রক্ত
আমি যখন প্রথম রক্ত দিই তখন বয়স ১৯ বছর। তখন থেকে এখন পর্যন্ত মোট রক্ত দেওয়ার সংখ্যা ৩৫। প্রতিবছর ৪ বার করে হিসেব করলে সর্বোচ্চ দেওয়া যায় ৪৮ বার। আমিও সেই হিসেবেই দিচ্ছিলাম। কিন্তু ২৭ বছর বয়সেই ২৯ বার রক্ত দেওয়ার পরে পিজি হাসপাতালের রক্ত সঞ্চালন বিভাগ থেকে এত বেশি রক্ত দিতে নিষেধ করেছিলেন ডাক্তার। তাত্ত্বিকভাবে ৩ মাস পর পর একজন পুরুষ এবং ৪ মাস পর একজন মেয়ে রক্ত দিতে পারলেও লোহা বা আয়রনের ঘাটতি পূরণ করতে গিয়ে এর চেয়ে বেশি সময় লেগে যেতে পারে। ডাক্তার আমাকে পরামর্শ দেন বছরে এক বার থেকে দু’বার রক্ত দেওয়ার, জরুরী দরকারে তিনবার হতে পারে কিন্তু চার বার যেন না দিই।
কেন?
রক্ত দেওয়ার ফলে হারিয়ে যাওয়া লোহিত রক্ত কণিকা তৈরি করতে যে লোহা দরকার তা আসে দেহের লোহার ভাণ্ডার, ফেরিটিন নামের প্রোটিন থেকে। লোহার ভাণ্ডারের অতিপ্রাচুর্য হৃদযন্ত্রের জন্য হুমকি। কিন্তু লোহার ঘাটতিও বেশ কিছু রোগ যেমন অ্যানেমিয়া এর জন্য দায়ী। যারা বেশি রক্ত দেয় তাদের ফেরিটিনের সঞ্চয়ে ঘাটতি পড়ে, যা ইরাইথ্রোপোয়েসিস উইথ আয়রন ডেফিশিয়েন্সি এর আশঙ্কা বাড়িয়ে দেয়।[1] রক্তের হেমাটোক্রিট অর্থাৎ রক্তে লোহিত কণিকার পরিমাণ কিংবা হিমোগ্লোবিন পরীক্ষা করলেই যে ফেরিটিনের ঘাটতি বোঝা যাবে তা নয়। সিরাম ফেরিটিনের মাত্রা ২০-৮০ ন্যানোগ্রাম/মিলি হচ্ছে স্বাভাবিক। এর কম হলে লোহাযুক্ত খাবার বেশি খেতে হবে, রক্ত কম দিতে হবে বা আয়রন সাপলিমেন্ট খেতে হবে। সিরাম ফেরিটিনের মাত্রা ৮০ পার হয়ে গেলে নিয়ম করে রক্ত দিতে হবে, নিজেকে সুস্থ রাখতেই!
মজার ব্যাপার হচ্ছে আমারই বয়সী একভাইকে চিনি, আমারই মতো AB+ রক্তের গ্রুপের, তিনি জীবনে একবারও রক্ত দেননি। কেন দেননি জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, কেউ তাকে বলেনি দিতে। অথচ একদিকে যেমন বাংলাদেশে রক্ত নিয়ে রীতিমত ব্যবসা চলে, আর অন্যদিকে বছরে এক থেকে দুবার রক্ত দেওয়া শরীরের জন্য ভালো। হিজামাহ নামে সুন্নাহ সমর্থিত চিকিৎসা পদ্ধতি আর কিছুই নয়—রক্তমোচন বা দেহের বিভিন্ন স্থান থেকে রক্ত বের করে দেওয়া! রক্ত দেওয়ার চারটা উপকার আছে:
১. রক্তে আয়রন বা লোহার পরিমাণ কমে–এতে কোলেস্টেরল কমে। গবেষণায় দেখা গেছে যারা নিয়মিত রক্ত দেয় তাদের অ্যাকিউট মায়োকারডিয়াল ইনফারকশন বা সহজ বাংলায় হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি ৮৮ শতাংশ কম।[2]
২. রক্তের সান্দ্রতা কমে, রক্ত প্রবাহ আরো সহজ হয়। লয়োলা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. ফিলিপ ডি ক্রিস্টোফার বলেন, রক্তদাতাদের হাসপাতালে আসতে হয় কম, এসে পড়লেও থাকতে হয় কম। এদের হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক কিংবা ক্যান্সারের ঝুঁকিও কম।[3]
৩. আমাদের নিয়মিত মেডিকাল চেক-আপের অভ্যাস একদম নেই। রক্ত দেওয়ার সময় মুফতে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়ে যায়। আমি কিছু মানুষকে চিনি যাদের শরীরে থাকা সমস্যাগুলো ধরা পড়েছে ঐ পরীক্ষালব্ধ তথ্য দিয়ে। আগে জানতে পারলে বিপদ আসার আগেই চিকিৎসা শুরু করা সম্ভব হয়।
৪. আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য মানুষের উপকারের হয় এমন কিছু করতে পারা। আবূ হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে কোনো মুসলিমের পার্থিব বিপদাপদের মধ্যে একটি বিপদও দূর করে দেয়, আল্লাহ তা’আলা তার পরকালের বিপদাপদের কোনো একটি বিপদ দূর করে দেবেন।[4]
কিন্তু আমাদের দেশে সমস্যা, যারা নিয়মিত রক্ত দেয় তাদের কেমন যেন একটা সুনাম হয়ে যায়। যার যখন ঐ গ্রুপের রক্ত দরকার হয়, সে তখন রক্তদাতা মানুষটিকে ফোন দেয়। এভাবে তাকে হয়ত তিন মাস পরপর রক্ত দিতে হয়, তার শরীরের ওপর চাপ পড়ে যায়; অন্যদিকে অন্যরা রক্ত দেওয়ার উপকারীতা থেকে বঞ্চিত হয়। কারো যদি সুনাম একটু বেশি হয় তাহলে তার কষ্ট আরো বেড়ে যায়, অন্যান্য গ্রুপের রক্তের জন্যও তার কাছে অনুরোধ আসতে থাকে। অনেক সময় এই অনুরোধগুলোকে সরাসরি নিষেধ-ও করা যায় না, আবার রক্ত খোঁজার জন্য যে সময়, শ্রম এবং ফোনের বিল খরচ করতে হয় সেটার সামর্থ্য-ও থাকে না। অনেক সময়ই কার রক্ত দরকার—এটা বোঝানোও কষ্টকর হয়ে যায়। অথচ খুব সহজে রক্তের সিংহভাগ সমস্যার সমাধান করা যায়। আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি চাহিদা A+, B+, O+ এবং AB+ এর। এগুলোর যোগানও বেশি। যদি আমার মায়ের রক্তের দরকার হয় আর আমি আমার বন্ধুকে ফোন করে বলি, আম্মার অমুক দিন অপারেশন, তুই কী রক্ত দিতে পারবি–সে খুব শক্ত অজুহাত না থাকলে না বলবে না। খুব পাষাণ টাইপের মানুষই শুধু কাছের মানুষের বিপদে না বলতে পারে।
এছাড়াও মানুষকে এটা বোঝানো যায় যে আজ আমার রক্ত লাগছে, তুমি দিচ্ছ। কাল তোমার দরকার হলে আমি দেবো। যদি তুমি না দাও, তোমাকেও কেউ দেবে না। এভাবেই যে মানুষটি রক্ত দেয় না তাকেও রক্তদাতা বানিয়ে ফেলা যায়। প্রশ্ন থাকতে পারে, কীভাবে জানব কাকে ফোন করতে হবে। আমার পরামর্শ মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে কন্টাক্ট লিস্ট ধরে একের পর একটা মানুষকে ফোন দেওয়া। কুশলাদি বিনিময়ের পরে তার রক্তের গ্রুপটা জানতে চাওয়া এবং আমার দরকারটা তাকে জানানো। রক্ত মিলে গেলে তো আলহামদুলিল্লাহ, না মিললেও দু’আটা তো অন্তত চাওয়া যায়। কিছু শুভেচ্ছা তো অন্তত বিনিময় হয়।
এ পর্যন্ত আমি কাউকে পাইনি যাদের রক্তের দরকার, আর তারা এভাবে ফোন করে কন্টাক্ট লিস্টের A দিয়ে যে নাম আছে সেগুলো শেষ করতে পেরেছে। একটু রেয়ার গ্রুপের জন্য বা বেশি ব্যাগ রক্তের জন্য হয়ত আরেকটু বেশি যাওয়া লাগবে, হয়ত Z পর্যন্ত যাওয়া লাগবে–কিন্তু রক্তের যোগান হবেই ইন শা আল্লাহ। পরবর্তীতে যেন গণহারে ফোন না করা লাগে এজন্য প্রতিটি ফোনের পরে ঐ ভাই/বোনের রক্তের গ্রুপ তার নামের সাথে সেভ করে রাখা যায় ফোনে, যেমন Opu AB+
শুধু পজিটিভ নয়, নেগেটিভ গ্রুপ বা অনেক বেশি রক্তের জন্য-ও এ পদ্ধতিতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হবার পরে তারপর ইমেইল গ্রুপ কিংবা ফেসবুকে অন্যদের দারস্থ হওয়া উচিত, তার আগে নয়। এতে নতুন রক্তদাতা তৈরি হয়, পুরনো রক্তদাতাদের ওপর চাপ কমে এবং কল্যাণকর কাজে অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা বাড়ানো যায়।
আল্লাহ যেন আমাদের অন্যের বিপদে এগিয়ে আসার তাওফিক দেন। আমিন।
– শরীফ আবু হায়াত অপু
———————–
[1] The effect of repeated blood donations on the iron status of male Saudi blood donors, Saleh M. Abdullah, Blood Transfus. 2011 Apr; 9(2): 167–171.
[2] Donation of blood is associated with reduced risk of myocardial infarction. The Kuopio Ischaemic Heart Disease Risk Factor Study, Salonen JT, Tuomainen TP, Salonen R, Lakka TA, Nyyssönen K. Am J Epidemiol. 1998 Sep 1;148(5):445-51.
[3] টাইম ম্যাগাজিন, ২২শে জুন, ২০১৪
[4] ইবনু মাজাহ (১২২৫), মুসলিম, সুনানে তিরমিযি ১৯৩০