সিরিয়াস কথা
– তোমার সাথে কথা আছে। সিরিয়াস। খুব সিরিয়াস।
– সিরিয়াস কথার সময় নেই এখন। খুব সিরিয়াস একটা লেখা নিয়ে ব্যস্ত আছি।
– তোমার সিরিয়াস লেখার গুষ্টি কিলাই। দশ মিনিটের মধ্যে নিউমার্কেট আসো। চা খেতে খেতে বলছি ঘটনাটা।
অগত্য সন্ধ্যেবেলা বের হলাম। যতটা না সিরিয়াস কথা শুনতে তারচে’ বেশি একসাথে চা খাবার লোভে। যাচ্ছি আনাসের সাথে দেখা করতে। ওর সাথে চাঁপাইয়ে এসে পরিচয় হয়েছে। অল্প কয়েকদিনেই বেশ ঘনিষ্ঠ আমরা। দ্বীনি ভাই বলেই হয়তো। বয়সে আমার চেয়ে দুই বছরের ছোট ও। তাও ‘তুমি’- করে বলে আমাকে। আমার অবশ্য এতে কোনো আপত্তি নেই। ডাকুক যা ইচ্ছে। ওকে বলেছি, তোমার ইচ্ছে হলে আমাকে ‘তুই’ বলেও ডাকতে পারো।
আনাস চোখ-মুখ শক্ত করে বলে, আমার সাথে এতো ঠাট্টা কেন করো তুমি?
ছেলে হিসেবে আনাসের তুলনা নেই। খুব মিশুক এবং ভদ্র। একটাই সমস্যা- প্রচণ্ড বোকা। সেন্স অফ হিউমারও ভালো না। যাক গে, সবার তো আর সব থাকবে না। দুইদিন হয়েছে আনাস বিয়ে করেছে। কীভাবে বিয়ে হয়েছে সেটা এক ইতিহাস। সে ইতিহাসের গল্প আরেকদিন বলব। ছেলেরা সাধারণত নতুন নতুন বিয়ে করলে সুকুনের সমুদ্রে ডুবে থাকে। বউকে নিয়ে নানা ‘আলহামদুলিল্লাহ’- সূচক আবেগঘন স্ট্যাটাস দেয়। বেদ্বীনি হলে কয়েক মাস সংসার করেই ‘Forever Together’- লিখে কাপল ফটো আপ্লোড দেয়। এ সময়ে পরিচিতি ভাই কিংবা বন্ধুদের দেয়ার মতো সময় তারা বের করতে পারে না। আনাস কীভাবে পারল সেটা এক রহস্য। কোনো সমস্যা হয়নি তো আবার?
নিউমার্কেট যেয়ে দেখি সাটু হল মার্কেটের সামনে আনাস মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছে। কী হ্যান্ডসাম একটা ছেলে! বাবরি চুল, ঘন দাড়ি। হলুদ ফর্সা মুখ। উচ্চতায় আমার চেয়েও লম্বা। যারা বলে দাড়িওয়ালা ছেলেরা দেখতে সুন্দর না, তারা একবার আনাসকে এসে দেখুক। আমাকে দেখেই হাহাকার জড়ানো গলায় বলল, ভাই এসেছ! আমার তো সর্বনাশ হয়ে গেছে।
আমি মুখ টিপে হেসে বললাম, কী হয়েছে? বউ ভেগেটেগে যায় নাই তো?
আনাস রাগী কথা বলল, রসিকতা করবে না তো। আজকে রসিকতা শোনার সময় নেই। এমনেই তোমার কথা শুনে খুব বিপদে পড়েছি। এখন মনে হচ্ছে তুমি আসলে মজা করে আমাকে ফাঁসিয়েছ। সত্যি করে বলো তো? বিয়ে নিয়ে তুমি যে পরামর্শগুলো দিয়েছো, সব মজা করে দিয়েছ, তাই না?
এবার সত্যিই সিরিয়াস গলায় বললাম, ইন্নালিল্লাহ! ছিঃ! এসব বিষয় নিয়ে কেউ মজা করে? যা বলেছি, সিরিয়াসলিই বলেছি। আমি মজা করি সত্যি, তাই বলে এতো মজা তো করি না।
আনাস বলল, তাহলে তোমার কথা শুনে আমার এই দুই দিন পুরা পণ্ড হয়ে গেলো যে। তোমাকে সব খুলে বলতে হবে। না হলে উপায়ও নেই।
এবার আমার মন খারাপ হওয়া শুরু হলো। যেসব থেকে পালিয়ে বেড়াই সেগুলোই কেন যেন আমার সামনে এসে পড়ে। এখন বসে বসে বাইশ বছরের এক আবেগী যুবকের বিয়ের গল্প শুনতে হবে। সময়ের কী নিদারুণ অপচয়! আজ আর ‘ইলম অর্জন করা হলো না।
মন খারাপের ভাব লুকিয়ে বললাম, চলো আলাউদ্দিন হোটেলে যাই। সেখানে চাইনিজ কর্ণারে বসলে একটু নির্জনে কথা বলা যাবে।
আলাউদ্দিনে যেয়ে আনাস তার বিশাল গল্প বলা শুরু করল-
-তুমি বিয়ে নিয়ে যতো বই সাজেস্ট করেছিলে তার একটাও পড়া বাদ রাখিনি। অসংখ্য লেকচারও শুনেছি। তুমি যে পরামর্শ দিয়েছো, সে অনুযায়ীই সব করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু কিছুই হলো না প্ল্যানমত।
– প্ল্যানমত হবে না কেন?
– কিছুই বুঝতে পারলাম না। বাসর রাতে বউয়ের সামনে যেয়ে কপালে হাত রাখলাম। তারপর….
– ইয়ে মানে! তোমার বাসর রাতের গল্প আমাকে না বললে হয় না। আমার এসব শুনতে কোনো আগ্রহ নেই। তাছাড়া এসব বলা উচিতও না।
– আরে আমি কি তোমাকে খুশিতে-ঠ্যালায়-ঘোরতে এসব বলছি নাকি? সমস্যা না শুনলে বুঝবে কী করে?
– ঠিক আছে বলো।
– যা বলছিলাম। বউয়ের কপালে হাত রেখে দু‘আ পড়তে হয় জানোই তো। সমস্যা হলো, নার্ভাসনেসের কারণে দু‘আটা ভুলে গেলাম। ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা খইরহা’- এতটুকু বলে আর মনে করতে পারছিলাম না। এ কী? হাসছ কেন? খবরদার হাসবে না।
– আচ্ছা, ঠিক আছে। হাসি বাদ দিলাম।
আনাস হতাশ গলায় বলল, তোমাকে দোষ দিয়ে লাভ কী? দেখি বউ নিজেই মিটিমিটি হাসছে।
– তখন কী করলে?
– কী আর করব? মোবাইল থেকে হিসনুল মুসলিমের অ্যাপ বের করে দেখে দেখে দু‘আ পড়েছি। এটা দেখে বউ আমার মিটিমিটি হাসি বাদ দিল। একদম খিলখিল করে হাসা শুরু করল। আমার তো একদম রাগ উঠে গেল। মেয়েদের লাজ-লজ্জা কি এখন আসলেই কমে যাচ্ছে নাকি? কোথায় বর ভুল করেছে। দেখেও না দেখে ভান করবে। তা না! ভেটকি মাছের মতো হাসা শুরু করেছেন উনি। অবশ্য হাসলে ওকে খুব সুন্দর লাগে। গালে সুন্দর টোল পড়ে।
আমি খুক খুক করে কেশে বললাম, নিজের বউয়ের রূপ পরপুরুষের কাছে বর্ণনা করা গুনাহের কাজ।
– ওহ আচ্ছা। সরি! আচ্ছা আর বলব না। বাকী গল্পটুকু বলি শোনো। তারপর হতাশ হয়ে বউকে বললাম, চলো দুই রাকাত সালাত পড়ি একসাথে। ও কিছু না বলে সুন্দরমত আমার পিছে গিয়ে দাঁড়ালো। মনে মনে বললাম, সুন্দরী! ঘুঘু দেখেছ! ঘুঘুর ফাঁদ দেখোনি। এইবার দেখবে। সূরা মরিয়াম আর সূরা ত্ব-হা তো ঠাডা মুখস্থ পারি। ঠিক করলাম, দুই রাকাতে এই দুই সূরা পড়ব। খুব তো হেসেছ। এইবার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা বুঝো। হাসি কাকে বলে? ও কতো প্রকার!
– তুমি তো খুব নিষ্ঠুর মানুষ। প্রথম রাতেই বউকে এতক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখলে! বেচারী কতো ক্লান্তিতে ছিল। সারাদিন কী টেনশনই না গিয়েছে।
আনাস রাগীরাগী গলায় বলল, তুমি খুব বেশি কথা বলো। আগে শুনবে তো আমার কথা। নামায পড়তে গিয়ে দেখি সূরা ফাতিহা পড়তেই প্যাঁচ লাগিয়ে ফেলছি। ‘মালিকি ইয়াওমিদ্দিন’ এর পর ‘ইয়্যা কানা’আ বুদু’ না পড়ে ‘ইহদিনাস সিরাতল মুস্তাকিম’ পড়ছি। মরিয়ম কিংবা ত্ব-হা পড়ার সাহসই পেলাম না আর। কোনোমত ইখলাস আর কাওসার পড়ে নামায শেষ করলাম। পিছে ফিরে দেখি বউ আমার মোনাজাতের ভঙ্গী করে মুখ ঢেকে রেখেছে। শরীর মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে। মোনাজাত না ছাই! আসলে ও তখন হাসি থামানোর চেষ্টা করছিল। ঠিক বুঝে গিয়েছিলাম আমি।
আমি সারকাস্টিক গলায় বললাম, বাহ! তুমি তো অনেক বুঝো!
আনাস এটাকে প্রশংসা হিসেবে ধরে নিয়ে বলল, তা আর বলতে। তবে এবার হাসি দেখে আর রাগ হলো না। একটা মেয়েকে এতো হাসাতে পারছি, প্রাপ্তি হিসেবে এটাই বা কম কী বলো? হঠাৎ করে আমার মধ্যে প্রেমপ্রেম ভাব উদয় হলো। তুমি আমাকে যতগুলো বই সাজেস্ট করেছিলে, সেখান থেকে একটা বইয়ের কিছু ডায়লগ আমি আগেই মুখস্থ করে রেখেছিলাম। সেগুলো ওকে বলা শুরু করলাম।
– কোন ডায়লগ?
আনাস কিছুটা লজ্জা পেলো। তারপর নীচের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত রবোটিক গলায় বলা শুরু করল, তুমি কিন্তু আমার ওপর রাগ করে থাকতে পারবে না। আমি রাগ করলেও না। আর শোনো! আমি পুঁটি মাছের দো-পেয়াজা খুব পছন্দ করি। কলই ডালের বড়া খেতে পছন্দ করি, তুমি না পারলে শিখে নেবে।
আর তোমার প্রিয় মাছ কোনটা সেটা আমাকে জানিয়ে দেবে…..।
তুমি যদি পঙ্গুও হয়ে যাও, আমি তোমার সেবা করে বাকি জীবন কাটিয়ে দেব। তুমি অন্ধ হয়ে গেলে আমি তোমার হাতের লাঠি হব। তুমি বোবা হয়ে গেলে আমি তোমার কথা হয়ে থাকব। তুমি স্মৃতিহীন হলে তোমার স্মৃতি হয়ে থাকব। তবুও তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাব না। তোমাকে নিজ হাতে খাইয়ে দেব, নাইয়ে দেব। চুল আঁচড়ে দেব। বেণি করে দেব। তোমার সাথে সাপ-লুডু খেলব। রাতের বেলায় তালপাখায় বাতাস করে তোমায় ঘুম পাড়াব। দখিনের জানালা খুলে চাঁদনি রাত কাটাব। তোমার শিয়রে বসে গল্প শোনাব। চুলে বিলি কেটে তোমার মাথাব্যাথা ভালো করে দেব। গভীর রাতে কুপি জ্বেলে তোমাকে ‘বাহির’ থেকে ঘুরিয়ে আনব। তোমার পাতের মাছের কাঁটা আমি বেছে দেব। তোমার জন্যে পিতলের তৈরি পানের বাটা এনে দেব। শেষরাতে শীতল বাতাসের পরশে, কুণ্ডুলী পাকিয়ে ঘুমিয়ে থাকা তোমার গায়ে আলগাছে সুজনী কাঁথা ছড়িয়ে দেব।
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, এভাবে রোবটের মতো করে বউকে বলেছিলে?
আনাস অবাক হয়ে বলল, তাতে সমস্যা কী?
– না, সমস্যা থাকবে কেন?
– আবার মজা করছ, তাই না? সমস্যা তো ছিলই। না হলে এই ডায়লগ শুনে বউ আমার কাঁদা শুরু করবে?
আমি মনে মনে বললাম, এজ এক্সপেক্টেড।
আনাস মন খারাপ করে বলল, এই ডায়লগ শুনে বউ বলে, আমি কী দেখতে এতই খারাপ যে আমাকে বলার জন্য আপনার অন্য বই থেকে ডায়লগ মুখস্থ করা লাগবে? কেন? আমাকে দেখে কি নতুন করে কিছু বলা যায় না?
– বাহ! উনি ধরে ফেলেছেন যে, এটা বই থেকে কপি করেছ? অবশ্য ধরে ফেলা কঠিন কিছু না। যেভাবে রোবটের মত ডায়লগ বলতেছিলা।
– আসলে তা না। ও অনেক বই পড়ে। গল্প আর কবিতা পড়তে ভালোবাসে।
– বাহ! কোন ভার্সিটিতে পড়েন উনি?
– আরে ভার্সিটিতে কেন পড়বে? সামনেরবার ইন্টার দিবে।
– বলো কী? শিশু বিয়ের অপরাধে তোমাকে তো হাজতে ঢুকানো উচিত।
আনাস আবার বিরক্ত গলায় বলল, আরেকবার রসিকতা করবে তো আমি কিন্তু চলে যাব। তোমার কাছে সমাধান চাইতে এসেছি। বউ রাগ করে দুইদিন আমার সাথে কথা বলছে না। আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না। নামাযে মন বসে না। খেতে পারছি না। রাতে ঘুমোতে পারছি না।
– হয়েছে। থামো, থামো। ভাবি একটু। উনার নাম কী বললে?
– নাম বলিনি তো। নাম দিয়ে কী করবে?
– সমস্যা না থাকলে বলো।
– ফারহানা রাইসা।
– বোন রাইসা কবিতা খুব পছন্দ করেন, তাই না?
– হ্যাঁ। তুমি কীভাবে জানলে?
– তুমিই তো একটু আগে বললে গাধা কোথাকার। আচ্ছা ইশার আযান দিচ্ছে। দশটার দিকে তোমাকে একটা জিনিস পাঠাব। ওটা চিরকুটে করে লিখে বউয়ের হাতে দিবে। প্রতিটা লাইনের প্রথম অক্ষর নীল কালিতে লিখবে। শুধু চিরকুট দিয়ে বসে থাকবে না। হাত ধরে সুন্দর করে সে কবিতা মুখস্থ করে শোনাবে বউকে। আর শোনো! দয়া করে রোবটের মতো করে কথা বলার অভ্যাস ত্যাগ করো।
রাত দশটার দিকে আনাসের মোবাইলে মেসেজ পাঠালাম একটা-
“ফাগুন চলে গেছে, চলে গেছে শুকনো পাতার দল,
রয়ে গিয়েছিল কিছু ব্যাথা, হৃদয়ে ছিল একাকীত্বের ঢল।
হাসি ছিল তোমার প্রথম উপহার, কী সুন্দর করেই না তুমি হাসতে।
না হয় সেই হাসি দেখতেই আজীবন শুধু ভুল করতাম, তখন কি তুমি কাঁদতে?
রাতটা যেভাবে কাটাতে চেয়েছিলাম সেভাবে তো কাটেনি,
ইচ্ছে ছিল অনেক কিছু বলার, লজ্জায় কিছুই বলিনি।
সাথী আমার! আরেকবার কি হাসা যায় না, ওগো সুহাসিনী?”
কবিতা খুব একটা মনঃপুত না হলেও কাজ চালানোর মতো হয়েছে বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু পরদিন সন্ধ্যেবেলা আবার আনাস ফোন দিয়ে বলল-
– তোমার সাথে কথা আছে। সিরিয়াস। খুব সিরিয়াস।
— Shihab Ahmed Tuhin
মাশাআল্লাহ গল্পটা অনেক সুন্দর। এই গল্টটা কি আমি আমার ইউটিউবে ভিডিওআকারে উপস্থাপন করতে পারি? লেখকের নাম ঘোষণা করা হবে ইনশাআল্লাহ……… অনুমতি দিলে খুব খুশি হবো। আপনার ফেচবুক লিংক দিলে আরো ভালো হবে।
মাশাআল্লাহ খুবই সুন্দর পোস্ট আল্লাহ আপনাদেরকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাক.
যাজাকাল্লাহ ।
ওয়া ইয়্যাকা।