দাওয়াত ও জিহাদবিদআত ও কুসংস্কারসচেতনতা

শায়েখ ইলিয়াছ (রহিমাহুল্লাহ)-র তাবলীগ জামাতঃ একটি পর্যালোচনা

তাবলীগ জামাআতের চলমান অবস্থার প্রেক্ষিতে ছোটবেলা থেকেই তাবলীগ জামাআতের সাথে যুক্ত একজন মুহতারাম ভাইয়ের পর্যালোচনাটি পড়া আবশ্যক মনে হল। এবিষয়ে আমার নিজের লিখার আগে কিছু বিষয়ে সংক্ষেপে সঠিক ধারণার জন্য লিখাটি উপকারি হবে ইন-শা-আল্লাহ।

শায়েখ ইলিয়াছ (রহিমাহুল্লাহ)-র তাবলীগ জামাতঃ একটি পর্যালোচনা

কেন তাবলীগ জামা’আত ‘ফি-সাবিলিল্লাহ’ অর্থাৎ ‘আল্লাহর রাস্তা’ পরিভাষাটি দাওয়াতের ময়দানে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করে?

কখনো কি দেখেছেন জিহাদের গুরুত্ব-ফযিলত বলতে গিয়ে কেউ দাওয়াতের ‘আয়াত’ ‘হাদীস’ ব্যবহার করেছে? অথবা কেউ কি জিহাদে বের করার জন্য দাওয়াত সম্পর্কিত ঘটনাগুলো টেনে এনেছে? করেনি, করার প্রয়োজনও পড়েনি। কারণ জিহাদের জন্য বহু আয়াত, হাদিস, ইতিহাস রয়েছে। সাড়ে চারশোর উপরে শুধু কুরআনের আয়াতই আছে এর উপর। কিন্তু কেন আজ দাওয়াতের কাজে বের করার জন্য জিহাদের ‘আয়াত’ ‘হাদীস’ ‘ইতিহাস’ প্রয়োগ করার প্রয়োজন পড়লো? দাওয়াতের কাজে বের করার জন্য কী আলাদা কোনো দলিল নেই? হ্যাঁ আছে। তবে কেন ওগুলো ব্যবহার হচ্ছে? এটা বুঝতে হলে প্রথমে তাবলীগ জামাআতের মাইন্ডসেট বুঝতে হবে।

মাওলানা ইলিয়াস (রহিমাহুল্লাহ) বলেছিলেন, “আমি ওই দিনের অপেক্ষায় আছি যেদিন মসজিদ থেকে জিহাদের জন্য মুজাহিদ বাহিনী যাত্রা করবে”।

এই উদ্দেশ্যেই মূলত মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) এই মেহনত শুরু করেছিলেন। যাতে মুসলিমরা হারানো ঈমান আমল ফিরে পায়, এবং এর মাধ্যমে আবারো সেই অপরাজেয় যোদ্ধা জাতিতে পরিণত হয়ে দ্বীনকে বিজয়ী করতে পারে। [তাবলীগের আলমী শুরার অন্যতম মুরুব্বি মরহুম ইঞ্জিনিয়ার হাজী আবদুল মুকীত সাহেব রহ. সহ তাবলীগের অন্যান্য পুরোন মুরুব্বিদেরকেও আমি নিজ কানে বলতে শুনেছি ছোট বেলায়— ‘প্রত্যেক মুসলমানকে অবশ্যই চারটি বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে হবে— ১. মুতাআল্লিম, ২. মুআ’ল্লিম, ৩. মুবাল্লিগ, ৪. মুজাহিদ (এটা এখন কেন যেন আর শুনি না!) – সংকলক]

কিন্তু আফসোসের ব্যাপার হচ্ছে তা হয়নি। তিনি মালফুযাতে যে আশংকা করেছিলেন সেটাই বাস্তবায়িত হয়েছে। ফিতনায় পরিণত হয়েছে। কিন্তু কিভাবে?

এসব বোঝার জন্য আসুন প্রথমে একটু ইতিহাস থেকে ঘুরে আসি, সংক্ষেপে।

রাসূলের ﷺ নবুয়তের প্রথম দিকে বা প্রথমদিকের ইসলাম গ্রহণকারী সাহাবায়ে কিরামের (রদিআল্লাহু আ’নহুম) সময় মক্কায় দাওয়াত দেয়ার জন্য কোনো জামাআতবদ্ধ গ্রুপ ছিলো না। যারা সীরাত পড়েছেন এটা তারা ভালো করে জানার কথা। প্রথম দিকে ইনফিরাদি দাওয়াত ছিলো গোপনে। আল্লাহর আদেশে পরে হয় প্রকাশ্যে। তবে সেটাও ইনফিরাদি, ইজতিমায়ী নয়। কোনো সুনির্দিষ্ট উসূলের ভিত্তিতেও নয়। তাবলীগী ভাইয়েরা নিজেদের কাজকে মাক্কী জীবনের সাথে তুলনা করে থাকেন। উনারা যেভাবে গাশত করে থাকেন, অর্থাৎ কাতার ধরে একটা দল মানুষের কাছে যাবে। তাদের মধ্যে একজন আমীর থাকবে, যিনি জামাআত পরিচালনা করবে। কয়েকজন মামুর থাকবে, যারা জিকিরে ফিকিরে চলবে আর দু’আ করতে থাকবে, কোনো কথা বলবে না। একজন মুতাকাল্লিম থাকবেন, ইনিই শুধু দাওয়াত দিবেন, মানুষের সাথে কথা বলবেন। আর একজন রাহবার থাকবেন যিনি মানুষের কাছে এই গাশতের জামাআতকে নিয়ে যাবেন। কিন্তু এই দাওয়াতী সিস্টেম মাক্কী জীবনে দূরে থাক মাদানী জীবনেও ছিলোনা।

মাদানী জীবনে গোত্র ভিত্তিক ‘তরবারির মাধ্যমে’ দাওয়াত দেয়া হতো। প্রথমে কোনো গোত্রকে ইসলামের দিকে আহবান করা হতো। তারা ইসলাম মেনে না নিলে তাদেরকে বশ্যতা স্বীকার করে জিজিয়া দিয়ে তাদের জান-মালের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে বলা হতো। এতেও সাড়া না দিলে তাদের সাথে যুদ্ধ করে তাদেরকে পদানত করা হতো। কিন্তু তাদের জোর করে ধর্মান্তরিত না করে সক্ষমদের উপর মাথাপিছু কর (জিজিয়া) ধরা হতো। এটা ধরা হতো আল্লাহর হুকুম হিসেবে, তাদের নিরাপত্তা দেয়ার বিপরীতে এবং ইসলাম যাতে বিজয়ী হিসেবে উর্ধ্বে থাকে সেটা নিশ্চিত করতে। যেমন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন “আমাকে মানুষের সাথে যুদ্ধের করার আদেশ দেয়া হয়েছে যতক্ষণ না তারা এই সাক্ষ্য দিবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং আমি (মুহাম্মদ) আল্লাহর রাসূল এবং নামায প্রতিষ্ঠা করে ও যাকাত দেয়। যখন তারা এই কাজগুলো সম্পাদন করবে তখন তারা আমার হাত থেকে নিজেদের জান ও মাল নিরাপদ করে নিল।” আর যদি তা না করে তাহলে, “তোমরা যুদ্ধ কর আহলে-কিতাবের ঐ লোকদের সাথে, যারা আল্লাহ ও রোজ হাশরে ঈমান রাখে না, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যা হারাম করে দিয়েছেন তা হারাম করে না এবং গ্রহণ করে না সত্য দ্বীন, অথবা যতক্ষণ না করজোড়ে তারা জিযিয়া প্রদান করে। [সূরা আত তাওবাহ, ৯: ২৯]

অর্থাৎ তিনটি অপশন ছিলো, ইসলাম কবুল, নয়তো জিজিয়া, নয়তো মৃত্যু (যুদ্ধ)। এভাবে কিছু লোক মুসলিম হতো। বাকিরা হতো জিজিয়া প্রদানকারী কাফির-মুশরিক। তারা মুসলিম শাসনের অধীনে জীবন যাপন করতে থাকতো। সেখানে খুতবা, বক্তৃতা ইত্যাদির মাধ্যমের দাওয়াত পেত। মুসলিমদের সাথে চলাফেরা করতে করতে মুসলিমদের এক রব্বের ইবাদাত, আখলাক, আল্লাহ ভীতি, মুয়ামালাত-মুয়াশারাত, দুনিয়াবিমুখতা, আখিরাতমুখিতা আর ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়ে তারা ইসলাম গ্রহণ করতো। [যেমনটা আজ কাফের-মুশরিকদের দেশে বসবাসকারী মুসলমানদের পরিণতি। তারা সেখানে কাফেরদেরকে ট্যাক্স দিয়ে বসবাস করছে। আর তাদের শিক্ষা, সংস্কৃতি, আইন ও আদর্শে প্রভাবিত হয়ে তাদের বাতিল মতাদর্শ গ্রহণ করছে। ধর্মান্তরিত হয়ে তাদের মত উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখছে। হিসেব পুরোই উল্টে গেছে। কারণ, মানুষ সাধারণত পরাজিত আর দুর্বলদের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয় না। চাই তা সত্যই হোক না কেন। একারণেই আল্লাহর হুকুম হল— ইসলামকে সকল ধর্মের উপর বিজয়ী ধর্মরূপে প্রতিষ্ঠিত করা।

هو الذي أرسل رسوله بالهدى ودين الحق ليظهره على الدين كله ولو كره المشركون

এই আয়াতের শেষাংশে আল্লাহ পাক কাফেরদের মূল চরিত্রটা উন্মোচন করেছেন যে, তারা ইসলামের সব মানতে পারে, কিন্তু ইসলামকে বিজয়ী ধর্মরূপে দেখাটা তারা কখনই মানতে পারেনা। আর জিহাদের মাক্বসাদ ও উদ্দেশ্য এটাই যে, কুফর ও কুফফারদের প্রভাব-প্রতিপত্তিকে চূর্ণ করে দেয়া। কারণ, বাতিলের এই প্রভাব-প্রতিপত্তিটাই মানুষের দলে দলে ইসলাম গ্রহণের পথে সবচে’ বড় বাঁধা। অথচ বর্তমানে তাবলীগের একদল মুরুব্বিদের মানসিকতাই এটা হয়ে গেছে যে, যেকোন দেশে দাওয়াতের অনুমতি মিললেই সেখানে জিহাদের আর কোনো বৈধতা থাকেনা। নাঊযুবিল্লাহ। – সংকলক] আর বিভিন্ন আলিম-আল্লাহওয়ালাদের সাহচর্যে, তালীমের মাধ্যমে ইসলাহী জীবন গঠন করতো। আর তাযকিয়া হতো মূলত জিহাদের মাধ্যমেই। এভাবেই সাড়া দুনিয়াতে ইসলাম ছড়িয়ে পড়তো। কারো প্রয়োজন হলে “সীরাত ইবনে হিশাম” আর “আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া” পড়ে দেখতে পারেন। এই ইতিহাসই পাবেন।

তাহলে প্রশ্ন হলো, এই গাশত পদ্ধতি নেয়া হলো কোথা থেকে? তারা কি নিজেরা আবিষ্কার করেছেন? না। কিছুটা নিজেরা আবিষ্কার করেছে। কিছুটা সাহাবাদের (রা) জিহাদী জামাআতের নমুনা থেকে আমদানি করেছে। আপনারা লক্ষ্য করলে দেখবেন তাবলীগ জামায়াতের কিছু কিছু কাজ জিহাদী জামায়াতের সাথে মিলে যায়। যেমন –

১. জিহাদ জামাআতবদ্ধ আমাল। তাবলীগী জামাআতের মেহনতও জামাআত বদ্ধ আমাল। এটা জিহাদের জামাআতব্ধতা থেকে নেয়া হয়েছে।
.
২. জিহাদি জামাআতে যেমন একজন আমীর থাকতে হয়, তাবলীগী জামাআতেও একজন আমীর থাকতে হয়। এটাও জিহাদের জামাআত থেকে নেয়া হয়েছে।
.
৩. গাশতে দাওয়াত দেয়ার জন্য যেভাবে লাইন ধরে যাওয়া হয়, এটা মূলত সামরিক বাহিনীর অভিযানে যাওয়া থেকে নেয়া। যোদ্ধারা এভাবেই লাইন ধরে অভিযানে যায়, ফিরে আসে। সেখানে একজন আমীর থাকে। রাহবার থাকে।
.
৪. মাশওয়ারা বা পরামর্শের সময় গোল হয়ে বসাটাও জিহাদের জামাআত থেকে নেয়া। মাশওয়ার সময় তারা বলেও দেয়, ‘এটা এজন্য যে, যাতে শত্রুবাহিনী আসলে জামাআতের কেউ একজন দেখতে পায়’।
.
৫. জিহাদের জন্য পাঁচ কাজ করতে হয়। রাসূল (সা) বলেছেন, “আমি তোমাদের পাঁচটি কাজের জন্য আদেশ করছি। যে পাঁচটি কাজের জন্য আল্লাহ আমাকে আদেশ করেছেন। তোমরা জামাআতবদ্ধ হবে, এক আমীরের কথা শুনবে, এক আমীরের কথা মানবে, হিজরত করবে, ও জিহাদ করবে”। [আল হারিস আল আশয়ারী (রাঃ) থেকে, আহমাদ, তিরমিযি – বাব উল ইমারাহ, মিশকাত। হাদীসের মান সাহীহ] এটা থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে তারাও পাঁচকাজ আবিষ্কার করেছেন। তবে অন্যভাবে।
.
৬. আমীরকে মান্য করতে তারা ব্যাপক জোর দিয়ে থাকে। যেমন কোনো বাহিনীর কমান্ডারকে মান্য করতে হয়।
.
৭. উসূল ভঙ্গ না করার প্রতি প্রচুর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। যেমন সামরিক বাহিনীতে শৃঙ্খলার রক্ষার প্রতি কঠোর নজর রাখা হয়।

এরকম আরো আছে যেগুলো মূলত জিহাদি জামাআতের পদ্ধতি থেকে নেয়া। আর এজন্য জামাআত পাহারা দেয়াকে এরা জিহাদের ভূমিতে বা ইসলামী সম্রাজ্যের সীমানা পাহারা দেয়ার মত ‘রিবাত’-এর আমল হিসেবে গণ্য করে। এজন্যই রিবাতের ফযিলতগুলো জামাআত পাহারা বা সামানা পাহারার সাথে লাগায়। বিভিন্ন জিহাদের অভিযানগুলোকে দাওয়াতের জামাআত হিসেবে বয়ান করে। যেমন আবু আইয়্যুব আনসারীর (রদিআল্লাহু আনহু) ইস্তাম্বুলের সমাধিত হওয়ার ঘটনাকে ‘তাদের আল্লাহর রাস্তায়’ বের হওয়ার গুরুত্ব হিসেবে বর্ণনা করে। কাব বিন মালিকের (রদিআল্লাহু আনহু) জিহাদের বের না হওয়াকে জামাআতে না বের হওয়ার ক্ষেত্রে ব্যবহার করে। এরকম আরো অনেক আছে। আর এসবের জন্যই তারা তাদের কাজকে জিহাদের সাথে তুলনা করে। এটার সাথে ‘আল্লাহর রাস্তা’ বা ‘ফিসাবিলিল্লাহ’ ব্যাপকভাবে ব্যবহার করে।

এটা এত ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছে যে, এখন কাউকে আল্লাহর রাস্তা শব্দটা বললেই মনে করে ‘তাবলীগ জামাআত’। যেভাবে সাহাবায়ে কিরামের (রদিআল্লাহু আনহুম) সময় ফিসাবিলিল্লাহর দিকে আহবান করলেই সবাই তরবারি/যুদ্ধের সরঞ্জাম নিয়ে হাজির হয়ে যেতেন। তারা তাদের কাজকে ‘সাহাবায়ে কিরামের (রদিআল্লাহু আনহুম) নকল হরকত’ বলে থাকে। কারণ সাহাবায়ে কিরামের (রদিআল্লাহু আনহুম) ‘দাওয়াত ও জিহাদ’-এর কর্মকান্ডের সাথে উপরে উল্লেখিত পয়েন্টগুলো কিছুটা মিলে যায়। কিন্তু তাদের সিস্টেমটা কোনো রকম নকল করলেও কাজগুলো নকল করতে পারেনি। যেখানে সাহাবায়ে কিরামের (রদিআল্লাহু আনহুম) আমল ছিলো দাওয়াত ও জিহাদের পূর্ণাঙ্গ রূপ, সেখানে তারা সিস্টেমটা কিছুটা ঠিক রেখে রাষ্ট্রীয়/জিহাদের দিকটা বাদ দিয়ে শুধু নিয়েছেন দাওয়াতের দিকটা। তারা ভুলে গিয়েছে ‘জিহাদ হলো সর্বোত্তম দাওয়াত। কিন্তু তাদের দাওয়াতটাও অপূর্ণাঙ্গ। এই দাওয়াতে ‘তাওহীদ আল হাকিমিয়্যাহ’ অনুপস্থিত। কারণ এটা বললে শাসকবর্গ ক্ষেপে যাবে। যেহেতু সামরিক দিকটা ছাটাই করে দিয়েছে, তাদের তো আর প্রতিরোধ করার ক্ষমতা নেই।

তাই তাওহীদ আল হাকিমিয়্যাহ বাদ দিয়ে একটি ‘সেক্যুলার ধর্ম’ প্রচারের জামাআতের আত্মপ্রকাশ ঘটিয়েছে। যেভাবে সেক্যুলার রাষ্টব্যবস্থায় ধর্মের নাক গলানো নিষিদ্ধ, তেমনি তাদের সেক্যুলার ধর্মে রাষ্ট্রব্যবস্থা নিয়ে নাক গলানো নিষিদ্ধ। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের বিপরীতে রাষ্ট্র নিরপেক্ষ ধর্ম। কিন্তু তাদের এই আংশিক দাওয়াতি মিশনে জিহাদের আয়াত-হাদীসের ইবারতগুলো ঠিক রেখে, সেগুলো তাওয়ীল-তাহরীফ করে, জিহাদের পারিভাষিক অর্থ ‘লড়াই’কে বাদ দিয়ে শাব্দিক অর্থের ভিত্তিতে ‘মেহনত’ শব্দ যোগ করে তাদের নিরস্ত্র জিহাদের সাথে রেখে দিয়েছে, যাতে এটাকে শারঈ জিহাদ বলতে পারে। আর এটাকে মুসলিমদের ইসলাহের সাথে বেশি সংযুক্ত রেখেছে। অর্থাৎ এটা মুসলিমদের ইসলাহের নাসীহাহ বা দাওয়াত। যেখানে কুফফারদের উপর হামলা করার পূর্বে দাওয়াত দেয়া মুস্তাহাব, সেখানে মুসলিমদের সংস্কারের দিকে দাওয়াত দেয়াকে বানিয়েছে ‘ফরজ’।

সর্বোপরি সাহাবায়ে কিরামের (রদিআল্লাহু আনহুম) সশস্ত্র জিহাদি কাফেলার নকশাকে এরা ‘নিরস্ত্র জিহাদী’ কাফেলার নকশা বানিয়ে দিয়েছে। এর ফলাফল যা হয়েছে, কিছু খারাপ মানুষ হয়তো ভালো মানুষে পরিণত হয়েছে। তার সাথে একটি ‘নিরস্ত্র জিহাদি’ যুব সমাজ তৈরি হয়েছে। যারা নিজেরদেরকে সাহাবীদের (রদিআল্লাহু আনহুম) মত ‘আল্লাহর রাস্তা’ বা ‘ফিসাবিলিল্লাহ’য় নিজেদের জান-মাল-সময় ব্যয় করছে বলে আত্মপ্রশান্তিতে জীবন পার করে, প্রকৃত ‘ফিসাবিলিল্লাহ’র অনুসারীদেরকে তিরস্কার করছে।

আরো হাস্যকর ব্যাপার হলো, তারা মনে করে বর্তমানে যারা গোলাবারুদ দিয়ে জিহাদ করছে তারা শুধু শুধু বোকামি করছে। এসব একসময় শেষ হয়ে যাবে, তখন তারা ইমাম মাহদী অধীনে তরবারি নিয়ে জিহাদ করবেন। তারা বলে তারাই নাকি ইমাম মাহদী আসলে সবার আগে জিহাদে যাবে। তারাই হবে ইমাম মাহদীর মূল সৈনিক। এজন্য তারা তাদের ‘সর্বোচ্চ হজরতজী’র আসন খালি রাখে। এখন তারা ওই জিহাদের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এজন্য তাদের কিছু মুরুব্বী প্রতিবছর রামাদানে-হজ্বে ইমাম মাহদীর তালাশে মক্কায় যায়।

এটা আমার বানানো গালগপ্পো নয়। তাদের মুরুব্বীদের কাছে থেকেই জেনেছি, দীর্ঘদিন তাদের পিছে ঘোরার কারণে। কিন্তু তারা জানে না যে, তারা নিজেরাই এখন একটা ফিতনায় পরিণত হয়েছে। যারা প্রতিনিয়ত শারীয়াহর বিভিন্ন পরিভাষা বিকৃত করে চলেছে, অপপ্রয়োগ করে চলেছে। যেমনটা মাওলানা ইলিয়াস (রাহিমাহুল্লাহ) এটা তৈরি করার সময় আশংকা করেছিলেন। এবং তার স্বপ্ন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। এসব এখন উলামারাও বলা শুরু করেছেন।

জনৈক শাইখের (ফা.আ.) ভাষায়, “পাঠা তোলাইলে যেমন খাসি হয়ে যায়, তেমন একটি খাসি প্রজন্ম গড়ে উঠছে এদের দ্বারা”। অর্থাৎ সশস্ত্র জিহাদের দিকে নিরুৎসাহি, মৃত্যু ভয়ে ভীত, সেক্যুলার ইসলামের অনুসারী একটি ‘ফার্মের মুরগি প্রজন্ম’ গড়ে তুলতে তারা সক্ষম হয়েছে।

বিঃদ্রঃ এটা আমার দীর্ঘদিনের পর্যালোচনা, তাদের কিতাবাদি পড়াশোনা, তাদের সাথে দীর্ঘ সময় দেয়ার পর, অভিজ্ঞাতা থেকে লিখেছি। অনুগ্রহ করে এখানে কেউ ‘অমুক তাবলীগী জিহাদী মানহাজের’ বলতে আইসেন না। যারা তাবলীগ থেকে জিহাদী হয়েছেন, তারা তাবলীগ থেকে জিহাদের তালীম পায়নি। বরং জিহাদীদের নিরলস পরিশ্রমের কারণে কিছু তাবলীগী ভাইকে আল্লাহ বুঝ দিয়েছেন। বাকি যারা আছে তারা ওখানেই পড়ে আছে। আর এটা শুধু তাবলীগ থেকে না, শিবির, আহলে-হাদীস, বেরলভী থেকেও আছে। এই কারণে তাদের পুরো জামাআত হক্বের উপর উঠে যায়নি।

আল্লাহ আমাদের দ্বীনের সহীহ বুঝ দান করুন। আমিন।


লিখেছেন : তানভীর আহমেদ (আল্লাহ্‌ তাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন)

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

৩টি মন্তব্য

  1. আলহামদুলিল্লাহ, তথ্যবহুল সংক্ষিপ্ত আলোচনা। আপনাকে ধন্যবাদ। নিজের জন্য ও তাদের জন্য দোয়া করতে হবে সঠিক ও হেদায়েতের। আল্লাহ আমাদেরকে সঠিক জ্ঞান দান করুন।

মন্তব্য করুন

Back to top button