আস্তিকতা ‘বনাম’ ইসলাম
আমরা তখন মাধ্যমিক লেভেলের স্কুলে পড়ছি। হুমায়ূন আহমেদের গল্প উপন্যাস আমাদের মনোজগতের অনেকখানি জুড়ে দখল নিয়েছে। তারপরও আমাদের সামাজিক আর পারিবারিক বিশ্বাসের বিপরীতে তাঁর নাস্তিকতা ঘেঁষা কিংবা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে বেশ কটাক্ষ করে লেখাগুলো পড়ে অনেকের মনেই ব্যথা লাগতো। মাহফুজ আহমেদের নেয়া একটি দীর্ঘ সাক্ষাতকারে তিনি বললেন, “আমি ভীষণভাবে আস্তিক”। আমার মনে আছে, সে সাক্ষাতকার পড়ে আমরা খুব খুশী হয়েছিলাম আর বন্ধুরা মিলে আলাপ করতাম-“যাক, সে আর যাই হোক শামসুর রাহমান কিংবা শওকত ওসমান ক্যাটাগরির লোক নয়”। নাস্তিকতার প্রসঙ্গ এলেই বাংলাদেশের স্বঘোষিত এসব নাস্তিকদের মনে হতো আবু জাহল-আবু লাহাবদের মতো। আমার ইসলামের জ্ঞান তখন প্রায় শূন্যের কোঠায়। আল্লাহর কৃপায় যখন ইসলাম সম্বন্ধে কিছুটা জানতে শুরু করেছি তখন একদিন আমি ভীষণ হোঁচট খেলাম যখন জানলাম আবু জাহল, আবু লাহাব, উতবা, শাইবা প্রমুখ ইসলাম ও রাসুলুল্লাহর ঘোরতর শত্রু সকলেই ছিলো ‘ভীষণভাবে আস্তিক’। মক্কার সকল কাফির কঠিনভাবে আল্লাহকে বিশ্বাস করত। এমনকি তাদের দেব-দেবী বা মূর্তিগুলোকে তারা আল্লাহকে পাবার মাধ্যম হিসেবেই কেবল বিবেচনা করতো, তবে জানত যে চুড়ান্ত ক্ষমতা কেবল আল্লাহরই। তাদের স্বজন-সহকর্মীদের নাম ছিল আব্দুল্লাহ, উবাইদুল্লাহ ইত্যাদি। আল্লাহর উপর এমন ‘পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ থাকার পরও এদেরকেই আল্লাহ মুশরিক বলেছেন। এ কথা কেউ আমাকে মুখে বললে আমি কখনও বিশ্বাস করতাম না। তবে বিশ্বাস না করার আর কোন রাস্তা রইলোনা যখন কুরআনে আল্লাহ এই মুশরিকদের সম্বন্ধেই এভাবে বলেছেন-
“তুমি যদি তাদের জিজ্ঞেস কর কে তাদের সৃষ্টি করেছে, তারা অবশ্যই বলবে আল্লাহ, এরপরও তারা কোথায় ফিরে চলেছে?” (সুরা যুখরুফঃ ৮৭)
“যদি তুমি তাদের জিজ্ঞেস কর এ নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল কে সৃষ্টি করেছেন, তারা অবশ্যই বলবে আল্লাহ”। (সুরা লুকমানঃ ২৫)
“যদি তুমি তাদের জিজ্ঞেস কর, কে আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেন, এরপর তা দিয়ে মৃত মাটিকে সঞ্জীবিত করেন, তবে তারা অবশ্যই বলবে আল্লাহ। বল, সমস্ত প্রসংশা আল্লাহরই, কিন্তু তাদের অধিকাংশই তা বোঝে না”। (সুরা আনকাবুতঃ ৬৩)
আস্তিকতা হলো এমন একটা বিষয় যা মানুষ মাত্রেরই ‘ফিতরাত’ বা সহজাত প্রবৃত্তি। যেকোন মানুষ, তা সে যে ধর্মেরই হোকনা কেন, সৃষ্টিকর্তার উপস্থিতি এবং তাঁর সুবিশাল প্রভাবের বিষয়টি অনুভব না করে পারেনা। এমনকি হাতে গোনা দু-একজন ছাড়া বাকি সব নাস্তিক মনের ভেতরের এক অজানা ভয়ে মৃত্যুর পর তাদের জানাজা না দেয়া, বা ধর্মীয়ভাবে সৎকার না করার কথাও বলে যায়না। সৃষ্টিগত ফিতরাতের জন্য প্রায় সব মানুষ আস্তিক বলেই প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ যতবার কুফর আর শির্ক সম্পর্কে বলেছেন, সকল স্থানে তিনি তাদেরকেই উদ্দেশ্য করেছেন যারা আস্তিকতায় বিশ্বাসী, নাস্তিকতায় নয়। সমস্ত কুরআনে কেবলমাত্র একটি আয়াতে তিনি নাস্তিকদের কথা উল্লেখ করেছেন। সুতরাং কেউ একজন জোর গলায় নিজেকে আস্তিক দাবী করলে সে আল্লাহর কাছে দাঁড়ানোর পর মুসলিম হিসাবে গন্য হবে এমনটি কখনও হবে না।
ইসলামকে নিজের দ্বীন হিসাবে গ্রহণ করা বা না করা একান্তই কারো ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে মুসলিম হবার জন্য প্রত্যেককে আল্লাহর বেঁধে দেয়া শর্তগুলো পূরণ করে তবেই মুসলিম হতে হবে। আমি একটি মুসলিম পরিবারে জন্ম নিয়েছি এবং আমি খুবই আস্তিক- শুধুমাত্র এ ব্যাপারটা আমার মুসলিম পরিচয় বহন করবে আল্লাহর কাছে, তা কখনও হবার নয়। আমরা কখনও একটি কথা ভেবে দেখি না যে, আমাদের পাশের বাড়ীর নন মুসলিম পরিবারে যে শিশুটি জন্ম নিলো সে তো ইচ্ছে করে ওখানে আসেনি, বরং আল্লাহ চাইছেন বলেই এসেছে। অন্যদিকে আমিও ইচ্ছা করে মুসলিম পরিবারে জন্ম নেইনি, এটাও হয়েছে আল্লাহ চাইছেন বলেই। আল্লাহ, যিনি হলেন সর্বোত্তম ইনসাফকারী এবং শ্রেষ্ঠতম বিচারক তিনি কি এজন্যই আমাকে জান্নাত দেবেন আর নন মুসলিম পরিবারে পাঠিয়ে সেই ছেলেটিকে জাহান্নামে দেবেন? নিশ্চয়ই এটা আল্লাহর ইনসাফ হতে পারে না।
কোন লোক ঈমানদার কিনা তার প্রাথমিক নির্দেশকারী হলো সালাত বা নামাজ। রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন, “ইসলাম এবং কুফর এর পার্থক্যকারী বিষয় হলো সালাত” (সহীহ বুখারী)। তাঁর সাহাবীগন বলেছেন, “রাসুলুল্লাহ সাঃ এর সময় কোন লোক সালাত ছাড়া অন্য কিছু ত্যাগ করলে আমরা তাকে কাফির বলতাম না”। অর্থাৎ, তখন যদি মুসলিম নামধারী কেউ সালাত ত্যাগ করতো, তাহলে সে লোকটি ইসলামের বাইরে বলেই গণ্য হতো।
একজন মানুষের ইসলামী নাম, ইসলামী পরিবারে জন্মগ্রহণ কিংবা ইসলামী আচার অনুষ্ঠানে সামাজিকভাবে অংশগ্রহণের ফলে তার মুসলিম পরিচয় আমাদের চোখে হতে পারে কিন্তু মুসলিমের মতো কর্ম না হলে ইসলামের চোখে সে মুসলিম নয়। আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন এবং মুসলিম হিসাবে আমাদের মৃত্যু দিন।
– আবু উসাইদ