নাস্তিক্যবাদের পরিচয়
অবিশ্বাস, ধর্মহীনতা আর নাস্তিক্যবাদের অবিরাম ধেয়ে আসা ঝড়ের মুখে পড়ে আজ আমাদের যুবসমাজ দিগ্বিদিকশূন্য। যে জাতি এক সময় গোটা পৃথিবীর নেতৃত্ব দিয়েছে, বিস্তৃত দুনিয়ার দিগ-দিগন্তে বিজয়াভিযান পরিচালনা করেছে, মহান খালিকের মহাপবিত্র রিসালতের আলোকমালা অন্ধকার পৃথিবীর অলিতে-গলিতে পৌঁছে দিয়ে বিশ্ব-মানবতাকে হিদায়াতের রাজপথে এনে দাঁড় করিয়েছে, তৎকালীন পৃথিবীর মানবতার ঘাড়ে চেপে বসা সারশূন্য ধর্মগুলোর জের-জুলুম থেকে মুক্ত করে ইসলামের আদল-ইনসাফের সুশীতল ছায়াতলে এনে আশ্রয় দিয়েছে, শির্কের যিন্দানখানা থেকে আযাদ করে তাওহীদের পেয়ালা মানবতার অধরে তুলে ধরেছে- সেই জাতিই আজ সর্বহারা। বিশ্ব বিজেতা সেই জাতিই আজ বিশ্বের সবচেয়ে ভীতু ও পরাভূত জাতি। সবধরনের জুলুম আর জাহালত আজ সে জাতির সর্বত্র জেঁকে বসেছে। তাদের নতুন প্রজন্ম স্বীয় দীন-ধর্ম আর ঐতিহ্য থেকে সর্বদা পালানোর পথ খুঁজছে। পূর্বপুরুষের গৌরবোজ্জ্বল অতীতকে পাশে ফেলে রেখে কুফর, নাস্তিক্যবাদ আর পৌত্তলিকতার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ছে।
নাস্তিক্যবাদের পরিচয়
আজ গোটা পৃথিবী নানা সমস্যায় জর্জরিত। জ্ঞান-বিজ্ঞানের জয়জয়কার অবস্থা আর নানা আবিষ্কারের নেশায় একসময় সমগ্র মানবতা কল্পনা করেছিল যে, এবার বুঝি গোটা পৃথিবী সুখের আকাশে ডানা মেলে উড়বে। কিন্তু তা আর হয়ে উঠেনি। বিশ্ব যতই বস্তুগত উন্নতির পথে অগ্রসর হয়েছে, ততই সংকট আর মুসীবতের গভীর থেকে গভীরে তলিয়ে গেছে। আজ আমাদের জীবনে সম্পদের প্রাচুর্য্য এসেছে, পার্থিব বিলাস-ব্যসনের সকল উপকরণ বিদ্যমান আছে। কিন্তু নেই সুখ ও শান্তির নামের সেই সোনার হরিণ। বরং প্রতিনিয়ত এসব সমস্যা ও সংকটের পরিমাণ বেড়েই চলছে। মানসিক চাঞ্চল্য ও অস্থিরতা চারপাশ থেকে আমাদের ঘিরে ধরেছে। ফিতনা ও ফাসাদ আমাদের ওপর রাজত্ব কায়েম করে আছে। স্বার্থপরতা আর চরিত্রহীনতার সর্বত্র জয়জয়কার অবস্থা। জুলুম আর নির্যাতন নিজের সকল রূপ নিয়ে নৃত্য করছে। প্রতি মুহূর্তেই কেউ কেউ না রাজনীতির বলির পাঠা হচ্ছে। ধন-সম্পদের কারণে প্রতিদিনই মরতে হচ্ছে কাউকে না কাউকে। দু’একটি ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে গোটা পৃথিবীটাই আজ এসব সমস্যার সম্মুখীন। আফসোসের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, মানবতার পার্থিব ও বস্তুগত উন্নতি এসব সমস্যাকে আদৌ কমাতে পারেনি; বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা গেছে, মানুষ যতটাই বস্তুগত উন্নতি লাভ করেছে, এসব সমস্যার প্রকোপ ততটাই বেড়েছে।
আর এসব সমস্যা ও সংকটের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু হলো নাস্তিক্যবাদ। কিন্তু নাস্তিক্যবাদ কি প্রকৃত অর্থেই কোনো সমস্যার নাম নাকি এটা একই সঙ্গে অন্য কিছু থেকে সৃষ্ট সমস্যা ও সমস্যার কেন্দ্রবিন্দুও? নাস্তিক্যবাদ সমস্যা বলতে আসলে কী বোঝায়? এর উৎপত্তি ও কার্যকারণ কী? নাস্তিক্যবাদ সমস্যার ইসলামে কী সমাধান রয়েছে? সামনের পৃষ্ঠাগুলোতে আমরা এসব প্রশ্নেরই জবাব খোঁজার চেষ্টা করবো।
নাস্তিক্যবাদ বলতে কী বোঝায়?
নাস্তিক্যবাদ মূলত জগতের সকল দীন ও ধর্মকে অস্বীকারের নাম। এটা আল্লাহর অস্তিত্বে স্বীকার করে না। পরকাল, জান্নাত কিংবা জাহান্নাম কোনো কিছুতেই বিশ্বাস করে না। এর মতে, এই পৃথিবী আর এখানকার পার্থিব জীবনই সবকিছু। এটাই শুরু আবার এটাই শেষ। নাস্তিক্যবাদ মূলত আজ গোটা পৃথিবীর একটি পরিচিত মুখ। উত্তরাধিকারসূত্রে ইউরোপ ও আমেরিকাসহ গোটা পাশ্চাত্য পৃথিবী আল্লাহ ও জান্নাত-জাহান্নামে বিশ্বাসী খ্রিস্টধর্ম পেলেও আজ সেখানকার মানুষগুলো কেবল পার্থিব জীবনেই বিশ্বাস করে। খ্রিস্টবাদ আজ সেখানে একটি সেকেলে বিশ্বাসরূপে স্থান লাভ করেছে। গির্জাগুলো হয়ে পড়েছে প্রাচীন ইতিহাস আর ঐতিহ্যের স্মৃতিচিহ্ন রক্ষার যাদুঘর। মানুষের জীবনে এর এতটুকু প্রভাব আজ অবশিষ্ট নেই। অথচ এর বিপরীতে নাস্তিক্যবাদ কখন যে ধীরে ধীরে ইউরোপ ও আমেরিকার সাংবিধানিক ধর্মে পরিণত হয়ে গেছে তা তারা জানতেও পারেনি। আর সেকারণেই তারা সেই নাস্তিক্যবাদকে কখনো ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ আবার কখনো ধর্মহীনতা বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করে। বাদবাকি আমাদের মনে রাখতে হবে, বানান আর উচ্চারণে ভিন্নতা থাকলেও এসব শব্দের অর্থ ও তাৎপর্য কিন্তু এক ও অভিন্ন।
প্রাচ্য দুনিয়ার সবচেয়ে বড় রাষ্ট্র রাশিয়া হলো নাস্তিক্যবাদের লীলাভূমি। কম্যুনিজমের প্রাদুর্ভাবের সেই গোড়া থেকেই রাশিয়া একে বুকে আগলে রেখেছে। সকল সংকট আর প্রতিকূলতা থেকে একে রক্ষা করেছে। কম্যুনিজম ‘গায়েব’ বা অদৃশ্যে বিশ্বাস করে না। এর মতে, পৃথিবীর এই জীবনই সবকিছু। পৃথিবীতে মানুষ যে লড়াই আর সংগ্রাম করে, তাও মূলত এখানে টিকে থাকারই সংগ্রাম। রাশিয়া ব্যতীত প্রাচ্যের অধিকাংশ দেশই এতদিন পর্যন্ত হিন্দু, বৌদ্ধ কিংবা কনফুসিয়াস ইত্যাদি ধর্ম-বিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু পশ্চিমা নাস্তিক্যবাদের বাধভাঙা জোয়ারের সামনে শেষ পর্যন্ত সেগুলো দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনি। ভেসে গেছে প্রচণ্ড স্রোতের তোড়ে।
গোটা পৃথিবীর এমন সঙ্গিন ও ঝঞ্ঝাঘন অন্ধকার মুহূর্তে আজও ইসলামী বিশ্ব তাওহীদ আর অদৃশ্যে বিশ্বাসের দীপশিখা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু এর চারপাশে নৃত্য করছে প্রচণ্ড তুফান-ব্যাত্যা। যেন হঠাৎ এসে এক ঝটকায় নিবিয়ে দিবে এই সর্বশেষ প্রদীপটির আলোটুকুও। তাই আমাদেরকে এখনই সতর্ক হতে হবে। এখনই নেমে পড়তে হবে কোমর বেঁধে।
—————
– আব্দুর রহমান খালেক
১৯-০২-১৯৮৩ ইং
write