আত্মপীড়িত তারুণ্য ও জঙ্গীবাদ
চেতনার উন্মেষকাল যে বয়সে শুরু হয়, জীবন ও জগতের নানা আলো-অন্ধকার যখন চিত্তমানসের সূক্ষ্ম রাজপথে গমনাগমন শুরু করে, সে বয়সটিই হল কৈশোর-যৌবনের সম্মিলনকাল। জীবনের মোড় অনেকটাই নির্ধারিত হয়ে যায় এই ধাপটিতে এসে। দিক নির্ধারণী এই পর্যায়টিতে পরিবার ও সমাজ মিলে যে পরিপার্শ্ব, তার ভূমিকাই থাকে প্রায় শতভাগ। কখনও সেই ভূমিকা হয় ইতিবাচক, কখনওবা নেতিবাচক। আজকে যে তরুণদেরকে আমরা বিপথগামী আখ্যা দিচ্ছি, সক্রোধে জঙ্গী বলে ক্ষোভ ঝাড়ছি, তারা কিন্তু এই সমাজে আর দশজনের মতই পিতা-মাতার অপার স্নেহে, পরম মমতায় বেড়ে ওঠা সন্তান। তাদের হিংস্রতা, জঙ্গী মনস্তত্ত্ব একদিনে গড়ে উঠেনি। চলমান সমাজ, রাষ্ট্র কিংবা বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট বহুলাংশে এর প্রভাবক হিসাবে কাজ করেছে।
মানুষ কখন চরমপন্থী হয়ে ওঠে, তা নিয়ে মনোবিজ্ঞানীরা হাযারও বিশ্লেষণ করেছেন। তবে বিশ্লেষণ ছাড়াই এটুকু বুঝা যায় যে, মানুষ যখন নিজেকে অধিকার বঞ্চিত ভাবে, সমাজকে নিজের দুর্ভাগ্যের জন্য দায়ী মনে করতে থাকে এবং তার প্রতিকারের কোন উপায় তার জানা না থাকে, তখনই এর প্রতিক্রিয়া থেকে জন্ম নেয় বিচার-বুদ্ধিহীন মরিয়া পদক্ষেপ, যাকে আমরা চরমপন্থা বলছি। এ কথা অনস্বীকার্য যে, বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি আমরা আমাদের চারপাশে প্রতিনিয়ত প্রত্যক্ষ করছি; যে অত্যাচার, নির্যাতন, সহিংসতা, মিথ্যাচার, প্রতারণা, দ্বিচারিতা, অমানবিকতা, অযৌক্তিকতায় ভরা পৃথিবী আমাদের মুক্ত বিবেকের দুয়ারে প্রতি মুহূর্তে প্রবলভাবে ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে, তা বিশেষতঃ আবেগী তরুণপ্রাণের পক্ষে সামাল দেয়া কঠিনই। তার বিদ্রোহী মন সর্বদা এসব থেকে পরিত্রাণের পথ খোঁজে, সমাধানের উপায় তালাশ করে। তার চিত্তমানস জুড়ে আকুলি-বিকুলি করতে থাকে হাযারো ভাবনা, পরিকল্পনা। জীবনের এই সংশয়াচ্ছন্ন বয়সটিতে যারা সঠিক শিক্ষা ও দিকনির্দেশনা পেয়েছে, সঠিক মানুষদের সংস্পর্শ পেয়েছে, তারা এক সময় সমাধানের পথটি সঠিকভাবে খুঁজে নেয়। কিন্তু যারা এই সৌভাগ্যের অধিকারী হয়নি, বরং কোন পথভ্রষ্ট ও স্বার্থবাদী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর খপ্পরে পড়েছে, তারা সমাধানের শুদ্ধ পন্থার পরিবর্তে সমাজবিধ্বংসী এবং আত্মবিনাশী রাস্তাকেই সমাধানের যথার্থ পথ ভেবে বসে। আগ-পিছ চিন্তা না করে সমাজের প্রতি নিদারুণ দায়বোধশূন্য এক রঙিন ইউটোপিয়া তার অরক্ষিত হৃদয়জগতে খেলা করতে থাকে। যা কেবল মুদ্রার একপিঠই দেখে, অপর পিঠ দেখে না। জীবনের একরৈখিক সীমানাই চেনে, বহুমুখিতার দুয়ার খুলে দেখে না। কল্পিত শত্রুর প্রতি কেবল জিঘাংসার ক্রোধাগ্নিই লালন করে, সর্বাঙ্গীন মানবমুক্তির পথ সন্ধান করে না। জঙ্গীবাদ ও চরমপন্থায় আক্রান্ত ব্যক্তি তাই যে কোন সমাজের জন্য সর্বগ্রাসী আত্মবিনাশের পথ উন্মুক্ত করে।
গুলশান ও শোলাকিয়া হামলার পর লাভের লাভ এই হয়েছে যে, দেশের কথিত বুদ্ধিজীবীদের চোখ কিছুটা হলেও খুলেছে। হিস্টিরিয়া রোগীর মত যারা কথায় কথায় মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থা এবং নিরীহ মাদরাসা ছাত্রদেরকে জঙ্গীবাদের মূল নিয়ামক হিসাবে দেখিয়ে এসেছেন বছরের পর বছর, তারা এখন নতুন করে ভাবতে বসেছেন যে, আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত, সমাজের বিত্তশালী ও সফল অংশের সন্তানরা কেন সুন্দর জীবনের মায়া ছেড়ে এই পথ বেছে নিল? এখন তারা মায়া দেখাচ্ছেন, আত্মসমালোচনা করছেন। কিন্তু শেষ বেলায় সমাধানের পথ খুঁজতে এসে আবার সেই বালখিল্যতার পরিচয় দিচ্ছেন। আগে তারা রব তুলতেন জঙ্গীবাদ দমন করতে হলে মাদরাসা শিক্ষা বন্ধ করতে হবে, আর এখন রব তুলছেন যে জঙ্গীবাদ দূর করতে তরুণদের রবীন্দ্র সংগীত শেখাতে হবে, নাচ-গানের সংস্কৃতি চর্চায় যুক্ত করতে হবে! আসলে এইসব বুদ্ধিজীবীরা কখনই আত্মপীড়িত মুসলিম তরুণদের মনের আগুনকে অনুধাবনের চেষ্টা করেননি, তা নেভানোর গরজও বোধ করেননি। তাইতো তথাকথিত ‘মুক্তমনা’রা যখন মুক্ত-স্বাধীনভাবে অনলাইন জুড়ে বিশ্রী ভাষায় ইসলাম ও ইসলামের নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে গালিগালাজ করছিল, তখন তারা বাকস্বাধীনতার নামে তাদের সপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। দেশের পত্র-পত্রিকাগুলো যখন ইসলামী দল ও প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে একাধারে মিথ্যাচার চালিয়ে এসেছে, জঙ্গী অপবাদ দিয়েছে, তখন তাদের বিরুদ্ধে মারকাটারি রব তুলেছেন। অন্যদিকে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা থেকে যখন ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করার হীন কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে, তখন তারা নিশ্চুপ। ‘পিস টিভি’র মত নখদন্তহীন নিরেট শান্তিবাদী গণমাধ্যমকে মিথ্যা অভিযোগে বন্ধ করা হলেও তারা তাদের বহুল চর্চিত বাক স্বাধীনতা হরণের অভিযোগ তোলেন না। বৈশ্বিক নিষ্ঠুর অপরাজনীতির করাল গ্রাসে দেশে দেশে মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর যখন মর্মন্তুদ নির্যাতন পরিচালিত হচ্ছে, লক্ষ-লক্ষ নিরপরাধ মানুষ ও নারী-শিশুর রক্তের স্রোতে আল্লাহ্র যমীন লালে লাল হয়ে যাচ্ছে, তখন তারা অতি সযত্নে সেসব প্রসঙ্গ থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখেন। সুতরাং এক শ্রেণীর মুসলিম তরুণকে বিক্ষুব্ধ করে তাদেরকে বিপথে ঠেলে দিতে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের দায় কোন মতেই এড়ানোর সুযোগ নেই।
আলেমদেরকে পরামর্শ দেয়ার কোন প্রয়োজন নেই। তারা তাদের দায়িত্ব ঠিকমতই পালন করেছেন ও করে যাচ্ছেন। দেশে এমন কোন ইসলামী সংগঠন নেই, এমন কোন মসজিদ-মাদরাসা নেই, যেটি জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা পালন করে না। সামান্য ইসলামী জ্ঞানও যার আছে, তার পক্ষে কখনই ধর্মের নামে নিরীহ মানুষ হত্যার এই পথ বেছে নেয়ার সুযোগ নেই। আমরা নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি, জঙ্গীবাদের প্রসারে ধর্ম বা কোন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের চুল পরিমাণ ভূমিকা নেই, যদিও সাধারণতঃ ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়েই এদের মধ্যে উন্মাদনা সৃষ্টি করা হয়। সুতরাং জঙ্গীবাদের মূলোৎপাটনে এবং এই সকল পথভ্রষ্ট তরুণদেরকে সুপথে ফিরিয়ে আনতে সরকার ও দেশের জ্ঞানী সমাজকে অবশ্যই সমস্যার মূলে যেতে হবে। সকল প্রকার দায়িত্বহীন আচরণ ও হঠকারী পদক্ষেপ থেকে ফিরে আসতে হবে। দেশে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার ফিরিয়ে আনতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থায় ইসলামী শিক্ষাকে যথাযথ মর্যাদায় স্থান দিতে হবে। ইসলামের সঠিক শিক্ষা সমাজে উন্মুক্তভাবে প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে। তরুণদের কথা শুনতে হবে। তাদেরকে সমাধানের পথ দেখাতে হবে। যদি তাদের মুখ বন্ধ করে দেয়া হয়, তাদেরকে নিরাপত্তাহীন করে তোলা হয়, তাদেরকে গুরুত্ব না দিয়ে কোণঠাসা করে রাখা হয়, মুসলিম হিসাবে আত্মপরিচয়ের সংকটে ফেলে দেয়া হয়, ইসলামবিদ্বেষ অব্যাহতভাবে ছড়ানো হয়, তবে তাদের একটা অংশ জঙ্গীবাদ ও চরমপন্থাতেই সমাধান খোঁজার চেষ্টা করবে। আর তাদের আবেগকে ব্যবহার করবে সুযোগসন্ধানী মহল।
তারুণ্যের ধর্মই দ্রোহ। এই দ্রোহের মন্ত্রে একবার ভুলভাবে দীক্ষিত হলে ন্যায়-অন্যায়ের বিবেচনাবোধ, হিতাহিত জ্ঞান আর অবশিষ্ট থাকে না। তখন যত উপদেশবাণীই শোনানো হোক না কেন, তারা তোয়াক্কা করে না। ধর্ম-অধর্ম মানে না। নিজের জন্য, সমাজের জন্য যে কোন বিধ্বংসী কাজেও পিছপা হয় না। সুতরাং এই দ্রোহের কারণগুলো যত দ্রুত চিহ্নিত করা যাবে এবং তা সমাধানের আন্তরিক উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে, ততই জঙ্গীবাদ নামের এই বিষবৃক্ষ উৎপাটনের পথ উন্মুক্ত হবে। এর ব্যত্যয় ঘটলে জঙ্গী ভূতের এই বাড়বাড়ন্ত অবস্থা আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রকে কোথায় যে নিয়ে যাবে, তা ভাবতেও গা শিউরে ওঠে। সাম্রাজ্যবাদের শিখণ্ডীদের মঞ্চস্থ বিশ্ব ইতিহাসের জঘন্যতম মানবহত্যার উৎসবকেন্দ্র আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম দেশের করুণ পরিণতি আমাদের সেই অশনিসংকেতই দেয়। আল্লাহ আমাদের হেফাযত করুন। আমীন!