কিসের তরে বাঁচবো বল
আমার মা হার্টের রোগী, ক’দিন আগে বুক এফোঁড়-ওফোঁড় করে চিরে বাইপাস সার্জারি করা হয়েছে। তিনমাস পর আবার ক্লাসে যাওয়া শুরু করেছেন দিনকয়েক ধরে। কিন্তু সেদিন দুপুরে হঠাৎ বুকে ব্যাথা ওঠে। আমরা দুই হতভাগা ভাইয়ের কেউই ছিলামনা বাসায়। হাঁচড়ে-পাঁচড়ে রিক্সায় চেপে গেলেন জাতীয় হ্রদরোগ ইন্সটিটিউটে। ইমার্জেন্সি থেকে পিসিসিইউতে ভর্তি করে রাখলো ডাক্তার। আমার ছোটভাই সোহরোয়ার্দি মেডিকেলে পড়ে, খবর পেয়ে ছুটে গেল ওখানে। মা আমার তখনো মেঝেতেই শোয়া। ও প্রথমে ওয়ার্ডবয়কে জিজ্ঞেস করলো বিছানা জোগাড় করে দেয়া যাবে কিনা? ওয়ার্ডবয় জানায় যাবে – তবে টাকা লাগবে। ভাই আমার মায়ের নীতিবোধের কিছুটা পাওয়ায় বলল – আমি সোহরোয়ার্দির ছাত্র, আমি টাকা দেবোনা। অগত্যা কর্তব্যরত ডাক্তারকে নিজের পরিচয় দিয়ে একটা বিছানার মিনতি জানায় ও। ডাক্তার ৩০ নম্বর বেডের রোগীকে ছুটি দিয়ে ওয়ার্ডে পাঠিয়ে দিলেন, আর ওয়ার্ডবয়কে বলে দিলেন মাকে যেন ঐ খালি বিছানায় উঠিয়ে দেয়। ওয়ার্ডবয় দিলনা, গড়িমসি করে আধ ঘন্টা পার করে দিল। এবার তার শিফট শেষ। নতুন লোক এল। নতুন ওয়ার্ডবয়কে বলা হল ডাক্তারের আদেশের কথা। সে জানালো তার ফাইল দেখা লাগবে! ভালো কথা – দেখেন। ঘন্টাখানেক চলে গিয়েছে তার এখনো ফাইল দেখার সময় হয়নি।
আমি ইতমধ্যে পৌছে গিয়েছি হাসপাতালে। দেখলাম অসহায় এক হবু ডাক্তার মুখ চুন করে একবার ডাক্তার, একবার নার্স আর নতুন ওয়ার্ডবয়ের কাছে ধর্ণা দিয়ে বেরাচ্ছে। ৩০ নম্বর বেডের রোগী সব গুছিয়ে বসে আছে, তাকে ছুটি দেয়া হয়েছে কিন্তু কেউ তাকে নিয়ে যাচ্ছে না। আর এদিকে আমার মা অস্থির হয়ে গিয়েছেন। পথেই শোয়া, ৩ ঘন্টা আগে ৩ মিগ্রা মরফিন দেয়া হয়েছে – লোকজনের হাটাচলা আর কথাবার্তায় ঘুমাতে পারছেননা। পিসিসিইউ এর এসি বোধহয় নষ্ট, মাথার উপর ফ্যানটাও। উনার আর সহ্য হচ্ছেনা। জেদ ধরেছেন বন্ড দিয়ে বাড়ি চলে যাবেন। আমরা বুঝিয়ে শুনিয়ে ধরে রেখেছি।
অবশেষে নতুন ওয়ার্ডবয়ের সাথে দেখা হল আমার। তার শরীরের ভাষা আর মুখভঙ্গির সামনে নিজেকে খুব তুচ্ছ মনে হল। মনে হল কিছুক্ষণ আগে যে মোটা বেড়ালদুটো খাবারের খোঁজে বিছানার তলা তদন্ত করছিল সেগুলোও বোধহয় আমার চেয়ে বেশি আত্মসম্মান নিয়ে চলে। আমি ছোট ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম – এই লোকের এত সাহস কোথা থেকে আসে, ডিউটি ডাক্তারের কথারও কোন দাম দিচ্ছেনা!
– সরকারী দলের লোক।
লোকটার দিকে তাকিয়ে একটা ঘৃণার ঢেউ বয়ে গেল সারা শরীর জুড়ে। ঘৃণার সাথে রাগ যোগ করে এমন একটা মানসিক অবস্থা তৈরি হল যে মনে হচ্ছিল যদি লোকটাকে ছিড়ে দু’টুকরো করে ফেলতে পারতাম! সাথে সাথে আল্লাহ আমার মনের চোখের সামনে একটা আয়না ধরলেন তুলে। আমি সেখানে দেখতে পেলাম এই লোক আর আমি একে অপরের প্রতিচ্ছবি! – আমরা দুজনই নিজেদের একান্ত ব্যক্তিগত স্বার্থে আঘাত পড়ায় ক্ষিপ্ত!
এই লোকটা প্রতিদিন রোগীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বিছানা বিক্রি করেছে, আমার কোন সমস্যা হয়নি। আজ যখন আমার কাছ থেকে সে টাকা চেয়েছে তখন আমার শরীরে রাগ-ঘৃণা সব ভর করেছে। অন্যেরা যে জিনিসটা টাকা দিয়ে কেনে সেটা আমি ক্ষমতা দিয়ে কিনতে চেয়েছি, সমাজে আমার অবস্থানগত সুবিধা দিয়ে কিনতে চেয়েছি। যখন কিনতে পারিনি যখন স্বার্থের দ্বন্দ্বে আমি হেরে গেছি তখন আমার দু’পয়সার নীতিবোধ লাফ দিয়ে উঠেছে। আমার চোখে এমন একজন মানুষ সাক্ষাৎ শয়তানের প্রতিমূর্তি হয়ে দাড়িয়েছে যে শুধু আমার কাজটা করে দিলেই তাকে আমি ফেরেশতার পাখা পরিয়ে দিতাম।
দুর্নীতির শুরু ব্যক্তিতে। যখন একটা মানুষ সচেতনভাবে তার দায়িত্বগুলো অস্বীকার করে অথবা অচেতনভাবে সেই দায়িত্বগুলো পাশ কাটিয়ে যায় তখন দুর্নীতির জন্ম হয়। আমি আমার কর্তব্যগুলো না করে আশা করতে থাকি যে অন্যেরা তাদের কর্তব্যগুলো করতে থাকবে যাতে সমাজে চলতে ফিরতে আমার কোন সমস্যা না হয়। কিন্তু সমাজের আর মানুষেরা তো আমারই মতন। তাই স্বাভাবিকভাবে যা হবার কথা ছিল তা হয়না। আমাকে অনৈতিক বিকল্প পথ খুঁজতে হয় স্বার্থসিদ্ধির জন্য। এটাই দুর্নীতি।
আমরা দুর্নীতির বিপক্ষে অনেক কথা বললেও কখনো সেটার ভিত্তির বিরুদ্ধে কিছু বলিনা কারণ সেখানে দাঁড়িয়ে আছি আমরা নিজেরা। দুর্নীতির তথাকথিত ‘মূল উৎপাটন’ যদি করতে হয় তবে শেকড় ছিড়বে আসলে আমাদের নিজেদের ভোগ-বিলাসে মত্ত জীবনটার। তাই আমরা দুর্নীতির বাহারী গাছটার গোড়ায় জল ঢালি আর পাতায় চালাই কাঁচি। কার্টুন এঁকে আর মিছিল করে দুর্নীতি কমানোর হাস্যকর প্রচেষ্টা করি।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরুর দিকে আমি তাত্বিক বাম রাজনীতির দিকে একটু ঝুঁকেছিলাম। সম্পদের সমবন্টন, সাম্যবাদ জাতীয় ব্যাপারগুলো আমার খুব ভালো লাগতো। কিন্তু পরে এক ঝাঁকিতে বাম ঝোঁক কেটে যায়। আসলে আমি বেজায় মাতৃভক্ত মানুষ। আমি যদি কখনো সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হই তবে টাকা দেবার চাইতে মেঝেতে শুয়ে থাকা বেশি পছন্দ করবো; কসম করে বলতে পারছিনা কিন্ত আমার স্ত্রী বা সন্তানের ক্ষেত্রেও সম্ভবত আমি তাই চাইবো। কিন্তু আমার মা মাটিতে শুয়ে কাতরাবে, বিছানা পাবেনা এটা সহ্য করা কোনভাবেই আমার পক্ষে সম্ভব না। তাই এক্ষেত্রে সাম্যবাদের তত্ত্ব আমার মায়ের ব্যাপারে সেটা আমি খাটাতে পারবোনা।
কিন্তু তাহলে এখন উপায় কি? নিজের আদর্শের সাথে আপোষ করে ১০০টা টাকা ধরিয়ে দেই ওদের হাতে। আচ্ছা দেয়ার ক্ষেত্রে যদি আপোষ করিই তাহলে নেয়ার ক্ষেত্রে আপোষ করলে দোষ কোথায়? যে কলেজে পড়াই তার দু’একটা ছাত্র পড়ালেই তো হয়। ছাত্র পড়ানোতো আর হারাম না। হাতে কিছু টাকা আসলো। এরপর মা’কে নিয়ে চলে যাব সোজা ল্যাব-এইডে। দেয়ার ক্ষেত্রে তো আর আপোষ করা লাগবেনা।
খুব চমৎকার সমাধান, তাইনা? তাইকি?
যে ছাত্রটাকে পড়ালাম সে পরীক্ষার আগেরদিন বলে বসবেঃ
– স্যর, ইম্পর্ট্যান্টগুলো দাগায় দেন।
– না, সব পড়।
– তাহলে আপনার কাছে পড়ে লাভ হল কি?
– আমি তোমাকে ভাল করে বুঝিয়ে দিচ্ছি পড়া।
– তাহলে এই ভাল বোঝানোটা কেন ক্লাসে বোঝাননা স্যর?
আদর্শে আপোষ হচ্ছে একটা বাঁধে একটা ফাটলের মত। ছোট্ট একটা চিড় দরকার শুরুতে। এরপর পানির চাপে ঐ ছোট্ট চিড়টাই বড় হবে, এরপর ফাটল ধরবে; একদিন ধ্বসে যাবে পুরো বাঁধটাই। আমি আমার হিসেব করলাম, আপনি আপনার হিসেব করে নিন।
পৃথিবীতে সব সমস্যার সবচেয়ে ভারসাম্যপূর্ণ, সাস্টেনেইবল সমাধান দিতে পারে ইসলাম। অন্য সব সমাধানের গলদ আছে – সেটা আপনি এখন টের পান, পাঁচ বছর পর অথবা পঞ্চাশ। গলদ যে আছে তা নিশ্চিত। দুর্নীতির সমাধান আছে একদম মৌলিক ইসলামে – বিচার দিবসে বিশ্বাসে।
মানুষ যতদিন এই পৃথিবীর জন্য বাঁচবে ততদিন দুর্নীতি হবেই। আর যখন মানুষ পরকালের জন্য বাঁচবে তখন দুর্নীতি থাকবেনা।
মুরগির মাথা একটা – পরিবারে মানুষ দশজন। একজন মাথা খেলে ন’জন পাবেনা। কাউকে দাবী ছাড়তেই হবে। এখন যে দাবী ছেড়ে দিল সে যদি এই আশায় ছাড়ে যে আল্লাহ তাকে প্রতিদান দেবেন তবে পরিবারের সদস্যরা যদি কোনদিনও তার আত্মত্যাগের মর্ম না বোঝে তবুও তার কোন কিছু যায় আসেনা। একটা ভালো কাজকে সাদা চোখে খুব ছোট মনে হলেও আল্লাহ তাকে অনেক বড় চোখে দেখেন এবং তার অনেক বড় প্রতিদান দেন।
বাজারে মুরগি একটা – পরিবার দশটা। যে পরিবারের টাকা বেশি সে মুরগি নিয়ে যাবে। এ পৃথিবীতে ভালোটা খেতে টাকা লাগবে। যখন মানুষের অভীষ্ট লক্ষ্য হবে এ পৃথিবীতে ভাল খাওয়া, ভাল থাকা তখন সে টাকা চাইবেই। প্রথমে সে চাইবে টাকাটা ভালভাবেই যেন আসে। কিন্তু যদি না আসে তখন সে ভাল টাকার চেয়ে ভাল থাকাটাকে দাম দেবে বেশি। ভাল থাকা সে কিনে নেবে খারাপ টাকা দিয়ে। খুব পাপবোধ জমা হলে কিছু টাকা ভিক্ষা দেবে, আত্ম-পরিতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলবে।
যে লোকটা মাসে বিশ হাজার টাকা কামাই করে ফকিরকে দু’টাকা দিয়ে নিজেকে দাতা ভাবে তাকে দান কী তা কে বোঝাবে? যে লোকটা ঘুষের টাকায় মসজিদ বানায় আর সুদের টাকায় মাদ্রাসা চালায় তাকে কে বোঝাবে আল্লাহ অনেক পবিত্র, অপবিত্র কোন কিছু তিনি গ্রহণ করেননা?
পৃথিবী একটা ক্ষেতের মত, যেখানে কৃষককে কষ্ট করে সেচ দিতে হয়, সার দিতে হয়, বীজ বুনতে হয়, নিড়ানি দিতে হয়। ফসল তোলা তথা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ক্ষেতের যত্ন আত্তি করতে হয়, পাহারা দিয়ে রাখতে হয়। ফসল ঘরে তুললে সব কষ্ট লাঘব হয়ে যায়। তিন মাসের কষ্ট দিয়ে বাকি বছর চলে যায়। এ দুনিয়ায় আমাদের সব পরিশ্রম, সব কষ্টের লক্ষ্য একটাই – আখিরাতের ফসল ভোগ করা।
একজন মুসলিম এই পৃথিবীর জীবনের জন্য বাঁচেনা। সে বাঁচে অনন্তকালের জীবনের জন্য। আল্লাহ তার পৃথিবীর জীবনটা পরকালের বিনিময়ে কিনে নিয়েছেন। আল্লাহ তাকে মুরগি খাওয়ালে সে বলে আলহামদুলিল্লাহ, শাক খাওয়ালে বলে আলহামদুলিল্লাহ, শুধু লবন দিয়ে ভাত খাওয়ালেও বলে আলহামদুলিল্লাহ। একেবারে কিছু না খাওয়ালেও বলে আল্লাহ তোমার উপর ভরসা রাখলাম। রসুলুল্লাহ (সাঃ) কে উহুদ পাহাড় সোনায় বদলে দেবার প্রস্তাব দিয়েছিলেন ফেরেশতারা। তিনি ঐশ্বর্যকে না বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন যেদিন খাবার জুটবে সেদিন খাব আর আলহামদুলিল্লাহ বলব। আর আরেকদিন না খেয়ে থাকবো, সবর করব।
যে সেক্যুলারিস্ট ছেলেটা বেনসন খেতে খেতে দারিদ্র্য উৎখাত তথা শ্রেণীসংগ্রামের স্বপ্ন দেখে তাকে কে বোঝাবে যে আদর্শ কপচানোর জিনিস না, জীবনে ধারণ করবার জিনিস! গুলশানে আড়াই কোটি টাকার ফ্ল্যাটে দু’টনি এসির বাতাস খাওয়া কমিউনিস্ট নেতাকে তাই দেখা যায় মহা জোট তৈরি করে গার্মেন্টস শ্রমিকদের মূলী বাঁশ দেয়া মজুরী বেঁধে দিতে।
বাংলাদেশের যে লোকটা সবচেয়ে গরিব, সবচেয়ে হতভাগা সেও অন্তত দিনে একবার খায়। আমাদের মত ভূড়িওয়ালা জাতিকে আমি কিভাবে বোঝাবো ছয় বেলায় একবেলা খাওয়া মানে কি! সারা পৃথিবীর সবচেয়ে যে গরিব লোকটা তার ঘরে অন্তত মাসে একবার চুলা জ্বলে। যারা মুহাম্মদ (সাঃ) এর নামে মিথ্যা অপবাদ দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে যান তাদের আমি কিভাবে বোঝাবো যে এই তার ঘরে দু’মাসেরও বেশি সময় পার হয়ে যেত কিন্তু চুলায় আগুন ধরিয়ে রান্না করবার মত কোন খাবারের দেখা মিলতোনা!
এই মানুষটা আমাদের রসুল, আমাদের নেতা। আমাদের তাকে অনুসরণ করার কথা ছিল, তাকে অনুকরণ করার কথা ছিল।
এই রসুলেরই একজন সাহাবি বাসায় এসে জানতে চাইলেন খাবার কি আছে। ঘরণী বললেন কিছু নেই। তিনি বেরিয়ে গেলেন। দিনমজুরির টাকা দিয়ে গম কিনে আনলেন বাসায়। স্ত্রী গম ভাঙ্গলেন, আটা বানালেন, সেটা দিয়ে রুটি। দরজায় ভিক্ষুক এসে খাবার চাইলো। রুটি দিয়ে দেয়া হলো। আবার রুটি বানালেন স্ত্রী। আবার একজন দরজার করা নেড়ে কিছু খাবার চাইলো। বানানো রুটি দিয়ে দেয়া হলো। এবার বাকি গমটুকু নিংড়ে যা কিছু পাওয়া গেল তা দিয়ে হল শেষ রুটি। খেতে বসতেই আল্লাহ আরেকজনকে পাঠালেন তাদের দ্বারে। সবটুকু দিয়ে সকালের ক্ষুধার্ত �%A