আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদ
জাতিসংঘ মানবাধিকার সনদ :
মানবতার ইতিহাসে বিভীষিকাময় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৮) সংঘটিত হওয়ার পর যুদ্ধে জড়িত এবং জড়িত নয় এরূপ প্রায় সকল দেশ উপলব্ধি করল যে, যুদ্ধ মানুষের কখনও কোন কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। তাই এর বিকল্প কিছু একটা করা দরকার। সে লক্ষ্যে ১৯২০ সালে গঠিত হয় ‘লীগ অব নেশন্স’ বা ‘জাতিপুঞ্জ’। এটা গঠনের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল যে, এতে বিশ্বে বিভিন্ন দেশের সংখ্যালঘু মানুষের অধিকার, জাতিগত সংঘাত নিরসন, ধর্ম পালন ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা প্রভৃতি নিয়ে মানুষের বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকারগুলো সংরক্ষণ ও প্রয়োগের নিশ্চয়তা থাকবে। কিন্তু না, তা হ’ল না। এ সনদ মানুষের কোন কল্যাণ আনতে পারেনি। যার কারণে দু’দশক পরে শুরু হয় আর এক ভয়ংকর বিশ্বযুদ্ধ। বিশ্বে এক দেশ আর এক দেশের ওপর কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব, এক রাষ্ট্রনায়ক অন্য রাষ্ট্রনায়কের ওপর অবিশ্বাস ও সন্দেহ অথবা জাতিগত শক্তি প্রয়োগের অপচেষ্টায় ১৯৩৯ সালে শান্তিময় বিশ্বের বুকে জ্বলে ওঠে আর এক যুদ্ধের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। ফ্যাসিবাদী জার্মান শাসক ন্যাৎসী হিটলারের নেতৃত্বে ইটালী, জাপান প্রভৃতি এবং অন্য দিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য প্রভৃতি দেশের মধ্যে শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। যে যুদ্ধে নিহত হয়- প্রায় দুই কোটি সৈনিক ও চার কোটি সাধারণ মানুষ সহ মোট ছয় কোটি বনু আদম, ধ্বংস হয় কোটি কোটি ঘর-বাড়ী ও স্থাপনা। বিনাস হয় মানব সভ্যতা। ১৯৪৫ সালের ৬ আগষ্ট জাপানে হিরোশিমা এবং ৯ আগষ্ট নাগাশীকাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিক্ষিপ্ত ২টি পারমাণবিক বোমাতে মারা যায় ২ লক্ষ ৪০ হাযার মানুষ (উইকিপিডিয়া)। নিমিষে ধ্বংস হয়ে যায় বড় বড় এই দু’টি শহর। যারা বেঁচে ছিল তারাও পরবর্তীতে ধুঁকে ধুঁকে মারা যায়। আজও যারা বেঁচে আছে তারা নানা জটিল রোগ অথবা পঙ্গুত্ব বরণ করে মহাকালের স্বাক্ষী হয়ে বেঁচে আছে। এর ধকল শুধু জাপান কেন গোটা বিশ্ববাসীকে আজও পোহাতে হচ্ছে।
তাইতো সেদিনের বাস্তবতা শত্রু-মিত্র উভয়পক্ষ উপলব্ধি করতঃ বিশ্বে লীগ অব নেশন্সের বিকল্প কিছু একটা করার উদ্যোগ নেয়। ১৯৪৫ সালে যুদ্ধ শেষ অবধি মার্কিন প্রেসিডেন্ট Franklin Delano Roosevelt এবং বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী Winston Churchill মিত্র বাহিনী নিয়ে শান্তি মিশনের এক জোট গঠনের উদ্যোগ নেন আটলান্টিক মহাসাগরের ওপর একটি জাহাজে। একে বলা হয় ‘আটলান্টিক সনদ’ (Atlantic charter)।১ ধীরে ধীরে বহুদেশ এই মতের দিকে এগিয়ে আসে। অবশেষে আমেরিকার সানফ্র্যান্সিস্কোতে ‘সম্মিলিত জাতিসংঘ’ (The United Nations) নামের সংগঠনটি গড়ে উঠে এবং এর জন্য ১৯৪৫ সালের ২৪ শে অক্টোবর জাতিসংঘ সনদ (UN Charter) প্রণয়ন ও কার্যকর করা হয়। মূলতঃ মানবাধিকার লংঘনের প্রতিবাদ স্বরূপ প্রণীত হয় এই জাতিসংঘ সনদ। এই সনদ একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি, যাতে বিশ্ব সম্প্রদায় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মানবাধিকার এবং মৌলিক স্বাধীনতা উন্নয়নে সম্মত হয়। জাতিসংঘ সনদে মোট নয়টি স্থানে মানবাধিকার এবং মৌলিক স্বাধীনতার কথা সরাসরি উল্লেখ রয়েছে। এ অনুচ্ছেদগুলোর মধ্যে ৬৮ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ১৯৪৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারী ECOSOC মানবাধিকার কমিশন গঠিত হয়। ১৯৪৬ সালে লন্ডনে সাধারণ পরিষদের প্রথম অধিবেশনে এ কমিশনকে অনুমোদন দেয়া হয়। তারপর ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরে জেনেভাতে সাধারণ পরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশনে মানবাধিকার কমিশন সিদ্ধান্ত নেন যে, ‘International Bill of Rights’-এর তিনটি অংশ থাকবে। যথা- ১. মানবাধিকারের ঘোষণা, ২. মানবাধিকার চুক্তি এবং ৩. বাস্তবায়ন পদ্ধতি। এরই আলোকে মানবাধিকার কমিশন গঠনের উদ্যোগ নেয় জাতিসংঘ মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্র তৈরীর কাজ।
মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণা (The Universal Declaration of Human Rights, UDHR) : জাতিসংঘ মানবাধিকার মূল সনদ বলতে সেই সনদকে বুঝানো হয় যা মানবাধিকার কমিশন মিসেস এলিয়নর রুজভেল্ট (Mrs. Eleanor Roosevelt)-এর নেতৃত্বে ‘মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণার খসড়া তৈরী করে অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের মাধ্যমে প্যারিসে অনুষ্ঠিত সাধারণ পরিষদের তৃতীয় অধিবেশনে জমা দেয়।
এখানে তিনটি অংশের মধ্যে প্রথমটি ছিল মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণা। তাই এটাকে ‘তিন সোপান বিশিষ্ট রকেটের প্রথম সোপান’ বলা হয় (The First stage of the three staged on rocket)।২ এ সময় সাধারণ পরিষদের সদস্য সংখ্যা ছিল ৫৮। উপস্থিত ৫৬ সদস্যের মধ্যে সার্বজনীন ঘোষণার পক্ষে ভোট দিয়েছিল ৪৮ টি। বিপক্ষে কেউ ভোট দেয়নি। তবে ৮টি রাষ্ট্র ভোট দানে বিরত ছিল। সুতরাং বলা যায়, সর্বসম্মতিক্রমে ১৯৪৮ সালের ১০ই ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ গ্রহণ করে ‘মানাবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণা।৩ মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাটি ‘সকল জাতির এবং মানুষের অধিকার অর্জনের সাধারণ মান’ হিসাবে গৃহীত হয়। যে দর্শনের উপর ভিত্তি করে এটি গৃহীত হয় তা হ’ল ‘সকল মানুষই বন্ধনহীন অবস্থায় এবং সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। তাদের বুদ্ধি ও বিবেক দেয়া হয়েছে এবং তাদের উচিৎ ভাতৃসুলভ মনোভাব নিয়ে একে অন্যের প্রতি আচরণ করা।
সার্বজনীন ঘোষণায় ৩০টি অনুচ্ছেদ রয়েছে। ৩ থেকে ২১ অনুচ্ছেদে ১৯টি নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার বর্ণিত হয়েছে, যেগুলো জাতি, গোত্র, বর্ণ, নারী-পুরুষ ভাষা, ধর্ম, রাজনৈতিক বা অন্য মতবাদ, জাতীয় বা সামাজিক উৎপত্তি, সম্পত্তি, জন্ম বা অন্য মর্যাদা নির্বিশেষে প্রত্যেক মানুষ ভোগ করার অধিকারী। ২২ থেকে ২৭ অনুচ্ছেদে ৬টি অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। যেগুলো মানুষের মর্যাদা ও ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য অপরিহার্য। বিধায় ‘সমাজের সদস্য হিসাবে’ প্রত্যেক ব্যক্তিই তা পাবার অধিকারী। প্রতিটি রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে স্বীয় প্রচেষ্টা ও আন্তর্জাতিক সাহায্য-সহযোগিতার মাধ্যমে প্রাপ্ত সম্পদের সর্বোচ্চ ও সর্বোত্তম ব্যবহার দ্বারা এ অধিকারগুলোর বাস্তবায়নে সচেষ্ট হওয়া। তাই বলা যায়, সার্বজনীন মানবাধিকার বুঝানোর মধ্য দিয়েই আন্তর্জাতিক আইন পর্যায়ে মানবাধিকারের আধুনিক ইতিহাস শুরু হয়েছে। এই ঘোষণাকে জাতিসংঘের সবচেয়ে বড় সাফল্য বলে অভিহিত করেছেন মনীষী গুড রিচ। কারণ UDHR গ্রহণ করার পর মাত্র দুই বছরের মধ্যে জাতিসংঘ Capitalist & Socialist ব্লকের মধ্যে বিরাজমান মতভেদের সমন্বয় সাধনে সমর্থ হয়।৪
সার্বজনীন ঘোষণার ক্ষমতা ও প্রভাব :
সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাটির (UDHR) ক্ষমতা ও প্রভাব বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। মানবাধিকার কমিশন UDHR-এর খসড়া প্রণয়নকারী মিসেস এলিয়নর রুজভেল্ট নিজেই এ প্রসঙ্গে বলেন, ঘোষণাটি চুক্তি বা আন্তর্জাতিক সম্পত্তি নয় এবং আইনগত দায়দায়িত্বও আরোপ করে না; বরং এটি সকল মানুষ এবং জাতির অধিকার অর্জনের সাধারণ মান হিসাবে উপস্থাপিত হস্তান্তরঅযোগ্য মানবাধিকার নীতি সমূহের আনুপূর্বিক বর্ণনা।
একই সুরে লটার পাস্ট বলেন, ‘যেহেতু ঘোষণাটি কোন আইনী দলীল নয়, সেহেতু এটি আন্তর্জাতিক আইনের বাইরে কিছু এবং এর বিধানগুলো একটি আইনী ব্যাখ্যার বিষয়বস্ত্ত হ’তে পারে না। অপরদিকে Goodrich মনে করেন, সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার একটি তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব রয়েছে রাষ্ট্রসমূহের মান বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এবং রাষ্ট্রগুলোর কাছে শুধু এটাই আশা করা যায় না যে, এই ঘোষণার বিধান বদলে তাদের উদ্দেশ্য হিসাবে দেখবে ও অর্জন করবে। এও আশা করা হয় যে, এটিকে তারা আইনগত প্রতিশ্রুতি হিসাবে সম্মান করবে। কিন্তু লটারপাস্ট আরও এক ধাপ এগিয়ে মন্তব্য করেন যে, UDHR-এর কোন আইনগত বাধ্যকরণ শক্তি তো নেই, এমনকি নৈতিক কোন গুরুত্বও নেই।৫
সুতরাং উপরোক্ত আলোচনা থেকে বুঝা যায়, অধুনা বিশ্বে শান্তি ও মানবাধিকার তথা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্ব সম্প্রদায় যে জাতিসংঘ সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাটি প্রণয়ন করেছে, তা আদৌ সার্বজনীন নয়। কারণ যারা এটা প্রণয়ন করেছেন তারাই এটাকে বিশ্ব শান্তি, শৃংখলা ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার আইনগত ব্যাখ্যা ও ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তবে একটা বিষয় স্পষ্ট যে, বিশ্বে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা হৌক বা না হৌক প্রচার ও অপব্যবহার কোন অংশে কমতি নেই। বিশ্বের পরাশক্তিধর দেশগুলো তথা জাতিসংঘের স্থায়ী ৫ সদস্য রাষ্ট্রের কাছে যেন সেই শান্তির অমীয় বাণী বন্দী হয়ে রয়েছে। তাদের ‘ভেটো পাওয়ার’ আরও ক্ষতির কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। কারণ তারা এ পাওয়ারকে যথেচ্ছ ব্যবহার করছে। যেমন- স্থায়ী ৫ সদস্যভুক্ত কোন ১টি রাষ্ট্র বিশ্ব শান্তি অথবা মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার বিপক্ষে যদি ভেটো প্রয়োগ করে, তবে তা বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না। যেমন ফিলিস্তীন রাষ্ট্রের স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্বের সকল রাষ্ট্র ভোট দিলেও এক যুক্তরাষ্ট্রের ভেটোর কারণে তা কার্যকর হয়নি। তথাপি যেহেতু সার্বজনীন ঘোষণাটি বর্তমান বিশ্বে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও আলোচিত হচ্ছে, সেহেতু একে খাটো না করে ইসলামের আলোকে মানবাধিকারের আলোচনা ও মূল্যায়নে যথার্থ হচ্ছে কি-না সে বিষয়ে উপস্থাপনের প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ। সে লক্ষে আমরা প্রথমে জাতিসংঘ সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাটির মূল দলীল উপস্থাপন করতঃ প্রত্যেকটি ধারার তুলনামূলক ব্যাখ্যা পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে বিশ্লেষণ করব এবং দেখব প্রকৃত অর্থে কোন বিধানটি মানব জীবনের জন্য সর্বোত্তম, সার্বজনীন ও বিতর্কের ঊর্ধ্বে?
মূল লেখা: মানবাধিকার ও ইসলাম
– শামসুল আলম
1. ডঃ রেবা মন্ডল ও ডঃ মোঃ শাহজাহান মন্ডল, মানবাধিকার আইন, (ঢাকা : শামস পাবলিকেশন্স, ২য় প্রকাশ, ২০০৯), পৃঃ ৩৫।
2. তদেব, পৃঃ ৩৯।
3. তদেব, পৃঃ ৩৯।
4. তদেব, পৃঃ ৪০।