষ জ্ঞান। পরোক্ষ জ্ঞান হ’ল বই-পুস্তক পড়ে যে জ্ঞান আহরণ করা হয়। আর প্রত্যক্ষ জ্ঞান হ’ল আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষ জ্ঞান। যার সাহায্যে মানুষ নিজের ব্যক্তিত্ব নিয়ে ভাবতে পারে এবং নিজের আচার-ব্যবহার সম্পর্কে আত্মপর্যালোচনা করতে পারে। নিজেকে চেনা বা নিজেকে নিয়ে পর্যালোচনা করার জন্য প্রত্যক্ষ জ্ঞানই হ’ল উপযুক্ত। অর্থাৎ আল্লাহ মানুষকে যে জ্ঞান দিয়েছেন বা নবী-রাসূলদের মাধ্যমে শিখিয়েছেন, তা দিয়ে নিজেকে বিচার বিশ্লেষণ করাই উত্তম। বাইরের কোন তত্ত্ব বা দর্শন দিয়ে নিজেকে আবিষ্কার করার জন্য তৎপর হবার চেয়ে প্রত্যক্ষ জ্ঞানের সাহায্যে আত্মোপলব্ধির চেষ্টা করাই যে সঙ্গত, এটা যৌবনে পদার্পণকারী সন্তানদেরকে বোঝাতে হবে।

আরেকটি বিষয় যৌবনপ্রাপ্ত সন্তানদেরকে বোঝাতে হবে, তাহ’ল জীবন মাত্রই চড়াই-উৎরাই এবং সাফল্য ও ব্যর্থতায় পূর্ণ। তাই সাফল্য কিংবা ব্যর্থতা সর্বাবস্থাতেই আত্মবিশ্বাসী থাকার মনোবল সন্তানের মধ্যে থাকতে হবে। জীবনের ভাঙ্গা-গড়ায় নিজেকে গড্ডালিকা প্রবাহে ভাসিয়ে দেওয়া আত্মবিশ্বাসী চরিত্রের আলামত নয়। কোন অবস্থাতেই দুঃখ-বেদনায় ভেঙ্গে পড়লে চলবে না। সর্বাবস্থায় আল্লাহর ওপর অটল-অবিচল বিশ্বাস রেখে জীবনের যেকোন ঘাত-প্রতিঘাতকে প্রতিহত করতে হবে। সাফল্যে অহঙ্কার করা যেমন ঠিক নয়, তেমনি ব্যর্থতায় মুষড়ে পড়া বা হতাশায় মূহ্যমান হওয়াও ঠিক নয়। এ দুই অবস্থাই প্রাপ্তবয়স্ক    সন্তানের জন্য ভয়াবহ। নবী-রাসূলগণ এবং তাঁদের প্রকৃত অনুসারীগণ যাঁরা এ পৃথিবীর মানুষের কল্যাণের জন্য আল্লাহর বিধান প্রচার, প্রসার ও বাস্তবায়নে নিজেদের শ্রম ও মেধা ব্যয় করে গেছেন, তাঁদের জীবনেও বহু উত্থান-পতন আর ভাঙ্গা-গড়ার ঘটনা ঘটেছে। তারপরও তাঁরা আত্মবিশ্বাসে অটল থেকেছেন, আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী করে গেছেন। কোনরকম অন্যায় করেননি, সর্বদা সত্যের ওপর অটল থেকেছেন। এসব মনীষীর জীবনী পড়ার জন্য সন্তানদেরকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। তাঁদের জীবনী পড়ে শিখতে হবে যৌবনের সংবেদনশীল সময়টিকে তাঁরা কীভাবে এত পূত-পবিত্রতার মধ্য দিয়ে কাটিয়েছেন। কীভাবে নিজেদের মেধা ও যোগ্যতাকে নৈতিক চরিত্র গঠনের কাজে ব্যয় করেছেন। কীভাবে ইনসানে কামেল বা পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে ওঠার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। কীভাবে নিজেদের জীবনকে অন্যদের জন্য কল্যাণকামী ও মঙ্গলের আধারে পরিণত করেছেন।

এভাবেই জ্ঞানী-গুণীদের জীবনী থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেদের যৌবনকালকে সমৃদ্ধ ও পবিত্রভাবে কাটানোর জন্য সন্তানদের শেখাতে হবে। কেবল নবী-রাসূলদের জীবনী যুবকদেরকে নৈতিক চরিত্র গঠনে যথার্থ সহযোগিতা করতে পারে। তাঁদের জীবনের সমস্যাসঙ্কুল বিচিত্র পর্যায় এবং চড়াই-উৎরাই কীভাবে অতিক্রম করেছেন, তা থেকে শিক্ষা নিয়ে যৌবনপ্রাপ্ত সন্তানেরা তাদের যোগ্যতা ও মেধাকে ঋদ্ধ ও সমৃদ্ধ করতে পারে। অন্যদিকে জীবনে যারা দুর্নীতি-অনাচার আর গোমরাহীর দিকে ধাবিত হয়, তাদের অধিকাংশই যৌবনের বেশীরভাগ সময়ে ব্যাপক দূষিত পরিবেশের সম্মুখীন হয়। সেই দূষিত পরিবেশের কুপ্রভাব পরবর্তীকালে তাদের ব্যক্তিত্বের ওপর পড়ে। তাই যে সকল বৈরী ও দূষিত পরিবেশ তাদেরকে বিপথে নিয়ে যায়, সেসব পরিবেশ থেকে সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত সন্তানদেরকে দূরে রাখার ক্ষেত্রে বাবা-মাসহ সকল অভিভাবককে সচেতন থাকতে হবে। সন্তানদেরকেও কৌশলে এ ব্যাপারে যথার্থ ধারণা দিতে হবে। কারণ যৌবন পর্যায়ের এ সঙ্কটগুলোর ব্যাপারে সন্তানেরা যদি না জানে, তাহ’লে তাদের অজান্তেই নিজেদের মানসিকতা ও ব্যক্তিত্বের ওপর দূষিত পরিবেশের এমন ভয়ঙ্কর প্রভাব পড়তে বাধ্য, যার পরিণতিতে তাদের জন্য অপেক্ষা করবে এক জটিল ও অন্ধকার ভবিষ্যত।
একটি যুবকের সামনে সাধারণত অফুরন্ত সময় থাকে। এ সময়কে বিচিত্র কাজে ব্যয় করার অধিকার সে রাখে। কিন্তু কীভাবে, কোন্ উদ্দেশ্যে বা কোন্ উপায়ে সে তার সময়কে কাজে লাগাবে সেটাই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একজন ঈমানদার যুবক নিজ জীবনের অপ্রত্যাশিত ঘটনা বা পরিস্থিতিকে আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষা হিসাবে ধরে নিয়ে এ দুর্ঘটনাকে নিজের উন্নতি ও অগ্রগতির সোপান বলে গ্রহণ করে। তাই সমস্যার সিঁড়িগুলোকে সে অত্যন্ত সচেতনতার সাথে অতিক্রম করে নিজের ভবিষ্যতকে উজ্জ্বল করে তুলতে পারে।

নবী-রাসূল ও ছাহাবাগণ তাঁদের সামনে আসা অপ্রত্যাশিত সমস্যাগুলোকে অত্যন্ত মেধা ও দক্ষতার সাথে যথার্থ পন্থায় মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়েছেন। যৌবনে জীবন সমস্যার মোকাবেলায় বিজয়ীদের মধ্যে আদর্শ হিসাবে ইউসুফ (আঃ)-এর জীবনে সংঘটিত ঘটনাকে উদাহরণ স্বরূপ পেশ করা যেতে পারে।

যৌবনে পদার্পনকারী সন্তানের জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও জীবন সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি যদি সঠিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক হয়, তাহ’লে তার জীবন হয়ে উঠবে উজ্জ্বল ও প্রশান্তিময়। সে গভীর অধ্যবসায়ের সাথে নিজ জীবন পর্যালোচনা করে এবং জীবন সংগ্রামে উত্তীর্ণ হয়ে নিরন্তর অগ্রগতির দিকে এগিয়ে যাবে এবং সাফল্যের সাথে তার জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছার আনন্দ লাভ করতে সক্ষম হবে।

একটি যুবক বা কিশোর যদি তার যৌবনকালের বিভিন্ন সঙ্কট সম্পর্কে এবং এ পৃথিবীর সৃষ্টি, মানুষ, পশুপাখিসহ অন্যান্য প্রাণীকুল সম্পর্কে অহি তথা কুরআন ও ছহীহ হাদীছ থেকে স্বচ্ছ ধারণা লাভ করে এবং যৌক্তিক ও বিশুদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি লাভ করতে সক্ষম হয়, তাহ’লে তার আদর্শচ্যুতির আশঙ্কা কমে যায়। শয়তানের খপ্পরে পড়ার সম্ভাবনা থাকে না। কিন্তু কোন কারণে শয়তানের ফাঁদে একবার পড়ে গেলে জীবনটাই ধ্বংস হয়ে যাবে। লেখাপড়া কিংবা জীবনের বৃহত্তর উদ্দেশ্য সবকিছুই ভেস্তে যাবে। যার পরিণতিতে যুবকের সকল মেধা ও যোগ্যতা বিফলে যাবে।

একটি সন্তান যখন নবযৌবনে পৌঁছে, তখন তার দেহে শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন দেখা দিতে থাকে। ছেলে হোক, মেয়ে হোক এ বয়সটায় সবার মধ্যেই শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ একটা নতুন অবস্থার সৃষ্টি হয়। সেই সাথে শরীরের  আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক Gland বা গ্রন্থিগুলো তৎপর হয়ে ওঠে। আধুনিক বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে যে, এই গ্লান্ডগুলো যা কিছুই উৎপাদন করে তা শরীরের প্রয়োজনেই করে। তবে যৌন হরমোন বলে পরিচিত আভ্যন্তরীণ গ্রন্থিগুলো যেমন টেস্টোস্টেরন, প্রজেস্ট্রোন এবং স্ট্রোজেন ইত্যাদি শারীরবৃত্তিয় কাজে এবং লৈঙ্গিক পূর্ণতার জন্যই বেশীরভাগ তৎপর থাকে। এই শারীরিক পরিবর্তন এবং এই নতুন অবস্থা আল্লাহর সৃষ্টি প্রক্রিয়ারই এক অমোঘ বিধান। উত্তর প্রজন্ম সৃষ্টির বৃহত্তর স্বার্থেই আল্লাহ রাববুল আলামীন এ শারীরিক বিধান দিয়েছেন। এগুলোর যথার্থ ব্যবহার বা প্রয়োগবিধিও তিনি বলে দিয়েছেন। সদ্য যৌবনলাভকারী সন্তানদেরকে এ সম্পর্কে যথার্থ ধারণা এবং এর বৈধ ব্যবহার সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা না দিলে তাদের লক্ষ্যচ্যুতি এবং আদর্শচ্যুতি ঘটতে পারে। যার পরিণতিতে সন্তানের জন্য অপেক্ষা করবে অন্ধকার এক ভবিষ্যত।

এ শারীরিক অবস্থায় পৌঁছতে ছেলে এবং মেয়ের মধ্যে বয়সগত কিছুটা তারতম্য রয়েছে। ছেলেরা সাধারণত পনের বছর পর আর মেয়েরা নয় বছর পর থেকে এ শারীরিক অবস্থায় পৌঁছে। ছেলে এবং মেয়েদের বয়োঃপ্রাপ্তির এ অবস্থায় বাবা-মা সচেতন হ’লে তাদের কথাবার্তা এবং আচার-আচরণ থেকেই টের পেয়ে যেতে পারেন। ছেলেদের কণ্ঠ পরিবর্তন আর মেয়েদের শারীরিক পরিবর্তনসহ আরো কিছু নিদর্শন আছে, যা বাবা-মা লক্ষ্য করলেই অনুধাবন করতে পারেন। অনুধাবনের পর ছেলে- মেয়েদেরকে যথার্থ দিক-নির্দেশনা দেবেন যাতে তারা যৌবনের এ ক্রান্তিলগ্নে কোনরকম ভুল করে না বসে।
সন্তানদেরকে প্রশিক্ষিত করে তোলার লক্ষ্যে পিতামাতা বা অভিভাবকদের কিছু পরিকল্পনা ও অনুক্রমিক কর্মসূচী থাকা চাই। কোনভাবেই সন্তানদের মধ্যে একজনের সাথে আরেকজনকে ভুলভাবে তুলনা করা ঠিক নয়। তাদের মাঝে ন্যায় ও ইনছাফ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তাদের সাথে আচার-ব্যবহারের ক্ষেত্রে দৃঢ় তবে সদয় হ’তে হবে। স্বাবলম্বী হওয়ার ব্যাপারে তাদের সামনে বিভিন্ন দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যেতে পারে। তাদেরকে ধৈর্য এবং চিন্তা-ভাবনা করে কথা বলার শিক্ষা দিতে হবে। অন্যকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা থেকে বিরত থাকতে বাবা-মায়ের উচিত সহযোগিতা করা। বিভিন্ন সমস্যার ব্যাপারে সন্তানদের সাথে আলোচনা করার মাধ্যমে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং চিন্তার বিকাশ ঘটানোর সুযোগ দেওয়া উচিত। তাদের ভেতরে চিন্তাগুলোকে এমনভাবে ঢুকিয়ে দিতে হবে যাতে নিজেরাই নিজেদের মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতে পারে।

সন্তানের কোন কাজে পিতা-মাতা অসন্তুষ্ট হ’লে তার ওপর রেগে না গিয়ে বরং ঠান্ডা মাথায় তাকে কাছে ডেকে ঐ কাজটার ব্যাপারে তাকে বুঝিয়ে বলতে হবে, উপযুক্ত সময়ে তার মেজায ও পরিবেশ বুঝে। হুট করে যখন তখন উপদেশ দিতে গেলে হিতে বিপরীত হ’তে পারে। মনে রাখতে হবে সন্তানদের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা মানে তাদের ওপর খবরদারী করা, তাদেরকে আবদ্ধ রাখা কিংবা তাদের স্বাধীনতায় বাধা দেয়া নয়। অন্য কাউকে খারাপ কাজ করতে দেখলে পরিকল্পিতভাবে ঠান্ডা মাথায় এমনভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাতে হবে, যাতে সন্তানও বুঝতে পারে এমন ধরনের কাজ করা ঠিক নয় এবং এ ধরনের কাজ করতে দেখলে বাধা দেওয়া উচিত।

উপদেশ দেওয়ার সময় কোনভাবেই যেন আদেশ-নিষেধসুলভ প্রকাশভঙ্গি না থাকে। সেই সাথে সন্তানকে কোনভাবেই চাপের মুখে রাখা যাবে না, তিরস্কার বা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে কথা বলা যাবে না, এমনকি ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে কিংবা মানসিকভাবে চাপ দিয়ে কোন কাজ করানো যাবে না। সন্তানের সাথে যেকোন আচরণের সময় তার বয়স, মেধা, পরিবেশ, তার মানসিক অবস্থা, তার অনুভূতি, তার স্মৃতিশক্তির বিকাশ, তার বেড়ে ওঠা ইত্যাদির প্রতি খেয়াল রাখতে হবে এবং সে অনুযায়ী তার ওপর কাজের দায়িত্ব দিতে হবে। সর্বোপরি মনে রাখতে হবে উত্তম প্রশিক্ষণ হ’ল তাই, যা ভালবেসে আন্তরিকতার সাথে দেওয়া হয়। আর উত্তম প্রশিক্ষণের ফলাফল হ’ল উত্তম পরিবার। আল্লাহর নিকটে সকাতরে দো‘আ করছি তিনি আমাদেরকে তাঁর বিধান থেকে যথার্থভাবে উপকৃত হবার তৌফিক দিন- আমীন!

– নূরজাহান বিনতু আব্দুল মজীদ (রুকূ)

মন্তব্য করুন

Back to top button