মানবাধিকার ও ইসলাম : সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ব্যতীত কাউকে বন্দী/আটক রাখা নিষিদ্ধ

সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া কাউকে বন্দী করা বা অন্তরীণ রাখা নিষিদ্ধ :
Article-9. No one shall be subjected to arbitrary arrest, detention or exile.[1] ‘কোন ব্যক্তিকে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া বন্দী, আটক বা অন্তরীণ রাখা যাবে না’ (অনুঃ ৯)।
অর্থাৎ জাতিসংঘ সার্বজনীন মানবাধিকার সনদের ৯নং অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে, কোন ব্যক্তিকে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া বন্দী, আটক বা অন্তরীণ (কারারুদ্ধ) রাখা যাবে না। যদি রাখা হয় তা হবে মানবাধিকার পরিপন্থী। এ ধারার প্রথমাংশে `Complain’ বা ‘অভিযোগ’ শব্দটির যে সংযোজন করা হয়েছে তা ব্যাখ্যাসাপেক্ষ ও সমালোচনামূলক। কারণ উক্ত ধারাতেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে কেবল অভিযোগ থাকলেই তাকে গ্রেফতার, আটক বা কারারুদ্ধ রাখা যাবে, অন্যথা নয়। সুতরাং এখানে অভিযোগ (Complain) কি এবং কোন কোন অভিযোগের ভিত্তিতে কাউকে আটক করা বা আটকাদেশ (Detantion) দেয়া যায়, তা খতিয়ে দেখা দরকার। যেমন এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ফৌজদারী আইনের ৫৪ (১) ধারায় উল্লেখ রয়েছে, কোন পুলিশ অফিসার ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ অথবা ওয়ারেন্ট ব্যতীত ৯ ধরণের ব্যক্তিকে গ্রেফতার করতে পারেন। তন্মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন হ’ল-
প্রথমত: কোন আমলযোগ্য অপরাধের সাথে জড়িত কোন ব্যক্তি, যার বিরুদ্ধে যুক্তিসংজ্ঞত অভিযোগ করা হয়েছে অথবা বিশ্বাসযোগ্য খবর পাওয়া গেছে অথবা যুক্তিসংগত সন্দেহ রয়েছে।
দ্বিতীয়ত: আইনসঙ্গত অজুহাত ব্যতীত যার নিকট ঘর ভাঙ্গার কোন সরঞ্জাম রয়েছে।
তৃতীয়ত: এই কার্যবিধি অনুসারে অথবা সরকারের আদেশ দ্বারা যাকে অপরাধী বলে ঘোষণা করা হয়েছে।
চতুর্থত: চোরাই বলে সন্দেহ করা যেতে পারে এরূপ মাল যার নিকট রয়েছে এবং যে এরূপ মাল সম্পর্কে কোন অপরাধ করেছে বলে যুক্তিসঙ্গত সন্দেহ রয়েছে।
পঞ্চমত: পুলিশকে তার কাজে বাধা দানকারী ব্যক্তি অথবা যে ব্যক্তি আইনসঙ্গত হেফাজত হ’তে পালিয়েছে অথবা পালানোর চেষ্টা করেছে এমন ব্যক্তি।[2]
এছাড়া ফৌজদারী কার্যবিধির ৫৫, ৫৭ ও ১৫১ ধারা অনুসারে পুলিশ বিনা পরওয়ানা (Warrent) বা ম্যাজিষ্ট্রেট-এর আদেশ ছাড়া যে কাউকে গ্রেফতার করতে পারেন। যেমন- ১৫১ ধারায় উল্লেখ রয়েছে, কোন পুলিশ অফিসার যদি কোন আমলযোগ্য অপরাধ সংঘটনের ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পারেন এবং তাঁর নিকট যদি প্রতীয়মান হয় যে, এই অপরাধ সংঘটন অন্যভাবে নিবারণ করা যাবে না, তাহ’লে তিনি ম্যাজিষ্ট্রেটের আদেশ ও ওয়ারেন্ট ব্যতীত ষড়যন্ত্রকারী ব্যক্তিকে গ্রেফতার করতে পারবেন।[3]
উপরোক্ত ধারাগুলো পড়লে মনে হয় যে, পুলিশের হাতে এই বৃটিশ রচিত ফৌজদারী বিধান বিপুল ক্ষমতা দিয়েছে। শুধুমাত্র সন্দেহের বশীভূত হয়ে তারা বিনা ওয়ারেন্টে যেকোন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করতে পারেন। এমনকি অনির্দিষ্ট কালের জন্য জেলে আটক রাখতে পারেন।
ইসলামের আলোকে বিশ্লেষণ : ইসলাম মানব জাতির জন্য পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। একটি ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে অপরাধ প্রবণতাকে প্রতিকারের লক্ষ্যে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা অবশ্য বিদ্যমান। যাকে বাংলায় ফৌজদারী আইন, ইংরেজীতে Criminal law এবং আরবীতে বলা হয় قَانُوْن جِنَائِى ‘ক্বানূন জিনাঈ’।
ইসলামী রাষ্ট্রের শাসনকার্য পরিচালনার জন্য নির্বাহী, বিচার ও প্রশাসন বিভাগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা সম্পূর্ণ পৃথক ও স্বাধীনভাবে পরিচালিত হয়। এখানে পক্ষপাতিত্ব ও অন্যায়-অবিচারের যেমন কোন সুযোগ নেই, তেমনি রাষ্ট্র জোর করে ও অযৌক্তিক ভিত্তির ওপর নির্ভর করে কেবল সন্দেহ বশতঃ কাউকে গ্রেফতার, বন্দী বা অন্তরীণ রাখতে পারে না। কারণ কুরআনে আছে ভাল করে যাচাই-বাছাই না করে কেবল অনুমান বা সন্দেহের উপর নির্ভর করে কাউকে কিছু বলা বা করা যাবে না (হুজুরাত ৪৯/৬)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘তোমরা অবশ্যই ধারণা থেকে বেঁচে থাক। কেননা ধারণা সবচেয়ে বড় মিথ্যা কথা’…।[4] এটা কঠিন পাপের কারণ। আর বিচার ব্যবস্থার কথা তো পরের কথা। এখানে সাক্ষী ছাড়া কোন বিচারও নেই। কোনরূপ সাক্ষী ছাড়া বিচার করা, আটক বা বন্দী রাখার অর্থই হচ্ছে মানুষের উপর যুলুম করা, যা ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এই যুলুমের কারণে মানুষ জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হ’তে পারে। এ সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘প্রত্যেক যুলুমই ক্বিয়ামতের দিনে অন্ধকারের কারণ হয়ে দাঁড়াবে’।[5] অর্থাৎ যদি কেউ কারও উপর অন্যায়ভাবে কোন কিছু চাপিয়ে দেয় অথবা সে যা করেনি তাকে সে দোষে দোষী সাব্যস্ত করা হয়, তাহ’লে ক্বিয়ামতের ময়দানে উক্ত ব্যক্তিকে জবাব দিতে হবে। এ সম্পর্কে হাদীছে বর্ণিত হয়েছে- তায়ীফ (রাঃ) বলেন, ‘একদা আমি সাফওয়ান বিন জুন্দুব এবং তাঁর সঙ্গীদের নিকট উপস্থিত ছিলাম। তখন তিনি সাথীদেরকে উপদেশ দিচ্ছিলেন। সাথীরা তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে কিছু শুনতে পেয়েছেন? উত্তরে জুন্দব (রাঃ) বললেন, আমি রাসূল (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি সুনামের জন্য সৎ কাজ করে, আল্লাহ তার উদ্দেশ্য ক্বিয়ামতের দিন প্রকাশ করে দিবেন। যে মানুষকে বিপদে ফেলবে, ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহও তাকে বিপদে নিক্ষেপ করবেন’..।[6]
ইসলাম বিচার-আচারের ব্যাপারে কাযী বা বিচারককে সাধ্যমত ন্যায়বিচার করার নির্দেশ দিয়েছে। যেমন- উম্মে সালামা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘আমি তো একজন মানুষ। তোমরা বিভিন্ন মামলা-মোকদ্দমা নিয়ে আমার নিকটে আস। আর সম্ভবত তোমাদের কেউ কেউ দলীল-প্রমাণ উপস্থাপনে অন্যের চেয়ে বাক্পটু। সুতরাং আমি যা শুনি সে মোতাবেক বিচার-ফায়ছালা করি। কাজেই আমি যে ব্যক্তির বিচার করে তার ভাইয়ের হক অন্য ভাইকে প্রদান করি, সে যেন তা গ্রহণ না করে। কেননা আমি তাকে কেবলমাত্র এক টুকরা অগ্নি প্রদান করি’।[7]
একই সাথে কারো বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করাও অত্যন্ত গর্হিত ও ধ্বংসাত্মক কাজ। যেমন- আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, ‘তোমরা সাতটি ধ্বংসকারী বিষয় থেকে বেঁচে থাক। ছাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, সেগুলো কি হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! তিনি বললেন, (১) আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা (২) যাদু (৩) যথার্থ কারণ ছাড়া কাউকে হত্যা করা, যা আল্লাহ হারাম করেছেন (৪) সূদ খাওয়া (৫) ইয়াতীমের সম্পদ ভক্ষণ করা (৬) জিহাদের ময়দান থেকে পলায়ন করা এবং (৭) সতী-সাধ্বী ঈমানদার নারীর প্রতি মিথ্যা অপবাদ দেওয়া’।[8]
অত্র হাদীছে কয়েকটি নিষিদ্ধ দিক ফুটে উঠেছে যার মধ্যে অন্যতম ক্ষতিকর বা ধ্বংসাত্মক কাজ হ’ল মানুষকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা এবং সতী-সাধ্বী ঈমানদার নারীদের উপর মিথ্যা অপবাদ আরোপ করা। এখানে শুধু নারী কেন, ভাল পুরুষের বিরুদ্ধেও বাজে অপবাদ না দেয়ার গুরুত্ব ফুটে উঠেছে। অপর হাদীছে বর্ণিত আছে যে, মা‘কিল ইবনে ইয়াসার (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী করীম (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, যদি কোন ব্যক্তিকে আল্লাহ প্রজা পালনের দায়িত্ব অর্পণ করেন, কিন্তু সে তাদের কল্যাণকর নিরাপত্তা বিধান না করে, জান্নাতে প্রবেশ তো দূরের কথা সে জান্নাতের সুগন্ধিও পাবে না’।[9]
তাহ’লে দেখা যায় শুধু আমাদের দেশে নয়, বিশ্বের প্রায় সকল দেশে আজ রাষ্ট্রীয় প্রশাসন দিয়ে দুষ্টের দমনের নামে শিষ্টদেরকে আটক করে জেলে ঢুকিয়ে তাদের উপর সর্বাত্মক অন্যায়-যলুম চালানো হচ্ছে, যা মানবাধিকার পরিপন্থী। মা‘কিল ইবনে ইয়াসার (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী করীম (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, ‘যদি কোন ব্যক্তি মুসলিম জনগণের শাসক নিযুক্ত হয়, অতঃপর খেয়ানতকারী হিসাবে মৃত্যুবরণ করে, আল্লাহ তার জন্য জানণাত হারাম করে দিবেন’।[10]
অন্য হাদীছে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘আমার সম্মুখে জাহান্নাম পেশ করা হয়েছিল। সেখানে বনী ইসরাঈলের এক মহিলাকে দেখতে পেলাম। তাকে একটি বিড়ালের কারণে শাস্তি দেয়া হচ্ছে। সে বিড়ালটি বেঁধে রেখেছিল, তাকে খাদ্য দেয়নি এবং ছেড়েও দেয়নি, যাতে সে যমীনের পোকা-মাকড় খেতে পারে’।[11] এখানে দেখা যাচ্ছে, একটি বিড়ালের মত জন্তুকে আটকিয়ে মারার কারণে কি পরিণতি হ’তে পারে? এভাবে আমাদের এই সমাজে হাযার হাযার ভাল, জ্ঞানী, গুণী-সম্মানী ও সাধারণ নির্দোষ মানুষকে কেবল সন্দেহের কারণে অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করে বছরের পর বছর কারাগারে আটকে রেখে নির্যাতন করা হচ্ছে এবং বহু লোক মারাও যাচ্ছে। তাহ’লে বুঝা যায়, মানব রচিত এই আইনের কোন মূল্য আছে কি?
মানুষের উপর অন্যায়ভাবে অত্যাচার-নির্যাতন করা ও অপবাদ দেয়া কতটা মারাত্মক তা নিম্নবর্ণিত হাদীছ থেকে অনুমেয়। প্রখ্যাত ছাহাবী আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণনা করেন, একদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমরা কি জান কোন ব্যক্তি নিঃস্ব? ছাহাবীগণ বললেন, আমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি নিঃস্ব বা দরিদ্র, যার কোন ধন-সম্পদ নেই। তিনি বললেন, আমার উম্মতের মধ্যে প্রকৃত নিঃস্ব ঐ ব্যক্তি, যে ক্বিয়ামতের দিন অনেক ছালাত, ছিয়াম, যাকাত (নেকী) সহ উপস্থিত হবে। (কিন্তু তার সাথে সাথে ঐ সমস্ত লোকেরাও উপস্থিত হবে) যাদের কাউকে সে গালি দিয়েছে, কারও প্রতি মিথ্যা অপবাদ আরোপ করেছে, কারও মাল (অবৈধভাবে) ভক্ষণ করেছে, কারও রক্তপাত করেছে এবং কাউকে মেরেছে। অতঃপর এ (অত্যাচারিত) ব্যক্তিদেরকে তার নেকী থেকে দেয়া হবে। অতঃপর সকলের দাবী পূরণ করার পূর্বেই যদি তার নেকী শেষ হয়ে যায়, তাহ’লে তাদের পাপরাশি নিয়ে অত্যাচারী ব্যক্তির আমলনামায় যোগ করে দেয়া হবে। অতঃপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে’।[12] অতএব সংশ্লিষ্টি সকলে সাবধান!
এ প্রসঙ্গে অন্য এক হাদীছে বর্ণিত আছে, হিশাম বিন হাকীম বিন জিহাস (রাঃ) বর্ণনা করেন, ‘একদা তিনি সিরিয়া অঞ্চল অতিক্রমকালে কতিপয় আজমী কৃষক সম্প্রদায়ের কিছু লোকের কাছে ফিরে যাচ্ছিলেন। ঐ লোকদের রোদের মধ্যে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল। তাদের মাথায় যয়তুনের তেল ঢালা হয়েছিল। তিনি জিজ্ঞেস করলেন ব্যাপারটি কি? তাঁকে বলা হ’ল, ভূমি রাজস্ব আদায়ের জন্য এদেরকে শাস্তি দেয়া হচ্ছে। অন্য এক রেওয়ায়াতে বলা হয়েছে, জিজিয়া আদায়ের কারণে এদেরকে আটকে রাখা হয়েছে। হিশাম বলেন, আমি শপথ করে বলছি, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, নিঃসন্দেহে আল্লাহ সেই লোকদের শাস্তি দিবেন, যারা দুনিয়ায় লোকদের শাস্তি দেয়। এরপর তিনি সেখানকার শাসকের কাছে গেলেন এবং হাদীছটি শুনালেন। তখন তিনি আলোচ্য বিষয়ে নির্দেশ দিলেন এবং সে অনুসারে আটক ব্যক্তিদেরকে মুক্তি দেয়া হ’ল’।[13]
ইসলাম অন্যায়ভাবে তো দূরের কথা, ন্যায়সঙ্গত শাস্তির ক্ষেত্রেও অপরাধীর সাথে অমানবিক, নিষ্ঠুর ও অসদাচরণকে সমর্থন করে না এবং অপরাধীকে মানবেতর অবস্থায় ফেলে দেয় না। বরং সদা সর্বদা উত্তম ব্যবহারের নির্দেশ প্রদান করে। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, وَاعْبُدُواْ اللهَ وَلاَ تُشْرِكُواْ بِهِ شَيْئاً وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَاناً وَبِذِي الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينِ وَالْجَارِ ذِي الْقُرْبَى وَالْجَارِ الْجُنُبِ وَالصَّاحِبِ بِالجَنبِ وَابْنِ السَّبِيلِ وَمَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ إِنَّ اللّهَ لاَ يُحِبُّ مَن كَانَ مُخْتَالاً فَخُوراً ‘তোমরা আল্লাহর ইবাদত করবে ও কোন কিছুকে তাঁর সাথে শরীক করবে না এবং পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম, অভাবগ্রস্ত, নিকট প্রতিবেশী, দূর প্রতিবেশী, সঙ্গীসাথী, পথচারী এবং তোমাদের অধিকারভুক্ত দাস-দাসীদের প্রতি সদ্ব্যবহার করবে। আল্লাহ পসন্দ করেন না দাম্ভিক, আত্মাভিমানীকে’ (নিসা ৩৬)।
আল্লাহ পাক অন্যত্রে বলেন, وَلاَ تَأْكُلُواْ أَمْوَالَكُم بَيْنَكُم بِالْبَاطِلِ وَتُدْلُواْ بِهَا إِلَى الْحُكَّامِ لِتَأْكُلُواْ فَرِيقاً مِّنْ أَمْوَالِ النَّاسِ بِالإِثْمِ وَأَنتُمْ تَعْلَمُونَ ‘তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অন্যের অর্থ-সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস কর না এবং মানুষের ধন-সম্পত্তির কিয়দাংশ জেনেশুনে অন্যায়ভাবে গ্রাস করার উদ্দেশ্যে তা বিচারকগণের নিকট পেশ কর না’ (বাক্বারাহ ১৮৮)।
অত্র আয়াতদ্বয় থেকে বুঝা গেল, দুনিয়ার সকল স্তরের মানুষসহ পথচারীদের সাথেও উত্তম ব্যবহারের নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং কারও ধন-সম্পত্তি অন্যায়ভাবে গ্রাস করার উদ্দেশ্যে বিচারকগণের নিকট পেশ করতেও নিষেধ করা হয়েছে। যদিও আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশে এ ধরণের ঘটনা হরহামেশা ঘটছে। আর দেশের প্রশাসনসহ আইন-শৃংখলা বাহিনী যেন এ কাজে সহযোগিতার জন্য সরকারি সার্টিফিকেট নিয়ে মাঠে-ময়দানে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে চলেছে।
এ কথা সত্য যে, ইসলামী রাষ্ট্রে প্রকৃত অপরাধীকে চিহ্নিত করতে হ’লে কখনও কখনও ভুল করে নির্দোষ লোককেও আটক করা হ’তে পারে। তবে সে ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক যাচাই-বাছাই করতঃ নির্দোষ মানুষের নিকট ভুল স্বীকার ও ক্ষমা চেয়ে দ্রুত ছেড়ে দিতে হবে। দিনের পর দিন মাসের পর মাস অথবা বছরের পর বছর আটকে রাখার প্রশ্নই ওঠে না।
পুলিশ (Police) ও রিমান্ড (Remand) : জাতিসংঘ সার্বজনীন মানবাধিকার সনদের এই ধারার সাথে বিশ্বের পুলিশের ভূমিকা ও রিমান্ডের সঙ্গে রয়েছে যেমন সম্পর্ক, তেমনি এ দু’ক্ষেত্রে রয়েছে নানা বিতর্ক, আলোচনা ও সমালোচনা। সংক্ষিপ্তভাবে বিষয়গুলো তুলে ধরা হ’ল।-
পুলিশ (Police) শব্দটি পর্তুগীজ শব্দ থেকে এসেছে। বৃটিশ ঔপনিবেশিকগণ ভারতীয় উপমহাদেশকে শাসনের হাতিয়ার হিসাবে জনগণের বন্ধু (!) হয়ে কাজ করবে বলে এই বাহিনী গঠন করে। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবের পর তারা উপলব্ধি করে এরকম কিছু একটা করা দরকার। এরপর ১৮৬০ সালের আগষ্টে গঠন করা হয় একটি কমিশন। ১৮৬১ সালে পুলিশ এ্যাক্ট পাশ করা হয়। প্রথমে তাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য কিছু সফল হ’লেও তাদের চিন্তা ছিল ভিন্ন। আক্ষরিক অর্থে Police শব্দটি বিশ্লেষণ করলে দাঁড়ায় এরকম P=Polite (নম্র, ভদ্র), O=Obedient (কর্তব্যপরায়ণ), L=Loyel (বিশ্বস্ত), I=Intelligent (বুদ্ধিমান) C=Courageous (সাহসী), E=Efficient (দক্ষ)।[14] এসব শব্দ-বিশ্লেষণ করলে মনে হয় পুলিশ কখনও মানুষের শত্রু হ’তে পারে না। তবে আমাদের দেশের পুলিশের যে বেহাল দশা, সম্ভবতঃ তা অন্য কোন দেশে নেই। যেমন- ইংল্যান্ডেই এদেরকে জনগণের বন্ধু ভাবা হয়। আমাদের দেশেও কিছু পুলিশ ভাল আছে। কিন্তু তাদের খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তবে সব মিলে বর্তমানে বাংলাদেশের পুলিশী ভূমিকার অবস্থা যে একেবারে নিম্ন স্তরে গিয়ে পৌঁছেছে তা এখন আর গোপন নেই। বৃটিশ আমল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় দেড় ডজনের অধিক সংস্কার কমিটি গঠন ও সংস্কারের প্রস্তাব হয়েছে। কিন্তু পুলিশের ভূমিকার পরিবর্তন হয়নি। সর্বশেষ ২০০৪ সালে শত বর্ষের বৃটিশ পোষাকের রং বদল হ’লেও বদল হয়নি পুলিশের মনমানসিকতার। যদিও এর জন্য দায়ী রাজনৈতিক দল ও দলীয় সরকার ব্যবস্থা। তবে প্রশ্ন হচ্ছে- পুলিশ ব্যবস্থার এ করুণ দশার জন্য প্রকৃত অর্থে গলদটা কোথায়? আসলেই পুলিশ দায়ী, না পুলিশী আইন ব্যবস্থা দায়ী? এ ক্ষেত্রে ইসলামী পুলিশ ব্যবস্থা কি বলে?
ইসলামী রাষ্ট্রে পুলিশী ব্যবস্থা থাকাটা স্বাভাবিক। তবে মানব রচিত বৃটিশ আইনের সাথে ইসলামী রাষ্ট্রের পুলিশের ভূমিকা সম্পূর্ণ ভিন্ন। ইসলামিক বিধানে অপরাধী যে হৌক না কেন যাচাই-বাছাই না করে এবং সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না পেলে তাকে আটক করা হয় না। যদি এ রকম আকস্মিক দু’একটি ঘটনা ঘটেই যায়, তবে তার আত্মপক্ষ সমর্থন এবং আল্লাহর নামে শপথের মাধ্যমে তাকে মুক্তি দেয়া হয়। এখানে কোনরূপ যুলুম-অত্যাচারের সুযোগ নেই।
আমর ইবনু শো‘আয়েব (রাঃ) তাঁর পিতার মাধ্যমে তাঁর দাদা হ’তে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘প্রমাণ বাদীকেই পেশ করতে হবে এবং বিবাদীর ওপর বর্তাবে কসম’।[15]
অর্থাৎ পুলিশ প্রশাসনের উচিত কেউ কখনও রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক কল্যাণের ক্ষেত্রে অপরাধী হিসাবে ধৃত হ’লে এবং তার পক্ষে সাক্ষী প্রমাণ উপস্থাপন করতে না পারলে সঙ্গে সঙ্গে ধৃত ব্যক্তিকে আল্লাহর নামে শপথ করাবে যে, সে এই অপরাধের সাথে জড়িত নয়। এরপরে তাকে ছেড়ে দিবে।
রিমান্ড (Remand) : যখন কোন মামলার অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গ্রেফতার করার পর তদন্তকারী কর্মকর্তার এরূপ প্রত্যয় জন্মে যে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে (৬১ ধারা অনুযায়ী) তদন্তকার্য সম্পন্ন করা যাবে না, তখন অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে পাওয়া তথ্যাদিসহ কেইস ডাইরী সমেত অভিযুক্তকে সংশ্লিষ্ট আদালতে সোপর্দ পূর্বক রিমান্ডে নেয়ার আবেদন পেশ করতে পারে। উপযুক্ত কারণ থাকলে সংশ্লিষ্ট আদালতের বিচারক অধিকতর তদন্তের স্বার্থে রিমান্ড মঞ্জুর করতে পারেন। তবে একই মামলায় সর্বমোট ১৫ দিনের বেশী রিমান্ড মঞ্জুর করবেন না।
আমাদের দেশে পুলিশী রিমান্ড অর্থ এক ভয়ংকর কাহিনী। ধৃত আসামীর কাছ থেকে যখন পুলিশ স্বীকারোক্তি আদায় করতে পারে না, তখন প্রশাসনের নির্দেশে পুলিশ কোর্টের কাছে রিমান্ডের আবেদন করেন। কোর্ট ইচ্ছামত রিমান্ডের আবেদন মঞ্জুর করেন। শুরু হয় আসামীদের উপর নানারূপ নির্যাতন। শারীরিক নির্যাতনে পঙ্গুত্ব বরণ করে অনেকে। কেউবা মারা যায়। মানসিক নির্যাতন ও অমর্যাদাকর আচরণ তো রয়েছেই। এক রিপোর্টে দেখে যায়, ২০০১-২০০২ দেশের জেল কাস্টডিতে কারাদন্ডপ্রাপ্ত ৩০ জন, আটকাদেশ প্রাপ্ত ৮৭ জন এবং পুলিশ কাস্টডিতে ৯ জন মারা যায়।[16] তাই রিমান্ড নিয়ে চলছে নানা বিতর্ক ও সমালোচনা। সচেতন নাগরিক ও মানবাধিকার কর্মীদের মতে, রিমান্ড বা পুলিশ হেফাযতে জিজ্ঞাসাবাদের নামে এ নির্যাতন শুধু মানবাধিকার লংঘনই নয়; এটি একটি বেআইনী কর্মকান্ডও বটে। রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করে আসামীর কাছ থেকে তথ্য বের করার কোন আইনগত ভিত্তি নেই। অথচ রিমান্ডে নিয়ে আসামীদের স্বীকারোক্তির জন্য ইলেক্ট্রিক শক্, ইলেক্ট্রিক চেয়ারে বসানো, নখে সুঁচ ঢুকানো, নাকে গরম পানি দেয়া ও মরিচ দেয়া, চোখ বেঁধে রাখা, খেতে না দেয়া, ঘুমাতে না দেয়া, শারীরিক ও মানসিকসহ নানা রকম অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়। যার বিবরণ শ্রবণে গা শিউরে উঠে। বাংলাদেশে বহু আলেম-ওলামা, শিক্ষক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবি, রাজনৈতিক ও সাধারণ মানুষকে এই নির্যাতনের শিকার হ’তে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বিশ্বের অন্যান্য দেশেও বিশেষ করে ইসলামপন্থীদের উপরে চলছে এসব নির্যাতন।
কারাগারে অনিয়ম ও বন্দী নির্যাতন : ১৭৭২ সালে বৃটিশ গভর্নর ওয়ারেন্ট হেন্টিংস দেওয়ানী ও ফৌজদারী আদালত সৃষ্টির মাধ্যমে প্রচলিত কারাগারের প্রবর্তন করেন। ১৮৬৪ সালে বেঙ্গল জেল কোড প্রণয়ন করা হয়। এখনও বাংলাদেশে সেই বৃটিশ আমলে প্রণীত কোড অনুসরণ করেই চলছে কারা ব্যবস্থাপনা। রাষ্ট্র কর্তৃক ধৃত সকল অপরাধীর গন্তব্য স্থল হ’ল কারাগার। উল্লেখ্য, কারাগারগুলো প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল অপরাধীদের বিচারকালীন কোর্ট হাজিরা, অপরাধী যাতে একই অপরাধ বারবার করতে না পারে ও বিচার কাজের সুবিধার জন্য। কিন্তু বৃটিশ ঔপনিবেশিক আমলে আমাদের দেশের আলেম-ওলামা, সাধারণ মানুষ, রাজনৈতিক ব্যক্তি, বিপ্লবীদের ধরে বিচারের নামে যেভাবে নির্যাতন করত, বর্তমানে ঠিক একই কায়দায় বরং পূর্বের চেয়েও এ নির্যাতন মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। স্বাধীনতার ৪২ বছর পর হ’লেও বেঙ্গল জেল কোর্ড, প্রিজন অ্যাকট সহ আইনগুলোর যে সংশোধন প্রয়োজন ছিল তা করা হয়নি এবং কারাগার ব্যবস্থাপনার যে আমূল পরিবর্তন আনা প্রয়োজন ছিল তাও হয়নি। ফলে কারাগার হয়ে উঠেছে অপরাধের অভয়ারণ্য। যেখানে ধাপে ধাপে আসামীর প্রবেশ থেকে শুরু করে জামিন পর্যন্ত চলে টাকার খেলা, নইলে ধুঁকে ধুঁকে মরতে হয় বন্দীকে। এখানে যেসব স্থানে হাজতী বা কয়েদি বন্দীকে ঘুষ দিতে হয়- সেগুলো আমদানি, কেইস টেবিল, ব্রেকিংআপ, কারাচৌকী, জেলগেট, সুইপার দফা, বিশেষ দফা, মেডিকেল, ডান্ডাবেড়ি, চালান, বেত্রাঘাত, বন্দীদের দেখা, মাদক রাখা, মাদকদ্রব্য ও সার্বিক ক্রয়, চিত্ত বিনোদন, নাপিত দফা, প্রিজনার্স ক্যান্টিন, মহিলা ওয়ার্ড, আইনগত সমস্যা, কয়েদি শাখা, জামিন শাখা, কোর্ট শাখা, কাজপাশ, বহির্গমন ইত্যাদি।[17]
এসব ধাপে বন্দিদের অত্যধিক দুর্নীতির মুখোমুখি হ’তে হয়। এছাড়া তারা কারা প্রশাসন, কারারক্ষী, জেলার, সাব জেলার, সুবেদার, জমাদার, সিনিয়র সুপার ও সুপারেরও দুর্নীতির শিকারে পতিত হয়। এই দুর্নীতির মাত্রা সাধারণ দুর্নীতির চেয়ে বহুগুণ বেশী। এখানে যেন স্বাধীনতার ছোয়া এখনও লাগেনি।
একজন বন্দী হাজতী কোন বিষয়ে সুবিধা পাবে কি পাবে না তা নির্ভর করে তার টাকার পরিমাণের উপর। যেমন- রাতের শেষে বন্দীদের ডাকা হয়। দু’তিনশ’ বন্দীর জন্য দু’একটি টয়লেট। টাকা না দিলে দুর্গন্ধযুক্ত টয়লেটের সামনে ঘুমাতে দেয়া হয়। সকালে নাস্তার জন্য রুটি আসে চামড়ার চেয়ে শক্ত, দুর্গন্ধময় ও কালচে, যা খাওয়ার অনুপযোগী। সঙ্গে যে গুড় দেয়া হয়, কতদিনের যে বাসী তা বুঝা মুশকিল। মনে হয় ফেলে দেয়া গুড়, কুড়িয়ে এনে খেতে দিয়েছে। এসব দেখে মনে হয়, পেটে যা আছে তা বমি হয়ে এখনি বের হয়ে যাবে। কেইস টেবিলে বন্দিদের লাঠি পেটা, চড়-থাপ্পড় মারা, জুতা পেটা থেকে শুরু করে সব ধরনের নির্যাতন করা হয়। এভাবে বন্দীর নির্যাতনের লোমহর্ষক লাখো চিত্র ও কাহিনী চলে আসছে আবহমানকাল থেকে।
জেল হাসপাতাল হ’ল দুর্নীতির আর এক স্থান। এখানে থাকে বেশীর ভাগই সুস্থ বন্দী। আয়েশী জীবন-যাপনের জন্য মক্কেলকে ৬ থেকে ৮ হাযার টাকা দিতে হয়। মেডিকেলে সবচেয়ে বড় দুর্নীতি হ’ল ডাক্তারদের রোগী না দেখার মানসিকতা। বাইরের মেডিকেলে নেয়ার জন্যও একজন বন্দীকে মোটা অংকের টাকা ঘুষ দিতে হয়। অথচ প্রকৃত অসুস্থ রোগী বাইরের মেডিকেলে তো দূরের কথা কারাগারের মেডিকেলেও সীট পায় না![18] ষোল কোটি বনু আদমের এই বাংলাদেশে মোট ১১টি কেন্দ্রীয় কারাগার সহ মোট ৬৬টি জেলা কারাগার রয়েছে। ২০০২ সালের এক রিপোর্টে দেখা যায়, দেশের ৬৬টি কারাগারে (উপযেলা পর্যায়ে ১৬টি কারাগারে ৪৮০ জন সহ) ধারণক্ষমতা মোট ২৫,০১৮ জন। অথচ এতে বন্দীর সংখ্যা হ’ল ৭৫,১৩৫ জন। এর মধ্যে দন্ডপ্রাপ্ত ১৯,৯১৬ জন, বিচারাধীন ৪৯,২৭০ জন, আটকাদেশ প্রাপ্ত ৫,২৩৬ জন, অবৈধ বিদেশী নাগরিক ৭১৩ জন। তাদের মধ্যে ৭২,৯৯১ জন পুরুষ এবং ২,১৪৪ জন মহিলা।[19] বর্তমানে কারাগারগুলোতে হাজতি/কয়েদির সংখ্যা ধারণ ক্ষমতার প্রায় ৮ গুণ ছাড়িয়ে গেছে। কারণ ২০১৩ সালে কেবল রাজনৈতিক কারণেই লক্ষাধিক মানুষকে গ্রেফতার করা হয়েছে।[20] এর মধ্যে দেশের আলেম-ওলামা, বড় বড় রাজনীতিবিদ, উচ্চশিক্ষিত ও সাধারণ শ্রেণী, অপরাধী ও নিরাপরাধ সকলকে অত্যন্তসংকীর্ণ প্রকোষ্ঠে অবস্থান করতে হচ্ছে। এই হ’ল একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক (?) দেশের জেলখানার মানবাধিকার পরিস্থিতি!
পক্ষান্তরে ইসলামী রাষ্ট্রের জেলখানায় এরূপ দুর্ব্যবস্থা ও অনিয়ম-দুর্নীতির সুযোগ নেই। সেখানে একজন আসামী বা কয়েদীর জীবন যাপন অনেক উন্নত। তাদের খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও থাকার ব্যবস্থা অনেক উন্নত, যা আমাদের এই কারাব্যবস্থার সাথে তুলনীয় নয়।
সেখানে অপরাধীদের সংশোধনের জন্য রয়েছে বহু সুযোগ-সুবিধা ও স্বাভাবিক জীবন-যাপনের নিশ্চয়তা। আর সেই লক্ষ্য-উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই প্রকৃত অপরাধীদের কারাগারে রাখা হয়। আর তারা বিচারের রায় দ্রুত পেয়ে যায়। ফলে কারাগারেরও তেমন একটা প্রয়োজন পড়ে না।
পর্যালোচনা :
জাতিসংঘ সার্বজনীন মানবাধিকার সনদের ৯নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তিকে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া বন্দী, আটক বা অন্তরীণ (জেলে) রাখা যাবে না। কথাগুলো ভাল মনে হ’লেও প্রকৃত অর্থে জাতিসংঘের এই সনদের সাথে বিশ্বের ফেŠজদারী (প্রায়োগিক) আইনের কতটুকু মিল রয়েছে? এই ধারাতে উল্লেখ করা হয়েছে, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া কাউকে আটক বা গ্রেফতার করা যাবে না। অথচ বাস্তবে সকল ক্ষেত্রে এ আইনের অপপ্রয়োগ হচ্ছে। যেমন- বৃটিশ আমলে প্রণীত বাংলাদেশের ফৌজদারী কার্যবিধির ৫৪(১) ধারা অনুসারে- যে সকল ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে অন্তরীণ করতে পারবে, তার সকল ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের প্রয়োজন পড়ে না। কোনরূপ সন্দেহ হ’লেই যে কোন মানুষকে গ্রেফতার করতে পারবে। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে যদি তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সম্মানিত প্রফেসরও হন। শুধু তাই নয়, দলীয় সরকারের নির্দেশে পুলিশ প্রশাসন এই ৫৪ ধারা ও অন্যান্য ধারার অপব্যবহার করে অজস্র নিরীহ মানুষকে গ্রেফতার করে জেলে ঢুকাচ্ছে।
মাসের পর মাস, বছর পর বছর এ সকল হতভাগা বনু আদমকে কারা প্রকোষ্ঠে নিদারুণ কষ্টে দিন কাটতে হয়। সেখানে প্রকৃত অপরাধীরা যেমন শাস্তি পাচ্ছে, তেমনি নিরপরাধ ব্যক্তিও শাস্তি পাচ্ছে। কেন তা হবে? ৫৪(১) ধারার তৃতীয় স্তরে বলা হয়েছে, এই কার্যবিধি অনুসারে অথবা সরকারের আদেশ দ্বারা যাকে অপরাধী বলে ঘোষণা করা হয়েছে ম্যাজিষ্ট্রেটের আদেশ ছাড়া বিনা ওয়ারেন্টে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করতে পারবে। একইভাবে ৫৫, ৫৭ ও ১৫১ ধারায় পুলিশ যে কাউকে গ্রেফতার করে জেলে দিতে পারে। এগুলো সন্দেহজনক অপরাধী হিসাবে চালিয়ে দেয়া হয়। কখনও কখনও শ্যোন অ্যারেস্ট দেখিয়ে ১০/১৫টি বা ক্ষেত্র বিশেষে আরও অধিক মামলা দেয়া হয়। একই কায়দায় তথাকথিত গণতান্ত্রিক দলীয় সরকার কর্তৃক বিরোধী মতের ব্যক্তিদেরকেও এই আইনের আওতায় গ্রেফতার দেখিয়ে নানা প্রকার যুলুম-নির্যাতন ও গুম-হত্যা করা হচ্ছে। উল্লেখ্য, এসব যুলুম-নির্যাতন চলে ক্ষমতার পালাবদলে সব সরকারের আমলে। এগুলো তাদের কাছে মানবাধিকার পরিপন্থী নয়।
পাশ্চাত্যের দেশেগুলোতেও একইভাবে সাধারণ ও নিরীহ মানুষের উপর পুলিশী নির্যাতন চলছে। সেখানে সন্দেহের বশবর্তী হয়ে অথবা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে জাতিসংঘ মানবাধিকার সনদের এই ধারা লংঘন করা হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের লস এ্যাঞ্জেলসের কেস ডেলানো রেজিষ্ট্রার নামক এক ব্যক্তি মিথ্যা অভিযোগের ভিত্তিতে খুনের মামলায় ৩৪ বছর কারা ভোগের পর নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে মুক্তি পেয়েছেন। যে যুক্তরাষ্ট্র নিজ দেশের চেয়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশে বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলোর ওপর মিথ্যা ও সন্দেহমূলক গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে গোটা দেশকে ধ্বংস করতে কসুর করে না সে যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগের এই হচ্ছে নিষ্করুণ দৃশ্য। ইরাক, আফগানিস্তান প্রভৃতি দেশ তার প্রমাণ। যার জাজ্বল্য প্রমাণ।
ইরাক যুদ্ধের প্রায় ১০ বছর পরে ২০১৩ সালে বাগদাদে নিযুক্ত জাতিসংঘের অস্ত্র পরিদর্শন সংস্থার প্রধান হ্যান্স ব্লিক্স স্বীকার করেছেন যে, ইরাকে যুদ্ধ ছিল ইতিহাসের এক ভয়ংকর ভুল। একইভাবে স্বীকার করেছেন আরও অনেকে। অথচ এই ভুলে প্রাণ গিয়েছে ১০ লক্ষাধিক মানুষের। সেখানে এখনও প্রতিমাসে গড়ে নিহত হচ্ছে ৩ শতাধিক বনু আদম। ৩৫ লাখ ইরাকী হতাহত হয়েছে, ১৪ লাখ নারী হয়েছেন বিধবা, ইয়াতীম হয়েছে ৬০ লাখ শিশু। ২০০৮ সাল পর্যন্ত নিখোঁজ হয়েছে ১২ লাখ ইরাকী।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সাড়ে ৪ হাযার সৈন্য নিহত হয়েছে। এ যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যয় হয়েছে ৮৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ও যুক্তরাজ্যের ৪.৫ বিলিয়ন ইউরো। মার্কিন হামলায় ধ্বংস হয়েছে হাযার বছরের মুসলিম ঐতিহ্য। সেখানে এখনও তাদের ৫০ হাযার সৈন্য মোতায়েন আছে। এসবই সংঘটিত হয়েছে তেল সম্পদকে কুক্ষিগত ও মধ্যপ্রাচ্যে আধিপত্য বিস্তারের জন্য। আর এসব সম্ভব হচ্ছে তথাকথিত রাসায়নিক অস্ত্রের মজুদের মিথ্যা ও সন্দেহের বশে।[21] সেখানে এখনও প্রতিনিয়ত রক্তের শ্রোত বয়েই চলেছে। অথচ সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ, কলিন পাওয়েল, রামসফেল্ড, যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধান মন্ত্রী টনি ব্লেয়াররা যুদ্ধাপরাধী নন (?) কি চমৎকার ন্যায় বিচার, কি চমৎকার গণতন্ত্র! কি চমৎকার জাতিসংঘ সার্বজনীন মানবাধিকার সংস্থা!
আফগানিস্তানকে ধ্বংস করা ও এ এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করার জন্য বহু পূর্ব থেকে ইহুদী সহ আমেরিকা প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছিল। কথিত উসামা বিন লাদেনের মিথ্যা গল্প-কাহিনী আবিষ্কারে তারা মাঠে ময়দানে নামে। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর বিশ্ব বাণিজ্য সেন্টার টুইন টাওয়ারে হামলা চালায়। দোষ দেয়া হয় উসামা বিন লাদেন ও আল-কায়দার উপরে। প্রতিশোধ নিতে আফগানিস্তানে হামলা করা হ’ল, সে দেশ ধ্বংস হ’ল। হাযার হাযার মানুষ নিহত হ’ল, লক্ষ লক্ষ মানুষ আহত হ’ল, বিধ্বস্ত হ’ল স্থাপনা, বিনষ্ট হ’ল মানুষের সহায়-সম্পদ। অথচ কিছুদিন পরেই সত্য প্রকাশ পেল। জানা গেল, নিউইয়র্কের বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রে এবং পেন্টাগনে ৯/১১’র হামলা সম্পর্কে কয়েক মাস আগে থেকে জানতেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ, ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনি ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রামস্ফেল্ড। আর এ কথা ফাঁস করেছেন ৯/১১ হামলার পর মার্কিন প্যাট্রিয়টিক অস্ত্রের দায়িত্বে থাকা ও সম্প্রতি গ্রেফতার হওয়া সুসান লিন্ডার নামে সি,আই,এ’র এক কর্মী। কিছুদিন পূর্বে রাশিয়ার একটি টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারিত ইউটিউব ভিডিও ফুটেজে লিন্ডার বলেছেন, বুশ, চেনি ও রামস্ফেল্ড জানতেন ৯/১১-এর হামলা সংঘটিত হ’তে যাচ্ছে। তিনি জানান, সিআইএ’র কন্ট্রোল অফিসার ডঃ রিচার্ড ফিউশজকে একটি লাইভ পিড দেখতে দেখেছিলেন, যাতে দেখা গেছে যে, ইসরাঈল থেকে যাওয়া বিমান বিশ্ববাণিজ্য কেন্দ্রে আঘাত হানছে। সুতরাং এ ঘটনায় বিশ্ব বিবেকের কাছে দিবালোকের মত পরিষ্কার যে, বিশ্ববাণিজ্য কেন্দ্রে হামলাটি ছিল আমেরিকা গং-এর সাজানো নাটক। এ নাটকের শিকারে মুসলিম কর্মকর্তা ও কর্মচারীসহ ৩১০ লোক নিহত হন।[22] আরও আশ্চর্য ব্যাপার হ’ল এ হামলার সময় ঐ কেন্দ্রে কোন ইহুদী কর্মচারী ছিল না। এসব ঘটানো হচ্ছে মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলক অভিযোগের ভিত্তিতে।
একইভাবে গণতন্ত্রের দাবীদার (?) ভারতের কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই’র সাবেক সদস্য সতীশ ভার্মা জানিয়েছেন, ‘কোন সন্ত্রাসী গোষ্ঠী নয় বরং ভারত সরকারই দেশটির পার্লামেন্ট ভবনে এবং ২০০৮ সালে মুম্বাইয়ে হামলা চালিয়েছিল। ভারতের ইংরেজী দৈনিক টাইমস অব ইন্ডিয়ায় চাঞ্চল্যকর এ খবর প্রকাশিত হয়েছে। হামলায় ১১ জন লোক নিহত হয়।[23]
অথচ এ হামলায় মুসলমানদেরকে দায়ী করা হয়েছিল।
ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, বৃটেন-মিশর, সিরিয়া তাদের আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে যেমন মানবাধিকার সনদের এই ধারার অপব্যবহার করে যাচ্ছে, তেমনিভাবে সারা বিশ্বে কথিত মানবাধিকার রক্ষার নামে মুসলিম দেশ ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসাবে সনদটি কাজে লাগাচ্ছে।
বাংলাদেশ সরকারও এখন এ ধারার অপব্যবহার করে চলেছে ব্যাপকভাবে। ফলে দেশের বিভিন্ন ইসলামী ব্যক্তিত্ব, জ্ঞানী-গুণীদেরকে সন্দেহমূলক আইনের আওতায় ও মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করে যুলুম চালানো হচ্ছে। পক্ষান্তরে ইসলাম সন্দেহবশত যুলুম-নির্যাতনের এই পদ্ধতি ও আইনকে সমর্থন করে না। কারো মধ্যে যদি অপরাধের আলামত কিছুই না পাওয়া যায়, তাহ’লে তাকে ধরা যাবে না। আর যদি এরকম কিছু ঘটেও থাকে তবে ইসলামী আদলতে যাচাই-বাছাই করে আল্লাহর নামে কসম করিয়ে তাকে সঙ্গে সঙ্গে ছেড়ে দেয়া হয় এবং সম্মানের সাথে তাকে বাড়ী পর্যন্ত পৌঁছে দেয়া হয়। অনেক ক্ষেত্রে ক্ষতিপুরণ দেয়া হয়।
পরিশেষে বলা যায়, জাতিসংঘ সার্বজনীন মানবাধিকার সনদের ৯ ধারা বহু ত্রুটি ও ফাঁক রয়েছে। এখানে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ শব্দের ব্যাখ্যা স্পষ্ট নয়। কারণ সুনির্দিষ্ট অভিযোগ শব্দগুলোকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করছে বাংলাদেশ এবং বিশ্বের বিভিন্ন পরাশক্তি। পক্ষান্তরে ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় উপযুক্ত প্রমাণ ও সাক্ষ্য উপস্থাপন ছাড়া কোন ব্যক্তিকে আটক করে জেলে ঢোকানোর বিধান নেই। যদি রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্র হয়ে থাকে তথাপিও সাক্ষ্য-প্রমাণ না পেলে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ প্রশাসন স্বসম্মানে তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য। অতএব জাতিসংঘ সার্বজনীন মানবাধিকার সনদের ৯ ধারাতে যা বলা হয়েছে, তা পূর্ণাঙ্গ নয়। সুতরাং এ ধারাটি বাতিল করে ইসলামী বিধানের সুসীতল ছায়াতলে বিশ্ববাসীকে আত্মসমর্পণ করা উচিত।
মূল লেখা: মানবাধিকার ও ইসলাম
লেখক: শামসুল আলম
[1]. Fifty years of the Universal Declaration of Human Rights, Dhaka, P. 200.
[2]. গাজী শামছুর রহমান, ফৌজদারী আইনের ভাষ্য, খোশরোজ কিতাব মহল, ঢাকা (সংশোধিত নতুন সংস্করণ), পৃঃ ৬৪-৬৬।
[14]. আইন (মানবাধিকার বিষয়ক পাক্ষিক পত্রিকা), ২০তম বর্ষ, ১১ ও ১২তম যুগ্ম সংখ্যা, ১-১৬ ডিসেম্বর ২০১০, পৃঃ ৪।
[18]. Hameeda Hossain, Human Rights in Bangladesh (Dhaka : Ain o Salish Kendra (ASK), First published 2003), P. 85.