জ্ঞান-বিজ্ঞানে মুসলিম মনীষীদের অবদান
আজকের এই পৃথিবীতে মুসলিম জনসংখ্যা প্রায় দেড়শ’ কোটির মতো। আজ পৃথিবীর অন্যান্য জাতিবর্গ সভ্যতার পোশাকধারী, আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান যাদের হাতে লালিত পালিত হচ্ছে। তারাই এসবের দাবিদার। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আজ একথা কেউ আর ভাবে না যে, এ সভ্যতা কোথা থেকে এলো? জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্বেষণ ও এর অনুসরণ-অনুকরণ, অনুধাবন মুসলমানদের ঈমানেরই অঙ্গ ও অংশবিশেষ। মহাগ্রন্থ আল-কোরআনে শিক্ষা-দীক্ষার জন্য নানারূপ উপদেশ বাণী রয়েছে। তদ্রুপ হাদীস শরীফেও বিভিন্ন উৎসাহ বাণী আছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখা-প্রশাখা অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে যে, মুসলমানদের ধর্মীয় প্রেরণা ও প্রয়োজন তাদেরকে জ্ঞানার্জনে বাধ্য করেছে। অবশ্য, অজানাকে জানা, অচেনাকে চেনার দুর্নিবার আগ্রহ এর মূলে রয়েছে। মধ্য যুগে তারাই বিশ্ববাসীকে বিজ্ঞান শিক্ষা দিতেন। আধুনিক বৈজ্ঞানিক যুগের সূত্রপাত তারাই করেছেন। পিকে. হিট্টির ভাষায় বলতে হয়, ‘অষ্টম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রারম্ভ পর্যন্ত কোরআন ও হাদীসধারীগণ সমগ্র বিশ্বে সভ্যতা সংস্কৃতিকে আলাদা করেছেন।’
ইতিহাস হচ্ছে একটি জাতির দর্পণ। তারই মধ্যে পূর্বের আলোকে, বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে ভবিষ্যৎ চিত্র সুন্দরভাবে প্রতিফলিত হয়। হিজরী দ্বিতীয় সনে ধারাবাহিকভাবে ইতিহাস রচনার প্রকৃত ভিত্তি গড়ে উঠে। আলী বিন মোহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ মাদায়েনী ছিলেন ইসলামের প্রথম ইতিহাস লেখক। সমগ্র বিশ্বের সর্বশেষ ঐতিহাসিক হচ্ছেন পারস্যের তাবারী স্থানের অধিকারী আবু জাফর মোহাম্মদ ইবনে জারীর আত্-তারাবী। যিনি দৈনিক ৪০ পৃষ্ঠা করে সুদীর্ঘ ৪০ বছর পর্যন্ত ইতিহাস লিখার কাজে ব্যয় করেছিলেন। তাছাড়া ঐতিহাসিক ইবনে ইসহাক, ইবনে সা’দ, আল-ওয়াকিদি, আল-মাসুদী ও ইবনে খালদুন হলেন বিশ্ববিখ্যাত ঐতিহাসিকদের অন্যতম। মুসলিম দর্শন হযরত আদম (আ.)-এর কাল থেকেই আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল। জীবন ও জগতের পরিপূর্ণ মূল্যায়নের নাম যদি দর্শন হয়, তবে কি হযরত ইব্রাহিম (আ.) তথা অন্যান্য নবীর খোদা লাভের ধ্যান-ধারণা দর্শন নয়? কিন্তু বিশেষ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ইবনেসিনা, ইবনে রুশদ ও ইমাম গাজ্জালীর যুগে দর্শন শাস্ত্রের প্রকৃত চেহারা ফুটে উঠে। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলস্বরূপ বিশ্ববাসী বুঝতে সক্ষম হয়েছে, মুসলিম দর্শনই প্রকৃত দর্শন। ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিক হলেন আল-ফারাবী ও ইমাম গাজ্জালী। পবিত্র কোরআনে রোগ যন্ত্রণার মুক্তির পথ বর্ণিত হয়েছে। অনুরূপভাবে সহীহ বোখারী শরীফে এ সম্পর্কে দুটি অধ্যায়ের অবতারণা করা হয়েছে। এ শাস্ত্র যাদের ছোঁয়ায় ভরপুর তারা হলেন- হুমায়ুন বিন ইসহাক, ইসা বিন ইয়াহিয়া, জাবির বিন হাইয়ান, মোহাম্মদ বিন জাকারিয়া, আলী, রাজীত, ইবনে সিনা, ইবনে মিনার। ‘কানুন’ নামক গ্রন্থ পাশ্চাত্যে ‘মেডিকেল বাইবেল’ নামে পরিচিত হয়েছিল। সুদীর্ঘ আটশ’ বছর পর্যন্ত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তক রূপে নির্ধারিত ছিল। বর্তমানে প্রচলিত অঙ্ক শাস্ত্রের জনক হলেন ‘আল খারিজমী’। তার রচিত গ্রন্থ দ্বাদশ শতাব্দী থেকে ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত আধুনিক সভ্যতাভিমানী ইউরোপের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যপুস্তক হিসেবে ল্যাটিন অনুবাদের মাধ্যমে ব্যবহৃত হয়েছিল। তাছাড়া নব্য রসায়ন শাস্ত্র যাকে আমরা কেমিস্ট্রি বলে থাকি এর আবিষ্কারক হলেন ‘জাবির বিন হাইয়ান’। ইউরোপের বীজগণিতে নব যুগের সূচনাকারী হলেন ‘ঈসা আল মুহানী’ প্রকৃত পক্ষে মুসলিম মানচিত্রকার ও ভূগোলবিদ হলেন- আল খারিজমী, আলী ইদ্রিস, আল মাকসুদী, আল বেরুনী প্রমুখ।
এরূপভাবে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখা-প্রশাখায় মুসলিম মনীষীদের অবদান অন্ধকার আকাশে পূর্ণিমার চন্দ্রের মতো বিরাজমান। মানব সমাজের প্রধান প্রধান কাজ মুসলমানগণ সমাধান করেছেন। সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিক আল ফারাবী ছিলেন মুসলমান। সর্বশ্রেষ্ঠ গণিতবেত্তা আবু কামিল ও ইব্রাহিম বিন সিনান ছিলেন মুসলমান। সর্বশ্রেষ্ঠ মানচিত্রকার ও ভূগোলবিদ আলী ইদ্রিস, আল মাকসুদী ছিলেন মুসলমান। বর্তমান বিজ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক মুসলমানদের নিকট শতদিক দিয়ে ঋণী। কিন্তু হায়! যখন ইউরোপবাসীরা দস্তখত তো দূরের কথা দু’হাতের সাহায্যে টিপসইও দিতে জানতো না, তখন মুসলিম স্পেনে একজন নিরক্ষর লোক পাওয়া যেত না। আজ মুসলিম সমাজ তাদের মূল পুঁজি কোরআন-হাদীসকে অবহেলা করে বিশ্ববাসীর হাসির খোরাক ও হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছে। নানারূপ নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হচ্ছে মুসলিম সম্প্রদায়গুলো। আল্লাহ আমাদের সবাইকে ভালোভাবে কোরআন-হাদীস বুঝার ও নবীর আদর্শকে আঁকড়ে ধরে সুন্দর জীবন যাপন করার তৌফিক দান করেন। আমিন!
————-
লেখক: আতিকুর রহমান নগরী
প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট
(ইনকিলাব)