উত্তম পরিবার
عَنْ سَعْدِ بْنِ أَبِي وَقَّاصٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أَرْبَعٌ مِنَ السَّعَادَةِ: الْمَرْأَةُ الصَّالِحَةُ، وَالْمَسْكَنُ الْوَاسِعُ، وَالْجَارُ الصَّالِحُ، وَالْمَرْكَبُ الْهَنِيءُ، وَأَرْبَعٌ مِنَ الشَّقَاوَةِ: الْجَارُ السُّوءُ، وَالْمَرْأَةُ السُّوءُ، وَالْمَسْكَنُ الضِّيقُ، وَالْمَرْكَبُ السُّوءُ-
অনুবাদ : সা‘দ বিন আবী ওয়াকক্বাছ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, চারটি বস্ত্ত হ’ল সৌভাগ্যের নিদর্শন: পুণ্যবতী স্ত্রী, প্রশস্ত বাড়ী, সৎ প্রতিবেশী ও আরামদায়ক বাহন। আর চারটি বস্ত্ত হ’ল দুর্ভাগ্যের নিদর্শন : মন্দ স্ত্রী, সংকীর্ণ বাড়ী, মন্দ প্রতিবেশী ও মন্দ বাহন।[1]
উক্ত হাদীছে একটি উত্তম পরিবারের জন্য আবশ্যিক বিষয়গুলি বিধৃত হয়েছে। যার মধ্যে ক্রমিকের হিসাবে পুণ্যবতী স্ত্রীকে প্রথমে আনা হয়েছে। এর দ্বারা বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, সকল সম্পদের সেরা সম্পদ হ’ল পুণ্যবতী স্ত্রী। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, الدُّنْيَا مَتَاعٌ وَخَيْرُ مَتَاعِ الدُّنْيَا الْمَرْأَةُ الصَّالِحَةُ ‘দুনিয়াটাই সম্পদ। যার সেরা সম্পদ হ’ল পূণ্যশীলা স্ত্রী’।[2] যার নমুনা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,
أَلَا أُخْبِرُكُمْ بِرِجَالِكُمْ مِنْ أَهْلِ الْجَنَّةِ؟ قَالُوا: بَلَى يَا رَسُولَ اللهِ، قَالَ: النَّبِيُّ فِي الْجَنَّةِ، وَالصِّدِّيقُ فِي الْجَنَّةِ، وَالشَّهِيدُ فِي الْجَنَّةِ، وَالْمَوْلُودُ فِي الْجَنَّةِ، وَرَجُلٌ زَارَ أَخَاهُ فِي نَاحِيَةِ الْمِصْرِ يَزُورُهُ فِي اللهِ فِي الْجَنَّةِ، وَنِسَاؤُكُمْ مِنْ أَهْلِ الْجَنَّةِ الْوَدُودُ الْعَؤُودُ عَلَى زَوْجِهَا، الَّتِي إِذَا غَضِبَ جَاءَتْ حَتَّى تَضَعَ يَدَهَا فِي يَدِهِ، ثُمَّ تَقُولُ: لَا أَذُوقُ غَمْضًا حَتَّى تَرْضَى-
‘আমি কি তোমাদেরকে জান্নাতী লোকদের বিষয়ে খবর দিব না? নবী জান্নাতী, ছিদ্দীক জান্নাতী, শহীদ জান্নাতী, ভূমিষ্ট সন্তান জান্নাতী, ঐ ব্যক্তি জান্নাতী যে স্রেফ আল্লাহকে খুশী করার জন্য শহরের এক কোণে বসবাসকারী ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এবং ঐ স্ত্রী জান্নাতী, যে তার স্বামীর প্রতি সর্বাধিক প্রেমময়ী, অধিক সন্তান দায়িনী ও স্বামীর দিকে অধিক প্রত্যাবর্তনকারিনী। স্বামী অসন্তুষ্ট হ’লে সে দ্রুত ফিরে আসে ও স্বামীর হাতে হাত রেখে বলে, আপনি খুশী না হওয়া পর্যন্ত আমি ঘুমের স্বাদ নেব না।[3]
অন্যদিকে উত্তম স্বামী সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, أَكْمَلُ الْمُؤْمِنِينَ إِيمَانًا أَحْسَنُهُمْ خُلُقًا وَخِيَارُكُمْ خِيَارُكُمْ لِنِسَائِهِمْ ‘পূর্ণ মুমিন সেই যার চরিত্র সবচেয়ে সুন্দর। আর তোমাদের মধ্যে উত্তম সেই যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম’।[4] অন্যত্র তিনি বলেন, خَيْرُكُمْ خَيْرُكُمْ لأَهْلِهِ وَأَنَا خَيْرُكُمْ لأَهْلِى ‘তোমাদের মধ্যে উত্তম সেই যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম। আর আমি আমার স্ত্রীদের কাছে উত্তম’।[5] বুঝা গেল যে, জান্নাতী হওয়ার জন্য স্বামী ও স্ত্রী উভয়ের জন্য উভয়ের সাক্ষ্য প্রয়োজন।
এজন্য বিবাহের পূর্বে দ্বীনদার স্বামী ও স্ত্রী বাছাই করা একান্ত কর্তব্য। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) অন্য সবকিছু ছাড় দিয়ে দ্বীনকে অগ্রাধিকার দেবার নির্দেশ দিয়েছেন।[6] তিনি বলেন, যখন এমন কোন ছেলে তোমাদের কাছে বিয়ের পয়গাম নিয়ে আসে, যার দ্বীন ও চরিত্র সম্পর্কে তোমরা খুশী হবে, তাহলে মেয়েকে তার কাছে বিয়ে দাও। যদি তা না দাও, তাহলে পৃথিবীতে ফিৎনা ও বিশৃংখলা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়বে’।[7] আল্লাহ বলেন,الْخَبِيثَاتُ لِلْخَبِيثِينَ وَالْخَبِيثُونَ لِلْخَبِيثَاتِ وَالطَّيِّبَاتُ لِلطَّيِّبِينَ وَالطَّيِّبُونَ لِلطَّيِّبَاتِ أُولَئِكَ مُبَرَّءُوْنَ مِمَّا يَقُولُونَ لَهُمْ مَغْفِرَةٌ وَرِزْقٌ كَرِيمٌ ‘দুষ্টু নারী দুষ্টু পুরুষের জন্য ও দুষ্টু পুরুষ দুষ্টু নারীর জন্য এবং পবিত্রা নারী পবিত্র পুরুষের জন্য ও পবিত্র পুরুষ পবিত্রা নারীর জন্য। লোকেরা যা বলে এরা সেসব থেকে মুক্ত। এদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও সম্মানজনক রূযী’ (নূর ২৪/২৬)।
শ্রেষ্ঠ স্ত্রীর ব্যাখ্যা দিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,المَرْأةُ الصَّالِحَةُ تَراها فَتُعْجِبُكَ وَتَغِيبُ عَنْها فَتَأْمَنُها على نَفْسِها ومالِكَ ‘পূণ্যশীলা স্ত্রী সেই, যাকে দেখলে তুমি খুশী হও। তোমার অসাক্ষাতে তুমি তার ব্যাপারেও তোমার মাল-সম্পদের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাক।[8]
২. বর্ণিত হাদীছে উত্তম পরিবারের জন্য দ্বিতীয় স্থানে রাখা হয়েছে প্রশস্ত বাড়ী (وَالْمَسْكَنُ الْوَاسِعُ)। অন্য বর্ণনায় এসেছে ‘প্রশস্ত ও বহুবিধ সুবিধা সম্পন্ন বাড়ী’ (الدَّارُ تَكُونُ واسِعَةً كَثِيرةَ المَرافِقِ)।[9] অর্থাৎ যে বাড়ীতে কিচেন, বাথরুম, টয়লেট, অতিথি কক্ষ, পাঠকক্ষ, খাবার কক্ষ, ইবাদত খানা, লাইব্রেরী, খোলা বারান্দা, বাগান-পুকুর, গাড়ী ঘর, কর্মচারী কক্ষ, হাস-মুরগীর ঘর, গরু-বকরীর গোয়াল ইত্যাদি নিত্য প্রয়োজনীয় সবকিছু রয়েছে, সর্বোপরি যে বাড়ীর চারদিকে খোলামেলা ও আলো-বাতাসে ভরা সেটাকে ‘বহুবিধ সুবিধাসম্পন্ন বাড়ী’ বলা চলে।
সেই সাথে এ যুগের আবিষ্কৃত এসি, ফ্রিজ, কুকার, ওভেন, ফ্যান, লাইট, ওয়াশিং মেশিন, আনুষঙ্গিক বিষয় সমূহ কোন বিলাস সামগ্রী নয়, বরং নিঃসন্দেহে অবশ্য প্রয়োজনীয় বস্ত্ত সমূহের অন্তর্ভুক্ত। এগুলিকে তাক্বওয়া বিরোধী মনে করা ঠিক নয়। সামর্থ্য থাকলে এগুলি দ্বারা বাড়ীকে সর্বাধিক সুবিধা মন্ডিত করা দোষণীয় নয়। যদি না সেখানে কোনরূপ বিলাসিতা ও অপচয় থাকে এবং গর্ব ও অহংকার প্রকাশ উদ্দেশ্য না হয়। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, إِنَّ اللهَ يُحِبَّ أَنْ يُرَى أَثَرُ نِعْمَتِهِ عَلَى عَبْدِهِ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তার বান্দার উপরে তার নে‘মতের নিদর্শন দেখতে ভালবাসেন’।[10] তবে এগুলির জন্য ঋণ করা জায়েয নয়। কেননা ঋণগ্রস্তের জানাযা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) পড়েননি। এমনকি শহীদের সবকিছু মাফ হলেও তার ঋণ মাফ হয় না।[11]
উত্তম বাড়ীর জন্য কেবল ভৌতকাঠামোই যথেষ্ট নয়। বাড়ীটি হ’তে হবে আল্লাহর রহমতে পূর্ণ ও শয়তান হ’তে মুক্ত। এজন্য বাড়ীটিকে সর্বদা (১) আল্লাহর যিকরে পূর্ণ রাখতে হবে। বাড়ীতে প্রবেশকালে ও বের হবার সময় এবং ঘুমানোর সময় ছহীহ হাদীছের দো‘আ সমূহ পাঠ করবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, যখন কেউ গৃহে প্রবেশকালে এবং খাবার সময় বিসমিল্লাহ বলে, তখন শয়তান তার সাথীদের বলে, আজ তোমাদের এ বাড়ীতে থাকার ও খাওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু যখন সে আল্লাহর নাম স্মরণ করে না, তখন শয়তান খুশী হয়ে বলে আজ তোমাদের এ বাড়ীতে থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা হ’ল’।[12] আর বের হওয়ার সময় দো‘আ পড়লে শয়তান এক পাশে সরে যায় ও তার সাথী আরেক শয়তানকে বলে, লোকটি হেদায়াত প্রাপ্ত হ’ল এবং তার জন্য যথেষ্ট হ’ল ও সে বেঁচে গেল’।[13] এতদ্ব্যতীত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বাড়ীতে প্রবেশ করার পর প্রথমে মিসওয়াক করতেন।[14] তিনি বলেন, যে বাড়ীতে আল্লাহর স্মরণ করা হয় ও যে বাড়ীতে হয় না, দু’টির তুলনা জীবিত ও মৃতের ন্যায়’।[15] এজন্য ফরয ব্যতীত সকল সুন্নাত ও নফল ছালাত বাড়ীতে পড়া উত্তম। ছাহাবায়ে কেরাম সর্বদা এতে আকাংখী থাকতেন। পরিবারের কোন সদস্য সকালে কুরআন তেলাওয়াত না করে ঘর থেকে বের হবে না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, তোমরা তোমাদের বাড়ীগুলিকে কবর বানিয়ো না। কেননা শয়তান ঐ বাড়ীতে প্রবেশ করে না, যে বাড়ীতে সূরা বাক্বারাহ পাঠ করা হয়।[16] বিশেষ করে বাক্বারাহর শেষ দু’টি আয়াত পরপর তিন দিন পাঠ করলে শয়তান সে বাড়ীর নিকটবর্তী হয় না’।[17]
এতদ্ব্যতীত বাড়ীকে পাপমুক্ত রাখতে হবে। যেমন বাড়ীতে ছবি-মূর্তি টাঙানো, গায়ের মাহরাম নারী-পুরুষের অবাধ প্রবেশ, গান-বাজনা, গীবত-তোহমত, চোখলখুরী ইত্যাদি থেকে মুক্ত রাখা। সর্বদা উন্নত চিন্তা, নিঃস্বার্থ ভালোবাসা, পারস্পরিক সহানুভূতি ও সহমর্মিতা, উন্নত চরিত্র মাধুর্য ও ধর্ম চর্চার মাধ্যমে বাড়ীকে পবিত্র রাখতে হবে।
৩. উত্তম প্রতিবেশী : আলোচ্য হাদীছে উত্তম পরিবারের জন্য তৃতীয় আবশ্যকীয় বিষয় হিসাবে আনা হয়েছে উত্তম প্রতিবেশীকে। অথচ প্রতিবেশী কখনো পরিবারের অংশ নয়। তবুও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একে পরিবারের জন্য সৌভাগ্যের নিদর্শন বলেছেন। কারণ উত্তম প্রতিবেশী না থাকলে কোন পরিবার একাকী উত্তম থাকতে পারে না। প্রত্যেক মানুষই পরমুখাপেক্ষী। আর এজন্য সে সবচাইতে বেশী মুখাপেক্ষী হ’ল তার নিকটতম ব্যক্তির। অতঃপর তার নিকটতম প্রতিবেশীর।
সেকারণ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, জিব্রীল আমাকে প্রতিবেশীর ব্যাপারে একাধারে অছিয়ত করছিলেন। তাতে আমার ধারণা হচ্ছিল যে, হয়ত তিনি আমাকে সত্বর তাকে ওয়ারিছ করার নির্দেশনা দিবেন’।[18] তিনি বলেন, আল্লাহর কসম সে মুমিন নয়, (৩ বার), যার অনিষ্ট হ’তে তার প্রতিবেশী নিরাপদ নয়’।[19] তিনি বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও বিচার দিবসে ঈমান রাখে, সে যেন প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়’।[20] তিনি আরও বলেন, ঐ ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যে ব্যক্তির অনিষ্টকারিতা হ’তে তার প্রতিবেশী নিরাপদ নয়’।[21]
প্রতিবেশী তার বহুবিধ গোপন ও প্রকাশ্য বিষয়ের প্রত্যক্ষ সাক্ষী থাকেন। সেকারণ তিনি উপকারও করতে পারেন বেশী। আবার ক্ষতিও করতে পারেন বেশী। প্রতিবেশী সৎ হলে তার অসাক্ষাতেই তিনি উপকার করেন আল্লাহকে খুশী করার জন্য। এতে তিনি সবচেয়ে বেশী নেকী উপার্জন করতে পারেন। একইভাবে তিনি ক্ষতিও করতে পারেন বেশী। তাতে তিনি সর্বাধিক পাপের ভাগীদার হন। তাই বাসস্থান নির্ধারণের আগে প্রতিবেশী নির্ধারণ আবশ্যক।
পুণ্যশীলা স্ত্রী বা কন্যা অতক্ষণ পুণ্যশীলা থাকতে পারেন, যতক্ষণ তিনি পর্দার মধ্যে থাকেন। গায়ের মাহরাম নিকটাত্মীয় পুরুষ, নিকটতম বন্ধু ও নিকটতম প্রতিবেশী দ্বারাই মহিলারা দ্রুত বিপথে যায়। সেকারণেই স্বামীর ছোট ভাই অর্থাৎ দেবরকে হাদীছে ‘মৃত্যু’ (الْحَمْوُ الْمَوْتُ ) বলা হয়েছে।[22] কারণ তার মাধ্যমে খুব সহজে ঐ মহিলার ইযযতের মৃত্যু হতে পারে। একইভাবে স্বামীর বা নিজের নিকটাত্মীয়, নিকটতম বন্ধু বা প্রতিবেশী কর্তৃক সেটা সহজে সম্ভব। নিকটাত্মীয় পুরুষ বা প্রতিবেশীর সঙ্গে নিতান্ত প্রয়োজনে পর্দার মধ্যে থেকে কথা বলা যাবে, ঠিক যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু। কোনরূপ কথা ও সাক্ষাৎ ছাড়াই সন্তান বা শিশুদের মাধ্যমে আপ্যায়ন করতে হবে। এতে উভয় পক্ষ অভ্যস্ত হয়ে গেলে আর কোন সমস্যা হবে না। আর এই অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য সংসারে স্বামী-স্ত্রীকে দৃঢ়চিত্ত হতে হবে। সাথে পরিবারের অন্য সদস্যরাও সহযোগিতা করবেন। প্রতিবেশীরাও এতে অভ্যস্ত হবেন। কেউ পর্দা রক্ষাকে মান-অপমানের ইস্যু করবেন না। বরং পর্দার ফরয পালন করায় খুশী হবেন ও অন্যকে উৎসাহিত করবেন।
৪. আরামদায়ক বাহন (الْمَرْكَبُ الْهَنِيءُ ) :
অন্য বর্ণনায় এসেছে, (الْمَرْكَبُ الصَّالِحُ) ‘স্বচ্ছন্দ বাহন’।[23] উত্তম পরিবারের জন্য এটি অন্যতম অবশ্য প্রয়োজনীয় বিষয়। যুগের সহজপ্রাপ্য বাহন একটি পরিবারকে সদা স্বচ্ছন্দ রাখে। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সৌভাগ্যের নিদর্শন হিসাবে বলেন,الدَّابَةُ تَكُونُ وَطِيئَةً فَتُلْحِقُكَ بأصْحابِكَ ‘বাহন এমন স্বচ্ছন্দ হবে যা তোমাকে তোমার বন্ধুদের সাথে মিলিত করবে’।[24] একটি উত্তম বাহন মানুষের বিপদে ও প্রয়োজনে সর্বাবস্থায় কাজে লাগে। অতএব স্বচ্ছন্দ ও দ্রুত বাহন একটি উত্তম পরিবারের আবশ্যিক অনুষঙ্গ। তবে সবকিছুই নির্ভর করে সামর্থ্যের উপর ও সুযোগ-সুবিধার উপর। হালাল ও বৈধ পথে যতটুকু পাওয়া যায়, ততটুকুতে সন্তষ্ট থাকতে হবে। না পেলে ধৈর্যধারণ করতে হবে এবং আল্লাহর রহমত কামনা করতে হবে।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, পবিত্র রূহ জিব্রীল আমাকে গোপন প্রত্যাদেশ করেছেন যে, কোন প্রাণী মৃত্যুবরণ করে না তার রিযিক পূর্ণ না করা পর্যন্ত। অতএব সাবধান! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সুন্দর পন্থায় তা সন্ধান কর। আর রিযিক দেরীতে আসার কারণে তোমাদেরকে যেন আল্লাহর অবাধ্যতার মাধ্যমে তা অর্জনে প্ররোচিত না করে। কেননা আল্লাহর নিকটে যা আছে, তা তাঁর আনুগত্য ব্যতীত পাওয়া যায় না।[25]
সৌভাগ্যের নিদর্শন হিসাবে আলোচ্য হাদীছে বর্ণিত চারটি বস্ত্তর প্রত্যেকটিই মানবজীবনে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। যদি কারু ভাগ্যে আল্লাহ চারটি বস্ত্তই রেখে থাকেন, তবুও সুখী পরিবার হওয়ার জন্য তাদেরকে পূর্ণরূপে আল্লাহর উপর ভরসা করতে হবে এবং তাঁর প্রদত্ত ভাল-মন্দ তাক্বদীরের উপর সন্তুষ্ট থাকতে হবে। হযরত ওমর (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি যে, যদি তোমরা আল্লাহর উপর সত্যিকারভাবে ভরসা কর, তাহ’লে তিনি তোমাদেরকে এমনভাবে রূযী দিবেন যেমনভাবে পক্ষীকুলকে দিয়ে থাকেন। তারা সকালে ওঠে ক্ষুধার্ত অবস্থায় এবং সন্ধ্যায় ফেরে তৃপ্ত হয়ে’।[26]
ছোহায়েব রূমী (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, মুমিনের ব্যাপারটি কতই না বিস্ময়কর! তার সমস্ত কাজই তার জন্য কল্যাণকর। আর এটা মুমিন ব্যতীত কারু জন্য সম্ভব নয়। যদি তার কোন আনন্দ স্পর্শ করে, সে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে। এটা তার জন্য কল্যাণকর হয়। আর যদি তার কোন মন্দ স্পর্শ করে, সে ছবর করে। আর এটাও তার জন্য কল্যাণকর হয়’।[27]
৫. উত্তম পরিবার প্রধান ও সদস্যবর্গ :
অন্যান্য হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, উত্তম পরিবারের জন্য চাই উত্তম পরিবার প্রধান। ইসলামী পরিবারে পিতা হ’লেন পরিবার-প্রধান এবং মাতা হ’লেন গৃহকত্রী। সন্তানরা বড় হ’লে তারা হবে পিতা-মাতার সাহায্যকারী ও পরামর্শদাতা। সকলে মিলে বাড়ীকে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে, যেন দিবারাত্রি সর্বদা রহমতের ফেরেশতা সেটিকে ঘিরে রাখে। আল্লাহর বিশেষ প্রশান্তি নাযিল হয় এবং যে বাড়ীর সদস্যদের নিয়ে আল্লাহ তাঁর নিকটবর্তী ফেরেশতাদের নিকট গর্ব করতে পারেন। এজন্য সর্বাগ্রে পরিবার-প্রধান হিসাবে পিতাকে ‘উত্তম আদর্শ’ হতে হবে। অতঃপর মাতা, বড় ভাই, বড় বোন সবাইকে সমভাবে। সকলের জন্য উত্তম আদর্শ হলেন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)। যেমন আল্লাহ বলেন, لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُوْلِ اللهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُو اللهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللهَ كَثِيْرًا ‘নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ নিহিত রয়েছে আল্লাহর রাসূলের মধ্যে, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও বিচার দিবসকে কামনা করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে’ (আহযাব ৩৩/২১)।
পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে শান্তি ও শৃংখলা বিধানের জন্য তাঁর ঘোষিত চিরন্তন মূলনীতি হ’ল, বড়কে সম্মান করা ও ছোটকে স্নেহ করা। যেমন তিনি বলেন, مَنْ لَمْ يَرْحَمْ صَغِيرَنَا وَيَعْرِفْ حَقَّ كَبِيرِنَا فَلَيْسَ مِنَّا ‘যে ব্যক্তি আমাদের ছোটদের স্নেহ করে না ও বড়দের হক বুঝে না’। তিরমিযীর বর্ণনায় এসেছে, شَرَفَ كَبِيْرِنَا যে আমাদের বড়দের মর্যাদা বুঝে না, সে আমাদের দলভুক্ত নয়’।[28] তিনি বলেন, বৃদ্ধ মুসলিমকে সম্মান করা, কুরআনের বাহক অর্থাৎ হাফেয-ক্বারী ও তাফসীরকারকে সম্মান করা, যিনি তার হক আদায়ে বাড়াবাড়ি ও ত্রুটি করেন না এবং ন্যায়পরায়ণ শাসককে সম্মান করা, আল্লাহকে সম্মান প্রদর্শনের অন্তর্ভুক্ত’।[29]
তিনি বলেন, আল্লাহর সন্তুষ্টি রয়েছে পিতার সন্তুষ্টির মধ্যে এবং আল্লাহর অসন্তুষ্টি রয়েছে পিতার অসন্তুষ্টির মধ্যে’।[30] জনৈক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমি কার প্রতি সর্বাধিক সুন্দর আচরণ করব? তিনি বললেন, তোমার মায়ের প্রতি (৩ বার)। অতঃপর বললেন, তোমার পিতার প্রতি। অতঃপর নিকটতমদের প্রতি পর্যায়ক্রমে’।[31] তিনি বলেন, আল্লাহ বলেছেন, আমি আল্লাহ আমি রহমান। আমি ‘রেহম’ (মাতৃগর্ভ) সৃষ্টি করেছি এবং আমার নাম থেকে তার নামকরণ করেছি। অতএব যে ব্যক্তি রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়তা সংযুক্ত রাখবে আমি তাকে (আমার রহমতের মধ্যে) যুক্ত করে নেব। আর যে ব্যক্তি তা ছিন্ন করবে, আমিও তাকে বিচ্ছিন্ন করে দেব’।[32] তিনি বলেন, আত্মীয়তা সম্পর্ক ছিন্নকারী ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না’।[33]
উপরের হাদীছগুলি পিতা-মাতার মাধ্যমে সৃষ্ট একটি পরিবারের পরস্পরে শক্ত বন্ধনে আবদ্ধ করেছে। আর পরিবার হ’ল সমাজের প্রাথমিক ইউনিট। পরিবার যদি সুন্দর হয়, সমাজ সুন্দর হবে। আর পরিবার নষ্ট হলে সমাজ নষ্ট হয়। অতএব বিয়ে-শাদী করার সময় অবশ্যই প্রথমে উত্তম পরিবার দেখতে হবে।
৬. সন্তান পালন :
উত্তম পরিবারের অন্যতম প্রধান নিদর্শন হ’ল উত্তম সন্তানাদি। এদের মাধ্যমেই পরিবারের আদর্শ ও বৈশিষ্ট্য প্রকাশিত হয়। পরিবারের কৃষ্টি ও সংস্কৃতি বিকশিত হয়। তাই সন্তানকে শিশুকাল থেকেই ইসলামী কৃষ্টি-কালচার অনুযায়ী গড়ে তোলা পিতা-মাতা ও অভিভাবকদের উপর অপরিহার্য দায়িত্ব। বন্ধুকে দেখে যেমন রন্ধুকে চেনা যায়। তেমনি সন্তানকে দেখে বাপ-মাকে চেনা যায়। অতএব এ বিষয়ে পিতা-মাতা যেমন সজাগ হবেন, সন্তানদেরও তেমনি সজাগ থাকতে হবে। যেন নিজেদের কোন ভুলের জন্য বাপ-মা ও বংশের বদনাম না হয়। পরিবারে একজন বদনামগ্রস্ত হলে পুরা পরিবার ও বংশ বদনামগ্রস্ত হয়। এই বদনাম যুগ যুগ ধরে চলে। যার অভিশাপ পোহাতে হয় পরবর্তী বংশধরগণকে। একজনের অন্যায়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সকলে। সেকারণ পরিবারের প্রত্যেক সদস্যকে উত্তম পরিবার গড়ার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। অবশ্য আল্লাহর বিধান মানতে গিয়ে পারিবারিক রসম বর্জন করায় কোন বদনাম নেই। বরং সেটাই সুনাম। কিন্তু অনেকে এটা বুঝতে পারে না। বরং বাপ-দাদা ও পারিবারিক রেওয়াজের দোহাই দিয়ে কুফর এবং শিরক ও বিদ‘আতের পাপে ডুবে থাকে। এতে তাদের ইহকাল রক্ষা হলেও পরকাল ধ্বংস হয়।
আল্লাহ বলেন, قُلْ هَلْ نُنَبِّئُكُمْ بِالْأَخْسَرِينَ أَعْمَالًا- الَّذِينَ ضَلَّ سَعْيُهُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَهُمْ يَحْسَبُونَ أَنَّهُمْ يُحْسِنُونَ صُنْعًا- أُولَئِكَ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا بِآيَاتِ رَبِّهِمْ وَلِقَائِهِ فَحَبِطَتْ أَعْمَالُهُمْ فَلَا نُقِيمُ لَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَزْنًا ‘তুমি বল, আমি কি তোমাদের খবর দিব ক্ষতিগ্রস্ত আমলকারীদের সম্পর্কে’? ‘পার্থিব জীবনে যাদের সকল কর্ম নিস্ফল হয়েছে। অথচ তারা ভাবে যে, তারা সৎকর্ম করেছে’। ‘ওরা হ’ল তারাই, যারা তাদের প্রতিপালকের আয়াত সমূহ ও তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎকে অস্বীকার করেছে। ফলে তাদের সকল কর্ম বরবাদ হয়েছে। অতএব আমরা ক্বিয়ামতের দিন তাদের জন্য মীযানের পাল্লা খাড়া করব না’ (কাহফ ১৮/১০৩-০৫)।
পরিবারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হ’ল সন্তান। সন্তানকে শিশু অবস্থায় গড়ে না তুললে বড় অবস্থায় খুব কমই ফেরানো যায়। এজন্যই ইসলামের বিধান, مُرُوا أَوْلاَدَكُمْ بِالصَّلاَةِ وَهُمْ أَبْنَاءُ سَبْعِ سِنِينَ وَاضْرِبُوهُمْ عَلَيْهَا وَهُمْ أَبْنَاءُ عَشْرِ سِنِينَ وَفَرِّقُوا بَيْنَهُمْ فِى الْمَضَاجِعِ ‘তোমরা তোমাদের সন্তানদের সাত বছর বয়সে ছালাতের নির্দেশ দাও। দশ বছর বয়সে এজন্য প্রহার কর এবং তাদের বিছানা পৃথক করে দাও’।[34]
কেবল শিশুরাই নয়, বরং পরিবারের সবাই যেন নিয়মিত ছালাতে অভ্যস্ত হয়, সে বিষয়ে আল্লাহ বলেন, وَأْمُرْ أَهْلَكَ بِالصَّلاَةِ وَاصْطَبِرْ عَلَيْهَا لاَ نَسْأَلُكَ رِزْقًا نَحْنُ نَرْزُقُكَ وَالْعَاقِبَةُ لِلتَّقْوَى ‘তুমি তোমার পরিবারকে ছালাতের আদেশ দাও এবং এর উপর তুমি নিজে অবিচল থাক। আমরা তোমার নিকট রিযিক চাই না। বরং আমরাই তোমাকে রিযিক দিয়ে থাকি। আর শুভ পরিণাম কেবল আল্লাহভীরুদের জন্য’ (ত্বোয়াহা ২০/১৩২)। এর দ্বারা বুঝা যায় যে, অর্থ-সম্পদে ধনী হওয়ার চাইতে আল্লাহভীরুতায় ধনী হওয়াটাই আল্লাহর কাম্য। নিঃসন্দেহে এর মধ্যে রয়েছে মানবতার সর্বোচ্চ মর্যাদা। নইলে ধন-সম্পদ তো চোর-গুন্ডাদেরই বেশী। কিন্তু সমাজে তাদের মর্যাদা কোথায়?
অন্যকে দেখে শেখা : এটি পরিষ্কার যে, পরিবার প্রধানকেই আদর্শবান ও কর্তব্যনিষ্ঠ হতে হয়। নইলে সন্তান ছন্নছাড়া হয়ে যায়। পরিণামে পিতাই লজ্জিত হন বেশী। কিন্তু সন্তান যখন বড় হয়ে যায় তখন তাকে সর্বদা হাতে-নাতে সবকিছু শিখানো কর্মব্যস্ত পিতা-মাতার পক্ষে অনেক সময় সম্ভব হয় না। এমতাবস্থায় তাদের অনেক কিছু দেখে শিখতে হয়। এ প্রসঙ্গে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, السَّعِيدُ مَنْ وُعِظَ بِغَيْرِهِ وَالشَّقِىُّ مَنْ شَقِىَ فِى بَطْنِ أُمِّهِ- ‘সৌভাগ্যবান সেই, যে অন্যের উপদেশ গ্রহণ করে এবং হতভাগা সেই যে মায়ের পেট থেকে হতভাগা হয়ে ভূমিষ্ট হয়’।[35] লোকমান নবী ছিলেন না। অথচ নির্বোধদের দেখেই তিনি সংযত হন ও সেই প্রজ্ঞা থেকেই তিনি বিশ্ববিখ্যাত জ্ঞানী ব্যক্তিতে পরিণত হন। কুরআনে তার নামে একটি সূরা নাযিল হয়। যেখানে সন্তানদের প্রতি লোকমানের মূল্যবান উপদেশসমূহ বর্ণিত হয়েছে (লোকমান ৩১/১৩-১৯)।
মনে রাখতে হবে, সন্তানের আক্বীদা ও আচরণের ভিত শিশুকালেই গড়ে দিতে হবে। নইলে একটি শিশুর আক্বীদা বিনষ্ট করা তাকে জীবন্ত হত্যা করার চাইতে বড় পাপ। তাই শিশুকালে সঠিক আক্বীদার ভিত একবার মযবুত হয়ে গেলে বয়সকালে সাধারণতঃ সে বিভ্রান্ত হয় না।
কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া এযুগে শিক্ষার জন্য সন্তানকে বাড়ী থেকে বের করতেই হয়। তাই সুশিক্ষা ও সুন্দর লালন-পালনের মুখ্য দায়িত্ব পড়ে যায় মূলতঃ শিক্ষকদের উপর। সেই সাথে চাই উন্নত আবাসিক পরিবেশ। সেজন্য উচ্চমানের শিক্ষক ও মানুষ তৈরীর উপযোগী উত্তম পরিবেশে সন্তানকে সুশিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত করে গড়ে তোলা অভিভাবকদের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব।
শিক্ষার বিষয়বস্ত্ত যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি সন্তানের বন্ধু কারা, সেদিকেও দৃষ্টি রাখাটা গুরুত্বপূর্ণ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, الْمَرْءُ عَلَى دِينِ خَلِيلِهِ فَلْيَنْظُرْ أَحَدُكُمْ مَنْ يُخَالِلُ ‘মানুষ তার বন্ধুর আদর্শে গড়ে ওঠে। অতএব তোমাদের লক্ষ্য রাখা উচিত কার সাথে বন্ধুত্ব করবে’।[36] তিনি বলেন, لاَ تُصَاحِبْ إِلاَّ مُؤْمِنًا وَلاَ يَأْكُلْ طَعَامَكَ إِلاَّ تَقِىٌّ ‘ঈমানদার ব্যতীত কাউকে সাথী বানিয়ো না। আর আল্লাহভীরু ব্যতীত কেউ যেন তোমার খাদ্য না খায়’।[37]
মু‘আল্লাক্বা খ্যাত কবি ত্বরাফাহ আল-বিকরী বলেন,
عَنِ الْمَرْءِ لاَ تَسْأَلْ وَسَلْ عَنْ قَرِيْنِهِ + فَكُلُّ قَرِيْنٍ بِالْمُقَارِنِ يَقْتَدِيْ
‘ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করো না, বরং তার বন্ধু সম্পর্কে জিজ্ঞেস কর। কেননা প্রত্যেক বন্ধু তার বন্ধুর অনুসরণ করে থাকে’।[38]
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্বীয় চাচাতো ভাই কিশোর বালক আব্দুল্লাহ ইবনু আববাসকে স্বীয় বাহনের পিছনে বসিয়ে (চলার পথে) উপদেশ দেন, হে বৎস! আল্লাহর বিধান সমূহের হেফাযত কর তিনি তোমাকে হেফাযত করবেন। আল্লাহর বিধানের হেফাযত কর, তুমি সর্বদা তাঁকে তোমার সম্মুখে পাবে। তুমি কিছু চাইলে আল্লাহর কাছে চাইবে। সাহায্য চাইলে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইবে। জেনে রেখ, যদি পুরা সৃষ্টিজগত একত্রিত হয়ে তোমার কোন উপকার করতে চায়, তবুও তারা আল্লাহর পূর্ব নির্ধারিত পরিমাণ ব্যতীত তোমার কোন উপকার করতে পারবে না। পক্ষান্তরে যদি সমস্ত সৃষ্টিজগত একত্রিত হয়ে তোমার কোন ক্ষতি করতে চায়, তবুও তারা আল্লাহর পূর্ব নির্ধারিত পরিমাণ ব্যতীত তোমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। তাক্বদীর লিপিবদ্ধ হওয়ার পর কলম উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং দফতরসমূহ শুকিয়ে গেছে (অর্থাৎ তাক্বদীর পরিবর্তন হবে না)।[39]
উক্ত উপদেশের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বালক ইবনু আববাসকে আল্লাহর বিধান মান্য করা, সর্বাবস্থায় তার সাহায্য কামনা করা এবং তাক্বদীর বিষয়ে সুস্পষ্ট শিক্ষা প্রদান করেছেন। যাতে এর ফলে ঐ বালক তার বাকী জীবনে শয়তানের গোলামী হ’তে মুক্ত থাকে। আলহামদুলিল্লাহ! ঐ বালকটিই পরবর্তীকালে হয়েছিলেন সর্বাধিক বিজ্ঞ মুফাসসিরে কুরআন যাঁকে ছাহাবীগণের মধ্যে রঈসুল মুফাসসেরীন বা কুরআন ব্যাখ্যাকারদের নেতা বলে অভিহিত করা হয়। অতএব আসুন! আমরা উত্তম সন্তান ও পরিবার গড়ার মাধ্যমে উত্তম সমাজ গড়ায় সচেষ্ট হই। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দিন- আমীন!
ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব