পরিবার ও দাম্পত্য

ইসলামে প্রতিবেশীর অধিকার

ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম

সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে মানুষ পরস্পর একতাবদ্ধ হয়ে বসবাস করে আসছে। বাড়ীর পাশাপাশি বসবাসকারী আত্মীয় বা অনাত্মীয় লোকজনই প্রতিবেশী। মানুষের সুখে-দুঃখে, বিপদে-আপদে এরাই সর্বাগ্রে এগিয়ে আসে এবং সহযোগিতার হাত সম্প্রসারিত করে। কাজেই এই প্রতিবেশীর সাথে সদাচরণ করা যরূরী। প্রতিবেশীর সাথে সম্পর্ককে সৌহার্দ্যপূর্ণ, আন্তরিক ও সহানুভূতিশীল করার লক্ষ্যে ইসলাম বিশেষভাবে নির্দেশ দিয়েছে। এই নির্দেশ প্রতিটি মানুষের জন্য অবশ্য পালনীয়। এ নিবন্ধে প্রতিবেশীর অধিকার সমূহ আলোচনা করা হবে ইনশাআল্লাহ।

প্রতিবেশীর পরিচয় :  প্রতিবেশীর আরবী প্রতিশব্দ جار (জার) এবং ইংরেজী প্রতিশব্দ Neighbour. পারিভাষিক অর্থে- A person who lives next to you or near you. ‘তোমার পরে বা পার্শ্বে বসবাসকারী লোক।[1]

ইবনুল মানযূর বলেন, وهو مَنْ جاورك جوارًا شرعيًا سواء كان مسلمًا أو كافرًا، برًا أو فاجرًا، صديقًا أو عدوَّا، محسناً أو مسيئاً، نافعًا أو ضارًا، قريبًا أو أجنبيًا، بلديَّاً أو غريبًا. ‘প্রতিবেশী হচ্ছে যে ব্যক্তি আইনত তোমার পার্শ্বে অবস্থান করছে, সে মুসলিম হোক বা কাফের, পুণ্যবান হোক বা পাপী, বন্ধু হোক বা শত্রু, দানশীল হোক বা কৃপণ, উপকারী হোক বা অনিষ্টকারী, আত্মীয় হোক বা অনাত্মীয়, দেশী হোক বা বিদেশী।[2]

প্রতিবেশী গণ্য হওয়ার সীমা : কত দূর এলাকার অধিবাসীরা প্রতিবেশী হিসাবে গণ্য হবে এ সম্পর্কে বিভিন্ন অভিমত পাওয়া যায়। যেমন- (১) হাসান (রাঃ) বললেন, أربعين داراً أمامه، وأربعين خلفه، وأربعين عن يمينه، وأربعين عن يساره. অর্থাৎ নিজের ঘর হ’তে সম্মুখের চল্লিশ ঘর, পশ্চাতের চল্লিশ ঘর, ডান দিকের চল্লিশ ঘর এবং বাম পার্শ্বের চল্লিশ ঘর’ (এর অধিবাসী লোকজনই প্রতিবেশী হিসাবে গণ্য)।[3] (২) কেউ বলেন, চারিদিকের দশ ঘর প্রতিবেশী হিসাবে গণ্য হবে। (৩) কেউ বলেন, যে ব্যক্তি ডাক শুনতে পায় সে প্রতিবেশী। (৪) যে অতি নিকটে বা পাশাপাশি থাকে সে প্রতিবেশী। (৫) কেউ বলেন, প্রতিবেশী হচ্ছে যারা একই মসজিদে সমবেত হয়।[4]

প্রতিবেশীর প্রকার : দূরত্বের বিবেচনায় প্রতিবেশী দু’প্রকার : ১. নিকটবর্তী প্রতিবেশী ২. দূরবর্তী প্রতিবেশী (নিসা ৪/৩৬)। ধর্মীয় ও আত্মীয়তার সম্পর্কের দিক দিয়ে প্রতিবেশী ৩ প্রকার। যথা- ১. মুসলিম আত্মীয় প্রতিবেশী, ২. মুসলিম অনাত্মীয় প্রতিবেশী ৩. অমুসলিম প্রতিবেশী।

আচার-আচরণের দৃষ্টিতে প্রতিবেশী দুই প্রকার। ১. উত্তম প্রতিবেশী ও ২. নিকৃষ্ট প্রতিবেশী। উত্তম প্রতিবেশী সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) বলেন, مِنْ سَعَادَةِ الْمَرْءِ الْمُسْلِمِ: الْمَسْكَنُ الْوَاسِعُ، وَالْجَارُ الصَّالِحُ، وَالْمَرَاكَبُ الْهَنِيْءُ ‘একজন মুসলমানের জন্য খোলামেলা বাড়ী, প্রশস্ত বাসভবন, সৎপ্রতিবেশী ও রুচিসম্মত বাহন সৌভাগ্য স্বরূপ’।[5]

অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,  خَيْرُ الأَصْحَابِ عِنْدَ اللهِ تَعَالَى خَيْرُهُمْ لِصَاحِبِهِ، وَخَيْرُ الْجِيْرَانِ عِنْدَ اللهِ خَيْرُهُمْ لِجَارِهِ- ‘আল্লাহর নিকট সেই সাথী উত্তম, যে তার নিজ সাথীদের নিকট উত্তম এবং আল্লাহর নিকট সেই প্রতিবেশীই উত্তম, যে নিজের প্রতিবেশীর কাছে উত্তম’।[6]

পক্ষান্তরে নিকৃষ্ট প্রতিবেশী হ’তে রাসূল (ছাঃ) দো‘আ করতেন এই বলে, اَللَّهُمَّ! إِنِّيْ أَعُوْذُ بِكَ مِنْ جَارِ السُّوْءِ فِيْ دَارِ الْمَقَامِ فَإِنَّ جَارَ الدُّنْيَا يَتَحَوَّلُ ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার আশ্রয় প্রার্থনা করছি দুষ্ট প্রতিবেশী হ’তে স্থায়ী বাসস্থানের। কেননা দুনিয়ার প্রতিবেশী পরিবর্তন হয়ে থাকে’।[7]

প্রতিবেশী সম্পর্কে বিশেষ তাকীদ : প্রতিবেশীর ব্যাপারে রাসূল (ছাঃ)-কে জিবরীল (আঃ) বার বার তাকীদ করতেন। রাসূল (ছাঃ) বলেন,  مَا يُوْصِيْنِي بِالْجَارِ حَتَّى ظَنَنْتُ أَنَّهُ سَيُوَرِّثُهُ. ‘জিবরীল (আঃ) এসে আমাকে প্রতিবেশীর ব্যাপারে অবিরত উপদেশ দিতে থাকতেন। এমনকি মনে হ’ত যে, হয়ত তিনি প্রতিবেশীকে উত্তরাধিকারী বানিয়ে দিবেন’[8]

উত্তম ব্যবহার পাওয়ার অধিকার :  প্রতিবেশী আত্মীয় হোক অথবা অনাত্মীয়, মুসলিম হোক অথবা অমুসলিম যে কোন অবস্থায় সাধ্যানুযায়ী তাদের সাহায্য-সহায়তা করা ও তাদের খোঁজ-খবর নেয়া যরূরী। তাদের সাথে উত্তম আচরণ করা আল্লাহর নির্দেশ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَاعْبُدُوا اللهَ وَلاَ تُشْرِكُوْا بِهِ شَيْئًا وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا وَبِذِي الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِيْنِ وَالْجَارِ ذِي الْقُرْبَى وَالْجَارِ الْجُنُبِ وَالصَّاحِبِ بِالْجَنْبِ وَابْنِ السَّبِيْلِ وَمَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ إِنَّ اللهَ لاَ يُحِبُّ مَنْ كَانَ مُخْتَالاً فَخُوْرًا-

‘আল্লাহর ইবাদত কর, তাঁর সাথে কাউকে শরীক করো না। পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার কর এবং নিকটাত্মীয়, ইয়াতীম, মিসকীন, নিকটবর্তী প্রতিবেশী ও দূরবর্তী প্রতিবেশী, সহকর্মী, পথিক ও দাস-দাসীর সাথে ভাল ব্যবহার কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ অহংকারী-দাম্ভিককে পসন্দ করেন না’ (নিসা ৪/৩৬)। এই আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা পিতামাতার সাথে ভাল ব্যবহারের নির্দেশ দানের পাশাপাশি নিকটবর্তী ও দূরবর্তী প্রতিবেশীর সাথেও উত্তম ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছেন। কেননা প্রতিবেশীরাই মানুষের বিপদ-আপদে সর্বাগ্রে এগিয়ে আসে। তাই এসব লোকের সাথে ভাল আচরণ করা সকলের জন্য অবশ্য কর্তব্য। রাসূল (ছাঃ) বলেন, مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللهِ وَالْيَوْم الْآخِرِِ فَلْيُحْسِنْ إِلَى جَارِهِ. ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন তার প্রতিবেশীর সাথে সদ্ব্যবহার করে’।[9] অন্যত্র তিনি বলেন, –وَأَحْسِنْ إِلَى جَارِكَ تَكُنْ مُؤْمِنًا ‘তুমি তোমার প্রতিবেশীর সাথে উত্তম ব্যবহার কর, তাহ’লে তুমি মুমিন হ’তে পারবে’।[10]

প্রতিবেশীর সাথে সদাচরণ করার মধ্যেই আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ)-এর ভালবাসা নিহিত আছে। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ سَرَّهُ أَنْ يُّحِبَّ اللهُ وَرَسُوْلُهُ أَوْ يُحِبَّهُ اللهُ وَرَسُوْلُهُ فَلْيُصْدِقْ حَدِيْثَهُ إِذَا حَدَّثَ وَلِيُؤَدِّ أَمَانَتَهُ إِذَا اُؤْتُمِنَ وَلِيُحْسِنْ جِوَارَ مَنْ جَاوَرَهُ- ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ভালবাসা পেতে ইচ্ছা করে সে যেন সদা সত্য কথা বলে, আমানত রক্ষা করে এবং প্রতিবেশীর উপকার করে’।[11]

প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেওয়া : সুশৃংখল ও শান্তিপূর্ণ সমাজ বিনির্মাণে ও সুখী-সমৃদ্ধশালী জীবন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রতিবেশীর সাথে উত্তম ব্যবহার করা যরূরী। নিজেকে নিয়ে যে সদা ব্যস্ত থাকে, নিজের স্বার্থ ব্যতীত যে অন্য কিছুই ভাবে না, প্রতিবেশীর বিপন্ন ও দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থা, হৃদয়গ্রাহী হাহাকার, করুণ আর্তনাদ যার মনে রেখাপাত করে না, এমনকি স্বীয় স্বার্থ চরিতার্থ করার লক্ষ্যে তাদেরকে কষ্ট দিতে কুন্ঠিত হয় না, সে পূর্ণ মুমিন হ’তে পারে না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, وَمَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ فَلاَ يُؤْذِ جَارَهُ ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস রাখে, সে যেন তার প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়।[12] প্রতিবেশীর সাথে খারাপ আচরণ করা পাপ। এমনকি তা ঈমানহীনতার পরিচায়ক।

রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, وَاللهِ لاَ يُؤْمِنُ وَاللهِ لاَ يُؤْمِنُ وَاللهِ لاَ يُؤْمِنُ، قَالُوْا وَمَا ذَاكَ يَا رَسُوْلَ اللهِ، قَالَ الْجَارُ لاَ يَأْمَنُ جَارُهُ بَوَائِقَهُ. ‘আল্লাহর কসম! সে মুমিন নয়, আল্লাহর কসম! সে মুমিন নয়, আল্লাহর কসম! সে মুমিন নয়। জিজ্ঞেস করা হ’ল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! কে সেই ব্যক্তি? তিনি বললেন, যার অনিষ্ট থেকে তার প্রতিবেশী নিরাপদ থাকে না’।[13] প্রতিবেশীকে কষ্ট দানকারী ব্যক্তি জান্নাতে যাবে না।  রাসূল (ছাঃ) বলেন, لاَ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ مَنْ لاَ يَأْمَنُ جَارُهُ بَوَائِقَهُ. ‘সেই ব্যক্তি জান্নাতে যাবে না, যার অনিষ্ট থেকে তার প্রতিবেশী নিরাপদে থাকে না’।[14]

অপর একটি হাদীছে এসেছে, আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত একদা জনৈক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! إِنَّ فُلَانَةَ تُذْكَرُ مِنْ كَثْرَةِ صَلَاتِهَا وَصِيَامِهَا وَصَدَقَتِهَا غَيْرَ أَنَّهَا تُؤْذِيْ جِيْرَانَهَا بِلِسَانِهَا قَالَ هِيَ فِي النَّارِ، قَالَ يَا رَسُوْلَ اللهِ فَإِنَّ فُلاَنَةَ تُذْكَرُ مِنْ قِلَّةِ صِيَامِهَا وَصَدَقَتِهَا وَصَلَاتِهَا وَإِنَّهَا تَصَدَّقُ بِالْأَثْوَارِ مِنْ الْأَقِطِ وَلَا تُؤْذِيْ بِلِسَانِهَا جِيْرَانَهَا قَالَ هِيَ فِي الْجَنَّةِ- ‘অমুক মহিলা অধিক ছালাত পড়ে, ছিয়াম রাখে এবং দান-ছাদাক্বাহ করার ব্যাপারে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। তবে সে নিজের মুখের দ্বারা স্বীয় প্রতিবেশীদেরকে কষ্ট দেয়। তিনি বললেন, সে জাহান্নামী। লোকটি আবার বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! অমুক মহিলা সম্পর্কে জনশ্রুতি আছে যে, সে কম ছিয়াম পালন করে, দান-ছাদাক্বাও কম করে এবং ছালাতও কম আদায় করে। তার দানের পরিমাণ হ’ল পনীরের টুকরা বিশেষ। কিন্তু সে নিজের মুখ দ্বারা স্বীয় প্রতিবেশীদেরকে কষ্ট দেয় না। তিনি বললেন, সে জান্নাতী’।[15]

প্রতিবেশীর সাথে ঝগড়া-বিবাদ না করা : প্রতিবেশীর সাথে কোন বিষয় নিয়ে বাক-বিতন্ডা ও ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হওয়া উচিত নয়। কেননা এতে উভয়ের মাঝে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। তাছাড়া এর জন্য ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহর সামনে বিচারের সম্মুখীন হ’তে হবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, أَوَّلُ خَصْمَيْنِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ جَارَانِ- ‘ক্বিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম ঝগড়াটে দুই প্রতিবেশীর মোকদ্দমা পেশ করা হবে’।[16]

প্রতিবেশীকে নির্যাতন করে গৃহত্যাগে বাধ্য না করা : প্রতিবেশীকে কষ্ট দিতে রাসূল (ছাঃ) নিষেধ করেছেন এবং কষ্ট দানকারীকে ঈমানহীন বলে অভিহিত করেছেন। এরপরও প্রতিবেশীকে কষ্ট দেওয়া ও নির্যাতন করে গৃহত্যাগে বাধ্য করা অতি বড় গোনাহের কাজ। এমর্মে বর্ণিত হয়েছে, আবু আমের হিমছী বর্ণনা করেন, ছাওবান (রাঃ) প্রায়ই বলতেন,

مَا مِنْ رَجُلَيْنِ يَتَصَارِمَانِ فَوْقَ ثَلاَثَةِ أَيَّامٍ، فَيُهْلِكُ أَحَدُهُمَا، فَمَاتَا وَهُمَا عَلَى ذَلِكَ مِنَ الْمُصَارِمَةِ، إِلاَّ هَلَكَا جَمِيْعاً، وَمَا مِنْ جَارٍ يَظْلِمُ جَارَهُ وَيُقْهِرُهُ، حَتَّى يَحْمِلَهُ ذَلِكَ عَلَى أَنْ يَّخْرُجَ مِنْ مَنْزِلِهِ، إِلاَّ هَلَكَ.

অর্থাৎ যখন দু’ব্যক্তি তিন দিনের বেশী সময় ধরে সম্পর্কচ্ছেদ করে থাকে, তখন তাদের একজনের সর্বনাশ হয়ে যায়। আর যদি দু’জনই সম্পর্কচ্যুত অবস্থায় মৃত্যুমুখে পতিত হয়, তবে তাদের উভয়েরই সর্বনাশ হয়। আর যে প্রতিবেশী তার কোন প্রতিবেশীকে নির্যাতন করে বা তার সাথে নিষ্ঠুর আচরণ করে যাতে সে ব্যক্তি গৃহত্যাগে বাধ্য হয়, সে ব্যক্তি নিশ্চিত ধ্বংসের মধ্যে পতিত হয়।[17]

প্রতিবেশীকে হাদিয়া দেওয়া : উপহার আদান-প্রদানে পরস্পরের মধ্যে ভালবাসা সৃষ্টি হয়। নবী করীম (ছাঃ) বলেন, تَهَادُوْا تَحَابُّوْا-  ‘পরস্পরকে উপহার দাও। এতে তোমাদের মধ্যে ভালবাসা সৃষ্টি হবে’।[18]

হাদিয়া প্রদানের ক্ষেত্রে নিকটতম প্রতিবেশীকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি বললাম,  يَا رَسُولَ اللهِ، إِنَّ لِى جَارَيْنِ، فَإِلَى أَيِّهِمَا أُهْدِى قَالَ إِلَى أَقْرَبِهِمَا مِنْكِ بَابًا- অর্থাৎ হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমার দু’জন প্রতিবেশী আছে। আমি তাদের কার নিকট উপঢেŠকন পাঠাব? রাসূল (ছাঃ) বললেন, ‘যার দরজা (বাড়ী) তোমার বেশী নিকটবর্তী’।[19]

বাড়ীতে ভাল কোন খাদ্য বা তরকারী পাক হ’লে তাতে প্রতিবেশীকে শরীক করা রাসূল (ছাঃ)-এর নির্দেশ। তিনি আবু যর (রাঃ)-কে বলেন, يَا أَبَا ذَرٍّ إِذَا طَبَخْتَ مَرَقَةً فَأَكْثِرْ مَاءَهَا وَتَعَاهَدْ جِيْرَانَكَ ু ‘হে আবু যর! যখন কোন তরকারী পাক করবে, তখন তাতে একটু বেশী পানি দিয়ে ঝোল বাড়াও এবং তোমার প্রতিবেশীকে পৌঁছাও’।[20] অন্য বর্ণনায় আছে, وَإِذَا صَنَعْتَ مَرَقَةً فَأَكْثِرْ مَاءَهَا ثُمَّ انْظُرْ أَهْلَ بَيْتٍ مِنْ جِيْرَانِكَ فَأَصِبْهُمْ مِنْهُ بِمَعْرُوْفٍ  ‘যখন ঝোল পাকাবে তখন তাতে পানি বেশী করে দিবে এবং তৎপর প্রতিবেশীর প্রতি লক্ষ্য করবে ও তা তাদেরকে সদিচ্ছা সহকারে বিতরণ করবে’।[21] তিনি আরো বলেন,إِذَا طَبَخْتَ مَرَقَةً فَأَكْثِرْ مَاءَ الْمَرَقَةِ وَتَعَاهَدْ جِيْرَانَكَ أَوْ اَقْسِمْ فِيْ جِيْرَانِكَ ‘যখন ঝোল পাকাও, তখন তাতে পানি বেশী করে দিবে এবং তা

প্রতিবেশীদের মাঝে বিতরণ করবে’।[22]

প্রতিবেশী যে ধর্মেরই হোক না কেন সকলেই উত্তম আচরণ পাবার অধিকারী। বাড়ীতে কোন ভাল জিনিস তৈরী হ’লে কিংবা পশু-পাখি যবেহ করা হ’লে তার গোশ্ত মুসলমান প্রতিবেশীর ন্যায় বিধর্মী প্রতিবেশীর বাড়ীতেও প্রেরণ করা উচিত। একবার আব্দুল্লাহ বিন আমর (রাঃ)-এর বাড়ীতে তাঁর বালক ভৃত্য একটি ছাগলের চামড়া ছাড়াচ্ছিল। তিনি বললেন, হে বৎস! কাজ শেষ করে আমাদের ইহুদী প্রতিবেশী হ’তে (গোশ্ত বিতরণ) শুরু করবে। তখন সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তি বলে উঠল, কি ইহুদী? আল্লাহ আপনাকে সংশোধন করে দিন। তিনি বললেন, আমি নবী করীম (ছাঃ)-কে প্রতিবেশী সম্পর্কে উপদেশ প্রদান করতে শুনেছি।[23]

প্রতিবেশীর জন্য নিজের পসন্দনীয় বস্ত্ত এখতিয়ার করা : নিজের জন্য যা পসন্দ করবে, প্রতিবেশীর জন্যও তাই পসন্দ করবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)বলেন, وَالَّذِىْ نَفْسِىْ بِيَدِهِ لاَ يُؤْمِنُ عَبْدٌ حَتَّى يُحِبَّ لِجَارِهِ أَوْ قَالَ لأَخِيْهِ مَا يُحِبُّ لِنَفْسِهِ ‘আল্লাহর শপথ! তোমাদের মধ্যে কেউ পূর্ণ ঈমানদার হ’তে পারবে না, যতক্ষণ নিজের জন্য যা পসন্দ করে তা প্রতিবেশী অথবা তার ভাইয়ের জন্য পসন্দ না করবে’।[24]

প্রতিবেশীকে অভুক্ত রেখে নিজে ভুরিভোজ না করা : দুঃখ-দৈন্য, অভাব-অনটন মানব জীবনের নিত্যসঙ্গী। এসব দিয়ে আল্লাহ মানুষকে পরীক্ষা করেন। আবার ধনী-দরিদ্রও আল্লাহ করে থাকেন। সুতরাং দরিদ্র প্রতিবেশীর খোঁজ-খবর নেওয়া আবশ্যক। প্রতিবেশী অভুক্ত থাকলে তাকে খাদ্য না দিয়ে নিজে পেট পুরে খাওয়া ঈমানদারের পরিচয় নয়। এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)বলেন, لَيْسَ الْمُؤْمِنُ الَّذِىْ يَشْبَعُ وَجَارُهُ جَائِعٌ إِلَى جَنْبِهِ-  ‘ঐ ব্যক্তি পূর্ণ মুমিন নয়, যে পেট পুরে খায় আর তার পাশেই তার প্রতিবেশী অভুক্ত থাকে’।[25]

প্রতিবেশীর দাওয়াত কবুল করা : সমাজের মানুষের মধ্যে সুসম্পর্ক ও আন্তরিকতা সামাজিক বন্ধনকে সুদূঢ় করে। আর পরস্পরকে দাওয়াত দিলে হৃদ্যতা বৃদ্ধি পায়। দাওয়াত কবুল করা রাসূলের নির্দেশও বটে। তিনি বলেন, إِذَا دُعِىَ أَحَدُكُمْ إِلَى طَعَامٍ فَلْيُجِبْ فَإِنْ شَاءَ طَعِمَ وَإِنْ شَاءَ تَرَكَ.  ‘যখন তোমাদের কাউকে খাবারের জন্য দাওয়াত দেয়া হয়, তখন সে যেন তাতে সাড়া দেয় বা দাওয়াত কবুল করে। অতঃপর ইচ্ছা হ’লে সে খাবে আর না হ’লে সে ছেড়ে দিবে’।[26] অন্য বর্ণনায় এসেছে, إِذَا دُعِىَ أَحَدُكُمْ إِلَى طَعَامٍ فَلْيُجِبْ فَإِنْ كَانَ صَائِمًا فَلْيُصَلِّ يَعْنِى الدُّعَاءَ. ‘যখন তোমাদের কাউকে খাবারের জন্য আহবান জানানো হয়, তখন সে তাতে সাড়া দিবে। যদি সে ছায়েম হয়, তাহ’লে সে দো‘আ করবে’।[27]

মুসলমানের ছয়টি হকের অন্যতম হচ্ছে দাওয়াত কবুল করা। যেমন রাসূল (ছাঃ) বলেন, حَقُّ الْمُسْلِمِ عَلَى الْمُسْلِمِ سِتٌّ. قِيْلَ مَا هُنَّ يَا رَسُولَ اللهِ قَالَ إِذَا لَقِيتَهُ فَسَلِّمْ عَلَيْهِ وَإِذَا دَعَاكَ فَأَجِبْهُ وَإِذَا اسْتَنْصَحَكَ فَانْصَحْ لَهُ وَإِذَا عَطَسَ فَحَمِدَ اللهَ فَسَمِّتْهُ وَإِذَا مَرِضَ فَعُدْهُ وَإِذَا مَاتَ فَاتَّبِعْهُ. ‘একজন মুসলমানের উপর অন্য মুসলমানের ছয়টা হক আছে। বলা হ’ল সেগুলি কি হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! তিনি বললেন, তার সাথে সাক্ষাৎ হ’লে সালাম দিবে; তোমাকে দাওয়াত দিলে কবুল করবে; পরামর্শ চাইলে সুপরামর্শ দিবে; হাঁচি দিয়ে আল-হামদুলিল্লাহ বললে ‘ইয়ারহামুকাল্লাহ’ বলবে; অসুস্থ হ’লে দেখতে যাবে এবং মারা গেলে জানাযায় শরীক হবে’।[28]

প্রতিবেশীর সুবিধা-অসুবিধার প্রতি লক্ষ্য রাখা : প্রতিবেশীর সুবিধা-অসুবিধার প্রতি লক্ষ্য রাখা ইসলামের নির্দেশ। এমনকি নিজের কিছুটা ক্ষতি হ’লেও প্রতিবেশীর সুবিধা করে দেওয়া ও তার অসুবিধা না করার নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, لاَ يَمْنَعْ أَحَدُكُمْ جَارَهُ أَنْ يَغْرِزَ خَشَبَةً فِي جِدَارِهِ ‘এক প্রতিবেশী যেন অপর প্রতিবেশীকে দেয়ালের সাথে খুঁটি গাড়তে নিষেধ না করে’।[29]

প্রতিবেশীর জান-মাল, ইয্যত-আব্রু হেফাযত করা : প্রতিবেশীর মান-সম্মানের প্রতি লক্ষ্য রাখা যেমন যরূরী, তেমনি মাল-সম্পদ হেফাযত করাও অবশ্য কর্তব্য। রাসূল (ছাঃ) বলেন, الْمُسْلِمُ مَنْ سَلِمَ الْمُسْلِمُوْنَ مِنْ لِسَانِهِ وَيَدِهِ ‘মুসলিম সে ব্যক্তি যার হাত ও যবান থেকে অন্য মুসলিম নিরাপত্তা লাভ করে’।[30] অন্য হাদীছে এসেছে, মিকদাদ ইবনুল আসওয়াদ (রাঃ) বলেন, سَأَلَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم أَصْحَابَهُ: عَنِ الزِّنَا؟ قَالُوْا حَرَامٌ، حَرَّمَهُ اللهُ وَرَسُوْلُهُ، فَقَالَ لأَنْ يَزْنِىَ الرَّجُلُ بِعَشْرِ نِسْوَةٍ أَيْسَرُ عَلَيْهِ مِنْ أَنْ يَزْنِىَ بِامْرَأَةِ جَارِهِ، وَسَأَلَهُمْ عَنِ السَّرَقَةِ؟ قَالُوا حَرَامٌ، حَرَّمَهَا اللهُ عَزَّ وَجَلَّ وَرَسُوْلُهُ، فَقَالَ: لأَنْ يَسْرِقَ مِنْ عَشْرَةِ أَهْلِ أَبْيَاتٍ أَيْسَرُ عَلَيْهِ مِنْ أَنْ يَسْرِقَ مِنْ جَارِهِ. অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একদা তাঁর ছাহাবীগণকে ব্যভিচার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন, (তা কেমন? উত্তরে) তারা বললেন, হারাম; আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তা হারাম করেছেন। তখন তিনি বললেন, কোন ব্যক্তি দশজন নারীর সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হ’লেও তা তার প্রতিবেশীর স্ত্রীর সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া অপেক্ষা লঘুতর (পাপ)। অতঃপর তিনি বললেন, কোন ব্যক্তির দশ ঘরের লোকজনের বস্ত্ত-সামগ্রী চুরি করা তার প্রতিবেশীর ঘরে চুরি করার চেয়ে লঘুতর’।[31]

প্রতিবেশীর দোষ-ত্রুটি গোপন রাখা : মানুষ দোষ-ত্রুটির ঊর্ধ্বে নয়। ভাল এবং মন্দগুণের সমন্বয়ে মানুষ। প্রতিবেশীর দোষ গোপন রাখা অবশ্য কর্তব্য। কেননা মুসলিম ভাইয়ের দোষ গোপন রাখলে আল্লাহ ক্বিয়ামতে তার দোষ গোপন রাখবেন। রাসূল (ছাঃ) বলেন, لاَ يَسْتُرُ اللهُ عَلَى عَبْدٍ فِي الدُّنْيَا إِلاَّ سَتَرَهُ اللهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ‘যে ব্যক্তি দুনিয়াতে কারো দোষ গোপন রাখে, ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ তার দোষ গোপন রাখবেন’।[32]

অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ سَتَرَ مُسْلِمًا سَتَرَهُ اللهُ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ ‘যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের দোষ গোপন করবে, আল্লাহ দুনিয়া ও আখিরাতে তার দোষ গোপন করবেন’।[33] অন্যত্র তিনি আরো বলেন, مَنْ سَتَرَ عَوْرَةَ أَخِيْهِ الْمُسْلِمِ سَتَرَ اللهُ عَوْرَتَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَمَنْ كَشَفَ عَوْرَةَ أَخِيْهِ الْمُسْلِمِ كَشَفَ اللهُ عَوْرَتَهُ حَتَّى يَفْضَحَهُ بِهَا فِىْ بَيْتِهِ- ‘যে ব্যক্তি মুসলিম ভাইয়ের ত্রুটি গোপন রাখবে আল্লাহ ক্বিয়ামতের দিন তার দোষ গোপন রাখবেন। আর যে মুসলিম ভাইয়ের দোষ প্রকাশ করে দিবে, আল্লাহ তার দোষ প্রকাশ করে দিবেন। এমনকি তাকে অপদস্ত করবেন তার ঘরের ভিতরে’।[34]

প্রতিবেশীর প্রতি অনুগ্রহ করা ও তাকে কর্যে হাসানা প্রদান করা :

পার্থিব জীবনে মানুষ অপরের সাহায্য ছাড়া চলতে পারে না। এজগতে কোন মানুষই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। বরং সে কোন না কোন ক্ষেত্রে অপরের মুখাপেক্ষী। প্রতিবেশীর কাজে সাধ্যমত সহায়তা করা তার প্রতি দয়ার বহিঃপ্রকাশ। আর মানুষের প্রতি মানুষের দয়া-অনুগ্রহে সমাজ সুন্দর হয়; আল্লাহর রহমত লাভ হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, لاَ يَرْحَمُ اللهُ مَنْ لاَ يَرْحَمُ النَّاسَ ‘আল্লাহ তা‘আলা সেই ব্যক্তির উপর দয়া করেন না, যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি দয়া করে না’।[35]

প্রতিবেশী কখনও সমস্যায় পড়লে কর্যে হাসানা দিয়ে তাকে সাহায্য করা উচিত। তাকে কর্যে হাসানা দিয়ে সাহায্য করলে আল্লাহ তা‘আলা সাহায্যকারীকেও সাহায্য করবেন। এ মর্মে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,

مَنْ نَفَّسَ عَنْ مُؤْمِنٍ كُرْبَةً مِنْ كُرَبِ الدُّنْيَا نَفَّسَ اللهُ عَنْهُ كُرْبَةً مِنْ كُرَبِ يَوْمِ الْقِيَامَةِ وَمَنْ سَتَرَ مُسْلِمًا سَتَرَهُ اللهُ فِى الدُّنْيَا وَالآخِرَةِ وَمَنْ يَسَّرَ عَلَى مُعْسِرٍ يَسَّرَ اللهُ عَلَيْهِ فِى الدُّنْيَا وَالآخِرَةِ وَاللهُ فِى عَوْنِ الْعَبْدِ مَا كَانَ الْعَبْدُ فِى عَوْنِ أَخِيهِ-

‘যে ব্যক্তি কোন মুমিনের পার্থিব দুঃখ-কষ্ট দূর করবে, আল্লাহ ক্বিয়ামতে তার দুঃখ-কষ্ট দূর করবেন। যে ব্যক্তি কোন সংকটাপন্ন ব্যক্তির সংকট নিরসন করবে, আল্লাহ তার দুনিয়া ও আখিরাতের যাবতীয় সংকট নিরসন করে দিবেন। আর যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের দোষ-ত্রুটি গোপন করবে আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়া ও আখেরাতে তার দোষ-ত্রুটি গোপন রাখবেন। আর আল্লাহ ততক্ষণ পর্যন্ত বান্দার সাহায্য করে থাকেন, যতক্ষণ পর্যন্ত বান্দা নিজ ভাইয়ের সাহায্যে রত থাকে’।[36]

প্রয়োজনে প্রতিবেশীকে কর্যে হাসানা প্রদান করা। এটা এমন একটি সৎকাজ যার কারণে আল্লাহ দাতাকে অনেক পুণ্য দান করে থাকেন। এর ছওয়াব বহুগুণ হয় এবং এর দ্বারা অপরাধ ক্ষমা করা হয়। মহান আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন,  إِنْ تُقْرِضُوا اللهَ قَرْضًا حَسَنًا يُضَاعِفْهُ لَكُمْ وَيَغْفِرْ لَكُمْ وَاللهُ شَكُوْرٌ حَلِيْمٌ ‘যদি তোমরা আল্লাহকে উত্তম ঋণ দান কর, তিনি তোমাদের জন্যে তা দ্বিগুণ করে দিবেন এবং তোমাদেরকে ক্ষমা করবেন’ (তাগাবুন ১৭)। সুতরাং আমাদের প্রত্যেকের কর্তব্য সাধ্যমত অভাবী প্রতিবেশীকে কর্যে হাসানা প্রদান করা।

কর্যে হাসানার ফযীলত সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) বলেন, الصَّدَقَةُ بِعَشْرِ أمْثَالِهَا وَالْقَرْضُ بِثَمَانِيَةِ عَشَرَ  ‘ছাদাক্বার ছওয়াব দশগুণ এবং কর্যে হাসানার ছওয়াব আঠারগুণ’।[37] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরো বলেন, مَا مِنْ مُسْلِمٍ يُقْرِضُ مُسْلِمًا قَرْضًا مَرَّتَيْنِ إِلاَّ كَانَ كَصَدَقَتِهَا مَرَّةً ‘যদি কোন মুসলিম ব্যক্তি তার অপর কোন মুসলিম ভাইকে দু’বার ঋণ প্রদান করে তবে তার আমলনামায় এ অর্থ একবার ছাদাক্বা করে দেয়ার সমান ছওয়াব লিখা হবে’।[38]

অন্য হাদীছে এসেছে, রাসূল (ছাঃ) বলেন, كَانَ رَجُلٌ يُدَايِنُ النَّاسَ، وَكَانَ يَقُوْلُ لِفَتَاهُ: إِذَا أَتَيْتَ مُعْسِرًا فَتَجَاوَزْ عَنْهُ، لَعَلَّ اللهَ أنْ يَّتَجَاوَزَ عَنَّا، فَلَقِيَ اللهَ فَتَجَاوَزَ عَنْهُ- ‘এক ব্যক্তি লোকদেরকে ঋণ দিত। সে তার কর্মচারীকে বলত, কোন ব্যক্তিকে ঋণ পরিশোধে অক্ষম দেখলে তাকে ক্ষমা করে দিও। এ কাজের বিনিময়ে আল্লাহ হয়তো আমাদেরকে ক্ষমা করে দিবেন। ঐ ব্যক্তি মৃত্যুর পর আল্লাহর নিকট পৌঁছলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন’।[39]

অন্যত্র তিনি বলেন, مَنْ سَرَّهُ أَنْ يُنْجِيَهُ اللهُ مِنْ كُرَبِ يَوْمِ الْقِيَامَةِ فَلْيُنَفِّسْ عَنْ مُعْسِرٍ أَوْ يَضَعْ عَنْهُ- ‘যে ব্যক্তি এ কামনা করে যে আল্লাহ তা‘আলা তাকে ক্বিয়ামতের দিন দুঃখ-কষ্ট হ’তে মুক্তি দান করুন, সে যেন ঋণ পরিশোধে অক্ষম ব্যক্তির প্রতি সহজ পন্থা অবলম্বন করে কিংবা মাফ করে দেয়’।[40]

আবু কাতাদা (রাঃ) বলেন, আমি রাসূল (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, مَنْ أَنْظَرَ مُعْسِرًا أَوْ وَضَعَ لَهُ، أَنْجَاهُ اللهُ مِنْ كُرَبِ يَوْمِ القِيامَةِ-  ‘যে ব্যক্তি ঋণ পরিশোধে অক্ষম ব্যক্তিকে অবকাশ দিবে অথবা ঋণ ক্ষমা করে দিবে, আল্লাহ তাকে ক্বিয়ামতের দিন দুঃখ-কষ্ট হ’তে মুক্তি দিবেন’।[41]

অন্য বর্ণনায় এসেছে, مَنْ أَنْظَرَ مُعْسِرًا أَوْ وَضَعَ عَنْ مُعْسِرٍ أَظَلَّهُ اللهُ فِيْ ظِلِّهِ- ‘যে ব্যক্তি ঋণ পরিশোধে অক্ষম ব্যক্তিকে অবকাশ দিবে অথবা তার ঋণ মাফ করে দিবে, আল্লাহ তা‘আলা ক্বিয়ামতের দিন স্বীয় ছায়ায় তাকে ছায়া দান করবেন’।[42]

প্রতিবেশীর অসুস্থতায় দেখতে যাওয়া ও সেবা করা : রোগাক্রান্ত ও অসুস্থ হ’লে মানুষ অসহায় ও শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় কোথাও যেতে পারে না। বিছানায় শুয়ে শুয়ে তার সময় কেটে যায়। এমতাবস্থায় কেউ পাশে গিয়ে সান্ত্বনা দিলে সে স্বস্তি বোধ করে। অনুরূপভাবে অসুস্থ প্রতিবেশীকে দেখতে গেলে তাকে সে আপন মনে করে। তাছাড়া অসুস্থ ব্যক্তির খোঁজ-খবর নেয়া মুসলমানের অন্যতম দায়িত্ব। রোগীর দেখা-শোনা ও সেবা-শুশ্রূষাকে ইসলাম অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, أَطْعِمُوا الْجَائِعَ وَعُوْدُوا الْمَرِيْضَ وَفُكُّوا الْعَانِىَ- ‘ক্ষুধার্তকে খাদ্য দান কর, রুগ্ন ব্যক্তির দেখাশুনা কর এবং বন্দীকে মুক্ত কর’।[43] অন্যত্র তিনি বলেন, عُوْدُوا الْمَرِيْضَ، وَاتَّبِعُوا الْجَنَائِزَ، تُذَكِّرُكُمُ الْآخِرَةَ ‘রুগ্ন ব্যক্তিকে দেখতে যাবে এবং জানাযার অনুসরণ করবে, তাহ’লে তা তোমাদেরকে আখেরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দিবে’।[44]

রোগীকে দেখতে যাওয়া ও সেবা-শুশ্রূষা করা বিরাট পূণ্যের কাজও বটে। নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, إِنَّ الْمُسْلِمَ إِذَا عَادَ أَخَاهُ الْمُسْلِمَ لَمْ يَزَلْ فِىْ خُرْفَةِ الْجَنَّةِ حَتَّى يَرْجِعَ ‘কোন মুসলিম যখন তার কোন রুগ্ন মুসলমান ভাইকে দেখতে যায়, তখন সে যেন জান্নাতের বাগানে ফল আহরণ করতে থাকে, যতক্ষণ না সে ফিরে আসে’।[45] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ عَادَ مَرِيْضًا خَاضَ فِى الرَّحْمَةِ، حَتَّى إِذَا قَعَدَ اسْتَقَرَّ فِيْهَا. ‘যদি কোন ব্যক্তি কোন রোগীকে দেখতে যায়, সে রহমতের মধ্যে ডুব দেয়, এমনকি সে যখন সেখানে বসে পড়ে, তখন সে রহমতের মধ্যেই অবস্থান করে’।[46]

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরো বলেন, مَنْ عَادَ مَرِيْضًا أَوْ زَارَ أَخًا لَهُ فِى اللهِ نَادَاهُ مُنَادٍ أَنْ طِبْتَ وَطَابَ مَمْشَاكَ وَتَبَوَّأْتَ مِنَ الْجَنَّةِ مَنْزِلاً. ‘কোন ব্যক্তি কোন রোগীকে দেখতে গেলে অথবা আল্লাহর ওয়াস্তে তার কোন ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ করলে, একজন আহবানকারী (অন্য বর্ণনায় রয়েছে আল্লাহ তা‘আলা) তাকে ডেকে বলেন, তুমি উত্তম কাজ করেছ, তোমার পদচারণা উত্তম হয়েছে এবং জান্নাতে তুমি একটি ঘর তৈরি করে নিয়েছ’।[47] অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَا مِنْ مُسلِمٍ يَعُوْدُ مُسْلِمًا غُدْوَةً إِلاَّ صَلَّى عَلَيْهِ سَبْعُوْنَ أَلْفَ مَلَكٍ حَتَّى يُمْسِىَ وَإِنْ عَادَه عَشِيَّةً إِلاَّ صَلَّى عَلَيْهِ سَبْعُوْنَ أَلْفَ مَلَكٍ حَتَّى يُصْبِحَ وَكَانَ لَه خَرِيْفٌ فِىْ الْجَنَّةِ. ‘যে কোন মুসলমান সকাল বেলা কোন মুসলমান রোগীকে গেলেই তার জন্য সন্ধ্যা পর্যন্ত সত্তর হাযার ফেরেশতা দো‘আ করতে থাকে। আর সন্ধ্যা বেলা কোন রোগী দেখতে গেলে সকাল পর্যন্ত তার জন্য সত্তর হাযার ফেরেশতা দো‘আ করতে থাকে। আর তার জন্য জান্নাতে একটি ফলের বাগান সুনির্ধারিত করে দেয়া হয়’।[48]

প্রতিবেশীর দুঃখ-শোকে সান্ত্বনা দেওয়া :  প্রতিবেশীর যে কোন দুঃখ-শোকে তার পাশে দাঁড়ানো, তার প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করা এবং তাকে সান্ত্বনা প্রদান করা নেকীর কাজ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَا مِنْ مُؤْمِنٍ يُعَزِّى أَخَاهُ بِمُصِيْبَةٍ إِلاَّ كَسَاهُ اللهُ سُبْحَانَهُ مِنْ حُلَلِ الْكَرَامَةِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ- ‘যে ব্যক্তি তার মুমিন ভাইকে বিপদে সান্ত্বনা প্রদান করবে, আল্লাহ তা‘আলা ক্বিয়ামতের দিন তাকে সম্মানের পোশাক পরিধান করাবেন’।[49]

প্রতিবেশীর জানাযায় অংশগ্রহণ : এক মুসলিমের প্রতি অপর মুসলিমের যে ছয়টি হক রয়েছে তন্মধ্যে অন্যতম হ’ল কেউ ইন্তিকাল করলে তার জানাযায় অংশগ্রহণ করা।[50]

অন্যত্র রাসূল (ছাঃ) বলেন, حَقُّ الْمُسْلِمِ عَلَى الْمُسْلِمِ خَمْسٌ رَدُّ السَّلاَمِ، وَعِيَادَةُ الْمَرِيْضِ، وَاتِّبَاعُ الْجَنَائِزِ، وَإِجَابَةُ الدَّعْوَةِ، وَتَشْمِيتُ الْعَاطِسِ ‘এক মুসলমানের উপর অপর মুসলমানের হক পাঁচটি। সালামের জওয়াব দেওয়া, রোগীকে দেখতে যাওয়া, জানাযায় শরীক হওয়া, আহবানে সাড়া দেওয়া, হাঁচির জবাব দেওয়া’।[51]

জানাযায় অংশগ্রহণে প্রতিবেশীর হক যেমন আদায় হয়, তেমনি এতে অশেষ ছওয়াব রয়েছে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, مَنِ اتَّبَعَ جَنَازَةَ مُسْلِمٍ إِيْمَانًا وَاحْتِسَابًا، وَكَانَ مَعَهُ حَتَّى يُصَلَّى عَلَيْهَا، وَيَفْرُغَ مِنْ دَفْنِهَا، فَإِنَّهُ يَرْجِعُ مِنَ الأَجْرِ بِقِيْرَاطَيْنِ، كُلُّ قِيْرَاطٍ مِثْلُ أُحُدٍ، وَمَنْ صَلَّى عَلَيْهَا ثُمَّ رَجَعَ قَبْلَ أَنْ تُدْفَنَ فَإِنَّهُ يَرْجِعُ بِقِيْرَاطٍ. ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও ছওয়াবের আশায় কোন মুসলমানের জানাযার অনুগমন করে এবং তার জানাযার ছালাত আদায় ও দাফন সম্পন্ন হওয়া পর্যন্ত সঙ্গে থাকে, সে দুই ক্বীরাত ছওয়াব নিয়ে প্রত্যাবর্তন করবে। প্রতিটি ক্বীরাত হ’ল ওহোদ পর্বতের মতো। আর যে ব্যক্তি শুধু তার জানাযা আদায় করে, তারপর দাফন সম্পন্ন হবার পূর্বেই চলে আসে, সে এক ক্বীরাত ছওয়াব নিয়ে প্রত্যাবর্তন করবে’।[52]

প্রতিবেশীর মৃত্যু হ’লে তার পরিবারের জন্য খাদ্য সরবরাহ করা : কোন ব্যক্তি মারা গেলে তার পরিবার-পরিজন শোকে মুহ্যমান থাকে। ঐ সময় পাড়া-প্রতিবেশীদের কর্তব্য হ’ল তাদেরকে খাদ্য সরবরাহ করা। মু’তার যুদ্ধে জা‘ফর (রাঃ) শহীদ হ’লে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছাহাবীদেরকে বলেছিলেন,اصْنَعُوا لآلِ جَعْفَرٍ طَعَامًا فَقَدْ أَتَاهُمْ مَا يَشْغَلُهُمْ أَوْ أَمْرٌ يَشْغَلُهُمْ  ‘তোমরা জা‘ফরের পরিবারের জন্য খাদ্যের ব্যবস্থা কর। কেননা আজ তাদের প্রতি এমন জিনিস বা এমন বিষয় এসেছে, যা তাদেরকে ব্যস্ত রেখেছে’।[53]

প্রতিবেশীর অসদাচরণের প্রতিকার : কোন ব্যক্তি তার প্রতিবেশীকে কষ্ট দিলে তার প্রতিকার কৌশলে করা উচিত। এ মর্মে হাদীছে এসেছে, আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)!

إِنَّ لِيْ جَاراً يُؤْذِيْنِيْ، فَقَالَ: اِنْطَلِقْ. فَأَخْرِجْ مَتَاعَكَ إِلَى الطَّرِيْقِ. فَانْطَلَقَ فَأَخْرَجَ مَتَاعَهُ، فَاِجْتَمَعَ النَّاسُ عَلَيْهِ، فَقَالُوْا: مَا شَأْنُكَ؟ قَالَ : لِيْ جَارٌ يُؤْذِيْنِيْ، فَذَكَرْتُ لِلنَّبِيْ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ: اِنْطَلِقْ. فَاَخْرُجْ مَتَاعَكَ إِلَى الطَّرِيْقِ فَجَعَلُوْا يَقُوْلُوْنَ : اَللَّهُمَّ اَلْعِنْهُ، اَللَّهُمَّ أَخْزِهِ، فَبَلَغَهُ، فَأَتَاهُ فَقَالَ: اِرْجِعْ إِلَى مَنْزِلِكَ، فَوَاللهِ! لاَ أُوْذِيْكَ.

অর্থাৎ আমার এক প্রতিবেশী আমাকে পীড়া দেয়। তিনি বললেন, যাও, তোমার গৃহ-সামগ্রী রাস্তায় বের করে রাখ। সে ব্যক্তি তখন ঘরে গিয়ে তার গৃহসামগ্রী রাস্তায় বের করে রাখল। এতে তার পাশে লোকজন জড়ো হয়ে গেল। তারা জিজ্ঞেস করল, তোমার কি হয়েছে? সে বলল, আমার প্রতিবেশী আমাকে পীড়া দেয়। আমি তা নবী করীম (ছাঃ)-কে বললে তিনি বললেন, যাও, ঘরে গিয়ে তোমার গৃহসামগ্রী রাস্তায় বের করে রাখ। তখন তারা সেই প্রতিবেশীটিকে ধিক্কার দিতে দিতে বলতে লাগল, হে আল্লাহ! এর উপর তোমার অভিসম্পাত হোক। হে আল্লাহ! তাকে অপমানিত ও লাঞ্ছিত কর। এ কথা ঐ প্রতিবেশীর কানে গেল এবং সে সেখানে উপস্থিত হ’ল। সে তখন বলল, তুমি তোমার ঘরে ফিরে যাও। আল্লাহর কসম! আর কখনো আমি তোমাকে পীড়া দেব না’।[54]

অন্য হাদীছে এসেছে, আবু জুহায়ফা (রাঃ) বলেন, شَكَا رَجُلٌ إِلَى النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم جَارَهُ، فَقَالَ: اِحْمِلْ مَتَاعَكَ، فَضَعْهُ عَلَى الطَّرِيْقِ، فَمَنْ مَرَّ بِهِ يَلْعَنْهُ. فَجَعَلَ كُلُّ مَنْ مَرَّ بِهِ يَلْعَنُهُ، فَجَاءَ إِلَى النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ: مَا لَقِيْتَ مِنَ النَّاسِ؟ فَقَالَ: إِنَّ لَعْنَةَ اللهِ فَوْقَ لَعْنَتِهِمْ. ثُمَّ قَالَ لِلَّذِيْ شَكَا : كَفَيْتَ أَوْ نَحْوَهُ. একদা এক ব্যক্তি এসে তার প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে নবী করীম (ছাঃ)-এর দরবারে অভিযোগ করল। তিনি তাকে বললেন, যাও তোমার দ্রব্য-সামগ্রী উঠিয়ে রাস্তায় রেখে দাও। তখন যে রাস্তা অতিক্রম করবে, সে তাকে অভিসম্পাত দিবে। (সে ব্যক্তি তা-ই করল)। ফলে রাস্তা অতিক্রমকারী প্রত্যেকেই সেই প্রতিবেশীটিকে অভিসম্পাত দিতে লাগল। তখন সে ব্যক্তি দৌড়ে গিয়ে নবী করীম (ছাঃ)-এর খেদমতে উপস্থিত হ’ল। তখন তিনি বললেন, লোকদের নিকট থেকে তুমি কি পেলে? এরপর তিনি বললেন, লোকজনের অভিসম্পাতের পরও রয়েছে আল্লাহর অভিসম্পাত। অতঃপর অভিযোগকারীকে বললেন, তোমার জন্য যথেষ্ট হয়ে গেছে। অথবা তিনি অনুরূপ বললেন।[55]

প্রতিবেশীদের মাঝে ন্যায়বিচার করা : প্রতিবেশীদের মাঝে কোন বিষয়ে সমস্যা দেখা দিলে ন্যায়সঙ্গতভাবে এর সমাধান করা ইসলামের নির্দেশ। এতে ছাদাক্বার ছওয়াব পাওয়া যায়। বিবাদ মীমাংসার জন্য আল্লাহর নির্দেশ, إِنَّمَا الْمُؤْمِنُوْنَ إِخْوَةٌ فَأَصْلِحُوْا بَيْنَ أَخَوَيْكُمْ وَاتَّقُوا اللهَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُوْنَ. ‘নিশ্চয়ই মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই। সুতরাং তোমাদের ভাইদের মধ্যে মীমাংসা করে দাও। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। আশা করা যায় তোমরা রহমতপ্রাপ্ত হবে’ (হুজুরাত ৪৯/১০)। প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগেরও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেন,وَإِنْ طَائِفَتَانِ مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ اقْتَتَلُوْا فَأَصْلِحُوْا بَيْنَهُمَا فَإِنْ بَغَتْ إِحْدَاهُمَا عَلَى الْأُخْرَى فَقَاتِلُوا الَّتِيْ تَبْغِيْ حَتَّى تَفِيْءَ إِلَىْ أَمْرِ اللهِ فَإِنْ فَاءَتْ فَأَصْلِحُوْا بَيْنَهُمَا بِالْعَدْلِ وَأَقْسِطُوْا إِنَّ اللهَ يُحِبُّ الْمُقْسِطِيْنَ. ‘মুমিনদের দুই দল দ্বন্দ্বে লিপ্ত হ’লে তোমরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দিবে; আর তাদের একদল অপর দলের বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ি করলে যারা বাড়াবাড়ি করে তাদের বিরুদ্ধে তোমরা যুদ্ধ করবে, যতক্ষণ না তারা আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে। যদি তারা ফিরে আসে, তাহ’লে তাদের মধ্যে ন্যায়সঙ্গতভাবে ফায়ছালা করে দিবে এবং সুবিচার করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সুবিচারকারীদের ভালবাসেন’ (হুজুরাত ৪৯/৯)।

বিবাদ মীমাংসা করা শরী‘আতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও পুণ্যের কাজ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِأَفْضَلَ مِنْ دَرَجَةِ الصِّيَامِ وَالصَّلاَةِ وَالصَّدَقَةِ؟ ‘আমি কি তোমাদেরকে ছিয়াম, ছালাত ও ছাদাক্বার চেয়ে উত্তম মর্যাদাকর বিষয় সম্পর্কে খবর দেব না? ছাহাবীগণ বললেন, অবশ্যই হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! তিনি বললেন, إِصْلاَحُ ذَاتِ الْبَيْنِ. ‘বিবাদমান বিষয়ে মীমাংসা করা’।[56]

মুসলিম ভাইদের মাঝে বিবাদ মীমাংসা করে দিলে ছাদাক্বা করার ছওয়াব পাওয়া যায়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, تَعْدِلُ بَيْنَ الاِثْنَيْنِ صَدَقَةٌ  ‘তোমার দুই ব্যক্তির মধ্যে ন্যায়সঙ্গতভাবে বিচার-ফায়ছালা করা একটি ছাদাক্বা’।[57]

প্রতিবেশীকে হত্যা করা ক্বিয়ামতের আলামত : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) প্রতিবেশীর সাথে উত্তম ব্যবহার করতে বলেছেন এবং তাদেরকে কষ্ট দিতে নিষেধ করেছেন। অথচ বর্তমানে তুচ্ছ কারণে মানুষ প্রতিবেশীকে হত্যা পর্যন্ত করছে। এটা ক্বিয়ামতের পূর্ব লক্ষণ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, لاَ تَقُوْمُ السَّاعَةُ حَتَّى يُقْتَلَ الرَّجُلُ جَارَهُ وَأَخَاهُ وَأَبَاهُ-   ‘ক্বিয়ামত হবে না যতক্ষণ না কোন ব্যক্তি তার প্রতিবেশী, তার ভাই এবং পিতাকে হত্যা করবে’।[58]

উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, প্রতিবেশীর হক অত্যধিক। তাদের সাথে সদাচরণ করা প্রত্যেক মুমিনের অবশ্য কর্তব্য। তাদের কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকা রাসূলের নির্দেশ। খাদ্য আদান-প্রদান ও উত্তম আচরণের মাধ্যমে তাদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা যরূরী। প্রতিবেশীর হক আদায় না করলে এবং তাদের সাথে ভাল ব্যবহার না করলে জান্নাত পাওয়া দুষ্কর হবে।

তাছাড়া সমাজকে সুন্দর করার জন্য প্রতিবেশীর সাথে সম্প্রীতি-সদ্ভাব বজায় রাখা এবং তার সাথে সদাচরণ করা যরূরী। এতে সমাজে শান্তি বিরাজ করে। প্রতিবেশীর হক আদায় করলে পার্থিব জীবনে উপকারের পাশাপাশি পরকালীন জীবনেও অশেষ ছওয়াব অর্জিত হবে। আল্লাহ আমাদেরকে প্রতিবেশীর হক আদায় করার তাওফীক্ব দিন-আমীন!



[1].A S Hornby, Oxford Advanced Learner’s Dictionary, (New York : Oxford University Press, p. 1024.

[2]. লিসানুল আরব ৪/১৫৩-৫৪ পৃঃ।

[3]. আদাবুল মুফরাদ হা/১০৯, সনদ হাসান।

[4]. মুহাম্মাদ ইবনু ইবরাহীম আল-হামদ, আত-তাক্বছীর ফী  হুকূকিল জার, ১/১ পৃঃ।

[5]. আদাবুল মুফরাদ হা/১১৬; ছহীহ আত-তারগীব হা/১৯১৪, ২৫৭৬, সনদ ছহীহ।

[6]. আদাবুল মুফরাদ হা/১১৫; ছহীহুল জামে‘ হা/৩২৭০; ছহীহাহ হা/১০৩।

[7]. আদাবুল মুফরাদ হা/১১৭, সনদ ছহীহ।

[8]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৪৯৬৪।

[9]. ইবনু মাজাহ হা/৩৬৭২; আত-তারগীব হা/২৫৬৫; ছহীহুল জামে‘ হা/৬৫০১; আদাবুল মুফরাদ হা/১০২।

[10]. তিরমিযী হা/২৪৭৫; মিশকাত হা/৫১৭১; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৭২।

[11]. মিশকাত হা/৪৯৯০, সনদ হাসান।

[12]. বুখারী হা/৫৬৭২; আবু দাউদ হা/৫১৫৬।

[13]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৪৯৬২‘শিষ্টাচার’ অধ্যায়।

[14]. মুসলিম, মিশকাত হা/৪৯৬৩।

[15]. আহমাদ, বায়হাক্বী, মিশকাত হা/৪৯৯২; ছহীহ তারগীব হা/২৫৬০।

[16]. আহমাদ, মিশকাত হা/৫০০০; ছহীহুল জামে‘ হা/২৫৬৩, সনদ হাসান।

[17]. আদাবুল মুফরাদ হা/১২৭, সনদ ছহীহ।

[18]. আদাবুল মুফরাদ হা/৫৯৪।

[19]. বুখারী, হা/২২৫৯; আদাবুল মুফরাদ হা/১০৭-১০৮।

[20]. বুখারী হা/৬০১৪-১৫; মুসলিম হা/২৬২৪।

[21]. আদাবুল মুফরাদ হা/১১৩; ছহীহুল জামে‘ হা/৩৭৭৯।  

[22]. মুসলিম, মিশকাত হা/১৯৩৭; আদাবুল মুফরাদ হা/১১৪।

[23]. আদাবুল মুফরাদ হা/১২৪, সনদ ছহীহ।

[24]. মুসলিম হা/৪৫; ছহীহুল জামে‘ হা/৭০৮৬।

[25]. মিশকাত, হা/৪৯৯১; আদাবুল মুফরাদ হা/১১২; সিলসিলা ছহীহাহ হা/১৪৯।

[26]. মুসলিম হা/১৪৩০; মিশকাত হা/৩২১৭।

[27]. তিরমিযী হা/৭৮০; ইবনু মাজাহ হা/১৭৫০, সনদ ছহীহ।

[28]. মুসলিম হা/২১৬২; মিশকাত হা/১৫২৫।

[29]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/২৯৬৪,‘ক্রয়-বিক্রয়’ অধ্যায়।

[30]. বুখারী হা/১০; মুসলিম হা/৪০।

[31]. আদাবুল মুফরাদ হা/১০৩; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৬৫।

[32]. মুসলিম হা/৪৬৯১।

[33]. ইবনু মাজাহ হা/২৫৪৪; সনদ ছহীহ।

[34]. ইবনু মাজাহ হা/২৫৪৬; ছহীহ আত-তারগীব হ/২৩৩৮; ছহীহাহ হা/২৩৪১-এর আলোচনা দ্র:।

[35].  বুখারী হা/৭৩৭৬; মিশকাত হা/৪৯৪৭।

[36]. মুসলিম হা/৭০২৮; মিশকাত, ‘কিতাবুল ইলম’ হা/২০৪।

[37]. সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩৪০৭।

[38]. ছহীহুল জামে‘ হা/৫৭৬৯, সনদ ছহীহ।

[39]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/২৯০১।

[40]. মুসলিম, মিশকাত হা/২৯০২।

[41]. মুসলিম, মিশকাত হা/২৯০৩।

[42]. মুসলিম হা/৩০০৬; মিশকাত হা/২৯০৪।  

[43]. বুখারী, মিশকাত, হা/১৫২৩।

[44]. আদাবুল মুফরাদ হা/৫১৮; সিলসিলা ছহীহাহ হা/১৯৮১, হাদীছ ছহীহ।

[45]. মুসলিম হা/২৫৬৮; মিশকাত হা/১৫২৭।

[46]. আদাবুল মুফরাদ হা/৫২২, হাদীছ ছহীহ।

[47]. তিরমিযী হা/২০০৮, হাদীছ হাসান; মিশকাত হা/৫০১৫।

[48]. তিরমিযী হা/৯৬৯, হাদীছ ছহীহ।

[49]. ইবনু মাজাহ হা/১৬০১, সনদ হাসান, ইরওয়াউল গালীল হা/৭৬৪।

[50]. মুসলিম, মিশকাত হা/১৫২৫।

[51]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/১৫২৪।

[52]. বুখারী হা/৪৭; মিশকাত হা/১৬৫১।

[53]. ইবনু মাজাহ হা/১৬১০;  আবুদাঊদ হা/৩১৩২ সনদ হাসান।

[54]. আদাবুল মুফরাদ হা/১২৪, সনদ হাসান-ছহীহ।

[55]. আদাবুল মুফরাদ হা/১২৫, সনদ হাসান-ছহীহ।

[56]. আবূ দাঊদ হা/৪৯১৯, তিরমিযী হা/২৬৪০, হাদীছ ছহীহ।

[57]. মুসলিম হা/১০০৯।

[58]. আদাবুল মুফরাদ হা/১১৮; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩১৮৫।

মন্তব্য করুন

Back to top button