দাওয়াত ও জিহাদ

রাসূল (ছাঃ) কিভাবে জিহাদ করেছেন?

পরস্পরে মারামারি ও যুদ্ধ-বিগ্রহ মানুষ ও পশু-পক্ষী সকল প্রাণীর স্বভাবগত বিষয়। স্ব স্ব স্বার্থ রক্ষার জন্য মানুষ পরস্পরে যুদ্ধ করে। ধর্মীয় স্বার্থে হ’লে তখন সেটা ‘ধর্মযুদ্ধে’ পরিণত হয়। সেকারণ প্রত্যেক ধর্মেই যুদ্ধ একটি স্বীকৃত বিধান। ইসলাম আল্লাহ প্রেরিত সর্বশেষ দ্বীন। যা সকল মানুষের কল্যাণে অবতীর্ণ হয়েছে। তাই হিন্দু-বৌদ্ধ-জৈন সহ সকল মানবরচিত ধর্ম এবং ইহূদী-নাছারা সহ পূর্ববর্তী সকল এলাহী ধর্ম, যা এখন মানসূখ বা হুকুমরহিত হিসাবে গণ্য; এসব ধর্ম রক্ষার জন্য লড়াই করাকে ‘জিহাদ’ বলা হবে না। বরং ঐসব ধর্মের অনুসারীদের হামলা থেকে ইসলামকে রক্ষা করার লড়াইকে ‘জিহাদ’ বলা হবে। ইসলামে জিহাদ বা যুদ্ধবিধান সম্পূর্ণরূপে দ্বীনের নিরিখে রচিত। এই বিধান সর্বব্যাপী ও সার্বজনীনভাবে কল্যাণময়। স্থান-কাল ও পাত্র বিবেচনায় এই বিধানের সুনির্দিষ্ট প্রয়োগবিধি রয়েছে। নিম্নের আলোচনায় তা স্পষ্ট হবে ইনশাআল্লাহ।

রাসূল (ছাঃ) -এর মাক্কী ও মাদানী জীবনে জিহাদ :

মাক্কী জীবনে : দীর্ঘ ২৩ বছরের নবুঅতী জীবনের প্রথম ১৩ বছর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মক্কায় অবস্থান করেন। এই সময় তাঁকে সশস্ত্র জিহাদের নির্দেশ দেওয়া হয়নি। বরং তাঁকে প্রতিকূল পরিবেশে প্রজ্ঞা ও সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে মানুষকে আল্লাহ্র দ্বীনের পথে আহবানের নির্দেশ দেওয়া হয়। তাঁর সম্প্রদায় যখন তাঁর আহবানের মধ্যে বাপ-দাদার আমল থেকে চলে আসা রীতি ও সংস্কৃতির বিরোধী বক্তব্য দেখতে পেল, তখন তাঁর বিরুদ্ধে তারা খÿহস্ত হয়ে উঠলো এবং তাঁর উপরে নানাবিধ নির্যাতন শুরু করে দিল।

এই সময় রাসূল (ছাঃ)-কে বলা হয়, ‘তুমি আহবান কর মানুষকে তোমার প্রভুর পথে প্রজ্ঞার সাথে ও সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে এবং তাদের সাথে বিতর্ক কর সর্বাধিক সুন্দর পন্থায়’ (নাহ্ল ১৬/১২৫)। বলা হয়, ‘তুমি মন্দকে ভাল দ্বারা প্রতিরোধ কর। তারা যা বলে আমরা সে বিষয়ে ভালভাবে অবগত’ (মুমিনূন ২৩/৯৬)। বলা হ’ল, ‘তাহ’লে তোমার শত্রুর অবস্থা এমন দাঁড়াবে, যেন সে তোমার অন্তরঙ্গ বন্ধু’ (হা-মীম সাজদাহ ৪১/৩৪)।

মাক্কী জীবনে মন্দকে মন্দ দ্বারা বা অস্ত্রকে অস্ত্র দ্বারা মুকাবিলা করার নির্দেশ আল্লাহপাক স্বীয় রাসূলকে দেননি। এই সময় তাঁকে কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা ও প্রজ্ঞাপূর্ণ উপদেশ দ্বারা বাতিলপন্থী মন্দশক্তিকে মুকাবিলা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। যেমন- আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে বলেন, ‘আমরা ভালভাবে অবগত আছি যা তারা বলে। কিন্তু তুমি তাদের উপর যবরদস্তিকারী নও। অতএব তুমি কুরআন দ্বারা উপদেশ দাও যে ব্যক্তি আমার শাস্তিকে ভয় করে’ (ক্বাফ ৫০/৪৫)। অতঃপর এটাকেই ‘বড় জিহাদ’ হিসাবে উল্লেখ করে বলা হ’ল, ‘তুমি কাফিরদের আনুগত্য করো না। বরং তাদের বিরুদ্ধে কুরআন দ্বারা বড় জিহাদে অবতীর্ণ হও’ (ফুরক্বান ২৫/৫২)।

কুরআন ও কুরআনের বাহক রাসূল ও তাঁর অনুসারীদেরকে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে কাফেররা মানসিক পীড়ন করতে থাকলে আল্লাহ বলেন, ‘যখন তুমি তাদেরকে আমাদের আয়াত সমূহে ত্রুটি সন্ধানে লিপ্ত দেখবে, তখন তুমি তাদের থেকে সরে যাবে। যে পর্যন্ত না তারা অন্য কথায় লিপ্ত হয়’ (আন‘আম ৬/৬৮)। আরও বলা হয়েছে, ‘তাদেরকে ছিদ্রান্বেষণ ও খেল-তামাশায় ছেড়ে দাও সেই দিবসের (ক্বিয়ামতের) সম্মুখীন হওয়া পর্যন্ত, যে দিবসের ওয়াদা তাদেরকে করা হয়েছে’ (যুখরুফ ৪৩/৮৩, মা‘আরিজ ৭০/৪২)। বলা হয়, ‘তুমি যে বিষয়ে আদিষ্ট হয়েছ, তা প্রকাশ্যে প্রচার কর এবং মুশরিকদের উপেক্ষা কর’। ‘বিদ্রুপকারীদের বিরুদ্ধে তোমার জন্য আমরাই যথেষ্ট’ (হিজর ১৫/৯৪-৯৫)।

মাক্কী যিন্দেগীতে সাধারণ মুসলমানদের সামাজিক জীবন ও চলাফেরা সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘দয়াময় আল্লাহ্র সত্যিকারের বান্দা তারাই যারা ভূপৃষ্ঠে বিনম্রভাবে চলাফেরা করে এবং মূর্খরা যখন তাদের লক্ষ্য করে বিভিন্ন কথা বলতে থাকে, তখন তারা বলে ‘সালাম’ (ফুরক্বান ২৫/৬৩)। এই সময় কাফেরদের ক্ষমা করার উপদেশ দিয়ে আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে বলেন, ‘তুমি তাদেরকে সুন্দরভাবে ক্ষমা করে দাও’ (হিজর ১৫/৮৫)। সাধারণ মুসলমানদেরও একইরূপ পরামর্শ দিয়ে বলা হয়, ‘তুমি মুমিনদের বল, তারা যেন ঐসব লোকদের ক্ষমা করে দেয়, যারা আল্লাহ্র দিবস সমূহ (অর্থাৎ তাঁর শাস্তি বা অনুগ্রহ কোনটাই) কামনা করে না’ (জাছিয়াহ ৪৫/১৪)। উপরে বর্ণিত আয়াতগুলির সবই মাক্কী। এইভাবে সূরা হজ্জ ৩৯ আয়াত নাযিলের পূর্ব পর্যন্ত ৭০-এর অধিক আয়াতে মাক্কী জীবনে যুদ্ধকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল’।[1]

মাদানী জীবনে : উপরের আলোচনায় মাক্কী জীবনে জিহাদের প্রকৃতি ফুটে উঠেছে। প্রতিকূল পরিবেশ ও পরিস্থিতির কারণে সেখানে দ্বীনের দাওয়াতকে খুবই ধৈর্য ও দূরদর্শিতার সাথে জনগণের নিকটে পেশ করতে হয়েছে। কিন্তু এতদসত্তেবও যখন কুফরী শক্তি ঈমানদারগণকে বরদাশত করতে পারলো না, বরং তাদের বিরুদ্ধে অত্যাচারের মাত্রা সীমা ছাড়িয়ে গেল এবং অবশেষে তারা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে হত্যার ষড়যন্ত্র করল, তখন আল্লাহ্র নির্দেশে তিনি মদীনায় হিজরত করতে বাধ্য হন (আনফাল ৮/৩০)। যেখানে পূর্ব থেকেই অন্ততঃ ৭৫ জন নারী-পুরুষ তাঁর হাতে বায়‘আত করে ইসলাম কবুল করেছিলেন ও তাঁর জানমালের নিরাপত্তা দানে ওয়াদাবদ্ধ হয়েছিলেন। তাছাড়া মুছ‘আব বিন ‘ওমায়ের (রাঃ) সেখানে পূর্ব থেকেই দ্বীনের প্রচারে লিপ্ত ছিলেন ও ক্ষেত্র প্রস্ত্তত করে রেখেছিলেন। যে কারণে মদীনায় গিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বিপুলভাবে সমাদৃত হন এবং জনসমর্থন ও শক্তি অর্জনে সমর্থ হন। ফলে এখানে যখন ২য় হিজরীতে মক্কার কাফেররা এসে হামলা চালায়, তখন আর তাঁকে পূর্বের মাক্কী জীবনের ন্যায় ছবর ও ক্ষমা করার কথা না বলে বরং হামলাকারীদের বিরুদ্ধে পাল্টা যুদ্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়।

আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) প্রমুখাৎ হযরত আবুবকর (রাঃ)-এর উক্তি বর্ণিত হয়েছে যে, যে রাতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের উদ্দেশ্যে বের হন, সে রাতে আবুবকর (রাঃ) দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘তারা তাদের নবীকে বের করে দিল। এখন অবশ্যই তারা ধ্বংস হবে’। এ সময় সূরা হজ্জ-এর ৩৯ আয়াতটি নাযিল হয়, ‘যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হ’ল তাদেরকে, যারা আ।ান্ত হয়েছে। কারণ তাদের প্রতি যুলুম করা হয়েছে। বস্ত্ততঃ আল্লাহ তাদেরকে (যুদ্ধ ছাড়াই) সাহায্য করতে অবশ্যই সক্ষম’ (৩৯)। ‘যাদেরকে তাদের ঘর-বাড়ি থেকে অন্যায়ভাবে বের করে দেওয়া হয়েছে শুধুমাত্র এ কারণে যে, তারা বলে আমাদের পালনকর্তা ‘আল্লাহ’। যদি আল্লাহ মানবজাতির একদলকে অন্য দল দ্বারা প্রতিহত না করতেন, তাহ’লে নাছারাদের বিশেষ উপাসনালয়, সাধারণ উপাসনালয়, ইহূদীদের উপাসনালয় ও মুসলমানদের মসজিদসমূহ, যে সকল স্থানে আল্লাহ্র নাম অধিকহারে স্মরণ করা হয়, সবই বিধ্বস্ত হয়ে যেত। আর নিশ্চয়ই আল্লাহ মহাশক্তিমান ও পরা।মশালী’ (হজ্জ ৩৯-৪০)।[2]

অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা যুদ্ধ কর আল্লাহ্র রাস্তায় তাদের বিরুদ্ধে, যারা তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। তবে বাড়াবাড়ি করো না। কেননা আল্লাহ সীমালংঘনকারীদের ভালবাসেন না’ (বাক্বারাহ ২/১৯০)।[3]

উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় হাফেয ইবনু কাছীর (৭০০-৭৭৪ হিঃ) বলেন, তোমরা আল্লাহ্র রাস্তায় যুদ্ধ কর এবং তাতে সীমালঙ্ঘন করো না। আল্লাহ্র নিষিদ্ধ বস্ত্তকে সিদ্ধ করো না। যেমন বুরাইদাহ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন কোন সেনাদল প্রেরণ করতেন, তখন বলতেন, ‘তোমরা আল্লাহ্র নামে তাঁর রাস্তায় যুদ্ধ কর তাদের বিরুদ্ধে যারা আল্লাহ্র সাথে কুফরী করে। যুদ্ধ কর, কিন্তু গণীমতের মালে খেয়ানত করো না। চুক্তি ভঙ্গ করো না। শত্রুর অঙ্গহানি করো না। শিশুদের ও উপাসনাকারীদের হত্যা করো না’।[4] ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, এক যুদ্ধে এক মহিলাকে নিহত দেখতে পেয়ে রাসূল (ছাঃ) দারুণভাবে ক্ষুব্ধ হন এবং নারী ও শিশুদের থেকে বিরত থাকার ব্যাপারে কঠোর নির্দেশ দেন।[5]

উপরে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ)-এর মাক্কী ও মাদানী জীবন পর্যালোচনা করলে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, বাতিলের বিরুদ্ধে জিহাদ সর্বাবস্থায় ফরয। তবে সেটি স্থান-কাল-পাত্র ভেদে কখনো নিরস্ত্র হবে, কখনো সশস্ত্র হবে। নিরস্ত্র জিহাদ মূলতঃ প্রজ্ঞাপূর্ণ দাওয়াত ও হক-এর উপরে দৃঢ় থাকার মাধ্যমে হয়ে থাকে। পক্ষান্তরে সশস্ত্র জিহাদের জন্য অনুকূল পরিবেশ, পর্যাপ্ত সামর্থ্য, বৈধ কর্তৃপক্ষ এবং স্রেফ আল্লাহ্র ওয়াস্তে নির্দেশ দানকারী আমীরের প্রয়োজন হবে। নইলে ছবর করতে হবে এবং আমর বিল মা‘রূফ ও নাহি ‘আনিল মুনকারের মৌলিক দায়িত্ব (সৎ কাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ) পালন করে যেতে হবে।


[1] মুফতী মুহাম্মাদ শাফী, তাফসীর মা‘আরেফুল কুরআন (সংক্ষেপায়িত), বঙ্গানুবাদ : মহিউদ্দীন খান (মদীনা : ১৪১৩/১৯৯৩) পৃঃ ৯০৩।

[2] তিরমিযী হা/৩১৭১; নাসাঈ হা/৩০৮৫; আহমাদ হা/১৮৬৫; হাকেম হা/২৩৭৬।

[3] তাফসীর কুরতুবী ২/৩৪৭, শাওকানী, তাফসীর ফাৎহুল ক্বাদীর ১/১৯০।

[4] মুসলিম হা/১৭৩১; আহমাদ হা/২৭২৮; মিশকাত হা/৩৯২৯।

[5] বুখারী হা/৩০১৫।

মন্তব্য করুন

Back to top button