নির্বাচিত ফেসবুক স্ট্যাটাস

সেকুলার ধর্মের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ভণ্ডামি

শুধু বাংলাদেশ না দুনিয়াব্যাপী সেকুলারদের একটা বয়ান হচ্ছে ফ্রান্স হচ্ছে গণতন্ত্র এবং লিবার্টি বা স্বাধীনতার ধারক-বাহক।
আসলেই কী তাই? মোজাম্মেল হোসেন তোহা ভাইয়ের একটা লেখা থেকে কিছুটা অংশ তুলে দিচ্ছি –

ফ্রান্স টিকেই আছে আফ্রিকাকে শোষণ করার মধ্য দিয়ে। এটা গোপন কিছু না। সময়ে সময়ে ফরাসিরা নিজেরাও এটা স্বীকার করে। ১৯৫৭ সালে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া মিতেঁরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, আফ্রিকার উপর নিয়ন্ত্রণ টিকিয়ে রাখতে না পারলে একবিংশ শতাব্দীর ইতিহাসে ফ্রান্সের কোনো জায়গা থাকবে না।

পাঁচ দশক পর তার পরবর্তী প্রেসিডেন্ট জ্যাক শিরাক ২০০৮ সালে সেটা আবারও নিশ্চিত করে বলেছিলেন, আফ্রিকা না থাকলে ফ্রান্স তৃতীয় বিশ্বের তালিকায় ছিটকে পড়ত। তিনি পরিষ্কারভাবেই স্বীকার করেছিলেন, ফ্রান্সের ব্যাঙ্কগুলোতে যে টাকা আছে, তার একটা বড় অংশ আসে আফ্রিকান রাষ্ট্রগুলোকে শোষণ করার মধ্য দিয়ে।

কীভাবে ফ্রান্স আফ্রিকাকে শোষণ করছে? প্রধানত কলোনিয়াল মুদ্রা সিএফএ ফ্রাঙ্কের (CFA Franc – Franc of the French Colonies in Africa) মাধ্যমে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে যখন আফ্রিকাজুড়ে কলোনিগুলো স্বাধীনতা দাবি করে, তখন ব্রিটিশ, স্প্যানিয়ার্ড এবং ইতালিয়ানরা তুলনামূলকভাবে সহজেই তাদেরকে স্বাধীনতা দিয়ে ফিরে যায়। কিন্তু ফ্রান্স ছিল ব্যতিক্রম। তারা তাদের কলোনিগুলোকে স্বাধীনতা দেয় এই শর্তে যে, স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোকে তারা অর্থনৈতিক এবং সামরিক দিক থেকে “সহযোগিতা” করবে।

সামরিক ক্ষেত্রে এই সহযোগিতার অর্থ ছিল, ফরাসি সেনাবাহিনী স্বাধীনতার পরেও আফ্রিকান রাষ্ট্রগুলোতে অবস্থান করবে, তাদের পুলিশ এবং সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিবে, বিনিময়ে রাষ্ট্রগুলোকে তাদের সকল অস্ত্র ক্রয় করতে হবে কেবলমাত্র ফ্রান্সের কাছ থেকে।

আর অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এই সহযোগিতার অর্থ ছিল, স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোকে তাদের মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার করতে হবে সিএফএ ফ্রাঙ্ক। শুধু তাই না, রাষ্ট্রগুলোর যেকোনো প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলনের ক্ষেত্রে, যেকোনো বড় প্রজেক্ট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আগে ফ্রান্সকে প্রস্তাব দিতে হবে।

সিএফএ ফ্রাঙ্ক মুদ্রাটি নিয়ন্ত্রণ করে ফ্রেঞ্চ ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট। আর সে কারণে আফ্রিকায় ফ্রান্সের ১৪টি সাবেক কলোনিকে আজও তাদের ফরেন রিজার্ভের অর্ধেক (আগে ছিল ৬৫%, তারও আগে ৮৫%) জমা রাখতে হয় ফ্রেঞ্চ ট্রেজারির কাছে।

দেশ চালানোর জন্য তাদের যদি অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন হয়, তাহলে তাদেরকে সেটা ঋণ নিতে হয় ফ্রান্সের কাছ থেকেই। এবং সেই ঋণের সুদ শোধ করতে করতেই তাদের বাকি জীবন অতিবাহিত হয়। চক্রে আটকা পড়ে যায় তাদের জীবন।

ভাবতে পারেন, আফ্রিকান রাষ্ট্রগুলো কেন এই ব্যবস্থা মেনে নিচ্ছে? কেন তারা এই সিস্টেম থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে না? উত্তরটা হচ্ছে, অনেকেই চেষ্টা করেছিল। তাদের পরিণতি ভালো হয়নি।

স্বাধীনতার পর সেকু তুরের নেতৃত্বে গিনি ফ্রান্সের আধিপত্য মেনে নিতে রাজি হয়নি। ১৯৬০ সালে তারা ফ্রাঙ্ক জোন ছেড়ে বেরিয়ে যায়। প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে ফ্রেঞ্চ সিক্রেট সার্ভিস জাল মুদ্রা সরবরাহ করে গিনির অর্থনীতি পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়।

সিলভানাস অলিম্পিওর নেতৃত্তে টোগোও স্বাধীনভাবে পথ চলার উদ্যোগ নেয়। স্বতন্ত্র টোগোলিজ মুদ্রা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৬৩ সালের ১২ই ডিসেম্বর তারা আনুষ্ঠানিকভাবে ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে। পরের দিন সকালে ফরাসিদের দ্বারা প্রশিক্ষিত টোগোলিজ সেনারা অলিম্পিওকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করে।

এটা ছিল সাবেক কলোনিগুলোতে সংঘটিত ফ্রান্সের প্রথম ক্যু, পরবর্তীতে যার পুনরাবৃত্তি হয়েছে অনেকবার।

আফ্রিকার প্রতিটি সাবেক কলোনিতে ক্যু এবং পাল্টা ক্যুয়ের মাধ্যমে ফ্রান্স নিজেদের অনুগত স্বৈরশাসকদেরকে ক্ষমতায় বসিয়ে রেখেছে, আর তাদের মাধ্যমে খনিজ সম্পদে পরিপূর্ণ আফ্রিকার সম্পত্তি লুট করে যাচ্ছে।

১৯৬৪ সালে ফ্রান্স গ্যাবনে সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ওমার বঙ্গোকে ক্ষমতায় বসায়, যার শাসনব্যবস্থা চলে পরবর্তী ৪২ বছর পর্যন্ত। গ্যাবনের গুরুত্ব কী? গ্যাবনে আছে বিশাল ইউরেনিয়ামের মজুদ। আর ফ্রান্সের নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরগুলোর জন্য দরকার এই ইউরেনিয়াম।

ওমারের মৃত্যুর পর আজও গ্যাবনের ক্ষমতায় আছে তার ছেলে আলি ওমার বঙ্গো। ফ্রান্সের প্রতি তাদের আনুগত্যের বিষয়টা প্রকাশ পায় ওমার বাঙ্গোর একটা উক্তি থেকে। যেখানে জ্যাক শিরাক নিজেই আফ্রিকাকে শোষণের কথা স্বীকার করেছিলেন, সেখানে বাঙ্গো বলেছিলেন, গ্যাবনকে ছাড়া ফ্রান্স হচ্ছে ড্রাইভার ছাড়া গাড়ির মতো, আর ফ্রান্সকে ছাড়া গ্যাবন হচ্ছে জ্বালানী ছাড়া গাড়ির মতো।
অথচ বাস্তবে ফ্রান্সই দশকের পর দশক ধরে গ্যাবনের কাছ থেকে ইউরেনিয়াম জ্বালানি আদায় করে নিচ্ছে অত্যন্ত সুলভ মূল্যে।

এই সুলভ মূল্যে যদি কেউ রাজি না হয়, তাহলে তার ভাগ্যেও জুটতে পারে অভ্যুত্থান। সেটাই ঘটেছিল নাইজারের প্রেসিডেন্ট মামাদু তানজার ভাগ্যে। ফ্রান্সের দেওয়া মূল্য কম মনে হওয়ায় ২০০৯ সালে তিনি ইউরেনিয়ামের মূল্যের ব্যাপারে চীনের সাথে দরদাম শুরু করেছিলেন। কয়েক মাসের মধ্যেই তাকে বিদায় নিতে হয়।

২০১১ সালে বিদায় নিতে হয় আইভরি কোস্টের প্রেসিডেন্টকেও। সেখানেও একই কারণ। তবে ইউরেনিয়াম না, আইভরি কোস্ট হচ্ছে ফ্রান্সের প্রধান কফি এবং কোকো সরবরাহকারী রাষ্ট্র।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ফ্রান্স এ পর্যন্ত ৩০টিরও বেশি সামরিক অভিযান পরিচালনা করেছে। আফ্রিকার প্রায় প্রতিটা অভ্যুত্থান, প্রতিটা গুপ্তহত্যার পেছনে ফ্রান্সের কোনো না কোনো ভূমিকা আছে।

এবং এটা শুধু মধ্য ও দক্ষিণ আফ্রিকার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ না। ২০১১ সালে গাদ্দাফিকে উৎখাত করার পেছনেও প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল ফ্রান্স। সে সময় আমেরিকার ভূমিকা ছিল লিডিং ফ্রম বিহান্ড। ওবামা প্রশাসন ছিল দ্বিধাবিভক্ত। কিন্তু ফ্রান্স একেবারেই শুরু থেকেই ছিল আগ্রাসী।

ফ্রান্সই সর্বপ্রথম লিবিয়ার বিদ্রোহীদেরকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। ফ্রান্সই জাতিসংঘের রেজোল্যুশন ড্রাফট করেছিল। এবং সেই রেজোল্যুশন পাশ হওয়ার আগেই ফ্রান্স তার যুদ্ধবিমান পাঠিয়ে দিয়েছিল বেনগাজির দিকে অগ্রসর হতে থাকা গাদ্দাফির বাহিনীর উপর হামলা করার জন্য।

গাদ্দাফির মৃত্যুর পরে আমেরিকা লিবিয়া থেকে নিজেকে অনেকটাই গুটিয়ে নিয়েছে। কিন্তু ফ্রান্স দিনে দিনে তার ইনভলভমেন্ট আরো বৃদ্ধি করেছে। আমেরিকার অক্সিডেন্টাল অয়েল অ্যান্ড গ্যাস লিবিয়া ছেড়ে যাওয়ার সময় নিজেদের শেয়ার বিক্রি গেছে ফ্রান্সের টোটালের কাছে।

কিন্তু এটা ঘটেছে বৈধভাবে। আর অবৈধভাবে ফ্রান্স লিবিয়ার দক্ষিণে স্বর্ণের খনি থেকে স্বর্ণ উত্তোলন এবং চোরাচালান করে নিয়ে যাচ্ছে কোনো নজরদারি ছাড়াই। প্রায় কোনো মিডিয়াতেই এটা পাওয়া যায় না, কিন্তু দক্ষিণাঞ্চলের স্থানীয় লিবিয়ানদের কাছ থেকে শোনা যায়, সেখানে আফ্রিকানদেরকে দিয়ে স্বর্ণ উত্তোলন করানোর এই কার্যক্রমের পেছনে ফরাসি কোম্পানিগুলোই দায়ী।

সেকুলার ধর্মের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ভণ্ডামি। মিলিয়ে দেখেন।

– Sharif Abu Hayat Opu

মন্তব্য করুন

Back to top button