দাওয়াত ও জিহাদ

কিভাবে জিহাদ করব?

❑ জিহাদের মাধ্যম চারটি :

(১) অন্তর দিয়ে (২) যবান দিয়ে (৩) মাল দিয়ে এবং (৪) অস্ত্রের মাধ্যমে।

(ক) আল্লাহ বলেন, ‘মুমিন কেবল তারাই যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান এনেছে, অতঃপর তাতে সন্দেহ পোষণ করেনি। আর নিজেদের মাল ও জান দিয়ে আল্লাহ্র পথে জিহাদ করেছে। এরাই হ’ল সত্যনিষ্ঠ’ (হুজুরাত ৪৯/১৫)।

(খ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, তোমাদের মধ্যে যখন কেউ কোন অন্যায় হ’তে দেখে, তখন সে যেন তা হাত দিয়ে প্রতিহত করে। তাতে সক্ষম না হ’লে যবান দিয়ে প্রতিবাদ করবে। তাতেও সক্ষম না হ’লে অন্তর দিয়ে ঘৃণা করবে। আর এটা হ’ল দুর্বলতম ঈমান’।[1]

(গ) তিনি বলেন, আমার পূর্বে আল্লাহ এমন কোন নবীকে তার উম্মতের মধ্যে পাঠাননি, যাদের মধ্যে তার একদল ‘হাওয়ারী’ ও মুখলেছ সাথী ছিল না। যারা তার সুন্নাতের উপর আমল করত ও তার আদেশ মেনে চলত। অতঃপর তাদের স্থলে এমন লোকেরা এল, যারা এমন কথা বলত যা তারা করত না এবং এমন কাজ করত যা তাদের আদেশ করা হয়নি। (আমার উম্মতের মধ্যেও এরূপ হবে) অতএব যে ব্যক্তি তাদের বিরুদ্ধে হাত দ্বারা জিহাদ করবে সে মুমিন, যে ব্যক্তি যবান দ্বারা জিহাদ করবে সে মুমিন, যে ব্যক্তি অন্তর দ্বারা জিহাদ করবে সে মুমিন। এরপরে সরিষাদানা পরিমাণও ঈমান নেই’।[2]

(ঘ) তিনি আরও বলেন, ‘তোমরা মুশরিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ কর তোমাদের মাল দ্বারা, জান দ্বারা ও যবান দ্বারা’।[3] ইমাম কুরতুবী বলেন, কুরআন ও হাদীছে মালের কথা আগে বলা হয়েছে। তার কারণ জিহাদের জন্য প্রথমে মালের প্রয়োজন হয়ে থাকে।[4]

আল্লাহ্র কালেমাকে সমুন্নত করার জন্য সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা যেমন ‘জিহাদ’, যবান ও কলমের মাধ্যমে ও নিরন্তর সাংগঠনিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে মানুষের চিন্তা-চেতনা ও আমল-আচরণে পরিবর্তন আনাটাও তেমনি ‘জিহাদ’। এর জন্য জান-মাল, সময় ও শ্রম ব্যয় করাও তেমনি ‘জিহাদ’। বরং কথা, কলম ও সংগঠনের মাধ্যমে জিহাদই স্থায়ী ফলদায়ক। যার মাধ্যমে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র পরিবর্তিত হয়।

দুনিয়াবী স্বার্থে যুদ্ধ-বিগ্রহকে ইসলাম কখনোই সমর্থন করেনি। বরং ইসলামী জিহাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হ’ল ‘সর্বক্ষেত্রে আল্লাহ্র সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করা ও তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন করা’। আর এজন্য সর্বতোভাবে শক্তি অর্জন করা যরূরী। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে সাধ্যমত শক্তি ও সদা সজ্জিত অশ্ববাহিনী প্রস্ত্তত রাখো। যার দ্বারা তোমরা ভীত করবে আল্লাহ্র শত্রুদের ও তোমাদের শত্রুদের এবং যাদেরকে তোমরা জানো না, কিন্তু আল্লাহ তাদের জানেন। আর তোমরা আল্লাহ্র পথে যা কিছু ব্যয় কর, তার পুরোপুরি প্রতিদান তোমাদের দেওয়া হবে এবং তোমাদের উপর মোটেই যুলুম করা হবে না’ (আনফাল ৮/৬০)।

আয়াতে বর্ণিত ‘ঘোড়া’ কথাটি এসেছে উদাহরণ স্বরূপ, তৎকালীন সময়ের প্রধান যুদ্ধবাহন হিসাবে। এর দ্বারা সকল যুগের সকল প্রকারের যুদ্ধোপকরণ বুঝানো হয়েছে। অনুরূপভাবে ‘শক্তি’ কথাটি ‘আম’। এ দ্বারা অর্থ, অস্ত্র, কথা, কলম, সংগঠন সবই বুঝানো হয়েছে। এই আয়াতের মাধ্যমে কোন মুসলিম বা অমুসলিম রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে সাধারণ মুসলিম নাগরিকদের সশস্ত্র প্রস্ত্ততি গ্রহণের কথা বলা হয়নি। যেমন অনেকে ধারণা করে থাকেন। কেননা সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্ত্ততি বা জিহাদ ঘোষণার অধিকার মুসলমানদের সর্বসম্মত আমীরের (আলে ইমরান ৩/৫৯) অর্থাৎ সরকারের। অন্য কারুর নয়।

মোট কথা মুশরিক ও কুফরী শক্তির বিরুদ্ধে মুমিনের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নিয়োজিত করাকে ‘জিহাদ’ বলে। এখানে গিয়ে জিহাদকে ৩টি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে।-

❑ জিহাদের প্রকারভেদ :

(১) নফসের বিরুদ্ধে জিহাদ : নফসের মধ্যে খারাপ চিন্তা আসাটা স্বাভাবিক। সেকারণ নফসকে কলুষিত করে ও আখেরাতের চিন্তা থেকে দূরে সরিয়ে নেয় এমন সব সাহিত্য, পরিবেশ ও প্রচার মাধ্যম থেকে ও দুনিয়াবী জৌলুস থেকে নিজেকে সাধ্যমত দূরে সরিয়ে রাখতে হবে এবং সর্বদা দ্বীনী আলোচনা ও দ্বীনী পরিবেশের মধ্যে নিজেকে ধরে রাখতে হবে। যেমন আল্লাহ তাঁর রাসূলকে নির্দেশ দিচ্ছেন, ‘তুমি নিজেকে ঐসব লোকদের সাথে ধরে রাখো, যারা তাদের প্রভুকে ডাকে সকালে ও সন্ধ্যায়। তারা কামনা করে কেবল আল্লাহ্র সন্তুষ্টি। তুমি তাদের থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ো না। তুমি কি দুনিয়াবী জীবনের জৌলুস কামনা কর? তুমি ঐ ব্যক্তির অনুসরণ করো না, যার অন্তর আমাদের স্মরণ থেকে গাফেল হয়েছে এবং সে প্রবৃত্তির অনুসারী হয়েছে ও তার কাজকর্মে সীমালংঘন এসে গেছে’ (কাহফ ১৮/২৮)।

ফাযালাহ বিন ওবায়েদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘মুজাহিদ সেই ব্যক্তি যে আল্লাহকে খুশী করার জন্য তার নফসের বিরুদ্ধে জিহাদ করে’।[5] ছাহেবে তুহফাহ বলেন, এর অর্থ, যে ব্যক্তি তার প্রবৃত্তিকে দমন করে এবং পাপ থেকে বিরত হয়ে আল্লাহ্র আনুগত্যে নিজেকে ধরে রাখে। আর এটাই হ’ল সকল জিহাদের মূল। কেননা যে ব্যক্তি নিজের নফসের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে পারে না, সে ব্যক্তি বাইরে শত্রুর বিরুদ্ধে জিহাদ করতে পারে না’।[6] বস্ত্ততঃ অর্থের লোভ, পদের লোভ, নাম-যশের লোভ প্রভৃতি মনের রোগ মানুষকে প্রতিনিয়ত আল্লাহ্র পথে জিহাদ থেকে ফিরিয়ে রাখে। তাই এই ভিতরকার গোপন শত্রুর বিরুদ্ধে প্রথমে যুদ্ধ করা প্রয়োজন। এজন্যেই বলা হয়েছে, ‘সবচেয়ে কঠিন যুদ্ধ হ’ল প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ। আর মানুষকে সম্মানিত করে না আল্লাহভীতি ব্যতীত’।

(২) শয়তানের বিরুদ্ধে জিহাদ : শয়তান জিন ও ইনসান উভয়ের মধ্য থেকে হ’তে পারে (নাস ১১৪/৬)। এদের দিনরাতের কাজ হ’ল বিভিন্ন ধোঁকার মাধ্যমে মুমিনকে পথভ্রষ্ট করা। আল্লাহ বলেন, ‘এমনিভাবে আমরা প্রত্যেক নবীর জন্য শত্রু নিযুক্ত করেছি মানুষ ও জিন থেকে একদল শয়তানকে। যারা ধোঁকা দেওয়ার জন্য একে অপরকে কারুকার্য খচিত কথা বলে’ (আন‘আম ৬/১১২)। এদের থেকে বেঁচে থাকার জন্য আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে বলেন, ‘যখন তুমি ঐসব লোকদের দেখবে যে, আমার আয়াত সমূহে ছিদ্রান্বেষণে লিপ্ত হয়েছে, তখন তুমি তাদেরকে এড়িয়ে চলো, যে পর্যন্ত না তারা অন্য কথায় লিপ্ত হয়’ (আন‘আম ৬/৬৮)।

এযুগে শয়তানের সবচেয়ে বড় ধোঁকা হ’ল গণতন্ত্র ও জঙ্গীবাদ। ক্ষমতা দখলের সুড়সুড়ি দিয়ে এ দু’টি মতবাদ মুসলিম সমাজকে পরস্পরে হানাহানি ও রক্তাক্ত জনপদে পরিণত করেছে। তাদের নৈতিক ও বৈষয়িক উন্নতি শেষ করে দিয়েছে এবং তাদের ইহকাল ও পরকাল ধ্বংস করেছে।

এজন্য শয়তানের অনুসারী ব্যক্তি ও সংগঠন বর্জন করা ও তাদের থেকে দূরে থাকা আবশ্যক। শিরক ও বিদ‘আতপন্থী এবং ভোগবাদী ও বস্ত্তবাদী শিক্ষা ও পরিবেশ বর্জন করা যরূরী। সাথে সাথে এসবের অনুসারী প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া থেকে নিজেকে ও নিজের গৃহকে পরিচ্ছন্ন রাখা অপরিহার্য। এসবের স্থলে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছপন্থী ব্যক্তি ও সংগঠনভুক্ত থাকা, দ্বীনী শিক্ষা ও পরিবেশ অপরিহার্য করে নেওয়া এবং এর অনুসারী প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে নিজেকে ও নিজের গৃহকে আলোকিত রাখা আবশ্যক।

(৩) কাফির-মুশরিক ও ফাসিক-মুনাফিকের বিরুদ্ধে জিহাদ : আল্লাহ বলেন, ‘হে নবী! তুমি জিহাদ কর কাফির ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে এবং তাদের উপরে কঠোর হও। ওদের ঠিকানা হ’ল জাহান্নাম। আর কতইনা মন্দ ঠিকানা সেটি’ (তওবা ৯/৭৩; তাহরীম ৬৬/৯)। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, কাফিরদের বিরুদ্ধে জিহাদ হবে অস্ত্রের দ্বারা এবং মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ হবে যবান দ্বারা এবং অন্যান্য পন্থায় কঠোরতা অবলম্বনের দ্বারা’। মুনাফিক সর্দার আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইকে সকল নষ্টের মূল জেনেও রাসূল (ছাঃ) তাকে হত্যার নির্দেশ দেননি তার বাহ্যিক ইসলামের কারণে। ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ কর হাত দ্বারা, না পারলে যবান দ্বারা, না পারলে ওদেরকে এড়িয়ে চল’। ইবনুল ‘আরাবী বলেন, যবান দ্বারা দলীল কায়েম করার বিষয়টি হ’ল স্থায়ী জিহাদ’।[7] আধুনিক যুগে যবান, কলম ও অন্যান্য প্রচার মাধ্যম একই গুরুত্ব বহন করে। বরং কলমই হ’ল স্থায়ী জিহাদ।

 


 

[1] মুসলিম হা/৪৯, মিশকাত হা/৫১৩৭।

[2] মুসলিম হা/৫০; মিশকাত হা/১৫৭ ‘ঈমান’ অধ্যায়, ‘কিতাব ও সুন্নাহ্কে আঁকড়ে ধরা’ অনুচ্ছেদ।

[3] আবুদাঊদ, নাসাঈ, দারেমী, মিশকাত হা/৩৮২১ ‘জিহাদ’ অধ্যায়।

[4] কুরতুবী, সূরা তওবা ৪১ আয়াতের তাফসীর দ্রষ্টব্য; ৮/১৩৯।

[5] তিরমিযী হা/১৬২১।

[6] তুহফাতুল আহওয়াযী শরহ তিরমিযী, হা/১৬৭১-এর ব্যাখ্যা।

[7] কুরতুবী, সূরা তওবা ৭৩ আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য; ৮/১৮৭ পৃঃ।

১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

Back to top button