জীবনের বাঁকে বাঁকে

জাতের বড়াই

প্রথম বর্ষের ছাত্র আমি তখন, জিইবি-১০৫ ইউনিটটি নিতেন শ্রদ্ধেয় আনোয়ার স্যার। তিনি আমাদের নেচার বনাম নার্চার বিতর্ক পড়িয়েছিলেন। মানুষ কেমন হবে তা নির্ধারণ করে কোনটি – জিনোম, যা তার কোষে কোষে আছে নাকি পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, যাতে সে বেড়ে উঠেছে? জানলাম দুটোরই অবদান আছে, অর্ধেক-অর্ধেক। কিন্তু পরবর্তীতে দেখলাম শুধু এ-দুটো দিয়েই সব ব্যাখ্যা করা যায়না। মানুষের আরো আছে রুহ্‌ বা আত্মা – যার বুদ্ধিমত্তা ও স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি আছে। এর বলেই মানুষ জিনোম এবং পরিবেশ উভয়ের প্রভাবকে জয় করতে পারে। মানুষের আছে বেছে নেবার ক্ষমতা – এই বেছে নেবার ক্ষমতাই মানুষকে জৈবিক পশুত্বের পর্যায় থেকে মনুষ্যত্বের স্তরে উঠিয়ে দেয়।

দুঃখজনক হলেও সত্য, যুগে যুগে মানুষ নিজেদের বিচার করার সময় জন্মের যতটা দাম দিয়েছে, কাজের ততটা দাম দেয়নি। ‘জন্ম হোক যথা তথা, কর্ম হোক ভাল’ – ধরণের নীতিবাক্যগুলো ভাব সম্প্রসারণ করা ছাড়া অন্য কাজে লাগেনি। নায়ক চৌধুরি বংশের আর নায়িকা খান বংশের – এই দ্বন্দ্ব নিয়ে হাজারখানেক বাংলা সিনেমা তৈরী হয়েছে। সামন্তযুগের বংশ বা গোত্র নিয়ে মানুষের যে অবস্থানটা ছিল, পুঁজিবাদী যুগে সেটা বৃহত্তর পরিসরে ‘জাতি’র চেহারা নিয়ে হাজির হয়েছে। মানুষ এখন বংশের বড়াই না করে জাতীয়তাবাদের গৌরব করে। জাতীয়তাবাদের উগ্র মূর্তির চেহারা আমরা দেখি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। হিটলার বিশ্বাস করতো একমাত্র আর্য জার্মানদের অধিকার রয়েছে সমগ্র বিশ্ব শাসনের কারণ আর্য জার্মানরা সৃষ্টিগতভাবে, জেনেটিকালি অন্য জাতিগুলোর চেয়ে উন্নত। সে ১ কোটি ১০ লক্ষেরও বেশি মানুষকে হত্যা করেছিল শুধু এই নীতিবোধে যে, সব জাতের কর্তব্য জার্মানদের সেবা করা এবং যারা তা করবেনা তাদের পৃথিবীতে জীবিত থাকার অধিকার নেই।

১৯৪৫ সালে হিটলারের পতন ঘটলেও জাত্যাভিমানের কিন্তু অবসান ঘটেনি। জাতিগত কোন্দলের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা দেখি পোলিশদের প্রতি রাশানদের বর্বরতা, তুরষ্কে আর্মেনিয়ানদের গণহত্যা, ইরাকে কুর্দিদের নিশ্চিহ্নাভিযান, রুয়ান্ডার হুতু-তুতসিদের মাঝে সংঘটিত হত্যাকান্ড, শ্রীলঙ্কার তামিল-সিংহলিজ গৃহযুদ্ধ, বসনিয়ায় সার্ব কর্তৃক বসনিয়ানদের গণহত্যা ইত্যাদি ইত্যাদি। এথনিক ক্লিনসিং এর পিছনে লুকিয়ে আছে এক জাতির মানুষদের প্রতি আরেক জাতির প্রবল ঘৃণা। আজকের তথাকথিত সুসভ্য জাত ফরাসি আর ইংরেজরা পনেরশ থেকে আঠারোশ শতাব্দীতে যা করেছে তাকে কুকুরের কামড়াকামড়ি বললে কম বলা হয়। ল্যান্ড অফ ফ্রিডম নামে পরিচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আদি নিবাসী ছোট ছোট নৃতাত্বিক গোষ্ঠীগুলোর প্রতি বর্বরতার ইতিহাস অনেক ঢাকা-ঢুকো দেবার পরেও যতটা বেরিয়ে আসে তা জানলে হতবাক হতে হয়।

আরো ন্যাক্কারজনক ব্যাপার হল এক জাতি আরেক জাতিসত্ত্বাকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে তাদের সম্পদকে দখল করবে, এটাকে অন্যায় হিসেবেও দেখা হয়না। ডারউইনিজমের হাত ধরে আসা সোশ্যাল ডারউইনিজম বলে – যে জাতি বেশি সক্ষম সে জাতি অন্য জাতিকে ধরে খাবে। সার্ভাইবল অফ দ্য ফিটেস্ট, এটা নাকি প্রকৃতির নিয়ম – এতে অন্যায় কিছু নেই! হোমো স্যাপিয়েন্স জাত দুভাগে বিভক্ত – সাদা চামড়ার হোমো সুপেরিয়র আর বাদামি-কালো চামড়ার হোমো ইনফেরিয়র। এমন বিশ্বাস নিয়ে বিখ্যাত দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট, শ্যোপেনহাওয়ার, ফ্রিডরিখ হেগ্যেল, অগাস্ত ক্যোৎ থেকে শুরু করে আজকের হাভার্ডের বিজ্ঞানীরা বই অবধি লিখেছেন। ইউরোপীয় এনলাইটমেন্টের গুরু ভলতেয়ার সন্দেহ প্রকাশ করে লিখেছিলেন যে নিগ্রোরা বাঁদর থেকে এসেছে নাকি বাঁদররা নিগ্রো থেকে এসেছে তা গবেষণার বিষয়!

অথচ সত্যি কথা এই যে মানুষ যা কিছু নিয়ে গর্ববোধ করে – গায়ের রঙ, মেধা, বংশ-মর্যাদা, সৌভাগ্য, রূপ-লাবণ্য, শারীরিক গঠন – কোন কিছুই তার নিজের কামাই না, সবই জন্মসূত্রে মুফতে পাওয়া। আমি এই যে দেহ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি, সেই আমি আমার অস্তিত্বে আসার আগে আমার প্রাপ্ত দেহের কোন অংশের ব্যাপারেই কিছু করিনি। করার মত কোন বোধই তো ছিলনা। আমার আমি – আমার আত্মা, বিবেক-বোধ, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সমেত – এই আমি, পুরোটা একটা সিঙ্গেল প্যাকেজ, পুরোটাই আল্লাহর দান। কোন বুদ্ধিমান মানুষ কি স্রষ্টা যা ‘ভিক্ষা দিলেন তা নিয়ে অহংকার করতে পারে? আমার যাতে কোন কৃতিত্ব নেই সেটা নিয়ে গর্ব করার কিইবা আছে?

আমি বাংলাদেশে জন্মেছি। কিন্তু আমি ডেনমার্কে জন্মে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান হতে পারতাম আবার নাইজেরিয়াতে জন্মে কালো মানুষও হতে পারতাম। আমার জন্মভূমি বা জাতিসত্তা নির্ধারণে আমার কোন হাত ছিলনা – এটা পুরোপুরি স্রষ্টাপ্রদত্ত একটা ব্যাপার। আমার মনে পড়েনা যে আমি আল্লাহকে বলেছিলাম – আল্লাহ বাংলাদেশ জায়গাটা খুব সুন্দর ওখানে আমার জন্ম দিও। আল্লাহ যে আমাকে সাহারার শুকনো ধূধূ কোন মরুভূমিতে জন্ম দেননি, কিংবা কানাডার আলবার্টার বরফরাজ্যের অধিবাসী করে পাঠাননি সেজন্য আমি সত্যি আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ। আমি বৃষ্টি আর পাহাড় দু’টি খুব ভালোবাসলেও আল্লাহ যে আমাকে আসামের চেরাপুঞ্জি বা হিমালয়ের কোন পাহাড়ি গ্রামে জন্ম দিয়ে পাঠাননি সেজন্য আমি মোটেই দুঃখিত নই। আমি তথাকথিত উন্নত বিশ্বের নাগরিক নই বলে আমার যেমন আক্ষেপ নেই তেমনি মক্কায় জন্ম হলে বায়তুল্লাহ্‌তে প্রতি ওয়াক্ত স্বলাত আদায় করে ১ লক্ষ গুণ প্রতিদান পেতে পারতাম – সেটা নিয়েও আমার মনঃতাপ নেই।

কেন নেই? কারণ আমি জানি আল্লাহ আমার রব্ব, এবং তিনি যে আমাকে বাংলাদেশের যশোরে জন্ম দিয়েছেন, ঢাকায় বড় করে তুলেছেন তার পিছনে তার একটি উদ্দেশ্য আছে। এই উদ্দেশ্যটা আমি জানিনা। কিন্তু তার যে আমাকে নিয়ে একটি পরিকল্পনা আছে তা সুনিশ্চিত। আরেকটু বড় আঙ্গিকে দেখলে – এই সমগ্র বিশ্বচরাচর সৃষ্টি ও প্রতিপালনের মহাপরিকল্পনার আমিও একটা অংশ। আল্লাহ যাই করেন তার অসীম জ্ঞানের ভিত্তিতে যেটা ভালো বোঝেন সেটাই করেন। তার এই সাজিয়ে দেয়া প্রেক্ষাপটে আমার ভূমিকা- আল্লাহ আমাকে যখন যে পরিস্থিতিতে ফেলবেন তখন আমাকে বিবেক-বুদ্ধি ব্যবহার করে এমন একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে যাতে তিনি সন্তুষ্ট হন। আল্লাহ কিসে সন্তুষ্ট হবেন সেটা জানতে পারবো আল ক্বুর’আন এবং মুহাম্মদ (সাঃ) এর সহিহ সুন্নাহ থেকে।

আল্লাহ সুবহানাহু সুরা হুজুরাতে খুব স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন –

হে মানবজাতি, আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে, পরে তোমাদের বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অপরের সাথে পরিচিত হতে পারো। 

আল্লাহ আমাকে বাঙালি জাতিতে সৃষ্টি করেছেন যেন আমি অন্যান্য জাতির কাছে পরিচিতি দিতে পারি। আল্লাহ জাতিভেদ এ জন্য সৃষ্টি করেননি যেন আমি বাঙালি সংষ্কৃতি নিয়ে অহংকার করতে পারি। একজন মানুষ ভারতে জন্মেছে দেখে তাকে আমি ভারতীয় হিসেবে অপছন্দ করবো, আবার পাকিস্তানের নাগরিক দেখেই তাকে ঘৃণায় মুখ সরিয়ে নেব – একারণে আল্লাহ একেকজনকে একেক জাতিসত্ত্বা দিয়ে পৃথিবীতে পাঠাননি। মানুষের জন্মপরিচয়টা যে আল্লাহর কাছে গুরুত্ব রাখেনা সেটা একই আয়াতের বাকি অংশে আল্লাহ তা’আলা জানিয়ে দিলেন –

তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তিই আল্লাহর কাছে অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে আল্লাহকে অধিক ভয় করে। 

মানুষকে তার জন্মের ভিত্তিতে ভাগ করা যাবেনা, ভাগ করতে হবে তার কাজের  ভিত্তিতে। আর কে কি করবে তা নির্ভর করে সে কি বিশ্বাস করে তার উপরে। যে বিশ্বাস করে আল্লাহ সব কিছু দেখছেন সে প্রবৃত্তির তাড়নায় মূহুর্তের অসতর্কতায় একটা পাপ করে ফেললেও আল্লাহর কাছে ফিরে আসে, ক্ষমা চায়। কিন্তু যে ক্বুর’আনে বিশ্বাসী নয় সে গরীব মানুষকে উচ্চ সুদে টাকা ধার দিয়ে ভাবে খুব ভালো কাজ করছি। ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষ জাতি তাই দু’ভাগে বিভক্ত – বিশ্বাসী/ অবিশ্বাসী, যারা জানে/ যারা জানেনা, যারা মানে/ যারা মানেনা, জান্নাতী/ জাহান্নামী।

একজন মুসলিম তার জাতীয়তাবাদ নিয়ে গর্ব করতে পারেনা। রসুলুল্লাহ (সাঃ) শিক্ষা দিলেন –

মানুষ যেন তাদের মৃত পূর্বপুরুষকে নিয়ে গর্ব না করে। … আল্লাহ অজ্ঞতার যুগের সাম্প্রদায়িকতা ও বংশগৌরব নিষিদ্ধ করেছেন। নিশ্চয় একজন মানুষ হয় সৎ বিশ্বাসী অথবা হতভাগ্য পাপাচারী। সমস্ত মানুষ আদমের সন্তান আর আদম ছিলেন মাটির তৈরী। 

আরবের শ্রেষ্ঠ বংশে জন্ম নেয়া মুহাম্মদ (সাঃ) আরব জাতীয়তাব�%B

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon
Back to top button