পরিবার ও দাম্পত্য

সফল মাতা-পিতার জন্য যা করণীয়

সন্তান জন্ম দেয়া সহজ।  কিন্তু সফল ও যোগ্য পিতা-মাতা হওয়া কঠিন। সন্তান মানুষ করা আরও কঠিন। পিতা-মাতার  কাছে সন্তান অমূল্য সম্পদ। তাদের ঘিরেই থাকে সব স্বপ্ন। অথচ সফল পিতা-মাতা কি করে  হ’তে হয় অধিকাংশ মানুষই তা জানেন না বা জানলেও অনুসরণ করেন না। ফলে যা হবার তাই  হচ্ছে। সন্তানদের সাথে দূরত্ব বাড়ছে, সন্তানরা বিপথগামী হচ্ছে, মানসিক যন্ত্রণা ও  দ্বন্দ্ব বাড়ছে। পশু-পাখির বাচ্চা জন্ম নিয়েই দৌড়ায়। কিন্তু মানব সন্তানকে যে যত্ন  ও নিয়ম করে হাঁটতে-দৌড়াতে শিখাতে হয়।           

মনে রাখতে হবে শিশুরাই  একটি দেশ, সমাজ ও জাতির ভবিষ্যত কর্ণধার। তাই এরাই সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব পাওয়ার দাবীদার।  এই বয়সে তারা যা শিখে বা তাদের যা শেখানো হয়, তার ভিত্তির উপরই গড়ে ওঠে তাদের তথা  জাতির ভবিষ্যত। অথচ শিশুরা আজ যে শিক্ষা ও দিকনির্দেশনা পাচ্ছে, তাতে তারা আদর্শ  মানুষ হিসাবে গড়ে উঠতে পারছে না। প্রকৃত শিক্ষা বলতে যা বোঝায় তা শুধু  স্কুল-কলেজের লেখাপড়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। চারিত্রিক ও আত্মিক উন্নয়নের বিষয়গুলোও  এ শিক্ষার সঙ্গে জড়িত। আজকাল শিশুরা মারামারি, চুরি, ডাকাতি, মেয়েদের উত্ত্যক্ত  করা, সন্ত্রাস এমনকি হত্যাকান্ডসহ নানা অপরাধে জড়িত হচ্ছে। কোমলমতি শিশুদের  নিষ্ঠুরতা ও সহিংস প্রবৃত্তি গ্রাস করছে কেন? সুস্থ ও স্বাভাবিক মানুষ হিসাবে  বিকশিত হওয়ার বদলে কেন তারা অমানুষে পরিণত হচ্ছে? এই প্রশ্নের সদুত্তর খোঁজার দায়  সমাজের সচেতন সবারই।            

জন্মের পর থেকেই শিশুর  শিক্ষা শুরু হয়। শিশুর শিক্ষার প্রথম পাঠ শুরু হয় মায়ের কাছ থেকে তথা পরিবার থেকে।  একটি শিশুকে গড়া মানে একটি জাতি গড়া। আর জাতি গড়ার এ মহান দায়িত্ব ন্যস্ত হয়  বাবা-মা ও পরিবারের উপর। এ কারণেই সন্তান লালনের আগে কিছু কিছু বিষয়ে বাবা-মায়ের  প্রস্ত্ততি নেয়া অত্যাবশ্যক। অন্য কিছুতে গাফলতি করলেও এ বিষয়ে গাফলতি ঠিক নয়।  কারণ এর সঙ্গে সমাজ ও জাতির ভবিষ্যত জড়িত। ভালো স্কুলে ভর্তির জন্য যে ধরনের  প্রস্ত্ততি চলে, তেমনি শিশুর চারিত্রিক উন্নয়ন সাধনে দৃঢ় প্রচেষ্টা দরকার। সোনার  মানুষ গড়ার জন্যও প্রয়োজন কঠোর সাধনা।           

আমরা শিশুর শারীরিক  বিষয়ে যতটা গুরুত্ব দিচ্ছি কিন্তু তার মানসিক বিকাশ, তার চিন্তা-চেতনা সঠিকভাবে  গড়ে উঠছে কি-না সে বিষয়ে আমরা তেমনভাবে গুরুত্ব দিচ্ছি না। ফলে অধিকাংশ শিশুরা  ত্রুটিপূর্ণ চিন্তা-চেতনায় এবং অভ্যাসে বড় হয়ে উঠে এবং বড় হয়ে ঐ সকল বদ অভ্যাস ও  ত্রুটিগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে ত্যাগ করতে পারে না। যেমন  দুই/তিন বছরের অনেক শিশুকে দেখা যাবে,  জিনিসপত্র নষ্ট করছে, যা খাচ্ছে অর্ধেক ফেলে দিচ্ছে, টেবিলে-সোফায় লাফালাফি করে  জিনিসপত্র ক্ষতি করছে। খেলনাপত্র ভাংচুর করছে। অন্য বাড়িতে গিয়ে সাজানো জিনিসপত্র  নাড়াচাড়া বা নষ্ট করছে। জানালা দিয়ে বাইরে জিনিস ফেলছে। অথচ মমতাময়ী মাতা খুশী মনে  বলছেন, আমার সন্তান দারুণ প্রাণচঞ্চল, দারুণ দুষ্ট। এসব কথা তারাই বলেন, যারা  নিজেরা ঐভাবে বড় হয়েছেন এবং এ বিশৃঙ্খলভাবে বেড়ে উঠাকেই সঠিক মনে করছেন। অনেক  মায়েরা এও বলে থাকেন, বাচ্চামানুষ করবেই তো, বড় হ’লে ঠিক হয়ে যাবে। অথচ এটা  একেবারেই ভুল কথা। বড় হ’লে শিখবে না। বরং এসব বদ অভ্যাস, বিশৃঙ্খল কাজ ছেড়ে দিতে কষ্ট  হবে।           

বাচ্চারা ৬ মাস থেকেই  ভালমত শিখতে শুরু করে। আদর যেমন বোঝে, ধমকও বোঝে। ভালো কাজ, খারাপ কাজ শেখার বা  বোঝার ক্ষমতা ঐ সময় থেকেই শুরু হয়ে যায়। যেমন দু’বছরের কোন শিশুকে দেখবেন চকলেটের  কভার খুলে ঘরের কোণে রাখা ডাস্টবিনে গিয়ে ফেলছে। কোন নতুন বাসায় গিয়ে শোপিস দেখছে,  কিন্তু ধরছে না। যাতে ভেঙ্গে না যায়। দু’বছরের বাচ্চারা নিয়ম-শৃঙ্খলা,  সৌন্দর্যবোধ, গুছিয়ে রাখা, নষ্ট না করা, কোনটা করা উচিত এবং উচিত নয় তা বোঝার  ক্ষমতা অর্জন করে ফেলে। বরং আমরা অভিভাবকরা বুঝি না তাদের কিভাবে শেখানো উচিত।  কারণ ঐ শিশুর ব্লাংক ব্রেন সফটওয়ারে সবকিছু বুঝতে চায়, জানতে চায় এবং সে তার  ব্রেনে দ্রুত সবকিছু সংরক্ষণ করে রাখে। ছয় বছরের মধ্যে শিশুরা ব্রেনের পূর্ণতা  পেয়ে যায়। ঐ বয়সে সে যা কিছু দেখে, শোনে, বোঝে পরবর্তী জীবনে তার প্রতিফলন ঘটে।  স্বার্থপরতা, আত্মকেন্দ্রিকতা অথবা উদারতা, মায়া-মমতা প্রভৃতি ইতিবাচক বা নেতিবাচক  গুণাবলিতে বিকশিত হয়। এসময় যা ইনপুট হবে পরবর্তী জীবনে তাই আউটপুট হবে। সুতরাং এই  সময়টি শিশুদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সবচেয়ে আদরের সন্তানকে আদব-কায়দায়,  সৃষ্টিশীলতায় এবং কিভাবে আদর্শ মানুষ করতে হয় এর কিছু গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কে  নিম্নে বিষয় আলোচনা করা হবে ইনশাআল্লাহ।           

শিশুকাল থেকে ইতিবাচক  শিক্ষায় গড়ে তোলা :           

একথা কখনই মনে করা ঠিক নয়  যে, শিশু কিছু বোঝে না। ও ঠিকই বোঝে, ক্ষেত্র বিশেষে ও পিতা-মাতার চাইতে দ্রুত গ্রহণ করার ক্ষমতা রাখে। এখন সে কাদামাটির ন্যায়,  যেভাবে গড়া হবে সেভাবেই গড়ে উঠবে। পিতা-মাতা, বাড়িতে থাকা ভাই-বোনরাই তার  গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষক। শিশুরা দেখে শেখে, শুনে শেখে, করে শেখে। তাদের ব্রেনের  সফটওয়ার এসময় সম্পূর্ণ খালি থাকে। ফলে যা দেখবে, শুনবে, অনুভব করবে, তাই ব্রেনে দ্রুত  রেকর্ড হয়ে যাবে। যেমন কোন শিশু ঘরের ভেতর দৌড়াতে গিয়ে দরজার চৌকাঠে গিয়ে আঘাত  পেয়ে কাঁদতে শুরু করল, তাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে দরজার চৌকাঠে আঘাত করে বাচ্চাকে  বুঝানো হ’ল দরজাকে শাস্তি দেয়া হয়েছে। বাচ্চার কান্না থেমে গেল। এতে সন্তানকে  শেখানো হ’ল যে বাঁধা দেয় বা কষ্ট দেয় তাকে ধরে মারতে হয়। ফলে ঐ শিশু প্রতিশোধ  পরায়ণতা শিখল শিশুবেলা থেকেই।           

আরো একটি উদাহরণ, তৃতীয়  শ্রেণীতে অধ্যয়নরত সন্তানকে যে টিফিন দেয়া হয়, সেটা অধিকাংশ সময় সে নিজে খায় না,  তার বন্ধুরা খেয়ে ফেলে। একদিন সন্তানকে বলা হ’ল যে,  ‘তোমার টিফিন তুমি খাও না, বন্ধুরা খায় কেন?  তুমি বোকা, না গাধা? নিজের স্বার্থ বুঝ না? আজ থেকে তোমার টিফিন বন্ধুরা যেন না  খায়’। এভাবে বলার মাধ্যমে সন্তানকে স্বার্থপরতা, আত্মকেন্দ্রিকতা শিখানো হ’ল। ঐ  সন্তান হয়ত পরবর্তীতে বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে দেখবে না। কারণ সে ছোট বেলা থেকেই স্বার্থপরতা  শিখে এসেছে। সে শিখেছে, নিজেরটা আগে দেখো। অথচ এক্ষেত্রে শিখানো উচিত ছিল বন্ধুকে  জিজ্ঞেস করে খেয়ো, সে খেয়েছে কি-না? মিলে-মিশে খেয়ো। মানুষকে সাহায্য করো, দু’টি  ভালো কলম থাকলে বন্ধুকে একটি দাও। যাতে ও ভালো লিখতে পারে।            

এভাবে শিশুকে বড় মন নিয়ে  বড় হ’তে দিতে হবে। তবেই বাবা-মাকে শ্রদ্ধা ও সম্মান করবে। যত দেয়া যায়, বহুগুণে তা  ফিরে আসে।          

শিশুদের আত্মমর্যাদাবোধ  সমুন্নত রেখে গড়ে তোলা :
     
অভিভাবকরা চান বাচ্চারা  সম্মান ও মর্যাদাবোধ নিয়ে আদর্শ মানুষ হিসাবে গড়ে উঠুক। কিন্তু তাদেরকে উপরে উঠাতে  গিয়ে না বুঝে নীচে টেনে নামিয়ে দেয়া হচ্ছে। তাদের বড় করতে গিয়ে ছোট করা হচ্ছে।  নিচের দিকে টেনে নেয়া হচ্ছে কিন্তু ভাবা হচ্ছে তারা উপরে উঠছে। যেমন কোন আত্মীয়ের  সামনে নিজের সন্তানকে বলা হচ্ছে, ‘তোমার খালাতো ভাই কত বুদ্ধিমান! কত সুন্দর করে  কথা বলে! ব্যবহার কত ভালো, এদের দেখে শিখো। কিছুতো পারো না’। এতে সবার সামনে তার  মর্যাদায় আঘাত দেয়া হ’ল। আরও বলা হ’ল, ‘অমুক ছেলে পড়াশোনায়, খেলাধূলায় জিনিয়াস,  তুমি কি করো! তুমি তো একটা গাধা! এতে কি ছেলেকে উৎসাহিত করা হ’ল না নিরুৎসাহিত করা  হ’ল?            

একটি দু’বছরের শিশুকে  তাচ্ছিল্য করলেও সে মন খারাপ করে। সেখানে কিশোর বয়সী সন্তানকে সবার সামনে ছোট করে  তাকে কিভাবে বড় করা যাবে? তার আত্মমর্যাদা, আত্মবিশ্বাস নষ্ট হ’তে হ’তে এক সময় তার  মনে হবে, সত্যিই আমি গাধা আমাকে দিয়ে কিছু হবে না।         

এভাবে তার ভেতরের  অফুরন্ত সম্ভবনাকে নষ্ট করা হ’ল। সবাইকে দিয়ে সবকিছু হয় না। সন্তানকে সবার সামনে কখনও  প্রশংসা করতে হবে। উৎসাহ-উদ্দীপনা জোগাতে হবে। জন্মগত মেধাকে গুরুত্ব দিতে হবে। তাদের  মনের খোরাক মনের খাদ্য হ’ল উৎসাহ, সেটা দিতে হবে। মাঝে মাঝে বলতে হবে ‘আমার  জিনিয়াস চাইল্ড, তোমাকে নিয়ে আমি গর্ব করি’। দেখবেন সন্তান কত উৎসাহিত হচ্ছে,  প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হচ্ছে পিতা-মাতার এই গর্বকে সমুন্নত রাখতে। সে উচ্ছৃঙ্খল নয় সুশৃঙখল  পথেই বেড়ে উঠবে। একটি ঘটনা উল্লেখ করা যায়।           

ঢাকার শীর্ষস্থানীয়  শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এক ছাত্রী উচ্চমাধ্যমিকে গোল্ডেন জিপিএ ৫ পেয়েছে। সন্ধ্যায় তার  পিতা অফিস থেকে এসে ড্রাইং রুমে বসে টিভি চ্যানেল বদলাচ্ছিলেন। মেয়েটি তার পিতার  পাশে খুশীমনে বসেছিল কিছুক্ষণ। কিন্তু তার বাবা তাকে কোন অভিনন্দন জানাননি। মেয়েটি  পরে বলল, আমি ভেবেছিলাম পিতা হয়তো খুশী হয়ে আমাকে কিছু বলবেন। কিন্তু তিনি কিছুই  বললেন না।          

অনেক অভিভাবক এমনও বলেন,  গোল্ডেন জিপিএ ৫ পাওয়া কোন ব্যাপার নাকি! এত প্রাইভেট টিচার, এত কোচিং কয়জন পায়?  মেডিকেল, বুয়েট বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হও, তখন বোঝা যাবে! পিতা-মাতা  আত্মীয়ের বাড়িতে মিষ্টি পাঠিয়ে আনন্দ করছেন। অথচ এত কষ্ট করে যে এত ভাল রেজাল্ট  করল তার মাথায় স্নেহের হাত রেখে বলতে পারছেন না, মহান আল্লাহ আরো বড় করুক তোমায়।  কয়জন আমরা এমনটি বলতে পারছি? ভাবখানা এমন যে, প্রশংসা করলে বা ভাল বললে ভবিষ্যতে  খারাপ করবে। অথচ সন্তান পিতা-মাতার আনন্দ দেখতে চায়। পেতে চায় তাদের হৃদয়নিংড়ানো  ভালোবাসা ও অভিনন্দন। যা তাকে আরও শক্তি ও উৎসাহ জোগাবে। সুতরাং ছেলে/মেয়েদের  ভেতরের অসীম ক্ষমতাকে জাগিয়ে তুলতে হবে, তাকে স্বীকৃতি দিতে হবে। পুরষ্কৃত করতে  হবে। পিতা-মাতার ভালোবাসা ও নেক দো‘আ সন্তানের পাথেয় হবে। সাথে সাথে পারিবারিক  বন্ধনও সুদৃঢ় হবে।             

সন্তান ভুল করলে বা মন  খারাপ থাকলে মনে শক্তি জোগাতে হবে :           

বয়ঃসন্ধির সময়টিতে সন্তানদের  প্রতি মা-বাবার বিশেষ যত্ন, ভালবাসা ও সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। তাদের সাথে সম্পর্ক  আরও বাড়াতে হবে। ঐ বয়সের গুরুত্বপূর্ণ ও অনিবার্য বিষয়গুলো সহজ ও সরলভাবে  মনোবৈজ্ঞানিক কৌশলে বোঝাতে হবে। এক্ষেত্রে অভিভাবকরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে সঠিক কাজটি  করতে ব্যর্থ হন। যেমন- সন্তান কোন ক্ষেত্রে ভুল বা অন্যায় করে ফেলেছে, যাতে সে  বিব্রত ও লজ্জিত। সে অপরাধবোধ, সিদ্ধান্তহীনতা নিয়ে হতাশায় ভুগছে। এই নেতিবাচক  পরিস্থিতি থেকে তাকে উদ্ধার করে স্বাভাবিক জীবনে নিয়ে আসার শক্তি জোগাবে কে? তার  জীবনের সবচেয়ে আপনজন তার পিতা-মাতা। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই পিতা-মাতা সঠিক পরামর্শ  বা সান্ত্বনা না দিয়ে বকাবকি, অত্যাচার বা অপমান করেন। যার কারণে তার মধ্যে যতটুকু  ইতিবাচক এনার্জি ছিল সেটাও ধূলায় মিশিয়ে যায়। অথচ এমতাবস্থায় তার আবেগীয় ভুলগুলো  আলোচনা করে তার ভ্রান্ত বিশ্বাসের ভিত্তির গভীরে গিয়ে তার চিন্তাধারার পরিবর্তন  করলেই তার জীবনধারা বদলে যাবে।          

আমরা তা না করে মানসিক  নির্যাতন করছি। অথচ পিতা-মাতা সন্তানের সবচেয়ে ঘনিষ্ট বন্ধু। ঐ সময় সন্তানের  মানসিক শূন্যতা পূরণের দায়িত্ব পিতা-মাতার। সন্তানের মানসিক বিপর্যয়ের সময় সবচেয়ে  কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন তারাই। এক্ষেত্রে যরূরী বিষয় মনে রাখতে হবে। ‘কি ভুল  করেছে’ সেটার চাইতে গুরুত্বপূর্ণ ‘কেন ভুল করেছে’।  পিন পয়েন্ট সমাধানের পথ তখনই সহজ হবে যাতে  ভবিষ্যতে এমন ভুল আর না ঘটে।           

সন্তানদের কার্যকর সময়  দিতে হবে :           

সফল  মাতা-পিতা  হবার  গুরুত্বপূর্ণ   একটি  কর্তব্য  হ’ল সন্তানদের সময় দেয়া এবং এক ছাদের নিচে এক  সাথে থাকাকে সময় দেয়া বুঝায় না। সন্তান তার ঘরে, আর পিতা-মাতা আরেক ঘরে থাকাকে সময়  দেয়া বুঝায় না। কার্যকর সময় দেয়া মানে সন্তানের সাথে ভাব বিনিময় করা সন্তানের সাথে  পড়াশোনা, ধর্মীয় আলোচনা, নীতি-নৈতিকতা শিক্ষা দেওয়া, গল্প করা, মাসে একবার হ’লেও  পরিবারের সবাইকে নিয়ে বেড়াতে যাওয়া। এ বিষয়ে বাচ্চাদের পরামর্শ চাওয়া, কোথায় গেলে  ভালো হয়, কিভাবে গেলে ভালো হয় ইত্যাদি বিষয়ে তাদের মতামত চাওয়া। এতে সন্তানদের  দায়িত্ববোধ, গুরুত্ববোধ,  সৃষ্টিশীলতা  বৃদ্ধি  পায়।   পিতা-মাতার  সাথে আন্তরিকতা, মুক্তমনে আলোচনার সম্পর্ক ঠিক  থাকে। তখন জমে থাকা অনেক কথা, যে কোন পরামর্শ খোলা-মেলাভাবে পিতা-মাতার সাথে শেয়ার  করতে পারে। এতে বিভিন্ন ভুল সিদ্ধান্ত থেকে সন্তানরা মুক্ত থাকে। অথচ অধিকাংশ  পরিবারে দেখা যায়, বাচ্চাদের বয়স ১২/১৩ বছর হয়ে গেলে তাদের সাথে তেমন কথা-বার্তা  বলা প্রয়োজনবোধ করেন না অভিভাবকরা। অতি প্রয়োজনীয় কথা ছাড়া কথা বলেন না। এমন অনেক  পিতা আছেন সাত দিনে সাতটি কথাও বলেন না। তারা মনে করেন খাওয়া-পরা, স্কুল-কলেজে  পড়ানো, প্রাইভেট টিউটর, পোশাক-পরিচ্ছদ, কম্পিউটার, দামি মোবাইল সব কিছুই তো দেয়া  হচ্ছে। যা চাচ্ছে সবই তো পাচ্ছে। অপূর্ণ তো কিছু রাখা হয়নি। অথচ সন্তান যতই বড় হৌক  তারা চায় পিতা-মাতার আন্তরিক সান্নিধ্য, সাহচর্য, চায় তাদের সাথে প্রাণখুলে কথা  বলতে, চায় অন্তরখোলা ভালবাসা।  এটা  যদি  না  থাকে  তবে  পিতা-মাতার সাথে সন্তানের মানসিক আকর্ষণ তৈরী হবে কিভাবে? রিলেশন থাকে কিভাবে?           

সুতরাং সন্তানদের সময়  দিতেই হবে। একটি সত্য ঘটনা শুনুন।  ৫ম  শ্রেণীতে  অধ্যয়নরত এক প্রখ্যাত চিকিৎসকের সন্তান। তার  পিতা সকালে মেডিকেল কলেজে যান এবং বিকালে প্রাইভেট রোগী দেখেন। রাত প্রায় ১২-টার  দিকে বাসায় ফেরেন। এটি নিত্য ঘটনা। সন্তান বা স্ত্রীকে সুযোগ দেবার সময় পান না।  তার সন্তানটি একদিন বাবার সাথে বিকেলে নভোথিয়েটারে বেড়াতে যেতে চেয়েছিল, পিতা সময়  দিতে পারেননি, রোগী দেখার ব্যাপার আছে। ঐ ছেলে মা, মামা, চাচা, খালুর নিকট থেকে  পাওয়া, এমনকি টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে ছয় হাযার টাকা জমিয়ে একটি খামে ভরে সবিনয়ে পিতাকে  দিয়ে বলেছিল, ‘আববু! এই তোমার ছয় হাযার টাকা’। আগামীকাল তিন ঘণ্টা আমাকে নিয়ে  বিকালে বেড়াতে যাবে। ঐ শিশু হিসাব করে দেখেছে, তিন ঘণ্টায় তার বাবা ঐ পরিমাণ টাকা  আয় করেন। সুতরাং একটি ছোট্ট শিশু আর কি-ই-বা করতে পারে! এর পরেও কি পিতা-মাতাদের  চেতনা ফিরে আসবে না? এত অর্থ সম্পদ কার জন্য? কিসের জন্য এত পরিশ্রম? কিসের জন্য  এত ত্যাগ? পরিবারের তথা সন্তানদের সুখের জন্যই তো? তবে কোথায় সেই সুখ? সুতরাং পিতা-মাতাকে  ভাবতে হবে। সারাজীবন পিতা-মাতার সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত এই সন্তানগুলো যখন বড় হয়ে  বৃদ্ধ পিতা-মাতার প্রতি স্নেহের দৃষ্টি দিতে ভুলে যাবে, ন্যূনতম দায়িত্বটুকু পালন  করতে অবহেলা করবে, তখন হয়ত সেদিনগুলির কথা মনে আসবে। কিন্তু তখন তো আর এসব ভাবনার  কোন মূল্য হবে না। সুতরাং আসুন! এখন থেকেই সাবধান হই।           

শিশুর সামনে ব্যবহারে  সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে :            

শিশুরা ৫ মাস বয়স থেকেই  কথাবার্তা বুঝতে শুরু করে। তাই এ সময় থেকেই শিশুর সামনে সতর্ক থাকতে হবে।  পিতা-মাতা খারাপ আচরণ করলে শিশুর উপর প্রভাব পড়ে। এসময় বাচ্চারা অনুকরণের চেষ্টা  করে। মা জোরে কথা বললে শিশুও জোরে কথা বলতে শিখে। বাবা-মা ঝগড়া করলে সেও ঝগড়াটে  হয়। মা সবসময় ধমকা-ধমকি করলে শিশু বদমেজাজী হয়ে ওঠে। এমনকি শিশুকে মারধর করলে সে  পরে বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশীদের সঙ্গে মারমুখো আচরণ করে। তাই বাবা-মাকে শিশুর  সামনে কথাবার্তা ও ব্যবহারে খুব সাবধানী হ’তে হবে। আর বাবা যদি বদমেজাজী হন, তাহ’লে  ঝগড়ার সময় মাকে পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে। শিশু বড় হয়ে বুঝতে শুরু করলে সে মায়ের  সহনশীলতা ও ধৈর্যশীলতায় মুগ্ধ হবে। তখন মায়ের ঐ গুণগুলো সে নিজেও অর্জন করতে সক্ষম  হবে।           

সুবিবেচক ও দূরদর্শী হ’তে  হবে :           

শিশুর মন বুঝতে হবে। সে  কাঁদলেই মা নাচিয়ে, দুলিয়ে, ধমকিয়ে, শিস বাজিয়ে, কখনও চড়-থাপ্পড় মেরে শান্ত করার  চেষ্টা করেন। অথচ শিশুর কি প্রয়োজন, সেটি বুঝে উঠতে পারেন না। একটু খোঁজ করলেই তার  সমস্যার কারণ মা বের করতে পারেন। এজন্য মাকে বিচক্ষণ হ’তে হবে। মোটকথা শিশুর সামনে  রাগ দেখানো, মারধর, জোরে চিৎকার অযথা ধমকানো থেকে বিরত থেকে দূরদর্শিতার পরিচয়  দিতে হবে। উন্নত জীবন গড়ার জন্য সন্তানের মনোভাব বোঝাটাও একান্ত যরূরী। তাই শৈশব  কাল থেকে সন্তানের মনোভাব বুঝে তার আগ্রহের বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে  পিতা-মাতাকে সুবিবেচনার পরিচয় দিতে হবে।            

সৎসঙ্গ ও সুস্থ পরিবেশে  গড়ে তোলার চেষ্টা করা :           

স্কুল-কলেজে পড়া  অবস্থাতেই অনেক ছাত্রের মধ্যে নেশা করার প্রবণতা দেখা দেয়। নেশাখোর ছাত্ররা অন্য  ভালো ছাত্রদেরও নেশা করায় উদ্বুদ্ধ করে। মা-বাবাকে এ ব্যাপারে সন্তানকে স্কুলে  ভর্তির সময় থেকে সাবধান ও সচেতন করতে হবে। অনেক ছাত্র দল বেঁধে ছাত্রীদের  উত্ত্যক্ত করে। আবার অনেকে ধ্বংসাত্মক রাজনীতি, সন্ত্রাস, ছিনতাইয়ে জড়িত হয়।  ছোটবেলা থেকে এসব অপকর্মের বিষয়ে সচেতন করার দায়িত্ব পিতা-মাতার। আর সব ছাত্র-ছাত্রীই  খারাপ নয়। তাই যেসব ছাত্র লেখাপড়ায় ভালো, নিয়মিত ক্লাস করে, মেধাবী, আচার-আচরণে  ভালো, উচ্চ নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ সম্পন্ন, লেখাপড়ার পাশাপাশি সমাজ সচেতনতামূলক  কার্যক্রমে জড়িত, এমন ভালো ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে তাদের মিশতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।  প্রতিদিন সন্তানের খোঁজ-খবর নিতে সপ্তাহে একবার করে হ’লেও স্কুলে যেতে হবে। পিতা-মাতা  বুঝবেন তার সন্তানের হাল-হকিকত। বস্ত্ততঃ প্রথম থেকেই সন্তানের আদর্শ মনোভাব গড়ার  দায়িত্ব পিতা-মাতার।           

সত্য কথা বলা ও ওয়াদা  পালনের শিক্ষা দেওয়া :          

সদা সত্য কথা বলবে। এ  উপদেশবাণী যতই স্কুলে আওড়ানো হোক না কেন, যখন ঘরে পিতা-মাতাকে মিথ্যা বলতে দেখবে  তখন শিশুটি মিথ্যাকে আর দোষণীয় মনে করবে না। জীবনের যে কোন পরিস্থিতিতে  নির্দ্বিধায় মিথ্যা বলবে। তাই উন্নত জীবনের জন্য পিতা-মাতাকে শিশুর সামনে সত্যের  চর্চা করা কর্তব্য। ওয়াদা পালনের গুণটিও শিশুকাল থেকে শেখানো যরূরী। ওয়াদা পালনের  গুণটি অর্জন করলে দেশ ও সমাজের প্রতি তার দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সে সচেতন হয়।  ভবিষ্যতে লেখাপড়াসহ অন্যান্য যে কোন কাজে সহজে সফল হয় এবং সুনাম অর্জন করে।           

শিশুর সামনে আদর্শ মডেল  তুলে ধরতে হবে :            

শুধু তত্ত্ব কথায় শিশুকে  বোঝানো কষ্টসাধ্য। তাই তার সামনে চরিত্র গঠনের বিষয়গুলো কাহিনী অবলম্বনে শোনালে তা  তার মনে সহজে রেখাপাত করবে। আজকাল অনেকে বাচ্চাদের হাতে কল্পকাহিনী জাতীয় বই তুলে  দিচ্ছেন। এসব বইয়ের গল্পগুলো অবাস্তব, অসত্য ও অলীক। যা শিশুদের বাস্তব জীবন থেকে  দূরে রাখে। বাজারে সত্য কাহিনী অবলম্বনে বিভিন্ন গল্পের বই পাওয়া যায়। এছাড়া  মনীষীদের জীবনকাহিনী, তাদের ধৈর্য, পরিশ্রম ও উন্নত চরিত্রের গল্প ইত্যাদি  শিক্ষণীয় বইপত্র তাদেরকে পড়ে শুনান। অতঃপর পড়তে শিখলে তাদের হাতে সেগুলি তুলে দিন।            

নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত  করে তুলতে হবে :            

বিষয়টি সবশেষে আনা হ’লেও  এটিই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। নৈতিক শিক্ষা দেয়ার পদক্ষেপ শিশুকাল থেকে নিতে হবে।  চরিত্র গঠন ও উন্নত জীবনের জন্য ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করার কোন বিকল্প নেই। এতে  করে শিশুর মনে যে আল্লাহভীতি সৃষ্টি হয়, তা তাকে যে কোন খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে।  বাবা-মাকে সম্মান করা, প্রতিবেশীকে শ্রদ্ধা করা, সৎপথে চলা, ন্যায়ের প্রতি  ভালোবাসা, অন্যায়ের প্রতি ঘৃণাবোধ ইত্যাদি বিষয়গুলো একটি শিশুর জীবনকে সুন্দর করে  তোলে। তবে স্মরণ রাখতে হবে যে, নৈতিক শিক্ষা দেয়ার জন্য পিতা-মাতাকে সর্বাগ্রে  উন্নত নৈতিকতার অধিকারী হ’তে হবে। আর নৈতিক অবক্ষয় থেকে শিশুকে বাঁচানোর একমাত্র  পথ তার হৃদয়ে গভীর ধর্মীয় মূল্যবোধ সৃষ্টি করা।           

নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত  করার জন্য ধর্মীয় কাহিনীগুলো শিশুকে শোনানোর কোন বিকল্প নেই। আজ ইউরোপ-আমেরিকাতেও  একটা সেলাগান বেশি শোনা যাচ্ছে, তা হ’ল Back  to the religion. পাশ্চাত্যের একজন মনীষী তাই বলেছিলেন, ধর্ম বাদে  অন্য কোন শিক্ষাই সৎ মানুষ গড়ার জন্য পরিপূর্ণ শিক্ষা নয়।          

গবেষণার মাধ্যমে শিশুর  মানসিক বিকাশের পথ, চরিত্র উন্নয়নের নানা কর্মকৌশল ও শিশু অপরাধ দমনের আরও অনেক রাস্তা  বের করা সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন সরকারী উদ্যোগ। মোটকথা, বর্তমান সময়ে শুধু  স্কুল-কলেজের উপর ভরসা করে শিশুদের ছেড়ে দিলে আমাদের শিশুরা আদর্শবান উন্নত  মানুষরূপে গড়ে ওঠার পথ থেকে বিচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনা যে কত বেশী, তা আশপাশের সমাজ  চিত্র দেখলেই সহজে অনুমিত হয়। এজন্য শিশুদের মানুষ করার দায়িত্ব নিতে হবে  পিতা-মাতা, অভিভাবক, শিক্ষক সবাইকেই। যেহেতু একজন মা একটি শিশুর সবচেয়ে কাছের এবং  সবচেয়ে বেশী সময় শিশুর পাশে থাকেন, সেহেতু মা-ই পারবেন শিশুকে আদর্শ মানুষরূপে গড়ে  তুলতে। সঙ্গে সঙ্গে বাবার সহযোগিতাও অপরিহার্য। সর্বোপরি প্রয়োজন সরকারের  দূরদৃষ্টি ও কার্যকর শিক্ষানীতি, যার আলোকে একটি শিশু পিতা-মাতা, পরিবার, সমাজ ও  দেশের প্রতি তার দায়িত্ব ও কর্তব্য অনুধাবন করতে পারে।           

একটি মজার কথা বলে আজকের  প্রবন্ধ শেষ করব। এক অভিভাবক সন্তানকে সঠিক নিয়ম-কানূনে মানুষ করতে না পেরে শেষে  তার এক আত্মীয়কে বলছেন, ‘সন্তান কোন কথাই শুনে না। কি আর করব আল্লাহর উপর ছেড়ে  দিয়েছি’। কি আশ্চর্য স্রষ্টা আপনাকে সন্তান দিয়ে মানুষ করার দায়িত্ব আপনার উপর  ছেড়ে দিয়েছেন। আর আপনি আল্লাহর উপর ভরসা করে নিজের করণীয় ছেড়ে দিচ্ছেন। এটা কোন  দায়িত্বশীল সচেতন মানুষের কাজ নয়। নিশ্চয়ই এটি আপনার জন্য পরীক্ষা। আপনি দায়িত্ব  এড়াচ্ছেন কেন? ধৈর্য ধারণ করে সামনে এগিয়ে যেতে সন্তানকে আদর্শ মানুষ করার ব্রত  নিয়ে। তাহ’লে এটা সহজ হবে।

আজ  অধিকাংশ পরিবারে পিতা-মাতার সাথে সন্তানদের দূরত্ব বাড়ছে। ব্যস্ত জীবনের জন্যই  হোক, প্রযুক্তির যুগকে দোষ দিয়েই হোক। ভাবতে হবে সমস্যাটি কোথায়? পারিবারিক  শিক্ষা, সঠিক ধর্মীয় মূল্যবোধ, পিতামাতার দায়িত্ব, শিক্ষকদের মহান ব্রত। সমাজ  সচেতনতার এক সামগ্রিক কার্যক্রম একটি শিশুকে আদর্শ মানুষ হিসাবে গড়ে তুলতে পারে।  আসুন, আমরা যার যার অবস্থান থেকে আদর্শ সন্তান তথা আদর্শ পরিবার ও সমাজ গড়ে তুলি।  আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন!

১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

Back to top button