মোহরানা বা দেনমোহর
“মাহার” একটি আরবী শব্দ। আমাদের দেশে যা দেনমোহর বা মোহরানা হিসাবে প্রচলিত। -বহুবচনে ﻣﻬﻮﺭﺓ – ﻣﻬﻮﺭ আভিধানিক অর্থে- স্ত্রীর মাহার। বিবাহ বন্ধনের প্রেক্ষিতে স্বামী তার স্ত্রীকে যে অর্থ/সম্পদ প্রদান করে তাকে মাহার বলে। [আল মিসবাহ আল মুনীর] কুরআন,সহীহ হাদীস ও ফিকহ শাস্ত্রে মাহার এর সমার্থক আরো কয়েকটি শব্দ পাওয়া যায়। তা হল- ১ / ﺍﻟﺼﺪﺍﻕ ( সাদাক) ২ / ﺍﻟﻨﺤﻠﺔ ( নিহলা) ৩/ ﺍﻟﻔﺮﻳﻀﺔ ( ফারীদা) ৪ / ﺍﻟﺤﺒﺎﺀ ( হিবা) ৫ / ﺍﻟﺼﺪﻗﺔ ( সাদাকাহ) ইত্যাদি। [আল-মাওসু’আতুল ফিকহিয়্যাহ।]
মাহারের হুকুম:
বিবাহ ইচ্ছুক প্রত্যেক পুরুষের জন্য মাহার প্রদান করা ওয়াজিব। আল্লাহ তা’আলা বলেন –
..“ উল্লেখিত নারীগণ ব্যতিত অন্য নারীকে অর্থব্যয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করতে চাওয়া তোমাদের জন্য বৈধ করা হল।“ [সূরা আন-নিসাঃ২৪]
একই সূরাতে আল্লাহ বলেন –
“ আর তোমাদের স্ত্রীদের তাদের মাহার দিয়ে দাও খুশি মনে।“ [সূরা আন-নিসাঃ৪]
অবশ্য স্ত্রী চাইলে মাহারের কিছু অংশ কিংবা সম্পূর্ণ অংশ ছেড়ে দিতে পারে। [সূরা আন-নিসাঃ৪] তবে এ ব্যাপারে স্ত্রীর উপর কোন প্রকারের চাপ প্রয়োগ করা যাবে না। মাহারের সাথে সংশ্লিষ্ট আরেকটি পরিভাষা হল ﺍﻟﻨﻔﻘﺔ ( নাফাকাহ), শারয়ী পরিভাষায় যার অর্থ হল স্ত্রীর অন্ন,বস্ত্র,বাসস্থান যা প্রদান করা স্বামীর কর্তব্য। তবে মাহার ও নাফাকাহ এর মাঝে পার্থক্য হল মাহার ওয়াজিব হয় বিবাহ অনুষ্ঠানের সাথে সাথে স্ত্রীর বিশেষ অঙ্গের সম্মান এর প্রেক্ষিতে,অপরদিকে স্ত্রীকে স্বামী নিজের সাথে রাখার জন্য নাফাকাহ প্রদান ওয়াজিব হয়ে থাকে। [ফাতহুল কাদিরের টিকা দ্রষ্টব্য ,খন্ডঃ৩ পৃঃ ৩২১] মাহার প্রদান করা ওয়াজিব হলেও সকল উলামাদের মতে মাহার বিবাহের রুকন তথা বিবাহ সম্পাদন শুদ্ধ হবার শর্ত নয়। [আল মুগনী; খন্ড-৬ ; পৃঃ ৭১২ ] উলামাদের ঐক্যমতের ভিত্তি হল কুরআনে বর্ণিত আয়াত – ﻻَّ ﺟُﻨَﺎﺡَ ﻋَﻠَﻴْﻜُﻢْ ﺇِﻥ ﻃَﻠَّﻘْﺘُﻢُ ﺍﻟﻨِّﺴَﺎﺀ ﻣَﺎ ﻟَﻢْ ﺗَﻤَﺴُّﻮﻫُﻦُّ ﺃَﻭْ ﺗَﻔْﺮِﺿُﻮﺍْ ﻟَﻬُﻦَّ ﻓَﺮِﻳﻀَﺔً “ যে পর্যন্ত না তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের স্পর্শ করেছ এবং তাদের জন্য মাহার ধার্য করেছ(এ অবস্থায়)তাদেরকে তালাক দিলে তোমাদের কোন গুনাহ নেই।”[সূরা আল বাকারাহঃ২৩৬] এ আয়াতের দ্বারা মাহারের উল্লেখ ছাড়াই তালাক সম্পাদন সহীহ ও বিশুদ্ধ বলে প্রতীয়মান হয়। অথচ তালাকের প্রশ্ন আসে বিবাহ সম্পাদন বিশুদ্ধ হলেই! [আল ইনায়া; খন্ডঃ২ ; পৃঃ ৪৩৪]
মাহারের পরিমান:
সাধারণভাবে মাহার কম ধার্য করাই মুস্তাহাব।রসূল(সাঃ)বলেন –
“ সে নারী বরকতের মাঝে আছে যাকে প্রস্তাব দেয়া সহজ ও যার মোহরানা অল্প” [ মুসনাদু আহমাদ; হাসান সানাদে]
তবে মাহার এর সর্বনিম্ন পরিমান সম্পর্কে ইমাম ইবনুল কায়্যিম(রহঃ) বলেন- “ কোন বস্তু, সেবা যার মূল্য আছে তাই মাহার হিসেবে ধার্য করা যেতে পারে” যেমন- সোনা,রূপা,টাকা-পয়সা, জমি জমা, ফলমূল ইত্যাদি। আর সেবার উদাহরণ হলঃ ভেড়া চরানো, সেচ দেয়া, ফল তোলা কুরআন শিক্ষা দেয়া ইত্যাদি। মাহারের সর্বাধিক পরিমাণের ক্ষেত্রেও নির্দিষ্ট কোন সীমা নেই। এ ব্যাপারে সকল আলিম ঐক্যমত পোষণ করেছেন। [আল-মুগনী; খন্ড- ৬; পৃঃ ৬৮১] আলিমগণ নিম্নোক্ত দালীলের ভিত্তিতে একমত হয়েছেন –
..“ আর (স্ত্রীদের) একজনকে দিয়েছ স্তুপীকৃত সম্পদ।“ [নিসাঃ২০]
এই আয়াতে ﻗﻨﻄﺎﺭ শব্দটির একটি অর্থ হচ্ছে- ‘প্রচুর সম্পদ,সম্পদের স্তুপ’ [আল হাবী আল কাবীর; খন্ডঃ ১২ ; পৃঃ ৪] বিবাহের পর উভয় পক্ষের সম্মতিতে পূর্ব নির্ধারিত মাহারের হ্রাস-বৃদ্ধি উভয়ই জায়েয।[সূরা আন-নিসাঃ৭৮] জমহুর আলিমগণও এ ব্যাপারে একমত পোষণ করেছেন। [আল মুগনি; খন্ডঃ৬ ; পৃঃ ৭৪৩-৭৪৪]
মাহারের প্রকারভেদ:
ওয়াজিব মাহার ২ প্রকার –
১/ নির্ধারিত বা মুসাম্মা মাহারঃ বিয়ের সময় বা বিয়ের পর উভয় পক্ষ আলাপ আলোচনার মাধ্যমে যে মাহার নির্ধারন করে তাকে নির্ধারিত বা মুসাম্মা মাহার বলে। [মাতালিবু উলিন নুহা; খন্ড-৫ ; পৃঃ ১৭৩]
২/ মাহারে মিছালঃ স্ত্রীর সমপর্যায়ের মেয়েদের মাহার তুলনা করে যে পরিমাণ মাহার স্বামী ও স্ত্রীর পক্ষ পছন্দ করে তাকে মাহারে মিছাল বলে। [রওদাতুত তলিবিন; খন্ড-৮ ; পৃঃ ২৮২]
মাহার প্রদানের সময়:
পারষ্পরিক সমোঝোতার ভিত্তিতে মাহার প্রদান বিয়ের সময় বা বিয়ের পরে উভয়ই জায়েয। [আল মুগনি; খন্ড-৭ ;পৃঃ ১৬৯] এমনকি মাহারের কিছু অংশ বিবাহের সময় এবং কিছু অংশ পরবর্তীতে প্রদান করাও জায়েয। তবে এ ক্ষেত্রেও তা পারষ্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে হতে হবে। [আল মুগনি; খন্ড-৭;পৃঃ১১৫] একটি ব্যাপার এখানে উল্লেখ্য যে,আমাদের সমাজে ছেলেদের সামর্থ্যের দিকে খেয়াল না রেখে কনেপক্ষ যে অবাস্তব মোহরানা দাবী করে এবং স্বামীও মোহরানা প্রদানের ক্ষেত্রে নানা প্রকারের টালবাহানা করে,অনেক ক্ষেত্রে প্রদানও করে না এ সবই সম্পূর্ণ শারীয়াহ বিরোধী কাজ। এর জন্য স্বামীকে ঋণখেলাপী হিসেবে আখিরাতে দন্ডায়মান হতে হবে।
আল্লাহ আমাদের ইসলাম সমস্ত আহকামের মৌলিক বিধিবিধান সঠিক উপায়ে পালন করার এবং আমাদের ওপর অর্পিত যাবতীয় দায়িত্বের হক্ক সুষ্ঠুভাবে আদায় করার তাউফিক দান করুন।
মোহরানার সংক্ষিপ্ত বিধান
সংকলনেঃ মোহাম্মদ তানভীর হায়দার
সম্পাদনাঃ শাইখ রায়হানুদ্দিন আল মাদানী
লিসান্স, মাদীনাহ ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়
আপনাদের অনেক ধন্যবাদ।।।।।।।।
ইসলামের এই মূল্যবান জিনিস কে সুন্দর ভাবে বুঝিয়ে বলার জন্য।।।।।