নির্বাচিত ফেসবুক স্ট্যাটাস

যে বিষয়ে আপনার পরিপূর্ণ জ্ঞান নেই, সে বিষয়ে চুপ থাকুন

মানুষের সক্ষমতা অনেক, কিন্তু অ্যাবসোলিউট নয়। ফলে চোখ ধাঁধানো অনেক কিছু করে দেখালেও দিন শেষে মানুষকে তার নিজের সীমাবদ্ধতাকে সাথে করেই ঘুমোতে যেতে হয়। মানুষ একে স্বীকার করুক বা না করুক, ইসলামিক ও কনভেনশনাল উভয় পার্সপেক্টিভ থেকে এটা একটা ফ্যাক্ট। এখন অবিচ্ছেদ্য এই সীমাবদ্ধতাকে না বুঝতে পারার কারণে আমাদের সমাজে দু’টো প্রান্তিক ধারা তৈরি হয়। একটি ধারা নিজেদের “প্রগতিশীল” বলে দাবি করেন। আর অন্য ধারাটি রিলেজিয়োসিটি কমপ্লেক্সে ভোগার কারণে তাদেরকে “ধর্মবাদী” হিসেবে আখ্যা দেয়া যায়।

১ম ধারাটি নিজেদের সীমাবদ্ধতা বুঝতে না পারার ফলে যে সমস্যাটি তৈরি করেন, সেটি একটু লক্ষ্য করুন। এই ধারাটির মানুষজন বেশ শিক্ষিত, কেউ কেউ আবার ধনী এবং এলিট হওয়ার কারণে তাদের মধ্যে এক ধরনের ওভার কনফিডেন্স এর জন্ম হয়। এই ওভার কনফিডেন্স তাদের মধ্যে অনভিপ্রেত অহংকারের জন্ম দেয়। এই ওভার কনফিডেন্স এর আফটারম্যাথ হিসেবে তাদের কাছ থেকে ইসলাম নিয়ে অথরিটিসুলভ মন্তব্য প্রকাশ পায় এবং ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে তারা হুটহাট জাজ করে বসেন। তাদের হাভ ভাব দেখলে মনে হয়, সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা সাবজেক্ট নিয়ে পড়লেই বুঝি ইসলামিক ডিসিপ্লিন নিয়ে মাতবরি করা যায়!

অথচ তারা এটি চিন্তা করে দেখেন না যে, অন্য সব ডিসিপ্লিনের মতো ইসলামিক ডিসিপ্লিনের নিজস্ব মেথড, স্বতন্ত্র এপিস্টেমোলজি, আলাদা মোডাস অপারেন্ডি আছে। বিশ্ববিদ্যালয় পরিসরে অনার্স ও মাস্টার্স মিলিয়ে মোট পাঁচ বছর সময়ে কেউ অনেকগুলো ডিসিপ্লিন থেকে কোন একটি নির্দিষ্ট ইসলামিক সাইন্সে খুব ভালোভাবে পড়াশোনা সম্পন্ন করার পরেও অর্জন হিসেবে তার ঝুলিতে “প্রাথমিক ধাপটিকে কেবল অতিক্রম করা” ছাড়া আর কিছুই জমা হয় না। স্পেশালাইজেশনের জন্য তাকে আরো ন্যুনতম পনেরো বা বিশ বছর সেই নির্দিষ্ট একটি সাবজেক্ট নিয়ে পড়ে থাকতে হয়।

এই বাস্তবতা মাথায় রাখলে, কোন ব্যক্তি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েট-চুয়েটের মতো সেরা প্রতিষ্ঠানের নির্দিষ্ট সাবজেক্টে সেরা শিক্ষক কিংবা ছাত্র হয়ে থাকলেও ইসলামিক ডিসিপ্লিনে ন্যুনতম ছাত্র হওয়ারও উপযুক্ত না হয়ে থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। ইন ফ্যাক্ট এটা ব্যর্থতা বা দোষেরও কিছু নয়। একই সময়ে একই সাথে অনেকগুলো সাবজেক্টে এক্সপার্ট হতে না পারাটা মানুষের সীমাবদ্ধতা।

(এই পয়েন্টে অনেকে হয়তো পলিম্যাথদের কথা বলবেন যা আমার কথার সাথে সাংঘর্ষিক নয়। কারণ যারা পলিম্যাথ হন, তারাও ভিন্ন ভিন্ন সাবজেক্টে আলাদা আলাদা সময় বিনিয়োগের মাধ্যমেই মূলত পলিম্যাথ হন। তাছাড়া বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় পলিম্যাথ হওয়া সম্ভব কিনা সেটা নিয়ে আমার যথেষ্ট সংশয় আছে)। মূলত এই সীমাবদ্ধতাকে বুঝতে না পারার কারণেই এই প্রান্তিকতার সৃষ্টি হয়।

এই প্রান্তিকতার কিছু উদাহরণ হলোঃ বিভিন্ন সময় “প্রগতিশীল” দাবিদার কিছু মানুষ ইসলামিক সাইন্সের অ-আ-ক-খ জানা না থাকার পরেও ইসলামিক রুলিংসে (যেমনঃ হিজাব, ইসলামে রাজনীতি ইত্যাদি বিষয়) হুটহাট সিদ্ধান্ত দিয়ে অনধিকার চর্চা করে থাকেন।

অন্যদিকে ২য় ধারাটির দিকে তাকালে দেখবেন যে, এই ধারাটি ইসলামকে ভালোবাসেন এবং নিয়মিত ইসলামিক রিচুয়াল প্র‍্যাক্টিস করেন। যার কারণে তাদের মধ্যে এক ধরনের রিলেজিয়োসিটি কমপ্লেক্সে তৈরি হয়। তাদের হাবভাব দেখলে মনে হয় যে, ইসলামের প্রতি ভালোবাসা ও আনুগত্য থাকলে অন্য যে কোন ডিসিপ্লিনে এক্সপার্টের মতো মন্তব্য করা যায়!

অথচ এক্ষেত্রে তারা আল্লাহর রাসূলের (সাঃ) অনন্য শিক্ষাটির প্রতি লক্ষ্য করেন না।

একদিন আল্লাহর রাসূল (সাঃ) একদল খেজুর চাষীদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন যারা পরাগায়ন করছিলেন। সেটা দেখে রাসূল (সাঃ) বললেনঃ “যদি তোমরা এমনটা না করতে তাহলে ভালো হতো”। পরাগায়ন না করার ফলে খেজুর উৎপাদন প্রচন্ড ব্যাহত হলো। আরেকদিন রাসূল (সাঃ) তাদের পাশ দিয়ে যাবার সময় এ অবস্থা দেখে জিজ্ঞেস করলেনঃ “তোমাদের খেজুরের এই অবস্থা কেন?” তারা বললেন আপনি পরাগায়ন করতে নিষেধ করেছিলেন। না করার কারণে এই অবস্থা। এ কথা শুনে রাসূল (সাঃ) বললেনঃ “তোমাদের দুনিয়াবী বিষয়ে আমার চেয়ে তো তোমরাই ভালো জানো”। [সহীহ মুসলিম, ২৩৬৩ নং হাদিস]

হাদিসটি থেকে শেখার অনন্য জায়গাটি খেয়াল করুন। এই হাদিসটিতে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) দুনিয়াবী বিষয়ের ক্ষেত্রে যারা যে বিষয়ে এক্সপার্ট সেটি তাদের জন্য ছেড়ে দিচ্ছেন। অথচ অতি-ধর্মবাদী এই ধারাটিকে আমরা এমন বিভিন্ন স্পর্শকাতর বিষয়ে নির্দ্বিধায় জাজমেন্টাল কথা বলতে শুনি, যেসব বিষয়ে ধর্মীয় দিক থেকে মূলত কিছুই বলা বা করার জায়গা থাকে না বা থাকলেও খুব অল্প পরিমাণে থাকে।

উদাহরণ হিসেবে হালের ডিপ্রেশন এর কথা বলা যায়। মনোবিজ্ঞানের অ-আ-ক-খ না পড়েও শুধু নিজেদের রিলেজিয়োসিটির তান্ডবে তারা এমন সব অথরিটি সুলভ লেখালেখি করছেন বা কথাবার্তা বলছেন যা স্পষ্টত রাসূলের (সাঃ) সুন্নাহর বিরোধী।

এখন এ দু’টো প্রান্তিকতা এভয়েড করতে করণীয় হিসেবে আমরা কিছু বিষয় মাথায় রাখতে পারি। যেমনঃ

  • নিজেদের সসীম সক্ষমতা ও সীমাবদ্ধতাকে বুঝতে শেখা এবং স্বীকার করে নেওয়া।
  • যে কোন ডিসিপ্লিনে (সেটা ইসলামিক হোক বা কনভেশনাল হোক) নিয়মতান্ত্রিক পড়াশোনা ছাড়া সে বিষয়ে অথরিটিসুলভ মন্তব্য ও সিদ্ধান্ত দেয়া থেকে বিরত থাকা।
  • নিয়মতান্ত্রিক পড়াশোনার তোয়াক্কা না করে যে কোন বিষয়ে নাক গলানো বা কথা বলার মতো বাজে অভ্যেসকে ত্যাগ করতে চেষ্টা করা এবং পাশাপাশি চুপ থাকার প্র‍্যাক্টিস করতে শেখা।

– শায়খুল আজম আবরার

২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

Back to top button