মুসয়াব ইবন উমাইর (রাঃ)
নাম মুসয়াব, কুনিয়াত আবু মুহাম্মদ। ইসলাম গ্রহণের পর লকব হয় মুসয়াব আল-খায়ের। পিতা ’উমাইর এবং মাতা খুনাস বিনতু মালিক। পিতা-মাতার পরম আদরে ঐশ্বর্যের মধ্যে লালিত মক্কার অন্যতম সুদর্শন যুবক ছিলেন তিনি। মা সম্পদশালী হওয়ার কারণে অত্যন্ত ভোগ বিলাসের মধ্যে তাঁকে প্রতিপালন করেন। তখনকার যুগে মক্কার যত রকমের চমৎকার পোশাক ও উৎকৃষ্ট খুশবু পাওয়া যেত সবই তিনি ব্যবহার করতেন। রাসূলুল্লাহর সা. সামনে কোনভাবে তাঁর প্রসংগ উঠলে বলতেনঃ ‘মক্কায় মুসয়াবের চেয়ে সুদর্শন এবং উৎকৃষ্ট পোশাকধারী আর কেউ ছিল না।’ (তাবাকাত) ঐতিহাসিকরা বলেছেনঃ ‘তিনি ছিলেন মক্কার সর্বোৎকৃষ্ট সুগন্ধি ব্যবহারকারী।’
সৌন্দর্য্য, সুরুচি ও সৎ স্বভাবের সাথে সাথে আল্লাহ তা’আলা তাঁর অন্তরটি দারুণ স্বচ্ছ করে তৈরী করেছিলেন। তাওহীদের একটি মাত্র ঝলকেই তিনি শিরকের প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে ওঠেন এবং হযরত রাসুলে পাকের দরবারে হাজির হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। এ সেই সময়ের কথা যখন রাসূল সা. হযরত আরকামের বাড়ীতে অবস্থান করে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে চলেছিলেন এবং মুসলমানদের সামনের মক্কার মাটি সংকীর্ণ হয়ে উঠেছিলো।
মক্কার অলিতে-গলিতে, কুরাইশদের আড্ডায়, পরামর্শ সভায় তখন একই আলোচনা- মুহাম্মাদ আল আমীন ও তঁঅর নতুন দ্বীন আল ইসলাম। কুরাইশদের এই আদুরে দুলাল এসব আলোচনা অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে শুনতেন। অল্প বয়স্ক হওয়া সত্ত্বেও তিনি হতেন কুরাইশদের সকল বৈঠক ও মজলিসের শোভা ও মধ্যমণি। তাদের প্রতিটি বৈঠকে সবার কাম্য হতো তাঁর উপস্থিতি। তীক্ষ্ণ মেদা, প্রখর বুদ্ধিমত্তা ও ব্যক্তিত্ব ছিল তাঁর চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য। আর এ বৈশিষ্ট্য তাঁর হৃদয়ের সকল দ্বার, সকল অর্গল উন্মুক্ত করে দেয়।
তিনি শুনতে পেলেন, রাসূল সা. ও তাঁর প্রতি বিশ্বাসীরা কুরাইশদের সকল অর্থহীন কাজ ও তাদের যুলুম অত্যাচার থেকে দূরে থেকে সেই সাফা পাহাড়ের পাদদেশে আল আরকাম ইবন আবিল আরকামের বাড়ীতে সমবেত হন। সব দ্বিধা সব দ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে একদিন সন্ধ্যায় তিনি হাজির হলেন দারুল আরকামে। রাসুল সা. সেই দিনগুলিতে সেখানে তাঁর সাথীদের সংগে মিলিত হতেন, তাদেরকে কুরআন শিক্ষা দিতেন এবং তাদের সাথে নামায আদায় করতেন।
মুসয়াব ইবন উমাইর দারুল আরকামে বসতে না বসতেই কুরআনের আয়াত নাযিল হলো। রাসূলের সা. যবান থেকে সে আয়াত বের হয়ে তা যেন সকল শ্রোতার কর্ণকুহরে ও হৃদয়ের গভীরে প্রবেশ করতে লাগলো। সেই বরকতময় সন্ধ্যায় ইবন ’উমাইরও হয়ে গেলেন এক বিশ্বাসী অন্তঃকরণের অধিকারী। খুশী ও আনন্দে তিনি হয়ে পড়েন আত্মহারা। রাসুল সা. তাঁর একটি পবিত্র হাত বাড়িয়ে দিলেন মুসয়াবের বুকের ওপর। দারুণ এক প্রশান্তিতে বিভোর হয়ে পড়েন মুসয়াব। মুহূর্তে তিনি তঁঅর বয়সের তুলনায় বহুগুণ বেশী হিকমত ও জ্ঞান লাভ করলেন এবং এমন দৃঢ়তা অর্জন করলেন যে হাজারো বিপদ মুসীবাত তাঁর আর কোনদিন বিন্দুমাত্র টলাতে পারেনি।
মুসয়াবের মা খুনাস বিনতু মালিক ছিলেন এক প্রচণ্ড ব্যক্তিত্বের অধিকারিণী। মুসয়াব তাকে যমের মত ভয় করতেন। তিনি ইসলাম গ্রহণের পর ধরাপৃষ্ঠে একমাত্র তাঁর মা ছাড়া আর কারো ভয় পেতেন না। কুরাইশ ও তাদের দেব-দেবীসহ সকল শক্তি তাঁর কাছে তুচ্ছ মনের হলো। কিন্তু মায়ের ভয় তিনি দূর করতে পারলেন না। তাই সিদ্ধান্ত নিলেন আল্লাহর চূড়ান্ত ফায়সালা না হওয়া পর্যন্ত ইসলাম গ্রহণের সংবাদটি চেপে যাওয়ার দারুল আরকামে যাতায়াত চলতে লাগলো। রাসূলুল্লাহর সা. মজলিসে বসতে লাগলেন। কিন্তু তার মা কিছুই জানতে পেলেন না।
একদিন গোপনে তিনি দারুল আরকামে প্রবেশ করছেন, উসমান ইবন তালহা তা দেখে ফেললো। আরেক দিন তিনি মুহাম্মাদের সা. মত নামায পড়ছেন, সেদিনও তা উসমানের চোখে পড়ে যায়। বাতাসের আগে খবরটি মক্কার অলিতে গলিতে ছড়িয়ে পড়লো। তাঁর মায়ের কানেও খবরটি পৌঁছে গেল।
মুসয়াবকে তাঁর মা, গোত্রের লেকাজন ও মক্কার নেতৃবৃন্দের সামনের কাঠগড়ায় তাঁর করানো হলো। তিনি অত্যন্ত স্থির বিশ্বাস ও প্রশান্ত চিত্তে তাদেরকে পাঠ করে শুনাতে লাগলেন কুরআনের সেই মহাবাণী যার ওপর তিনি ঈমান এনেছেন। মা তাঁর গালে থাপ্পড় মেরে চুপ করিয়ে দিতে চাইলেন। বকাঝকা, মারপিট চললো। তারপর তাঁকে ঘরে আবদ্ধ করে রাখা হলো।
তিনি বন্দী অবস্থায় কাটাতে লাগলেন। রাত্রিদিন চব্বিশ ঘন্টা তাঁকে পাহারা দেয়া হয়। এর মধ্যে তিনি খবর পেলেন, তাঁরই মত কিছু মুমিন মুসলমান হাবশায় হিজরাত করছেন। তিনি মায়ের চোখে ধুলো দিয়ে সেই দলটির সাথে হাবশায় চলে গেলেন।
একদিন মুসলমানদের একটি দল রাসূলুল্লাহর সা. পাশে বসে আছেন। এমন সময় পাশ দিয়ে তারা মুসয়াবকে যেতে দেখলেন। তাঁকে দেখেই বৈঠকে উপস্থিত সকলের মধ্যে ভাবান্তর সৃষ্টি হলো। তাঁদের দৃষ্টি নত হয়ে গেল। কারো কারো চোখে পানি এসে গেল। কারণ, মুসয়াবের গায়ে তখন শত তালি দেওয়া জীর্ণ শীর্ণ একটি চামড়ার টুকরো। তাতে মারাত্মক দারিদ্রের ছাপ সুস্পষ্ট। তাঁদের সকলের মনে তখন তাঁর ইসলাম পূর্ব জীবনের ছবি ভেসে উঠলো। তখনকার পরিচ্ছদ হতো বাগিচার ফুলের মত কোমল চিত্তাকর্ষক ও সুগন্ধিময়। এ দৃশ্য দেখে একটু মুচকি হেসে রাসূল সা. বললেনঃ ‘মক্কায় আমি এ মুসয়াবকে দেখেছি। তার চেয়ে পিতামাতার বেশী আদরের আর কোন যুবক মক্কায় ছিল না। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের মুহাব্বতে সবকিছু সে ত্যাগ করেছে।’
কিছুদিন হাবশায় থাকার পর তিনি মক্কায় ফিরে এলেন। তারপর রাসূলুল্লাহর সা. নির্দেশে আরেকটি দলকে সংগে করে হাবশায় চলে যান। কিন্তু মুসয়াব উপলব্ধি করেছিলেন, তিনি মক্কায়, হাবশায় যেখানেই থাকুন না কেন, জীবন তাঁর নতুন-রূপ ধারণ করেছে। তাঁর একমাত্র অনুকরণীয় আদর্শ ব্যক্তি মুহাম্মাদ সা. এবং একমাত্র কাম্য মহাপ্রভু আল্লাহর সন্তুষ্টি।
তাঁর মা নতুন দ্বীন থেকে ফিরাতে ব্যর্থ হয়ে তাঁকে সবকিছু দেওয়া বন্ধ করে দিল। যে ব্যক্তি তাঁদের দেব-দেবীকে ছেড়ে দিয়েছে, তাদের গালাগাল করে, তা সে নিজের পেটের ছেলেই হোকনা কেন, তাকে সে কোন মতেই খেতে পরতে দিতে পারে না।
মুসয়াব হাবশা থেকে ফিরে আসার পর তার মা আবারো তাকে বন্দী করতে চাইলো। তিনি মায়ের মুখের ওপর কসম খেয়ে বললেনঃ যদি তুমি এমনটি কর এবং যারা তোমার এ কাজে সাহায্য করবে তোমাদের সবাইকে আমি হত্যা করবো। মা তার এই বেয়াড়া ছেলেকে জানতো। তাই কাঁদতে কাঁদতে তাঁকে বিদায় দিল, আর তিনিও মাকে কাঁদতে কাঁদতে বিদায় দিলেন।
বিদায় মুহূর্তে মা যেমন কুফরীর ওপর ছেলেও তেমনি ঈমানের ওপর অটল। প্রাণ-প্রিয় ছেলেকে বাড়ী থেকে তাড়িয়ে বের করে দিতে দিতে মা বলছেঃ ‘তোমার যেখানে খুশী যাও। আমাকে আর মা বলে ডেক না।’ ছেলে একটু মায়ের দিকে এগিয়ে বললেনঃ ‘মা আমি আপনাকে ভালো কথা বলছি, আপনার প্রতি আমার দারুণ মমতা রয়েছে। আপনি একবার একটু বলুন, আশহাদু আন্-লাইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূলুহু।’ মা উত্তেজিত হয়ে নক্ষত্ররাজির নামে কসম খেয়ে বললেনঃ ‘আমি তোমার দ্বীন গ্রহণ কবো না। তোমার দ্বীন গ্রহণ করলে আমার মতামত ও বুদ্ধি বিবেক দুর্বল বলে মনে করা হবে।’ এভাবে কুরাইশদের সেই চরম আদুরে ও বিলাসী যুবক মুসয়াব বাড়ী থেকে বিতাড়িত হয়ে পথে বেরিয়ে পড়লেন। এখন তিনি মোটা শতচ্ছিন্ন তালিযুক্ত পোশাক পরেন। একদিন খাবার জুটলে অন্যদিন অভূক্ত কাটান। কিন্তু বিশ্বাসের আলোয় আলোকিত তাঁর অন্তরটি।
হজ্জের সময় মদীনা থেকে কতিপয় লোক মক্কায় এসে রাসূলুল্লাহর সা. সাথে গোপনে আকাবায় সাক্ষাৎ করলো এবং তাঁর ওপর ঈমান এনে বাইয়াত করলো। তারা মদীনায় ফিরে গেল। তাদেরকে দ্বীনের তালীম দেওয়ার এবং অন্যদের কাছে দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে, এবং মদীনাকে হিজরাতের জন্য প্রস্তুত করার লক্ষ্যে রাসূল সা. মুসয়াবকে দূত হিসাবে মদীনা পাঠালেন। এভাবে তিনি হলেন ইসলামের ইতিহাসে প্রথম দূত।
মক্কায় তখন মুসয়াবের চেয়েও বয়সে ও মর্যাদায় বড় অনেক সাহাবী ছিলেন। তা সত্ত্বেও এ গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য রাসূল তাঁকেই নির্বাচন করেন। মুসয়াব তাঁর খোদাপ্রদত্ত বুদ্ধি, মেধা ও মহৎ চরিত্রের সাহায্যে অত্যন্ত আমানতদারীর সাথে এ কঠিন দাযিত্ব পালন করেন। কঠোর সাধনা, নিষ্ঠা ও মহত্বের সাহায্যে তিনি মদীনাবাসীদের হৃদয়ের সাথে সংলাপ করেন। ফলে দলে দলে তারা আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করে।
মুসয়াব মদীনায় এলেন। এর আগে মদীনার মাত্র বারো জন লোক আকাবায় এসে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু তিনি মদীনায় আসার পর কয়েক মাস যেতে না যেতেই বহু মানুষ তাঁর দাওয়াতে সাড়া দিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। পরবর্তী হজ্জ মওসুমে মদীনাবাসী মুসলমানদের বাহাত্তর জনের একটি প্রতিনিধিদল তাদের ধর্মীয় শিক্ষক ও নবীর দূত মুসয়াবের সাথে মক্কায় এলো এবং আকাবায় আবার রাসূলুল্লাহর সা. সাথে মিলিত হলো।
মুসয়াব তাঁর দায়িত্ব এবং সে দায়িত্বের সীমা সঠিকভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন, তিনি আল্লাহর দিকে আহ্বানকারী এবং আল্লাহর এমন এক দ্বীনের সুসংবাদ দানকারী যা মানবসমাজকে হিদায়াত ও সরল সোজা পথের দিকে আহ্বান জানায়। তাঁর ওপর এ দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কোন দায়িত্ব নেই।
মুসয়াব মদীনায় পৌঁছে আসয়াদ ইবন যারারার অতিথি হলেন। তাঁরা দু’জন মদীনার বিভিন্ন গোত্রে, বিভিন্ন বাড়ীতে এবং সমাবেশে এক আল্লাহর দিকে মানুষকে দাওয়াত দিতে লাগলেন। নানারক বাধারও সম্মুখীন হলেন। কিন্তু বুদ্ধি, প্রজ্ঞা ও ধৈর্যের সাথে সব বাধা তাঁরা অতিক্রম করলেন।
একদিন তিনি কিছু লোককে দাওয়াত দিচ্ছেন। হঠাৎ বনী আবদিল আশহালের নেতা উসাইদ ইবন হুদাইর সশস্ত্র অবস্থায় দারুণ উত্তেজিতভাবে উপস্থিত হল। তার ভীষণ রাগ সেই ব্যক্তিটির ওপর যে কিনা মুহাম্মাদরে দূত হিসাবে এখানে এসেছে এবং মানুষকে তাদের পৈত্রিক ধর্ম ত্যাগ করতে উৎসাহিত করছে। সে তাদের উপাস্য দেব-দেবীকে গালাগালও করছে। উসাইদের এ রণমূর্তি দেখে মুসয়াবের পাশে বসা মুসলমানরা ভয় পেয়ে গেলেন। কিন্তু না, মুসয়াব ভয় পেলেন না, সহাস্যে উসাইদকে স্বাগতম জানালেন। হাসতে হাসতে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। উসাইদ তখন তাঁকে ও আসয়াদ ইবন যারারাকে লক্ষ্য করে বলছেঃ তোমরা আমাদের গোত্রীয় এলাকায় এসে এভাবে আমাদের দুর্বল লোকদের লেকাদের বোকা বানাচ্ছো কেন? যদি তোমাদের মরার সখ না থাকে তাহলে আমাদের এলাকা থেকে বেরিয়ে যাও।
হাসতে হাসতে মুসয়াব তাকে বললেনঃ আপনি কি একটু বসে আমার কথা শুনবেন না? আমার কথা শুনুন। ভালো লাগে মানবেন, ভালো না লাগলে আমরা চলে যাব।
উসাইদ ছিল একজন বুদ্ধিমান লোক। মুসয়াবের কথা তার মনে লাগলো। এ তো বুদ্ধিমানের কথা। শুনতে আপত্তি কিসের! সে অস্ত্র ফেলে মাটিতে বসে কান লাগিয়ে মুসয়াবের কথা শুনতে লাগলো।
মুসয়াব পবিত্র কুরআনের আয়াত তিলাওয়াত করে নবী মুহাম্মাদ সা. যে দ্বীন নিয়ে এসেছেন তার ব্যাখ্যা করছেন, আর এদিকে উসাইদের মুখমণ্ডল একটু একটু করে হাস্যোজ্জ্বল হয়ে উঠছে। মুসয়াব তাঁর বক্তব্য এখনও শেষ করতে পারেননি, এর মধ্যে উসাইদ ও তাঁর সংগী লোকটি বলে বসলোঃ এ তো খুব চমৎকার ও সত্য কথা। তোমাদের দ্বীনে প্রবেশ করতে গেলে কি করতে হয়? মুসয়াব বললেনঃ শরীর ও পোশাক পবিত্র করে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এই সাক্ষ্য দিতে হয়।
উসাইদ উঠে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর যখন ফিরে এল তখন তার মাথার চুল থেকে টপ টপ করে পানি পড়ছে। দাঁড়িয়ে তিনি ঘোষণা করেন, ‘আশহাদু আন্ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ওয়া আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূলুহ।’ এ খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো, সাদ ইবন মুয়াজ ও সাদ ইবন উবাদা ছুটে এলেন মুসয়াবের নিকট। তাঁরা উভয়ে ইসলাম গ্রহণ করলেন। এসব নেতৃবৃন্দের ইসলাম গ্রহণের পর সাধারণ মদীনাবাসী বলাবলি করতে লাগলো, আমরা পেছনে পড়ে থাকবো কেন। চল যাই মুসয়াবের কাছে ইসলাম গ্রহণ করি।
এভাবে আল্লাহর রাসূলের প্রথম দূত এমনভাবে সফল হলেন যে, তার কোন তুলনা ইতিহাসে নেই। সময় দ্রুত গতিতে বয়ে চললো। রাসূলুল্লাহ সা ও তাঁর সংগী সাথীরা মক্কা থেকে মদীনায় হিজরাত করে এসেছেন। হিংসায় কুরাইশরা জ্বলতে লাগলো। মদীনা থেকেও তাদেরকে সমূলে উৎপাটিত করার ষড়যন্ত্র করলো। বদরে তারা এমন শিক্ষাই পেল যে, তাদের হিংসা প্রতিশোধস্পৃহায় রূপান্তরিত হলো। তারা আবার উহুদে মুসলমানদের মুখোমুখি হলো। যুদ্ধ শুরুর পূর্বে রাসূল সা. মুসলিম বাহিনীর মাঝখানে সবার মুখের দিকে তাকাচ্ছেন। চিন্তা করছেন কার হাতে আজ ইসলামের ঝাণ্ডাটি দেওয়া যায়। গভীরভাবে নিরীক্ষণ করলেন। তারপর মুসয়াবকে ডাকলেন তাঁরই হাতে ঝাণ্ডাটি তুলে দিলেন।
তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। কুরাইশ বাহিনী পরাজয়ের মুখোমুখি। এমন সময় মুসলিশ তীরন্দাজ বাহিনী রাসূলুল্লাহর সা নির্দেশে ভুলে গিয়ে নিজেদের অবস্থান থেকে সরে কুরাইশদের পিছু ধাওয়া করলো। কিন্তু তাদের এ কাজ মুসলিম বাহিনীর সুনিশ্চিত বিজয় নস্যাৎ করে দিয়ে পরাজয় বয়ে নিয়ে এলো। মুসলিম তীরন্দায বাহিনীর ছেড়ে যাওয়া গিরিপথ দিয়ে কুরাইশ বাহিনী অকস্মাৎ ঢুকে পড়ে পেছন দিক থেকে মুসলিম বহিনীকে আক্রমণ করে বসলো। মুসলিম বাহিনী বিশৃঙ্খল হয়ে পড়লো। এই সুযোগে কুরাইশ বাহিনী তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করে রাসূলুল্লাহকে সা. ঘিরে ফেললো।
মুসয়াব ইবন উমাইর বিপদের ভয়াবহতা উপলব্ধি করলেন। যতটুকু সম্ভব তিনি ঝাণ্ডা উঁচু করে ধরলেন, গলা ফাটিয়ে নেকড়ের মত হুঙ্কার ছাড়তে এবং জোরে জোরে তাকবীর দিতে লাগলেন। আর সেইসাথে লম্ফ ঝম্ফ মেরে আস্ফালন দেখাতে লাগলেন। তাঁর উদ্দেশ্য হলো শত্রুদের দৃষ্টি রাসূলুল্লাহ সা. থেকে ফিরিয়ে নিজের প্রতি নিবদ্ধ করা। এভাবে সেদিন তিনি নিজের একটি মাত্র সত্তাকে একটি বাহিনীতে পরিণত করেন। অত্যন্ত আমানতদারীর সাথে একহাতে ঝাণ্ডা উঁচু করে ধরেন এবং অন্য হাতে প্রচণ্ড বেগে তরবারি চালাতে থাকেন। শত্রুবাহিনী তাঁর দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং তাঁর দেহের ওপর দিয়ে তারা রাসূলুল্লাহর সা. কাছে পৌঁছার চেষ্টা করে। হযরত মুসয়াবের অন্তিম অবস্থা সম্পর্কে ইবন সাদ বর্ণনা করে, ‘‘উহুদের দিনে মুসয়াব ইবন উমাইর ঝাণ্ডা বহন করেন। মুসলমানরা যখন বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে মুসয়াব তখন অটল হয়ে রুখে দাঁড়ান। অশ্বারোহী ইবন কামীয়া তাঁর দিকে এগিয়ে এসে তরবারির এক আঘাতে তাঁর ডান হাতটি বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। মুসয়াব তখন বলে ওঠেনঃ ‘ওয়ামা মুহাম্মাদুন ইল্লা রাসূল, কাদ খালাত মিন কাবলিহির রুসুল- মুহাম্মাদ একজন রাসূল ছাড়া আর কিছু নন। তাঁর পূর্বে আরো বহু রাসূল অতিবাহিত হয়েছেন।’ মুসয়াব বাম হাতে ঝাণ্ডাটি তুলে ধরেন। তরবারির অন্য একটি আঘাতে তাঁর বাম হাতটিও বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। আবারো তিনি ‘ওয়ামা মুহাম্মাদুন ইল্লা রাসূল’ এ কথাটি বলতে বলতে ঝান্ডর ওপর ঝুঁকে পড়ে দুই বাহু দ্বারা সেটি তুলে ধরেন। তারপর তাঁর প্রতি বর্শা নিক্ষেপ করা হয়। পতাকাসহ তিনি মাটিতে ঢলে পড়েন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। হযরত মুসয়াব শাহাদাতে পূর্বে যে বাক্যটি বার বার উচ্চারণ করছিলেন তখনও কিন্তু সেটি কুরআনের আয়াত হিসেবে নাযিল হয়নি। উহুদের এ ঘটনার পরই ‘ওয়ামা মুহাম্মাদুন ইল্লা রাসূল….’ এ আয়াতটি নিয়ে হযরত জিবরীল আ. উপস্থিত হন।’’
যুদ্ধ শেষে হযরত মুসয়াবের লাশটি খুঁজে পাওয়া গেল। রক্ত ও ঘূলোবালিতে একাকার তাঁর চেহারা। লাশের কাছে দাঁড়িয়ে রাসূল সা. অঝোরে কেঁদে ফেললেন। হযরত খাব্বাব ইবনুল আরাত বলেনঃ ‘আমরা আল্লাহর রাস্তায় আল্লাহর সন্তুষ্টি উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহর সা. সাথে হিজরাত করেছিলাম। আমাদের এ কাজের প্রতিদান দেওয়া আল্লাহর দায়িত্ব। আমাদের মধ্যে যাঁরা তাঁদের এ কাজের প্রতিদান মোটেও না নিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে তাঁদের একজন মুসয়াব ইবন উমাইর।
উহুদে তিনি শাহাদাত বরণ করলেন। তাঁকে কাফন দেওয়ার জন্য একপ্রস্থ চাদর ছাড়া আর কোন কাপড় পাওয়া গেল না। তা দিয়ে তাঁর মাথা ঢাকলে পা এবং পা ঢাকলে মাথা বেরিয়ে যাচ্ছিল। শেষমেষ রাসূল সা. আমাদের বললেনঃ চাদর দিয়ে মাথার দিক দিয়ে যতটুকু ঢাকা যায় ঢেকে দাও, বাকী পায়ের দিকে ‘ইযখীর’ ঘাস দাও। রাসূল সা. মুসয়াবের লাশের পাশে দিাঁড়িয়ে পাঠ কররেনঃ মিনাল মু’মিনীনা রিজানুল সাদাকু আহাদুল্লাহ আলাইহি….. মুমিনদের এমন কিছু লোক আছে যারা আল্লাহর সাথে অঙ্গীকার সত্যে পরিণত করেছে। তারপর তাঁর কাফনের চাদরটির প্রতি তাকিয়ে বলেনঃ আমি তোমাকে মক্কায় দেখেছি। সেখানে তোমার চেয়ে কোমল চাদর এবং সুন্দর যুলফী আর কারো ছিল না। আর আজ তুমি এখানে এই চাদরে ধুলি মলিন অবস্থায় পড়ে আছ। তিনি আরো বলেনঃ ‘আল্লাহর রাসুল সা. সাক্ষ্য দিচ্ছে, কিয়ামতের দিন তোমরা সবাই আল্লাহর কাছে সাক্ষ্যদানকারী হবে।’ তারপর সংগীদের দিকে ফিরে তিনি বলেনঃ ‘ওহে জনমণ্ডলী, তোমরা তাদের যিআরত কর, তাদের কাছে এস, তাদের ওপর সালাম পেশ কর। যাঁর হাতে আমার জীবন সেই সত্তার শপথ, কিয়ামত পর্যন্ত যে কেউ তাঁদের ওপর সালাম পেশ করবে তারা সেই সালামের জওয়াব দেবে।’
হযরত মুসয়াবের ভাই আবু রাওম ইবন উমাইর, আমের ইবন রাবীয়া এবং সুয়াইত ইবন সাদ তাঁকে কবরে নামিয়ে দাফন কাজ সম্পন্ন করেন।
হযরত মুসয়াব ছিলেন প্রখর মেধাবী, উদার ও প্রাঞ্জলভাষী বাগ্মী। যে দ্রুততার সাথে ইয়াসরিবে (মদীনা) ইসলাম প্রসার লাভ করেছিল তাতেই তাঁর এসব গুণের প্রমাণ পাওয়া যায়। তাঁর শাহাদাত পর্যন্ত যতটুকু কুরআন নাযিল হয়েছিল, তিনি মুখস্থ করেছিলেন। মদীনায় সর্বপ্রথম তিনিই জুময়ার নামায কায়েম করেন। মদীনায় মুসলমানদের সংখ্যা যখন একটু বেড়ে গেল তিনি রাসূলুল্লাহর সা. অনুমতি নিয়ে হযরত সাদ ইবন খুসাইমার রা. বাড়ীতে জুময়ার নামাযের সূচনা করেন। তিনিই ইমামতি করেন। নামাযের পর একটি ছাগল যবেহ করে মুসল্লীদের আপ্যায়ন করা হয়। (তাবাকাত)