জ্যোতির্বিজ্ঞানের নিরিখে যেলাসমূহের মাঝে সময়ের পার্থক্যের কারণ
পৃথিবী এবং সূর্য আপন আপন কক্ষপথে ঘূর্ণায়মান। এই ঘূর্ণনের ফলে আবর্তিত হয় দিন ও রাত; পরিলক্ষিত হয় ঋতুবৈচিত্র্য। এই ঋতুবৈচিত্র্যের কারণে পৃথিবীর সর্বত্র সর্বদা দিন-রাত্রি সমান হয় না। এর পেছনে কারণ হিসাবে কয়েকটি বিষয়কে চিহ্নিত করা যায়। যেমন, পৃথিবীর আহ্নিক ও বার্ষিক গতি, সূর্যের নিজ কক্ষপথের ওপর গতি, কক্ষপথের আকার-আকৃতি, সূর্য ও পৃথিবীর আকার-আকৃতি, সূর্য ও পৃথিবীর মধ্যকার দূরত্ব ইত্যাদি।
এবার আসুন! কিছু মৌলিক বিষয় জেনে নেওয়া যাক :
১. অক্ষরেখা, অক্ষাংশ ও বিষুবরেখা : পৃথিবীর কেন্দ্র দিয়ে উত্তর-দক্ষিণে কল্পিত রেখাকে অক্ষরেখা (axis) বা মেরুরেখা বলে। অক্ষরেখার ঠিক মধ্যবিন্দু থেকে পূর্ব-পশ্চিমে পৃথিবীকে বেষ্টনকারী রেখাকে বলে নিরক্ষরেখা বা বিষুবরেখা। আর বিষুবরেখা থেকে উত্তর বা দক্ষিণে কোন স্থানের কৌণিক দূরত্বকে ঐ স্থানের অক্ষাংশ বলা হয়। এছাড়া বিষুবরেখার সমান্তরাল পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত রেখাগুলোকে বলে সমাক্ষরেখা ।
২. দ্রাঘিমারেখা, মূল মধ্যরেখা ও দ্রাঘিমাংশ : নিরক্ষরেখার উপর দিয়ে উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত রেখাগুলোকে বলা হয় দ্রাঘিমারেখা। যুক্তরাজ্যের লন্ডন শহরের গ্রিনিচ (Greenwich) মানমন্দিরের উপর দিয়ে যে দ্রাঘিমারেখা অতিক্রম করেছে তাকে মূল মধ্যরেখা বলে। গ্রিনিচের মূল মধ্যরেখা থেকে পূর্ব বা পশ্চিমে যে কোন স্থানের কৌণিক দূরত্বকে সেই স্থানের দ্রাঘিমা বলা হয়।
উলেখ্য যে, গিনি উপসাগরের একটি স্থানে নিরক্ষরেখা ও মূলমধ্যরেখা পরস্পরকে লম্বভাবে ছেদ করেছে। এই স্থানের অক্ষাংশ ও দ্র উভয়ই ০° (শূন্য ডিগ্রী)।
দিবা-রাত্রির দৈর্ঘ্য হ্রাস-বৃদ্ধি বিজ্ঞানের আলোকে :
হিসাবের সুবিধার্থে সূর্যকে পরিক্রমণকালে কক্ষপথে পৃথিবীর চারটি অবস্থান নির্দিষ্ট করা হয়েছে। যথা : ২১শে জুন, ২৩শে সেপ্টেম্বর, ২২শে ডিসেম্বর ও ২১শে মার্চ।
২১শে জুন : সূর্যকে পরিক্রমণকালে ২১শে জুন পৃথিবী এমন অবস্থানে পৌঁছে, যেখানে উত্তর মেরু সূর্যের দিকে ২৩.৫° ঝুঁকে থাকে এবং দক্ষিণ মেরু সূর্য থেকে দূরে সরে পড়ে। এদিন ২৩.৫° উত্তর অক্ষাংশে অর্থাৎ কর্কটক্রান্তির উপর সূর্যকিরণ ৯০° কোণে বা লম্বভাবে পড়ে। ফলে এইদিন উত্তর গোলার্ধে দিন সবচেয়ে বড় এবং রাত সবচেয়ে ছোট হয়। আর দক্ষিণ গোলার্ধে রাত সবচেয়ে বড় এবং দিন সবচেয়ে ছোট হয়।
২৩শে সেপ্টেম্বর : ২১শে জুনের পর উত্তর মেরু সূর্য থেকে দূরে সরতে থাকে এবং দক্ষিণ মেরু নিকটে আসতে থাকে। ফলে উত্তর গোলার্ধে ক্রমশঃ দিন ছোট ও রাত বড় হ’তে থাকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে দিন বড় ও রাত ছোট থাকে। এভাবে ২৩শে সেপ্টেম্বর পৃথিবী এমন এক অবস্থানে আসে, যখন উভয় মেরু সূর্য থেকে সমান দূরে থাকে। এইদিন সূর্যরশ্মি নিরক্ষরেখায় ৯০° কোণে এবং মেরুদ্বয়ে ০° কোণে আপতিত হয়। ফলে এই তারিখে পৃথিবীর সর্বত্র দিন-রাত্রি সমান হয়।
২২শে ডিসেম্বর : ২৩শে সেপ্টেম্বরের পর উত্তর মেরু সূর্য থেকে আরও দূরে সরতে থাকে এবং দক্ষিণ মেরু অপেক্ষাকৃত সূর্যের কাছে সরে আসে। ফলে উত্তর গোলার্ধে দিন ছোট হ’তে থাকে এবং রাত বড় হ’তে থাকে। এভাবে ২২শে ডিসেম্বর এমন অবস্থানে পৌঁছায় যখন দক্ষিণ মেরু সূর্যের দিকে সর্বাধিক (২৩.৫° কোণে) হেলে থাকে। এইদিন সূর্যকিরণ ২৩.৫° দক্ষিণ অক্ষাংশে লম্বভাবে বা ৯০° কোণে আপতিত হয়। ফলে এইদিন দক্ষিণ গোলার্ধে দিন সবচেয়ে বড় হয় এবং রাত সবচেয়ে ছোট হয়। একই সাথে উত্তর গোলার্ধে দিন ছোট ও রাত বড় হয়।
২১শে মার্চ : পৃথিবী তার নিজ কক্ষপথে আবর্তন কালে ২২শে ডিসেম্বরের পর উত্তর মেরু ক্রমশঃ সূর্যের নিকটে আসে এবং দক্ষিণ মেরু সরে যেতে থাকে। এতে উত্তর গোলার্ধে দিন বড় ও রাত ছোট হ’তে থাকে। অবশেষে ২১শে মার্চ পৃথিবী এমন অবস্থানে আসে যখন উত্তর মেরু ও দক্ষিণ মেরু সূর্য থেকে সমান দূরত্বে থাকে। ফলে এইদিনও ২৩শে সেপ্টেম্বরের মত পৃথিবীর সর্বত্র দিন-রাত্রি সমান হয়।
উপরের আলোচনায় দেখা যাচ্ছে যে, পৃথিবী ২৩.৫° কোণে হেলে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করার ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান ও সূর্যের মধ্যে দূরত্ব তথা অবস্থানের পার্থক্য দেখা দেয়। এতে করে সারা বছর পৃথিবীর সর্বত্র সূর্যরশ্মি সমান ভাবে না পড়ে কোথাও লম্বাভাবে আবার কোথাও তির্যকভাবে পড়ে অর্থাৎ ঋতুভেদে বিভিন্ন কোণে আপতিত হয়। ফলে পৃথিবীর সর্বত্র সারা বছর বিভিন্ন স্থানে দিন বা রাত্রি সময়কাল সমান হয় না। এতে করে সারা বছর সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময়ও কম-বেশী হ’তে থাকে। এ কমবেশি পূর্ব-পশ্চিমের ক্ষেত্রে দ্রাঘিমাংশের মাধ্যমে জানা গেলেও, উত্তর ও দক্ষিণের স্থানগুলোর সময়ের পার্থক্য জানতে সেই স্থানের কৌণিক দূরত্বের ব্যাখ্যা প্রয়োজন পড়ে। তাই আন্তর্জাতিকভাবে সারা বছরের সূর্য ও পৃথিবীর মধ্যকার কৌণিক অবস্থান নির্ণয় করে স্থানীয় সময় নির্ণয় করা হয়।
ঢাকার হিসাব : উপরে বর্ণিত নিয়মানুযায়ী ঢাকার সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয়ের সাথে পূর্ব কিংবা পশ্চিমে বা উত্তর ও দক্ষিণে অবস্থিত যেলাগুলোর সূর্যাস্ত-সূর্যোদয়ের সময়ের পার্থক্য পরিলক্ষিত হবে।
যেমন ২১শে জুন তারিখে সূর্যের সর্বোচ্চ উত্তরায়নে অর্থাৎ সূর্য যখন সর্বাধিক উত্তর-পূর্ব দিক থেকে উদিত হবে, তখন সূর্য অস্তমিত হবে সর্বাধিক উত্তর-পশ্চিম দিকে। অর্থাৎ দিনের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি পাবে। কারণ সূর্যের উত্তরায়ণের সময় উত্তর গোলার্ধ সর্বাধিক কোণে সূর্যের দিকে হেলে থাকে।
অনুরূপভাবে সূর্যের সর্বোচ্চ দক্ষিণায়নের কারণে সূর্যোদয় হবে সর্বাধিক দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে এবং অস্তমিত হবে সর্বাধিক দক্ষিণ-পশ্চিমে। ফলে দিনের দৈর্ঘ্য হ্রাস পাবে। এতে করে সূর্যের উত্তরায়ণের সময় ঢাকার সাথে ঢাকা থেকে উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত পঞ্চগড় যেলার সূর্যোদয়ের সময়ের পার্থক্য থাকবে খুবই কম, কিন্তু সূর্যাস্তের পার্থক্য থাকবে তুলনামূলকভাবে বেশী। আবার সূর্যের দক্ষিণায়নের সময় পঞ্চগড় যেলার সাথে ঢাকার সূর্যোদয়ের পার্থক্য থাকবে তুলনামূলক বেশি এবং সূর্যাস্তের পার্থক্য থাকবে তুলনামূলকভাবে কম।
আবার ২১শে জুন ২৩.৫° থেকে সরতে সরতে ২৩শে সেপ্টেম্বর ০°-তে উপনীত হয়। এসময় উভয় গোলার্ধে দিন-রাত সমান হয়। ফলে সেসময় ঢাকা থেকে পঞ্চগড়ের দূরত্ব সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তে সমান হয়। এভাবেই ঢাকার সাথে দেশের বিভিন্ন যেলার সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময়ের পার্থক্য সারা বছর ঋতুভেদে পরিবর্তিত হ’তে থাকে।
ইতিপূর্বে ঢাকাকে কেন্দ্র ধরে সারা বছরের সাহারী-ইফতারের যে সময়সূচী নিরূপণ করা হ’ত সেখানে কেবলমাত্র দ্রাঘিমার দূরত্ব হিসাব করে সময় নির্ধারণ করা হ’ত। ফলে সারা বছর অন্য যেলাগুলোর সাথে ঢাকার সময়ের পার্থক্য একই হ’ত। যাতে পুরোপুরি সঠিকভাবে সারা বছরের জন্য স্থানীয় সময় নিরূপণ করা সম্ভব নয়। অতএব সঠিক স্থানীয় সময়ের জন্য ঋতুভেদে সূর্য ও পৃথিবীর কৌণিক অবস্থান নির্ণয় করে সময় হিসাব করতে হবে।
সুতরাং ছালাতের সময় নির্ধারণ, সাহারী ও ইফতারের সময় নির্ধারণ ইত্যাদির ক্ষেত্রে স্থানীয় সময় নির্ধারণের জন্য আন্তর্জাতিক পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। স্থানীয় সময় অনুযায়ী তথা সঠিক সময়ে সাহারী ও ইফতার করলেই কেবল রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাত পালন করা হবে। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের অনিচ্ছাকৃত ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করুন-আমীন!