ছাহাবী চরিত

ইকরিমাহ ইবনে আবি জাহল (রাঃ)

আবু উসাইদ

রাদিআল্লাহু আনহু, যে কথাটার অর্থ হলো আল্লাহ্ যার উপর সন্তুষ্ট হয়েছেন, সে বিশেষণটি যে একদিন ইকরিমার জন্য প্রযোজ্য হবে তা ছিল অসম্ভব কল্পনার মত। ইকরিমা, যার বাবার নাম হলো আবু জাহল্ – যার অত্যাচারে মুসলিমদের ক্রন্দন ঘোর কাফিরদের মনেও কাঁপন ধরিয়েছে,-যে ব্যক্তিটির জন্য মুসলিম বাহিনী উহুদ যুদ্ধে পরাজিত হয়েছে, যার ঘোর শত্র“তা ও ইসলাম বিরোধিতার জন্য রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) মক্কা বিজয়ের পরও তাকে ক্ষমার জন্য অযোগ্য ঘোষনা করেছিলেন, একদিন সে ব্যক্তিটিই তার জীবন ও সম্পদের সবটুকুই ইসলামের জন্য উৎসর্গ করেছিলেন এবং প্রমান করেছিলেন অল্লাহ্ যাকে চান তাকে হিদায়াত দান করেন।

ইকরিমার বয়স যখন সবেমাত্র ত্রিশ পার হয়েছে তখন মুহাম্মাদ (সাঃ) প্রকাশ্যে ইসলামের দাওয়াত দেয়া শুরু করেছেন। আরবের বিশাল অঞ্চল জুড়ে যে কয়েকটি বংশ সম্মান ও মর্যাদায় সবার উপর ছিল তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছিল কুরাইশ। এ কুরাইশ গোত্রটি ছিল বিশাল এবং এ গোত্রের নেতৃত্ব যাদের হাতে ছিল ইকরিমা ছিলো সে বংশের সন্তান। একই ভাবে ধন সম্পদের দিক থেকেও ইকরিমার পরিবার ছিল বিখ্যাত। ইকরিমার মতই উচ্চবংশ ও উচ্চমর্যাদার যে সকল তরুণ মক্কায় ছিল, তাদের মধ্যে সা’দ ইবন্ আবি ওয়াক্কাস্, মুসআ’ব ইবন্ উমাইর এর মত অনেকেই ইসলাম গ্রহণ করেছিল। ইকরিমাও হয়ত তাদেরই মত শুরুতেই ইসলামে প্রবেশ করতে পারত, পারেনি তার বাবা আবি জাহল্ বলেই। আবি জাহ্ল্ এর অত্যাচার প্রথম দিককার মুসলিমদের ভীষণ পরীক্ষায় ফেলেছিল এবং অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করে তারা সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিল। যে লোকটি ইসলামের প্রথম শত্র“ ছিল, তার সাথে সাথেই ইসলাম বিরোধিতার মধ্যে দিয়ে ইকরিমা ইবন্ আবি জাহ্ল্ এর তারুণ্যের দিনগুলো কাটতে লাগল। ইসলামের বিস্ময়কর উত্থান যে তার এবং তার বাবার ভবিষ্যত নেতৃত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছিল সেজন্য ইসলামের অগ্রযাত্রা রোধ করার জন্য ইকরিমা সর্বশক্তি নিয়োগ করল। বাবা এবং ইসলামের অন্যান্য শত্র“দের সাথে মিলে দুর্বল ও অসহায় নব্য মুসলিমদের প্রতি অত্যাচার তার প্রতিদিনকার কর্ম হয়ে দাঁড়াল।

আল্লাহ্র নির্দেশে মুহাম্মাদ (সাঃ) একদিন এদেরই অত্যাচারে মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করলেন। এরপর বদর প্রন্তরে রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) প্রথম মক্কার মুশরিকদের সাথে কোন যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন। আবি জাহ্ল্ তখন মুশরিক দলের নেতৃত্বে। লাত, মানাত ও আর সকল দেব দেবীর নামে শপথ করে সে মুসলিমদের সমূলে ধ্বংস না করে মক্কায় না ফেরার জন্য শপথ করল। বদর প্রন্তরেই সে এসব দেব-দেবীর নামে তিনটি উট বলীদান করল। মধ্যপান আর নারীদের গান আর নাচের মাধ্যমে সে তার সেনাদলকে উদ্দীপ্ত করে চলল।

যুদ্ধ শুরু হল। আবি জাহ্ল্ অতি দ্রুত মুয়াজ ও মুওয়াইবিজ নামের অল্পবয়স্ক দুজন আনসারী মুসলিম তরুণের হাতে ধরাশায়ী হয়ে মৃত্যুবরণ করল। ইকরিমা দূর থেকে বাবার এ করুণ পরিণতি দেখল। মৃত্যুকালে তার বাবার শেষ চীৎকার তার অন্তরকে বিদ্ধ করল, যদিও প্রচন্ড যুদ্ধের মধ্যে তার কিছুই করার ছিল না। পরাজয় আর পিতা হারানোর বেদনা নিয়ে মক্কায় ফিরে এল ইকরিমা।

সেদিন থেকেই পরাজয় আর পিতৃহত্যার প্রতিশোধের ভীষণ আগুন ইকরিমার মনে দাউ দাউ করে জ্বলতে লাগল। ইকরিমার মত আর যারা মক্কায় তাদের পিতা বা নিকটাত্বীয়কে হারিয়েছিল, তারাও রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) ও মুসলিমদের প্রতিশোধের জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগল। এভাবেই একদিন মুসলিমদের সাথে কাফিরদের ২য় যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠল এবং দুপক্ষ মুখোমুখী হল উহুদ প্রান্তরে।

উহুদের যুদ্ধে ইকরিমা একটি বিরাট অশ্বারোহী দলের নেতৃত্বে ছিল। উহুদ যুদ্ধে ইকরিমাকে সঙ্গ দেবার জন্য তার স্ত্রী উম্মু হাকীম তার সাথে ছিল এবং অন্যান্য মলিাদের সাথে মিলে সে কুরাইশ সেনাদলকে বাদ্য বাজিয়ে, চীৎকার করে উত্তেজিত করে চলছিল।

কুরাইশ বাহিনীর ডান বাহুর নেতৃত্বে ছিল খালিদ বিন ওয়ালিদ এবং বাম বাহুর নেতৃত্বে ছিল ইকরিমা। যুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে মুসলিমদের প্রবল আক্রমনের মুখে কুরাইশ বাহিনী পিছু হটে গেল এবং ছত্রভঙ্গ হয়ে ছড়িয়ে পড়ল। মুসলিমদের একটি দলকে রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) অনড় থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভ্যালী পাহারা দেবার জন্য নিয়োজিত করেছিলেন এবং কোন অবস্থাতেই সে স্থান ত্যাগ না করার জন্য আদেশ করেছিলেন। কুরাইশ বাহিনী পিছু হটে যাবার পর গনিমতের সম্পদ লাভের আশায় এ দলটির অধিকাংশ সদস্য রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) এর নির্দেশ ভুলে গিয়ে স্থান ত্যাগ করল। আরবের বিখ্যাত সমর কুশলী এবং ঘনিষ্ঠ দুই বন্ধু ইকরিমা এবং খালিদ মুসলিমদের এ স্থানচ্যুতির সুযোগে পেছন থেকে অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে আক্রমন করলেন এবং মুষ্টিমেয় যে কজন মুসলিম রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) এর নির্দেশ মেনে সে স্থানটি পাহারা দিচ্ছিল তাদের হত্যা করে মুসলিম বাহিনীকে অপ্রত্যাশিত আক্রমন করে বসল। ফলশ্র“তিতে কুরাইশ বাহিনী প্রতিআক্রমনে মুসলিম বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে ফেলল এবং বিপুল সংখ্যক অকুতোভয় সাহাবী দৃঢ়পদ থেকে যুদ্ধ করে শাহাদাত বরণ করলেন। মুসলিমদের এ পরাজয় বদর যুদ্ধের প্রতিশোধ হিসাবে ধরে নিয়ে কুরাইশ বাহিনী মক্কায় ফিরে এল।

উহুদের পর মুসলিমদের শেষ দেখে নেবার জন্য বিশাল বাহিনী নিয়ে কুরাইশ সেনাদল ইহুদীদের সহায়তা নিয়ে মদিনা আক্রমন করতে এগিয়ে এল। রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) এ যুদ্ধে পরিখা খনন করে কুরাইশ বাহিনীকে অত্যন্ত হতচকিত করেন ও চমকে দেন। মদীনার প্রবেশমুখে বাধা পেয়ে মুশরিক সেনাদল মদিনা অবরোধ করার সিদ্ধান্ত নেয়। এ অবরোধ দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়। মুশরিক বাহিনীর রসদ ও মনোবল দীরে ধীরে ক্ষয়ে আসা শুরু হয়। সেনাদলের এ অবস্থা দেখে সুচতুর পর্যবেক্ষণ করে পরিখার একটি যায়গায় একটি সরু পথ খুঁজে বের করেন। দুঃসাহসিক এক প্রচেষ্টার মাধ্যমে তিনি একদিন ওই স্থানটি দিয়ে পরিখা অতিক্রম করে বসেন। কুরাইশদের একটি ক্ষুদ্র দল এ অভিযানে তার অনুগামী হয়। অচিরেই অকুতোভয় এবং অদম্য মনোবলের মুসলিম একদল রক্ষীর হাতে এ দলটির একজন প্রাণ হারায়, দ্রুত ইকরিমা নিজের প্রাণ বাঁচিয়ে সে স্থান ত্যাগ করতে সক্ষম হন।

সময় বয়ে যায়। মানুষ বুঝতে পারে সত্য দ্বীন এসে গেছে, আর বসে থাকা যায় না। একে একে ইকরিমার ঘনিষ্ট বন্ধু খালিদ বিন ওয়ালিদ, আমর ইবনুল আস্ সকলে মক্কা ত্যাগ করে রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) এর কাছে গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করছে। কিন্তু ইকরিমা তার লক্ষ্যে অবিচল। যেভাবেই হোক জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়েও মুহুম্মাদের শেষ দেখে সে ছাড়বে।

হিজরতের নয় বছর পর রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) দশ হাজার জানবাজ মুসলিমের বিরাট বাহিনী নিয়ে অত্যন্ত সন্তর্পণে মক্কা বিজয়ের জন্য মক্কার দ্বারপ্রন্তে উপস্থিত হলেন। কুরাইশ দলের প্রধান নেতা আবু সুফিয়ান অবস্থা বেগতিক দেখে বিচলিত হয়ে পড়লেন। অবশেষে তিনি নিজেই ইসলাম গ্রহণের ঘোষনা দিয়ে রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) এর সাথে মিলে গেলেন। রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) তাঁর সেনাদলকে অত্যন্ত সতর্কভাবে সাধারণ কুরাইশ, যারা যুদ্ধ হতে পেছনে থাকবে, তাদের আক্রমন না করতে আদেশ করলেন, যা পৃথিবীর সমর ইতিহাসে একটি একক ও অনন্য ঘটনা। মক্কার বিভিন্ন প্রবেশপথে রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) বিভিন্ন কৌশলী সাহাবীর নেতৃত্বে সেনাদল পাঠালেন। এমনি এক সেনাদলের নেতৃত্বে ছিল খালিদ ইবন্ ওয়ালিদ। যদিও মক্কার অধিকাংশ লোক এবং যোদ্ধা রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) এর আগমন নিরবে মেনে নিল, তবু ইকরিমা সিদ্ধান্ত নিল সে মুসলিমদের যেভাবেই হোক প্রতিহত করবে। বিশ্বস্ত কিছু সৈন্য সাথে নিয়ে কুরাইশদের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে ইকরিমা মুসলিম বাহিনীর বিরোধিতায় অটল থাকলেন। মুখোমুখি হলেন খালিদের নেতৃত্ব দেয়া মুসলিম বাহিনীর । একসময় যে দুজন ছিলেন অন্তরঙ্গ বন্ধু, একসাথে যুদ্ধ করেছেন মুসলিমদের বিরুদ্ধে, আজ সেই খালিদের বিরুদ্ধে তিনি অস্ত্র ধরলেন। অন্যদিকে খালিদ বিন ওয়ালিদ, যাকে রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) আল্লাহ্র তলোয়ার উপাধীতে ভূষিত করেছিলেন, তাঁর নেতৃত্ব দেয়া মুসলিম বাহিনী নিয়ে অল্পক্ষনের মধ্যেই পরাজিত করলেন ইকরিমার বাহিনীকে। মুশরিকদলের অনেকে নিহত হল এবং বাকীরা কোনক্রমে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে বাঁচল। যারা পালিয়ে গিয়েছিল, তাদের মধ্যে একজন হলেন ইকরিমা।

মক্কা বিজয়ের দিন রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) এর ঐতিহাসিক অভিযানে একমাত্র ইকরিমার সেনাদলের সাথেই মুসলিমদের সংঘাত ও রক্তপাত হয়েছিল। বাকী সব অংশ দিয়ে আল্লাহ্র রাসুল, তাাঁর উপর আল্লাহ্র শান্তি ও করুণা বর্ষিত হোক, নির্বিঘেœ প্রবেশ করলেন। একদিন যে মাটি থেকে তাঁকে তাঁর নিজ বংশীয় লোকজন অমানুষিক অত্যাচার করে বিতাড়িত করেছিল, বার বার যে লোকগুলো তাঁর বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিয়েছে, তাঁর মাথার মূল্য নির্ধারণ করে দিয়ে দুর্ধর্ষ খুনিদের লেলিয়ে দিয়েছে, আজ তাদেরই মাঝে তিনি বিজয়ীর বেশে উপস্থিত। রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) পৃথিবীর সমর ইতিহাসে সেরা ক্ষমা ও দয়ার নজির প্রদর্শন করলেন। তিনি ঘোষনা করলেন, সকল নারী ও শিশু নিরাপদ, যারা নিজ ঘরে অথবা কাবাগৃহে আশ্রয় নিয়েছে তারা নিরাপদ, যারা আবু সুফিয়ান এর গৃহে আশ্রয় নিয়েছে তারা নিরাপদ। এভাবে তাঁর ঘোষনার মাধ্যমে প্রায় সমস্ত মক্কাবাসী নিরাপত্তা লাভ করল। তবে সাধারাণ ক্ষমার মধ্যে থেকেও তিনি কয়েকজন চিহ্নিত লোকের নাম বললেন, যাদের সম্পর্কে ঘোষনা দিয়েছিলেন, তারা যদি এমনকি কাবাগৃহের গিলাফের নীচেও আশ্রিত অবস্থায় পাওয়া যায় তাদেরকে সেখানেই হত্যা করা হবে। এই ঘোষনার শীর্ষ ব্যক্তিটির নাম ছিল ইকরিমা ইবন্ আবী জাহ্ল্। ইকরিমার কানে যখন এ ঘোষনা পৌঁছাল তখন তিনি দ্রুত মক্কার সীমানা অতিক্রম করে ইয়ামেনের দিকে পালানোর জন্য ঘোড়া ছুটালেন।

ইতিমধ্যে ইকরিমার স্ত্রী উম্মু হাকীম আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা, যে কিনা উহুদ যুদ্ধে রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) এর চাচা হামযার কলিজা চিবিয়ে কুখ্যাত ছিলেন, অন্য আরো প্রায় দশজন মহিলার সাথে রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) এর ক্যাম্পে ক্ষমা প্রার্থনার জন্য উপস্থিত হল। ক্যাম্পে রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) এর দুজন স্ত্রী, তাঁর মেয়ে ফাতিমা এবং আবদুল মুত্তালিব এর পরিবারের কয়েকজন মহিলা তখন রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) এর সাথে ছিল। উপস্থিত মহিলাদের দলটির মধ্যে কেবল হিন্দাই কথা বলবে বলে স্থির করা ছিল। উহুদের সেই মর্মান্তিক ঘটনার জন্য হিন্দ অত্যন্ত লজ্জিত ও ব্যথিত ছিল। রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) এর কাছে সে নিজের মুখ ঢেকে হাজির হল।

নিজেকে আড়াল রেখে হিন্দা বলে চলল- ”আল্লাহ্র রাসুল, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি ইসলামকে নিজের মনোনীত দীন হিসাবে নির্বাচিত করেছেন। আপনি সম্পর্কের দিক থেকে আমার নিকটাত্মীয়। আমি আপনার কাছে এজন্য ক্ষমা ও উত্তম ব্যবহারের আশা করছি। আজ থেকে আমি নিজেকে বিশ্বাসী মুমিনদের একজন বলে ঘোষনা করছি, যে আল্লাহ্ যে সত্য মিশন সহ আপনাকে পাঠিয়েছেন, তা দৃঢ়চিত্তে বিশ্বাস করে।”

এ কথা বলার পর হিন্দা নিজের মুখ থেকে নিকাব সরিয়ে ফেলে বললÑআমি হিন্দা বিনত্ উৎবা ইয়া রাসুলুল্লাহ্।

রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) তাকে ক্ষমা করে দিলেন এবং বললেন, ”তোমাকে স্বাগতম।”

হিন্দা বলে চলল ”আল্লাহর শপথ হে আল্লাহর রাসুল, আজকের আগে পৃথিবীর কোন ঘর আমার কাছে আপনার ঘরের চেয়ে অপছন্দনীয় ছিল না, আর আজ এখন থেকে পৃথিবীর কোন ঘর আপনার ঘরের চেয়ে প্রিয় আর মর্যাদাপূর্ণ নেই।”

এবার উম্মু হাকীম উঠে দাঁড়ালেন এবং রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) কে তার ইসলামে প্রবেশের ঘোষনা দিয়ে বললেন, ”ইয়া রাসুলুল্লাহ্, ইকরিমা আপনি তাকে পেলে হত্যা করবেন এই ভয়ে মক্কা থেকে পালিয়ে ইয়েমেন এর দিকে চলে গেছে। আপনি তাকে নিরাপত্তা দিন, তাহলে আল্লাহ্ও আপনাকে নিরাপত্তা দেবেন।”

”সে নিরাপদ”, রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) অঙ্গীকার করলেন।

উম্মু হাকীম এক মুহূর্তও দেরী করলেন না। তখনই বেরিয়ে পড়লেন ইকরিমার খোঁজে ইয়ামেনের পথে। তার সাথে একজন গ্রীক কৃতদাসকে সঙ্গে নিলেন পথে সঙ্গ দেবার জন্য। তারা যখন নির্জন এলাকা দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন সে দাসটি জোর করে তাকে শ্লীলতাহানী করতে চাইল। কিন্তু উম্মু হাকীম তাকে কোন আরব লোকালয়ে পৌঁছানো পর্যন্ত ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হলেন। লোকালয়ে পৌঁছানোর পরই উম্মু হাকীম সেখানকার অধিবাসীদের সব জানিয়ে সাহায্য চাইলেন। তারা দ্রুত তাঁর সাহায্যে এগিয়ে এল এবং গ্রীক কৃতদাসটিকে বেঁধে ফেলে তাদের কাছে রেখে দিল। উম্মু হাকীম এবার একাই বেরিয়ে পড়লেন ইয়ামেনের পথে ইকরিমার খোঁজে। দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে অবশেষে তিনি লোহিত সাগরের তীরে তিহামা নামক স্থানে ইকরিমাকে ধরতে পারলেন। ইকরিমা তখন সাগর পাড়ি দেবার জন্য একজন মুসলিম নাবিকের সাথে বাদানুবাদ করছিলেন। নাবিকটি বলছিল, ”আগে আপনি পবিত্র হয়ে আসুন, তবেই আমি আপনাকে নিয়ে সাগরে নামব।”

”কিন্তু আমি কিভাবে পবিত্র হব?”

”আপনি এ কথার সাক্ষ্যদান করুন যে, আল্লাহ্ ছাড়া কোন উপাস্য নাই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহ্র রাসুল।”

”আমি তো এর জন্যই এখানে পালিয়ে এসেছি।”

ইতিমধ্যেই দুজনের মধ্যে এসে উপস্থিত হলেন উম্মু হাকীম। বললেন, ”আমার চাচাতো ভাই (আত্মীয়তার দিক দিয়ে এরা দুজন চাচাতো ভাই-বোন ছিলেন), আজ আমি আপনার কাছে এসেছি পৃথিবীর সেই অনন্য সাধারণ, সবচেয়ে সঠিক পথের দিশারী আর সব মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মানুষ মুহাম্মাদ ইবন্ আদুল্লাহ্র কাছ থেকে এসেছি। আমি তাঁর কাছে আপনার জন্য নিরাপত্তা চেয়েছি। তিনি তা দিয়েছেন। এখন আপনি আর নিজেকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেবেন না।”

ইকরিমা সমস্ত ব্যাপারগুলোতে অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে গেলেন। এতদূরে তাঁর স্ত্রীর একাকী উপস্থিতি, মুহম্মাদÑযার সাথে তার এত শত্র“তা, যিনি তাকে ক্ষমার অযোগ্য ঘোষনা করেছেন তার পক্ষ থেকে নিরাপত্তা; তিনি নিজের কানকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তিনি স্ত্রীকে বললেন, ”তুমি কি নিজে তাঁর সাথে কথা বলেছ?” উম্মু হাকীম উত্তর করলেন, ”হ্যাঁ, আমি নিজে তাঁর সাথে কথা বলেছি এবং তিনি নিজেই আপনাকে নিরাপত্তা দিয়েছেন।” ইকরিমা ফিরে চললেন মক্কার পথে। পথে উম্মু হাকীম সেই গৃক ভৃত্যের কথা স্বামীকে জানালেন। ইকরিমা সে কথা শুনে সরাসরি সে এলাকায় চলে গেলেন যেখানে ভৃত্যটি আটক অবস্থায় ছিল। ইকরিমা তাকে সেখানে হত্যা করলেন এবং আবার এগিয়ে চললেন মক্কার পথে। পথিমধ্যে যেখানে তারা বিশ্রামের জন্য থামছিলেন, সেখানে এক রাতে স্ত্রীকে একান্তে পেতে চাইলেন। উম্মু হাকীম ছিটকে সরে এলেন এবং তার সাথে মিলিত হতে অস্বীকার করলেন। বললেন, ”আপনি আমার সাথে মিলিত হতে পারবেন না, কারণ আমি মুসলিমা আর আপনি হলেন মুশরিক।”

ইকরিমা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়লেন। তাঁর স্ত্রী মুসলিম হয়েছে একেবারেই সেদিন, আর তাঁরা দুজন মিলিত হলে আর তো কেউ দেখছে না, ঈমান তাকে এতটুকু পরিবর্তন করেছে? বললেন, ”এ তো কোন সহজ বিষয় নয় যা তোমার আর আমার মিলন আর এতদিনের সম্পর্কের মধ্যে বাধা হয়ে দাঁড়িেেয়ছে। ” ইকরিমা মক্কায় প্রবেশ করলেন।

রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) তার মক্কায় ড্রবেশের সাথে সাথেই সাহাবীদের ঘোষনা দিলেন, ”ইকরিমাহ্ ইবন্ আবী জাহ্ল্ তোমাদের মধ্যে মুসলিম এবং মুহাজির হয়ে আসছে। তোমরা তার পিতাকে গাল দিও না, কেননা মৃতকে গাল দিলে তা তাদের কাছে পৌঁছায় না।”

কিছুক্ষনের মধ্যে ইকরিমা সেখানে প্রবেশ করলেন যেখানে রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) বসে ছিলেন। নবী, তাঁর উপর আল্লাহ্র শান্তি ও রহমত বর্ষিত হোক, উঠে দাড়ালেন এবং উষ্ণ আলিঙ্গনে ইকরিমাকে স্বাগত জানালেন।

”মুহাম্মাদ,” ইকরিমা বলল, ”উম্মু হাকীম আমাকে জানিয়েছে যে আপনি আমাকে নিরাপত্তা দিয়েছেন।”

”হ্যাঁ, সে সত্য বলেছে।” রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) বললেন। ”তুমি নিরাপদ।”

”আপনি মানুষকে কিসের দিকে ডাকছেন?”

”আমি তোমাকে তোমাকে এই কথার সাক্ষ্য দেবার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি যে, আল্ল্াহ্ ছাড়া কোন ইলাহ্ নাই এবং আমি আল্লাহ্র বান্দা ও রাসুল এ কথার সাক্ষ্য দেবার জন্য, সালাত কায়েম করার জন্য, যাকাত আদায় করার জন্য এবং ইসলামের অন্যান্য বিধিনিষেধগুলো মেনে চলার জন্য।”

”আল্লাহ্র শপথ”, ইকরিমা বলে চলল, ”আপনি কেবলমাত্র তার দিকেই ডেকেছেন যা সত্য এবং আপনি কেবলমাত্র সৎকাজেরই আদেশ দান করেছেন। আপনার মিশন শুরু করার আগে আপনি আমাদেরই মাঝে ছিলেন এবং তখন আপনি ছিলেন কথায় ছিলেন সবচেয়ে সত্যবাদী এবং কাজে ছিলেন সবচেয়ে সঠিক।” ইকরিমা রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) এর দিকে তার হাত প্রসারিত করে দিলেন এবং বলে চললেন, ”আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্ল্াহ্ ছাড়া কোন ইলাহ্ নাই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহ্র বান্দা ও রাসুল।” রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) তাকে বলতে বললেন, ”আমি আল্লাহ্ এবং এখানে উপস্থিত সবাইকে সাক্ষী রেখে বলছি, আমি হলাম সে মুসলিম যে একজন মুজাহিদ এবং মুহাজির।” ইকরিমা তাই বললেন। এরপর বললেন,

” ইয়া রাসুলুল্লাহ্ , আপনি আল্লাহ্র কাছে আমার জন্য প্রার্থনা করুন, তিনি যেন আমাকে ইসলামের বিরুদ্ধে আমার সকল শত্র“তা ক্ষমা করে দেন এবং আপনার উপস্থিত ও অনুপস্থিত অবস্থায় আমি আপনার নামে যে সকল নিন্দা করেছি আর কুৎসা রটনা করেছি সেগুলো যেন তিনি ক্ষমা করে দেন।”

রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) আল্লাহ্র কাছে এ বলে প্রার্থনা করলেন যে, ” হে প্রতিপালক, আমার বিরুদ্ধে যত শত্র“তা সে করেছে এবং তোমার আলোকে নিভিয়ে দেবার যত চেষ্টা সে করেছে তার জন্য তাকে ক্ষমা করে দাও। আমার সামনে বা পেছনে আমার সম্মানহানীর জন্য যা কিছু সে বলেছে তার জন্যও তাকে ক্ষমা করে দাও।”

ইকরিমার মুখ গভীর আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। তিনি বললেন, ”আল্লাহ্র শপথ ইয়া রাসুলুল্লাহ্, আমি শপথ করছি, যা কিছু আমি আল্লাহ্র পথের শত্র“তার জন্য ব্যয় করেছি, তার দ্বিগুন আমি ব্যয় করব আল্লাহ্র পথে, এবং ইসলামের বিরুদ্ধে যত যুদ্ধ আমি করেছি তার দ্বিগুন আমি আল্লাহ্র পথে যুদ্ধ করব।”

সেদিন থেকে ইকরিমা একনিষ্ঠভাবে ইসলামের প্রবেশ করল। মুসলিম হিসাবে প্রতিটি জিহাদে তিনি জীবন বাজী রেখে অংশ নিতে লাগলেন এবং তাঁর দ্রুতগামী ঘোড়া অবিশ্বাসীদের হৃদয়ে কাঁপন ধরিয়ে তুলতে লাগল। যুদ্ধময়দানে না থাকলে তাঁর দিনের বেলা কাটত রোজা রেখে, মসজিদে ও কুরআন অধ্যয়ন করে, আর রাত কাটত নিভৃতে আল্লাহ্র কাছে কেঁদে কেঁদে। তখন কুরআন কোন বই আকারে ছিল না, তা ছিল চামড়া, বড় উটের হাড়, উপযুক্ত কোন পাথর ইত্যাদিতে লিখিত অবস্থায়। কুরআনের সে সংরক্ষিত অংশগুলোকে বলা হয় মুসাফ। ইকরিমা প্রয়ই এ মুসাফগুলোকে নিজের চুমু খেয়ে, মুখের উপর রেখে অঝোরধারায় কাঁদতেন আর বলতেন, ”কিতাবু রাব্বী, কালামু রাব্বী”, ”এ আমার রবের কিতাব, এ আমার রবের ভাষা”।

ইসলাম গ্রহণের সময় ইকরিমা যে ওয়াদা রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) এর সাথে করেছিলেন, তার পৃতিটি অক্ষরে অক্ষরে পালন করার জন্য তিনি ভীষণ কঠোর ও দৃঢ় ছিলেন। তার ইসলাম গ্রহণের পর যতগুলো যুদ্ধ মুসলিম বাহিনী অংশগ্রহণ করেছে তার প্রতিটিতেই তিনি ছিলেন সেনাবাহিনীর অকুতোভয় প্রথম সারির যোদ্ধা।

রাসুলুল¬াহ্ (সাঃ) এর ইন্তেকালের পর হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দিকে দিকে ধর্মত্যাগীদের ফিতনা দাউ দাউ করে ছড়িয়ে পড়ে। কোমল হৃদয় আবু বকর আল্লাহ্র কৃপায় তা অসাধারণ কঠোর হাতে দমন করেন। এ সময় আরবের অধিকাংশ অঞ্চলে এদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইকরিমা ছিলেন মুসলিম সেনাদলের অন্যতম সমরবিদ ও যোদ্ধা। আবু বকরের পর উমর এর খিলাফত শুরু হল। এ সময় মুসলিমরা একের পর এক রাজ্য আল্লাহ্র কৃপায় জয় করতে লাগল। সে সময় রোমান সাম্রাজ্যের সাথে মুসলিমদের যে ভয়াবহতম ঐতিহাসিক যুদ্ধ সংগঠিত হয় তা ছিল ইয়ারমুকের যুদ্ধ। এ যুদ্ধে ইকরিমার কথা বর্ণনা করার আগে এর ঐতিহাসিক কিছু প্রেক্ষাপট আলোচনা করা জরুরী।

নব্বই দশক পর্যন্ত যেমন এ পৃথিবী আমেরিকা ও সোভিয়েত এ দুটি সুপার পাওয়ারে বিভক্ত ছিল, ঠিক তেমনি রাসুলুল¬াহ্ (সাঃ) যখন এ পৃথিবীতে ইসলামের বার্তা নিয়ে আসেন তখন পৃথিবী রোমান এবং পারস্য এ দুটি সাম্রাজ্যের সুপার পাওয়ারে বিভক্ত ছিল। বিশাল সিরিয়ান অঞ্চল, যা রাসুলুল¬াহ্ (সাঃ) এর সময় শাম নামে পরিচিত ছিল তা ছিল রোমান সাম্রাজ্যের অধীন এবং ইরাকের কিছু অংশ এবং ইরান ও এর সংলগ্ন এলাকাগুলো ছিল পারস্য সাম্রাজ্যের অধীন। এ দুটি শক্তি দীর্ঘকাল ধরে যুদ্ধ করে যাচ্ছিল এবং বর্তমান পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক অংশ এ দুটি সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রনাধীন ছিল। সম্পদ, মর্যাদা, সামরিক শক্তি, ক্ষমতা সবদিক থেকে এ জাতি দুটো সবার চেয়ে উপরে ছিল। এ দুটি সাম্রজ্যের শাসিত অঞ্চলগুলো ছিল প্রাকৃতিক সম্পদ ও সৌন্দর্য়ে অতুলনীয়। আরব জাতি ভৌগলিকভাবে এ দুটো জাতিরই প্রতিবেশী ছিল। রোমানরা এবং পারসিকরা আরব জাতিকে অসভ্য একটি জাতি হিসাবে জানত, আরবীয়দের সাথে তারা মিশতে চাইত না এবং তাদের রাজসভায় আরবীয়দের প্রবেশাধিকার অত্যন্ত নিয়ন্ত্রিত ছিল। আরবীয়রাও এ দুটি সাম্রাজ্যের শাসকগোষ্ঠী এবং তাদের ক্ষমতাকে অত্যন্ত সমীহ করে চলত। আরবীয় কয়েকটি গোষ্ঠীর রাজা এবং স্থানীয় শাসকবর্গ রোমান অথবা পারসিকদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে তাদের শাসন মেনে ও কর দিয়ে চলত। এহেন অবস্থায় রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) এর আগমন ঘটল এ প্রথিবীতে। ইসলামের প্রচারের প্রথমদিকে তিনি মানুষকে আল্লাহ্র দিকে ডেকে ডেকে বলতেন, ”তোমরা ইসলামের ছায়াতলে এসে আল্লাহ্র সার্বভৌমত্যকেই মেনে নাও। আল্লাহ্র শপথ, একদিন পারসিক ও রোমানদের সম্পদ আল্লাহ্ তোমাদের হাতে তুলে দেবেন।”। তাঁর কথা শুনে অবিশ্বাসীরা হাসত, কেউ কেউ আরবের সবচেয়ে বিশ্বস্ত ও সত্যবাদী লোকটি কেন এমন কথা বলছে তা ভেবে বিস্মিত হত। ধীরে ধীরে ইসলামের আলো বিকশিত হতে লাগল, রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) দূত পাঠিয়ে সকলকে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছাতে লাগলেন। এভাবে একদিন রোমান এবং পারসিক সম্রাটের কাছেও তাঁর দূত পৌঁছে গেল। যে আরবদের তারা ঘৃনা করে সে আরবদের এমন ঔদ্ধত্য তারা মেনে নিতে পারে নি। রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) এর মৃত্যুর পর উমার (রাঃ) এর খিলাফতকালে মুসলিম মুজাহিদরা যুগপতভাবে পারস্য ও রোম সাম্রজ্যে আক্রমন শুরু করল। প্রথমদিকে পারস্য অঞ্চলের যুদ্ধে মুসলিমবাহিনীর সর্বাধিনায়ক ছিলেন খালিদ ইবন্ ওয়ালিদ (রাঃ)। এরপর তিনি মুসান্না ইবন্ হারিসার হাতে মুসলিম কমান্ড ন্যাস্ত করে চলে আসেন রোমানদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য এবং সেখানে তাঁর কাছ থেকে মুসলিম বাহিনীর কমান্ড গ্রহণ করেন আবু উবায়দা ইবনুল জাররা। একের পর এক যুদ্ধ হতে লাগল এবং যৎসামান্ন রসদ, স্বল্প সেনাদল নিয়েও মুসলিমরা এ দুটি সাম্রজ্যের অধীন রাষ্ট্রগুলো জয় করতে লাগল। পারস্য সাম্রজ্যের বিরুদ্ধে মুসলিমদের সবচেয়ে বড় যে যুদ্ধটি হয়েছিল তা ছিল কাদেসিয়ার যুদ্ধ এবং রোমানদের বিরুদ্ধে মুসলিমদের ভয়ংকরতম যুদ্ধটি ছিল ইতিহাস বিখ্যাত ইয়ারমুকের যুদ্ধ।

ইয়ারমুকের যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হবার আগে মুসলিম সেনাদল রোমানদের রাজ্য একে একে ছিনিয়ে নিচ্ছিল। ইসলামের এ বিজয় যখন আর রোধ করা যাচ্ছে না, তখন সুবিশাল রোমান সাম্রজ্যের সকল অংশ থেকে সেনাদল নিয়ে এসে জড়ো করা হল ইয়ারমুকের প্রান্তরে। প্রায় দেড় লাখ আধুনিক অস্ত্র সজ্জিত রোমান সেনা মাত্র তেত্রিশ হাজার মুসলিমের বাহিনী মোকাবেলা করার জন্য হাজির হল। ইসলামের ইতিহাসে কঠিনতম সে যুদ্ধে নেতৃত্বদানের জন্য বীর মুসলিম মুজাহিদ কমান্ডার খালিদ ইবন্ ওয়ালিদ কমান্ড গ্রহণ করলেন আবু উবায়দা উবনুল জাররার কাছ থেকে। ইকরিমা এ যুদ্ধে ছিলেন মুসলিম বাহিনীর একজন কমান্ডার। মরুভূমিতে পানিবিহীন পথচলার পর পথিক যেভাবে পানির জন্য ক্ষিপ্র হয়ে ছুটে চলে, এ যুদ্ধে ইকরিমাও তেমনি বার বার তার সেনাদল নিয়ে রোমানদের আক্রমন করে যাচ্ছিলেন। যুদ্ধের এক পর্যয়ে রোমান সেনাদল আক্রমন করে মুসলিম বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে ফেলল। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন সুরক্ষিত রোমান বাহিনীর একেবারে ভেতরে প্রবেশ করবেন এবং নিজের মৃত্যু পর্যন্ত তাদের সর্বোচ্চ ক্ষতি করবেন। ইকরিমার এ সংকল্পের কথা শুনে খালিদ দ্রুত তাকে বাধা দিয়ে বললেন, ”একাজ তুমি করো না ইকরিমা, তোমার মৃত্যু হবে মুসলিমদের জন্য একটা বড় আঘাত।” ইকরিমা বললেন,”আমাকে যেতে দাও খালিদ, আল্লাহ্র রাসুলের সাথে থাকার এবং তার সাথে যুদ্ধ করার সুযোগ তুমি পেয়েছ। আমার বাবা আর আমি ছিলাম তার সবচেয়ে ঘৃণ্য শত্র“। যে পাপ আমি করেছি তার শোধ দেবার সুযোগ তুমি আমাকে দাও। আল্লাহ্র নবীর বিরুদ্ধে আমি অনেকগুলো যুদ্ধ করেছি, আর আজ কি আমি এ রোমানদের দেখে পালিয়ে যাব তা কিছুতেই হতে দেয়া যায় না।”

ইকরিমা তখন বাহিনীর লোকদের ডেকে বললেন, ”কে কে আছো আমার সাথে যে মৃত্যুর জন্য বায়াত করবে আমার কেেছ।” তার এই আহ্বানে আল হারিস ইবন্ হিশাম, আইয়াশ ইবন্ রাবিয়া সহ চারশো মুজাহিদ তাকবীর ধ্বনি দিতে দিতে এগিয়ে এল। অত্যন্ত দ্রুতগতিতে এ দলটি সবাইকে ছাড়িয়ে ঢুকে পড়ল রোমান বাহিনীর একেবারে ভেতরে এবং বীরের মত তারা যুদ্ধ করল মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত। এ দলটির দ্বারা কাফির বাহিনীর যে ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়েছিল তা আর তারা কাটিয়ে উঠতে পারেনি।

সেদিন যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবার পর দেখা গেল, মুসলিমদের মধ্যে যারা শাহাদাত বরণ করেছে তাদের মধ্যে তিনজন মুমূর্ষু অবস্থায় কাতরাচ্ছেন। এই তিনজন ছিলেন আল হারিস ইবন্ হিশাম, আইয়াশ ইবন্ রাবিয়া এবং ইকরিমা ইবন্ আবু জাহল। ইকরিমা এবং আল হারিস পানির জন্য ডাকছিলেন। তাঁদের জন্য দ্রুত পানির ব্যবস্থা করা হল। পানি আনার পর আইয়াশ তাঁদের দিকে তাকালেন। তারা বললেন, ”এ পানি আইয়াশকে দাও।” আইয়াশের কাছে পানি নিয়ে যাবার পর দেখা গেল তিনি ততক্ষনে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে ফেলেছেন। আবার পানি যখন ইকরিমা এবং আল হারিসের দিকে নিয়ে যাওয়া হল, তখন দেখা গেল তাঁরা দুজনও ততক্ষনে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে নিয়েছেন।

উপস্থিত মুসলিমদের চোখ আবেগে অশ্র“সজল হয়ে উঠল। তারা বললেন, আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা নিশ্চয়ই তাঁদেরকে জান্নাতেব হাউজে কাউসারের সে পানি পান করাবেন, যা পান করার পর তাঁদের পিপাসা চিরকালের জন্য দূর হবে।

রেফারেন্সঃ

আসহাবে রাসুলের জীবনকথাঃ আবদুল মা’বুদ

সাহাবীদের জীবনীঃ তালিব আল হাশিমি

আল্লাহর তলোয়ারঃ এ আই আকরাম

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

আরও দেখুন
Close
Back to top button