নিজ অধিকার নিয়ে উদ্বিগ্ন না হয়ে স্ত্রীর অধিকারের প্রতি যত্নশীল হউন, সুখী দাম্পত্য জীবন কাটান
আল্লাহ্ আজওয়াজাল আইয়ুব আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে সত্তুর বছর বয়সে গুরুতর অসুস্থতা দিয়ে পরীক্ষা করেছিলেন। এই পরীক্ষার অংশ হিসাবে তিনি অর্থ-সম্পদ-প্রতিপত্তি-সন্তান সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যান। সময়ের পরিক্রমায় তাঁর (আঃ) আত্মীয় স্বজন ও প্রতিবেশিরাও তাঁকে ত্যাগ করে এবং এক পর্যায়ে শহরের বাইরে একটি আস্তাকুড়ের পাশে তাঁর (আঃ) জায়গা হয়। শুধু একজন তাঁকে ত্যাগ করেন নি, তিনি হচ্ছেন আইয়ুব (আঃ) এর স্ত্রী। তিনি যে শুধু তাঁর (আঃ) পাশেই থেকেছেন তা নয়, বরং ছোট-বড় ব্যক্তিগত প্রতিটি কাজ সম্পন্ন করতে সাহায্য করেছেন, সেবা-পরিচর্চা করেছেন। ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা থেকে শুরু করে তাঁর (আঃ) পুতিগন্ধময় ঘা, মল-মুত্র পর্যন্ত তিনি গভীর মমতায় নিজ হাতে পরিষ্কার করে দিতেন। ইবনে কাসির রচিত নবীদের কাহিনী ‘কাসাসুল আম্বিয়া’ গ্রন্থে এর কারণ উল্লেখ করা হয়েছে এইভাবেঃ ‘সুখের সময়ে তাঁর (স্ত্রীর) প্রতি আইয়ুব (আঃ) -এর উদারতা ও সহানুভূতিশীল ব্যবহার তিনি স্মরণ করেছিলেন’।
আইয়ুব (আঃ) এর স্ত্রীর এই ঘটনাটিকে একটি কেইস স্টাডি হিসাবে নেয়া যায়। সব ছেলেরাই (স্বামীরা) তাদের অন্তরে এমন আশা পোষণ করেন, যেন তার স্ত্রী সুখেদুঃখে সবসময় তাকে সঙ্গ দেন। বিশেষ করে কঠিন সময়ে যেন তাকে পরিত্যাগ না করেন, বরং পাশে থেকে সহায়তা করেন।
আচ্ছা বলুন তো, আইয়ুব (আঃ) এর স্ত্রী, সঙ্গিনী হিসাবে কোন দিক দিয়ে স্বতন্ত্র?
উত্তরঃ “সুখের সময়ে তাঁর (স্ত্রীর) প্রতি আইয়ুব (আঃ) -এর উদারতা ও সহানুভূতিশীল ব্যবহার তিনি স্মরণে রেখেছিলেন”।
এই ঘটনাটি আমাদেরকে যে নৈতিক উপদেশ দেয় তা হল, “আপনি আপনার স্ত্রীর ভেতর যে সকল চারিত্রিক গুণাবলী, ধীশক্তি থাকার প্রত্যাশা করেন। আপনার নিজের ভেতরেও ঠিক সেই সকল গুণাবলী থাকা প্রয়োজন”। ইংলিশে একটা কথা আছে, Goodness reaps goodness। সুরা আর-রাহমানে ঠিক যেমনটি বলা হয়েছে, “সৎকাজের প্রতিদান উত্তম পুরস্কার ব্যতীত কি হতে পারে”?[৫৫: ৬০]
যে সকল তরুণরা আমার ‘Marriage preparatory workshops’ অংশগ্রহন করে, তাদেরকে আমি বলি, “স্ত্রীদের উপর তোমাদের অধিকারগুলো জানার চেষ্টা করার আগে তোমার উপর তোমার স্ত্রীর অধিকারগুলো সম্পর্কে আগে জানো। আগে তাকে তার অধিকারগুলো দাও, তোমার অধিকার আপসেই তুমি পেয়ে যাবে, এমনকি বেশিও পেতে পারো”। তাহলে স্বামীর উপর স্ত্রীর অধিকার কি? খুব সহজ একটা উদাহরণ দেই। যদি আপনি আশা করেন, আপনার স্ত্রী সবসময় আপনার সামনে সেজেগুজে, পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন এবং সুশ্রী হয়ে নিজেকে উপস্থাপন করবে। তাহলে আপনার স্ত্রীরও সেই একই অধিকার আছে আপনার উপর। ইবনে আব্বাস রাদি আল্লাহু আনহু তাঁর স্ত্রীর কাছে সর্বদা পরিপাটি ও পরিচ্ছন্ন হয়ে উপস্থিত হতেন। যখন অন্য সাহাবীরা উনাকে এই বিষয়ে প্রশ্ন করেছিলেন, তখন উত্তরে তিনি (রাঃ) বলেছিলেন, “পুরুষদের যেমন স্ত্রীদের উপর অধিকার রয়েছে, তেমনি ভাবে স্ত্রীদেরও অধিকার রয়েছে পুরুষদের উপর“। [সুরা আল বাকারাহ: ২২৮]
বিবাহিত ছেলেরা প্রতিদিন সকালে গোসল করে পাটভাঙ্গা কাপড় পরে, কোলন-পারফিউম মেখে সুগন্ধ ছড়িয়ে তাদের কর্মক্ষেত্রে যায়। কেন যায়? কারণ কর্মক্ষেত্রে নিজেকে প্রেজেনটেবল করার দরকার আছে। সেখানে স্মার্ট-আকর্ষণীয়া সহকর্মীরা মিষ্টি হেসে যখন কুশল বিনিময় করে, তখন তারা মেলটিং পয়েন্টে চলে গিয়ে তাদের সাথে কথা বলে। সে সময় হাসিমুখে কথা বলতে তাদের কোন সমস্যা হয় না। সন্ধ্যায় ঘেমে, কুঁচকানো কাপড়ে একরাশ বিরক্তি নিয়ে তারা বাড়িতে ফিরে। সারাদিন হাসিমুখে ঘোরাঘুরি করার জন্য সম্ভবত তাদের ফেসিয়াল মাসল ব্যাথা হয়ে যায়। তাই স্ত্রী যখন হাসিমুখে দরজা খুলে সালাম দেয়, তখন কোনমতে ‘হু’ বলে কপাল কুঁচকে বাড়িতে প্রবেশ করে। বাসার ভেতরে সবকিছুতেই তার বিরক্তি, আলসেমি। অনেকেই এইভাবেই স্ত্রীর সাথে ঘুমাতে যায়। অথচ আশা করে স্ত্রী তার সামনে সেজেগুজে, পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন এবং সুশ্রী হয়ে নিজেকে উপস্থাপন করবে!
অনেক বিবাহিত ছেলেরা কাজের পর বন্ধু-বান্ধব এর সাথে ক্যাফেতে, ফুড কর্নারে, রেস্টুরেন্টে, ক্লাবে — মধ্যরাত/ গভীররাত পর্যন্ত ‘কোয়ালিটি’ সময় কাটায়। অনেকে ছুটির দিনে বন্ধুদের নিয়ে পিকনিকে, মাছ ধরতে, বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে যায়। যখন বাসায় ফিরে আসে তখনও তারা টিভিতে খেলা দেখে, খবর শোনে/পড়ে, কম্পিউটারে ‘জরুরী কাজ’ করে কিম্বা মোবাইলে কথা বলে/মেসেজ চেক করে। তারপর যদি সামান্য সময় হয় তবে বাসার কোন কোন কাজ ঠিকমত হয় নাই, সেই খুঁত খুঁজে বের করে! স্ত্রীর সাথে সাধারণ কুশল বিনিময় করারই সময় হয়ে ওঠে না, রোমান্টিক কথা তো বহুত দূর কি বাত! আপনি আশা করে থাকবেন আপনি বাইরে কাজে গেলে আপনার স্ত্রী ধুয়ে-মুছে বাড়িঘর পরিস্কার করে, বিভিন্ন পদ রান্না করে টেবিল সাজিয়ে আপনার জন্য বাসায় অপেক্ষা করবে। আপনি বলবেন, “এটা আমার অধিকার, কারণ আমি উপার্জন করি”। খুবই ভালো কথা। তাহলে আপনার উপর আপনার স্ত্রীও কিছু অধিকার আছে। সেটা হচ্ছে, আপনি যখন বাসায় ফিরবেন তখন তাকে সময় দিবেন। মুখের উপর গ্যাজেট ধরে থাকা সময় না, কোয়ালিটি সময়। যে সব বিবাহিত ছেলেরা অকারণেই বাসার বাইরে থেকে সময় নষ্ট করে, তারা নিজেরাও এখন বুঝতে পারছে না, তারা তাদের বিবাহিত জীবনের কি অপূরণীয় ক্ষতি করছে। নিজের হাতে যে দেয়াল তারা তৈরি করছে, একসময় এটা ভাঙ্গার ক্ষমতা আর তাদের থাকবে না!
বর্তমান সময়ে ইয়ার-দোস্ত/জিম/সিনেমা/ ক্লাব/পার্টি/ শপিং মল/ ইয়োগা ক্লাস/কোয়ান্টাম সেন্টারে গিয়ে লোকেরা মনের স্বস্তি, শান্তি খোঁজে। অথচ সুরা আন-নাহল এ বলা হয়েছে, “আল্লাহ্ তায়ালাই তোমাদের জন্যে তোমাদের ঘরগুলোকে (শান্তির) নীড় বানিয়েছেন,…”। [১৬:৮০]
– সিফাত মেহজাবিন