মানবাধিকার ও ইসলাম : ইসলাম দাস প্রথাকে একেবারে নিষিদ্ধ করেনি কেন?

পূর্বের অংশ পড়ুন: দাসপ্রথা নিষিদ্ধতা প্রসঙ্গ – ১
ইসলাম দাস প্রথাকে একেবারে নিষিদ্ধ করেনি কেন?
ইসলাম কেন দাসপ্রথা নিষিদ্ধ করেনি সে বিষয়ে আলোচনার পূর্বে দাসদের ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি সংক্ষিপ্ত আকারে উপস্থাপন করা প্রাসঙ্গিক মনে করি। ইহুদী, খৃষ্টান ধর্মে এবং বর্তমান সভ্য ও আধুনিক বিশ্বে দাস সৃষ্টির উপায়-উপকরণ ও সুযোগ থাকলেও সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে, ইসলাম কেন দাস প্রথাকে নিষিদ্ধ করেনি সেদিকেই বিরোধীরা অভিযোগের অঙ্গুলি নির্দেশ করে। কিন্তু নিরপেক্ষ দৃষ্টি ও উন্মুক্ত মন নিয়ে তাকালে ইসলাম দাসপ্রথার ব্যাপারে যে সূক্ষ্ম বিধান প্রবর্তন করেছে, তা তাদের চোখের সামনে উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে। এজন্য ইসলামে দাস সৃষ্টির মূল উৎস ও উপায়-উপকরণ, তাদের সাথে ব্যবহার, তাদের অধিকারের ক্ষেত্রে সমতা বিধান, তাদের প্রতি আযাদ ব্যক্তিদের দায়িত্ব-কর্তব্য এবং তাদের স্বাধীনতা লাভের যে অবারিত সুযোগ-সুবিধা ও পথ-পন্থা ইসলাম রেখেছে তার দিকে লক্ষ্য রাখা আবশ্যক। পাশাপাশি বর্তমান সভ্য, উন্নত ও অগ্রসরমান বিশ্বে নতুনভাবে দাস সৃষ্টির বিভিন্ন ধরন ও পদ্ধতির প্রতি সচেতন দৃষ্টি দিতে হবে, তাহ’লে ইসলামের প্রতি কারো অন্তরে কোন অভিযোগ থাকবে না। এমনকি অজ্ঞতায় যাদের মনে এ ব্যাপারে ক্ষোভের অগ্নি ধূমায়িত হয়েছে, তা মোমের ন্যায় বায়বীয় আকারে উবে যাবে। আর ইসলামের প্রতি শ্রদ্ধায় তার মস্তক অবনত হবে ইনশাআল্লাহ।
ইসলাম আগমনের প্রাক্কালে দাস সৃষ্টির যে কয়েকটি কারণ ছিল, তা হচ্ছে- ১. যুদ্ধ-বিগ্রহে পরাজিত হয়ে বন্দী হওয়া ২. ঋণের অস্বাভাবিক বোঝা বহনে অক্ষম হয়ে স্বেচ্ছায় দাসত্ব বরণ করা ৩. ডাকাতি, ছিনতাই-অপহরণের কবলে পড়ে ৪. সীমাহীন অভাব-অনটন ও দারিদ্রে্যর শিকার হয়ে। এগুলির মধ্যে রাস্তা-ঘাটে বা পথে-প্রান্তরে সন্ত্রাস, রাহাজানীর মাধ্যমেই বিশ্বে দাস প্রথার ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল, বিশেষত ইউরোপ, আমেরিকায়। অথচ ইসলাম এসব বন্ধে চূড়ান্ত ও কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। যেমন হাদীছে কুদসীতে এসেছে,
ثَلاَثَةٌ أَنَا خَصْمُهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَمَنْ كُنْتُ خَصْمَهُ خَصَمْتُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ رَجُلٌ أَعْطَى بِى ثُمَّ غَدَرَ وَرَجُلٌ بَاعَ حُرًّا فَأَكَلَ ثَمَنَهُ وَرَجُلٌ اسْتَأْجَرَ أَجِيْرًا فَاسْتَوْفَى مِنْهُ وَلَمْ يُوفِهِ أَجْرَهُ-
‘আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ক্বিয়ামতের দিন আমি নিজে তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে বাদী হব। যে ব্যক্তি আমার নামে ওয়াদা করে তা ভঙ্গ করল। যে ব্যক্তি কোন আযাদ মানুষকে বিক্রি করে তার মূল্য ভোগ করল। আর যে ব্যক্তি কোন মজুর নিয়োগ করে তার হ’তে পুরো কাজ আদায় করে এবং তার পারিশ্রমিক দেয় না’।[1]
এখানে আরো উল্লেখ্য যে, কুরআন ও হাদীছে এমন কোন দলীল নেই যেখানে নতুনভাবে দাস বানানোর কথা বলা হয়েছে; বরং কুরআন ও হাদীছে ১০টির অধিক দলীল রয়েছে, যেখানে দাসমুক্তি ও তাদের স্বাধীন করার উদাত্ত আহবান রয়েছে।
ইসলামের আবির্ভাব কালে দাসত্ব সৃষ্টির যে সকল উৎস ও পথ ছিল ইসলাম সেসব বন্ধ করার মাধ্যমে দাস প্রথাকে প্রায় উচ্ছেদ করেছিল। সে সাথে দাসদের আযাদ করার হাযারো দুয়ার উন্মুক্ত করেছিল। কেবল যুদ্ধের মাধ্যমে কাফির, মুশরিক ও তাদের নারী-শিশুদের দাস হওয়ার ব্যাপারটাকে আবশ্যক করে। আর মুসলমানরা গণীমত হিসাবে কাফির যুদ্ধবন্দীদের দাস-দাসী হিসাবে লাভ করলেও তারা ইসলাম গ্রহণ করে আযাদী লাভ করতে পারত। এরূপ ন্যায়-ইনছাফ ইসলাম ব্যতীত অন্য ধর্মে অকল্পনীয়। ইসলামই কেবল দাসদের সাথে উত্তম আচরণ করার ও ইসলাম গ্রহণ করার পর স্বাধীন হওয়ার সুযোগ দিয়েছে। তাছাড়া ইসলাম যুদ্ধে-বিগ্রহে বন্দীদের দাস হওয়ার যে সুযোগ রেখেছে, সেটা সব যুদ্ধে নয়। কেবল ইসলাম ও মুসলিম দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বন্দীরাই দাস হবে; ব্যক্তিগত, দলগত, গোত্রগত যুদ্ধের ক্ষেত্রে তা বৈধ নয়।
প্রাচীনকালে যুদ্ধবন্দীদের কোন সম্মান ও অধিকার ছিল না। তখন তাদের জন্য কেবল দু’টি পথ খোলা ছিল; হত্যা অথবা দাসত্ব। ইসলাম এসে এই দু’টি পথের সাথে মুক্তিপণ গ্রহণ কিংবা অনুগ্রহ করার বিষয়টি সংযুক্ত করেছে। যেমন আল্লাহ বলেন, فَإِمَّا مَنّاً بَعْدُ وَإِمَّا فِدَاءً ‘অতঃপর হয় অনুকম্পা, নয় মুক্তিপণ’ (মুহাম্মাদ ৪)।
এভাবে দাসত্বের সকল পথ-পন্থা বন্ধ করা ও তাদের জন্য উত্তম ব্যবস্থা করার পরেও ইসলাম দাস প্রথাকে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করেনি। কারণ কাফের যুদ্ধবন্দীরা হক ও ন্যায়-নীতির বিরোধী এবং হকের পথে প্রতিবন্ধক। তারা নিজেরা যেমন অত্যাচার করে, তেমনি যুলমকে সমর্থন দেয় এবং তা বিস্তারে সহায়তা করে। সুতরাং তাদের স্বাধীনতার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে অবাধ্যতা ও সীমালংঘন বিস্তার এবং অন্যের প্রতি তাদের নির্যাতন করার সুযোগ দেওয়া। আর হক্বের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করা এবং মানুষের নিকটে হক পৌঁছার পথ রুদ্ধ করা। পক্ষান্তরে দাসত্বের মাধ্যমে যুদ্ধবন্দীদের আটক রাখার ফলে ঐ সময়টাতে মানব সমাজ তাদের অনিষ্টতার কবল থেকে নিরাপত্তা লাভ করবে।
এই দাসপ্রথা বাহ্যত দৃষ্টিকটু মনে হলেও একেবারে সেটাকে নিষিদ্ধ করা হয়নি। কারণ এর পক্ষে অনেক বাস্তব উপযোগিতা ও যৌক্তিকতা উপলব্ধি করা যায়। তথাপিও এই দাস প্রথাকে ইসলাম কখনও আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেনি বরং সেটাকে অধিক নিরুৎসাহিত করেছে। এর পরেও পাশ্চাত্য পন্ডিতগণ এই দাসপ্রথা নিয়ে বিশ্বব্যাপী ইসলাম সম্পর্কে নানা কটুক্তি ও বিতর্কের ঝড় তুলেছে, কেন সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম ইসলাম এই জঘন্য প্রথাকে নিষিদ্ধ করল না? আশা করি নিম্নবর্ণিত কারণগুলো পড়লে উক্ত বিষয়টির প্রতি সকলের সুস্পষ্ট ধারণা জন্মাবে। নিম্নে এ বিষয়ে আলোকপাত করা হ’ল-
১. প্রথাগত কারণ :
দাসপ্রথা ছিল বহু প্রাচীনকালের একটি সামাজিক ব্যবস্থা। যেখানে একটা সমাজ বা পরিবারের আভিজাত্যের প্রকাশ পেত। যার যত দাস ছিল সে সমাজে একটা বড়ত্বের পরিচয় দিতে পারত। আর সে প্রথাকে সকল যুগে সকল সমাজ মেনে নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করত। এ ব্যবস্থা সমাজের মধ্যে এমনভাবে স্বীকৃতি পেয়েছিল যে, হঠাৎ করে তা কারু পক্ষে উচ্ছেদ বা নিষিদ্ধ করা খুবই কঠিন ছিল। তৎপরিবর্তে সর্বযুগের দূরদর্শী ব্যক্তিত্ব মহানবী (ছাঃ) এটাকে একেবারে বন্ধ না করে বরং ধীর পদ্ধতিতে এ প্রথাকে বিলুপ্ত করার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন।
২. সামাজিক কারণ :
দাস প্রথা বিদ্যমান থাকার মাঝে সামাজিক বড় কল্যাণের বিষয় নিহিত আছে। এর দ্বারা সমাজদেহ অশ্লীলতা বিস্তারের হাত থেকে রক্ষা পায়। মানুষের জৈবিক চাহিদা অনস্বীকার্য, যা বিবাহের মাধ্যমে পূরণ হয়। কিন্তু অনেকের পক্ষে মোহরানার উচ্চ হার বা অন্যান্য কারণে স্বাধীনা নারী বিবাহ করা সম্ভব হয় না। তাদের জন্য দাসী ক্রয় করে তাকে বিবাহের মাধ্যমে নিজেকে অবৈধ সম্পর্ক স্থাপন ও ব্যভিচারের মত মর্যাদাহানিকর কাজ থেকে রক্ষার সুযোগ রয়েছে। আল্লাহ বলেন,
وَمَن لَّمْ يَسْتَطِعْ مِنْكُمْ طَوْلاً أَنْ يَنْكِحَ الْمُحْصَنَاتِ الْمُؤْمِنَاتِ فَمِن مِّا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُم مِّن فَتَيَاتِكُمُ الْمُؤْمِنَاتِ وَاللهُ أَعْلَمُ بِإِيْمَانِكُمْ بَعْضُكُم مِّن بَعْضٍ فَانكِحُوْهُنَّ بِإِذْنِ أَهْلِهِنَّ وَآتُوهُنَّ أُجُوْرَهُنَّ بِالْمَعْرُوْفِ مُحْصَنَاتٍ غَيْرَ مُسَافِحَاتٍ وَلاَ مُتَّخِذَاتِ أَخْدَانٍ فَإِذَا أُحْصِنَّ فَإِنْ أَتَيْنَ بِفَاحِشَةٍ فَعَلَيْهِنَّ نِصْفُ مَا عَلَى الْمُحْصَنَاتِ مِنَ الْعَذَابِ ذَلِكَ لِمَنْ خَشِيَ الْعَنَتَ مِنْكُمْ وَأَن تَصْبِرُواْ خَيْرٌ لَّكُمْ وَاللهُ غَفُوْرٌ رَّحِيْمٌ-
‘তোমাদের মধ্যে কারো স্বাধীনা ঈমানদার নারী বিবাহের সামর্থ্য না থাকলে তোমরা তোমাদের অধিকারভুক্ত ঈমানদার দাসী বিবাহ করবে; আল্লাহ তোমাদের ঈমান সম্বন্ধে পরিজ্ঞাত। তোমরা একে অপরের সমান। সুতরাং তাদেরকে বিবাহ করবে তাদের মালিকের অনুমতিক্রমে এবং তাদেরকে তাদের মোহর ন্যায়সংগতভাবে দিয়ে দিবে। তারা হবে সচ্চরিত্রা, তারা ব্যভিচারিণী নয় ও উপপতি গ্রহণকারিণীও নয়। বিবাহিতা হবার পর যদি তারা ব্যভিচার করে তবে তাদের শাস্তি স্বাধীনা নারীর অর্ধেক; তোমাদের মধ্যে যারা ব্যভিচারকে ভয় করে এটা তাদের জন্য; ধৈর্য ধারণ করা তোমাদের জন্য মঙ্গল। আল্লাহ ক্ষমাপরায়ণ, পরম দয়ালু’ (নিসা ২৫-২৬)।
এছাড়া সমাজে এমন অনেক ক্ষেত্র রয়েছে যেখানে পূর্ণাঙ্গ পর্দানশীন নয় এমন মহিলাদের প্রয়োজন পড়ে। দাসীরা হচ্ছে এই শ্রেণী, যাদের উপর ইসলাম স্বাধীনা মহিলাদের ন্যায় পূর্ণাঙ্গ পর্দার বিধান আরোপ করেনি। বরং তাদের জন্য বক্ষদেশ থেকে হাঁটু পর্যন্ত আবৃত রাখাই যথেষ্ট, যদি ফেৎনার আশংকা না থাকে।[2]
যুদ্ধক্ষেত্রে বন্দী নারীদের দাসী হওয়ার ফলে এটি তাকে রক্ষণাবেক্ষণ, তার ইয্যত-আব্রুর হেফাযত ও মানবিক সম্মান বজায় রাখার ক্ষেত্রে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে। কেননা যুদ্ধ শেষে সাধারণত নারীরা স্বীয় স্বামী, ভাই বা পিতার তত্ত্বাবধানে বা আশ্রয়ে চলে যায়। কিন্তু যুদ্ধ বন্দীদের স্বজন থাকে না। এ ক্ষেত্রে তাকে খোলামেলা রাখলে এটা তার জীবন ও ইয্যতের জন্য ক্ষতির কারণ হ’তে পারে।
আর এটা সর্বজন বিদিত যে, ইসলামী শরী‘আতে নারী দাসী হ’লে তার নিকটে মনিব ব্যতীত অন্য কোন পুরুষ যেতে পারে না। আবার মালিকের সাথে চুক্তির মাধ্যমে কিংবা মনিবের সন্তান ধারণ করলে তার মৃত্যুর পরে তাৎক্ষণিক সে স্বাধীন হয়ে যায়।[3] এছাড়া মনিবের পক্ষ থেকে তার দেখা-শুনা, ভরণ-পোষণ, শিক্ষা-দীক্ষা ও সুন্দর আচরণ পাওয়ার অধিকার জন্মে যায়।
৩. রাজনৈতিক কারণ :
পূর্ব যুগে গোত্রীয় যুদ্ধ অথবা আন্ত:রাষ্ট্রীয় যুদ্ধ-বিগ্রহে পরাজিত বাহিনীকে বন্দী করা হ’ত। বন্দীরা সমাজে বা রাষ্ট্রে নতুন করে যেন কোনরূপ বিশৃংখলা সৃষ্টি করতে না পারে সেকারণে তাদেরকে দাস-দাসী হিসাবে রেখে দেয়া হ’ত। তবে সমাজপতি বা রাষ্ট্রনায়ক মনে করলে তাদেরকে শর্ত-সাপেক্ষে মুক্তি দিতে পারতেন। এখনও সেরকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হ’লে বন্দীদেরকে মুক্তি দেয়া হয়। অর্থাৎ সামাজিক পরিবেশ ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে সুসংহ’ত করতে দাস-প্রথাকে পূর্ণাঙ্গভাবে নিষিদ্ধ করা হয়নি।
৪. অর্থনৈতিক কারণ :
তৎকালে আরব দেশগুলোতে মারাত্মক অর্থনৈতিক সংকট বিদ্যমান ছিল। অধিকাংশ গরীব মানুষের অবস্থা এমন শোচনীয় হয়ে পড়েছিল যে তারা কাজ না পেয়ে মনিবের নিকট স্বেচ্ছায় গিয়ে বিক্রি হ’ত অথবা দাসত্বে আবদ্ধ হ’ত। মনিবদের নিকট গিয়ে তারা বলত, ‘আমাকে আবার আপনার গোলাম বানিয়ে রাখুন’। আমেরিকা ও সুদানে ঠিক তাই ঘটেছিল।[4] একইভাবে যুদ্ধ বন্দীদেরকে ছাহাবীদের মধ্যে গণীমতের মাল হিসাবে বণ্টন করলেও সেখানে অর্থনৈতিক বিষয়টাও মাথায় রাখা হয়েছিল। কারণ সে সময়ে আধুনিক জেলখানা ছিল না। তার প্রয়োজনও মনে করা হ’ত না। এছাড়া তাদেরকে জেলখানায় রাখলে তাদেরকে বসিয়ে খাওয়া-পরার পিছনে প্রচুর অতিরিক্ত অর্থ খরচ করতে হ’ত। বন্দীদের দাস-দাসীরূপে রেখে দেওয়ায় অন্তত সে ব্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যেত। উপরন্তু দাস-দাসীদেরকে সমাজের নানা উন্নয়ন মূলক কর্মকান্ডে সক্রিয় অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেওয়া হ’ত। যার জন্য সমাজে ও রাষ্ট্রে অর্থনৈতিক দিক থেকে তারা দারুণ ভূমিকা রাখত। অর্থাৎ দাস-দাসী সমাজের বোঝা না হয়ে বরং সামাজিক তথা রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন মূলক কর্মকান্ড যেমন কৃষি, মেষ চরানো, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কলকারখানা, শিক্ষা-দীক্ষা প্রভৃতি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত। যে কারণে এই প্রথাকে সম্পূর্ণরূপে রহিত করা হয়নি।
৫. ধর্মীয় কারণ :
ইসলাম আগমনের প্রাক্কালে দাস প্রথা ছিল বিশ্বব্যাপী প্রচলিত একটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। এটা তখন মানুষের জীবন যাত্রার সাথে এমন ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল যে একে নিষিদ্ধ করা ছিল দুরূহ। এমনি একে পরিবর্তন করার কথাও কেউ ভাবেনি। পরবর্তীতে দেখা যায় ইলাহী বিধান নাযিলের মাধ্যমে কিংবা ইসলাম কোন আকস্মিক ঘোষণার মাধ্যমে দাস প্রথাকে নিষিদ্ধ করেনি। বরং শরী‘আত এমন কতিপয় নিয়মতান্ত্রিক ও ধারাবাহিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, যার ফলে কোন বিরূপ প্রভাব বা প্রতিক্রিয়া ব্যতিরেকেই দাস প্রথা উচ্ছেদ ও নির্মূল হ’তে বাধ্য।
আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করেছেন এবং জনকল্যাণকর বিধান প্রবর্তন করেছেন। তার জন্য যা ক্ষতিকর তা রহিত করেছেন এবং যা ব্যক্তি, সমাজ, দেশ ও জাতির জন্য কল্যাণকর তা বহাল রেখেছেন। যেমন মদ ও সূদ নিষিদ্ধ করা হয়েছে মানবতার কল্যাণের জন্য। পক্ষান্তরে দাসপ্রথা বহাল রাখায় মানবতার কল্যাণ নিহিত রয়েছে বিধায় তিনি তা হারাম করেননি। যেমন আল্লাহ বলেন, أَلاَ يَعْلَمُ مَنْ خَلَقَ وَهُوَ اللَّطِيْفُ الْخَبِيْرُ ‘যিনি সৃষ্টি করেছেন তিনি কি জানেন না? তিনি সূক্ষ্মদর্শী, সম্যক অবগত’ (মূলক ১৪)।
তাছাড়া রাসূল (ছাঃ)-এর যুগে যদি এ ব্যবস্থা না থাকত মুসলিমরা বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হত। কারণ যুদ্ধাবস্থায় মুসলমান ও কাফিরদের মধ্যে বন্দী বিনিময় হত। এছাড়া ইসলামের শত্রুদেরকে যদি দাস-দাসী না বানানো হ’ত তাহলে এরা আবার সঙ্গবদ্ধ হয়ে ইসলামী রাষ্ট্রের উপর আঘাত হানতে পারত। যার জন্য সাময়িক অথবা অনির্দিষ্টকালের জন্য হ’লেও দাস ব্যবস্থাকে বহাল রাখতে হয়েছিল।
৬. মানবিক কারণ :
ইসলাম মানবতার ধর্ম। মানবতা প্রতিষ্ঠা করাই ইহার বৈশিষ্ট্য। ইসলাম যুদ্ধ ছাড়া অন্য সব ধরনের ক্রীতদাস সৃষ্টির উৎস বন্ধ করে দিয়েছে।[5] এজন্য সকলের জানা যে, যেকোন যুদ্ধ-বিগ্রহে অবশ্যই জয়-পরাজয় রয়েছে। পরাজিত বাহিনীর সবকিছুই বিজয়ী বাহিনীর হয়ে যায়। তখন বাস্তবে দেখা যায় পুরুষের পাশাপাশি নারী, শিশু, বৃদ্ধ, অসুস্থসহ সকল শ্রেণীর মানুষ অসহায় হয়ে পড়ে। ঠিক সে মুহূর্তে ইসলামের নির্দেশ শুধু মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীগণ ব্যতীত বাকী সকল পুরুষ, নারী, শিশু, বৃদ্ধ দাস-দাসীর আওতার বাইরে থাকবে। তবে ইসলামিক রাষ্ট্রে যিযিয়া কর দিয়ে ইসলাম তাদেরকে থাকার অনুমতি দিয়েছে। শুধু তাই নয়, এদেরকে পূর্ণ মানবিক সহযোগিতাও করতে হবে। পক্ষান্তরে বর্তমান বিশ্বে মুসলমান কিংবা ভিন্ন পন্থী সে যেই হৌক না কেন, সেসকল বন্দিদের সাথে যে অমানবিক ও নিষ্ঠুর আচরণ করা হচ্ছে তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। বিশেষ করে ইরাক, ফিলিস্তীন, আফগান, বার্মা ও অন্যান্য দেশের মুক্তিকামী যুদ্ধ বন্দী ও নারী-শিশুদের ওপর ইঙ্গ-মার্কিনী এবং অন্যান্যরা যেভাবে পৈশাচিক অত্যাচার ও নিষ্ঠুর নির্যাতন চালাচ্ছে তা বিশ্বমানবতাকে পদদলিত করার নামান্তর ছাড়া কিছুই নয়।
অপরদিকে দাসত্ব ও দাসপ্রথা উচ্ছেদ করার কথা অনেকে মুখে বললেও বস্ত্ততঃ জিইয়ে রাখতে চায়। আমেরিকা সভ্যতা গড়তে, নতুন ইমারত কলকারখানা তৈরীর জন্য ইতিপূর্বে আফ্রিকা থেকে বহু সংখ্যক দাস আমদানী করেছে। দেশটি উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশ থেকে এখনও শ্রম ও মেধা আকর্ষণের চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমেরিকার স্বাধীনতা (৪ জুলাই ১৭৭৬) সম্পর্কে মতামত বর্ণনা করতে গিয়ে Claude M. lightfood যে মন্তব্য করেন তাতে উপরোক্ত কথাটির প্রমাণ মেলে। তিনি বলেন, Black remained Slaves Until about 80 years later, women did not receive the right to vote until 112 years later and the working class did not get the legal right to organise and collectively burgain until 150 years later. অর্থাৎ ‘এই স্বাধীনতালাভের পরবর্তী ৮০ বছরেও নিগ্রোরা দাসই রয়ে গিয়েছিল। মহিলারা পরবর্তী ১১২ বছর পর্যন্ত ভোটাধিকার পায়নি। শ্রমিকরাও সংগঠিত হওয়া বা জোটবদ্ধভাবে কোন দাবী-দাওয়া উপস্থাপনের কোন আইনগত অধিকার পায়নি পরবর্তী ১৫০ বছর পর্যন্ত’।[6]
কিন্তু ইসলাম কখনও দাস দিয়ে সভ্যতা গড়তে চায়নি এবং চায়না। মুহাম্মাদ (ছাঃ) দাসদের শুধু মুক্তি দিতেই বলেননি, তাদেরকে ভাই হিসাবে গ্রহণ করতেও বলেছেন।[7]
ঠিক এ মুহূর্তে ইসলামী সৈনিকদের কাছে যদি ভিন্ন ধর্মীয় বন্দি দাস-দাসী হিসাবে অবস্থান করত তাহলে তারা কতই না সম্মানের হালতে থাকতে পারত যা কল্পনার বাইরে। এমতাবস্থায় কেউ হয়ত স্ত্রীর মর্যাদায়, কেউ সন্তান হিসাবে, কেউ বা মাতা-পিতা অর্থাৎ যার যেখানে মর্যাদা পাওয়ার কথা সে মর্যাদায়ই সে পেত। এটা রাসূল (ছাঃ)-এর চরম নির্দেশমূলক বাণী। যেমন রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘তোমরা যা খাবে, দাস-দাসীদের তা খেতে দিবে। তোমরা যা পরবে তাদেরকে তা পরতে দিবে। কখনও তাদের সাথে নিষ্ঠুর আচরণ করবে না’।[8] এ বিষয়ে পরবর্তীতে বিস্তারিত আলোচনা আসবে। মোদ্দাকথা সকল দিক বিবেচনা করে ইসলাম দাস প্রথাকে নিষিদ্ধ করেনি বরং এ প্রথাকে উচ্ছেদ করার জন্য বহুমুখী কর্মপন্থা দেখিয়েছেন মহামুক্তির মহান দূত সর্বকালের সকলের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ (ছাঃ)।
৭. বৈশ্বিক কারণ :
আমরা ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি যে, ইসলাম আগমনের প্রাক্কালে দাস প্রথা বিশ্বব্যাপী ব্যাপকভাবে চালু ছিল। মানুষের আর্থ-সামাজিক কর্মকান্ড এর উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল ছিল। এটাকে কেউ ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখতো না এবং একে পরিবর্তনের কল্পনাও করত না।
তাছাড়া বর্তমানে জাতিসংঘ সার্বজনীন মানবাধিকার সনদে কেবল কাগজে-কলমে দাসপ্রথা নিষিদ্ধ, এর বাস্তবায়ন প্রকৃত অর্থে নেই। কারণ এখানে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক বন্দিতব আজও বিদ্যমান। তাছাড়া কালের পরিক্রমায় দাসপ্রথা যে বিশ্বে আবার চালু হবে না এটা কোন মানুষ হলপ করে বলতে পারবে না। পার্থিব পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে এর প্রয়োজন কখনও দেখা দিতেও পারে, যা মানুষের আর্থ-সামাজিক কল্যাণ বয়ে আনবে। আর সেকারণে ইসলাম এ প্রথাকে নিষিদ্ধ করেনি।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, বিংশ শতাব্দীতে দাসত্বের ধরণ পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমানে ব্যক্তি ও গোত্রের দাসত্বের স্থলে পুরা জাতি ও সমগ্র দেশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও কম্যুনিষ্ট নাস্তিকদের দাসত্বের শৃংখলে আবদ্ধ হয়ে পড়ছে। ফলে জাতি যন্ত্রণাদায়ক এক অদৃশ্য আক্রমণের অসহনীয় শিকারে পরিণত হয়। এতে তার নিজস্ব ক্ষমতা রহিত হয়, স্বাধীনতা খর্ব হয়, আর তাদেরকে ঐ শক্তিধররা তাদের অধীনস্ত দাসে পরিণত করে শাসন করে পেশী শক্তির বলে। এতে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর, মুখ খুলে কথা বলার সামর্থ্য তাদের থাকে না। জাতির স্বাতন্ত্র্য বলতেও কিছু অবশিষ্ট থাকে না। কর্মক্ষেত্রে ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে তাদের কোন ভূমিকা থাকে না। ফলে জাতি সম্পূর্ণরূপে সাম্রাজ্যবাদী, নাস্তিক শক্তির করতলগত হয়ে যায়। জাতি লাঞ্ছনা, অপমানে পদানত হয়, মানবিক ইয্যত-সম্মান তিরোহিত হয়, স্বাধীনতা দূরীভূত হয়। মূলতঃ পরাধীনতার শৃংখলে আবদ্ধ হয়ে গোলামী বা দাসত্বের জিঞ্জিরে জড়িয়ে পড়ে। এক কথায় সাম্রাজ্যবাদী নাস্তিক শক্তি আজ ব্যক্তি, পরিবার, বংশ-গোত্রের পরিবর্তে পুরা জাতি ও দেশকে সাহায্য-সহযোগিতা ও সেবার ছদ্মাবরণে আধুনিক দাসত্বের বৃত্তে বন্দী করেছে। যা ইসলাম আদৌ সমর্থন করে না। পক্ষান্তরে ইসলাম উপযুক্ত কারণে দাস-দাসীদেরকে গ্রহণ করেছে এবং মর্যাদা ও নিরাপত্তা দিয়েছে। বিধায় এ প্রথাকে নিষিদ্ধ করা হয়নি।
৮. সংশোধনের সুযোগ : অমুসলিম যুদ্ধ বন্দীদেরকে সংশোধনের জন্য দারুণ সুযোগ করে দিয়েছে ইসলাম। যুদ্ধবন্দী দাস-দাসী যদি তাদের ভুল বুঝতে পেরে মুসলমান হয়ে যায়, তাহ’লে তাদেরকে কর্তৃপক্ষ মুক্ত করে দিবেন। দাস-দাসী থাকা অবস্থায় তাদেরকে মনিবেরা শিক্ষা-দীক্ষা দিয়ে থাকেন, যে কারণে তারা তাদের ভুল বুঝতে পারে। অতঃপর তারা মুসলমানদের আনুগত্য মেনে নেয়।
এছাড়া ইসলাম দাস-দাসীদেরকে গ্রহণ করেছে বটে, কিন্তু মুসলমানদের অধীনে যে মর্যাদা, মুক্তির ব্যবস্থা, সদাচরণ, নিরাপত্তা প্রদান ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার দৃষ্টান্ত দেখিয়ে গেছে সঙ্গত কারণে এই প্রথাকে আর নিষিদ্ধ করার প্রয়োজন পড়েনি এবং পড়বেও না। এ বিষয়ে পরবর্তী কিস্তিতে প্রকাশ পাবে ইনশআল্লাহ।
অতএব উপরোক্ত কারণগুলো ও অন্যান্য দিক বিশ্লেষণ করলেই সহজেই বুঝা যায় যে, ইসলাম কেন দাস প্রথাকে একেবারে নিষিদ্ধ করেনি। মহাজ্ঞানী ও মহাদার্শনিক আল্লাহই এ বিষয়ে সর্বাধিক জ্ঞাত।
পরবর্তীঅংশ পড়ুন: দাসপ্রথা নিষিদ্ধতা প্রসঙ্গ – ৩
মূল লেখা: মানবাধিকার ও ইসলাম
– শামসুল আলম