দাওয়াত ও জিহাদ

জিহাদ কোন ধরনের ফরয? কাদের উপর এবং কখন ফরয?

জিহাদ কোন ধরনের ফরয?

‘জিহাদ’ সকলের জন্য সর্বাবস্থায় ‘ফরযে আয়েন’ না জানাযার ছালাতের ন্যায় ‘ফরযে কিফায়াহ’ এ বিষয়ে বিদ্বানগণ মতভেদ করেছেন। সাঈদ ইবনুল মুসাইয়িব বলেন, জিহাদ প্রত্যেক মুসলমানের উপরে সব সময়ের জন্য ফরয। ইবনু আত্বিইয়াহ বলেন, এ বিষয়ে উম্মতের ‘ইজমা’ বা ঐক্যমত রয়েছে যে, উম্মতে মুহাম্মাদীর উপর জিহাদ ‘ফরযে কিফায়াহ’। তাদের কোন দল উক্ত দায়িত্ব পালন করলে বাকীদের উপর থেকে দায়িত্ব নেমে যায়। তবে যখন শত্রু ইসলামী খেলাফতের সীমানায় অবতরণ করে, তখন প্রত্যেক মুসলমানের উপরে জিহাদ ‘ফরযে আয়েন’ হয়ে যায়।[1] আত্বা ও ছাওরী বলেন, ‘জিহাদ’ ইচ্ছাধীন বিষয়। তাঁরা সূরা নিসা ৯৫ আয়াত থেকে দলীল গ্রহণ করেন। যেখানে জিহাদকারী ও বসে থাকা সকল মুমিনকে জান্নাতের সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে। যুহরী ও আওযাঈ বলেন, আল্লাহ জিহাদকে সকল মুসলমানের উপরে ফরয করেছেন, তারা যুদ্ধ করুক কিংবা বসে থাকুক। যে ব্যক্তি যুদ্ধ করল, সে যথার্থ করল ও আশীষপ্রাপ্ত হ’ল। আর যে ব্যক্তি বসে রইল, সেও গণনার মধ্যে রইল। যদি তার নিকটে সাহায্য চাওয়া হয়, তাহ’লে সে সাহায্য করবে। আর যদি যুদ্ধে বের হওয়ার আহবান করা হয়, তাহ’লে যুদ্ধে বের হবে। আর যদি তাকে আহবান না করা হয়, তাহ’লে বসে থাকবে।[2]

ইবনু কাছীর শেষোক্ত মতকে সমর্থন করে বলেন, সেকারণেই ছহীহ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে যে, ‘যে ব্যক্তি মারা গেল, অথচ জিহাদ করল না। এমনকি জিহাদের কথা মনেও আনলো না, সে ব্যক্তি মুনাফেকীর একটি শাখার উপর মৃত্যুবরণ করল’।[3] অনুরূপভাবে মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ঘোষণা করেন, ‘মক্কা বিজয়ের পরে আর হিজরত নেই। কিন্তু জিহাদ ও তার নিয়ত বাকী রইল। যখন তোমাদেরকে জিহাদের জন্য আহবান করা হবে, তখন তোমরা বের হবে’।[4] আল্লাহ বলেন, ‘আর সমস্ত মুমিনের জন্য জিহাদে বের হওয়া সঙ্গত নয়। অতএব তাদের প্রত্যেক দলের একটি অংশ দ্বীনের জ্ঞান অর্জনের জন্য কেন বের হ’ল না? যাতে তারা ফিরে এসে স্ব স্ব গোত্রকে সতর্ক করতে পারে এবং তারা নিজেরাও বাঁচতে পারে? (তওবাহ ৯/১২২)।

হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হোযায়েল গোত্রের লেহইয়ান শাখার বিরুদ্ধে একটি সেনাদল পাঠানোর সময় বলেন, প্রতি দু’জনের মধ্যে একজনকে পাঠাবে। কিন্তু নেকী দু’জনের মধ্যে ভাগ হবে’।[5] তাবুক যুদ্ধ থেকে ফিরে মদীনার উপকন্ঠে পৌঁছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, নিশ্চয়ই মদীনাতে এমন কিছু লোক রয়েছে যারা তোমাদের সঙ্গে অভিযানে বের হয়নি বা কোন ময়দান অতি।ম করেনি। অথচ তারা তোমাদের ন্যায় নেকীর অধিকারী। ছাহাবীগণ বললেন, এরূপ লোক কি মদীনাতে আছে? রাসূল (ছাঃ) বললেন, হ্যাঁ, তারা মদীনাতেই আছে। বিভিন্ন ওযর তাদেরকে আটকে রেখেছিল।[6] সাইয়িদ সাবিক্ব বলেন, এর কারণ এই যে, যদি জিহাদ প্রত্যেকের উপরে ফরয করা হ’ত তাহ’লে মানুষের দুনিয়াবী শৃংখলা বিনষ্ট হয়ে যেত। অতএব জিহাদ কিছু লোকের উপরেই মাত্র ওয়াজিব, সবার উপরে নয়।[7]

ছহীহ বুখারীর সর্বশেষ ভাষ্যকার আহমাদ ইবনু হাজার আসক্বালানী (৭৭৩-৮৫২ হিঃ) বলেন, ‘রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পরে জিহাদ ‘ফরযে কিফায়াহ’ হওয়ার মতামতই প্রসিদ্ধ রয়েছে। … তবে যখন শত্রু ঘেরাও করে ফেলবে তখন ব্যতীত এবং শাসক যখন কাউকে জিহাদে বের হবার আদেশ করবেন তখন ব্যতীত। তিনি বলেন, স্বতঃসিদ্ধ কথা এই যে, কাফিরের বিরুদ্ধে জিহাদ প্রত্যেক মুসলমানের উপর নির্ধারিত। চাই সেটা হাত দিয়ে হৌক বা যবান দিয়ে হৌক বা মাল দিয়ে হৌক কিংবা অন্তর দিয়ে হৌক’।[8] ইমাম শাওকানীও এ কথা বলেন।[9]

উপরের আলোচনায় পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, ঈমান, ত্বাহারৎ, ছালাত ও ছিয়ামের ন্যায় ‘জিহাদ’ প্রত্যেক মুমিনের উপরে সর্বাবস্থায় ‘ফরয আয়েন’ নয়। বরং আযান, জামা‘আত, জানাযা ইত্যাদির ন্যায় ‘ফরযে কিফায়াহ’। যা উম্মতের কেউ আদায় করলে অন্যদের জন্য যথেষ্ট হয়ে যায়। না করলে সবাই গোনাহগার হয়।

এতে বুঝা যায় যে, সশস্ত্র জিহাদ ফরযে কিফায়াহ হ’লেও যবান ও অন্তরের জিহাদ মুমিনের উপর সর্বাবস্থায় ‘ফরযে আয়েন’

ফরযে কিফায়াহ : যা চার প্রকার।-

(১) দ্বীনী ফরয : যেমন দ্বীনী ইলম শিক্ষা করা, ইসলামের সত্যতার বিরুদ্ধে সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টির প্রতিবাদ করা, জানাযার ছালাত আদায় করা, ছালাতের জন্য আযান দেওয়া, জামা‘আত কায়েম করা ইত্যাদি।

(২) জীবিকা অর্জনের ফরয : যেমন কৃষিকাজ, শিল্পকর্ম, ব্যবসা-বাণিজ্য, চিকিৎসা বা অনুরূপ শিক্ষা ও উপায়-উপাদানসমূহ অর্জন করা। যা না করলে মানুষের দ্বীন ও দুনিয়া দু’টিই হুমকির মুখে পড়ার সম্ভাবনা থাকে।

(৩) এমন ফরয, যা আদায়ের জন্য শাসকের নির্দেশ শর্ত : যেমন ‘জিহাদ’ করা, শারঈ ‘হদ’ বা দন্ডবিধি প্রয়োগ করা ইত্যাদি।৫৪ কেননা এগুলিতে শাসকের একক অধিকার রয়েছে।

(৪) এমন ফরয, যা আদায়ের জন্য শাসকের অনুমতি শর্ত নয় : যেমন সৎ কাজের আদেশ দেওয়া ও অসৎ কাজে নিষেধ করা, নেকীর কাজে মানুষকে আহবান করা ও নিকৃষ্ট কর্ম সমূহ দূর করা ইত্যাদি।

এই সমস্ত কাজ প্রত্যেক মুমিনের উপরে ‘ফরযে আয়েন’ নয়। বরং উম্মতের কেউ সম্পাদন করলে অন্যের উপর থেকে ‘ফরযিয়াত’ দূরীভূত হয়।

❑ জিহাদে পিতা-মাতা ও ঋণদাতার অনুমতি গ্রহণ :

জিহাদ যখন ‘ফরযে কিফায়াহ’ বা ইচ্ছাধীন ফরযের বিষয়ে পরিণত হবে, তখন জিহাদে যাওয়ার জন্য পিতা-মাতার অনুমতি গ্রহণ আবশ্যিক হবে। বরং এমতাবস্থায় জিহাদে গমন ঐব্যক্তির জন্য মোটেই সিদ্ধ নয়, যে ব্যক্তি স্বীয় পরিবার, সন্তান-সন্ততি ও পিতা-মাতার খিদমতের দায়িত্ব হ’তে মুক্ত হ’তে পারবে না।[29] হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রাঃ) বলেন, একদা আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম, কোন আমল আল্লাহ্র নিকটে সর্বাধিক প্রিয়? তিনি বললেন, ওয়াক্ত মত ছালাত আদায় করা (অন্য বর্ণনায় এসেছে, আউয়াল ওয়াক্তে ছালাত আদায় করা’[30])। আমি বললাম, তারপর কি? তিনি বললেন, পিতা-মাতার সেবা করা। বললাম তারপর কি? তিনি বললেন, আল্লাহ্র রাস্তায় জিহাদ করা’।[31] আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) বলেন, জনৈক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকটে এসে জিহাদে গমনের অনুমতি চাইল। রাসূল (রাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার পিতা-মাতা জীবিত আছেন কি? লোকটি বলল, হ্যাঁ। তিনি বললেন, তাহ’লে তাঁদের মাঝেই জিহাদ কর (অর্থাৎ তাঁদের সেবা-যত্নে মনোনিবেশ কর)।[32] একইভাবে ইচ্ছাধীন জিহাদে গমনের পূর্বে ঋণদাতার অনুমতি প্রয়োজন হবে। কেননা শাহাদাত সকল গোনাহের কাফফারা হ’লেও ঋণের দায়িত্ব থেকে শহীদ ব্যক্তি মুক্ত নন।[33] সাইয়িদ সাবিক্ব বলেন, এমতাবস্থায় ঋণের সঙ্গে যুক্ত হবে তার অন্যান্য যুলুম সমূহ। যেমন মানুষ খুন করা, অন্যায়ভাবে জনগণের অর্থ আত্মসাৎ করা ইত্যাদি (ফিক্বহুস সুন্নাহ ৩/৯১)।

এক্ষণে কোন্ কোন্ সময় জিহাদ প্রত্যেক মুমিনের উপরে ‘ফরযে আয়েনে’ পরিণত হয়, তা নিম্নে প্রদত্ত হ’ল।-

❑ যেসব ক্ষেত্রে জিহাদ ফরযে আয়েন :

(১) মুসলমানদের বাড়ীতে বা শহরে শত্রুবাহিনী উপস্থিত হ’লে : এই সময় সকল শহরবাসীর উপরে ফরয হ’ল ঘর থেকে বেরিয়ে এসে শত্রুকে প্রতিহত করা। আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা যুদ্ধ কর ঐসব কাফেরের বিরুদ্ধে যারা তোমাদের দুয়ারে হানা দিয়েছে। তারা তোমাদের কঠোরতা অনুভব করুক। আর জেনে রেখো আল্লাহ মুত্তাক্বীদের সাথে রয়েছেন’ (তওবাহ ৯/১২৩)। তিনি বলেন, ‘যুবক হও বৃদ্ধ হও, একাকী হও বা দলবদ্ধভাবে হও, তোমরা বেরিয়ে পড় এবং তোমাদের মাল ও জান দ্বারা আল্লাহ্র রাস্তায় জিহাদ কর। এটাই তোমাদের জন্য উত্তম, যদি তোমরা বুঝ’ (তওবাহ ৯/৪১)।

(২) শাসক যখন কাউকে যুদ্ধে বের হবার নির্দেশ দেন : ‘তোমাদের কি হয়েছে যে, যখন তোমাদেরকে আল্লাহ্র পথে জিহাদে বের হবার জন্য বলা হয়, তখন তোমরা মাটি কামড়ে পড়ে থাক। তোমরা কি আখেরাতের বদলে দুনিয়ার জীবনের উপরে তুষ্ট হয়ে গেলে? অথচ আখেরাতের তুলনায় দুনিয়াবী জীবনের উপকরণ অতীব নগণ্য’ (তওবাহ ৯/৩৮)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘মক্কা বিজয়ের পরে আর হিজরত নেই। কিন্তু জিহাদ ও নিয়ত বাকী রইল। এক্ষণে যখন তোমাদেরকে যুদ্ধে বের হবার নির্দেশ দেয়া হবে, তখন তোমরা বেরিয়ে পড়বে’।[10]

(৩) যুদ্ধের সারিতে উপস্থিত হ’লে : আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ! যখন তোমরা (কাফির) বাহিনীর মুখোমুখি হবে, তখন দৃঢ়ভাবে কায়েম থাক এবং আল্লাহকে বেশী বেশী স্মরণ কর, যাতে তোমরা সফলকাম হ’তে পার’ (আনফাল ৮/৪৫)। অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘হে ঈমানদারগণ! যখন তোমরা কাফির বাহিনীর সাথে যুদ্ধের ময়দানে মুখোমুখি হবে, তখন তাদের থেকে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করো না’ (আনফাল ৮/১৫)।

(৪) যখন কেউ বাধ্য হয় : যেমন রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘যে মুসলমান (১) তার সম্পদ রক্ষার্থে নিহত হয়, সে শহীদ (২) যে তার দ্বীন রক্ষার্থে নিহত হয়, সে শহীদ (৩) যে তার জীবন রক্ষার্থে নিহত হয়, সে শহীদ (৪) যে তার পরিবার রক্ষার্থে নিহত হয়, সে শহীদ।[11]

❑ জিহাদ কাদের উপরে ফরয ও কাদের উপরে নয় :

সুস্থ, বয়ঃপ্রাপ্ত ও জ্ঞানসম্পন্ন মুসলিম পুরুষের উপরে জিহাদ ফরয, যখন তার নিকটে পরিবারের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদের বাইরে জিহাদের জন্য প্রয়োজনীয় রসদ, সুযোগ ও সামর্থ্য থাকবে।[12] জিহাদ ফরয নয় কোন অমুসলিমের উপর, দুর্বলের উপর, নারী ও রোগীর উপর, শিশু ও পাগলের উপর। এইসব লোকদের কেউ জিহাদ থেকে দূরে থাকলেও তাদের উপর কোন দোষ বর্তাবে না। বরং জিহাদে এদের উপস্থিতি উপকারের চাইতে ক্ষতির কারণ বেশী হবে। আল্লাহ বলেন, ‘দুর্বলদের উপর, রোগীদের উপর, ব্যয়ভার বহনে অক্ষমদের উপর (জিহাদ থেকে দূরে থাকায়) কোন দোষ নেই, যখন তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি খালেছ অনুরাগ পোষণ করে’… (তওবাহ ৯/৯১)।

(ক) শিশু : আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) বলেন, ওহোদের যুদ্ধে যোগদানের জন্য আমি রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে গেলাম, তখন আমার বয়স ছিল চৌদ্দ বছর। কিন্তু তিনি আমাকে অনুমতি দিলেন না।[13] কেননা জিহাদ একটি ইবাদত, যা বয়ঃপ্রাপ্ত ব্যতীত অন্যদের উপরে ফরয নয়।[14]

(খ) নারী : হযরত আয়েশা (রাঃ) একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বললেন, হে আল্লাহ্র রাসূল! মেয়েদের জন্য কি জিহাদ নেই? রাসূল (ছাঃ) বললেন, অবশ্যই আছে। তবে সে জিহাদে ক্বিতাল নেই (অর্থাৎ পরস্পরে যুদ্ধ নেই)। সেটি হ’ল হজ্জ ও ওমরাহ’।[15] হযরত উম্মে সালামা (রাঃ) বলেন, আমি একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বললাম, হে আল্লাহ্র রাসূল! পুরুষেরা যুদ্ধ করে, অথচ আমরা করি না। সম্পত্তির অংশ বণ্টনেও আমরা পুরুষের অর্ধেক পাই। তখন নিম্নোক্ত আয়াতটি নাযিল হয়, ‘তোমরা এমন সব বিষয় আকাংখা করো না, যেসব বিষয়ে আল্লাহ তোমাদেরকে একে অপরের উপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করেছেন। পুরুষ যা অর্জন করে, সেটা তার অংশ এবং নারী যা অর্জন করে, সেটা তার অংশ। তোমরা আল্লাহ্র নিকটে অনুগ্রহ প্রার্থনা কর। নিঃসন্দেহে আল্লাহ সর্ব বিষয়ে জ্ঞাত’ (নিসা ৪/৩২)। অর্থাৎ পুরুষ ও নারীর উপার্জন তাদের নিজস্ব। তাদের যোগ্যতা ও কর্মক্ষেত্র পৃথক ও সুনির্দিষ্ট। অতএব একে অপরের কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করার আকাংখা করবে না। প্রত্যেকেই স্ব স্ব ক্ষেত্রে আন্তরিকতার সাথে দায়িত্ব পালন করলে সে পূর্ণ নেকীর হকদার হবে।[16]

নারী ও পুরুষের লিঙ্গ বৈষম্য দূর করার প্রবক্তাগণ ও তথাকথিত সাম্যের দাবীদারগণ আল্লাহ্র উক্ত বিধান মানবেন কি?

❑ জিহাদে নারীর অংশগ্রহণ :

নারীর উপর জিহাদ ফরয নয়। কিন্তু প্রয়োজনে তারাও তাতে অংশ নিতে পারে বিভিন্নভাবে সহযোগী হিসাবে। যেমন-

(১) চিকিৎসা ও অন্যান্য সেবা দান। হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, ওহোদ বিপর্যয়ের দিন আমি আয়েশা (রাঃ) ও (আমার মা) উম্মে সুলাইম (রাঃ)-কে পানির মশক পিঠে করে আহতদের নিকট গিয়ে গিয়ে পানি পান করাতে দেখেছি।[17] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, উম্মে সুলাইম ও তার সাথী আনছার মহিলাদের একটি দল যুদ্ধের ময়দানে সৈন্যদের পানি পান করিয়েছে এবং আহতদের চিকিৎসা করেছে’।[18] ওহোদ যুদ্ধে আহত রাসূল (ছাঃ)-এর যখম সমূহ কন্যা ফাতিমা (রাঃ) নিজ হাতে পরিষ্কার করেন। রক্ত বন্ধ না হওয়ায় চাটাই পোড়ানো ছাই দিয়ে তিনি তা বন্ধ করেন।[19] এছাড়াও রাসূল (ছাঃ)-এর নিহত হবার খবর শুনে মদীনা থেকে সম্মানিতা মহিলাগণ দলে দলে দৌড়ে ওহোদের ময়দানে চলে আসেন।[20] উম্মে সালীত্ব আনছারী (রাঃ) ওহোদ যুদ্ধে মুজাহিদদের জন্য পানির মশক সেলাই করে দিয়েছিলেন।[21] রুবাই‘ বিনতে মু‘আউভিয (রাঃ) বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে যুদ্ধে যেতাম এবং লোকদের পানি পান করাতাম ও তাদের খেদমত করতাম। আহত ও নিহতদের মদীনায় নিয়ে আসতাম’। ইবনু হাজার আসক্বালানী বলেন, এতে প্রমাণিত হয় যে, যরূরী প্রয়োজনে মহিলাগণ বেগানা পুরুষের চিকিৎসা করতে পারেন।[22]

(২) আত্মরক্ষার জন্য। যেমন হযরত আনাস (রাঃ) বলেন যে, হুনাইনের যুদ্ধে (আমার মা) উম্মে সুলাইমের হাতে খঞ্জর অর্থাৎ দু’ধারী লম্বা ছুরি দেখে রাসূল (ছাঃ) তাকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, যদি কাফের সৈন্য আমার নিকটবর্তী হয়, তবে এ দিয়ে আমি তার পেট ফেড়ে ফেলব। জবাব শুনে রাসূল (ছাঃ) হেসে ফেলেন।[23]

(৩) সহযোগী যোদ্ধা হিসাবে। খ্যাতনামা ছাহাবী হযরত ‘উবাদা বিন ছামেত (রাঃ)-এর স্ত্রী উম্মে হারাম বিনতে মিলহান (রাঃ) মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর স্ত্রী ফাখেতাহ বিনতে ক্বারাযাহ্র সাথে হযরত ওছমান (রাঃ)-এর খেলাফতকালে (২৩-৩৫ হিঃ) মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর নেতৃত্বে ২৭ হিজরী সনে রোমকদের বিরুদ্ধে ইসলামের ইতিহাসের ১ম নৌযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন ও সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন।[24]

উপরের আলোচনায় বুঝা গেল যে, যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ না করলেও যুদ্ধে সহযোগিতার বিভিন্ন ক্ষেত্রে মহিলাসহ যে কোন দুর্বল ও অপারগ মুমিন অংশগ্রহণ করতে পারবেন। বরং দুর্বলদের সহযোগিতাকে উৎসাহিত করে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ সাহায্য করেন এই উম্মতকে তার দুর্বল শ্রেণীর দ্বারা; তাদের দো‘আ ও দাওয়াতের মাধ্যমে এবং ছালাত ও খালেছ আন্তরিকতার মাধ্যমে’।[25] হযরত আবুদ্দারদা (রাঃ) বলেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি যে, তোমরা আমাকে দুর্বলদের মধ্যে সন্ধান কর। কেননা তোমরা রূযীপ্রাপ্ত হয়ে থাক এবং সাহায্যপ্রাপ্ত হয়ে থাক তোমাদের দুর্বলদের মাধ্যমে।[26]

এর অর্থ এটা নয় যে, মুসলমানদের সবাইকে দুর্বল হয়ে থাকতে হবে। বরং এর অর্থ হ’ল, মুসলিম উম্মাহ্র সকল সদস্য ও সদস্যার উপরে সর্বদা জিহাদ ফরয। তার মধ্যে কেউ সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে, কেউ সহযোগিতা করবে। কেউ দো‘আ করবে। কিন্তু কেউ জিহাদ হ’তে বিরত থাকার আন্তরিক ইচ্ছা পোষণ করলে সে মুনাফিক হয়ে মরবে।[27]

আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় জনগণের পক্ষ হ’তে সুশিক্ষিত ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নিয়মিত সেনাবাহিনী সরাসরি যুদ্ধের দায়িত্ব পালন করবে এবং অন্যেরা তাদের সহযোগিতা করবে। নিয়ত খালেছ থাকলে ও যুদ্ধ আল্লাহ্র জন্য হ’লে সকলেই জিহাদের পূর্ণ নেকী লাভে ধন্য হবেন ইনশাআল্লাহ। এমনকি ‘জিহাদের জন্য অমুসলিমদের নিকট থেকেও সাহায্য গ্রহণ করা জায়েয আছে, যদি তাদের থেকে কোনরূপ ক্ষতির আশংকা না থাকে’।[28]

 


[1] কুরতুবী, বাক্বারাহ ২১৬ আয়াতের ব্যাখ্যা; ৩/৩৯।

[2] মুখতাছার তাফসীরুল বাগাভী (রিয়াদ : ১ম সংস্করণ, ১৪১৬/১৯৯৬) বাক্বারাহ ২১৬ আয়াতের ব্যাখ্যা, ১/৭৭।

[3] মুসলিম হা/১৯১০, মিশকাত হা/৩৮১৩ ‘জিহাদ’ অধ্যায়।

[4] মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/২৭১৫, ৩৮১৮; তাফসীর ইবনু কাছীর ১/২৫৯।

[5] মুসলিম, মিশকাত হা/৩৮০০ ‘জিহাদ’ অধ্যায়।

[6] বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৩৮১৫-১৬।

[7] সাইয়িদ সাবিক্ব, ফিক্বহুস সুন্নাহ ৩/৮৪-৮৫।

[8] ফাৎহুল বারী হা/ ২৮২৫-এর ব্যাখ্যা, ৬/৪৫ পৃঃ।

[9] মুহাম্মাদ বিন আলী শাওকানী, নায়লুল আওত্বার (কায়রো : ১৩৯৮/১৯৭৮) ৯/১০৫ পৃঃ।

[10] মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/২৭১৫, ৩৮১৮; ফিক্বহুস সুন্নাহ ৩/৮৫।

[11] তিরমিযী হা/১৪২১, আবুদাঊদ, নাসাঈ, মিশকাত হা/৩৫২৯ ‘ক্বিছাছ’ অধ্যায়।

[12] ফিক্বহুস সুন্নাহ ৩/৮৫।

[13] বুখারী ও মুসলিম; ফিক্বহুস সুন্নাহ ৩/৮৬।

[14] ফিক্বহুস সুন্নাহ ৩/৮৫।

[15] আহমাদ, ইবনু মাজাহ; মিশকাত হা/২৫৩৪।

[16] ফিক্বহুস সুন্নাহ ৩/৮৬ টীকা-১।

[17] মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, ফাৎহুল বারী হা/২৮৮০ ‘জিহাদ’ অধ্যায়, ৬৫ অনুচ্ছেদ।

[18] মুসলিম হা/১৮১০ ‘জিহাদ’ অধ্যায়, ৪৭ অনুচ্ছেদ।

[19] বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/৩০৩৭ ‘জিহাদ’ অধ্যায় ১৬৩ অনুচ্ছেদ।

[20] সুলায়মান মানছুরপুরী, রাহমাতুল লিল আলামীন (দিল্লী : ১ম সংস্করণ, ১৯৮০ খৃঃ) ১/১০৯ পৃঃ।

[21] বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/২৮৮১ ‘জিহাদ’ অধ্যায়, ৬৬ অনুচ্ছেদ।

[22] বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/২৮৮৩-এর ব্যাখ্যা, ‘জিহাদ’ অধ্যায়, ৬৮ অনুচ্ছেদ।

[23] মুসলিম হা/১৮০৯ ‘জিহাদ’ অধ্যায় ৪৭ অনুচ্ছেদ।

[24] বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/২৮৭৮ ‘জিহাদ’ অধ্যায় ৬৩ অনুচ্ছেদ; আল-বিদায়াহ ৮/২৩২।

[25] নাসাঈ হা/৩১৭৮; ফিক্বহুস সুন্নাহ ৩/৮৭।

[26] বুখারী, আবুদাঊদ, মিশকাত হা/৫২৩২, ৫২৪৬।

[27] মুসলিম, মিশকাত হা/৩৮১৩।

[28] ফিক্বহুস সুন্নাহ ৩/৮৭।

[29] ফিক্বহুস সুন্নাহ ৩/৮৬; ফাৎহুল বারী ‘জিহাদ’ অধ্যায় ‘জিহাদে গমনে পিতামাতার অনুমতি গ্রহণ’ অনুচ্ছেদ ১৩৮।

[30] আহমাদ, আবুদাঊদ প্রভৃতি, মিশকাত হা/৬০৭।

[31] মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৫৬৮।

[32] মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৩৮১৭।

[33] মুসলিম, মিশকাত হা/৩৮০৬; ফিক্বহুস সুন্নাহ ৩/৮৬।

 

মন্তব্য করুন

Back to top button