নির্বাচিত ফেসবুক স্ট্যাটাস

ইসলামের ব্যাপারে চাপিয়ে দেয়া স্ট্যান্ডার্ড

ধরুন সাদা পাঞ্জাবী পরে আপনি কারো জানাযায় গেলেন। আপনার পোশাক নিয়ে দুজন মন্তব্য করলো।

প্রথমজন বললো : ও সাদা পাঞ্জাবী পরে এসেছে
দ্বিতীয়জন বললো : ও কালো পাঞ্জাবী পরে আসলে ভালো হত

এ দুজনের মন্তব্যের মধ্যে পার্থক্য কী? অনেক ধরণের পার্থক্যই আছে তবে আমরা মৌলিক একটা পার্থক্যের ওপর ফোকাস করবো।

প্রথমজনের কথা একটা statement of fact – সে জাস্ট একটা তথ্য জানাচ্ছে। নিরেট ইনফরমেইশান। এর সাথে আর কোন কিছু চাপিয়ে দেয়া নেই। দ্বিতীয় জনের বক্তব্য হল তার ব্যক্তিগত মত, কোন ফ্যাক্ট না। জানাযাতে সাদার বদলে কালো পরে আসলেই ভালো? কালোই কি বেস্ট চয়েস নাকি রঙটা অফ-ওয়াইট কিংবা নীল বা অন্য কিছু হতে পারে?

এধরনের প্রশ্নের অনেক রকমের উত্তর হতে পারে। একেকজনের কাছে একেক রঙ ভালো লাগতে পারে। কিন্তু দ্বিতীয়জনের এ বক্তব্য কোন নিরেট তথ্য না। অনেক মতের মধ্যে একটা মত কেবল। প্রথম জনের বক্তব্য একটা পযিটিভ স্টেইটমেন্ট। দ্বিতীয়জনের বক্তব্য নরম্যাটিভ। যে বক্তব্য শুধুমাত্র কোন বাস্তব সত্য বা তথ্যকে তুলে ধরে সেটা পযিটিভ। অন্যদিকে নরম্যাটিভ বক্তব্য হল যা নির্দিষ্ট মত (যেমন ঔচিত্য) বা নৈতিকতা প্রকাশ করে।

এ পার্থক্যটা মাথায় রাখুন।
.
২.
লক্ষ্য করবেন ইসলামের সাদা ও কালো চামড়ার (এবং অন্যান্য সব শেইডের) সমালোচকরা ঘুরেফিরে কিছু পয়েন্টে ফিরে আসে। ইসলামের বিরুদ্ধে তোলা তাদের আপত্তিগুলো এ মূল পয়েন্টগুলোর শেকড় থেকে বের হয়ে বিভিন্ন শাখাপ্রশাখার দিকে যায়। এ শাখাপ্রশাখাগুলোর অনেকগুলোই আপনার চেনা। যেমন,

⚫ ইসলামে নারীকে পূর্ণ অধিকার ও মর্যাদা দেয়া হয় না
⚫ ইসলামে বাকস্বাধীনতা নেই
⚫ সমকামীদের প্রতি ইসলামের অবস্থান উগ্র
⚫ ইসলাম মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দেয় না
⚫ ইসলাম ধর্মের স্বাধীনতা দেয় না
⚫ ইসলাম সাম্প্রদায়িক
⚫ ইসলাম মানবাধিকার রক্ষার দিকে যথাযথ গুরুত্ব দেয় না
⚫ নারীপুরুষের মেলামেশা ও যৌনতার ব্যাপারে ইসলামের ধারণা ব্যাকডেইটেড
⚫ ইসলাম সহিংসতাকে সমর্থ করে”, ইত্যাদি।
.
দেখবেন কাফিরদের মধ্যে যারা ইসলামের সমালোচনা করে অথবা মুসলিম পরিবারের জন্ম নিয়ে যারা নাস্তিক, অজ্ঞেয়বাদী অথবা ইসলামবিদ্বেষী হয়, ইসলাম মানার ব্যাপারে তাদের অস্বস্তি, আপত্তি ও অভিযোগের বিশাল একটা অংশ এগুলোর মধ্যে ঘুরপাক খায়। অনেকের সংশয় কিংবা বিদ্রোহের শুরুটা হয় এমন কোন চিন্তাকে কেন্দ্র করে।
.
অন্যদিকে এ অভিযোগগুলো করা হলে মুসলিমদের মধ্যে অনেকে ব্যস্ত হয়ে যান যে ইসলামেও নারী অধিকার আছে, ইসলাম সবচেয়ে মানবিক ধর্ম, ইসলাম মানে শান্তি, ইসলাম সবচেয়ে সহনশীল – ইত্যাদি প্রমানে।
.
কিন্তু এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ের দিকে মনযোগ দেয়া দরকার, যদিও আমরা কেউ দেই না বললেই চলে। সেটা কী? দেখুন এই যে সমালোচনাগুলো করা হচ্ছে এগুলোর প্রতিটির পেছনে ভালো-মন্দের একটি নির্দিষ্ট ধারণা কাজ করছে। নৈতিকতার একটি নির্দিষ্ট ফ্রেইমওয়ার্ক থেকে এ আপত্তিগুলো তোলা হচ্ছে। আচ্ছা বলুন তো –
.
নারীকে পুরুষের সমান অধিকার কেন দিতে হবে? কেন সমকামিতাকে বিকৃতি মনে না করে সমকামীদের অধিকার আদায়ের চেষ্টা করতে হবে? কেন একজন মুসলিম আর একজন অমুসলিমকে সমান মনে করতে হবে? নারীপুরুষের যৌনতার ব্যাপারে বর্তমান পৃথিবী যে অবস্থান গ্রহণ করেছে সেটাকে কেন ঠিক মনে করতে হবে?
.
কেন এটা খারাপ আর ওটা ভালো? কীসের ওপর ভিত্তি করে? কোন মাপকাঠি অনুযায়ী?
.
বিজ্ঞান? ওপরের একটা প্রশ্নের সাথেও বিজ্ঞানের কিংবা আরো নির্দিষ্টভাবে বললে নিরেট তথ্য, বাস্তবতা কিংবা ফ্যাক্টের কোন সম্পর্ক নেই।
.
ইনফ্যাক্ট বিজ্ঞান আপনাকে বলবে নারী এবং পুরুষের ব্রেইনের গঠন এবং ফাংশান ভিন্ন যা তাদেরকে ভিন্ন ভিন্ন কাজের জন্য উপযোগী করে। ফ্যাক্ট আপনাকে বলবে যুদ্ধ রাষ্ট্রের নামে হয়, দর্শনের নামে হয়, স্বার্থের জন্য হয়, গায়ের রঙের জন্যও হয়। যখনই মানুষের দু দলের মধ্যে মতবিরোধ শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করা যায় না এবং এক বা উভয়পক্ষ মতবিরোধ মেনে নিয়ে সহাবস্থান করতে চায় না, তখন সংহিসতার মাধ্যমে এ মতবিরোধের ফয়সালা করতে হয়। এটা মানবজাতির ইতিহাসের এক ধ্রুব সত্য।
.
কেন বহুবিবাহ খারাপ আর ‘সমকামী বিয়ে’ ভালো? কেন মুরতাদের জন্য মৃতুদন্ড বর্বর কিন্তু রাষ্ট্রদ্রোহীর জন্য মৃত্যুদণ্ড জায়েজ? কেন আর কেউ শক্তি ব্যবহার করলে সেটা বেআইনি কিন্তু রাষ্ট্র করলে সেটা বৈধ? এরকম অনেক প্রশ্ন ওঠানো যায়। কেন এটা খারাপ আর ওটা ভালো? হতে পারে যে কোন কোন ক্ষেত্রে যেটাকে ভালো বলা হচ্ছে সেটা আসলেই ভালো। কিন্তু এ ভালোমন্দটা ঠিক করা হচ্ছে কীভাবে? বন্ধ ঘড়িও ২৪ ঘন্টায় দুবার ঠিক টাইম দেয় তাই বলে বন্ধ ঘড়ির ওপর ভরসা করা যায় না।
.
আমি যা বোঝাতে চাচ্ছি তা হল, এসব সমালোচনার পেছনে নৈতিকতার একটি নির্দিষ্ট ফ্রেইমওয়ার্ক আছে। ভালোমন্দের একটি নির্দিষ্ট ধারণা থেকে এই উপসংহারগুলো বের হচ্ছে। সেই ফ্রেইমওয়ার্কটা কী? সেই মতাদর্শটা কী?
.
লিবারেলিযম, সেক্যুলার হিউম্যানিযম। এনলাইটেনমেন্টের গর্ভ থেকে বের হয়ে আসা বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গি।
.
এ ফ্রেইমওয়ার্ক আমাকে যেসব উপসংহার দিচ্ছে সেগুলো নরম্যাটিভ, পযিটিভ না। আপনার কাছে মনে হতেই পারে যে জানাযার জন্য সবার গোলাপী রঙের ফতুয়া পরে আসা উচিৎ। কিন্তু আপনার মনে হওয়া আপনার মতকে ঠিক প্রমাণ করে না। দাবিকে সত্য বলতে হলে প্রমাণ লাগবে। সেক্যুলার হিউম্যানিযম বা লিবারেলিযমের উপসংহারগুলোকে ধ্রুব সত্য বলে আমার ওপর চাপিয়ে দেয়ার আগে আপনাকে প্রমাণ দিতে হবে যে এটা নিছক আপনার মত না, বরং এটাই সত্য। ২+২ সমান ৪ এটা একটা ফ্যাক্ট। এটা অস্বীকার করা সম্ভব না। কিন্তু ২+২ = ২২ হওয়া উচিৎ ছিল, এটা নিছক দাবি।
.
৩.
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল, ভালোমন্দের এই ফ্রেইমওয়ার্ক কেন আমি মেনে নিতে বাধ্য? কয়েকশো বছর আগে ইউরোপের ঔপনিবেশিক লুটেরারা নিজেরা নিজেরা ভেবেযে মানদন্ড বানিয়েছে সেটা আমি মানবো কেন? নাস্তিক-ইসলামবিদ্বেষীরা প্রশ্ন করে – ‘আমি স্রষ্টার অস্তিত্ব মেনে নেব কেন? কুরআনে আছে বলে আমাকে মানতে হবে কেন’?
.
অথচ এই একই স্ট্যান্ডার্ড তারা নিজেদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করে না।
.
তুমি যেটাকে ভালো বলছো সেটাকে আমার ভালো বলে মেনে নিতে হবে কেন? তোমার দেয়া মানবাধিকার, অগ্রগতি আর উন্নতির সংজ্ঞাকেই কেন গ্রহণ করতে হবে? তোমাদের ঠিক করা ভালোমন্দের কনসেপ্টকে আমার কেন মানতে হবে? তুমি আমাকে বলছো পুরো মানবজাতির ইতিহাস থেকে মাত্র দু-তিনশো বছরের অল্প একটা টাইম পিরিয়ড নিয়ে, ইউরোপের অল্প কিছু মানুষের চিন্তাভাবনাকে ধ্রুব সত্য বলে মেনে নিতে? এবং আমার পুরো দৃষ্টিভঙ্গিকে এই ‘সত্যের’ ওপর ভিত্তি করে সাজাতে? অথচ তোমার দাবিগুলোর পক্ষে কোন প্রমাণ তোমার কাছে নেই?
.
এটা হল পশ্চিমের চাপিয়ে দেয়া ন্যারেটিভের সবচেয়ে বড় বুদ্ধিবৃত্তিক অসততার একটি। পশ্চিম আমাকে বলে বস্তুবাদী প্রমাণ ছাড়া স্রষ্টার আনুগত্য করা যাবে না। কিন্তু প্রমাণ ছাড়া মানুষের আনুগত্য করতে হবে। বিনা প্রশ্নে! দুঃখজনক বিষয়টা হল পশ্চিমের এ দাবিগুলোকে আমরা অনেকে নিজের অজান্তেই সত্য বলে মেনে নেই। এবং এগুলোকে সত্য ধরে নিয়ে এমনভাবে নিজেদের পরিচয় ও ইসলামকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি যাতে তা এই মানুষের বানানো ফ্রেইমওয়ার্কের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। আমরা ইসলামকে যখন সমর্থন করি তখনও সেটা পশ্চিমের শেখানো ভাষায় করি। সেক্যুলার হিউম্যানিযমের কাছে উপাদেয় করা চেষ্টা নিয়ে করি।

আর এটা; আমার ব্যাক্তিগত মতে, আমাদের সবচেয়ে বড় বুদ্ধিবৃত্তিক ও মনস্তাত্ত্বিক পরাজয়।

 

 


লিখেছেন: আসিফ আদনান

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button