অধিকার ও মর্যাদা

মানবাধিকার ও ইসলাম : স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা লাভের অধিকার

জীবন, স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা লাভের অধিকার :

জাতিসংঘ সর্বজনীন মানবাধিকার সনদ : Article-3

Everyone has the right to life, liberty and security of person. ‘প্রতিটি মানুষের জীবন, স্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তার অধিকার রয়েছে’ (অনুচ্ছেদ-৩)

অর্থাৎ পৃথিবীতে প্রত্যেক মানুষ তার নিজের জীবনের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা লাভের অধিকারী। অন্যায়ভাবে কেউ কারো ব্যক্তিগত জীবনে হস্তেক্ষেপ করবে না ও হত্যা-নিপীড়ন করবে না। মানুষকে সুষ্ঠুভাবে বেঁচে থাকার জন্য এ অধিকার অত্যন্ত প্রয়োজন, যা মানবাধিকার সনদে স্বীকৃত।

ইসলামের আলোকে বিশ্লেষণ :

ইসলাম কেবল একটি ধর্ম নয়; একে ‘The complete code of life’ বা পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান বলা হয়। এটা শুধু মুসলিমদের জন্য প্রযোজ্য তা নয়; বরং গোটা বিশ্ববাসীর জন্য অবতীর্ণ। ইসলামী জীবন বিধানে মৌলিক একটি নিদের্শনা হ’ল- প্রত্যেক মানুষ জীবন, স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা লাভের অধিকারী। অর্থাৎ কোন মানুষ একে অন্যকে অন্যায়ভাবে হত্যা করবে না, যুলুম-নির্যাতন করবে না এবং স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার অধিকার নষ্ট করবে না। এ ব্যাপারে ইসলামে কঠোর হুঁশিয়ারী আরোপ করা হয়েছে।

ক. জীবনের নিরাপত্তা : পৃথিবীতে মানুষের সুষ্ঠু-সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য ইসলাম দিয়েছে পূর্ণ গ্যারান্টি। এতে মানুষের জান-মালের নিরাপত্তার ব্যাপারে চমৎকার দিক-নির্দেশনা রয়েছে এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বনও করা হয়েছে। কেবল জাতিসংঘ সনদে নয়, অন্য কোন ধর্মেও এতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, مَن قَتَلَ نَفْساً بِغَيْرِ نَفْسٍ أَوْ فَسَادٍ فِي الأَرْضِ فَكَأَنَّمَا قَتَلَ النَّاسَ جَمِيْعاً وَمَنْ أَحْيَاهَا فَكَأَنَّمَا أَحْيَا النَّاسَ جَمِيْعاً- ‘নরহত্যা অথবা পৃথিবীতে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি ব্যতিরেকে কেউ কাউকে হত্যা করলে সে যেন পৃথিবীর সমগ্র মানব গোষ্ঠীকে হত্যা করল। আর কেউ কারও প্রাণ রক্ষা করলে সে যেন পৃথিবীর সমগ্র মানব গোষ্ঠীকে রক্ষা করল’ (মায়েদাহ ৩২)

আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন, وَلاَ تَقْتُلُواْ النَّفْسَ الَّتِي حَرَّمَ اللهُ إِلاَّ بِالحَقِّ- ‘আল্লাহ যে প্রাণ হত্যা নিষিদ্ধ করেছেন যথার্থ কারণ ব্যতিরেকে তাকে হত্যা করো না’ (বনী ইসরাঈল ৩৩)

তিনি আরো বলেন, وَمَنْ يَقْتُلْ مُؤْمِناً مُّتَعَمِّداً فَجَزَآؤُهُ جَهَنَّمُ خَالِداً فِيْهَا وَغَضِبَ اللهُ عَلَيْهِ وَلَعَنَهُ وَأَعَدَّ لَهُ عَذَاباً عَظِيْماً- ‘আর কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে কোন মুমিন ব্যক্তিকে হত্যা করলে তার শাস্তি জাহান্নাম, যেখানে সে স্থায়ী হবে এবং তার প্রতি আল্লাহর গযব ও অভিসম্পাত এবং তিনি তার জন্য মহাশাস্তি প্রস্তুত রাখবেন’ (নিসা ৯৩)

সমাজে দারিদ্র্য, ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষের কারণে মানুষ যেন তাদের সন্তানদের হত্যা না করে, সে সম্পর্কে আল্লাহ কুরআন মাজীদে কঠোরভাবে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। অধুনা বিশ্বে মানুষ জন্ম নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বংশ নিধনের যে কত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,وَلاَ تَقْتُلُواْ أَوْلاَدَكُم مِّنْ إمْلاَقٍ نَّحْنُ نَرْزُقُكُمْ وَإِيَّاهُمْ  ‘দারিদ্রে্যর ভয়ে তোমরা তোমাদের সন্তানদের হত্যা করো না। আমি তাদেরকে ও তোমাদেরকে রিযিক দেব’ (আন‘আম ১৫১)

এতদুদ্দেশ্যে সূরা বনী ইসরাঈলের ৩১, আন‘আমের ১৪০ নং আয়াতেও উল্লেখ করা হয়েছে।

এখন বাংলাদেশের মানুষের নিরাপত্তা কতটুকু তা একটি সমীক্ষা দেখলে বুঝা যাবে। যেমন মহাজোট সরকারের আমলে সাড়ে ৩ বছরে ১৬ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন।[1] চট্টগ্রামে সাড়ে ৫ বছরে ২ হাযার বেওয়ারিশ লাশ দাফন করেছে।[2] গত ৩ বছরে ঢাকায় ৫৫৭৬টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করেছে আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম।[3]

মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী গত ৯ মাসে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী ফোর্স (বিএসএফ) ২৮ জন বাংলাদেশী নাগরিককে হত্যা ও ৭০ জনকে আহত করেছে । এ সময় অপহৃত হন ৫৩জন বাংলাদেশী। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে যে, গত ৯ মাসে কমপক্ষে ৬০ জন বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছে এবং রাজনৈতিক সহিংসতায় ১৩০ জন নিহত এবং ১২ হাজার ২০৬ জন আহত হয়েছে। এসময় আরো ৬৫১ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে।[4] অর্থাৎ উক্ত রিপোর্টগুলো পর্যালোচনা করলেই বুঝা যায় যে, হত্যা, নির্যাতন, খুন-খারাবী যেন হিংস্র জানোয়ারকেও হার মানিয়েছে!

জীবন্ত কন্যা সন্তান হত্যা বন্ধ : ইসলাম পূর্ব জাহেলী যুগে আরবরা তাদের কন্যা সন্তান জন্ম হওয়াকে সামাজিক নীচু ও হীন ন্যক্কারজনক কাজ বলে মনে করত। যার জন্য পিতা-মাতা তাদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও অতি আদরের সন্তানদের জীবন্ত কবর দিতে দ্বিধা করত না। একদিকে পিতা-মাতার বুক ফাঁটা চাপা আর্তনাদ, অপর দিকে ঘৃণ্য বর্বর সামাজিক প্রথায় লোকলজ্জার কারণে স্নেহতুল্য কন্যাদেরকে জীবন্ত কবর দেয়া- এ যেন পৃথিবীর মুক্ত হাওয়াকে ভারী করে তুলেছিল; আর সে বিষাক্ত ও অমানবিক প্রথা বন্ধ করার তখন কেউ ছিল না। এমনি সময় আবির্ভূত হন মানবতার মুক্তির দূত মুহাম্মাদ (ছাঃ)। যার নিকটে আল্লাহ পাক নাযিল করলেন আল-কুরআন। এই কুরআনে ঘোষণা এল- وَإِذَا الْمَوْؤُوْدَةُ سُئِلَتْ- بِأَيِّ ذَنْبٍ قُتِلَتْ- ‘যখন জীবন্ত প্রোথিত কন্যাকে জিজ্ঞেস করা হবে, কি অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছিল’? (তাকবীর ৮১/৮-৯)

নিষিদ্ধ করা হ’ল কন্যা হত্যার জঘন্য প্রথা। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বরং কন্যাদের লালন-পালনের ব্যাপারে আরও উৎসাহ যোগালেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি তিনটি কন্যা সন্তান লালন-পালন করল সে জান্নাতে যাবে। এক ছাহাবীর প্রশ্নের উত্তরে তিনি (ছাঃ) বললেন, দু’টি মেয়েকে লালন-পালন করলেও সে জান্নাতে যাবে’।[5]

অর্থাৎ ইসলাম সকল সামাজিক কুপ্রথাকে পদদলিত করে কন্যাদেরকে সর্বোচ্চ মর্যাদার স্থানে অভিষিক্ত করেছে। কিন্তু সেক্ষেত্রে প্রগতিবাদীদের চক্ষু উম্মীলিত হয় না। অথচ ভারতে তামিলনাডু সরকারী হাসপাতালের রিপোর্ট অনুযায়ী জন্মগ্রহণকারী প্রতি ১০টি কন্যা শিশুর মধ্যে ৪টি শিশুকে মরে যাওয়ার জন্য রেখে দেয়া হয়। ভারতে যখনই কেউ জানে যে মাতৃগর্ভে কন্যা সন্তান রয়েছে, তখনই সে ভ্রূণ হত্যা করে ফেলা হয়। ফলে মেয়ে সংকটও দেখা যাচ্ছে। যেমন জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউ.এন.এফ.পি.ও) তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর প্রায় ১৫ হাযার মানুষ পাচার হচ্ছে। এর বেশীর ভাগ নারী ও শিশু। গত ১০ বছরে পাচার হয়েছে প্রায় ১ লাখ মানুষ। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত পাচার হয়েছে ১০ লাখেরও বেশী। এর মধ্যে ৪ লাখ নারী আটক আছে ভারতের বিভিন্ন পতিতালয়ে এবং ১০ হাযারের বেশী নারী বিক্রি হয়েছে পাকিস্তানের বিভিন্ন পতিতালয়ে।[6] এক হিসাবে দেখা যায়, ভারতে প্রতি বছর ১ মিলিয়নেরও বেশী কন্যা ভ্রূণ গর্ভপাত করানো হচ্ছে। এ ব্যাপারে ভারতে তামিলনাড়ু ও রাজাস্থান প্রদেশসহ বিভিন্ন স্থানে পোষ্টার ও প্রচার পত্রে বলা হচ্ছে ৫০০ রুপী খরচ করুন এবং ৫ লাখ রুপী বাঁচান। অর্থাৎ ৫০০ রুপীর মাধ্যমে আলট্রাসনোগ্রামের মাধ্যমে মাতৃগর্ভের শিশুটি ছেলে না মেয়ে জানার জন্য মূলত এই প্রচার পত্র। শুধু এ দেশ কেন বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশেও এর অনুকরণে কন্যা সন্তানদের বিরুদ্ধে নানাভাবে নীরবে হত্যা-নির্যাতন বাড়ছে যদিও তারা কন্যা তথা নারী অধিকার নামে কোটি কোটি ডলার খরচ করছে।

আত্মহত্যা বন্ধ : ইসলাম মানুষকে কেবল অন্যায়ভাবে অপরকে হত্যা নিষিদ্ধ করেনি। বরং আত্মহত্যাও নিষিদ্ধ করছে। কিন্তু বর্তমানে সামান্য কারণেও মানুষ আত্মহত্যা করছে। যা শুধু বাংলাদেশে নয়- ভারত, চীন, আমেরিকা, বৃটেন, জাপান প্রভৃতি উন্নত দেশেও হচ্ছে। যেমন- ভারতের ‘ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো’ সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী ভারতে দৈনিক ৪৩ জন কৃষক আত্মহত্যা করেছে। ১৯৯৭-২০১০ সাল পর্যন্ত ভারতে ২ লাখ ৩২ হাযার ৪৬৪ জন কৃষক আত্মহত্যা করে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এদিকে ‘ইন্ডিয়া টুডে’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দারিদ্রে্যর কারণে ভারতে প্রতি ৩০ মিনিটে একজন কৃষক আত্মহত্যা করে।[7] বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্র (?) বলে পরিচিত যুক্তরাজ্যে মন্দায় ২০০৮-২০১০ সাল পর্যন্ত আত্মহত্যা করেছে ১ হাযার মানুষ।[8] বাংলাদেশের কেবল ঝিনেদা যেলাতেই গত চার দশকে ৪০ হাযার মানুষ আত্মহত্যা করছে, যা দেশের সকল যেলাকে অতিক্রম করেছে। অবশ্য হত্যার পিছনে দারিদ্র, বেকারত্ব, হতাশা, পারিবারিক ও সামাজিক প্রভৃতি কারণ বিদ্যমান।[9] এটা সম্পূর্ণ অমানবিক ও অপ্রত্যাশিত, যা কুরআনে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, وَلاَ تَقْتُلُواْ أَنفُسَكُمْ ‘তোমরা আত্মহত্যা করো না’ (নিসা ৪/২৯)

এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি শ্বাসরুদ্ধ করে আত্মহত্যা করবে সে জাহান্নামে সর্বক্ষণ শ্বাসরুদ্ধ করে আত্মহত্যা করতে থাকবে। আর যে ব্যক্তি অস্ত্রের আঘাতে আত্মহত্যা করবে সে জাহান্নামে সর্বক্ষণ অস্ত্রের আঘাতে আত্মহত্যা করতে থাকবে’।[10]

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বাংলাদেশে দেখা যায় কোন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় ভাল ফলাফলকরতে না পারলে, খেলায় হেরে গেলে, এমনকি কারো পসন্দের নায়ক-নায়িকা মারা গেলেও আত্মহত্যা করতে দ্বিধা করে না, যা অত্যন্ত গর্হিত ও পাপের কাজ। এ সমস্ত সংস্কৃতি বন্ধ হওয়া অতীব যরূরী।

হত্যা কখন করা যাবে :

মানুষ মানুষকে অকারণে ও বেআইনিভাবে হত্যা করতে পারে না। আইন মোতাবেক তথা উপযুক্ত কারণে ইসলামী রাষ্ট্র কোন অপরাধীকে হত্যা করতে পারে। কোন ব্যক্তি আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে কোনরূপ হত্যাকান্ড ঘটাতে পারবে না।

ইসলামী আইনের চূড়ান্ত বিচারে মানুষকে হত্যা করা যায়, এমন ছয়টি ক্ষেত্র রয়েছে।-

১. অকারণে হত্যাকারীকে কিছাছের দন্ড হিসাবে হত্যা করা।

২. দ্বীন ইসলামের পথে বাঁধা সৃষ্টিকারীদের সাথে যুদ্ধ করা ও সে যুদ্ধে হত্যা করা।

৩. ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী ও তা উৎখাতের চেষ্টাকারীকে হত্যা করা।

৪. বিবাহিত পুরুষ-নারী যেনা করলে দন্ড স্বরূপ হত্যা করা।

৫. মুরতাদ তথা ইসলাম ত্যাগকারীকে দন্ড স্বরূপ হত্যা করা।

৬. ডাকাতির কারণে অথবা নিজের জানমাল ও ইযযত রক্ষার ক্ষেত্রে কাউকে হত্যা করা যায়।

ইসলামে কেবল উপরোক্ত ছয়টি অবস্থায় মানুষের জীবন ও প্রাণের সম্মান নিঃশেষ হয়ে যায়, বিধায় তাকে হত্যা করা যরূরী হয়ে পড়ে। তবে ব্যক্তিগত হত্যার ক্ষেত্রে নিজে কখনও আগেভাগে উদ্বুদ্ধ হবে না এবং সে হত্যায় মানুষের মানবিক মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করা চলবে না।

মানব হত্যার সূচনা : মানব ইতিহাসে হত্যার সূচনা হয় আদম (আঃ)-এর পুত্র কাবীল কর্তৃক হাবীলকে হত্যার মধ্য দিয়ে। এ হত্যা সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে এসেছে, لَئِنْ بَسَطتَ إِلَيَّ يَدَكَ لِتَقْتُلَنِيْ مَا أَنَاْ بِبَاسِطٍ يَدِيَ إِلَيْكَ لَأَقْتُلَكَ إِنِّيْ أَخَافُ اللهَ رَبَّ الْعَالَمِيْنَ- ‘তুমি যদি তোমার হাত আমার দিকে প্রসারিত কর আমাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে, আমি কিন্তু আমার হাত তোমার দিকে তোমাকে হত্যা করার জন্য প্রসারিত করব না। কেননা আমি বিশ্বপ্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করি’ (মায়েদাহ ২৮)। এ সম্পর্কে হাদীছে এসেছে পৃথিবীতে সংঘটিত সকল হত্যার একটি অংশ কাবীল পাবে।[11]

হত্যা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর হুঁশিয়ারী :

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বিনা কারণে মানুষ হত্যাকে কবীরা গুনাহ বলেছেন। তিনি মারামারি ও সশস্ত্র ঝগড়া বিবাদ থেকে দূরে থাকতে বলেছেন। কেননা তাতে অকারণ ও অনিচ্ছা সত্ত্বেও মানবহত্যা সংঘটিত হয়ে যেতে পারে, যা কোনক্রমেই কাম্য নয়। এ সম্পর্কে নবী করীম (ছাঃ) বলেন, দুই জন মুসলমান তরবারি (মারণাস্ত্র) সহ পরস্পরের মুখোমুখী হয়ে পড়লে (একজন নিহত হ’লে), হত্যাকারী ও নিহত উভয় ব্যক্তিই জাহান্নামী হবে। নিহত ব্যক্তির জাহান্নামী হওয়ার কারণ কি? জিজ্ঞেস করা হ’লে রাসূলে করীম (ছাঃ) বললেন, ‘কেননা সেও তো প্রতিপক্ষকে হত্যা করতে উদ্যোগী ছিল। অন্য জনের নিহত হওয়া তো হঠাৎ ঘটে যাওয়া ব্যাপার। তার পরিবর্তে তারই হাতে সেও নিহত হ’তে পারত’।[12]

মিকদাদ ইবনে আমর (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, হে রাসূল! আমি যদি একজন অমুসলিম কাফির ব্যক্তির সম্মুখীন হই, আর সে তার তরবারির আঘাতে আমার একটি হাত কেটে ফেলে। পরে সে একটি বৃক্ষের আশ্রয়ে বলতে থাকে, ‘আমি ইসলাম কবুল করেছি, আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ করেছি- এই কথা বলার পর আমি কি তাকে হত্যা করব? রাসূল (ছাঃ) বললেন, না, তুমি তাকে হত্যা করবে না। রাবী বললেন, হে রাসূল (ছাঃ)! সে আমার একটি হাত কেটে ফেলে ঐ কথা বলেছে। তবুও কি আমি তাকে হত্যা করব না? রাসূল (ছাঃ) বললেন, না, তুমি তাকে হত্যা করবে না। তুমি যদি তাকে হত্যা কর, তাহ’লে তাকে হত্যা করার পূর্বে তুমি যে অবস্থায় ছিলে, হত্যার পর সেই অবস্থায় ফিরে যাবে। আর সে যা বলছে, তা বলার পূর্বে সে যে অবস্থায় ছিল, তুমি সে অবস্থায় পৌঁছে যাবে’।[13] অর্থাৎ তুমি তাকে হত্যা করলে হত্যা করার পূর্বে মুসলিম হিসাবে তোমার যে মর্যাদা ছিল, সে সেই মর্যাদা লাভ করবে। আর ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেওয়ার আগে তার যে স্তর ছিল, তুমি সেই স্তরে পৌঁছে যাবে। অর্থাৎ মুসলিমকে হত্যার কারণে তোমাকে কিছাছের দন্ড হিসাবে হত্যা করা ওয়াজিব হবে।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তার উম্মতকে সর্বপ্রকার নিপীড়ন, কষ্টদান ও হত্যা থেকে রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় উপদেশ ও নছীহত করেছেন। একটি হাদীছে তিনি বলেছেন, ‘হে লোক! আমাদের উপর যে অস্ত্র নিক্ষেপ করবে বা সশস্ত্র আক্রমণ চালাবে, সে আমার উম্মতের মধ্যে গণ্য হবে না’।[14]

তিনি আরও বলেন, ‘যে লোক তীর, বর্শা-বল্লম (মারণাস্ত্র) নিয়ে আমাদের মসজিদ কিংবা আমাদের হাটে-বাজারে যাতায়াত করবে সে যেন তার অগ্রভাগ সামলিয়ে রাখে, অথবা বলেছেন সে যেন তার দস্তানা (তলোয়ার) ধরে থাকে। যাতে তা থেকে কোন মুসলিমের গায়ে একবিন্দু আঘাত না লাগে’।[15]

খ. জীবনের মর্যাদা

মানুষের জীবনের মর্যাদা সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) বিদায় হজ্জের ভাষণে দৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেন, হে লোক সকল! তোমাদের জান-মাল, ইয্যত আব্রুর উপর হস্তক্ষেপ তোমাদের জন্য হারাম করা হ’ল। তোমাদের আজকের এই পবিত্র দিন, এই পবিত্র (যিলহজ্জ) মাস, এই শহর (মক্কা) যেমন পবিত্র ও সম্মানিত অনুরূপভাবে উপরোক্ত জিনিসগুলোও সম্মানিত ও পবিত্র। সাবধান আমার পরে তোমরা পরস্পরের হন্তা হয়ে কাফেরদের দলভুক্ত হয়ে যেও না’।[16]

অতঃপর তাঁর (ছাঃ) এই নছীহত কার্যকর করতে গিয়ে সর্বপ্রথম দৃষ্টান্ত স্থাপন করে বলেন, জাহিলী যুগের যাবতীয় হত্যা রহিত হ’ল। প্রথম যে হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ আমি রহিত করলাম তা হচ্ছে আমার বংশের রবী‘আ ইবনুল হারিছের দুগ্ধপোষ্য শিশু হত্যার প্রতিশোধ। যাকে হুযাইল গোত্রের লোকেরা হত্যা করেছিল। অদ্য আমি তা ক্ষমা করে দিলাম’।[17] মহানবী (ছাঃ) আরো বলেন, ‘কোন মুসলিম ব্যক্তির নিহত হওয়া অপেক্ষা সমগ্র পৃথিবীর ধ্বংস হওয়া আল্লাহর দৃষ্টিতে অতি তুচ্ছ ব্যাপার’।[18]

যুদ্ধবন্ধী অমুসলিমকে হত্যার বিধি-বিধান :

ইসলাম শুধু মুসলমানদের জন্য যেমন প্রেরিত হয়নি, তেমনি হত্যার বিধানও কেবল মুসলমানদের জন্য প্রযোজ্য নয়। এ বিধান ধর্ম-বর্ণ, গোত্র, শিশু-নারী যিম্মী বা বন্দীদের প্রভৃতি ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য।

যেমন- রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোন যিম্মীকে হত্যা করবে আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিবেন’।[19] তিনি আরো বলেন, ‘যে ব্যক্তি চুক্তিবদ্ধ কোন অমুসলমানকে হত্যা করল সে কখনো জান্নাতের সুগন্ধিও পাবে না’।[20]

একবার কোন এক যুদ্ধে মুশরিকদের এক শিশু নিহত হ’লে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জানতে পেরে অত্যন্ত মর্মাহত হ’লেন; তিনি (ছাঃ) বললেন, মুশরিক শিশুরাও তোমাদের চাইতে উত্তম। সাবধান! শিশুদের হত্যা করো না। প্রতিটি জীবন আল্লাহ নির্ধারিত ফিতরাত (সৎ স্বভাব নিয়ে) জন্মগ্রহণ করে থাকে।[21]

আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ)-এর যুগে এক ব্যক্তির মৃতদেহ পাওয়া গেল, কিন্তু হত্যাকারীর সন্ধান পাওয়া গেল না। মহানবী (ছাঃ) চরম অসন্তুষ্ট অবস্থায় ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন; ‘হে লোক সকল! ব্যাপার কি, আমি তোমাদের মাঝে বর্তমান থাকতে মানুষ নিহত হচ্ছে এবং তার হত্যকারীর পরিচয় মিলছে না? একজন মানুষ হত্যা করার জন্য আসমান-যমীনের সমগ্র সৃষ্টিও যদি একত্রে হয়ে যায়, তবুও আল্লাহ এদের সকলকে শাস্তি না দিয়ে ছাড়বেন না’।[22]

কোন এক যুদ্ধে এক নারী নিহত হয়। মহানবী (ছাঃ) তাঁর লাশ দেখে বলেন, আহ! এ কি কাজ করলে? সেতো যোদ্ধাদের মধ্যে শামিল ছিল না। যাও সেনাপতি খালিদকে বলে দাও যে, নারী, শিশু ও দুবর্লদের হত্যা করো না। তাহ’লে এখানে স্পষ্ট যে, ইসলাম যুদ্ধবন্দি ও অমুসলিমদেরকেও কত নিরাপত্তা ও মর্যাদা দিয়েছে।[23]

মক্কা বিজয়ের সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর প্রতিশোধ না নেয়া :

৬৩০ সালে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মক্কা বিজয়ের সময় কাফির-কুরায়েশদের উপর কোন রূপ প্রতিশোধ নেননি। মক্কাতে এমনকি মদীনায় হিজরতের পরও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উপর কুরায়েশ ও কাফিররা লোমহর্ষক নির্যাতন-নিপীড়ন, চালিয়েছিল। তারা তাঁকে (ছাঃ) হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল, ছাহাবীদের ওপর অত্যাচারের স্টীম রোলার চালিয়েছিল ও কোন কোন ছাহাবীকে হত্যা করেছিল, যা ইতিহাসের পাতায় নির্মমতার নযীর হিসাবে ভাস্বর হয়ে রয়েছে। মক্কা বিজয় করলেন রাসূল (ছাঃ)। তিনি তাদের উপর কোনরূপ প্রতিশোধ না নেয়ার অঙ্গীকার করলেন। অতঃপর তিনি (ছাঃ) সেনাবাহিনীর উদ্দেশ্যে নিম্নোক্ত ফরমান জারী করেন :

১. যারা অস্ত্র সমর্পণ করবে তাদের হত্যা করবে না।

২. যে ব্যক্তি কা‘বা ঘরের অভ্যন্তরে আশ্রয় নেবে তাকে হত্যা করবে না।

৩. যে ব্যক্তি আবু সুফিয়ানের বাড়ীতে আশ্রয় নেবে তাকে হত্যা করবে না।

৪. যে ব্যক্তি নিজের বাড়ীতে বসে থাকবে তাকে হত্যা করবে না।

৫. যে হাকীম ইবনে হিযামের বাড়ীতে আশ্রয় নেবে তাকে হত্যা করবে না।

৬. পলায়নকারীদের পিছু ধাওয়া করবে না।

৭. আহত ব্যক্তিদের হত্যা করবে না।

রাসূল (ছাঃ) বিশ্ব দাবারে মানুষের জীবনের স্বাধীনতা ও ক্ষমা প্রদর্শনের এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। যেমন-

গ. জীবনের স্বাধীনতা ও ক্ষমা : মক্কা বিজয়ের পরে কা‘বার প্রাঙ্গনে সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, হে কুরায়েশগণ! আমি তোমাদের সাথে কিরূপ আচরণ করব বলে তোমরা আশা কর’? সবাই বলে উঠল, ‘উত্তম আচরণ। আপনি দয়ালু ভাই ও দয়ালু ভাইয়ের পুত্র’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ‘শোন! আমি তোমাদের সেকথাই বলছি, যেকথা ইউসুফ তার ভাইদের বলেছিলেন, ‘তোমাদের প্রতি আজ আর কোন অভিযোগ নেই’ (ইউসুফ ১২/৯২)। যাও তোমরা সবাই মুক্ত-স্বাধীন’।[24] এভাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মক্কার সকল শত্রুকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন।

আধুনিক বিশ্বের কোথাও কোথাও এরূপ ঘোষণার ধারা অব্যাহত রয়েছে। গত ১০ অক্টোবর ’১২ এর পত্রিকায় দেখা গেল যে, মিশরের প্রেসিডেন্ট ডঃ মুরসি ও যুদ্ধ শত্রুদেরকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছেন। কিন্তু বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম। আমরা দেখতে পাই ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে পাকবাহিনীর সমর্থনকারীদেরকে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন। এতে সকলে মিলে দেশ গঠনে মুখ্য ভূমিকা রেখেছিল। কিন্তু বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার দীর্ঘ প্রায় ৪০ বছর পর পিতার সেই আইনকে বাতিল করে যুদ্ধপরাধীদের বিচার শুরু করল। প্রশ্ন হ’ল এতে দেশ কতটুকু উপকৃত হবে? এতে বরং জাতিগত দ্বন্দ্ব বাড়তে থাকবে। এক্ষেত্রে রাসূল (ছাঃ) কর্তৃক কুরায়েশদের ক্ষমা প্রদর্শনের ঘটনা থেকে আমাদের শিক্ষা নেয়া উচিৎ।

জীবনের নিরাপত্তা প্রসঙ্গে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে- কখন থেকে এর প্রয়োগ হবে? পৃথিবীর সাধারণ আইনে শিশু ভূমিষ্ট হওয়ার পর থেকে জীবনের নিরাপত্তার অধিকার কার্যকর হয়। কিন্তু আল্লাহর আইনে মাতৃ উদরে গর্ভ সঞ্চার হওয়ার পর থেকেই প্রাণের মর্যাদার স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। এই কারণে মহানবী (ছাঃ) গামিদ গোত্রের এক নারীকে ব্যভিচারের সুস্পষ্ট স্বীকারোক্তি সত্ত্বেও হত্যার নির্দেশ দেননি। কেননা সে তার জবানবন্দীতে নিজেকে গর্ভবতী বলে উল্লেখ করে। অতঃপর সন্তান প্রসব ও দুগ্ধপানের সময়সীমা অতিক্রান্ত হওয়ার পর তাকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছিল।[25] তাৎক্ষণিকভাবে মৃত্যু কার্যকর করলে অন্যায়ভাবে মাতৃগর্ভের সন্তানের প্রাণ নাশের আশংকা ছিল। সেজন্য মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়নি।

আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, ادْرَءُوا الْجَلْدَ وَالْقَتْلَ عَنِ الْمُسْلِمِينَ مَا اسْتَطَعْتُمْ ‘যতদূর সম্ভব মুসলমান (নাগরিক)-কে বেত্রাঘাত ও মৃত্যুদন্ড থেকে অব্যাহতি দাও’।[26]

এখানে বুঝা যায় যে, মানুষ হিসাবে ভুল বা অন্যায় করতে পারে কিন্তু ইসলাম তা থেকে মুক্তি, নিরাপত্তা ও মর্যাদা পাওয়ার পথও খুলে রেখেছে। এরকম ঘটনা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জীবনে বহু উপস্থাপিত হয়েছে। যেমন- মায়েয ইবনু মালিকের ঘটনা। একবার তিনি ব্যাভিচারে লিপ্ত হয়ে যাওয়ার পর স্বয়ং মহানবী (ছাঃ)-এর খিদমতে হাযির হয়ে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে পবিত্র করুন’। তিনি বললেন, ‘ধিক তোমাকে! তুমি চলে যাও। আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও এবং তওবা কর’। বর্ণনাকারী বলেন, তিনি চলে গেলেন এবং সামান্য একটু দূরে গিয়ে পুনরায় ফিরে আসলেন এবং আবারও বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে পবিত্র করুন’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এবারও তাকে পূর্বের ন্যায় বললেন। এভাবে তিনি যখন চতুর্থ বার এসে বললেন, তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমি তোমাকে কোন্ জিনিস হ’তে পবিত্র করব’? তিনি বললেন, ‘যেনা হ’তে’। তার কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) (ছাহাবীগণকে) জিজ্ঞেস করলেন, ‘এ লোকটি কি পাগল’? লোকেরা বলল, ‘না, সে পাগল নয়’। তিনি আবার বললেন, ‘লোকটি কি মদ পান করেছে’? তৎক্ষণাৎ এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে তার মুখ শুঁকে তার মুখ হ’তে মদের কোন গন্ধ পেল না।

অতঃপর তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কি সত্যিই যেনা করেছ’? সে বলল, ‘হ্যাঁ’। এরপর তিনি রজমের নির্দেশ দিলেন, তখন তাকে রজম করা হ’ল। এ ঘটনার দু’তিন দিন পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) (ছাহাবীগণের নিকট) এসে বললেন, ‘তোমরা মায়েয বিন মালিকের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর। বর্ণনাকারী বলেন, তখন ছাহাবীগণ বললেন, আল্লাহ মায়েয বিন মালিককে ক্ষমা করুন। এরপর রাসূল (ছাঃ) বললেন, ‘সে এমন তওবা করেছে, যদি তা সমস্ত উম্মতের মধ্যে বিতরণ করে দেওয়া হয়, তবে তা সকলের জন্য যথেষ্ট হবে’।

এরপর আযদ বংশের গামেদী গোত্রীয় এক মহিলা এসে বলল, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে পবিত্র করুন’। তিনি বললেন, ‘ধিক তোমাকে! তুমি চলে যাও। আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও এবং তওবা কর’। তখন মহিলাটি বলল, ‘আপনি মায়েয বিন মালিককে যেভাবে ফিরিয়ে দিয়েছেন, আমাকেও কি সেভাবে ফিরিয়ে দিতে চান? আমার গর্ভের এই সন্তান যেনার’। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কি (সত্যই অন্তঃসত্তা)? মহিলাটি বলল, হ্যাঁ। তখন তিনি বললেন, ‘যাও, তোমার পেটের বাচ্চা প্রসব হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা কর’। বর্ণনাকারী বলেন, ‘আনছারী এক লোক মহিলাটির সন্তান হওয়া পর্যন্ত তাকে নিজের তত্ত্বাবধানে নিয়ে গেলেন। সন্তান প্রসব হওয়ার পর ঐ লোকটি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর খেদমতে এসে বলল, গামেদী মহিলাটি সন্তান প্রসব করেছে। এবার তিনি (ছাঃ) বললেন, ‘এ শিশু বাচ্চাটিকে রেখে আমরা মহিলাটিকে রজম (পাথর মেরে হত্যা) করতে পারি না’। কারণ তাকে দুধ পান করানোর মতো কেউ নেই। এ সময়  জনৈক আনছারী দাঁড়িয়ে বলল, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমি তার দুধ খাওয়ানোর ব্যবস্থা করব’। রাবী বলেন, তখন তিনি তাকে রজম করলেন।

অন্য এক বর্ণনায় আছে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মহিলাটিকে বললেন, ‘তুমি চলে যাও এবং সন্তান প্রসব হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা কর’। অতঃপর সন্তান প্রসবের পর যখন সে আসল, তখন তিনি বললেন, ‘আবার চলে যাও এবং তাকে দুধ পান করাও এবং দুধ ছাড়ানো পর্যন্ত অপেক্ষা কর’। পরে যখন বাচ্চাটির দুধ খাওয়া বন্ধ হয়, তখন মহিলাটি বাচ্চার হাতে এক খন্ড রুটির টুকরা দিয়ে তাকে সাথে নিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর খেদমতে হাযির হ’ল। এবার মহিলাটি এসে বলল, ‘হে আল্লাহর নবী! এই দেখুন আমি তাকে দুধ ছাড়িয়েছি, এমনকি সে নিজে হাতে খানাও খেতে পারে’। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বাচ্চাটিকে একজন মুসলমানের হাতে তুলে দিলেন। পরে মহিলাটির জন্য গর্ত খোঁড়ার নির্দেশ দিলেন। তার জন্য বক্ষ পর্যন্ত গর্ত খনন করা হ’ল। এরপর জনগণকে নির্দেশ দিলেন, তারা মহিলাটিকে রজম করল।

খালিদ বিন ওয়ালীদ (রাঃ) সম্মুখে অগ্রসর হয়ে তার মাথায় এক খন্ড পাথর নিক্ষেপ করলে রক্ত ছিটে এসে তার মুখমন্ডলের উপর পড়ল। তখন তিনি মহিলাটিকে গাল-মন্দ করলেন। তা শুনে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন ‘থাম হে খালেদ! যার হাতে আমার জীবন তার কসম করে বলছি, এই মহিলা এমন তওবা করেছে, যদি রাজস্ব আদায়ে কারচুপিকারী ব্যক্তিও এমন তওবা করত, তাহ’লে তাকেও ক্ষমা করা হ’ত’। অতঃপর তিনি ঐ মহিলার জানাযার ছালাত আদায়ের আদেশ দিলেন এবং নিজে তার জানাযা পড়লেন। অতঃপর তাকে দাফন করা হ’ল।

অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তার জানাযা পড়লে ওমর (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর নবী (ছাঃ)! আপনি তার জানাযা পড়লেন, অথচ সে যেনা করেছে? জবাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ‘এ মহিলা এমন তওবা করেছে যে, তা সত্তর জন মদীনাবাসীর মধ্যে বণ্টন করে দিলেও যথেষ্ট হয়ে যেত। তুমি কি এর চাইতে উত্তম কোন তওবা পাবে, যে ব্যক্তি স্রেফ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছে?’।[27]

এ হাদীছ দু’টিতে কয়েকটি দিক ফুটে উঠেছে-

ক. মানুষের মর্যাদা প্রদান ও জীবনের নিরাপত্তার সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে।

খ. প্রত্যেক মুমিন-মুসলিমের দোষ-ত্রুটি যতদূর সম্ভব গোপন রাখতে হবে। কারো কোন ইয্যাত-আব্রু নিয়ে বাড়াবাড়ি কিংবা টানা-হেঁচড়া করা যাবে না।

গ. বড় গুনাহের কারণে মানুষ আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করতে পারেন। আর এজন্য কোন পাপীকে ঘৃণা করা বা দূরে ছুড়ে ফেলা উচিত নয়।

ঘ. বসবাসের স্বাধীনতা ও  নিরাপত্তা :

ইসলাম বিনা অনুমতিতে কারো গৃহে প্রবেশ করা নিষিদ্ধ করেছে। কারণ সকলে যেন তার নিজ নিজ গৃহে স্বাচ্ছন্দ্যে ও নিরাপত্তার সাথে বসবাস করতে পারে। এ সম্পর্কে আল্লাহ পাক বলেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا لاَ تَدْخُلُوْا بُيُوْتاً غَيْرَ بُيُوْتِكُمْ حَتَّى تَسْتَأْنِسُوْا وَتُسَلِّمُوْا عَلَى أَهْلِهَا ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُوْنَ- فَإِن لَّمْ تَجِدُوْا فِيْهَا أَحَداً فَلاَ تَدْخُلُوهَا حَتَّى يُؤْذَنَ لَكُمْ وَإِن قِيْلَ لَكُمُ ارْجِعُوْا فَارْجِعُوْا هُوَ أَزْكَى لَكُمْ وَاللهُ بِمَا تَعْمَلُوْنَ عَلِيْمٌ-

‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদের বাড়ী ব্যতীত অন্যের বাড়ীতে মালিকের অনুমতি না নিয়ে এবং তাদের সালাম না দিয়ে প্রবেশ কর না। এটাই তোমাদের জন্য কল্যাণকর ব্যবস্থা। হয়ত তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে। যদি তোমরা বাড়ীতে কাউকে না পাও তাহ’লে তাতে প্রবেশ করবে না; যতক্ষণ না তোমাদেরকে অনুমতি দেয়া হয়। যদি তোমাদেরকে বলা হয়, ফিরে যাও, তবে তোমরা ফিরে যাবে। এটাই তোমাদের জন্য উত্তম। আর তোমাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে আল্লাহ সবিশেষ অবহিত’ (নূর ২৭-২৮)

এ আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, কারো বাড়ীতে প্রবেশের পূর্বে অনুমতি নিতে হবে। আর প্রয়োজন শেষে খোশ-গল্পের জন্য বসে না থেকে বিদায় নিতে হবে। কিন্তু আধুনিক সমাজে এমনকি মুসলিম সমাজেও কোন মেহমান বা আত্মীয়-স্বজন বাড়ীতে প্রবেশকালে বিনা প্রয়োজনে অযথা সময় নষ্ট করে গল্প-গুজব, হাসি-ঠাট্টায় লিপ্ত হয়, যা ইসলাম সমর্থন করে না। যেমন- আল্লাহ বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوا لاَ تَدْخُلُوْا بُيُوْتَ النَّبِيِّ إِلاَّ أَن يُؤْذَنَ لَكُمْ إِلَى طَعَامٍ غَيْرَ نَاظِرِيْنَ إِنَاهُ وَلَكِنْ إِذَا دُعِيتُمْ فَادْخُلُوْا فَإِذَا طَعِمْتُمْ فَانتَشِرُوْا وَلاَ مُسْتَأْنِسِيْنَ لِحَدِيْثٍ ً ‘হে মুমিনগণ! তোমাদেরকে অনুমতি দেয়া না হ’লে তোমরা আহার্য প্রস্ত্ততির জন্য অপেক্ষা না করে ভোজনের জন্য নবী-গৃহে প্রবেশ কর না। তবে তোমাদেরকে আহবান করলে তোমরা প্রবেশ কর এবং ভোজন শেষে তোমরা চলে যাও; তোমরা কথাবার্তায় মশগূল হয়ে পড় না’ (আহযাব ৫৩)

তবে প্রয়োজন অনুযায়ী গৃহে বা পাশে অবস্থান করা যাবে এবং লেন-দেনও করা যাবে। যেমন- কুরআনে বর্ণিত হয়েছে ‘নবী সহধর্মিনীদের নিকট থেকে কোন বস্ত্ত গ্রহণ করলে পর্দার আড়াল থেকে চেয়ে নাও’ (আহযাব ৫৩)

একইভাবে কারো গৃহে উঁকি-ঝুকি মারা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। যেমন- নবী করীম (ছাঃ) বলেন, ‘কেউ কারো ঘরের অভ্যন্তরে উঁকি মেরে তাকালে তার চক্ষু ক্ষত-বিক্ষত করে দাও। এতে কোন অপরাধ নেই।[28] সুতরাং সকলের উচিত এ বিষয়গুলোর প্রতি কঠোর দৃষ্টি রাখা। এছাড়া প্রতিবেশীদের পরস্পরকে সম্মান ও পূর্ণ নিরাপত্তা দিয়ে বসবাসের জন্য বলা হয়েছে। কোন গান-বাজনা, অপসংস্কৃতির তোড়-জোড় এবং কোনরূপ শত্রুতামূলক আচরণ করা যাবে না। এটা ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

হত্যাকারীর তওবা :

আল্লাহ পাক দুনিয়াতে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা ও মর্যাদা দিয়েছেন। আবার কোন পাপী ও হত্যাকারী যদি তার কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়ে তওবা করে তাহ’লে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন। যেমন- হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, বনী ইসরাঈলের জনৈক ব্যক্তি নিরানববই জন মানুষকে হত্যা করে দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ আলেমের সন্ধান করল। অতঃপর তাকে একজন খৃষ্টান পাদ্রীর কথা বলা হ’লে সে তার নিকট এসে বলল যে, সে নিরানববইজন ব্যক্তিকে হত্যা করেছে। এমতাবস্থায় তার জন্য তওবার কোন সুযোগ আছে কি? পাদ্রী বলল, নেই। ফলে লোকটি পাদ্রীকেও হত্যা করল। এভাবে তাকে হত্যা করে সে একশত সংখ্যা পূর্ণ করল। অতঃপর পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আলেমের সন্ধান করায় তাকে একজন আলেমের কথা বলা হ’ল। সে তাঁর নিকট গিয়ে বলল যে, সে একশ’ জনকে হত্যা করেছে, এখন তার জন্য তওবার কোন সুযোগ আছে কি? আলেম বললেন, হ্যাঁ, আছে। তার ও তার তওবার মাঝে কিসে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করল? তুমি অমুক জায়গায় চলে যাও। সেখানে কিছু লোক আল্লাহর ইবাদত করছে। তুমিও তাদের সাথে ইবাদত কর। আর তোমার দেশে ফিরে যাবে না। কেননা ওটা খারাপ জায়গা। লোকটি নির্দেশিত জায়গার দিকে চলতে থাকল।

অর্ধেক পথ অতিক্রম করলে তার মৃত্যুর সময় উপস্থিত হ’ল। সে তার বক্ষদেশ দ্বারা সে স্থানটির দিকে ঘুরে গেল। মৃত্যুর পর রহমতের ও আযাবের ফেরেশতামন্ডলীর মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিল। রহমতের ফেরেশতা বলল, এ লোকটি নিখাদ তওবার মাধ্যমে আল্লাহর দিকে ফিরে এসেছে। পক্ষান্তরে আযাবের ফেরেশতা বলল, লোকটিতো কখনও কোন ভাল কাজ করেনি। এমন সময় অন্য এক ফেরেশতা মানুষের রূপ ধারণ করে তাদের নিকট আগমন করলেন। তখন তারা তাকেই এ বিষয়ের শালিস নিযুক্ত করল। তিনি বললেন, ‘তোমরা উভয় দিকের জায়গার দূরত্ব মেপে দেখ। যে দিকটি নিকটবর্তী হবে, সে দিকেরই সে অন্তর্ভুক্ত হবে’। আল্লাহ তা‘আলা সামনের ভূমিকে আদেশ করলেন, তুমি মৃত ব্যক্তির নিকটবর্তী হয়ে যাও এবং পিছনে ফেলে আসা স্থানকে আদেশ দিলেন, তুমি দূরে সরে যাও। অতঃপর জায়গা পরিমাপের পর যেদিকের উদ্দেশ্যে সে যাত্রা করেছিল, তারা তাকে সেদিকেরই এক বিঘত পরিমাণ নিকটবর্তী পেল। ফলে তাকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করা হ’ল এবং রহমতের ফেরেশতা তার জান কবয করল’।[29]

আল্লাহ যে, অশেষ দয়ালু ও অতিশয় ক্ষমাশীল এ সম্পর্কে তিনি বলেন, قُلْ يَا عِبَادِيَ الَّذِيْنَ أَسْرَفُوْا عَلَى أَنْفُسِهِمْ لاَ تَقْنَطُوْا مِنْ رَّحْمَةِ اللهِ إِنَّ اللهَ يَغْفِرُ الذُّنُوْبَ جَمِيْعاً إِنَّهُ هُوَ الْغَفُوْرُ الرَّحِيْمُ- ‘বল, হে আমার সেসব বান্দা! যারা নিজেদের উপর বাড়াবাড়ি ও সীমালংঘন আচরণ করেছ, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হবে না। আল্লাহ নিশ্চয়ই সমস্ত গুনাহ মাফ করে দিবেন। কেননা তিনিই অতিশয় ক্ষমাশীল ও অশেষ দয়াবান’ (যুমার ৫৩)

পর্যালোচনা :

জাতিসংঘ মানবাধিকার সনদের ৩নং ধারাতে মানুষের জীবন স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা বিধানের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। পৃথিবীতে মানুষের সুষ্ঠু-সুন্দর জীবন পরিচালনার জন্য এই বিধানটিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয়তার দিকটি তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু উপরোক্ত আলোচনায় ইসলামের আলোকে এই ধারার বিস্তারিত ব্যাখ্যা অত্যন্ত চমৎকারভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। এখানে কুরআন ও হাদীছের তথ্য ভিত্তিক বিশ্লেষণ যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে সেভাবে জাতিসংঘ সনদে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি। যেমন- কুরআনে বর্ণিত হয়েছে কোন মানুষ অন্য কোন মানুষকে যদি অন্যায়ভাবে হত্যা করে তবে সে তো জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবেই। উপরন্তু বলা হয়েছে, সে যেন পৃথিবীর সকল মানুষকে হত্যা করল। যা জাতিসংঘের ধারাতে এতটা গুরুত্ব দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়নি। ইসলাম ছয় প্রকারের ব্যক্তি ছাড়া সকল প্রকারের হত্যাকে নিষিদ্ধ করেছে। পক্ষান্তরে মানবাধিকার রক্ষার নামে পরাশক্তিগুলো বিশেষ করে ইঙ্গ-মার্কিনরা বিশ্বব্যাপী মানুষ হত্যা ও নির্যাতনের জন্য জাতিসংঘের সার্টিফিকেট নিয়ে মাঠে নেমেছে। ইরাক, আফগানিস্তান, ফিলিস্তীন, পাকিস্তান, কাশ্মীর, বার্মা, আসাম প্রভৃতি দেশে মুসলমানদের উপর হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। কখনও মৌলবাদী, কখনও সন্ত্রাসী, কখনও বা তথাকথিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, কখনও মানবাধিকার রক্ষা(?) প্রভৃতি নামে তারা নির্যাতন ও গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। আর একাজে নিয়োজিত রয়েছে আমেরিকার (প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের) পেন্টাগনের তত্ত্বাবধানে ২৬টি সন্ত্রাসী গোয়েন্দা বাহিনী। এ বাহিনী কোন দেশের প্রেসিডেন্ট হোক বা মন্ত্রী হোক অথবা রাজনৈতিক বা ধর্মীয় ব্যক্তি হৌন না কেন তাদের মত ও স্বার্থ বিরোধী হ’লে তাদেরকে হত্যা অথবা অপসারণ অথবা জেল-যুলুমের শিকারে পরিণত হ’তে হয়। বর্তমান প্রজন্মে ইরাকের সাদ্দাম হোসেনের পতন এর অন্যতম উদহারণ। একইভাবে ভারত শাসিত কাশ্মীরে, আসামে মুসলিমদের উপর শুধু হত্যা-নির্যাতন নয়, তাদেরকে নিজ জন্মভূমি ছাড়তে বাধ্য করেছে। ফলে তারা আশ্রয় নিয়েছে পাশ্ববর্তী গরীব রাষ্ট্র বাংলাদেশে।

একটি রিপোর্টে প্রকাশ, ১৯৪৬ সালে পশ্চিমা বিশ্বের সহযোগিতা নিয়ে মায়ানমার সরকার ৭০% মুসলমান অধ্যুষিত আরকান দখল করে ১ লক্ষ ১০ হাযার মুসলমানকে হত্যা করে। মুসলিম জনগোষ্ঠীকে আরাকান হ’তে নির্মূল করে দেয়ার একটি মাত্র পরিকল্পনার অধীনে বর্মী সরকার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নামে মুসলমানদের উপর অপারেশন চালায়। ১৯৪৮, ১৯৫৫-৫৯, ৬৬-৬৭, ৬৯-৭১, ৭৪-৭৮, ৭৮-৭৯ সাল সমূহে ১২টি অপারেশন চালিয়ে হাযার হাযার মুসলমানদেনকে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করে, ঘর-বাড়ী জ্বালিয়ে দেয়। তাতেও বর্মীদের রক্ত পিপাসা মেটেনি। একই কায়দায় ১৯৯১ সালেও মুসলিম নিধন চালানো হয়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঠেলে দেয়া হয়েছে আরও প্রায় লক্ষাধিক মুসলমান নারী-পুরুষ ও শিশুকে। এভাবে ১৯৪২-১৯৯১ সাল পর্যন্ত প্রায় ১২ লক্ষ মুসলমানকে দেশ থেকে বিতাড়িত করে। তারা অনাহার-অর্ধাহার ও বিনা চিকিৎসায় দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে দুর্বিসহ মানবেতর জীবন যাপনে বাধ্য হচ্ছে। এভাবে ফিলিস্তীন কাশ্মীর, বুলগেরিয়া, চেচনিয়া, বসনিয়া, মিন্দানাও ও আফ্রিকার মুসলমানগণ বাস্ত্তহারা, অধিকার হারা হয়ে উদ্বাস্ত্ত শিবিরে আশ্রয় নিচ্ছে। আরেক রিপোর্টে দেখা যায়, পৃথিবীর প্রায় ৯০% উদ্বাস্ত্ত মুসলমান।[30]

এখনও লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গাদের মানবেতর জীবন যাপনের বিষয়টি নিয়ে কোন মানবাধিকার রক্ষাকারী দেশ বা সংস্থার কোন মাথা ব্যথা আছে বলে মনেই হয় না। বাংলাদেশ সরকারও যেন মুখে কুলুখ এঁটেছেন। সরকার এর সামান্যতম নিন্দাও করতে পারে না। কি দুর্ভাগ্য আমাদের!

অন্যদিকে ভারত কাশ্মীরে মানবাধিকার লংঘন করেই চলেছে। তারও প্রমাণ মেলে নিম্নের রিপোর্টে- সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত ভারতীয় সেনাবাহিনী ৬৬ হাযার ১৫৮ জন কাশ্মীরী মুসলমানকে হত্যা করেছে। তাদের মধ্যে ৫৮৫ জনকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছে। ৫৬৮ জনকে দড়িতে বেঁধে ঝিলাম নদীর পানিতে ডুবিয়ে মারা হয়েছে। ৫৯ হাযার ১৭০ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ২ হাযার ২৩৫ জনকে নানাভাবে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। ১ লাখ কাশ্মীরবাসী গৃহহারা হয়েছে, ৩৮ হাযার ৪৫০ জন পঙ্গু হয়েছে, ২ হাযার ১০০ জন মানবিক নির্যাতনের ফলে মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে, ৪৬১ জন ছাত্রকে জীবন্ত অগ্নিদগ্ধ করা হয়েছে, ৭২০টি শিশু অঙ্গ হারিয়েছে, ৭০ হাযার ৬০০ পুরুষ ও নারীকে বিনা বিচারে রাখা হয়েছে, ১৯ হাযার ২০ জন যুবককে টর্সার সেলে রেখে নির্যাতন করা হয়েছে। এছাড়া বাড়ী বাড়ী তল্লাসীর নামে কত যে কাশ্মীরী নারীকে নির্যাতন ও ধর্ষণ করা হয়েছে বা হচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই।[31] দি নিউওর্ক টাইমস পত্রিকার রিপোর্ট মতে ভারতে প্রতি বছর ১০ থেকে ২০ হাযার স্বাধীনতা সংগ্রামীদেরকে হত্যা করা হয়।

মার্কিন সেনারা গুয়ানতানামোবে, আবুগারিব সহ অন্যান্য কারাগুলোতে মুসলমানদেরকে উলঙ্গ করে, গায়ে প্রস্রাব করে, জুতা-লাথি মেরে ইলেক্ট্রিক শক দিয়ে, খেতে না দিয়ে বছরের পর বছর নির্যাতন করছে। এভাবে তারা প্রতিনিয়ত জাতিসংঘ মানবাধিকার সনদ লংঘন করে যাচ্ছে। অথচ তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার কেউ নেই। অনুরূপভাবে নির্যাতিতদের দেখার ও তাদের পক্ষে কথা বলারও যেন কেউ নেই। তবে একজন দেখার আছেন। তিনি হ’লেন মহান সর্বশক্তিমান আল্লাহ। অতএব হে আল্লাহ! বিশ্বব্যাপী তোমার প্রিয় মানুষগুলোকে হেফাযত কর।

পরিশেষে বলা যায় যে, জাতিসংঘ মানবাধিকার সনদের ৩নং ধারাটি কার্যত অচল। পক্ষান্তরে ইসলামী মানবাধিকারই বিশ্ববাসীর জান-মাল ও মর্যাদার নিরাপত্তা দিতে পূর্ণভাবে সক্ষম।

মূল লেখা: মানবাধিকার ও ইসলাম

– শামসুল আলম

 


[1]. আমার দেশ, ৮ আগষ্ট ২০১২, ১ম পৃঃ

[2]. আমার দেশ, ৮ জুলাই ২০১২

[3]. আমার দেশ ২৪ সেপ্টেম্বর’১১, ১ম পৃঃ

[4]. আমার দেশ, ২ অক্টোবর ২০১২

[5]. আদাবুল মুফরাদ হা/৭৮; ছহীহাহ হা/১০২৭

[6]. আমার দেশ, ২৯ জুলাই ২০১২, ৫ পৃঃ

[7]. আত-তাহরীক ডিসেম্বর ’১১, পৃঃ ৪১

[8]. ইনকিলাব, ২৫ আগষ্ট ২০১২, ৬ পৃঃ

[9]. আমার দেশ, ২২ সেপ্টেম্বর ২০১২

[10]. বুখারী, মিশকাত, হা/৩৪৫৪, ‘কিছাছ’ অধ্যায়

[11]. ইবনু মাজাহ হা/২৬১৬ সনদ হাসান

[12]. বুখারী হা/৩১; মুসলিম হা/২৪৪৪

[13]. বুখারী হা/৪০১৯; মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৩৪৪৯।

[14]. বুখারী হা/৭০৭০; মুসলিম হা/৯৮

[15]. বুখারী হা/৬৬৬৪

[16]. বুখারী হা/৬৭; মুসলিম হা/১২১৮।

[17]. মুসলিম হা/১২১৮।

[18]. বুখারী, তিরমিযী হা/১৩৯৫।

[19]. নাসাঈ হা/৪৭৪৭ সনদ ছহীহ।

[20]. বুখারী হা/৩১৬৬; মিশকাত হা/৩৪৫২।

[21]. আহমাদ হা/১৫৬২৬, হাকেম হা/২৫৬৬, সনদ ছহীহ।

[22]. তাবারাণী।

[23]. আবু দাঊদ, মিশকাত হা/৩৯৫৫, সনদ হাসান

[24]. ইবনু হিশাম ২/৪১২; আল-বিদায়াহ ৪/৩০১; সীরাতু ইবনে কাছীর ৩/৫৭০; ফিক্বহুস সীরাহ ১/৩৮২; যঈফাহ হা/১১৬৩, সনদ যঈফ

[25]. মুসলিম, মিশকাত হা/৩৫৬২

[26]. বায়হাক্বী, মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বা, ইরওয়াউল গালীল হা/২৩৫৫ আলোচনা দ্রঃ।

[27]. মুসলিম হা/১৬৯৫-৯৬, মিশকাত হা/৩৫৬২ ‘দন্ডবিধি’ অধ্যায়।

[28]. বুখারী হা/৪৯০২।

[29]. বুখারী হা/৩৪৭০, মুসলিম হা/২৭৬৬, মিশকাত হা/২৩২৭ ‘দো‘আ সমূহ’ অধ্যায়, ‘ইস্তিগফার ও তওবা’ অনুচ্ছেদ।

[30]. ইসলামিক ফাউন্ডেশন পত্রিকা ৪৬ বর্ষ ১ম সংখ্যা, জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০০৬, পৃঃ ১১৬।

[31]. জ্বলন্ত কাশ্মির : সমাধান কোন পথে? মাসিক আত-তাহরীক ৩য় বর্ষ, ২য় সংখ্যা, নভেম্বর, ১৯৯, পৃঃ ১৭।

মন্তব্য করুন

Back to top button