সমাজ পরিবর্তনের স্থায়ী কর্মসূচী
আল্লাহ বলেন,
هُوَ الَّذِي بَعَثَ فِي الْأُمِّيِّينَ رَسُولاً مِنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَإِنْ كَانُوا مِنْ قَبْلُ لَفِي ضَلاَلٍ مُبِينٍ- وَآخَرِينَ مِنْهُمْ لَمَّا يَلْحَقُوا بِهِمْ وَهُوَ الْعَزِيزُ لْحَكِيمُ-
‘তিনিই সেই সত্তা যিনি নিরক্ষরদের মধ্যে তাদের একজনকে রাসূল হিসাবে পাঠিয়েছেন। যিনি তাদের নিকট তাঁর আয়াত সমূহ পাঠ করেন ও তাদেরকে পবিত্র করেন। আর তাদেরকে কিতাব ও সুন্নাহ শিক্ষা দেন। যদিও তারা ইতিপূর্বে স্পষ্ট ভ্রান্তিতে নিমজ্জিত ছিল’। ‘আর তাদের অন্যান্যদের জন্যেও যারা এখনো তাদের সাথে মিলিত হয়নি। বস্ত্ততঃ আল্লাহ মহা পরাক্রান্ত, প্রজ্ঞাময়’ (জুম‘আহ ৬২/২-৩)।
প্রথম আয়াতে নবী যুগের লোকদের কথা বলা হয়েছে এবং শেষের আয়াতে নবী পরবর্তী ক্বিয়ামত পর্যন্ত আগত সকল মানুষ সম্পর্কে বলা হয়েছে। এর দ্বারা বুঝানো হয়েছে যে, মুহাম্মাদ (ছাঃ) এসেছিলেন শেষনবী হিসাবে এবং তিনি ক্বিয়ামত পর্যন্ত সকল জিন ও ইনসানের নবী। এর দ্বারা এটাও বলে দেওয়া হয়েছে যে, কুরআন ও সুন্নাহর অভ্রান্ত শিক্ষার মাধ্যমেই সকল যুগের জাহেলিয়াত দূর করা সম্ভব। অন্যকিছু দ্বারা নয়। আর এর মধ্যেই রয়েছে সমাজ পরিবর্তনের স্থায়ী কর্মসূচী।
ইবনু কাছীর (রহঃ)-এর মন্তব্য :
হাফেয ইবনু কাছীর (রাহেমাহুল্লাহ) বলেন, আরবের লোকেরা প্রাচীনকালে ইবরাহীমী দ্বীনের অনুসারী ছিল। পরে তারা তাওহীদকে শিরকে এবং ইয়াক্বীনকে সন্দেহে রূপান্তরিত করে। এছাড়াও তারা বহু কিছু বিদ‘আতের প্রচলন ঘটায়। একই অবস্থা হয়েছিল তওরাত ও ইনজীলের অনুসারীদের। তারা তাদের কিতাবে পরিবর্তন ঘটিয়েছিল। তাতে শাব্দিক যোগ-বিয়োগ করেছিল, রূপান্তর করেছিল ও দূরতম ব্যাখ্যা করেছিল। অতঃপর আল্লাহ মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে প্রেরণ করেন পূর্ণাঙ্গ শরী‘আত দিয়ে, যা সমস্ত সৃষ্টিজগতকে শামিল করে। যাতে রয়েছে তাদের হেদায়াত এবং তাদের জীবিকা ও পরকালীন জীবনের সকল প্রয়োজন পূরণের ব্যাখ্যা’…।[1]
দূর অতীতে জাহেলী আরবের যে পতিত অবস্থা ছিল, আধুনিক যুগে মানবজাতির অবস্থা তার চাইতে অধঃপতিত। সেদিন শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) যেভাবে সমাজে পরিবর্তন এনেছিলেন, সেই পথই হ’ল সমাজ পরিবর্তনের স্থায়ী কর্মসূচী। এর বিপরীত পথে গেলে মানুষ পথভ্রষ্ট হবে এবং সমাজে ব্যাপক অনাচার ও ধ্বংস নেমে আসবে। যেমনটি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে প্রকটভাবে দেখা যাচ্ছে। অতি সম্প্রতি প্রতিবেশী মিয়ানমারে মানবতার যে পরাজয় আমরা দেখেছি, সেই সাথে বিশ্বের সভ্যতাগর্বী দেশ সমূহের নেতাদের যে অমানবিক আচরণ আমরা লক্ষ্য করছি, তা পৃথিবীর চূড়ান্ত ধ্বংসের আলামত ছাড়া কিছু নয়। এমতাবস্থায় মানুষের মনুষ্যত্বের উন্নয়ন ও মানবতার বিজয় সাধনের জন্য সাময়িক কোন রাজনৈতিক টোটকা নয়। বরং জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সমাজ সংস্কারের স্থায়ী কর্মসূচী প্রদান ও তা যথাযথভাবে অনুসরণ করার কোন বিকল্প নেই।
উপরোক্ত আয়াতে সমাজ সংস্কারের যে কর্মসূচী দেওয়া হয়েছে, তা দু’টি শব্দে উল্লেখ করা যায়। তাযকিয়াহ ও তারবিয়াহ। অর্থাৎ পরিশুদ্ধিতা ও পরিচর্যা। যার মাধ্যম ছিল কিতাব ও হিকমাহ। তথা কুরআন ও সুন্নাহ। এতে দুনিয়ার উপরে আখেরাতকে অগ্রাধিকার দেওয়ার আহবানের মাধ্যমে মানুষের চিন্তাধারায় আমূল পরিবর্তন আনা হয়। যাতে তার মধ্যে সৃষ্টি হয় আত্মশুদ্ধিতার তীব্র অনুভূতি। ফলে তার যে কর্মতৎপরতা দুনিয়াকে কেন্দ্র করে চলছিল, তা নিমেষে আখেরাত কেন্দ্রিক হয়ে যায়। তার পার্থিব জীবনে এসে যায় ব্যাপক পরিবর্তন। যা সে আগে ভাবতেই পারত না। সে এখন দুনিয়া করে আখেরাতে মুক্তির আশায়। জান্নাত লাভের উদগ্র বাসনায় দুনিয়ার ভোগবিলাস তার কাছে এখন তুচ্ছ। কিন্তু শয়তান তাকে ছাড়ে না। সে প্রতি মুহূর্তে ওঁৎ পেতে থাকে তাকে পথভ্রষ্ট করার জন্য। তাই প্রয়োজন হয় তাকে নিয়মিত পরিচর্যার মাধ্যমে আখেরাতমুখী করে রাখার। এখন সে মুখাপেক্ষী হয় সংস্কারক নেতার ও সংগঠনের। যা তাকে সর্বদা ভ্রান্তি থেকে বাঁচাতে চেষ্টা করবে। এটাই হ’ল পরিশুদ্ধিতা ও পরিচর্যা।
পোকা-মাকড় থেকে রক্ষা করা এবং নিড়ানী ও পানি সরবরাহের মাধ্যমে নিয়মিত পরিচর্যা করে যেভাবে একটি চারাগাছকে বড় ও ফলবন্ত করা হয়, সেভাবে ব্যক্তি ও সমাজকে নিয়মিত পরিশুদ্ধি ও পরিচর্যার মাধ্যমে গড়ে তুলতে হয়। তাতে সুন্দর ফল আসে এবং সমাজ সুস্থ ও ফলবন্ত হয়। নইলে বিপরীত ফলে ব্যক্তি ও সমাজ বিপর্যস্ত হয়। প্রত্যেক নবী-রাসূল একাজই করেছেন। তাদের যথার্থ অনুসারী নেতাগণ চিরকাল এভাবেই ব্যক্তি পরিচর্যা ও সমাজ সংশোধনের কাজ করে গেছেন। যখন কোন সমাজে কোন সংস্কারক নেতার আবির্ভাব ঘটে, তখন সেই সমাজে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। যদিও অধিকাংশ লোক থাকে হঠকারী অথবা শৈথিল্যবাদী ও আপোষমুখী। কিন্তু সংস্কারকগণ তাতে থেমে যান না। এদিকে ইঙ্গিত করেই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,
مَا مِنْ نَبِىٍّ بَعَثَهُ اللهُ فِى أُمَّةٍ قَبْلِى إِلاَّ كَانَ لَهُ مِنْ أُمَّتِهِ حَوَارِيُّونَ وَأَصْحَابٌ يَأْخُذُونَ بِسُنَّتِهِ وَيَقْتَدُونَ بِأَمْرِهِ ثُمَّ إِنَّهَا تَخْلُفُ مِنْ بَعْدِهِمْ خُلُوفٌ يَقُولُونَ مَا لاَ يَفْعَلُونَ وَيَفْعَلُونَ مَا لاَ يُؤْمَرُونَ فَمَنْ جَاهَدَهُمْ بِيَدِهِ فَهُوَ مُؤْمِنٌ وَمَنْ جَاهَدَهُمْ بِلِسَانِهِ فَهُوَ مُؤْمِنٌ وَمَنْ جَاهَدَهُمْ بِقَلْبِهِ فَهُوَ مُؤْمِنٌ وَلَيْسَ وَرَاءَ ذَلِكَ مِنَ الإِيمَانِ حَبَّةُ خَرْدَلٍ-
‘আমার পূর্বে আল্লাহ এমন কোন নবীকে তার উম্মতের মধ্যে পাঠাননি, যাদের মধ্যে তার জন্য ‘হাওয়ারী’ বা আন্তরিক সহচরবৃন্দ ছিল না। এছাড়া তাদের আরও সাথী ছিল, যারা তাদের নবীর সুন্নাতের উপরে আমল করত এবং তার আদেশ-নিষেধের অনুসরণ করত। অতঃপর এমন সব লোক তাদের স্থলাভিষিক্ত হ’ল যারা এমন সব কথা বলত, যা তারা করত না। আবার নিজেরা এমন কাজ করত, যার নির্দেশ তাদের দেওয়া হয়নি। অতএব (আমার উম্মতের মধ্যেও ঐরূপ লোক দেখা গেলে) যে ব্যক্তি তাদের বিরুদ্ধে নিজের হাত দ্বারা জিহাদ করবে, সে (পূর্ণ) মুমিন। যে ব্যক্তি যবান (ও কলম) দ্বারা জিহাদ করবে, সেও মুমিন এবং যে ব্যক্তি (কমপক্ষে) অন্তর দ্বারা (ঘৃণার মাধ্যমে) জিহাদ করবে, সেও মুমিন। এরপর এক সরিষাদানা পরিমাণও ঈমান নেই’।[2]
এখানে ‘জিহাদ’ অর্থ সর্বাত্মক প্রচেষ্টা। আর এই প্রচেষ্টার মূল ও প্রথম অংশ হ’ল দাওয়াত। পুঁতিগন্ধময় সমাজ থেকে বাতিল হটাতে গেলে তাওহীদের প্রতি নিরন্তর দাওয়াত ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আপোষহীন জিহাদ ব্যতীত অন্য কোন পথ নেই। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একাজটিই করে গেছেন তাঁর সমগ্র নবুঅতী জীবনে। তাঁর নবুঅতকালে যেমন মাক্কী জীবনের নির্যাতন ও অসহায়ত্ব এবং মাদানী জীবনের যুদ্ধ ও বিজয় এসেছিল। একজন দাঈর জীবনেও সেরূপ আসতে পারে। মনে রাখা আবশ্যক যে, শেষনবী হিসাবে এবং দ্বীনের পূর্ণতা দানকারী হিসাবে তাঁর জীবনে আল্লাহর বিশেষ রহমতে এটা ঘটেছিল। কিন্তু অন্য দাঈদের জীবনে সেটা ঘটতেই হবে এমনটি নয়। বরং তাদের জীবনে মাক্কী জীবনের নির্যাতন ও অসহায়ত্বই বেশী থাকবে। দুনিয়াবী বিজয়ের সৌভাগ্য কমই থাকবে। বিগত দেড় হাযার বছরের ইতিহাস সে সাক্ষ্যই প্রদান করে।
এখানে এযুক্তি অচল যে, যেহেতু ইসলামের পূর্ণতা এসেছে সশস্ত্র বিজয়ের মাধ্যমে, অতএব সর্বদা রাজনৈতিক ও সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে প্রত্যেক দেশে ইসলামী শাসন কায়েম করতেই হবে। নইলে পূর্ণ মুমিন হওয়া যাবে না। কেননা তাতে ইসলামের ধর্মীয় আবেদন শেষ হয়ে যাবে। স্রেফ ক্ষমতান্ধ একটি আগ্রাসী রাজনৈতিক মতবাদ হিসাবে চিহ্নিত হবে। যা হবে ইসলামের জন্য সবচাইতে ক্ষতিকর। যে ক্ষতি ইতিমধ্যেই করেছে ক্ষমতা লোভী ব্যক্তিরা ও জঙ্গীবাদীরা।
তাযকিয়াহ ও তারবিয়াহর মাধ্যম হবে দু’টি : দাওয়াত ও জিহাদ। অর্থাৎ নির্ভেজাল তাওহীদ ও ছহীহ সুন্নাহর প্রতি দাওয়াত এবং শিরক-বিদ‘আত ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে জিহাদ। মূলতঃ দু’টিই সমান্তরালভাবে করার মাধ্যমে সমাজে পরিবর্তন আসে। নইলে কথা ও কর্ম পৃথক হ’লে বরং উল্টা ফল হবে।
(১) দাওয়াত ও তার পদ্ধতি :
আল্লাহ বলেন,
ادْعُ إِلَى سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُمْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعْلَمُ بِمَنْ ضَلَّ عَنْ سَبِيلِهِ وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِينَ- وَإِنْ عَاقَبْتُمْ فَعَاقِبُوا بِمِثْلِ مَا عُوقِبْتُمْ بِهِ وَلَئِنْ صَبَرْتُمْ لَهُوَ خَيْرٌ لِلصَّابِرِينَ- وَاصْبِرْ وَمَا صَبْرُكَ إِلاَّ بِاللهِ وَلاَ تَحْزَنْ عَلَيْهِمْ وَلاَ تَكُ فِي ضَيْقٍ مِمَّا يَمْكُرُونَ-
‘তুমি মানুষকে তোমার প্রতিপালকের পথে আহবান কর প্রজ্ঞা ও সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে এবং তাদের সাথে বিতর্ক কর সুন্দর পন্থায়। নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালক ভালভাবেই জানেন কে তার পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে এবং তিনি ভালভাবেই জানেন কে সুপথপ্রাপ্ত হয়েছে’। ‘যদি তোমরা প্রতিশোধ গ্রহণ কর, তবে ঐ পরিমাণ করবে, যে পরিমাণ তোমাদের সাথে করা হয়েছে। কিন্তু যদি তোমরা ধৈর্য ধারণ কর, তাহলে ধৈর্যশীলদের জন্য নিশ্চয়ই সেটি উত্তম’। ‘তুমি ধৈর্যধারণ কর। আর তোমার ধৈর্য ধারণ হবে কেবল আল্লাহর সাহায্যে। তাদের উপর দুঃখ করো না এবং তাদের ষড়যন্ত্রে তুমি মনঃক্ষুণ্ণ হয়ো না’ (নাহল ১৬/১২৫-২৭)।
(২) জিহাদ ও তার পদ্ধতি :
আল্লাহ বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا هَلْ أَدُلُّكُمْ عَلَى تِجَارَةٍ تُنْجِيكُمْ مِنْ عَذَابٍ أَلِيْمٍ- تُؤْمِنُونَ بِاللهِ وَرَسُولِهِ وَتُجَاهِدُوْنَ فِيْ سَبِيلِ اللهِ بِأَمْوَالِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ-
‘হে বিশ্বাসীগণ! আমি কি তোমাদের এমন একটি ব্যবসায়ের সন্ধান দিব, যা তোমাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি থেকে মুক্তি দেবে?’ ‘সেটা এই যে, তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর বিশ্বাস স্থাপন করবে এবং আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করবে তোমাদের মাল ও জান দিয়ে । এটাই তোমাদের জন্য উত্তম, যদি তোমরা বুঝ’ (ছফ ৬১/১০-১১)।
এই জিহাদ হবে আক্বীদা ও আমল, জান ও মাল সবকিছুর মাধ্যমে সর্বাত্মকভাবে। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, جَاهِدُوا الْمُشْرِكِينَ بِأَمْوَالِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ وَأَلْسِنَتِكُمْ ‘তোমরা জিহাদ কর মুশরিকদের বিরুদ্ধে তোমাদের মাল দ্বারা, জান দ্বারা ও যবান দ্বারা’।[3] ইমাম কুরতুবী বলেন, কুরআন ও হাদীছে মালের কথা আগে বলা হয়েছে। তার কারণ জিহাদের জন্য প্রথমে মালের প্রয়োজন হয়ে থাকে।[4]
আল্লাহর কালেমাকে সমুন্নত করার জন্য সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা যেমন ‘জিহাদ’, যবান ও কলমের মাধ্যমে ও নিরন্তর সাংগঠনিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে মানুষের চিন্তা-চেতনা ও আমল-আচরণে পরিবর্তন আনাটাও তেমনি ‘জিহাদ’। এর জন্য জান-মাল, সময় ও শ্রম ব্যয় করাও তেমনি ‘জিহাদ’। বরং কথা, কলম ও সংগঠনের মাধ্যমে জিহাদই স্থায়ী ফলদায়ক। যার মাধ্যমে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র পরিবর্তিত হয়। আর সশস্ত্র জিহাদ ঘোষণার অধিকার কেবল জামা‘আতে ‘আম্মাহ তথা রাষ্ট্রনেতার, অন্য কারু নয়। যেমন মাদানী জীবনে রাসূল (ছাঃ)-এর এবং পরবর্তীতে খলীফাগণের অধিকারে ছিল।
ফলাফল :
আল্লাহ বলেন,يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنْ تَنْصُرُوا اللهَ يَنْصُرْكُمْ وَيُثَبِّتْ أَقْدَامَكُمْ- وَالَّذِيْنَ كَفَرُوْا فَتَعْسًا لَهُمْ وَأَضَلَّ أَعْمَالَهُمْ- ‘হে মুমিনগণ! যদি তোমরা আল্লাহকে সাহায্য কর, তাহ’লে তিনি তোমাদেরকে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের পাগুলি দৃঢ় করবেন’। ‘আর যারা কুফরী করে তাদের জন্য রয়েছে দুর্ভোগ এবং তিনি তাদের কর্মগুলি নিস্ফল করে দিবেন’ (মুহাম্মাদ ৪৭/৭-৮)। যেমন আল্লাহ অন্যত্র বলেন, وَلَيَنْصُرَنَّ اللهُ مَنْ يَنْصُرُهُ إِنَّ اللهَ لَقَوِيٌّ عَزِيْزٌ- ‘আল্লাহ অবশ্যই তাকে সাহায্য করেন, যে তাকে সাহায্য করে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বশক্তিমান ও মহা পরাক্রান্ত’ (হজ্জ ২২/৪০)। এখানে আল্লাহকে সাহায্য করা অর্থ তাঁর দ্বীনকে ও নবীকে এবং আল্লাহর বন্ধুদেরকে সাহায্য করা (কুরতুবী, ক্বাসেমী)। যার ব্যাখ্যা হ’ল সার্বিক জীবনে যথাযথভাবে দ্বীন পালন করা, তার হালাল-হারামের বিধান সমূহ মেনে চলা এবং যথার্থভাবে দ্বীনের প্রচার করা। এটা করলেই তিনি আমাদের সাহায্য করবেন ও আমাদের পাগুলিকে দৃঢ় করবেন। অর্থাৎ ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনে স্থিতি ও দৃঢ়তা প্রদান করবেন। যেমন তিনি বলেন,
وَعَدَ اللهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنْكُمْ وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِي الْأَرْضِ كَمَا اسْتَخْلَفَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ وَلَيُمَكِّنَنَّ لَهُمْ دِينَهُمُ الَّذِي ارْتَضَى لَهُمْ وَلَيُبَدِّلَنَّهُمْ مِنْ بَعْدِ خَوْفِهِمْ أَمْنًا يَعْبُدُونَنِي لاَ يُشْرِكُونَ بِي شَيْئًا وَمَنْ كَفَرَ بَعْدَ ذَلِكَ فَأُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ- وَأَقِيمُوا الصَّلاَةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ-
‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে ও সৎকর্মসমূহ সম্পাদন করে, আল্লাহ তাদের ওয়াদা দিয়েছেন যে, তিনি তাদেরকে অবশ্যই পৃথিবীতে শাসন ক্ষমতা প্রদান করবেন, যেমন তিনি দান করেছিলেন পূর্ববর্তীদেরকে। আর তিনি অবশ্যই সুদৃঢ় করবেন তাদের ধর্মকে যা তিনি তাদের জন্য মনোনীত করেছেন এবং তিনি তাদেরকে ভয়-ভীতির বদলে অবশ্যই নিরাপত্তা দান করবেন। (শর্ত হ’ল) তারা কেবল আমারই ইবাদত করবে এবং আমার সাথে কাউকে শরীক করবে না। এরপরে যারা অবাধ্য হবে তারাই হবে পাপাচারী’। ‘তোমরা ছালাত কায়েম কর, যাকাত আদায় কর এবং রাসূলের আনুগত্য কর। যাতে তোমরা অনুগ্রহ প্রাপ্ত হ’তে পারে’ (নূর ২৪/৫৫-৫৬)। আল্লাহ নিশ্চয়তা দিয়ে বলেন,وَأُخْرَى تُحِبُّونَهَا نَصْرٌ مِنَ اللهِ وَفَتْحٌ قَرِيبٌ وَبَشِّرِ الْمُؤْمِنِينَ- ‘তিনি আরও একটি অনুগ্রহ দান করবেন যা তোমরা পসন্দ কর। (আর তা হ’ল) আল্লাহর সাহায্য ও আসন্ন বিজয়। অতএব তুমি বিশ্বাসীদেরকে সুসংবাদ দাও’ (ছফ ৬১/১৩)।
তাযকিয়াহ ও তারবিয়াহর নীতি সমূহ :
(১) আল্লাহর জন্য বিশুদ্ধচিত্তে কাজ করা। আল্লাহ বলেন, فَاعْبُدِ اللهَ مُخْلِصًا لَهُ الدِّينَ ‘তুমি আল্লাহর ইবাদত কর তার প্রতি খালেছ আনুগত্য সহকারে’ (যুমার ৩৯/২)। কেননা আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্য ব্যতীত কখনোই চিত্ত বিশুদ্ধ হয় না। যে আল্লাহ আমাকে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন, আমাকে কাজ করার তাওফীক দিয়েছেন, আমি অবশ্যই প্রাণ ভরে তার শুকরিয়া আদায় করব। আমি অবশ্যই সেই কাজ করব যে কাজে তিনি খুশী হন এবং সে কাজ ছাড়ব, যে কাজে তিনি নাখোশ হন। জীবন সংগ্রামের প্রতিটি মুহূর্তে আমি তাঁকে স্মরণ করব। তাঁর নিকটে সাহায্য চাইব এবং সর্বদা তাঁরই উপর ভরসা করব। তিনি সরাসরি আমাকে সরল পথ প্রদর্শন করবেন এবং গায়েবী মদদ করবেন। আমার কাজে কোন লোক দেখানো বা লোক শুনানো উদ্দেশ্য থাকবে না। যখন সকল মানুষ আমাকে পরিত্যাগ করবে, তখন আমি বলব, যেমনটি বলেছিলেন আমাদের পিতা ইবরাহীম (আঃ)।-رَبَّنَا إِنَّكَ تَعْلَمُ مَا نُخْفِي وَمَا نُعْلِنُ وَمَا يَخْفَى عَلَى اللهِ مِنْ شَيْءٍ فِي الْأَرْضِ وَلاَ فِي السَّمَاءِ- ‘হে আমাদের পালনকর্তা! নিশ্চয় তুমি জান যা কিছু আমরা গোপন করি ও যা কিছু আমরা প্রকাশ করি। আর যমীন ও আসমানের কোন কিছুই আল্লাহর নিকট গোপন থাকে না’ (ইবরাহীম ১৪/৩৮)। তিনি পথভ্রষ্টদের সম্পর্কে বলেছিলেন,رَبِّ إِنَّهُنَّ أَضْلَلْنَ كَثِيرًا مِنَ النَّاسِ فَمَنْ تَبِعَنِي فَإِنَّهُ مِنِّي وَمَنْ عَصَانِي فَإِنَّكَ غَفُورٌ رَحِيمٌ- ‘হে আমার প্রতিপালক! এই মূর্তিগুলো বহু মানুষকে বিপথগামী করেছে। অতএব যে আমার অনুসারী হবে, সে আমার দলভুক্ত। আর যে আমার অবাধ্য হবে, নিশ্চয় তুমি ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (ইবরাহীম ১৪/৩৬)। একইভাবে নিজ কওম বনু ইস্রাঈলের অবাধ্যতায় অতিষ্ঠ হয়ে নবী মূসা (আঃ) বলেছিলেন,رَبِّ إِنِّي لاَ أَمْلِكُ إِلاَّ نَفْسِي وَأَخِي فَافْرُقْ بَيْنَنَا وَبَيْنَ الْقَوْمِ الْفَاسِقِينَ- ‘হে আমার প্রতিপালক! আমি শুধু নিজের উপর ও আমার ভাইয়ের উপর অধিকার রাখি। অতএব তুমি আমাদের উভয়ের ও এই অবাধ্য সম্প্রদায়ের মধ্যে ফায়ছালা করে দাও’ (মায়েদাহ ৫/২৫)।
(২) জ্ঞান ও দূরদর্শিতা :
এখানে ‘জ্ঞান’ বলতে কুরআন ও হাদীছের জ্ঞান। ‘দূরদর্শিতা’ বলতে আখেরাতে কল্যাণের দূরদর্শিতা। আল্লাহ বলেন,قُلْ هَذِهِ سَبِيلِي أَدْعُو إِلَى اللهِ عَلَى بَصِيرَةٍ أَنَا وَمَنِ اتَّبَعَنِي وَسُبْحَانَ اللهِ وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ- ‘তুমি বল এটাই আমার পথ। আমি ও আমার অনুসারীগণ ডাকি আল্লাহর দিকে জাগ্রত জ্ঞান সহকারে। আল্লাহ পবিত্র। আর আমি অংশীবাদীদের অন্তর্ভুক্ত নই’ (ইউসুফ ১২/১০৮)।
কুরআন ও হাদীছের জ্ঞান এজন্য যে, এদু’টিই হ’ল অভ্রান্ত জ্ঞানের উৎস এবং এজ্ঞানই মানুষকে আখেরাতে কল্যাণের পথ দেখায়। লৌকিক জ্ঞান যেকোন সময় ভ্রান্ত প্রমাণিত হ’তে পারে। যাকে এ দুই অভ্রান্ত সত্যের আলোকে যাচাই করতে হয়। অতঃপর আখেরাতে কল্যাণের দূরদর্শিতা এজন্য যে, লৌকিক অভিজ্ঞতা ভিত্তিক দূরদর্শিতা কেবল নগদ লাভের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। যা ভবিষ্যতে অনেক সময় ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়। কিন্তু আখেরাতে কল্যাণ ভিত্তিক দূরদর্শিতা চিরন্তন মঙ্গলের পথ দেখিয়ে থাকে। আর যে জ্ঞান মানুষকে চিরন্তন কল্যাণের পথ দেখায়, সেটাই হ’ল ‘জাগ্রত জ্ঞান’। সে পথেই কুরআন ও সুন্নাহ মানুষকে আহবান করে থাকে। শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) মানবজাতিকে সেদিকে আহবান করার জন্যই আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত হয়েছিলেন। যুগে যুগে ইসলামের সনিষ্ঠ অনুসারীগণ সেদিকেই মানুষকে আহবান করবে। উক্ত আয়াতে চারটি বিষয় বর্ণিত হয়েছে। (১) মানুষকে স্রেফ আল্লাহর পথে আহবান জানাতে হবে। (২) আখেরাতে মুক্তির জন্য জাগ্রত জ্ঞান সহকারে ডাকতে হবে। বাপ-দাদা বা প্রচলিত প্রথার প্রতি অন্ধ আনুগত্যের সংকীর্ণ জ্ঞান সহকারে নয়। (৩) একাকী নয়। অনুসারীদের সাথে নিয়ে জামা‘আতবদ্ধভাবে সংস্কারের কাজ করতে হবে। এর মধ্যে সংগঠনের অপরিহার্যতা প্রমাণিত হয়। (৪) মুশরিকদের দলভুক্ত হওয়া যাবে না এবং কোনরূপ শিরকী প্রথা ও আদর্শের সাথে আপোষ করা যাবে না।
(৩) তাওহীদের আহবানের মাধ্যমেই দাওয়াত শুরু করতে হবে :
আল্লাহর আনুগত্য এবং অন্যের আনুগত্য একসঙ্গে চলে না। তাই প্রথমে আল্লাহর আনুগত্যের প্রতি মানুষকে আহবান জানাতে হবে। যেমন হযরত মু‘আয বিন জাবাল (রাঃ)-কে ইয়ামনে প্রেরণের সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘তুমি আহলে কিতাবদের নিকটে যাচ্ছ। অতএব তুমি প্রথমে তাদেরকে তাওহীদের দাওয়াত দাও। এটা মেনে নিলে তুমি তাদেরকে দিনে ও রাতে পাঁচ ওয়াক্ত ফরয ছালাতের দাওয়াত দাও। এটা মেনে নিলে তুমি তাদেরকে তাদের সম্পদের যাকাত আদায়ের কথা বল। যা তাদের ধনীদের নিকট থেকে নেওয়া হবে এবং তাদের অভাবগ্রস্তদের মধ্যে বিতরণ করা হবে। এটা মেনে নিলে তুমি তাদের থেকে যাকাত নাও এবং তাদের উত্তম মাল সমূহ থেকে বিরত থাক। আর তুমি মযলূমের বদদো‘আ থেকে সাবধান থাক। কেননা মযলূমের দো‘আ ও আল্লাহর মধ্যে কোন পর্দা নেই’।[5] অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘আল্লাহর ইবাদতের দিকে ডাক’ (মুসলিম হা/১৯ (৩১)। আরেক বর্ণনায় এসেছে, কালেমা শাহাদাতের দিকে ডাক’ (মুসলিম হা/১৯ (২৯)। সবগুলি একই মর্ম বহন করে।
বস্ত্ততঃ তাওহীদের দাওয়াতের মধ্যেই রিসালাতের প্রতি আনুগত্যের কথা রয়েছে। যা কালেমায়ে শাহাদাতের স্বীকৃতির মাধ্যমে উচ্চারিত হয়। অমুসলিমদের নিকট প্রথমে তাওহীদের দাওয়াত দানের কারণ হ’ল এই যে, তারা আল্লাহকে ছেড়ে অন্যকে অথবা আল্লাহর সাথে অন্যের আনুগত্যকে শরীক করে থাকে। আনুগত্যের পরিবর্তন ব্যতীত বিধান প্রদানের কোন অর্থই হয় না। কেননা তাতে বিধান কার্যকর হবে না। বরং পরিত্যক্ত হবে। তাওহীদ হ’ল বিশ্বাসের বস্ত্ত। এটা মেনে নেওয়ার পরেই ফরয বিধান সমূহ একে একে বর্ণিত হয়েছে। এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, সমাজ সংশোধন ও পরিবর্তনের জন্য সর্বাগ্রে বিশ্বাসের পরিবর্তন আবশ্যক। উক্ত হাদীছে তাওহীদের পর কেবল ছালাত ও যাকাতের কথা এসেছে। প্রথমটি নৈতিক ও চারিত্রিক দৃঢ়তা সৃষ্টির জন্য এবং দ্বিতীয়টি অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য। দু’টিই মানব জীবনের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ নীতি সকল যুগে প্রযোজ্য। যারা ছালাত আদায় করেন, অথচ নানা অজুহাতে ফরয যাকাত আদায় করেন না, তারা বিষয়টি অনুধাবন করুন। বস্ত্ততঃ নিয়মমাফিক যাকাত আদায় ও বণ্টন ব্যবস্থা না থাকায় মুসলিম সমাজে ধন বৈষম্য সৃষ্টি হয়ে থাকে এবং পুঁজিবাদীরা সুযোগ নিয়ে থাকে।
(৪) সত্যকে স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা :
আল্লাহ বলেন,وَكَذَلِكَ نُفَصِّلُ الْآيَاتِ وَلِتَسْتَبِينَ سَبِيلُ الْمُجْرِمِين ‘এমনিভাবে আমরা আয়াত সমূহ সবিস্তার বর্ণনা করি, যাতে পাপাচারীদের পথ সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে’ (আন‘আম ৬/৫৫)। উক্ত আয়াতে স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, নবীদের তরীকা ও অন্যদের তরীকা পৃথক। উভয় তরীকার মধ্যে আপোষ সম্ভব নয়। হেদায়াত স্পষ্ট এবং গুমরাহী স্পষ্ট। হেদায়াতের পরিণাম জান্নাত এবং গুমরাহীর পরিণাম জাহান্নাম। মানুষের স্বাধীনতা রয়েছে, যেটি ইচ্ছা গ্রহণ করার। যেমন আল্লাহ বলেন,إِنَّا هَدَيْنَاهُ السَّبِيلَ إِمَّا شَاكِرًا وَإِمَّا كَفُورًا ‘আমরা তাকে সুপথ প্রদর্শন করেছি। এক্ষণে সে কৃতজ্ঞ হৌক কিংবা অকৃতজ্ঞ হৌক’ (দাহর ৭৬/৩)। একথাই বর্ণিত হয়েছে অন্যত্র। যেমন আল্লাহ বলেন,قَدْ تَبَيَّنَ الرُّشْدُ مِنَ الْغَيِّ ‘নিশ্চয়ই সুপথ ভ্রান্তপথ হ’তে স্পষ্ট হয়ে গেছে’ (বাক্বারাহ ২/২৫৫)। অতএব ভ্রান্ত ও অভ্রান্ত পথের মধ্যে আপোষ সম্ভব নয়।
মুসলমান ইসলামে বিশ্বাসী। অতএব তাদের জন্য কুরআন ও সুন্নাহর বাইরে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। ইসলামের কিছু এবং কুফরীর কিছু মিলিয়ে জগাখিচুড়ী জীবন পরিচালনারও কোন সুযোগ নেই। বরং তাদের কর্তব্য হ’ল, একমুখী হওয়া এবং কথায় ও কাজে ইসলামের সত্যকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরা। এর ফলে মিথ্যা অবশ্যই পরাভূত হবে এবং সমাজ পরিশুদ্ধ হবে। যেমন আল্লাহ বলেন,بَلْ نَقْذِفُ بِالْحَقِّ عَلَى الْبَاطِلِ فَيَدْمَغُهُ فَإِذَا هُوَ زَاهِقٌ وَلَكُمُ الْوَيْلُ مِمَّا تَصِفُونَ- ‘বরং আমরা সত্যকে মিথ্যার উপর নিক্ষেপ করি। অতঃপর তা ওটাকে চূর্ণ করে দেয়। ফলে তা মুহূর্তেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। আর তোমরা যেসব কথা বল সেজন্য আফসোস’ (আম্বিয়া ২১/১৮)।
বস্ত্ততঃ ইসলামে হক ও বাতিল মিশ্রণের কোন সুযোগ নেই। আল্লাহ বলেন,وَلاَ تَلْبِسُوا الْحَقَّ بِالْبَاطِلِ وَتَكْتُمُوا الْحَقَّ وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ- ‘তোমরা সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশ্রিত করো না এবং জেনেশুনে সত্যকে গোপন করো না’ (বাক্বারাহ ২/৪২)।
যুগে যুগে ধর্মনেতা ও সমাজনেতারা শিরক ও বিদ‘আত রূপে সর্বদা ইসলামে ভেজাল মিশানোর চেষ্টা করেছে এবং এখনও করে যাচ্ছে। হাদীছপন্থী ওলামায়ে কেরাম সর্বদা এগুলি প্রতিহত ও পরিশুদ্ধ করার চেষ্টা করে গেছেন এবং আজও করে চলেছেন। এরাই উত্তম। যদিও সংখ্যায় কম। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,بَدَأَ الإِسْلاَمُ غَرِيْبًا وَسَيَعُوْدُ كَمَا بَدَأَ فَطُوبَى لِلْغُرَبَاءِ، قِيْلَ يَا رَسُوْلَ اللهِ وَمَنِ الْغُرَبَاءُ قَالَ: الَّذِيْنَ يُصْلِحُوْنَ مَا أَفْسَدَ النَّاسُ- ‘ইসলাম নিঃসঙ্গভাবে যাত্রা শুরু করেছিল। সত্বর সেই অবস্থায় ফিরে যাবে। অতএব সুসংবাদ হ’ল সেই অল্পসংখ্যক লোকদের জন্য। যারা আমার পরে লোকেরা (ইসলামের) যে বিষয়গুলি ধ্বংস করে, সেগুলিকে পুনঃসংস্কার করে’।[6] বস্ত্ততঃ হকপন্থীরা এই দলেই থাকেন। এরা না থাকলে আল্লাহর বিশুদ্ধ দ্বীন বাতিলের মিছিলে হারিয়ে যেত। এদিকে ইঙ্গিত করেই ইমাম আবুদাঊদ (২০২-২৭৫ হিঃ) বলেছেন,لَوْ لاَ هَذِهِ الْعِصَابَةُ لَانْدَرَسَ الْإِسْلاَمُ يَعْنِىْ أَصْحَابَ الْحَدِيْثِ- ‘আহলেহাদীছ জামা‘আত যদি দুনিয়ায় না থাকত, তাহ’লে ইসলাম দুনিয়া থেকে মিটে যেত’ (শারফ ২৯ পৃ.)।
মানুষের তৈরী মতবাদগুলি সর্বদা সংকীর্ণ স্বার্থ ও ভেজালে পূর্ণ। যেমন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় কোটি মানুষের রক্ত ঝরলেও সোভিয়েট ইউনিয়ন ও চীনা সমাজতন্ত্র কখনোই এক ছিল না। আর বর্তমানে দু’টি দেশই চরম পুঁজিবাদী। কিন্তু চীনারা তাদের নীতিভ্রষ্টতাকে সর্বদা কয়েকটি পরিভাষার আড়ালে ঢেকে রাখে। যেমন তারা বলে, Socialism with Chinese characteristics ‘চীনা বৈশিষ্ট্য যুক্ত সমাজতন্ত্র’। তাদের আরেকটি কালো চাদর হ’ল Principal contradiction & Non Principal ‘প্রধান দ্বন্দ্ব ও অপ্রধান দ্বন্দ্ব’। প্রথম পরিভাষাটি চীনাদের নিকট আপ্তবাক্যের ন্যায় প্রচলিত। দ্বিতীয়টি নিয়ে তাদের তাত্ত্বিকদের মধ্যে রয়েছে প্রচুর মতপার্থক্য। ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলিও ‘হানাফী মাযহাবের বৈশিষ্ট্যযুক্ত ইসলাম’ তথা Hanafied Islam কায়েম করতে চান। এছাড়াও তাদের মধ্যে রয়েছে শতশত পরস্পর বিরোধী দল ও উপদল। তাদের মধ্যেও ফরয বিধানগুলিকে প্রধান এবং অন্যগুলিকে অপ্রধান বলে এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা প্রকটভাবে বিদ্যমান। এমনকি শিরক ও বিদ‘আত এবং হালাল-হারামের মত বিষয়গুলিতেও তাদের কোন স্পষ্ট বক্তব্য পাওয়া যায় না। তাদের এই সংকীর্ণতার কারণেই পাকিস্তানে ইসলামী শাসন কায়েম হয়নি। বাংলাদেশেও হবে না যদিনা আল্লাহর বিশেষ রহমত হয়। এদিকে ইঙ্গিত করেই আল্লামা ইকবাল বলেন,
ہے فقط توحيدوسنت امن وراحت كا طريق
فتنہ وجنگ وجدل تقليد سے پيدا نہ كر
‘কেবল তাওহীদ ও সুন্নাত হ’ল শান্তি ও স্থিতির পথ + তাক্বলীদের মাধ্যমে ফিৎনা-ফাসাদ ও লড়াই সৃষ্টি করো না’।
(৫) আচরণ নম্র হওয়া :
আল্লাহ পাক স্বীয় রাসূলকে বলেন,
فَبِمَا رَحْمَةٍ مِنَ اللهِ لِنْتَ لَهُمْ وَلَوْ كُنْتَ فَظًّا غَلِيظَ الْقَلْبِ لَانْفَضُّوْا مِنْ حَوْلِكَ فَاعْفُ عَنْهُمْ وَاسْتَغْفِرْ لَهُمْ وَشَاوِرْهُمْ فِي الْأَمْرِ فَإِذَا عَزَمْتَ فَتَوَكَّلْ عَلَى اللهِ إِنَّ اللهَ يُحِبُّ الْمُتَوَكِّلِيْنَ-
‘আর আল্লাহর রহমতের কারণেই তুমি তাদের প্রতি (অর্থাৎ স্বীয় উম্মতের প্রতি) কোমলহৃদয় হয়েছ। যদি তুমি কর্কশভাষী ও কঠোর হৃদয়ের হ’তে, তাহ’লে তারা তোমার পাশ থেকে সরে যেত। কাজেই তুমি তাদের মার্জনা করে দাও ও তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর। আর যরূরী বিষয়ে তাদের সাথে পরামর্শ কর। অতঃপর যখন তুমি সংকল্পবদ্ধ হবে, তখন আল্লাহর উপর ভরসা কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ তার উপর ভরসাকারীদের ভালবাসেন’ (আলে ইমরান ৩/১৫৯)। অন্যত্র আল্লাহ স্বীয় নবী মূসা ও হারূণকে ফেরাঊনের নিকট প্রেরণের সময় বলেন,فَقُولاَ لَهُ قَوْلاً لَيِّنًا لَعَلَّهُ يَتَذَكَّرُ أَوْ يَخْشَى- ‘অতঃপর তার সাথে তোমরা দু’জন নরমভাবে কথা বল। হয়ত সে উপদেশ গ্রহণ করবে অথবা ভয় করবে’ (ত্বোয়াহা ২০/৪৪)। এতে বুঝা গেল যে, বাতিলের সামনে হক প্রকাশের সময় নিজের আক্বীদা দৃঢ় থাকবে ও আচরণ নম্র থাকবে। ভরসা পুরোপুরি আল্লাহর উপরে রাখতে হবে। যেমন আল্লাহ মূসা ও হারূণকে উপদেশ দিয়ে বলেন,لاَ تَخَافَا إِنَّنِي مَعَكُمَا أَسْمَعُ وَأَرَى ‘তোমরা ভয় করো না। নিশ্চয় আমি তোমাদের সাথে আছি। আমি সবকিছু শুনি ও দেখি’ (ত্বোয়াহা ২০/৪৬)।
সর্বদা মনে রাখতে হবে যে, বাতিল যেন হকপন্থীর আচরণে সন্তুষ্ট থাকে। যদিও সে হক কবুল করবে না। যেমন কুরায়েশ নেতারা রাসূল (ছাঃ)-কে সম্মান করত। যদিও তারা কুরআনকে মেনে নেয়নি। যেমন আল্লাহ বলেন,فَإِنَّهُمْ لاَ يُكَذِّبُوْنَكَ وَلَكِنَّ الظَّالِمِيْنَ بِآيَاتِ اللهِ يَجْحَدُوْنَ- ‘বস্ত্ততঃ ওরা তোমাকে মিথ্যা বলে না। বরং এইসব যালেমরা আল্লাহর আয়াত সমূহকে অস্বীকার করে’ (আন‘আম ৬/৩৩)।
(৬) হেদায়াতের প্রতি লোভ থাকা :
এজন্য আল্লাহর তাওফীক প্রয়োজন। যাতে হকপন্থী ব্যক্তি মানুষকে হেদায়াতের পথে ডাকার জন্য নিজের ভিতর থেকেই উৎসাহ পান। এই সহজাত আকাঙ্ক্ষা (Instinct) না থাকলে শত যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও ঐ ব্যক্তি সমাজ সংস্কারে ব্যর্থ হবে। যেমন আল্লাহ স্বীয় রাসূল সম্পর্কে বলেন,لَقَدْ جَاءَكُمْ رَسُولٌ مِنْ أَنْفُسِكُمْ عَزِيزٌ عَلَيْهِ مَا عَنِتُّمْ حَرِيصٌ عَلَيْكُمْ بِالْمُؤْمِنِينَ رَءُوفٌ رَحِيمٌ- ‘নিশ্চয়ই তোমাদের নিকট এসেছেন তোমাদের মধ্য থেকে একজন রাসূল, যার নিকট তোমাদের দুঃখ-কষ্ট বড়ই দুঃসহ। তিনি তোমাদের কল্যাণের আকাংখী। তিনি মুমিনদের প্রতি স্নেহশীল ও দয়াপরায়ণ’ (তওবা ৯/১২৮)।
(৭) হক প্রকাশে ইতস্তত না করা এবং হক বিরোধীদের এড়িয়ে চলা :
যেমন আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে বলেন,فَاصْدَعْ بِمَا تُؤْمَرُ وَأَعْرِضْ عَنِ الْمُشْرِكِينَ- إِنَّا كَفَيْنَاكَ الْمُسْتَهْزِئِينَ- ‘অতএব তুমি যে বিষয়ে আদিষ্ট হয়েছ, তা প্রকাশ্যে ব্যক্ত কর এবং মুশরিকদের উপেক্ষা কর’। ‘বিদ্রুপকারীদের বিরুদ্ধে আমরাই তোমার জন্য যথেষ্ট’ (হিজর ১৫/৯৪-৯৫)। এজন্যই দেখা যায় যে, শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) স্বীয় কওমের সমর্থনের অপেক্ষা না করে সমমনা ইয়াছরিববাসীদের আমন্ত্রণে সেখানেই হিজরত করেন।
(৮) সহনশীল হওয়া এবং দ্রুত ফল লাভের আশা না করা :
যেমন আব্দুল ক্বায়েস গোত্র ইসলাম কবুল করে মদীনায় আগমন করলে এবং কাফেলার মালামাল গুছিয়ে সকলের শেষে উপস্থিত হ’লে তাদের নেতা আশাজ্জ আল-‘আছরী (الأَشَجُّ العَصْرِيُّ)-কে লক্ষ্য করে রাসূল (ছাঃ) বলেন,
إِنَّ فِيكَ خَلَّتَيْنِ يُحِبُّهُمَا اللهُ الْحِلْمُ وَالأَنَاةُ. قَالَ يَا رَسُولَ اللهِ أَنَا أَتَخَلَّقُ بِهِمَا أَمِ اللهُ جَبَلَنِى عَلَيْهِمَا قَالَ : بَلِ اللهُ جَبَلَكَ عَلَيْهِمَا. قَالَ الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِى جَبَلَنِى عَلَى خَلَّتَيْنِ يُحِبُّهُمَا اللهُ وَرَسُولُهُ
‘তোমার মধ্যে দু’টি স্বভাব রয়েছে, যা আল্লাহ পসন্দ করেন, সহনশীলতা ও দূরদর্শিতা’ (অর্থাৎ কোন কাজের ফল লাভে ব্যস্ততা প্রদর্শন না করা এবং লক্ষ্যে দৃঢ় থাকা ও সুফলের অপেক্ষা করা (মির‘আত)। তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি কি উক্ত দু’টি গুণ দ্বারা ভূষিত হয়েছি, নাকি আল্লাহ আমাকে উক্ত দু’টি গুণের উপর সৃষ্টি করেছেন? জবাবে রাসূল (ছাঃ) বললেন, বরং আল্লাহ তোমাকে উক্ত দু’টি গুণের উপর সৃষ্টি করেছেন। তখন তিনি বললেন, আল্লাহর জন্য সকল প্রশংসা। যিনি আমাকে এমন দু’টি গুণের উপর সৃষ্টি করেছেন, যে দু’টি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ভালবাসেন’ (আবুদাঊদ হা/৫২২৫)।
উক্ত হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, সুন্দর চরিত্র মূলতঃ স্বভাবগতভাবেই হয়ে থাকে। যা কেবলমাত্র আল্লাহর রহমতেই লাভ করা সম্ভব। এদিক দিয়ে মানুষকে চারভাগে ভাগ করা যায়।- (১) জন্মগতভাবে চরিত্রহীন। ফলে দাওয়াত ও পরিচর্যার মাধ্যমেও যার কোন পরিবর্তন হয় না।
– প্রফেসর ড. মুহুম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
[1]. ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা জুম‘আ ২ আয়াত;وَذَلِكَ أَنَّ الْعَرَبَ كَانُوا مُتَمَسِّكِينَ بِدِينِ إِبْرَاهِيمَ الْخَلِيلِ عَلَيْهِ السَّلاَمُ فَبَدَّلُوهُ وَغَيَّرُوهُ، وَقَلَبُوهُ وَخَالَفُوهُ، وَاسْتَبْدَلُوا بِالتَّوْحِيدِ شِرْكًا وَبِالْيَقِينِ شَكًّا، وَابْتَدَعُوا أَشْيَاءَ لَمْ يَأْذَنْ بِهَا اللهُ وَكَذَلِكَ أَهْلُ الْكِتَابَيْنِ قَدْ بَدَّلُوا كُتُبَهُمْ وَحَرَّفُوهَا وَغَيَّرُوهَا وَأَوَّلُوهَا، فَبَعَثَ اللهُ مُحَمَّدًا صَلَوَاتُ اللهِ وَسَلاَمُهُ عَلَيْهِ بِشَرْعٍ عَظِيمٍ كَامِلٍ شَامِلٍ لِجَمِيعِ الْخَلْقِ، فِيهِ هِدَايَتُهُمْ، وَالْبَيَانُ لِجَمِيعِ مَا يَحْتَاجُونَ إِلَيْهِ مِنْ أَمْرِ مَعَاشِهِمْ وَمَعَادِهِمْ،…
[2]. মুসলিম হা/৫০; মিশকাত হা/১৫৭ ‘ঈমান’ অধ্যায়।
[3]. আবুদাঊদ হা/২৫০৪; নাসাঈ হা/৩০৯৬; দারেমী হা/২৪৩১; মিশকাত হা/৩৮২১ ‘জিহাদ’ অধ্যায়।
[4]. কুরতুবী, তাফসীর সূরা তওবা ৪১ আয়াত, ৮/১৩৯।
[5]. বুখারী হা/৭৩৭২, ১৪৫৮; মুসলিম হা/১৯ (২৯, ৩১); মিশকাত হা/১৭৭২ ‘যাকাত’ অধ্যায়।
[6]. আহমাদ হা/১৬৭৩৬; মিশকাত হা/১৫৯, ১৭০; ছহীহাহ হা/১২৭৩।