সফল কর্মীর পরিচয়
ভূমিকা :
মুমিন জীবন সফলতার, ব্যর্থতার নয়। তাওহীদভিত্তিক দাওয়াতী সংগঠনের কর্মীরা ঈমানী জীবন যাপন করে থাকেন। তাক্বওয়ার স্থায়ী বন্ধন হিসাবে তারা আল্লাহর রেযামন্দি লাভে সদা তৎপর থাকেন। জাহেলিয়াতের ময়দানে ঝঞ্ঝাবিক্ষুদ্ধ প্রতিকূল পরিবেশে যখন পরীক্ষার সম্মুখীন হন, তখন ধৈর্যের বাঁধনকে আরো শক্ত করেন। আর যখন তাকে দ্বীনি বসন্তের মহা সাফল্য স্বাগত জানায়, তখন তিনি আল্লাহর সামনে অবনত মস্তকে হৃদয় নিংড়ানো কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তাই কোন কর্মী সাফল্যের সোপানে দাঁড়িয়ে যেকোন অনৈতিক কাজকে সিংহের আক্রমণের চেয়েও বেশী ভয় পান। তিনি যেকোন মুহূর্তে জীবন দিতে প্রস্ত্তত থাকেন, কিন্তু আদর্শকে কখনো জলাঞ্জলি দেন না। কারণ আদর্শ চির অম্লান। অনেক কর্মী সফলতা লাভে ব্যর্থ হন কিংবা দীর্ঘ দিনের গচ্ছিত সফলতাকে মুহূর্তের মধ্যে তছনছ করে ফেলেন; দুনিয়া ও আখেরাত উভয়টিই হারান। এমন জীবন যেন কারো না হয়। নিম্নে সফল কর্মীর কতিপয় বৈশিষ্ট্য আলোচনা করা হল।
(১) নির্ভেজাল তাওহীদের আহবায়ক :
আল্লাহর প্রতি খাঁটি বিশ্বাস ও প্রকৃষ্ট তাক্বওয়া সফল কর্মীর সর্বশ্রেষ্ঠ গুণ। খালেছ তাওহীদশূন্য জীবন মৃত লাশের মত। যিনি তাওহীদকে লালন করেন এবং সেই দিকে মানুষকে আহবান করেন মূলতঃ তিনিই কৃতকার্য ব্যক্তি।
عَنِ ابْنَ عَبَّاسٍ يَقُوْلُ لَمَّا بَعَثَ النَّبِىُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مُعَاذًا نَحْوَ الْيَمَنِ قَالَ لَهُ إِنَّكَ تَقْدَمُ عَلَى قَوْمٍ مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ فَلْيَكُنْ أَوَّلَ مَا تَدْعُوْهُمْ إِلَى أَنْ يُوَحِّدُوا اللهَ تَعَالَى فَإِذَا عَرَفُوْا ذَلِكَ فَأَخْبِرْهُمْ أَنَّ اللهَ فَرَضَ عَلَيْهِمْ خَمْسَ صَلَوَاتٍ فِىْ يَوْمِهِمْ وَلَيْلَتِهِمْ فَإِذَا صَلُّوْا فَأَخْبِرْهُمْ أَنَّ اللهَ افْتَرَضَ عَلَيْهِمْ زَكَاةً فِىْ أَمْوَالِهِمْ تُؤْخَذُ مِنْ غَنِيِّهِمْ فَتُرَدُّ عَلَى فَقِيْرِهِمْ فَإِذَا أَقَرُّوْا بِذَلِكَ فَخُذْ مِنْهُمْ وَتَوَقَّ كَرَائِمَ أَمْوَالِ النَّاسِ.
ইবনু আববাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলতেন, রাসূল (ছাঃ) যখন মু‘আয (রাঃ)-কে ইয়ামানে পাঠালেন তখন তিনি তাকে লক্ষ্য করে বলেন, নিশ্চয় তুমি আহলে কিতাবদের একটি সম্প্রদায়ের নিকট যাচ্ছ। সুতরাং তুমি সর্বপ্রথম তাদেরকে আহবান করবে তাওহীদের দিকে, যেন তারা আল্লাহর একত্বকে মেনে নেয়। যদি তারা তা মেনে নেয় তাহলে তাদেরকে বলবে, আল্লাহ তাদের উপর দিনে-রাতে পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত ফরয করেছেন। তারা যদি ছালাত আদায় করে তবে তাদেরকে জানাবে যে, আল্লাহ তাদের উপর যাকাত ফরয করেছেন, যা ধনীদের নিকট থেকে আদায় করা হবে এবং গরীবদের মাঝে বিতরণ করা হবে। তারা যদি এটা মেনে নেয় তাহলে তাদের নিকট থেকে তা গ্রহণ করবে। তবে মানুষের সম্পদের মূল্যের ব্যাপারে সাবধান থাকবে (ছহীহ বুখারী হা/৭৩৭২)।
খালেছ তাওহীদে বিশ্বাসী কোন কর্মী শিরকের সামনে কখনো মাথা নত করেন না। তিনি মাথা দিতে প্রস্ত্তত থাকেন কিন্তু নির্ভেজাল আক্বীদা তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া যায় না। যেমন লোমহর্ষক বর্বর নির্যাতন সত্ত্বেও বেলাল (রাঃ)-এর মুখ থেকে তাওহীদের কথাই উচ্চারিত হচ্ছিল। সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজ থেকে নিষেধ- ইসলামী দাওয়াতের এই মূলনীতিকে ধারণ করে নির্ভেজাল তাওহীদের আহবায়ক সামনে অগ্রসর হন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَلْتَكُنْ مِنْكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوْفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ وَلَا تَكُوْنُوا كَالَّذِيْنَ تَفَرَّقُوْا وَاخْتَلَفُوْا مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْبَيِّنَاتُ وَأُولَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ عَظِيْمٌ
‘আর তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকা উচিত, যারা কল্যাণের দিকে আহবান করবে এবং ভাল কাজের আদেশ করবে ও মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করবে। আর তারাই হবে সফলকাম’। তোমরা তাদের মত হয়ো না, যাদের নিকট প্রকাশ্য প্রমাণ আসার পরও তারা বিভক্ত হয়েছে ও মতানৈক্য করেছে। তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি’ (আলে ইমরান ১০৪-১০৫)। অন্যত্র বলেন, كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُوْنَ بِالْمَعْرُوْفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَتُؤْمِنُوْنَ بِاللهِ ‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত। তোমাদের উত্থান ঘটান হয়েছে মানবজাতির জন্য। তোমরা ভাল কাজের আদেশ করবে এবং মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করবে এবং আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে’ (আলে ইমরান ১১০)। নির্ভেজাল তাওহীদের দাওয়াতের মাধ্যমেই মদীনায় যুবকাফেলার সূচনা হয়েছিল। মদীনা থেকে মক্কায় আগত ১২ জনের একটি প্রতিনিধি দলের সামনে রাসূল (ছাঃ) যা পেশ করেছিলেন তা নিম্নের হাদীছে বর্ণিত হয়েছে।
عَنْ عُبَادَةَ بْنَ الصَّامِتِ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ بَايِعُوْنِىْ عَلَى أَنْ لاَ تُشْرِكُوْا بِاللهِ شَيْئًا وَلاَ تَسْرِقُوْا وَلاَ تَزْنُوْا وَلاَ تَقْتُلُوْا أَوْلاَدَكُمْ وَلاَ تَأْتُوْا بِبُهْتَانٍ تَفْتَرُوْنَهُ بَيْنَ أَيْدِيْكُمْ وَأَرْجُلِكُمْ وَلاَ تَعْصُوْا فِىْ مَعْرُوْفٍ فَمَنْ وَفَى مِنْكُمْ فَأَجْرُهُ عَلَى اللهِ وَمَنْ أَصَابَ مِنْ ذَلِكَ شَيْئًا فَعُوْقِبَ فِى الدُّنْيَا فَهُوَ كَفَّارَةٌ لَهُ وَمَنْ أَصَابَ مِنْ ذَلِكَ شَيْئًا ثُمَّ سَتَرَهُ اللهُ فَهُوَ إِلَى اللهِ إِنْ شَاءَ عَفَا عَنْهُ وَإِنْ شَاءَ عَاقَبَهُ فَبَايَعْنَاهُ عَلَى ذَلِكَ .
উবাদাহ বিন ছামেত (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ)-এর পার্শ্বে তাঁর ছাহাবীদের একটি জামা‘আত উপস্থিত ছিলেন। তখন তিনি বলেন, তোমরা আমার নিকট এই মর্মে বায়‘আত কর যে, তোমরা আল্লাহর সঙ্গে কোন কিছুকে শরীক করবে না, তোমরা চুরি করবে না, ব্যভিচার করবে না, সন্তান হত্যা করবে না, মিথ্যা অপবাদ দিবে না যা তোমরা পরস্পরে তোমাদের হাত ও পায়ের মাধ্যমে দিয়ে থাক এবং তোমরা সৎ কাজের ক্ষেত্রে অবাধ্যতা করবে না। তোমাদের মধ্যে যে এইগুলো পূরণ করবে তার জন্য প্রতিদান রয়েছে আল্লাহর নিকটে। আর যে ব্যক্তি এগুলোর মধ্যে কোনটা করবে তাকে দুনিয়াতে শাস্তি দেওয়া হবে। তখন এটা তার জন্য কাফফারা হয়ে যাবে। তাছাড়া যে এগুলোর সাথে জড়িত হবে আল্লাহ তা গোপন রাখবেন। তিনি ইচ্ছা করলে মাফ করে দিবেন অথবা তাকে তিনি শাস্তি দান করবেন। রাবী বলেন, অতঃপর আমরা তাঁর কাছে এর উপর বায়‘আত করলাম (ছহীহ বুখারী হা/১৮, ‘ঈমান’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১১; ছহীহ মুসলিম হা/৪৫৫৮, ‘দন্ডবিধি’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১০; মিশকাত হা/১৮)। ব্যক্তিগত উক্ত শর্ত পূরণের পর রাসূল (ছাঃ) পরের বছর পেশ করেন আরো কয়েকটি শর্ত। আর এই শর্তগুলো সবই সামাজিক।
فَقُلْنَا يَا رَسُوْلَ اللهِ عَلاَمَا نُبَايِعُكَ قَالَ تُبَايِعُوْنِىْ عَلَى السَّمْعِ وَالطَّاعَةِ فِى النَّشَاطِ وَالْكَسَلِ والنَّفَقَةِ فِى الْعُسْرِ وَالْيُسْرِ وَعَلَى الأَمْرِ بِالْمَعْرُوْفِ وَالنَّهْىِ عَنِ الْمُنْكَرِ وَأَنْ تَقُوْلُوْا فِى اللهِ لاَ تَخَافُوْنَ فِى اللهِ لَوْمَةَ لاَئِمٍ وَعَلَى أَنْ تَنْصُرُوْنِىْ فَتَمْنَعُوْنِىْ إِذَا قَدِمْتُ عَلَيْكُمْ مِمَّا تَمْنَعُوْنَ مِنْهُ أَنْفُسَكُمْ وَأَزْوَاجَكُمْ وَأَبْنَاءَكُمْ وَلَكُمُ الْجَنَّةُ.
জাবের ইবনু আব্দুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমরা আপনার নিকট কিসের উপর বায়‘আত করব? তিনি বললেন, (১) তোমরা আমার নিকট বায়‘আত করো সন্তুষ্টি ও অলসতায় কথা শ্রবণ করবে ও আনুগত্য করবে, (২) সচ্ছল ও অসচ্ছল সর্বাবস্থায় আল্লাহর পথে ব্যয় করবে (৩) সৎ কাজের আদেশ দিবে এবং অসৎ কাজে বাধা দিবে, (৪) আল্লাহর পক্ষে কথা বলবে তাতে তোমাদেরকে যেন নিন্দুকের নিন্দা পাকড়াও না করে এবং (৫) আমি যখন ইয়াছরিব (মদীনায়) আগমন করব তখন তোমরা আমাকে সাহায্য করবে। অতঃপর তোমরা আমাকে অনুরূপ নিরাপত্তা দিবে যেমন নিরাপত্তা দাও তোমাদেরকে, তোমাদের স্ত্রীদেরকে এবং তোমাদের সন্তানদেরকে। তাহলে তোমাদের জন্য জান্নাত রয়েছে (ছহীহ ইবনু হিববান হা/৭০১২; মুসনাদে আহমাদ হা/১৪৬৯৪; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৬৭)। হাদীছটি ছহীহ মুসলিমে নিম্নরূপ এসেছে-
عَنْ عُبَادَةَ بْنِ الْوَلِيْدِ قَالَ بَايَعْنَا رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَى السَّمْعِ وَالطَّاعَةِ فِى الْعُسْرِ وَالْيُسْرِ وَالْمَنْشَطِ وَالْمَكْرَهِ وَعَلَى أَثَرَةٍ عَلَيْنَا وَعَلَى أَنْ لاَ نُنَازِعَ الأَمْرَ أَهْلَهُ وَعَلَى أَنْ نَقُوْلَ بِالْحَقِّ أَيْنَمَا كُنَّا لاَ نَخَافُ فِى اللهِ لَوْمَةَ لاَئِمٍ.
উবাদা বিন ওয়ালী (রাঃ) বলেন, আমরা রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট বায়‘আত করেছিলাম এই মর্মে যে, সচ্ছল-অসচ্ছল ও সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টি সর্বাবস্থায় আপনার কথা শুনব ও মেনে চলব, আমাদের উপরে কাউকে প্রাধান্য দিলেও, আমরা নেতৃত্ব নিয়ে ঝগড়া করব না এবং আমরা যেখানেই থাকি হক্ব কথা বলব আল্লাহর জন্য নিন্দুকের নিন্দাকে পরোয়া করব না। =ছহীহ মুসলিম হা/৪৮৭৪; মিশকাত হা/৩৬৬৬।
(২) তাক্বওয়া ও তাওয়াক্কুলের বলে বলিয়ান :
তাক্বওয়া মুমিন জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ। যেকোন কাজের ভিত্তি যদি তাক্বওয়া হয়, তাহলে তা একদিন সফলতার তীরে পৌঁছাবেই। যোগ্য কর্মী নিজের যাবতীয় কাজ আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে আল্লাহকে দেখিয়ে করে থাকেন। যাকে ইহসান বলে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, أَنْ تَعْبُدَ اللهَ كَأَنَّكَ تَرَاهُ فَإِنْ لَمْ تَكُنْ تَرَاهُ فَإِنَّهُ يَرَاكَ ‘তুমি আল্লাহর ইবাদত করো এমনভাবে, যেন আল্লাহ তোমাকে দেখছেন। যদি তুমি তাকে দেখতে না পাও তাহলে মনে করো তিনি তোমাকে দেখছেন’ (বুখারী হা/৫০; মিশকাত হা/২)। তাহলে আল্লাহভীতি যে সব কাজেই থাকতে হবে তা পরিষ্কার হয়ে গেল। অন্য হাদীছে এসেছে রাসূল (ছাঃ) জনৈক ছাহাবীকে বলেন, أُوْصِيْكَ بِتَقْوَى اللهِ فَإِنَّهُ رَأْسُ كُلِّ شَىْءٍ ‘আমি তোমাকে তাক্বওয়া অর্জনের জন্য অছিয়ত করছি। কারণ তাক্বওয়া সকল কিছুর মুকুট’ (আহমাদ হা/১১৭৯১, সনদ ছহীহ)। সফল কর্মী হিসাবে তাক্বওয়ার উপরে সকল কাজের ভিত্তি স্থাপন করতে হবে। তাহলে আল্লাহ অবশ্যই সফলতা দান করবেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَمَنْ يَتَّقِ اللهَ يَجْعَلْ لَهُ مَخْرَجًا- وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ وَمَنْ يَتَوَكَّلْ عَلَى اللهِ فَهُوَ حَسْبُهُ إِنَّ اللهَ بَالِغُ أَمْرِهِ.
‘যে ব্যক্তি তাক্বওয়া অবলম্বন করবে আল্লাহ তার পথ উন্মুক্ত করে দিবেন। আর তাকে তিনি কোথায় থেকে রুযী দান করেন সে কল্পনাও করতে পারবে না। আর যে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করবে আল্লাহই তার জন্য যথেষ্ট হবেন, আল্লাহ তার ইচ্ছা পূরণ করবেনই’ (তালাক ২-৩)। আল্লাহ তা‘আলার চিরন্তন ঘোষণা, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাদের সাথেই আছেন যারা তাক্বওয়াশীল এবং সৎকর্মপরায়ণ’ (নাহল ১২৮)। ইবরাহীম, মূসা, ঈসা, মুহাম্মাদ (ছাঃ) প্রমুখ নবী বিপদের মুহূর্তে তাক্বওয়া ও তাওয়াক্কুলের যে দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন, তা প্রকৃত কর্মীকে সর্বদা উজ্জীবিত রাখে।
(৩) সৎকর্মে অবিচল ব্যক্তি :
সৎ আমল মুমিন বান্দাকে সর্বদা তাওহীদী চেতনায় জাগ্রত রাখে। তাই তিনি আল্লাহর সাথে মুলাক্বাতের তীব্র বাসনায় ফরয ইবাদত সমূহের সাথে সাথে নিয়মিত নফল ইবাদতকে গুরুত্ব দেন। অপরকে কোন আমলের কথা বলার আগে নিজে তা বাস্তবায়ন করেন। চলার পথে কখনো ত্রুটি হয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর পথে ছাদাক্বা দেন। তওবা করে নিজেকে পাপমুক্ত করার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেন। কারণ তার উদ্দেশ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি। আল্লাহ বলেন,
فَمَنْ كَانَ يَرْجُو لِقَاءَ رَبِّهِ فَلْيَعْمَلْ عَمَلًا صَالِحًا وَلَا يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهِ أَحَدًا
‘সুতরাং যে তার প্রতিপালকের সাক্ষাৎ কামনা করে সে যেন সৎকর্ম করে ও তার প্রতিপালকের ইবাদতে কাউকেও শরীক না করে’ (কাহফ ১১০)। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন,
إِلَّا مَنْ تَابَ وَآمَنَ وَعَمِلَ عَمَلًا صَالِحًا فَأُولَئِكَ يُبَدِّلُ اللهُ سَيِّئَاتِهِمْ حَسَنَاتٍ وَكَانَ اللهُ غَفُوْرًا رَحِيْمًا وَمَنْ تَابَ وَعَمِلَ صَالِحًا فَإِنَّهُ يَتُوْبُ إِلَى اللهِ مَتَابًا
‘তবে তারা নয় যারা তওবা করে, ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে; আল্লাহ তাদের পাপ পরিবর্তন করে দিবেন পুণ্যের দ্বারা। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। যে ব্যক্তি তওবা করে ও সৎকর্ম করে সে সম্পূর্ণরূপে আল্লাহ অভিমুখী হয়’ (ফুরক্বান ৭০-৭১)। রাতের ইবাদত ও দিনে বেশী বেশী নফল ছিয়াম পালনের মাধ্যমে তাক্বওয়ার বাঁধনকে আরো শক্তিশালী করেন।
(৪) ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শনকারী :
ধৈর্য একটি বিশেষ বদান্যতা। ধৈর্যশূন্য কোন মানুষ মহৎ হতে পারে না, পারে না সফলতার শীর্ষে আরোহন করতে। মহা সত্যের ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করতে গেলে অনেক বিপদ-মুছীবত আসে তখন চরম ধৈর্যের পরিচয় দিতে হয়। এটা নবী-রাসূল ও হক্বপন্থী ওলামায়ে কেরামেরই ধারাবাহিক কর্মসূচী। আল্লাহ সাক্ষী দিচ্ছেন-
وَكَأَيِّنْ مِنْ نَبِيٍّ قَاتَلَ مَعَهُ رِبِّيُّوْنَ كَثِيْرٌ فَمَا وَهَنُوْا لِمَا أَصَابَهُمْ فِىْ سَبِيْلِ اللهِ وَمَا ضَعُفُوْا وَمَا اسْتَكَانُوْا وَاللهُ يُحِبُّ الصَّابِرِيْنَ. وَمَا كَانَ قَوْلَهُمْ إِلَّا أَنْ قَالُوْا رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا ذُنُوْبَنَا وَإِسْرَافَنَا فِىْ أَمْرِنَا وَثَبِّتْ أَقْدَامَنَا وَانْصُرْنَا عَلَى الْقَوْمِ الْكَافِرِيْنَ. فَآتَاهُمُ اللهُ ثَوَابَ الدُّنْيَا وَحُسْنَ ثَوَابِ الْآخِرَةِ وَاللهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِيْنَ.
‘এমন অনেক নবী ছিলেন, যাদের সহযোগে আল্লাহভক্ত লোকেরা যুদ্ধ করেছিল; বরং আল্লাহর পথে যা সংঘটিত হয়েছিল তাতে তারা নিরুৎসাহিত হয়নি, শক্তিহীন হয়নি ও বিচলিত হয়নি। আল্লাহ ধৈর্যশীলদের ভালবাসেন। আর এতদ্ব্যতীত তাদের অন্য কোন কথা ছিল না যে, তারা বলত, হে আমাদের প্রভু! আমাদের অপরাধ ও আমাদের বাড়াবাড়ি ক্ষমা করুন এবং আমাদের পদসমূহ সুদৃঢ় করুন এবং অবিশ্বাসীদের উপর আমাদের সাহায্য করুন। অনন্তর আল্লাহ তাদেরকে পার্থিব পুরস্কার প্রদান করেন এবং পরকালের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার দেবেন। আর আল্লাহ সৎকর্মশীলদেরকে ভালবাসেন’ (আলে ইমরান ১৪৬-১৪৮)।
عَنِ ابْنِ عُمَرَ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ الْمُسْلِمُ الَّذِي يُخَالِطُ النَّاسَ وَيَصْبِرُ عَلَى أَذَاهُمْ أَفْضَلُ مِنَ الَّذِىْ لَا يُخَالِطُهُمْ وَلَا يَصْبِرُ عَلَى أَذَاهُمْ.
ইবনু ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী (ছাঃ) বলেছেন, যে মুসলিম ব্যক্তি মানুষের সাথে চলাফেরা করে এবং তাদের জ্বালা-যন্ত্রণা-কষ্টে ধৈর্যধারণ করে তিনি ঐ ব্যক্তি অপেক্ষা উত্তম যে তাদের সাথে চলাফেরা করে না এবং যন্ত্রণা ও সহ্য করে না (তিরমিযী হা/২৫০৭, ‘ক্বিয়ামতের বিবরণ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৫৫; মিশকাত হা/৫০৮৭; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৪৮৬৫)।
(৫) উত্তম চরিত্রের অধিকারী :
বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা উত্তম চরিত্রের কাঙ্গাল। সচ্চরিত্র ও সদাচরণের অনুপস্থিতিতে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ কলুষিত হয়েছে। জাহেলী যুগের ন্যায় আজ নষ্টামি চরিত্রের রূপ ধারণ করেছে। তাই বর্তমান সমাজের অবস্থান সংশোধন করতে হলে একজন সফল কর্মীকে সর্বশ্রেষ্ঠ চরিত্রের অধিকারী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর পূত-পবিত্র জীবনের অনুসরণ করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা রাসূল (ছাঃ)-কে লক্ষ্য করে বলেন, وَإِنَّكَ لَعَلَى خُلُقٍ عَظِيْمٍ ‘নিশ্চয় আপনি মহান চরিত্রের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত’ (কলম ৪)।
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِنَّ مِنْ خِيَارِكُمْ أَحْسنَكُمْ أَخْلَاقًا.
আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘নিশ্চয় তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই সর্বাপেক্ষা উত্তম যে চরিত্রের দিক থেকে উত্তম’ (মুত্তাফাক্ব আলাইহ; বুখারী হা/৩৫৫৯; মিশকাত হা/৫০৭৫; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৪৮৫৪)।
عَنِ النَّوَّاسِ بْنِ سمْعَانَ قَالَ سَأَلْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنِ الْبِرِّ وَالْإِثْمِ فَقَالَ الْبِرُّ حُسْنُ الْخُلُقِ وَالْإِثْمُ مَا حَاكَ فِىْ صَدْرِكَ وَكَرِهْتَ أَنْ يَّطَّلِعَ عَلَيْهِ النَّاسُ.
নাওয়াস ইবনু সাম‘আন (রাঃ) বলেন, আমি একদা রাসূল (ছাঃ)-কে পুণ্য ও পাপ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। উত্তরে তিনি বললেন, পুণ্য হ’ল উত্তম চরিত্র। আর পাপ হ’ল, যে কাজ তোমার মনে সন্দেহ সৃষ্টি করে এবং ঐ কাজ মানুষের নিকট প্রকাশ পাওয়াকে অপসন্দ কর (ছহীহ মুসলিম হা/৬৬৮০, ‘সৎকর্ম, সচ্চরিত্র ও শিষ্টাচার’ অধ্যায়; মিশকাত হা/৫০৭৩; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৪৮৫২, ৯/১৬৭ পৃঃ, ‘কোমলতা, লাজুকতা ও সচ্চরিত্রতা’ অনুচ্ছেদ)।
عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهَا قَالَتْ سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُوْلُ إِنَّ الْمُؤْمِنَ لَيُدْرِكُ بِحُسْنِ خُلُقِهِ دَرَجَةَ قَائِمِ اللَّيْلِ وصَائِمِ النَّهَارِ.
আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, ‘নিশ্চয় মুমিন ব্যক্তি তার উত্তম চরিত্রের কারণে রাত্রিতে তাহাজ্জুদ ছালাত আদায়কারী এবং দিনে নফল ছিয়াম পালনকারীর মর্যাদা লাভ করবে (আবুদাঊদ হা/৪৭৯৮, সনদ ছহীহ, ‘শিষ্টাচার’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৮; মিশকাত হা/৫০৮২; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৪৮৬০, ৯/১৭০ পৃঃ)।
উত্তম চরিত্রের অধিকারী মানুষের সংখ্যা খুবই কম। এটা যেন আজ সোনার হরিণ। কে উত্তম চরিত্রের গুণে গুণান্বিত তার কয়েকটি নমুনা নিম্নে পেশ করা হল :
(ক) দয়ার্দ্র ভাষা :
অপরিচিত মানুষের সাথে প্রথম পরিচয় ঘটে কথা, লেখনি কিংবা চিঠির ভাষার মাধ্যমে। তাই কথা শুনলে, লেখনি পড়লে এবং চিঠির ভাষা উচ্চারণ করলেই তার সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা পাওয়া যায়। একজন দাঈর জন্য ভাষা অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সে জন্যই রাসূল (ছাঃ)-কে লক্ষ্য করে আল্লাহ বলেন,
فَبِمَا رَحْمَةٍ مِنَ اللهِ لِنْتَ لَهُمْ وَلَوْ كُنْتَ فَظًّا غَلِيْظَ الْقَلْبِ لَانْفَضُّوْا مِنْ حَوْلِكَ فَاعْفُ عَنْهُمْ وَاسْتَغْفِرْ لَهُمْ وَشَاوِرْهُمْ فِي الْأَمْرِ فَإِذَا عَزَمْتَ فَتَوَكَّلْ عَلَى اللهِ إِنَّ اللهَ يُحِبُّ الْمُتَوَكِّلِيْنَ
‘অতএব আল্লাহর অনুগ্রহ এই যে, আপনি তাদের প্রতি কোমল চিত্ত। আপনি যদি কর্কশভাষী, কঠোর হৃদয় হতেন তাহলে তারা আপনার সংসর্গ হতে দূরে সরে যেত। অতএব আপনি তাদেরকে ক্ষমা করুন এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন এবং কাজের ব্যাপারে তাদের সাথে পরামর্শ করুন। আর যখন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন তখন আল্লাহর প্রতি নির্ভর করুন। নিশ্চয় আল্লাহ নির্ভরশীলদেরকে ভালবাসেন’ (আলে ইমরান ১৫৯)।
عَنْ أَبِي الدَّرْدَاءَ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ إِنَّ أَثْقَلَ شَيْءٍ يُوْضَعُ فِىْ مِيْزَانِ الْمُؤْمِنِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ خُلُقٌ حَسَنٌ وَإِنَّ اللهَ يُبْغِضُ الْفَاحِشَ الْبَذِيءَ.
আবু দারদা (রাঃ) রাসূল (ছাঃ) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, ক্বিয়ামতের দিন মুমিনের পাল্লায় সর্বাপেক্ষা ভারী যে আমলটি রাখা হবে তা হল উত্তম চরিত্র। আর নিশ্চয় আল্লাহ অশলীলভাষী দুশ্চরিত্র ব্যক্তিকে ঘৃণা করেন (তিরমিযী হা/২০০২; মিশকাত হা/৫০৮১; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৪৮৫৯)।
عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ سَمِعَ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُوْلُ إِنَّ الْعَبْدَ لَيَتَكَلَّمُ بِالْكَلِمَةِ مَا يَتَبَيَّنُ فِيْهَا يَزِلُّ بِهَا فِى النَّارِ أَبْعَدَ مِمَّا بَيْنَ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ.
আবু হুরায়রাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূল (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছেন, নিশ্চয় কোন বান্দার কথায় এমন বিষয় প্রকাশ পায়, যার দ্বারা সে জাহান্নামের এত গভীরে নিক্ষিপ্ত হয়, যতটা গভীরতা পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে (বুখারী হা/৬৪৭৭; মিশকাত হা/৪৮১৩; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৪৬০২, ৯/৭৭ পৃঃ; আহমাদ হা/৮৯০৯)।
عَنْ أَبِي مَالِكٍ الْأَشْعَرِيِّ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِنَّ فِى الْجَنَّةِ غُرْفَةً يُرَى ظَاهِرُهَا مِنْ بَاطِنِهَا وَبَاطِنُهَا مِنْ ظَاهِرِهَا أَعَدَّهَا اللهُ لِمَنْ أَلَانَ الْكَلَامَ وَأَطْعَمَ الطَّعَامَ وَتَابَعَ الصِّيَامَ وَصَلَّى بِاللَّيْلِ وَالنَّاسُ نِيَامٌ.
আবু মালেক আশ‘আরী (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘নিশ্চয় জান্নাতে একটি বিশাল প্রাসাদ রয়েছে, যার বাহিরটা ভিতর থেকে এবং ভিতরটা বাহির থেকে দেখা যায় (এতই মসৃণ)। আল্লাহ তা‘আলা এই জান্নাত তৈরি করেছেন ঐ ব্যক্তির জন্য যে নরম কথা বলে, ক্ষুধার্তকে খাদ্য দান করে, নিয়মিত নফল ছিয়াম পালন করে এবং রাত্রিতে ছালাত আদায় করে যখন মানুষ ঘুমিয়ে থাকে’ (বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান হা/৩৬০৯; মিশকাত হা/১২৩২; সনদ হাসান, ছহীহুল জামে‘ হা/২১২৩; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/১১৬৪, ৩/১২২ পৃঃ)।
(খ) কোমল ও নম্র ব্যবহার :
ভদ্র ও নম্র ব্যবহারে আদর্শের ব্যাপ্তি লাভ করে। নবী-রাসূলগণ তাদের ব্যবহারের মাধ্যমেই সমাজের পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। নম্রতা ও ভদ্রতায় মুগ্ধ হয়ে বড় বড় গোত্রপতি ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। তাই একজন কর্মীর জন্য উক্ত গুণ অর্জন করা অত্যাবশ্যক।
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ مَسْعُوْدٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَلَا أُخْبِرُكُمْ بِمَنْ يَحْرُمُ عَلَى النَّارِ وَبِمَنْ تَحْرُمُ النَّارُ عَلَيْهِ؟ عَلَى كُلِّ هَيِّنٍ لَيِّنٍ قَرِيْبٍ سَهْلٍ.
আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, আমি কি তোমাদের এমন ব্যক্তি সম্পর্কে জানিয়ে দিব না যার উপর জাহান্নামের আগুন হারাম হয়ে যায় আর আগুনও তাকে স্পর্শ করতে পারবে না? এমন ব্যক্তি হলেন- যার মেযাজ নরম, স্বভাব কোমল, জনগণের সাথে মিশুক এবং চরিত্র সহজ-সরল (আহমাদ হা/৩৯৩৮; তিরমিযী হা/২৪৮৮, ‘ক্বিয়ামতের বিবরণ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৪৫; সনদ ছহীহ, মিশকাত হা/৫০৮৪; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৪৮৬২)।
عَنْ جَرِيْرٍ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ يُحْرَمِ الرِّفْقَ يُحْرَمِ الْخَيْرَ رَوَاهُ مُسْلِمٌ
জারীর (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘যাকে কোমলতা থেকে বঞ্চিত করা হয় তাকে যাবতীয় কল্যাণ থেকে বঞ্চিত করা হয়’ (ছহীহ মুসলিম হা/৬৭৬৩; মিশকাত হা/৫০৬৯; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৪৮৪৮, ৯/১৬৭ পৃঃ)।
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَجُلٌ يَا رَسُوْلَ اللهِ إِنَّ فُلَانَةً تُذْكَرُ مِنْ كَثْرَةِ صَلَاتِهَا وَصِيَامِهَا وَصَدَقَتِهَا غَيْرَ أَنَّهَا تُؤْذِىْ جِيْرَانَهَا بِلِسَانِهَا قَالَ هِيَ فِي النَّارِ قَالَ يَا رَسُولَ اللهِ فَإِنَّ فُلَانَةً تُذْكَرُ قِلَّةَ صِيَامِهَا وَصَدَقَتِهَا وَصَلَاتِهَا وَإِنَّهَا تَصَدَّقُ بِالْأَثْوَارِ مِنَ الْأَقِطِ وَلَا تُؤْذِىْ جِيْرَانَهَا قَالَ هِيَ فِى الْجَنَّةِ .
আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, একদা জনৈক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! অমুক মহিলা সম্পর্কে জনশ্রুতি আছে যে, সে বেশী বেশী ছালাত আদায় করে, ছিয়াম পালন করে এবং ছাদাক্বাহ করে। কিন্তু সে কথা দ্বারা প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয়। রাসূল (ছাঃ) উত্তরে বললেন, ঐ মহিলা জাহান্নামী। ঐ ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আরেক মহিলা সম্পর্কে জনশ্রুতি আছে, সে কম কম ছিয়াম পালন করে, অল্প করে দান করে এবং কম করে ছালাত আদায় করে। তার দানের পরিমাণ হল পনীরের টুকরার মত। কিন্তু সে কথা দ্বারা প্রতিবেশীদেরকে কষ্ট দেয় না। রাসূল (ছাঃ) উত্তরে বললেন, এই মহিলা জান্নাতী (আহমাদ হা/৯৬৭৩; মিশকাত হা/৪৯৯২; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৪৭৭৫, ৯/১৩৯ পৃঃ, সনদ হাসান)।
عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ عَنِ النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ إِنَّ الرَّحِمَ سُجْنَةٌ مِنَ الرَّحْمَنِ فَقَالَ اللهُ مَنْ وَصَلَكِ وَصَلْتُهُ وَمَنْ قَطَعَكِ قَطَعْتُهُ.
আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘রেহেম’ বা দয়া শব্দটি রহমান হতে উদ্ভূত। সে কারণে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, যে তোমাকে ধরে রাখে আমিও তাকে ধরে রাখব। আর যে তোমাকে বিচ্ছিন্ন করবে আমিও তাকে বিচ্ছিন্ন করে দেব’ (বুখারী হা/৫৯৮৮; মিশকাত হা/৪৯২০; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৪৭০৩, ৯/১১৫ পৃঃ)।
(গ) হাস্যোজ্জ্বল চেহারা, মিষ্টি হাসি, শীতল চক্ষু :
এই বৈশিষ্ট্য একজন সফল কর্মীর অমূল্য সম্পদ। এমন গুণে গুণান্বিত ব্যক্তির পাশে মানুষ আশ্রয় গ্রহণ করে। তার পরশে এসে প্রশান্তি লাভ করে। তাছাড়া চক্ষু ব্যক্তির আকর্ষণ। চোখের চাহনি মানুষের হৃদয়কে বিগলিত করে। কিন্তু যে চোখ চৈত্রের খরার মত তা কি মানুষের মন শীতল করে? দুঃখজনক হল- সমাজের অনেক মানুষের চেহারায় এমন কুৎসিত ছাপ পড়ে থাকে যার কারণে মানুষ তার পাশে যেতে চায় না। কখনো কেউ কাছে আসলেও তার অশালিন ভাষা, রুক্ষ ব্যবহার, কর্কষ বাক্য, অশ্রাব্য বকাবকি তাকে দূরে সরিয়ে দেয়। আর কখনো তার ধারে কাছে আসে না। নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির মাঝে এই স্বভাবের সমাবেশ বেশী ঘটে। একজন সফল দাঈর মাঝে এ ধরনে স্বভাব থাকা খুবই নিন্দনীয়।
عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهَا أَنَّ رَجُلًا اسْتَأْذَنَ عَلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ ائْذَنُوْا لَهُ فَبِئْسَ أَخُو الْعَشِيْرَةِ فَلَمَّا جَلَسَ تَطَلَّقَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِىْ وَجْهِهِ وَانْبَسَطَ إِلَيْهِ فَلَمَّا انْطَلَقَ الرَّجُلُ قَالَتْ عَائِشَةُ يَا رَسُوْلَ اللهِ قُلْتَ لَهُ كَذَا وَكَذَا ثُمَّ تَطَلَّقْتَ فِىْ وَجْهِهِ وَانْبَسَطْتَ إِلَيْهِ فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَتىَ عَهَدْتِنِىْ فُحَّاشًا؟ إِن شَرّ النَّاسِ مَنْزِلَةً يَوْمَ الْقِيَامَةِ مَنْ تَرَكَهُ النَّاسُ اتِّقَاءَ شَرِّهِ.
আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, একদা এক ব্যক্তি রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট এসে তাঁর সাথে সাক্ষাতের অনুমতি প্রার্থনা করল। তখন রাসূল (ছাঃ) ছাহাবীদেরকে বললেন, তোমরা অনুমতি দাও। লোকটি ছিল তার গোত্রের মধ্যে সবচেয়ে দুষ্ট প্রকৃতির। যখন সে বসল তখন রাসূল (ছাঃ) তার সাথে হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় সাক্ষাৎ করলেন এবং হাসি মুখে কথা বললেন। অতঃপর লোকটি চলে গেলে আয়েশা (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! এই লোকটি সম্পর্কে প্রথমে খারাপ উক্তি করলেন। অথচ তার সঙ্গে আপনি হাসি মুখে কথা বললেন? তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন, তুমি আমাকে কখন অশ্লীলভাষী পেয়েছ? ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহর নিকট মর্যাদার দিক থেকে ঐ ব্যক্তি সবচেয়ে মন্দ হবে, যার অনিষ্টের কারণে মানুষ তাকে বর্জন করেছে (বুখারী হা/৬০৩২; মিশকাত হা/৪৮২৯; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৪৬১৮, ৯/৮৩ পৃঃ)।
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ الْحَارِثِ بْنِ جَزْءٍ قَالَ مَا رَأَيْتُ أَحَدًا أَكْثَرَ تَبَسُّمًا مِنْ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ.
আব্দুল্লাহ ইবনু হারেছ ইবনে জাযই (রাঃ) বলেন, আমি রাসূল (ছাঃ)-এর চেয়ে অন্য কাউকে অধিক মুচকি হাসি হাসতে দেখিনি (তিরমিযী হা/৩৬৪১; মিশকাত হা/৪৭৪৮; সনদ ছহীহ)।
(ঘ) মায়াবী চরিত্র :
কোমল ও মায়াবী চরিত্রে বদান্যতার ছাপ ফুটে উঠে। মানুষ তার কাছে গিয়ে প্রশান্তি পায়। নানা দুঃখ বেদনা তার মাঝে থাকলেও সব দূর হয়ে যায়। বিরাট সান্ত্বনা ও অনুপ্রেরণার ঝুড়ি নিয়ে ফিরে আসে। পক্ষান্তরে যাদের মাঝে এই গুণ নেই তারা হয় ধূর্ত, অস্থির ও বাচাল স্বভাবের।
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ الْمُؤْمِنُ غِرٌّ كَرِيْمٌ وَالْفَاجِرُ خَبٌّ لَئِيْمٌ.
আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন, মুমিন ব্যক্তি হয় সরল ও ভদ্র। পক্ষান্তরে পাপী ব্যক্তি হয় ধূর্ত ও হীন চরিত্রের (তিরমিযী হা/১৯৬৪; আবুদাঊদ হা/৪৭৯০; মিশকাত হা/৫০৮৫; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৪৮৬৩)।
(৬) নেতার হক পূর্ণরূপে প্রদানকারী ও নিজের অধিকার আল্লাহর কাছে প্রত্যাশী :
অনেক সময় দায়িত্বশীল ব্যক্তি কর্মীর উপর বৈষম্যমূলক আচরণ করে থাকেন। নানাভাবে কষ্ট দেন। নেতার উক্ত আচরণে কর্মীরা দুঃখ পেয়ে থাকেন। এমতাবস্থায় একজন একনিষ্ঠ কর্মীর বিরল গুণ হল তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতিকে প্রাধান্য দেওয়া। কারণ রাষ্ট্রপতির চেয়ে তাঁর ঝাড়ুদারের মধ্যে যদি তাক্বওয়া বেশী থাকে, তাহলে আল্লাহর নিকট সেই ঝাড়ুদারই সর্বাধিক সম্মানিত। বেলাল (রাঃ) এর প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। দ্বিতীয়তঃ তার প্রাপ্য আল্লাহর কাছে চাওয়া। আর নেতার আনুগত্য ও সহযোগিতার হক্ব তাকে প্রদান করা।
عَنْ عَبْدِ اللهِ قَالَ قَالَ لَنَا رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِنَّكُمْ سَتَرَوْنَ بَعْدِىْ أَثَرَةً وَأُمُوْرًا تُنْكِرُوْنَهَا قَالُوْا فَمَا تَأْمُرُنَا يَا رَسُوْلَ اللهِ قَالَ أَدُّوْا إِلَيْهِمْ حَقَّهُمْ وَسَلُوا اللهَ حَقَّكُمْ.
আব্দুল্লাহ (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) আমাদেরকে বলেছেন, ‘আমার পরে তোমরা অতি শীঘ্রই এমন দায়িত্বশীল ও আমীরদেরকে দেখতে পাবে, যাদেরকে তোমরা অপসন্দ করবে। তারা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আপনি তাহলে আমাদেরকে কী নির্দেশ দিচ্ছেন? তিনি বললেন, তোমরা তাদের হক্ব তাদেরকে দিয়ে দিবে আর তোমাদের হক্ব আল্লাহর কাছে চাইবে (ছহীহ বুখারী হা/৭০৫২; ছহীহ মুসলিম হা/৪৮৮৮)।
(৭) হক্বের পক্ষে সদা সোচ্চার :
চিন্তাশীল ও কর্মঠ কর্মী নমনীয়তা ও শালিনতা বজায় রেখে সত্যের পক্ষে দৃঢ়ভাবে অবস্থান করেন। চরম বিপদের মুহূর্তেও অসৎ সঙ্গ ও ভ্রষ্ট পথ অবলম্বন করেন না। একমাত্র আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করে নিজের অবস্থানে অটল থাকেন। তাক্বওয়ার চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শনের কারণে অবশেষে অভাবনীয় সাফল্য তাকে স্বাগত জানায়। কিন্তু দুঃখজনক হল, এই নীতির ক্ষেত্রে অনেক কর্মীর দ্রুত পতন ঘটে। সত্য ত্যাগ করে মিথ্যা ও বাতিল পক্ষ অবলম্বন করেন। সত্য প্রকাশ না করে নিরপেক্ষ থাকার মিথ্যা ভান করেন। অথচ এই দুইটিই ধ্বংসের পথ। নিরপেক্ষতার দাবী করার অর্থই হল শয়তানের পথকে সুগম করা।
عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ ثَلَاثٌ مُنْجِيَاتٌ وَثَلَاثٌ مُهْلِكَاتٌ فَأَمَّا الْمُنْجِيَاتُ: فَتَقْوَى اللهِ فِي السِّرِّ والعلانيةِ والقولُ بالحقِّ فِي الرضى وَالسُّخْطِ وَالْقَصْدُ فِي الْغِنَى وَالْفَقْرِ وَأَمَّا الْمُهْلِكَاتُ فَهَوًى مُتَّبَعٌ وَشُحٌّ مُطَاعٌ وَإِعْجَابُ الْمَرْءِ بِنَفْسِهِ وَهِيَ أَشَدُّهُنَّ.
আবু হুরায়রাহ (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, তিনটি বিষয় মানুষকে মুক্তি দেয় আর তিনটি বিষয় মানুষকে ধ্বংস করে। মুক্তি দানকারী বিষয়গুলো হল- (ক) প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্য সর্বাবস্থায় আল্লাহকে ভয় করা (খ) সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টি উভয় অবস্থায় সত্য কথা বলা (গ) স্বচ্ছল ও অস্বচ্ছল উভয় অবস্থায় মধ্যমপন্থা অবলম্বন করা। আর ধ্বংসকারী বিষয়গুলো হল- (ক) প্রবৃত্তির অনুসারী হওয়া (খ) লোভ-লালসার পিছনে ছুটা (গ) আত্ম-অহংকার করা। আর এটা ঐগুলোর চেয়ে জঘন্য’ (বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান হা/৬৮৬৫, সনদ ছহীহ; ছহীহুল জামে‘ হা/৫৩৫০; মিশকাত হা/৫১২২; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৪৮৯৪, ৯/১৮০ পৃঃ)।
মনে রাখা আবশ্যক যে, অনেক ক্ষেত্রে সাময়িকভাবে মিথ্যাই প্রতিপত্তি লাভ করে। মিথ্যার তোপের মুখে সত্যাশ্রয়ী ব্যক্তির টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে যায়। এই অবস্থায় প্রকৃত কর্মী আল্লাহর নিকট ফায়সালা কামনা করবেন এবং ধৈর্য ধারণ করবেন (দাহর ২৪)। কোনক্রমে মিথ্যুকদের সাথে আপোস করবেন না। বিনিময়ে তিনি অফুরন্ত প্রতিদান পাবেন (দাহর ১২-২১)। অপরের সাথে তার ভালবাসা থাকতে পারে। তবে তা হবে আল্লাহর জন্য। যদি অন্যায়ের কারণে ভালবাসা ছিন্ন হয় তবে সেটাও হবে আল্লাহর জন্য। প্রকৃত ঈমান তো এখানেই।
عَنْ أَبِىْ أُمَامَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ أَحَبَّ لِلَّهِ وَأَبْغَضَ لِلَّهِ وَأَعْطَى لِلَّهِ وَمَنَعَ لِلَّهِ فَقَدِ اسْتكْمَلَ الْإِيْمَانَ.
আবু উমামা (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য কাউকে ভালবাসল, আল্লাহর জন্য কারো সাথে শত্রুতা পোষণ করল, আল্লাহর জন্য দান করল এবং আল্লাহর দান করা থেকে বিরত থাকল সে অবশ্যই ঈমানকে পরিপূর্ণ করল’ (আবুদাঊদ হা/৪৬৮১; মিশকাত হা/৩০, সনদ ছহীহ)।
উক্ত আপোসহীন নীতি অবলম্বন করার কারণে অনেক সময় যুলুম-নির্যাতনের খড়গ নেমে আসে। এমতাবস্থায় যদি তিনি উত্তম আচরণসহ ধৈর্য ধারণ করে থাকেন তাহলে তার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন সাহায্যকারী নিযুক্ত করা হবে।
عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ أَنَّ رَجُلًا قَالَ يَا رَسُوْلَ اللهِ إِنَّ لىْ قَرَابةَ أَصِلُهُمْ وَيَقْطَعُوْنِّىْ وَأُحْسِنُ إِلَيْهِمْ وَيَسَيِّؤُوْنَ إِلَيّ وَأَحْلِمُ عَلَيْهِم وَيَجْهَلُوْنَ عَلَيَّ فَقَالَ لَئِنْ كُنْتَ كَمَا قُلْتَ فَكَأَنَّمَا تُسِفُّهُمُ الْمَلَّ وَلَا يَزَالُ مَعَكَ مِنَ اللهِ ظَهِيْرٌ عَلَيْهِمْ مَا دُمْتَ عَلَى ذَلِكَ. رَوَاهُ مُسلم
আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, একদা জনৈক ব্যক্তি বলেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমার এমন কিছু আত্মীয় আছে তাদের সাথে আমি সদাচরণ করি কিন্তু তারা আমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে। আমি তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করি কিন্তু তারা আমার সাথে দুর্ব্যবহার করে। আমি তাদের ব্যবহারে ধৈর্য ধারণ করি অথচ তারা আমার সাথে বর্বর আচরণ করে। রাসূল (ছাঃ) উত্তরে বললেন, তুমি যা বললে তা যদি এমনটিই হয় তবে তুমি যেন তাদের মুখের উপর গরম ছাই মারছ। তুমি যতক্ষণ এই নীতি অবলম্বন করবে ততক্ষণ তোমার সাথে আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন সাহায্যকারী থাকবেন, যিনি তাদের ক্ষতিকে প্রতিরোধ করবেন। ছহীহ মুসলিম হা/৬৬৮৯; মিশকাত হা/৪৯২৪; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৪৭০৭, ৯/১১৬ পৃঃ।
(৮) আল্লাহর নিকট প্রতিদান কামনাকারী, মানুষের সৌজন্য প্রত্যাশী নয়।
আমিত্ব প্রকাশ করা নেতৃস্থানীয় অধিকাংশ ব্যক্তির স্বভাব। এটা আমার দ্বারা হয়েছে, এগুলো সব আমিই করেছি, আমি ছাড়া এই কাজ সম্ভব হত না, আমি ছিলাম বলেই এগুলো করা সম্ভব হয়েছে। মূলতঃ গণমানুষের প্রশংসা পাওয়ার জন্যই কথাগুলো বার বার উচ্চারণ করে থাকেন। বিনিময়ে তিনি তার সৎ আমলগুলো সব নষ্ট করে দেন (বাক্বারাহ ২৬৪)। পক্ষান্তরে দূরদর্শী কর্মী সর্বদা একটি বিষয় মাথায় রাখেন যে, কারো উপকার করলে সাধারণত সে একদিন ক্ষতি করতে পারে। তাই তার কাছে কোন প্রতিদান বা প্রশংসা পাওয়ার আশা করেন না; বরং তার ক্ষতির ব্যাপারে সতর্ক থাকেন। আর আল্লাহর কাছে তার প্রতিদান চেয়ে থাকেন। إِنَّمَا نُطْعِمُكُمْ لِوَجْهِ اللهِ لَا نُرِيْدُ مِنْكُمْ جَزَاءً وَلَا شُكُوْرًا ‘শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই আমরা তোমাদেরকে খাদ্য দান করি। আমরা তোমাদের নিকট থেকে কোন প্রতিদান চাই না, কৃতজ্ঞতাও চাই না’ (দাহর ৯)। এটা সফল কর্মীর অনন্য ভূষণ বৈশিষ্ট্য।
(৯) বদমেজাজী ও রুক্ষ স্বভাবমুক্ত হওয়া :
উক্ত গুণ মানুষের স্বভাব বহির্ভূত। দ্বীনের দাঈর মধ্যে থাকার প্রশ্নই আসে না।
عَنْ حَارِثَةَ بْنِ وَهْبٌ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ الْجَوَّاظُ وَلَا الْجَعْظَرِيُّ.
হারেছা বিন ওয়াহাব বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, কঠোর ও রুক্ষ-স্বভাবের ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না (আবুদাঊদ হা/৪৮০১; মিশকাত হা/৫০৮০; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৪৮৫৬, ৯/১৬৯ পৃঃ)।
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْحَيَاءُ مِنَ الْإِيمَانِ وَالْإِيمَانُ فِي الْجَنَّةِ. وَالْبَذَاءُ مِنَ الْجَفَاءِ وَالْجَفَاءُ فِي النَّار.
আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, লজ্জা ঈমানের অঙ্গ। আর ঈমানের বিনিময় হল জান্নাত। পক্ষান্তরে নির্লজ্জতা দুশ্চিরিত্রের অঙ্গ। আর দুশ্চিরিত্রতার স্থান জাহান্নাম (তিরমিযী হা/২০০৯; মিশকাত হা/৫০৭৭; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৪৮৫৬, ৯/১৬৮ পৃঃ)।
(১০) নেতার লোক দেখানো ভালবাসা ও প্রশংসাকে প্রত্যাখ্যানকারী :
সুযোগ্য কর্মী দায়িত্বশীলের অনুসরণ করে থাকেন এবং তার অবস্থান পরখ করেন। ফলে সহজেই তার কাছে নেতার প্রকৃত চরিত্র প্রতিভাত হয়। একপেশে ও অসাংগঠনিক কাজকে বৈধতা দানের লক্ষ্যে যোগ্য কর্মীকে হাত করা এবং তার মুখ বন্ধ রাখার জন্য দায়িত্বশীল জনগণের সামনে তার প্রতি ভালবাসা দেখান ও প্রশংসা করেন। সফল কর্মী নেতার এই ভন্ডামী চরিত্র অবশ্যই উপলব্ধি করেন। এই সূক্ষ্ম প্রতারণা সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের জন্য চরম হুমকি।
(১১) দ্বিমুখী চরিত্র থেকে মুক্ত :
নীতির পরিবর্তন ঘটানো পদস্খলনের সর্বশেষ স্তর। এটা মুনাফেকী ও চুগলখোরী চরিত্র। এ ধরনের ব্যক্তির মাঝে তাক্বওয়ার লেশমাত্র থাকে না। ফলে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয়। অতি লোভের কারণে সত্য-মিথ্যা উভয়ের পক্ষে থাকে। যখন যার বসন্ত আসে তখন তার পক্ষে থাকে। এই জঘন্য স্বভাবের জন্য আল্লাহ তাদেরকে জাহান্নামের সর্বনিম্নে নিক্ষেপ করবেন (নিসা ১৪৫)। সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের লোকের সংখ্যা অনেক। নেতাদের পাশে এরাই বেশী ঠাঁই পায়। কারণ দুষ্ট চরিত্রের লোকের মিষ্টি কথায় নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি দ্রুত সিক্ত হন। ফলে তাদের হাতে যাবতীয় ক্ষমতা অর্পণ করেন এবং তাদের উপর নির্ভরশীল হয়ে যান। অবশ্য এই স্বভাবের লোকের আসল চেহারা একদিন প্রকাশ পায়। তখন তার ক্ষতি সামাল দিতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। দুঃখজনক হল, এ ধরনের ঘটনা একাধিকবার ঘটলেও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগণ তার থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেন না।
(১২) প্রশংসার পূজারী নয় :
দায়িত্বশীল বা নেতার কাজের কেউ প্রশংসা করলে তিনি অত্যন্ত খুশি হন এবং আনন্দবোধ করেন। প্রশংসার পূজারী ঐ সমস্ত নেতা অন্যের যেকোন ভাল কাজ, কল্যাণকর উদ্যোগ, মানুষের সমর্থন, ভক্তি মুহূর্তের জন্যও বরদাশত করতে পারেন না; বরং ঐ ব্যক্তিকে যেকোনভাবে কোনঠাসা, অপমান, জনসম্মুখে তাচ্ছিল্য, তার কাজের সমালোচনা, কার্যক্রমে বাধা দান, তার সম্পর্কে কুধারণা সৃষ্টি ইত্যাদি কাজে ব্যস্ত থাকেন। এই আচরণ বাহ্যিকভাবে প্রকাশ করতে না পারলে চরম মনকষ্টে ভুগেন। কারণ তিনি শুধু লক্ষ্য করেন তার প্রশংসা কে করছে। অথচ প্রশংসার প্রত্যাশা তো দূরের কথা, কারো সামনে প্রশংসাবাক্য উচ্চারণ করাই নিন্দনীয় (মুসলিম হা/৭৬৯৮; মিশকাত হা/৪৮২৬)। একজন সফল কর্মী অবশ্যই নেতার এ ধরনের আচরণে দুঃখ পান না।
(১৩) জি হুজুর স্বভাবমুক্ত :
জি হুজুর স্বভাবের কর্মী সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের জন্য সবচেয়ে বেশী ক্ষতিকর। এদের ভাল-মন্দ বুঝার শক্তি একেবারেই কম। ফলে নেতা বা দায়িত্বশীলের ভাল-মন্দ যেকোন কাজে ‘জি’ ধরে। স্বার্থ হাছিলের জন্য কাছাকাছি অবস্থান করে এবং সর্বদা নেতার প্রশংসায় থাকে পঞ্চমুখ। বিচক্ষণ ও তাক্বওয়াশীল কর্মীকে উক্ত স্বভাব কখনোই প্রতারিত করতে পারে না; বরং তারা দায়িত্বশীলকে সুপরামর্শ দিয়ে যান। সেটা নেতার পক্ষে যাক, আর বিপক্ষে যাক। এটাই ছিল ছাহাবায়ে কেরামের নীতি।
(১৪) কুধারণা প্রবণ নন :
বকধার্মিক লোক সব সময় সমাজে থাকে। তারা কর্মের প্রতিযোগিতায় হেরে গেলে অন্য ব্যক্তি সম্পর্কে মানুষের মাঝে কুধারণা ছড়িয়ে দেয়। অতি ভক্তিপরায়ণ ও অতি নরম প্রকৃতির মানুষ কুধারণাকে দ্রুত মূল্যায়ন করে। কারণ তারা বকধার্মিক লোকের চরিত্র পর্যবেক্ষণ করতে অক্ষম। তবে এই অক্ষম ব্যক্তিরাই নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের পাশে থাকে। তাদের ফেরেশতা শুলভ ব্যবহারে নেতারা গলে যান এবং তাদের কথা কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করেন। ফলে বকধার্মিকদের পাচারকৃত কুধারণা অনুযায়ী কাজ করেন, সিদ্ধান্ত নেন এবং অপূরণীয় ক্ষতি সাধন করেন। সংগঠনের জন্য তথাকথিত এই ফেরেশতারাই সবচেয়ে বেশী ক্ষতিকর। অবশ্য এই কুনীতির ফলাফল অতি দ্রুতই প্রকাশ পেয়ে যায়। এরা চোগলখোর। তারা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না (মুসলিম হা/৩০৪; মিশকাত হা/৪৮২৩)। একজন যোগ্য কর্মী অবশ্যই এই ভন্ডামীর প্রতি তীক্ষ্ম দৃষ্টি রাখেন ও ধৈর্য ধারণ করেন।
(১৫) বিবেক সম্পন্ন ও বুদ্ধিদীপ্ত :
সফল কর্মী হবেন বিবেক সম্পন্ন ও বুদ্ধিদীপ্ত। আবেগী ও ঝোঁকপ্রবণ হবেন না। বিবেকশূন্য আবেগী কর্মী গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেন না, মাঝ পথে ছিটকে পড়েন। যেমন নড়বড়ে একটি গাড়ি পথ চলে, কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে না, মাঝ পথে বিকল হয়ে যায়। মোটা বুদ্ধির কারণে তারা সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন উভয় মহলে চলতে পারেন। আর তখনই ধূর্ত ও হীন চরিত্রের লোকেরা অন্যের ক্ষতি সাধনে ও নিজের স্বার্থ উদ্ধারে তাদেরকে ব্যবহার করে থাকে।
عَنْ عِيَاضِ بْنِ حِمَارٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَهْلُ الْجَنَّةِ ثَلَاثَةٌ ذُوْ سُلْطَانٍ مُقْسِطٌ مُتَصَدِّقٌ مُوَفِّقٌ وَرَجُلٌ رَحِيْمٌ رَفِيْقُ الْقَلْبِ لِكُلَّ ذِىْ قُرْبَى وَمُسْلِمٍ وَعَفِيْفٌ مُتَعَفِّفٌ ذُوْ عِيَالٍ. وَأَهْلُ النَّارِ خَمْسَةٌ الضَّعِيْفُ الَّذِىْ لَا زَبْرَ لَهُ الَّذِيْنَ هم فِيْكُمْ تَبَعٌ لَا يَبْغُوْنَ أَهْلًا وَلَا مَالًا وَالْخَائِنُ الَّذِىْ لَا يَخْفَى لَهُ طَمَعٌ وَإِنْ دَقَّ إِلَّا خَانَهُ وَرَجُلٌ لَا يُصْبِحُ وَلَا يُمْسِي إِلَّا وَهُوَ يُخَادِعُكَ عَنْ أَهْلِكَ وَمَالِكَ وَذَكَرَ الْبُخْلَ أَوِ الْكَذِبَ وَالشِّنْظِيْرُ الْفَحَّاشُ.
ইয়ায ইবনু হিমার (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, তিন শ্রেণীর মানুষ জান্নাতী : (এক) ইনছাফকারী ও দানশীল শাসক, যাকে সৎ কাজের যোগ্যতা দেয়া হয়েছে (দুই) এমন ব্যক্তি যিনি দয়ালু এবং নিকটস্থ ও অন্যান্য মুসলিমদের প্রতি কোমল প্রাণবিশিষ্ট (তিন) যে সৎচরিত্রের অধিকারী এবং পারিবারিক দন্যতা থাকা সত্ত্বেও ভিক্ষাবৃত্তি থেকে বেঁচে থাকে। পাঁচ প্রকার মানুষ জাহান্নামী : (এক) দুর্বল বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি, যে নিজের স্থূল বুদ্ধির কারণে নিজেকে খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখতে পারে না। এই সমস্ত লোক তাদের অন্তর্ভুক্ত যারা তোমাদের অধীনস্থ চাকর-বাকর। তারা স্ত্রী-পরিবার চায় না এবং সম্পদেরও ভ্রূক্ষেপ করে না (দুই) এমন আত্মসাৎকারী যার লোভ থেকে গোপনীয় জিনিষও রক্ষা পায় না। অতি তুচ্ছি জিনিষও আত্মসাৎ করে (তিন) এমন ব্যক্তি যে তোমাকে তোমার পরিবার ও সম্পদের ব্যাপারে প্রতারণায় ফেলার জন্য সকল-সন্ধ্যা ব্যস্ত থাকে (চার) কৃপণতা ও মিথ্যাবদিতা (পাঁচ) দুশ্চরিত্র ও অশ্লীলভাষী (ছহীহ মুসলিম হা/৭৩৮৬; মিশকাত হা/৪৯৬০; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৪৭৪৩, ৯/১৩০ পৃঃ)।
দূরদর্শী কর্মী ব্যক্তির অপরাধকে বিশ্লেষণ করেন। কারণ সব অপরাধ এক সমান নয়। কোন্ অপরাধের শাস্তি কী পরিমাণ হতে পারে তা তিনি ভেবে দেখেন। এরপর তিনি কর্মীর মানও বিশ্লেষণ করেন। কারণ সকল কর্মীর মেধা, যোগ্যতা, কর্মক্ষমতা এক সমান নয়। সফল কর্মী যখন দায়িত্বশীল হন তখন তাকে এগুলোর প্রতি সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতে হয়। তিনি অন্য কর্মীর নিকট থেকে ১০০% নির্ভুল কাজ প্রত্যাশা করেন না। কারণ উক্ত কর্মী যদি সম্পূর্ণ কাজ করতে পারতেন তবে তিনিই দায়িত্বশীল হতে বা নেতা হতেন। সুতরাং তার কাজে ভুল-ত্রুটি হওয়া স্বাভাবিক।
(১৬) নেতা বা দায়িত্বশীলের সামনে নিজ কাজের বর্ণনাকে যিনি তোয়াক্কা করেন না :
সচেতন দায়িত্ববান কর্মী একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করে থাকেন। সর্বদা তিনি তার কাজ আল্লাহর কাছে পেশ করেন এবং তাঁর কাছেই প্রতিদান কামনা করেন। কিন্তু বহু কর্মী নিজের সম্পাদিত কাজকে কত তাড়াতাড়ি নেতার সামনে বলতে পারবেন, তার জন্য অস্থির হয়ে পড়েন। সুযোগ পেলে সর্ব মহলে নিজের কাজের ফিরিস্তি বেশী বেশী বর্ণনা করে বেড়ান। মানুষকে দেখানোর জন্য উদ্বোধনী অনুষ্ঠান, বিভিন্ন আয়োজনের ব্যবস্থা তো থাকেই। যদিও নিরিক্ষণে দেখা যায়, তার কাজগুলো তাদের চেয়ে খুবই সাধারণ, যারা প্রকৃত কাজের আঞ্জাম দিয়ে থাকেন। অবশ্য ঐ সমস্ত কর্মীদের প্রতিই নেতার আশীর্বাদ বেশী থাকে। তখন ত্যাগী কর্মীরা মনকষ্টে থাকেন। একদিন প্রকৃত সত্যের দ্বার উন্মোচিত হয়, যখন রিয়া প্রদর্শনকারী কর্মীর পদস্খলন ঘটে। এই স্বভাবের কর্মীরা দুনিয়াতে লাঞ্ছনা-গঞ্জনার শিকার হন। পরকালেও তাদেরকে মুখের উপর ভর করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে (মুসলিম হা/৫০৩২; মিশকাত হা/২০৫)।
(১৭) অন্যের মর্যাদার প্রতি তীক্ষ্ম দৃষ্টি দানকারী :
আল্লাহ যাকে যতটুকু মর্যাদা দিয়েছেন তাকে ততটুকু মর্যাদা প্রদান করা একজন সফল কর্মীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। যিনি অন্যের মর্যাদা বুঝেন না বা মর্যাদা পরিমাপ করতে পারেন না, তিনি সারশূন্য পেপে গাছের মত। যেকোন সময় তিনি ভেঙ্গে পড়বেন, ধ্বংসে নিপতিত হবেন এবং একাকিত্ব বরণ করবেন। সবচেয়ে সম্মানের অধিকারী হলেন, হক্বপন্থী পরহেযহার ওলামায়ে কেরাম ও তাক্বওয়াশীল বান্দাগণ। নিজেকে বড় জ্ঞানী মনে করে সম্মানিত আলেমদেরকে তাচ্ছিল্য করা এবং সর্বদা কুৎসা রটনা করা কপট বিশ্বাসী লোকের অভ্যাস। জানা আবশ্যক যে, প্রত্যেক শ্রেণীর মানুষের মধ্যে ভাল-মন্দ দুই ধরনের লোক আছে। তাই সফল কর্মী এই মর্যাদার প্রতি সূক্ষ্ম দৃষ্টি রাখেন।
(১৮) কৃতজ্ঞতা প্রকাশকারী :
যারা বেশী বেশী আমিত্ব প্রকাশ করেন, তারা কখনো কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে চান না। কোন পরিস্থিতির কারণে তা প্রকাশ করলেও কৌশলে খুব সামান্যই করেন এবং অন্তরজ্বালায় ভুগেন। তারা মানুষের অবদান খুব দ্রুত ভুলে যান, পূর্বের একনিষ্ঠ সাথীকে অবজ্ঞা করে দূরে সরিয়ে দেন এবং হঠাৎ আবির্ভূত হওয়া নতুন অতিথিকে স্বাদরে গ্রহণ করেন। অতঃপর লোক দেখানো নিত্য-নতুন ভক্তিপূজায় নিজেদেরকে হারিয়ে ফেলেন। তখন তারা প্রকৃত ও পুরাতন সাথীকে মানুষই মনে করেন না। অখাদ্য, গন্ডমূর্খ, বোকা, অযোগ্য, কিছুই জানে না, বেহুশ, অলস, ইত্যাদি বলে তাচ্ছিল্য করেন। তারা এই সত্যটা ভুলে যান যে, তাদের মত গুণ যদি সকলের মাঝে থাকত তবে সবাই তো নেতা হয়ে যেত। আনুগত্যকারী কেউ থাকত না। কিন্তু ঐ সমস্ত লোকের স্বভাব যে আরো খারাপ সে দিকে তারা লক্ষ্য করেন না। তাই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা একজন সফল কর্মীর বিশেষ গুণ (তিরমিযী হা/১৯৫৪; মিশকাত হা/৩০২৫)।
(১৯) ইতিহাস থেকে শিক্ষা অর্জনকারী :
মানুষ ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে না এটাই সবচেয়ে বড় ইতিহাস। ভক্তির আতিশয্যে নেতা একজন রিয়াসম্পন্ন কর্মীর প্রতি স্বয়ং সম্পন্ন হয়ে পড়েন। তাকে সর্বপ্রকার ক্ষমতা প্রদান করেন। মুহূর্তের মধ্যে আজ্ঞাবহ ব্যক্তিটি মাথায় উঠে যায়। নেতার অনৈতিক পরশ পাওয়ার কারণে বেপরোয়া হয়ে উঠে, হয়ে যায় চরম স্বেচ্ছাচারী। সে তখন কোন মানুষকে মানুষ মনে করে না। একদিন সে বিশাল প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি সাধন করে চলে যায়। এ ধরণের ঘটনা বার বার ঘটলেও তা থেকে শিক্ষা নেয়া হয় না।
(২০) প্রতিশোধ পরায়ণ কিংবা অপরের দোষ অনুসন্ধানকারী নন :
একজন সফল কর্মী নিজেকে সর্বদা মনে করেন যে, আমি অভিযুক্ত তবে অভিযোগকারী নই, আমার শত্রুর অভাব নেই তবে আমি কারো শত্রু নই। মুসলিম হয়ে অপর মুসলিমের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ পরায়ণ হওয়া উচিত নয়। সর্বদা অপরের গীবত ও দোষ অন্বেষণ করা, কুধারণা সৃষ্টি করা আত্মঘাতী স্বভাব।
عَنِ ابْنِ عُمَرَ قَالَ صَعِدَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْمِنْبَرَ فَنَادَى بِصَوْتٍ رَفِيْعٍ فَقَالَ يَا مَعْشَرَ مَنْ أَسْلَمَ بِلِسَانِهِ وَلَمْ يُفْضِ الْإِيْمَانُ إِلَى قَلْبِهِ لَا تُؤْذُوْا الْمُسْلِمِيْنَ وَلَا تُعَيِّرُوْهُمْ وَلَا تَتَّبِعُوْا عَوْرَاتِهِمْ فَإِنَّهُ مَنْ يَتَّبِعْ عَوْرَةَ أَخِيْهِ الْمُسْلِمِ يَتَّبِعِ اللهُ عَوْرَتَهُ وَمَنْ يَتَّبِعِ اللهُ عَوْرَتَهُ يَفْضَحْهُ وَلَوْ فِىْ جَوْفِ رَحْلِهِ.
রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘ তোমরা মুসলিম ব্যক্তিদের দোষ অন্বেষণ কর না। কারণ যে ব্যক্তি তার কোন মুসলিম ভাইয়ের দোষান্বেষণ করবে আল্লাহ তার দোষ অন্বেষণ করবেন। আর যার দোষ খঁড়িয়ে বের করবেন তাকে অপমান করে ছাড়বেন, যদিও সে তার ঘরের কোণে লুকিয়ে থাকে’ (তিরমিযী হা/২০৩২; মিশকাত হা/৫০৪৪; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৪৮২৩, সনদ ছহীহ)।
(২১) চাকচিক্যময় বুলির দাবেদারী নন :
সফল কর্মী অতিরিক্ত কথায় বিশ্বাসী নন। অনেকে নিজেকে খুব বুদ্ধিমান মনে করে চটকদারী কথার মাধ্যমে সাংগঠনিক কাজ থেকে দূরে থাকেন। নেতার কাছে কথা ফুলঝুরি ছড়িয়ে তার আশীর্বাদ লাভে ধন্য হন। তার মোলায়েম কথা ও প্রশংসায় নেতাও আনন্দে ভাসতে থাকেন। কিন্তু প্রকৃতার্থে সেখানে কোন কল্যাণ নেই। এ সময় নিবেদিতপ্রাণ কর্মীরা তার থেকে অনেক দূরে অবস্থান করেন। এরূপ উদাহরণ সমাজে ভুরি ভুরি।
উপসংহার :
সফল কর্মী হওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করতে হবে তিনি যেন কবুল করেন। দাওয়াতী জীবনের উপরেই যেন মৃত্যু হয়। সেই সাথে নিম্নের হাদীছটি সার্বক্ষণিক মনে রাখা আবশ্যক, ‘জীবনের শেষ আমলই সবকিছু’ (বুখারী হা/৬৪৯৩; মিশকাত হা/৮৩)।
***
‘আমি অনেকের মুখে নীতির কথা শুনেছি, কিন্তু তার মধ্যে নীতির লেশমাত্র দেখিনি। অনেককে অহংকারের সমালোচনা করতে শুনেছি, কিন্তু অহংকারের ডিপু হিসাবে তাকেই পেয়েছি। অনেককে আমিত্বের বদনাম করতে শুনেছি, কিন্তু তাকেই দেখেছি তিনিই আমিত্বের ফাউন্ডেশন। অনেকের মুখে তাক্বওয়ার বয়ান শুনেছি, কিন্তু তাকেই পেয়েছি তাক্বওয়াশূন্য। অনেকের মুখে সদাচরণের উপদেশ শুনেছি, কিন্তু তার মধ্যেই বদমেজাজের গন্ধ পেয়েছি। অনেকের মুখে কোমল স্বভাবের গল্প শুনেছি, কিন্তু তার মুখেই শুনেছি কর্কশের ঝনঝনানি ’ -তাঈস
�
লেখক: মুযাফফর বিন মুহসিন