মানবাধিকার ও ইসলাম : মানুষকে নির্যাতন না করা
কোন মানুষের ওপর নির্যাতন, অমানবিক যন্ত্রণা, শাস্তি অথবা মানবেতর অবস্থা না চাপানো :
Article 5: No one shall be subjected to torture or cruel in human or degrading treatment and panishment.[1] ‘কাউকে নির্যাতন করা যাবে না বা অমানবিক যন্ত্রণা বা শাস্তি দেয়া যাবে না অথবা কারো উপর মানবেতর অবস্থা চাপিয়ে দেয়া যাবে না’।
অর্থাৎ ১৯৪৮ সালের জাতিসংঘ সার্বজনীন মানবাধিকার সনদের ৫নং ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, কোন মানুষ অন্য কোন মানুষকে নির্যাতন করতে পারবে না, অমানবিক যন্ত্রণা বা শাস্তি দিতে পারবে না এবং কারো উপর মানবেতর জীবন ব্যবস্থা চাপিয়ে দেয়া যাবে না। যদিও বর্তমান বিশ্বসহ আমাদের দেশে এ ধারাটির মারাত্মক অপপ্রয়োগ হচ্ছে। এখানে ধারাটির অর্থ থেকে বুঝা যায় না যে, নির্যাতন, অমানবিক যন্ত্রণা ও মানবেতর শব্দগুলোর ব্যবহার ন্যায় বা অন্যায় কোন ক্ষেত্রে হবে? এ সবের সুস্পষ্ট উল্লেখও নেই। তাহ’লে আমরা ধরে নিতে পারি যে, ন্যায় অথবা অন্যায় যেকোন ক্ষেত্রেই হৌক না কেন উক্ত ধরনের আচরণ করা যাবে না। সে যে কোন ব্যক্তি, জাতি-গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের হোক না কেন।
ইসলামের আলোকে বিশ্লেষণ : উপরোক্ত কথাগুলো নিঃসন্দেহে ভাল, যা ইসলামও সমর্থন করে। ইসলাম শুধু সমর্থন করেনি, বরং এর Solution বা সমাধান বহু পূর্বেই মানবজাতির সমীপে পেশ করেছে। ইসলাম অন্যায়ভাবে তো দূরের কথা, ন্যায়সঙ্গত শাস্তির ক্ষেত্রেও কোন অপরাধীর সাথে অমানবিক ও অসদাচরণ করে না এবং তাকে মানবেতর অবস্থায় নিক্ষেপ করে না। বরং সকলের সাথে উত্তম ও সদয় ব্যবহার করার নির্দেশ দেয়। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, وَاعْبُدُوْا اللهَ وَلاَ تُشْرِكُوْا بِهِ شَيْئاً وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَاناً وَبِذِيْ الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِيْنِ وَالْجَارِ ذِي الْقُرْبَى وَالْجَارِ الْجُنُبِ وَالصَّاحِبِ بِالجَنْبِ وَابْنِ السَّبِيْلِ وَمَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ إِنَّ اللهَ لاَ يُحِبُّ مَنْ كَانَ مُخْتَالاً فَخُوْراً- ‘তোমরা আল্লাহ্র ইবাদত করবে ও কোন কিছুকে তাঁর সাথে শরীক করবে না এবং পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম, অভাবগ্রস্ত, নিকট প্রতিবেশী, দূর প্রতিবেশী, সঙ্গী-সাথী, পথচারী এবং তোমাদের অধিকারভুক্ত দাস-দাসীদের প্রতি সদ্ব্যবহার করবে। আল্লাহ পসন্দ করেন না দাম্ভিক, আত্মগর্বীকে’ (নিসা ৩৬)।
ইসলাম উত্তম ব্যবহার দ্বারা দুর্ব্যবহারকে প্রতিহত করতে বলেছে। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ادْفَعْ بِالَّتِيْ هِيَ أَحْسَنُ السَّيِّئَةَ نَحْنُ أَعْلَمُ بِمَا يَصِفُوْنَ ‘মন্দের মুকাবিলা কর যা উত্তম তা দ্বারা। তারা যা বলে আমরা সে বিষয়ে সবিশেষ অবহিত’ (মুমিনুন ৯৬)।
কেউ কাউকে হত্যা করলে বা অঙ্গহানি করলে তার বদলে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে ইসলামে। আল্লাহ বলেন, وَكَتَبْنَا عَلَيْهِمْ فِيْهَا أَنَّ النَّفْسَ بِالنَّفْسِ وَالْعَيْنَ بِالْعَيْنِ وَالأَنْفَ بِالأَنْفِ وَالأُذُنَ بِالأُذُنِ وَالسِّنَّ بِالسِّنِّ وَالْجُرُوْحَ قِصَاصٌ فَمَنْ تَصَدَّقَ بِهِ فَهُوَ كَفَّارَةٌ لَّهُ وَمَنْ لَّمْ يَحْكُمْ بِمَا أنْزَلَ اللهُ فَأُوْلَـئِكَ هُمُ الظَّالِمُوْنَ ‘তাদের জন্য আমরা উহাতে বিধান দিয়েছিলাম যে, প্রাণের বদলে প্রাণ, চোখের বদলে চোখ, নাকের বদলে নাক, কানের বদলে কান, দাঁতের বদলে দাঁত এবং জখমের বদলে অনুরূপ জখম। অতঃপর কেউ তা ক্ষমা করলে তাতে তারই পাপ মোচন হবে। আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তদনুসারে যারা ফায়ছালা করে না তারাই যালিম’ (মায়েদাহ ৪৫)।
আল্লাহ পাক অন্যত্রে বলেন, وَإِنْ طَائِفَتَانِ مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ اقْتَتَلُوْا فَأَصْلِحُوْا بَيْنَهُمَا فَإِنْ بَغَتْ إِحْدَاهُمَا عَلَى الْأُخْرَى فَقَاتِلُوا الَّتِيْ تَبْغِيْ حَتَّى تَفِيْءَ إِلَى أَمْرِ اللهِ فَإِنْ فَاءَتْ فَأَصْلِحُوْا بَيْنَهُمَا بِالْعَدْلِ وَأَقْسِطُوْا إِنَّ اللهَ يُحِبُّ الْمُقْسِطِيْنَ ‘মুমিনদের দুই দল দ্বন্দ্বে লিপ্ত হ’লে তোমরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দিবে। অতঃপর তাদের এক দল অপর দলকে আক্রমণ করলে তোমরা আক্রমণকারী দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে যতক্ষণ না তারা আল্লাহ্র নির্দেশের প্রতি ফিরে আসে। যদি তারা ফিরে আসে তাদের প্রতি ন্যায়ের সাথে ফায়ছালা করবে এবং সুবিচার করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সুবিচারকারীদেরকে ভালবাসেন’ (হুজুরাত ৯)।
ইসলাম মানুষকে অন্যায়ভাবে কোন কিছু আত্মসাৎ বা আত্মসাৎ করার উদ্দেশ্যে বিচারকের কাছে মিথ্যা মামলা না করার প্রতিও কঠোর নির্দেশ প্রদান করেছে। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَلاَ تَأْكُلُواْ أَمْوَالَكُمْ بَيْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ وَتُدْلُوْا بِهَا إِلَى الْحُكَّامِ لِتَأْكُلُوْا فَرِيْقاً مِّنْ أَمْوَالِ النَّاسِ بِالإِثْمِ وَأَنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ ‘তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অন্যের অর্থ সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস কর না এবং মানুষের ধন-সম্পত্তির কিয়দাংশ জেনে শুনে অন্যায়ভাবে গ্রাস করার উদ্দেশ্যে তা বিচারকগণের নিকট পেশ কর না’ (বাক্বারাহ ১৮৮)।
অনাথ-ইয়াতীম ও যাচ্ঞাকারীদের প্রতিও সদয় হ’তে ইসলাম নির্দেশ দিয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, فَأَمَّا الْيَتِيْمَ فَلاَ تَقْهَرْ، وَأَمَّا السَّائِلَ فَلاَ تَنْهَرْ- ‘(হে নবী) আপনি ইয়াতীমের প্রতি কঠোর হবেন না এবং প্রার্থীকে (ভিক্ষুককে) ভৎর্সনা করবেন না’ (যুহা ৯-১০)।
কুরআনুল কারীমে ফেরাঊনের যে হীন কর্মের কথা উল্লেখ আছে তার মধ্যে একটি এই ছিল যে, সে তার জাতিকে উঁচু-নীচু ও আশরাফ-আত্বরাফ বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করে রেখেছিল। এদের মধ্যে এক শ্রেণীকে সে তার যুলুম-নির্যাতন ও অত্যাচার-অবিচারের যাঁতাকলে আবদ্ধ রাখত এবং তাদের অপমানিত ও লাঞ্ছিত করত। এ বিষয়ে কুরআনে বিধৃত হয়েছে যে, ‘ফেরাঊন দেশে (মিশরে) বিদ্রোহ করেছিল এবং সেখানকার অধিবাসীদেরকে বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করে তাদের একটি শ্রেণীকে সে হীনবল করে রেখেছিল’ (ক্বাছাছ ৪)।
উল্লেখ্য যে, শুধু ফেরাঊনের যুগে নয়, বরং বিভিন্ন নবী-রাসূলের যুগে কাফির-মুশরিক ও ইহুদী-খৃষ্টান কর্তৃক সাধারণ মানুষ ও মুসলমানেরা যে যুলুম নির্যাতনের শিকার হয়েছিল তা বর্ণনাতীত। পক্ষান্তরে মহানবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) পৃথিবীতে অহী নিয়ে এসেছিলেন বিশ্বের সকল মযলূম মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য, যা কুরআন মজীদের অসংখ্য আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।
মহামুক্তির অগ্রদূত মানবাধিকারের শ্রেষ্ঠ রূপকার সফল রাষ্ট্রনায়ক রাসূল (ছাঃ) মানুষের সাথে খারাপ আচরণ করতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত ছাহাবী আবূ হুরায়রা (রাঃ) বর্ণনা করেন, একদা রাসূলে আকরাম (ছাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি জান কোন ব্যক্তি নিঃস্ব? ছাহাবীগণ বললেন, আমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি নিঃস্ব বা দরিদ্র, যার কোন ধন-সম্পদ নেই। তিনি (ছাঃ) বললেন, আমার উম্মতের মধ্যে প্রকৃত নিঃস্ব ঐ ব্যক্তি, যে ক্বিয়ামতের দিন অনেক ছালাত, ছিয়াম, যাকাত (নেকী) সহ উপস্থিত হবে। (কিন্তু তার সাথে সাথে সে সমস্ত লোকেরাও উপস্থিত হবে) যাদের কাউকে সে গালি দিয়েছে, কারো প্রতি মিথ্যা অপবাদ আরোপ করেছে, কারো মাল (অবৈধভাবে) ভক্ষণ করেছে, কারো রক্তপাত করেছে এবং কাউকে মেরেছে। অতঃপর এ (অত্যাচারিত) ব্যক্তিকে তার নেকী থেকে দেওয়া হবে এবং এ (অত্যাচারিত) ব্যক্তিকে তার নেকী থেকে দেওয়া হবে। অতঃপর অন্যান্যদের দাবী পূরণ করার পূর্বেই যদি তার নেকী শেষ হয়ে যায়, তাহ’লে তাদের পাপরাশি নিয়ে তার (অত্যাচারীর) উপর দেওয়া হবে। অতঃপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে’।[2]
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরো বলেন, ‘মহান আল্লাহ ক্বিয়ামতের দিন অবশ্যই পাওনাদারদের পাওনা পরিশোধ করাবেন। এমনকি শিংযুক্ত ছাগল থেকে শিং বিহীন ছাগলের প্রতিশোধও নেয়া হবে’।[3] বুঝা যাচ্ছে, কেউ কারও কোন কিছু নষ্ট করতে পারবে না এবং কাউকে অন্যায়ভাবে নির্যাতন করা যাবে না।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে দিবালোকের মত স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, ইসলামে উপযুক্ত কারণ ব্যতিরেকে কোন ব্যক্তি অথবা সরকার কোন নাগরিককে শাস্তি দিতে পারে না। পারে না তাকে বন্দী করে তার ব্যক্তি স্বাধীনতা খর্ব করতে। এ সম্পর্কে কুরআনুল কারীমের নির্দেশ وَإِذَا حَكَمْتُمْ بَيْنَ النَّاسِ أَنْ تَحْكُمُواْ بِالْعَدْلِ ‘তোমরা যখন মানুষের মধ্যে বিচারকার্য পরিচালনা করবে তখন ন্যায় পরায়ণতার সাথে করবে’ (নিসা ৫৮)।
দৈহিক নির্যাতন না করা :
যে কোন ব্যক্তিকে দৈহিক নির্যাতন থেকে আত্মরক্ষার অধিকার ইসলাম দিয়েছে। অভিযুক্ত তো দূরের কথা অপরাধীকেও দোষ প্রমাণের পূর্বে দৈহিকভাবে নির্যাতন করা যাবে না। এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘যারা দুনিয়ায় মানুষকে নির্যাতন করে, তাদেরকে আল্লাহ কঠোর শাস্তি প্রদান করবেন’।[4] অনুরূপভাবে কোন ব্যক্তি যে অপরাধ করেনি, সেই অপরাধের স্বীকারোক্তি আদায়ে বাধ্য করাও বৈধ নয়। আর বল প্রয়োগ করে যা কিছু করা হয়, তা বাতিল। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘আমার উম্মতকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে ভুল-ত্রুটি থেকে এবং যা করতে তাকে বাধ্য করা হয়েছে তা থেকে’।[5]
এ সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) বিদায় হজ্জের ভাষণে দৃপ্তকণ্ঠে বলেন, ‘তোমাদের রক্ত, তোমাদের সম্পদ এবং তোমাদের সম্মান তোমাদের মধ্যে ঠিক তেমনি পবিত্র, যেমন তোমাদের নিকট আজকের এই দিন, এই মাস, এই শহর পবিত্র’।[6] এখানে কেবল অপর ভাইয়ের জান-মাল রক্ষা করতে বলেনি বরং এটা অত্যন্ত পবিত্র বলে বর্ণিত হয়েছে। ইবনে ওমর (রাঃ) বলেন, আমি রাসূল (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, ‘যে ব্যক্তি তার গোলামকে বিনা দোষে শাস্তি দেয় অথবা তাকে চপেটাঘাত করে, তবে এর কাফফারা হ’ল তাকে আযাদ করে দেয়া’।[7]
প্রতিবেশীদের সাথে খারাপ আচরণ করতেও কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। আব্দুল্লাহ বিন আমর ইবনুল আছ (রাঃ) বর্ণনা করেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘প্রকৃত মুসলমান হ’ল সেই ব্যক্তি, যার জিহবা ও হাত হ’তে অন্যসব মুসলমান নিরাপদ থাকে। আর প্রকৃত মুহাজির হ’ল সেই ব্যক্তি, যে আল্লাহ্র নিষিদ্ধ কাজগুলোকে ছেড়ে দেয়’।[8]
আলোচ্য হাদীছে কারও সাথে অমানবিক ও নিষ্ঠুর আচরণ করা থেকে বিরত রাখার জন্য হাত ও মুখকে সংযত রাখতে জোরালো নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মহানবী (ছাঃ) অন্যত্র বলেছেন, ‘সে ব্যক্তি মুসলমান নয় যে পেট পুরে খায় অথচ তার প্রতিবেশী অভুক্ত থাকে, সে মুমিন নয়’।[9] অথচ বর্তমানে আমাদের দেশসহ বিশ্বের কোটি কোটি শিশু, নারী-পুরুষ অভুক্ত ও উদ্বাস্ত্ত অবস্থায় নিদারুণ কষ্টে দিন কাটাচ্ছে। যার সঠিক কোন সমাধান জাতিসংঘ দিতে পারেনি অথচ ইসলাম দেড় হাযার বছর পূর্বেই এর সঠিক সমাধান দিয়েছে। হিশাম বিন হাকীম বিন জিহাম (রাঃ) বর্ণনা করেন, ‘একদা তিনি সিরিয়া অঞ্চল অতিক্রমকালে কতিপয় আজমী কৃষক সম্প্রদায়ের কিছু লোকের কাছে ফিরে যাচ্ছিলেন। ঐ লোকদেরকে রোদের মধ্যে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল। তাদের মাথায় যয়তুনের তেল ঢালা হয়েছিল। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ব্যাপারটি কি? তাকে বলা হ’ল ভূমি রাজস্ব আদায়ের জন্য এদেরকে শাস্তি দেয়া হচ্ছে। অন্য এক রেওয়ায়েতে বলা হয়েছে, জিযিয়া আদায়ের কারণে এদেরকে আটকে রাখা হয়েছে। হিশাম বলেন, আমি শপথ করে বলছি, আমি রাসূল (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, নিঃসন্দেহে আল্লাহ সেই লোকদের শাস্তি দিবেন, যারা দুনিয়ায় লোকদের শাস্তি দেয়। এরপর তিনি সেখানকার শাসকের কাছে গেলেন এবং তাকে হাদীছটি শোনালেন। তখন তিনি আলোচ্য বিষয়ে নির্দেশ দিলেন এবং সে অনুসারে আটক ব্যক্তিদেরকে মুক্তি দেয়া হ’ল’।[10]
অন্য এক হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, ‘আবু আমির হিমসী বর্ণনা করেন যে, ছাওবান (রাঃ) প্রায়ই বলতেন, যখন দুই ব্যক্তি তিন দিনের বেশী সময় ধরে সম্পর্কচ্ছেদ করে থাকে, তখন একজনের সর্বনাশ হয়ে যায়। আর যদি দু’জন সম্পর্কচ্যুত অবস্থায় মৃত্যুমুখে পতিত হয়, তবে তাদের উভয়েরই সর্বনাশ হয় এবং যে প্রতিবেশী তার কোন প্রতিবেশীকে নির্যাতন করে, তার সাথে নিষ্ঠুর আচরণ করে, যার ফলে সে ব্যক্তি গৃহ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়, সে ব্যক্তি নিশ্চিত ধ্বংসের মধ্যে পতিত হয়’।[11]
প্রতিবেশীদের সাথে কেমন আচার-ব্যবহার করা দরকার তা বর্ণিত হাদীছ থেকে প্রতীয়মান হয়। শুধু তাই নয়, প্রতিবেশী মুসলমান, হিন্দু, খৃষ্টান, বেŠদ্ধ বা যে শ্রেণীভুক্ত হোক না কেন কারও সাথে অসদ্ব্যবহার, অমানবিক ও নিষ্ঠুর আচরণ করা ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এ বিষয়ে অন্য এক হাদীছে বর্ণিত হয়েছে যে, ‘জনৈক ছাহাবী কোন কিছু প্রদান করতে গেলে প্রথমে এক ইহুদী প্রতিবেশী পেয়ে তাকেই উক্ত হাদিয়া দান করেছিলেন’।[12]
পর্যালোচনা :
জাতিসংঘ সার্বজনীন মানবাধিকার সনদের ৫নং ধারায় বর্ণিত হয়েছে যে, কেউ কাউকে নির্যাতন করবে না, অমানবিক যন্ত্রণা বা শাস্তি দিবে না অথবা মানবেতর অবস্থা চাপিয়ে দিবে না। এখানে ন্যায় বা অন্যায় যে কোন ক্ষেত্রে হৌক না কেন কাউকে কোন প্রকার নিষ্ঠুর ও অমানবিক শাস্তি বা অনুরূপ আচরণ করা যাবে না।
কিন্তু বাস্তবে ঐ ধারার কোন প্রয়োগ কি বিশ্বের কোথাও হচ্ছে? সহজ ও সংক্ষেপ জবাব হ’ল, না। কারণ যারা এই মানবাধিকার সনদের রূপকার বলে খ্যাত, তাদের মধ্যেই এর বাস্তব প্রতিফলন নেই। তারা নিজ দল বা দেশের স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রাখতে গিয়ে মানবাধিকারের কথা ভুলে যান। এদের মধ্যে যেমন নৈতিক চরিত্রের অভাব বিদ্যমান, তেমনি জবাবদিহিতার সামান্যতম কোন অনুভূতি নেই। যেমনটি আছে ইসলামে। ইসলাম এমন একটি ধর্ম যা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর মাধ্যমে রূপায়িত ও প্রতিষ্ঠিত। তিনি এখন পৃথিবীতে নেই। তবে কোটি কোটি তাওহীদপন্থী মানুষের মধ্যে তাঁর রেখে যাওয়া আদর্শ বেঁচে আছে।
উল্লেখ্য, সঊদী আরবের কোন আদালতে যখন অপরাধীকে শরী‘আত অনুযায়ী মৃত্যুদন্ড বা অন্য দন্ড দেয়া হয় তখন সারা বিশ্বে হৈচৈ শুরু হয়ে যায়। পাশ্চাত্যপন্থীরা বলে, অমানবিক ও নিষ্ঠুর আচরণ করা হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারও মাঝে মধ্যে তাদের সাথে সূর মিলানোর চেষ্টা করে। এই তো কিছুদিন আগেও কয়েক জন বাংলাদেশীকে সঊদী শারঈ আদালত হত্যার বদলে হত্যার রায় প্রদান করলে দেশের বর্তমান আওয়ামী সরকার কতই না দৌড়-ঝাঁপ শুরু করে দিল অপরাধীদেরকে বাঁচানোর জন্য। অবশেষে সকল চেষ্টাই ব্যর্থ হয় এবং তাদের রায় তথা মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। কারণ শরী‘আতে হত্যাকারীর শাস্তি মওকূফ করার অধিকার একমাত্র মৃতব্যক্তির উত্তরাধিকারীদের। এক্ষেত্রে মৃতব্যক্তির উত্তরাধিকারী (মিশরীয়) স্ত্রী অপরাধীদের ক্ষমা করেনি। ফলে রায় কার্যকর করা হয়। কি সুন্দর বিচার ব্যবস্থা! এদেশে অথবা বিশ্বের কোথাও এই আইন যদি চালু করা যায়, তাহ’লে পৃথিবী থেকে অপরাধ কর্মকান্ড বহুলাংশেই কমে যাবে।
জাতিসংঘ মানবাধিকার সনদের ৫নং ধারায় যা উল্লেখ রয়েছে তাতে আসলে স্পষ্ট করে বলা হয়নি। কিন্তু ইসলাম সকল বিষয়েই দিক-নির্দেশনা প্রদান করেছে, যা উপরে উল্লিখিত আলোচনা থেকে বুঝা গেল । এক কথায় পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ থেকে বুঝা যায় যে, মানুষ কোন মানুষের উপর কোনরূপ অন্যায়-অত্যাচার, জোর-যুলুম করবে না, কোন মানুষ কাউকে মানবেতর অবস্থায় ফেলে দিবে না। যেমনটি আমরা অন্যত্র দেখি। ভারতের তামিলনাড়ু সরকারী হাসপাতালের রিপোর্ট অনুযায়ী সে দেশে জন্ম গ্রহণকারী প্রতি ১০টি কন্যা শিশুর মধ্যে ৪টি শিশুকে মরে যাওয়ার জন্য রেখে দেয়া হয়।[13] আবার আমেরিকার ‘ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস’-এর ন্যাশনাল আইন ভিকটিমাইজেশন সারভে ব্যুরো অব জাষ্টিস-এর প্রকাশিত রিপোর্টে ১৯৯৬ সালে ৩,০৭,০০০টি ধর্ষণের অভিযোগ রেকর্ডভুক্ত করা হয়। এতে প্রতিদিন ২,৭১৩ অর্থাৎ প্রতি ৩২ সেকেন্ডে একজন নারী ধর্ষিতা হয়।[14] ঐ জরিপ থেকে আরও জানা যায় যে, সেখানে ৮ শতাংশ মানুষ অত্যাচার-অনাচারে যুক্ত। এখানে প্রতি ১২তম বা ১৩তম ব্যক্তি অনাচারে লিপ্ত।[15] বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এই হুঁশিয়ারী দিয়েছে যে, বিশ্বে ১০ কোটি মানুষ দ্রারিদ্র্য সীমার নীচে নেমে যাবে। এর জন্য তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে নানা কারণে দায়ী করছে।[16]
আমেরিকা, বৃটেন, ফ্রান্স, বার্মা, ভারত সহ বহু রাষ্ট্র মুসলিম দেশ ও মুসলমানদের ওপর নির্যাতন করছে। বিশেষ করে গুয়ানতানামো-বে কারাগারে, ইরাকের আবুগারীব কারাগারে এবং বার্মার মুসলমানদের ওপর অমানষিক অত্যাচার-নির্যাতন চালানো হচ্ছে। ফ্রান্সে মুসলমান নর-নারী ও তাদের পোষাকের ওপর নিষেধাজ্ঞা; ভারতের আসাম ও কাশ্মীরসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে মুসলমানদের ওপর যে অমানবিক নির্যাতন চালানো হচ্ছে তা জাতিসংঘ মানবাধিকার সনদের ৫নং ধারার সুস্পষ্ট লংঘন। যারা এ সনদ তৈরী করেছেন, যারা এর প্রবক্তা তাদের দ্বারাই এ ধারার অপ্রয়োগ হচ্ছে।
পরিশেষে একথাই বলা চলে যে, জাতিসংঘ সার্বজনীন মানবাধিকার সনদের এ ধারাটিতে অস্পষ্টতা ও বাস্তবে ত্রুটিপূর্ণতা রয়েছে, যার কারণে এর অপব্যবহার চলছে। এজন্যই কার্যত তা অচল ও ব্যবহারের অনুপোযোগী। আর যে কারণে বাংলাদেশ সহ বিশ্ব সম্প্রদায় হৈ চৈ করেও মানুষের ওপর অমানবিক নির্যাতন, নিষ্ঠুর শাস্তি ও মানবেতর অবস্থা থেকে নিজেদেরকে ফিরিয়ে আনতে পারছে না। পারছে না নিজেদের পরিবার, দেশ ও জাতিকে শান্তির পথ দেখাতে। পক্ষান্তরে ইসলামই সকল শান্তি ও মুক্তির পথ দেখাতে পেরেছে, যা বক্ষমাণ নিবন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
অতএব হে মানব মন্ডলী! আসুন চিরস্থায়ী ও নির্ভুল মহাগ্রন্থের দিকে ও বিশ্বশান্তির ধর্ম ইসলামের পতাকাতলে সমবেত হই। ব্যক্তি-পরিবার ও সমাজ সংশোধনের মাধ্যমে দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করতে চেষ্টা করি। আল্লাহ সকলকে সে তাওফীক দান করুন- আমীন!