বিজ্ঞানে মুসলিম অবদান
বাংলাদেশ আজ ডিজিটাল রাষ্ট্র। আধুনিক বিজ্ঞানের জয়যাত্রার বিজয় গানের সুর মুর্ছনায় দেশের সকলেই বিমোহিত। একদিনকার কল্পনার রাজ্য আজকে বাস্তবতায় ফুটে উঠেছে। ছোটবেলার ‘চাঁদের মা বুড়ির দেশে’ আজকে তথায় মানুষ বিচরণ করছে। মহারহস্যপুরী উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর মহাভেদ উন্মোচনে মানুষ তথায় আঘাত হানছে বারে বারে। প্রকৃতপক্ষে আধুনিক বিজ্ঞানের সফলতার জগৎ এক বিস্ময়কর অধ্যায়। পাখির বীরত্বকে হার মানিয়ে আকশে উড়ে বেড়াচ্ছে বাংলাদেশ বিমান। সমুদ্র্র সম্রাট দৈত্যাকৃতি নীল তিমির গর্বকে খর্ব করে সমুদ্রের উদর চিরে ধাবিত হচ্ছে ডুবোজাহাজ। দূর প্রাচ্য থেকে পরিচিত কণ্ঠের সাথে ছবিও ভেসে আসছে অবাক করে। দিনে দিনে আমরা পাচ্ছি বিজ্ঞানীদের থেকে জ্ঞান-সাধনার অভাবিত উপহার। বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে আজ মানব জীবনে এসেছে পরম সাচ্ছন্দ্য। এসেছে ডিজিটাল পদ্ধতি আর প্রগতি। মৌলিক চাহিদা যথা অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার ক্ষেত্রেও মুসলিম বৈজ্ঞানিকদের অবদান অনস্বীকার্য। বিজ্ঞান ছাড়া মানব সভ্যতাকে এখন আর কল্পনা করাই দুস্কর। বিশাল ভূমন্ডল আজ সংকীর্ণ রূপে প্রতিভাত হচ্ছে। মুহূর্তের ব্যবধানে পৃথিবী প্রদক্ষিণের ঘটনা আজকে আর অলীক নয়। ক্রমেই যেন কল্পনার বর্ণনাহীন সওয়ারী বাস্তবতায় পৌঁছতে বিজলির গতিতে এগিয়ে চলছে। হয়ত মানুষের ‘দুর্দম কৌতূহলের যবনিকা উন্মোচনই হচ্ছে এর শেষ মনজিল।
মহান স্রষ্টা পৃথিবীর জন্মলগ্ন থেকেই এক এক যুগে এক এক বিষয়ের উন্নতি সাধনের জ্ঞান দান করে ক্রিয়াশীল মানুষের জ্ঞানের রাজ্যকে সম্প্রসারিত করেছেন। তাই বর্তমান যুগ বিভিন্ন শিল্প ও যন্ত্রপাতির আবিষ্কার তথা বিজ্ঞানের চরম উন্নতির যুগ হিসেবে পরিগণিত। বিজ্ঞানের এ সফলতার যুগে অনেকের মধ্যেই সব কিছুকেই যুক্তি বিজ্ঞানের আলোকে বিচার ও বিশ্লেষণ করার একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। যদিও বিজ্ঞান জগৎ “জীবন সম্পর্কে নি্র্ভুল সত্যের সন্ধান লাভ করেছে” এমনকি দাবি করা যায় না; তবুও চির শাশ্বত কুরআন ও হাদীসের সবগুলো বিধান যুক্তির সাহায্যে ব্যাখ্যা করা সম্ভব বলে আমরা মনে করি।
বর্তমান মুসলিম সমাজে এমন কিছু ব্যক্তি রয়েছেন যারা মূলত ইসলামে বিশ্বাসী হয়ে থাকলেও আধুনিক জড়বাদী চিন্তা ধারার প্রভাবে ইসলাম সম্পর্কে সচেতন মনে কিছুটা সংশয়বাদী মনোভাব পোষণের ধৃষ্টাতা দেখাচ্ছেন। যুগ-যুগান্তের নানা বিভ্রান্তি ও শতাব্দীর পর শতাব্দীর দ্বন্দ্ব-সংঘাতের পর আজ মানুষ যখন আবার ইসলামের মহান আদর্শের কথা চিন্তা করতে শুরু করেছে তখনও এক শ্রেণীর মানুষ যুক্তি বুদ্ধির নামে ইসলামের চিরশাশ্বত আদর্শকে প্রাণপণে বিরোধিতা করে চলেছেন। তারা যদি সত্যিকারার্থে মুক্তবুদ্ধি ও বিজ্ঞানের অভিসারী হয়ে থাকেন তাহলে ইতিহাস পর্যালোচনার মাধ্যমে শ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যা উপস্থাপন করে এ কথা স্বীকার করতে বাধ্য হবেন যে, বিজ্ঞানের এ মহাসফলতা ইসলাম ও মুসলমানদেরই অবদান। এমনকি পাশ্চাত্য জগৎও বর্তমানে একবাক্যে স্বীকার করে নিয়েছে এবং বলেছে যে, “প্রাচীন দার্শনিকরা যেসব নীতিমালা উদ্ভাবন করে গেছেন, আধুনিক বিস্ময়কর বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার সেসবেরই ফলশ্রুতি।”
বিজ্ঞানের ইতিহাসকে আমরা মোটামুটি পাঁচ ভাগে ভাগ করতে পারি। যথা: ০১. গ্রীক যুগ ০২. মুসলিম যুগ ০৩. গ্যালিলিও নিউটনী যুগ ০৪. ক্ল্যাসিক্যাল যুগ ০৫. শিল্প ও আধুনিক যুগ। এর মধ্যে মুসলিম যুগই দীর্ঘস্থায়ী এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের ‘স্বর্ণযুগ’ বলে সর্বজন স্বীকৃত। গ্রীক যুগের অবসানকালে প্রায় সাড়ে নয়শ বছর বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কোন অগ্রগতি সুচিত হয়নি। বরং গ্রীকরা যৎসামান্য কিছুর সন্ধান পেয়েছিলেন, তারও অবলুপ্ত ঘটতে চলেছিল। এ দীর্ঘ অন্ধকার যুগের অবসান ঘটিয়ে যে যুগ আধুনিক বিজ্ঞানের জয়যাত্রার পথ সুগম করে দিয়েছে তাই মুসলিম যুগ বলে খ্যাত। মুসলিম যুগ প্রায় আটশত বৎসর স্থায়ী হয়েছিল। এ সময়ই অংক শাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা, পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন শাস্ত্র প্রভৃতির বিশেষ উন্নতি সাধিত হয়।
মুসলমানরা রসায়ন শাস্ত্রের জন্মদাতা বললে মোটেও অযুক্তিক হবে না। জারীর ইবনি হাইয়্যান ও ইমাম রাযি ছিলেন রসায়ন শাস্ত্রের সে যুগের নিউটন। এক হাজার শতাব্দীর বিখ্যাত মুসলিম বৈজ্ঞানিক আল হায়শাম (ল্যাটিন ভাষায় যার নাম দেয়া হয়েছে আল হাজিন)। পদার্থ বিজ্ঞানে তিনি যা দান করে গেছেন তা আধুনিক বিজ্ঞানের পরম সম্পদ। এ সময় মুসলিম বিজ্ঞানীদের গবেষণা দ্বারাই সর্বপ্রথম টেলিস্কোপের ধারা আবিষ্কৃত হয়েছিল। অংক শাস্ত্রে বাইনোমিয়েল তত্ত্ব, নানাবিধ সমীকরণ এবং আরো বহু বিষয় মুসলিম বিজ্ঞানের অসাধারণ কীর্তির ফসল। অ্যালজেব্রা ও কিমিস্ট্রি এ শব্দ আরবি আল-জাবার ও আল কিমী শব্দ থেকে নেয়া হয়েছে।
চিকিৎসা শাস্ত্রে মুসলমানগণ এত উন্নতি লাভ করেছিলেন যে, এক সময় গোটা ইউরোপের কাছে এ শাস্ত্রের জন্য মুসলিম মনীষীদের লেখা বইগুলো একমাত্র পাঠ্য বলে বিবেচিত হত। এ শাস্ত্রে ইবনে সিনার সাম ইউরোপ ও আমেরিকার শিক্ষিত সমাজের সর্বজনবিদিত। ভুগোল, জ্যোতির্বিদ্যা, ইতিহাস প্রভৃতি জ্ঞানের রাজ্যে আল-বিরুনি, ইবনি বাতুতা, আব্দুল্লাহ আল ইদ্রিসি, ইয়াকুত আল রুমি প্রমুখের নাম ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ রয়েছে।
সবচেয়ে বড় কথা হল: বিজ্ঞানের ব্যবহারিক দিক অর্থাৎ পরীক্ষা-নিরীক্ষা পদ্ধতি সর্বপ্রথম মুসলিম বিজ্ঞানীরাই প্রবর্তন করেছিলেন। গ্রীক যুগে এটা কারো জানাও ছিল না। খলিফা আল হাকাস এর সময় কায়রোতে প্রতিষ্ঠিত সরকারি সাহায্যপুষ্ট বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এশিয়ান বাগদাদ আর ইউরোপের কর্ডোভা প্রভৃতি নগরী সে যুগে বিশ্বের জ্ঞানচর্চার সর্বপ্রধান কেন্দ্র ছিল। সে যুগে মুসলমানদের জ্ঞান সাধনায় আরো এমন কিছু আবিষ্কার হয়েছিল, আধুনিক বিজ্ঞানে যার নকল পর্যন্ত করতে পারেনি।দামেস্কোর প্রাচীন স্থাপত্যশিল্প, স্পেনের বিস্ময়কর আবিষ্কারসমূহের ইতিহাস জানলে জ্ঞাত হওয়া যাবে যে, পৃথিবীর কল্যাণকর অত্যাবশ্যকীয় আবিষ্কারসমূহের অধিকাংশই আরব তথা মুসলমানদের জ্ঞান-সাধনার উপহার। তখনকার সভ্য জগতে ইউরোপবাসীর কোন নাম-গন্ধও ছিল না। তখন মুসলমানগণ এসব কিছুর আবিষ্কার করে জগদ্বাসীদের তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। দৃষ্টান্ত হিসেবে সংক্ষিপ্তারারে কিছু আলোকপাত করা হলো।
কামান আবিষ্কার স্পেনীয় আরবদের আবিষ্কৃত কামান আজও কালের সাক্ষী বহন করে স্পেনের জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। এসব কামান তারা গ্রানাডার দুর্গ প্রতিরক্ষার কাজে ব্যবহার করতো।উত্তম কাপড় আবিষ্কারদামেস্কো, স্পেন, আসবেলিয়া ও হিন্দুস্তানের মিহি ও পাতলা কাপড় শিল্প এত প্রসিদ্ধ ছিল যে, পৃথিবীর অন্য কোথাও তার তুলনা হয় না। এমনকি খোদ ইংরেজরাও এর শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করেছে। স্পেনের মারিয়া ও খিরা শহরে ছয় হাজার কারখানা শুধু রেশমী, শার্টিন ও পশমী কাপড় তৈরি করত এবং ৮শ কারখানায় সূচিকর্ম ও চাদরের কিনারায় ফুলের কাজ করা হত। তথায় ছারকিস্তার, মখমল ইত্যাদি উত্তম ধরনের সূক্ষ্ম কাপড় বহুল পরিমাণে তৈরি হত। ইউরোপীয় কারিগর এর নকল করেছে মাত্র। অদ্যাবধি এসব কাপড় আরবীয় নামের সাথে সম্পৃৃক্ত রয়েছে।
বাসনপত্র ও প্রসাধনী দ্রব্যসামগ্রী আবিষ্কারচিনি এবং কাচের মনোরম বাসনপত্র প্রসাধনী দ্রব্যসামগ্রী আজকাল ইংরেজদের অবদান বলে পরিচিত। মূলত এসব তাদের কয়েকশ বৎসর পূর্বেই আরবীয় কারিগর প্রস্তুত করেছে। মালিকা শহর এ শিল্পে প্রসিদ্ধ ছিল। এ জন্য বর্তমানেও আরব দেশে উন্নতমানের বাসনপত্রকে মালিকী বলা হয়ে থাকে। এর আবিষ্কারক ছিলেন স্পেনের ‘হাকিম আব্বাস ইবনি ফারসান’।কাগজ আবিষ্কার সাধারণত মনে করা হয় যে, কাগজ তৈরির কারখানা ইউরোপীয়দের আবিষ্কার। কিন্তু ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়- এটাও স্পেনের মুসলমানদের আবিষ্কার। স্পেনের বিভিন্ন শহরের অধিবাসীরা কাগজ শিল্পকে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছায়। সেখান হতে উন্নতমানের কাগজ প্রস্তুত হয়ে স্পেনের বিভিন্ন শহরে রপ্তানি হতো। প্রেস আবিষ্কারপ্রেস ও ইউরোপীয়দের আবিষ্কার বলে মনে করা হয় এবং গোটেন বার্গকে এর আবিষ্কারক বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু ইতিহাসে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, মূলত এর প্রথম আবিষ্কারক ছিল মুসলমান। স্পেনে প্রথম মুদ্রণ যন্ত্র আবিষ্কৃত হয়। স্পেনের বর্তমান ইতিহাস পর্যালোচনা করে জানা যায় যে, হিজরি চতুর্থ শতাব্দীর সুলতান নাসিরের উজিরে আজম আব্দুর রহমান ইবনি বদরশাহির হুকুমনামা লিখে ছাপাতে পাঠাতেন এবং মুদ্রিত কপি তিনি নিজের শাসনাধীন বিভিন্ন স্থানে পাঠাতেন। এর দ্বারা প্রমাণ পাওয়া যায় যে, গোটেন বার্গের চারশ বৎসর পূূর্বে মুসলমানগণ প্রেস আবিষ্কার করেছিলেন। বিমান আবিষ্কার বর্তমান বিমান আবিষ্কার বিজ্ঞানের চরম সফলতার এক চমক। এটারও প্রথম আবিষ্কারক ছিলেন আব্বাস ইবনি ফারনাস নামীয় জনৈক মুসলমান বিজ্ঞানী। তিনি বিশেষ ধরনের পাখা আবিষ্কার করেছিলেন। এ পাখা বাহুতে লাগিয়ে যে কোন মানুষ অতি সহজে আকাশে উড়তে পারতো। বর্তমান বিমানে যেসব বিপদ আপদ ও ঝুঁকি রয়েছে, উক্ত পাখা ওসব থেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ ছিল।
প্রফেসর মুহাম্মাদ মাসউদুর রহমান