শিক্ষাটা টাকা কামানোর টুল না, সার্টিফিকেটবাজির চেয়ে জীবনটা অনেক বড়

পড়াশোনা ব্যাপারটা খুব ভালো লাগে। পড়তে, পড়াতে।
একটা স্কুলে সায়েন্স, কেমিস্ট্রি আর ক্যারিয়ার স্টাডিজ পড়াই – ফ্রি। সকাল আটটা থেকে ক্লাস নিয়ে দশটায় সরোবরের অফিসে আসি।
ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে জনগণের টাকায় জেনেটিক এনজিনিয়ারিং পড়েছি – এইটা তার পে-ব্যাক।
নতুন এবং গরীব বিভাগ হওয়ায় অনেক শিক্ষকরা আমাদের ফ্রি পড়িয়েছেন – এটা সবসময় মনে রাখি। উনাদের আত্মত্যাগের প্রতিদান হয় না, তাও নিজের মতো কিছু একটা দেয়ার চেষ্টা করি।
নতুন হচ্ছে এমন একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল থেকে ডাকল – তাদের যেন সাহায্য করি। ঘরের খেয়ে বুনো হাতি তাড়াই – গেলাম।
২২ জন শিক্ষককে ভাইভা নিয়ে একজন নিয়োগ দিতে পারলাম – জিপিএ ফাইভ জেনারেশনের এতই ভয়াবহ অবস্থা।
যাকে নিয়োগ দিলাম সে পেশায় শিক্ষক নয়, তবে আগ্রহ আছে – শিখে নিতে পারবে এই আশায় দিলাম।
পরে মাদ্রাসাতে ঢোকার আগেই পরিচিত অভিভাবকরা ঘেরাও করল – শিক্ষক নাকি কিছুই পারে না।
নিজেকে বলদ বলদ লাগল – কাকে নিলাম তাহলে এত বেছে?
অভিভাবককে জিজ্ঞেস করলাম – কিছুই পারে না মানে?
শুনলাম কোনো একটা গ্রামার নাকি ভুল পড়িয়েছে। বুঝলাম মহাবিপদ – অতি সচেতন অভিভাবক!
কয়েকদিন পরে প্যারেন্টস-গারজিয়ান মিটিং।
শিক্ষকেরা অনুরোধ করলেন, ম্যানেজমেন্ট কমিটির সদস্য হিসেবে যেন থাকি।
থাকলাম। বললাম, একজন একজন করে অভিভাবকদের সাথে কথা বলব।
অভিভাবকেরা বললেন, সবাইকে একসাথে কথা বলতে দিলে মিটিং হবে, নয়ত হবে না। অনুরোধ করলাম। উনারা নারাজ।
বাধ্য হলাম অবস্থান থেকে সরে আসতে। উনারা আসলেন।
কথা বললেন না জেরা করলেন বুঝলাম না। ভাগ্য ভালো উপস্থিত শিক্ষিকাদের হাতে মারেননি।
অভিভাবকদের এই আচরণটা আমার কাছে বেয়াদবি মনে হয়েছিল।
এই কথাটা ম্যানেজমেন্টকে জানালাম।
আমি বাদে ম্যানেজমেন্টের সবার বাচ্চাই ওখানে পড়ে।
উল্টো শুনলাম কোন সাহসে অভিভাবকদের বেয়াদব বলি?
বললাম – বেয়াদব বলিনি, তাদের একটা আচরণকে বেয়াদবি মনে হয়েছে। খুব ভালো, ভদ্র একটা মানুষের একটা আচরণকে বেয়াদবি বলা মানে তাদের বেয়াদব বলা নয়।
তর্ক হলো; প্রমাদ গুণলাম।
ঘটনাটা বললাম বোঝানোর জন্য যে অধুনা শিল্পভিত্তিক সমাজে শিক্ষা সিম্পলি একটা পণ্য। টাকা যে দেবে সে কাস্টমার। তার স্যাটিসফেকশন আরাধ্য।
আমরা শিক্ষাকে পণ্য মনে করি না।
ছাত্রের ভালো ফোকাস হতে হবে, ছাত্রের বাবামাকে খুশি করাটা না।
অভিভাবকরা যেটাতে মঙ্গল ভাবছেন সেটাতে প্রকৃত কল্যাণ নাও থাকতে পারে।
দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিলাম।
আমি শুধু শিক্ষক নই, তিনটি স্কুলগামী সন্তানের বাবাও।
বাচ্চারা স্কুলে বকা খায়, শাস্তি পায়। প্রিনসিপালকে বলেছি – যোগ্যতা না থাকলে পরের ক্লাসে তোলার দরকার নাই। থাকুক এক ক্লাসে দুইবার, ভালো করে শিখে তারপরে যাক নতুন ক্লাসে।
সন্তানদের স্কুলে পাঠাই আদব শেখার জন্য, সামাজিকতা শেখার জন্য; রেজাল্ট ভালো করার জন্য না।
আসল যে শিক্ষা – সেটা ওরা শেখে ওদের আনন্দে। তিন ভাই বাসায় পড়তে থাকে। পড়ে আর হাসে। পড়ে আর খেলে। পড়াটাও ওদের কাছে খেলা।
শিক্ষাটা টাকা কামানোর টুল না। শিক্ষা মানে স্কুল, কলেজ আর ইউনিভার্সিটি পাশ দেওয়া না।
সার্টিফিকেটবাজির চেয়ে জীবনটা অনেক বড়।
শিক্ষিত হওয়া মানে আল্লাহকে চেনা, আল্লাহর রসুলকে চেনা, ইসলাম সম্পর্কে জানা। জ্ঞান মানে আল্লাহ যা বলেছেন, আল্লাহর রসুল যা বলেছেন।
আমি যখন সরিষা গাছের ডিফেন্স মেকানিজম পড়ি তখন আল্লাহর সৃষ্টির বিশালতা এবং সূক্ষ্মতা বুঝতে পারি।
জ্ঞান অর্জনের জন্য আরবি জানা দরকার। দরকার ইংরেজি, বিজ্ঞান আর অংক।
এগুলো টুল, অস্ত্র। যে এগুলো ভালো করে শিখবে সে তত ভালো করে আল্লাহকে চিনবে, ইসলামের সত্যতা বুঝবে – সমাজের মানুষের মঙ্গলের জন্য কাজ করবে।
সন্তানদের এটা সব সময়ই বলি। শেখাই।
আশা করি ওরা জীবনে কখনও নকল করবে না, ইন শা আল্লাহ।
নকল করা দরকার ভালো রেজাল্টের জন্য। ওদের ভালো রেজাল্টের চাপ কোনো দিন দেওয়া হয়নি, হবেও না – ইন শা আল্লাহ।
আমি চাই তারা আল্লাহর রাস্তায় জীবন দিক, আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য সবচেয়ে দামী জিনিসটাই দিতে হয়।
আশা করি তারা কখনও নিজের জীবনকে তুচ্ছজ্ঞান করবে না। ইনশা আল্লাহ।
শিশুদের সব কথায় ‘হ্যাঁ’ বলা ভুল। যেখানে প্রয়োজন ‘না’ বলতে হবে।
তাদের সত্য-মিথ্যাটা চেনাতে হবে, সত্য-মিথ্যার পার্থক্য বোঝাতে হবে।
কেন শিখতে হবে শুধু তা না, মানুষ কেন পৃথিবীতে এসেছে সেটা বোঝাতে হবে।
বার বার বলতে হবে – আমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে আল্লাহর ইবাদাত করার জন্য।
এই সমাজে এবং আখিরাতে জাহান্নামের আগুন থেকে আমাদের এবং আমাদের সন্তানদের বাঁচানোর এটাই একমাত্র পথ।
– Sharif Abu Hayat Opu