দাওয়াত ও জিহাদ

দাঈদের প্রতি নাসিহা

এই লেখাটি পড়ার আগে প্রথমে আংকেল টম বলতে কি বোঝানো হয় তা জেনে নেওয়া দরকার। আংকেল টম বলতে হীনমন্য প্রজাতির দাসভাবাপন্ন, বিনয়বিগলিত, সেবাপ্রদানে-তৎপর এক চরিত্রের দিকে নির্দেশ করা হয় যে কিনা শাসকশ্রেণীর প্রতি অতিমাত্রায় অনুগত। ঐতিহাসিকভাবে এটি একটি কৃষ্ণাঙ্গ চরিত্র যে নিজেদের নীচু জাত এবং সাদাদের উঁচু জাত মনে করে এবং তাদের চাটুকারিতায় লিপ্ত থাকে।

——————————–

তারিক মেহান্নার কাছে প্রশ্ন: আসসালামু আলাইকুম, আমার আগের প্রশ্নটির বিশদ উত্তর দেয়ার জন্য আল্লাহ আপনাকে উত্তম পুরস্কার দান করুন। কিন্তু আমি আপনার কাছে আরো কিছু বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা আশা করছি। আপনি আগের প্রশ্নের জবাবে পশ্চিমা দেশের অনেক দা’ঈ কে আংকেল টম হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। আপনার এ কথার সূত্র ধরে বলতে চাই, বর্তমান সময়ে এমন কিছু বিষয় আছে যেগুলো নিয়ে দা’ঈরা জেলে যাবার ভয়ে কথা বলতে চান না। হিকমাহর সাথে এসব বিষয় নিয়ে প্রকাশ্যে কীভাবে কথা বলা সম্ভব বলে আপনি মনে করেন? … আর যারা এসব ব্যাপারে কথা বলতে ভয় করে তাদের আসলে করণীয় কী?

তারিক মেহান্নার উত্তর:

প্রথমত, আমি এই ব্যাপারে আপনার সাথে দ্বিমত পোষণ করি যে, কেবলমাত্র ভয় পায় বলে এই দা’ঈরা সত্য কথা বলা থেকে বিরত থাকে। কেউ যদি ইসলামের কথা বলতে ভয় পায়, তাহলে সে চুপ করে থাকবে, ব্যস! কিন্তু আমরা যখন দেখি আংকেল টম নীরবতা ভঙ্গ করে ‘অতি উদ্যোগী’ হয়ে ইসলামকে কাটছাঁট করে নখদন্তহীনভাবে মানুষের সামনে ইসলামকে উপস্থাপনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, এবং সেটা সে করছে ইসলামের শত্রুদের সাথে এক টেবিলে বসে, তখন আমরা বুঝতে পারি, নিছক ভয়ের কারণে সে এমনটি করছে না, বরং সমস্যার মূল আরো গভীরে। আপনি খেয়াল করে দেখবেন, ইসলামের উপর আদর্শিক আক্রমণ নতুন কোনো ঘটনা নয়, বরং সেটা হয়ে আসছে বেশ কয়েক শতক জুড়েই, এবং প্রত্যেক আক্রমণের জবাবে আলিমদের কাছ থেকে তিনটি ভিন্ন ধরনের সাড়া মিলেছে।

  • প্রথম দল, এরা এই আক্রমণের মুখে কার্যত নতি স্বীকার করেছে। আক্রমণকারী কাফের সভ্যতার চোখ ধাঁধানো চাকচিক্যে এরা বিমুগ্ধ হয়ে নিজেদের আত্মা ও মন পুরোপুরি বিকিয়ে দিয়ে মানসিক দাসে পরিণত হয়েছে। ফলে তারা কাফেরদের দৃষ্টিভঙ্গিতে ইসলামকে বুঝাতে চেষ্টা করেছে এবং কাফেরদের ব্যবহৃত পরিভাষা ব্যবহার করে ইসলামকে ব্যাখ্যা করেছে।
  • দ্বিতীয় দল, তারা কিছু বিষয়ে আপস করে, কিছু বিষয়ে করে না (‘মানিয়ে চলো’ নীতি)।
  • তৃতীয় দলে আছেন এমন কিছু ‘আলিম, যাদের অবস্থান উপরের দুই দলের মতো নড়বড়ে নয়। তারা কোনোকিছুতে বিন্দুমাত্র ছাড় দেননি। সকল বাধা-বিপত্তি ও চাপের মুখেও তারা অবিচল থেকেছেন।

 

কাজেই, আংকেল টমের সমস্যাটি ভয়জনিত নয়, বরং মূল সমস্যা হচ্ছে তার পরাজিত মানসিকতা। সে ইসলামের শত্রুদের বুদ্ধিবৃত্তিক এবং আদর্শিক আক্রমণের সামনে পরাভূত হয়েছে। তাই সে এখন মন থেকেই তাদের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে। সে এখন চায় সমাজে যেন তার গ্রহণযোগ্যতা টিকে থাকে এবং বিরোধিতার মুখে পড়তে না হয়। এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে, আংকেল টম একাকী ঘরে বসে জালিমের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে না পারার যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট!! না, তার অবস্থা মোটেও এমন নয়! সে মানসিক দাসত্বের বেড়াজালে এতটাই বন্দী যে, সে জালিমকেও আর জালিম মনে করে না, উল্টো জুলুমের জন্য সে নিজেকেই দায়ী করে এবং জালিমের মন যুগিয়ে চলতে চায় (Stockholm syndrome)!

এসব লোকদের করণীয় কী জানতে চেয়ে আপনি যে প্রশ্নটি করেছেন সে প্রশ্নটি তাদের জন্য খাটেই না! আপনি ধরেই নিচ্ছেন তারা কিছু একটা করতে চায়! মনস্তত্ত্বের ভাষায়, বহু আগেই তারা হার মেনে নিয়েছে। যে বিষয়ে প্রশ্ন এবং বাস্তবিক আলোচনার অবকাশ আছে তা হলো, আমরা যারা হার-না-মানা দলের পথ অনুসরণ করতে চাই, যারা উম্মাহকে পুনর্জীবিত করতে চাই, তাদের এ মুহূর্তে কী করণীয়? বিশেষভাবে, আমরা যারা পশ্চিমা দেশে বসবাস করছি, তাদের কী করা উচিত যেখানে ভিনদেশি ও আজিব চেহারার এক ইসলাম পালিত হচ্ছে? যখন ইসলাম থেকে সম্মান আর গৌরবের চাদর খুলে ফেলে ইসলামকেই অপমানিত করা হচ্ছে এমন চরম মুহূর্তে আমাদের কী করণীয়?

কুরআনে কিছু আয়াত আছে যেগুলো আমাদেরকে গভীর চিন্তার খোরাক দেয়। নির্দিষ্ট করে বললে, মূসা (আ) এবং ফির’আউনের গল্পের দিকে আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করা উচিত। এই গল্পটি কুর’আনে সবচেয়ে বেশিবার বর্ণিত, সবচেয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বর্ণিত এবং আমরা যে সময়ে বাস করছি তার সাথে সবচেয়ে বেশি সাদৃশ্যপূর্ণ। আজকে বিশ্বাসী মুসলিম জাতির অবস্থা তৎকালীন বনী ইসরাইলের মতো। ফির’আউনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে আজ মুসলিমদের শোষণ করছে জুলুমবাজ আমেরিকান সরকার। সেদিনের মূসা (আ) এর মতো আজকে প্রয়োজন একজন মুসলিম নেতার যার দায়িত্ব হবে মুসলিম জাতিকে রক্ষা করা ও তাদেরকে ইসলাম শিক্ষা দেওয়া, একই সাথে জালিমদের শিক্ষা দেওয়া ইসলাম কী। আসুন আমরা দেখি, আল্লাহর প্রেরিত একজন নবী, একজন সুদক্ষ এবং কুশলী দা’ঈ হিসেবে মূসা (আ) তার উম্মাহকে নিয়ে এই কঠিন পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দিয়েছিলেন।

প্রথমেই লক্ষণীয় বিষয়টি হলো, মূসা (আ) এর কাছে ইসলামের “ওয়ালা” এবং “বারা” এ দুটো ধারণা ছিল স্ফটিকস্বচ্ছ। ফির’আউন এবং মূসা (আ) এর সম্পর্কের দিকে লক্ষ্য করুন, কোনো লুকোচুরি বা রাখঢাক নেই, কে কোন পক্ষে আছে – সেটা নিয়ে কোনোরকম অস্পষ্টতা নেই। দুটো দলকে মোটা দাগে পৃথক করা হয়েছে। মূসা (আ) ফির’আউন এবং ফির’আউনের দলভুক্ত সকলকে বনী ইসরাইলের স্পষ্ট ও প্রকাশ্য শত্রুরুপে চিহ্নিত করেছেন। বনী ইসরাইলকে আশ্বস্ত করে মূসা (আ) বলছেন,

”হতে পারে তোমাদের প্রভু তোমাদের শত্রুদের ধ্বংস করবেন, আর অচিরেই তোমাদেরকে প্রতিনিধিত্ব দান করবেন” [সূরা আরাফ:১২৯]

ফির’আউনের বিরুদ্ধে করা আগ্রাসী দু’আ থেকে মূসা (আ) এর বৈরী মনোভাব আরও পরিষ্কার হয়।

‘আর মূসা বললেন — ”আমাদের প্রভু! নিশ্চয় তুমি ফিরআউন ও তার পরিষদবর্গকে এই দুনিয়ার জীবনে শোভা-সৌন্দর্য ও ধন- দৌলত প্রদান করেছ, যা দিয়ে, আমাদের প্রভু! তারা তোমার পথ থেকে পথভ্রষ্ট করে। আমাদের প্রভু! বিনষ্ট করে দাও তাদের ধনসম্পত্তি, আর কাঠিন্য এনে দাও তাদের হৃদয়ের উপরে, তারা তো বিশ্বাস করে না যে পর্যন্ত না তারা মর্মন্তুদ শাস্তি প্রত্যক্ষ করে। ‘ [সূরা ইউনুস:৮৮]

অথচ মূসা (আ) এর কাহিনী বর্ণনা করে আল্লাহ বলেছেন,

“অতঃপর ফির’আউন পরিবার মূসাকে কুড়িয়ে নিল, যাতে তিনি তাদের শত্রু ও দুঃখের কারণ হয়ে যান। নিশ্চয় ফির’আউন, হামান, ও তাদের সৈন্যবাহিনী অপরাধী ছিল।” [সূরা ক্বাসাস:৮]

ফির’আউনের প্রতি মূসা (আ) যে ধরনের মনোভাব ও মানসিকতা পোষণ করতেন সেটা বোঝা আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ শত্রুর প্রকৃত পরিচয় নিয়ে যদি সুস্পষ্ট ধারণা না থাকে, তাহলে নিজেকে এবং নিজের উম্মাহকে শত্রুর ষড়যন্ত্রের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য সুপরিকল্পিত কোন কৌশল গ্রহণ করা সম্ভবপর হয়ে উঠবে না। এ কারণেই কুর’আনে শয়তানের ব্যাপারে আল্লাহ আমাদেরকে সতর্ক করে দিয়েছেন,

“নিঃসন্দেহ শয়তান তোমাদের শত্রু, কাজেই তাকে শত্রু হিসেবে গ্রহণ কর!” [সূরা ফাতির:৬]

আপনার শত্রু কখনোই আপনাকে তার পরিকল্পনা জানতে দেবে না। সে হবে খুব সূক্ষ্ণ, শঠতাপূর্ণ, কূটকৌশলী, স্মিতহাস্য, ধীরস্থির এবং ধূর্ত আপনি কিছু বুঝে ওঠার আগেই আপনাকে সে আঘাত করে চুরমার করে দেবে। এমনটা যে কেবল বাস্তব জগতে ঘটবে তা নয়, বরং মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধেই আপনি মনোবল হারিয়ে পরাজয় স্বীকার করতে পারেন। মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের একটা সুপ্রসিদ্ধ কৌশল হল আপনার শত্রু আপনাকে বোঝাবে যে, সে আপনার শত্রু নয় বরং বন্ধু। যেন আপনাকে ব্যবহার করে আপনার বন্ধু অর্থাৎ তার আসল শত্রুকে দমন করতে পারে। এই ফাঁদে পা দেয়ার অর্থই হলো নিজেদেরকে রক্ষা করার শেষ সুযোগটুকুও হারানো। অধিকন্তু, আপনার ভাই ও বোনদের দিকে বিশ্বস্ততার হাত না বাড়িয়ে সে হাত কাফিরদের সাথে মেলানো হলো মুনাফিক্বদের বৈশিষ্ট্য।

“এরা (মুনাফিক্বরা) দোদুল্যমান অবস্থায় ঝুলন্ত; এদিকেও নয় ওদিকেও নয়…” [সূরা নিসা:১৪৩]

কাজেই নিজে বাঁচতে এবং উম্মাহকে বাঁচাতে সর্বপ্রথম ধাপটি হচ্ছে ওয়ালা’ এবং বারা’ এর ধারণাকে পুনরুজ্জীবিত করা যেন আপনি শত্রুকে বন্ধু ভেবে গুলিয়ে না ফেলেন। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং বর্তমান সময়ে বিশেষ চিন্তার দাবি রাখে।

দ্বিতীয় যে ব্যাপারটি আমাদের খেয়াল করতে হবে তা হলো, “মৌলবাদ”, “চরমপন্থা”, “সন্ত্রাসবাদ”, “উগ্রবাদ” – যত্রতত্র এসকল শব্দের অসতর্ক ব্যবহার। এই শব্দগুলো ধোকাঁবাজি ছাড়া আর কিছুই নয়। গণমানুষকে বিভ্রান্ত করে রাখাই এসকল শব্দচয়নের উদ্দেশ্য। মূসা (আ) কে ফির’আউন রুখে দিতে চেয়েছিল “চরমপন্থা দমন” এর নামে!

“আর ফিরআউনের লোকদের প্রধানরা বললো -“আপনি কি মূসাকে ও তার লোকদের ছেড়ে দেবেন দেশে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে এবং আপনাকে এবং আপনার দেবতাদের পরিত্যাগ করতে?”[সূরা আরাফ:১২৭]

ফির’আউন বলল; তোমরা আমাকে ছাড়, মূসাকে হত্যা করতে দাও, ডাকুক সে তার পালনকর্তাকে! আমি আশংকা করি যে, সে তোমাদের ধর্ম পরিবর্তন করে দেবে অথবা সে দেশময় বিপর্যয় সৃষ্টি করবে” [সূরা গাফির: ২৬]

এবং ফির’আউন নিজেকে প্রগতিশীলসুশীল এবং উদারপন্থী হিসেবে দাবি করতো !

“ফির’আউন বলল, আমি যা বুঝি, তোমাদেরকে তাই বোঝাই, আর আমি তোমাদেরকে মঙ্গলের পথই দেখাই” [সূরা গাফির:২৯]

কিন্তু মূসা (আ) যে দিকে মানুষকে আহবান করছিলেন সেটিকে বোঝাতেই মূলত ফির’আউন এই শব্দগুলোর (ফিতনাবাজ, বিপর্যয় সৃষ্টিকারী) অবতারণা করেছিল। কারণ মূসা (আ) অবস্থান নিয়েছিলেন ফির’আউনের বিরুদ্ধে। যেসব মিশরীয় মূসা (আ) এর ধর্ম গ্রহণ করেছিল, তাদের কথা থেকে আমরা বুঝতে পারি ফির’আউন কি বুঝাতে চেয়েছিল। তারা বলেছিল:

“বস্তুতঃ আমাদের সাথে তোমার শত্রুতা তো এ কারণেই যে, আমরা ঈমান এনেছি আমাদের পরওয়ারদেগারের নিদর্শনসমূহের প্রতি যখন তা আমাদের নিকট পৌঁছেছে।” [সূরা আরাফ:১২৬]

ব্যাপারটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটু থেমে এই আয়াতটি নিয়ে আমাদের গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করা উচিত। ফির’আউন সকলের সামনে মূসার এমন একটি চরিত্র উপস্থাপন করতে চেয়েছিল যাতে মনে হবে মূসা একজন রক্তচোষা বিকারগ্রস্ত লোক, যে সমাজে ফিতনা-ফাসাদ করতে চায়! কিন্তু আমরা কুর’আনে দেখতে পাচ্ছি এমন কিছু মুসলিম ছিলেন যারা ফির’আউনের এই মিডিয়া ক্যাম্পেইনে প্রলুব্ধ হয়নি। তারা ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন মূসা (আ) সত্য বলছেন, আর ফির’আউন মিথ্যা। তারা জানতেন ফির’আউন মৌলবাদ, ধর্মীয় চরমপন্থা কিংবা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে না, বরং মূসা (আ) এর আহবান অর্থাৎ ইসলাম থেকে লোকজনকে দূরে সরিয়ে রাখতে এই ধরনের স্পর্শকাতর শব্দ ব্যবহার করছে। কেন? কারণ, মূসা (আ) যে বার্তাটি মানুষের কাছে ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন তা হলো, আমরা কেবল আল্লাহর কাছে মাথা নত করবো, ফির’আউনের মতো কোনো অত্যাচারী জালিমের কাছে নয়। যে মানুষগুলোকে ফির’আউন এতকাল মানসিক দাসত্বের বেড়াজালে বন্দী করে রেখেছিল তাদের মনে মূসার (আ) এই কথাগুলো গৌরব, মর্যাদা এবং আত্মসম্মানের একটি চেতনা সৃষ্টি করে।

আর আজকেও আমরা দেখছি ইসলামের যেসব ভাবনা মানুষের মধ্যে জাগরণ সৃষ্টি করবে, ইসলামের যেসব চেতনা ও উপলব্ধি মানুষের সামনে মুক্তির দুয়ার উন্মোচিত করবে, সেইসব বিষয়গুলোর সাথে খুব অপ্রীতিকর লেবেল জুড়ে দিয়ে নেতিবাচকভাবে গণমানুষের সামনে উপস্থাপন করা হয়। তাই “ওয়ালা এবং বারা” হয়ে যায় ‘মৌলবাদ’, আত্মরক্ষার জন্য জিহাদের নাম হয় ‘সন্ত্রাসবাদ’ বা ‘জঙ্গিবাদ’, আর শরীয়াহকে অপবাদ দেওয়া হয় ‘চরমপন্থা’ বলে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আপনি দেখবেন আমজনতাও কোনো চিন্তাভাবনা না করেই এসব সংজ্ঞা অবলীলায় গ্রহণ করছে। এমনকি অনেক আলিম এবং দা’ঈ পর্যন্ত তাদের কথায় এবং লেখায় কাফিরদের সাথে তাল মিলিয়ে এসব ‘পরিভাষা’ ব্যবহার করছেন।

লেখার শুরুতে আদর্শিক আক্রমণের জবাবে কার অবস্থান কেমন হয় সেটি আলোচনা করেছিলাম। উপরে যাদের কথা বলেছি তারাই হলো সেই প্রথম দল। এরা দাসসুলভ মানসিকতা বহন করে। এই শ্রেণির ‘আলিমরা আজকে তাগুত সরকার আয়োজিত “Counter-radicalism conference” এ গর্বের সাথে যোগ দিচ্ছে! আপনি কী কল্পনা করতে পারেন, মূসা (আ) ফির’আউনের কাছে গিয়ে আর্তি জানাচ্ছেন যেন বনী ইসরাইলকে সুশীল করে গড়ে তোলা হয়, যেন তাদের মধ্য থেকে মৌলবাদের বীজ নির্মূল করা হয়! কিংবা আমাদের রাসূল ﷺ স্পেশাল এজেন্ট আবু জেহেলকে দাওয়াত করে এনেছেন দারুল আরকামে সাহাবীদেরকে “চরমপন্থা দমনে কী করণীয়” তা নিয়ে লেকচার দেওয়ার জন্য? অবশ্যই না! কাজেই আপনাকে মূসা (আ) এর অনুসারীদের মতো সাবধান থাকতে হবে। এ ধরনের শব্দের উদ্দেশ্যমূলক ব্যবহারে প্রতারিত না হয়ে এই শব্দগুলোর ব্যবহার থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকুন।

আরো একটি ব্যাপার নিয়ে চিন্তার অবকাশ রয়েছে। তা হলো, হিকমাহ প্রয়োগ করা এবং নমনীয় হওয়া। আপনি আপনার প্রশ্নে হিকমাহ এর ব্যাপারে জানতে চেয়েছেন। আপনি হয়তো খেয়াল করবেন, এই হিকমাহ গ্রহণ করতে গিয়ে একদল বাড়াবাড়ি করছে, আবার আরেকদল হিকমাহ বর্জন করতে গিয়ে বাড়াবাড়ি করছে। একদল লোক আছে শ্রোতার মেজাজ-মর্জির দিকে থোড়াই কেয়ার করে। শ্রোতার জ্ঞানের মাত্রার প্রতি খেয়াল না রেখে কোনো রাখ-ঢাক ছাড়াই কথা বলতে থাকে। আবার অনেকে হিকমাহ খাটাতে গিয়ে সত্যকেই গোপন করে বসে যার ফলে ইসলামের মর্মকথার নির্যাসটুকুই নষ্ট হয়ে যায় এবং বিকৃত হয়ে যায়। মূসা (আ) এর দিকে দেখুন। এ দুটোর কোনোটিই তিনি করেননি। আমাদের মতো তিনিও ছিলেন সংখ্যালঘুদের অন্তর্ভুক্ত। আমাদের মতো তাঁরও দুনিয়াবী শক্তির ক্ষেত্রে দুর্বলতা ছিল। আমাদের মত তাঁকেও এক কঠিন পরিস্থিতি সামাল দিতে হয়েছিল। আর আমাদের মতো, তাঁকে বিশেষভাবে আদেশ করা হয়েছিল যেন তিনি উম্মাহর ব্যাপারে নমনীয়তা অবলম্বন করে।

“তোমরা উভয়ে ফেরআউনের কাছে যাও সে খুব উদ্ধত হয়ে গেছে. অতঃপর তোমরা তাকে নম্র কথা বল, হয়তো সে চিন্তা-ভাবনা করবে অথবা ভীত হবে” [সূরা ত্ব-হা:৪৩,৪৪]

আবার আপনি যখন অন্য আয়াতগুলোর দিকে তাকাবেন, তখন আপনি মূসা (আ) এর দা’ওয়াহ এর মধ্যে প্রজ্ঞার ছাপ দেখবেন। দা’ওয়াহ এর ক্ষেত্রে নমনীয়তা অবলম্বনের রীতিকে ঢাল বা সেন্সরবোর্ড রূপে ব্যবহার করে মূসা (আ) কখনোই সত্যকে অস্পষ্ট রাখেননি।

“আল্লাহর পক্ষ থেকে যে সত্য এসেছে, তার ব্যতিক্রম কিছু না বলার ব্যাপারে আমি সুদৃঢ়…” [সূরা আরাফ:১০৫]

শুধু তাই নয়, নমনীয়তা অবলম্বনের মানে এই নয় যে, জুলুম-নির্যাতনের মুখে ভীরু এবং নরম-সরম হয়ে থাকতে হবে।

“অতএব তোমরা তার কাছে যাও এবং বল: আমরা উভয়েই তোমার পালনকর্তার প্রেরিত রসূল, অতএব আমাদের সাথে বনী ইসরাইলকে যেতে দাও এবং তাদেরকে নিপীড়ন করো না। আমরা তোমার পালনকর্তার কাছ থেকে নিদর্শন নিয়ে তোমার কাছে আগমন করেছি। এবং যে সৎপথ অনুসরণ করে, তার প্রতি শান্ত। আমরা ওহী লাভ করেছি যে, যে ব্যক্তি মিথ্যারোপ করে এবং মুখ ফিরিয়ে নেয়, তার উপর আযাব পড়বে”।[সূরা ত্ব-হা:৪৭,৪৮]

আসুন আমরা এক মিনিটের জন্য থামি এবং এই আয়াতগুলোর দিকে মনোযোগ দিই। এখানে আমরা দেখছি মূসা (আ) একজন নবী, যিনি কোনো ক্ষমতাশালী ব্যক্তি নন, বরং তিনি ছিলেন নিপীড়িত মানুষদের একজন। তিনি ছিলেন সংখ্যালঘু। বিশ্বের তত্কালীন পরাশক্তির সাথে নম্রতা অবলম্বন করতে আদেশপ্রাপ্ত মূসা তাঁর সংকটাপন্ন উম্মাহকে উদ্ধার করতে তিনটি পদক্ষেপ নিলেন:

– তিনি ফিরাউনের অপকর্মের কথা খুব পরিষ্কারভাবে উপস্থাপন করলেন তার জাতির সামনে।

– তিনি খুব দৃঢ়তার সাথে দাবি করলেন যে, ফির’আউনকে অবশ্যই তার দুষ্কর্মের ইতি টানতে হবে।

– তিনি ফির’আউনকে তার দৌরাত্ম্যের জন্য তার অশুভ পরিণামের ব্যাপারে হুমকিদিলেন।

আপনি দেখবেন, মূসা (আ) আত্মপক্ষসমর্থন করার চেষ্টা করেননি, কোনো কৈফিয়ত দেয়ার চেষ্টা করেননি। তাঁর মধ্যে কোনো পরাজিত মানসিকতা ছিল না। তাঁর কথায় কোনো অস্পষ্টতা ছিল না। তাঁর মধ্যে ভীরুতা ছিল না। দুনিয়াবী শক্তির অভাব তাঁর নৈতিক মনোবলে কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। বরং তিনি তা-ই বলেছিলেন, যা বলা উচিত, যেভাবে বলা উচিত, এবং যখন বলা উচিত। ইমাম ইবনুল কায়্যিম(রাহিমাহুল্লাহ) হিকমাহকে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন এভাবেই, “হিকমাহ হচ্ছে উচিত সময়ে, উচিত ভঙ্গিতে, উচিত কথাটি বলা” (মাদারিজ আস-সালিকিন, ২/৪৭৯)।

মূসা (আ) মিনমিন করে কথা বলেননি। তাঁর কথায় দৃঢ়তা ছিল। তাঁর মধ্যে আত্মমর্যাদার ছাপ ছিল সুস্পষ্ট এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, তিনি ছিলেন স্পষ্টভাষী। ফির’আউনের প্রতিক্রিয়া দেখেই আমরা তা বুঝতে পারি। সে মূসাকে ‘সন্ত্রাসবাদ’ বা ‘মৌলবাদ‘-বিরোধী কনফারেন্সে আমন্ত্রণ করেনি কিংবা মূসাকে তার সরকারের ‘সন্ত্রাসবাদ দমন বিশেষজ্ঞ’ হিসেবে যোগ দিতে অনুরোধ করেনি। অথচ আজকে আমেরিকা কিছু স্বেচ্ছায় বিকিয়ে যাওয়া মুসলিম দা’ঈকে তার সাহায্যকারী হিসেবে পাচ্ছে! বরং ফির’আউন চেয়েছে মূসাকে হত্যা করতে, যেমন করে যুগে যুগে এই ফির’আউনদের অপকীর্তি প্রকাশ করে দেওয়ার কারণে মানবাধিকার এবং মুক্তিকামী নেতাদের যুগ যুগ ধরে গুপ্তহত্যা করা হয়েছে। এবং সেই একই ঘটনা ঘটে চলেছে আজ অবধি …

আমাদের অধিকাংশই ভীতু। আমরা যেকোনো মূল্যে দুশ্চিন্তা পরিহার করে চলতে চাই। লোকের বিরোধিতার মুখে পড়তে চাই না। আমরা চাই সবাই আমাদের পছন্দ করুক। যদিওবা আমরা কখনো বুঝতে পারি একটা সাহসী পদক্ষেপ নেয়া খুব জরুরী, আমরা সেটা নিতে চাই না, কারণ সেটার ফলাফল নিয়ে আমরা আতঙ্কগ্রস্ত থাকি। লোকে আমাদেরকে কী ভাববে এবং মিডিয়া আঙ্গুল তাক করবে – এই দুশ্চিন্তায় আমরা কেটে পড়ি। হ্যাঁ, আমরা আমাদের ভীরুতাকে “হিকমাহ” কিংবা “বিচক্ষণতা” বলে চালিয়ে দিতে পারি, কিন্তু বাস্তবিকপক্ষে এটা স্বার্থপরতা ছাড়া আর কিছুই নয়। আমাদের মধ্যে যে ভয় আছে তা আমাদের নিজেদের হাতে গড়ে নেয়া অভ্যাস, এটা সহজাত নয়। নিজেকে দুশ্চিন্তা থেকে বাঁচাবার জন্য আমরা এর আশ্রয় নিই। ভয়কে নিজের জীবন থেকে উপড়ে ফেলুন এবং সাহস দিয়ে একে প্রতিস্থাপিত করুন। ভীরুতার দরুণ আপনাকে যে মূল্য দিতে হবে তা সাহসের জন্য দেয়া মূল্য থেকে অনেক বেশি চড়া।

আপনার কাছে অবিশ্বাস্য ঠেকতে পারে, সুফিয়ান আস-সাওরী, সৎকাজে আদেশ এবং অসৎকাজে নিষেধ করতে গিয়ে মুখ ফুটে কিছু বলতে ব্যর্থ হলে চরম হতাশার চোটে রক্ত প্রস্রাব করতেন। কাজেই, যখন আপনি কিছু বলার সুযোগ পাবেন তখন চুপ করে থাকবেন না। দ্ব্যর্থকতার আড়ালে নিজেকে নিরাপদ অবস্থানে লুকিয়ে রাখবেন না। এতে আপনার কোনোই উপকার হবে না। মূসা (আ) কে অনুসরণ করুন। ধরে ধরে সুনির্দিষ্ট করে নামগুলো উচ্চারণ করুন। আমেরিকান সরকারের নাম বলুন। তুলে ধরুন প্যালেস্টাইন, ইরাক আর আফগানিস্তানের কথা। বলুন বোন আফিয়া সিদ্দিকির কথা। এমন প্রতিটি বিষয় তুলে ধরুন যেন জালেমরা জানতে পারে তাদের কাজকর্ম নিয়ে আমরা কী ভাবছি। এটাকে চরমপন্থা কিংবা মৌলবাদ অথবা উগ্রবাদ বলে না, এটা হচ্ছে সত্যকে কোনো কাটছাঁট না করে যেমন-আছে-তেমন-ভাবে প্রকাশ করে নিজের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করা

আর হিকমাহ মানে নিজেদের দ্বীনকে মানুষের কাছে লুকিয়ে রাখা নয়। আর এই কারণে তো নয়ই যে, দ্বীন ইসলামের কোনো একটি অংশ সমাজের চোখে অপছন্দনীয়, উচ্চারণের অযোগ্য কিংবা অযাচিত বলে ঠেকে। ইসলামিক দা’ওয়াহ এর মূল কথাই হল সত্যকে প্রকাশিত করা, তাকে গোপন করে রাখা নয়।

” আর স্মরণ করো! যাদের কিতাব দেওয়া হয়েছিল তাদের থেকে আল্লাহ্ অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলেন — ”তোমরা নিশ্চয় এর কথা লোকেদের কাছে প্রকাশ করবে, আর তা লুকিয়ে রাখবে না।” [সূরা আলে ইমরান:১৮৭]

“নিশ্চয় যারা গোপন করে, আমি যেসব বিস্তারিত তথ্য এবং হেদায়েতের কথা নাযিল করেছি মানুষের জন্য কিতাবের মধ্যে বিস্তারিত বর্ণনা করার পরও; সে সমস্ত লোকের প্রতিই আল্লাহর অভিসম্পাত এবং অন্যান্য অভিসম্পাতকারীগণের ও” [সূরা বাক্বারা:১৫৯]

যারা কোনো প্রশ্নের উত্তর জানার পরেও নিশ্চুপ থাকাকে শ্রেয় মনে করে, আল্লাহর রাসূল ﷺ তাদের জন্য একটি কঠোর সতর্কবাণী রেখে গেছেন: “যে ব্যক্তি ইলম সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হওয়ার পরে জানা সত্ত্বেও তা গোপন করেছে, ক্বিয়ামতের দিন তাকে আগুনের লাগাম পরিয়ে দেয়া হবে” হোক সে ব্যাপারটি আমাদের দ্বীনের ‘বিতর্কিত’ এবং সমাজের চোখে অযাচিতঅপছন্দনীয়, অনাহূত বিষয়গুলোর একটি। যেমন ধরা যাক জিহাদ। “আমার হাত-পা বাঁধা, আমার কিছু করার নেই” এরকম ভাব করে থাকবেন না। ইসলামে জিহাদের প্রকৃত ধারণাটি কেমন সেটা ব্যাখ্যা করে দিলেই তো পারেন, এমন তো নয় আপনাকে কেউ বলছে খাপখোলা তলোয়ার হাতে রাস্তায় নেমে পড়তে হবে!

যারা জানতে চায় তাদেরকে শুধু জানিয়ে দিন: ইসলামের মূলধারার, সর্বজনস্বীকৃত, প্রসিদ্ধ চারটি মাযহাব জিহাদের ব্যাপারে কী বলছে। আপনি যদি সেই তথাকথিত “বাকস্বাধীনতার দেশ” এ পড়ে থাকেন আর এ কথা বলতে ভয় করেন যে, ইসলাম আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার শিক্ষা দেয়, সেক্ষেত্রে আপনার উচিত সেই দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও হিজরতের চিন্তা করা, যেখানে অন্তত এই মৌলিক মানবাধিকারের কথা বলার কারণে আপনাকে জেলে ছুঁড়ে ফেলা হবে না। আমাদের এই দ্বীনে এমন কিচ্ছু নেই, কুর’আন বা হাদীস একটা অক্ষরও খুঁজে পাওয়া যাবে না যার জন্য আমাকে বা আপনাকে বিব্রত হতে হবে, লজ্জিত হতে হবে, কিংবা মানুষের কাছে ব্যাখ্যা করতে ভয় পেতে হবে। সবকিছু বাদই দিলাম, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আমেরিকানরা যে বিপ্লব করেছিল, যুদ্ধ করেছিল সেটা জিহাদ নয়তো কি? নাৎসি বাহিনীর বিরুদ্ধে ফ্রেঞ্চরা যে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল সেটাকে জিহাদ ছাড়া আর কী-ই বা বলা যায়? আর আজকে মুসলিমরা যখন আমেরিকার বিরুদ্ধে লড়ছে সেটাকে জিহাদ বলতে এত বাধছে কেন?

সবশেষে যে ব্যাপারটি আসে তা হল দা’ওয়াহ এর জন্য কষ্ট এবং যন্ত্রণা ভোগ। এই অজুহাতটি সকলে দিয়ে পার পাওয়ার চেষ্টা করে এবং যেকোনো কিছুকে জায়েজ করে ফেলে। হ্যাঁ, মূসা (আ) ও বনী ইসরাইলও একটি আতঙ্কময় পরিস্থিতিতে অবস্থান করছিল এবং সে সময়টা ছিল আমাদের সময় থেকে আরো বেশি ভয়ঙ্কর। মূসা (আ) এবং হারূন (আ) আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানালেন,

“তারা বলল: হে আমাদের পালনকর্তা, আমরা আশঙ্কা করি যে, সে আমাদের প্রতি জুলুম করবে কিংবা সীমালংঘন করবে” [সূরা ত্ব-হা:৪৫]

“কিন্তু তাঁর সম্প্রদায়ের সন্তানসন্ততি ব্যতীত আর কেউ মূসার প্রতি বিশ্বাস করেনি ফিরআউন ও তাদের পরিষদবর্গের ভয়ে পাছে তারা তাদের নির্যাতন করে…” [সূরা ইউনুস:৮৩]

“অতঃপর মূসা মনে মনে কিছুটা ভীতি অনুভব করলেন” [সুরা ত্ব-হা:৬৭]

তারা কারাবন্দী হওয়ার ভয়ে ভীতহয়েছিলেন।

“ফির’আউন বলল, তুমি যদি আমার পরিবর্তে অন্যকে উপাস্যরূপে গ্রহণ কর তবে আমি অবশ্যই তোমাকে কারাগারে নিক্ষেপ করব” [সূরা শু’আরা:২৯]

তারা অত্যাচারিত হবার আশঙ্কাকরছিলেন,

“ফির’আউন বলল: … আমি অবশ্যই তোমাদের হস্তপদ বিপরীত দিক থেকে কর্তন করব এবং আমি তোমাদেরকে খেজুর বৃক্ষের কান্ডে শূলে চড়াব …” [সূরা ত্ব-হা:৭১]

তাদের মধ্যে মৃত্যুভয় ছিল, 

“নিঃসন্দেহে ফির’আউন তার দেশে উদ্ধত হয়েছিল এবং সে দেশবাসীকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে তাদের একটি দলকে দূর্বল করে দিয়েছিল। সে তাদের পুত্র-সন্তানদেরকে হত্যা করত এবং নারীদেরকে জীবিত রাখত …” [সূরা কাসাস:৪]

ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে। FBI কিংবা MI5 এর মত গোয়েন্দাসংস্থাগুলো আজ যা করে বেড়াচ্ছে সেগুলোর প্রত্যেকটি কাজের হুমকি আগেও ছিল, এখনো আছে, তবে সত্যি বলতে কি আমাদের সময়টা তুলনামূলক সহজ। চরম আতঙ্কের পরিস্থিতিতে, ফির’আউনের হাতে ভীষণভাবে অত্যাচারিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও আমরা মূসা (আ) কে জালিমের গড়া ত্রাসের দেয়াল ভেঙে বেরিয়ে আসতে দেখেছি। তাঁর সাথে আজকের আংকেল টমদের পার্থক্য এই যে, তিনি তাঁর ভয়কে জয় করার জন্য মনঃস্থির করেছিলেন, আল্লাহর সাহায্যের উপর নির্ভর করেছিলেন এবং তাঁর সাধ্যে যা ছিল তা করেছিলেন। তাই আল্লাহও তাঁর জন্য সমুদ্রকে দু’ভাগ করে তাঁকে সাহায্য করেছিলেন।

তিনি তাঁর সিদ্ধান্তে ছিলেন দৃঢ়। তাঁর মতো যারা ছিলেন তাদের জন্যও অন্ধকার সমুদ্র সেদিন দু’ভাগ হয়ে গিয়েছিল। সিয়ার আ’লাম আল-নুবালা (১০/২৫৭) এ বর্ণিত আছে, নিজের দ্বীন বিক্রি করতে অস্বীকৃতি জানানোর ‘অপরাধে’ কারাবন্দী ইমাম আহমদের সাথে সাক্ষাৎ করতে আসেন আল-মাওয়ারদি। আল-মাওয়ারদি ইমাম আহমদকে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে অনুরোধ করেন। ইমাম আহমদ তাকে বললেন কারাগার থেকে বের হয়ে অমুক জায়গায় যাও এবং ফিরে এসে আমাকে জানাও তুমি কী দেখেছ। আল-মাওয়ারদি সেখানে গেলেন এবং দেখলেন, সেখানে যেন এক সাগর পরিমাণ মানুষ কাগজ-কলম হাতে বসে আছে। তিনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন তোমরা কী করছো ? তারা উত্তর দিল, আমরা ইমাম আহমদ কী বলেন আমরা সেটা শুনার জন্য অপেক্ষা করছি। তিনি যা বলবেন আমরা সেগুলো লিখে রাখবো। আল-মাওয়ারদি ফিরে এলেন এবং তিনি যা দেখে এসেছেন তা ইমাম আহমদকে জানালেন। ইমাম আহমদ কারাগারে তাঁর কক্ষ থেকে মুখ ঘুরিয়ে বললেন, তুমি কি চাও আমি এই লোকগুলোকে বিপথে পরিচালিত করি? তিন বছর কারাগারে থাকার পর ইমাম আহমদকে জেল থেকে মুক্তি দেয়া হয়।

যিনি সত্যিকারের একজন ‘আলিম, একজন মু’মিন, তিনি তার ব্যক্তিগত আরাম-আয়েশের উপরে সত্যকে অগ্রাধিকার দেন। যখন রাসূল ﷺ আবু বকর (রাঃ) কে সাথে নিয়ে গুহাতে বন্দী ছিলেন, আপনাদের কি মনে আছে তিনি আবু বকরকে কী বলেছিলেন ? তিনি বলেননি, আবু বকর ভয় কোরো না। বরং তিনি বলেছিলেন, “আবু বকর, মন খারাপ কোরো না”, কারণ আবু বকর তার নিজ জীবনের ভয় করেননি। বরং তিনি দেখছিলেন যদি তারা মুশরিকদের হাতে মারা যান তবে ইসলামের এই আহবান, ইসলামের এই দা’ওয়াহ থেমে যেতে পারে। আবু বকর খুব ভালো করে জানতেন, ইসলামের দিকে আহবান করলে তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়তে পারে। এ দুটো ব্যাপার অবিচ্ছেদ্য।

ইসলামী দা’ওয়াহর এটিই একমাত্র পথ। কেউ যদি কোনো প্রকার কাটা-ছেঁড়া ব্যতিরেকে নবীদের দা’ওয়াহকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেবার ব্যাপারে আন্তরিকভাবে আগ্রহী হয় এবং একইসাথে সে একটা উপভোগ্য ও নির্বিঘ্ন জীবনের স্বপ্ন দেখে, তাহলে সে ভ্রান্তির জগতে বসবাস করছে। আপনাকে মানসিকভাবে শক্ত হতে হবে। আরাম-আয়েশের গণ্ডি থেকে বের হয়ে আসতে হবে, যত যাই কিছুর মুখোমুখি হতে হোক না কেন। ইতস্তত বোধ করবেন না। ভয় যেন আপনাকে পেছনে টেনে না রাখে।

আশা করবো, উপরের আয়াতগুলো নিয়ে খুব মন দিয়ে আপনারা চিন্তা ভাবনা করবেন এবং আয়াতের শিক্ষাগুলোকে নিজের জীবনে প্রয়োগ করবেন। আমাদের কথায় ও লেখায় যেন আমরা মাথা উঁচু করে নিজেদের প্রকাশ করতে পারি।


বইঃ কখনও ঝরে যেও না

-তারিক মেহান্না

প্রকাশক: সীরাত পাবলিকেশন

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

২টি মন্তব্য

  1. সত্যিই আজ মুসলিম উম্মাহ তৎকালীন মুসা (আঃ)এর বনী ইসরায়িল কওমের মতো হয়ে পড়েছে।আর জুলুমের হাত থেকে এই উম্মাহ কে রক্ষা করার জন্য আমাদেরকে মুসা (আঃ)এর মতো আল্লাহর উপর ভরসা করে ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে বিশ্বের পরাশক্তি গুলির ভীত নাড়িয়ে দিতে হবে,যাতে তারা এটা বোঝে যে,ইসলাম ফেরাউনের সময় যেমন ছিল আজ জালেমদের বিরুদ্ধেও ঠিক একইরকম আছে।

মন্তব্য করুন

Back to top button