ছালাত, দো'আ ও যিকর

দো‘আ কবুল হতে দেরী হলে কি করবেন

দো‘আ কবুলে বিলম্ব হলে মনের মধ্যে কোন সংশয় রাখা যাবে না। আর শয়তানের কুমন্ত্রণার ব্যাপারেও সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। যদি দো‘আকারী গভীরভাবে চিন্তা করে তাহ’লে দো‘আ কবুল দেরীতে হওয়ার ক্ষেত্রে নিজেকে দোদুল্যমান রাখবে না। নিম্নে এমন কিছু বিষয় তুলে ধরা হ’ল যা একজন পাঠকের চিন্তাশক্তি ও দো‘আ সুন্দর করবে।

১. ধৈর্য ধারণ করা

মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর আমরা তোমাদেরকে মন্দ ও ভাল দ্বারা পরীক্ষা করে থাকি এবং আমাদের কাছেই তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে’ (আম্বিয়া ২১/৩৫)

কল্যাণ দ্বারা পরীক্ষিত হ’লে শুকরিয়া জ্ঞাপন করা এবং মুছীবত দ্বারা পরীক্ষিত হ’লে ধৈর্যধারণ করা মমিনের কর্তব্য। সুতরাং বিপদের সময় দীর্ঘ হ’লে সাবধান থাকা এবং অধিক পরিমাণে দো‘আ করা উচিত। এটাই মুমিনের বৈশিষ্ট্য। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ধৈর্যশীল মুমিনদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে বলেন, ‘মুমিনের ব্যাপারটি বড়ই বিস্ময়কর। তার সমস্ত বিষয়টিই কল্যাণময়। মুমিন ব্যতীত আর কারো জন্য এরূপ নেই। যখন তাকে কল্যাণ স্পর্শ করে, তখন সে শুকরিয়া আদায় করে। ফলে এটা তার জন্য কল্যাণকর হয়। আর যখন তাকে অকল্যাণ স্পর্শ করে, তখন সে ছবর করে। ফলে এটাও তার জন্য কল্যাণকর হয়’।

২. দো‘আ দেরীতে কবুল হওয়ার কারণ অনুসন্ধান করা

দো‘আকারীর ভুলের কারণে কখনো দো‘আ কবুল হয় না। দো‘আর সময় সে সন্দেহপূর্ণ খাবার খেত অথবা দো‘আর সময় তার অন্তর অমনোযোগী ছিল। কিংবা সে নিষিদ্ধ পাপাচারে জড়িত ছিল। ফলে দো‘আ কবুল হ’তে দেরী হ’লে নিজের মধ্যে অনুসন্ধান করতে হবে কেন দো‘আ কবুল হচ্ছে না? সেজন্য লক্ষ্য রাখতে হবে আল্লাহর সাথে তার অবস্থা কি?

৩. পাপ বর্জন করা

কোন ব্যক্তি যদি তাক্বওয়া অবলম্বন করে তাহ’লে সে তার চাওয়া অনুযায়ী প্রাপ্ত হবে। একমাত্র পাপই তার দো‘আ কবুলের পথে অন্তরায়। জেনে রাখা আবশ্যক যে, তাক্বওয়া প্রশান্তির কারণ যা সমস্ত কল্যাণ উন্মুক্ত করে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘বস্ত্ততঃ যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার জন্য উপায় বের করে দেন। আর তিনি তাকে তার ধারণাতীত উৎস থেকে রিযিক প্রদান করে থাকেন’ (তাহরীম ৬৫/২-৩)। অপর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন, ‘বস্ত্ততঃ যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার জন্য কর্ম সহজ করে দেন’ (তাহরীম ৬৫/৪)

৪. আল্লাহ রাজাধিরাজ

আল্লাহ কাকে দিবেন আর কাকে বঞ্চিত করবেন, এটা তার ইচ্ছাধীন। তাঁর অনুগ্রহে কোন বাধাদানকারী নেই এবং তাঁর হুকুমের পর্যালোচনাকারীও কেউ নেই। তাঁর দান-দক্ষিণায় কেউ প্রতিরোধকারী নেই। মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালক যা চান তা-ই করে থাকেন’ (হূদ ১১/১০৬)

তিনি কাউকে দিলে সে অনুগ্রহ প্রাপ্ত আর কেউ প্রাপ্ত না হ’লেও তিনি ইনছাফকারী। কেননা আল্লাহ বলেন, ‘বস্ত্ততঃ তোমার প্রতিপালক তার বান্দাদের উপর অত্যাচারী নন’ (হা-মীম সাজদাহ ৪১/৪৬)

ইবনু নাছিরুদ্দীন দিমাশকী (রহঃ) বলেন, আল্লাহর আদেশ ও ফায়ছালা থেকে কারও মুখ ফিরিয়ে নেওয়া উচিত নয়। তার পূর্ণাঙ্গ হুকুম মানার ক্ষেত্রে বা পরীক্ষার সময় তাকে উপেক্ষা করারও কোন সুযোগ নেই। নিশ্চয়ই আল্লাহর জন্যই সমস্ত রাজত্ব ও আনুগত্য। তিনি আমাদের পরিচালনা করেন যেভাবে তিনি চান’। এই দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে আল্লাহর নিকটে দো‘আ অব্যাহত রাখতে হবে।

৫. আল্লাহ পরিপূর্ণ জ্ঞানের অধিকারী

তিনি কাউকে কিছু দিলে সেটা যেমন হিকমতপূর্ণ। আর কাউকে বঞ্চিত রাখলে তাও হিকমতপূর্ণ। সুতরাং অদৃশ্য হিকমতের অপক্ষোয় আল্লাহর উপর নির্ভরশীল হ’তে হবে। কেননা মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর অবশ্যই তোমরা এমন বহু কিছু অপসন্দ কর, যা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আর অবশ্যই এমন বহু কিছু পসন্দ কর, যা তোমাদের জন্য ক্ষতিকর। প্রকৃত প্রস্তাবে আল্লাহ সবকিছু জানেন, কিন্তু তোমরা জানো না’ (বাক্বারাহ ২/২১৬)

৬. বান্দার জন্য আল্লাহর পসন্দ তার নিজের পসন্দের চেয়ে উত্তম

এটা গোপন বিষয় যা আল্লাহকে ডাকার সময় বান্দাকে মনোযোগী হওয়ার ক্ষেত্রে উপযোগী করে তোলে। নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা শ্রেষ্ঠ বিচারক ও পরম দয়ালু। বান্দার জন্য কোনটা কল্যাণকর তিনিই অধিক জ্ঞাত। আর তিনি অধিক দয়াশীল তার স্বীয় ব্যক্তি জীবনের চেয়ে, এমনকি তার পিতা-মাতার চেয়েও। যখন তার উপর এমন কিছু নাযিল হয় যা সে অপসন্দ করে সেটাই তার জন্য কল্যাণকর। এটা আল্লাহ করে থাকেন বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে এবং তাদের উপর দয়া স্বরূপ।

সুফিয়ান ছাওরী (রহঃ) বলেন, তাকে না দেওয়াটাও একটা দান। এটা এজন্য যে তিনি তাকে কৃপণতা ও অন্য খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখেন। মূলতঃ তিনি বান্দার কল্যাণের দিকে লক্ষ্য রাখেন। অতঃপর তাকে না দেওয়াটাও কল্যাণকর বিষয়’।

৭. মানুষ তার কাজের ফলাফল সম্পর্কে অজ্ঞাত

সে এমন কিছু চায় যা তার উপযোগী নয় বরং তার জন্য ক্ষতিকর। এর উদাহরণ ঐ উত্তেজিত শিশুর ন্যায় যে মিষ্টান্ন চায় অথচ সেটা তার জন্য ক্ষতিকর। সুতরাং মানুষের জন্য কোনটা কল্যাণকর আল্লাহই সর্বাধিক অবগত। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা এমন বহু কিছু অপসন্দ কর, যা তোমাদের জন্য কল্যাণকর’ (বাক্বারাহ ২/২১৬)

৮. মর্যাদাপূর্ণ ইবাদত পূর্ণ করা

আল্লাহ চান তাঁর বান্দারা মর্যাদাপূর্ণ ইবাদত পূর্ণ করুক। তিনি তাদের বিভিন্ন রকমের মুছীবত দ্বারা পরীক্ষা করেন। কখনো দেরীতে দো‘আ কবুলের মাধ্যমেও। যাতে তাঁর বান্দারা দো‘আ নামক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের পূর্ণতার উচ্চ শিখরে পৌঁছতে পারে। কেননা যথাযোগ্য ইবাদতেই বান্দার মর্যাদা পূর্ণ হয়। সুতরাং যখন একজন বান্দা যথাযোগ্য ইবাদত বৃদ্ধি করে তখন তার পূর্ণতাও বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়। সাথে সাথে তার মর্যাদাও বেশী হয়’। ফলে দো‘আ কবুল হ’তে দেরী হ’লে আল্লাহর উপর ভরসা করে উত্তম কিছু পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। তাহ’লে ভাল কিছুই অর্জন হবে।

৯. প্রিয় ব্যক্তিদের নিকট কষ্ট আসে

আল্লাহ তা‘আলা তাঁর প্রিয় বান্দাদের দুনিয়ায় কষ্টের সম্মুখীন করে থাকেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা যখন তাঁর কোন বান্দার মঙ্গল সাধনের ইচ্ছা করেন তখন দুনিয়ায় তাকে অতি তাড়াতাড়ি বিপদাপদের সম্মুখীন

করেন। আর যখন তিনি কোন বান্দার অকল্যাণের ইচ্ছা করেন তখন তার গুনাহের শাস্তি প্রদান থেকে বিরত থাকেন। অবশেষে ক্বিয়ামতের দিন তাকে এর পরিপূর্ণ শাস্তি প্রদান করেন। আর আল্লাহ তা‘আলা যখন কোন সম্প্রদায়কে ভালবাসেন তখন তাদের তিনি পরীক্ষায় ফেলেন। যে তাতে সন্তুষ্ট থাকে তার জন্য (আল্লাহর) সন্তুষ্টি থাকে। আর যে তাতে অসন্তুষ্ট হয় তার জন্য (আল্লাহর) অসন্তুষ্টি থাকে’।

সুতরাং বিপদাপদে ধৈর্যধারণ করে আল্লাহর কাছে কল্যাণ কামনা করতে হবে। কেননা তিনিই একমাত্র জানেন বান্দার কল্যাণ কোথায়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যদি তোমরা তাদের অপসন্দ কর, (তবে হ’তে পারে) তোমরা এমন বস্ত্তকে অপসন্দ করছ, যার মধ্যে আল্লাহ প্রভূত কল্যাণ রেখেছেন’ (নিসা ৪/১৯)

পরিশিষ্ট

দো‘আ করে কখনও নিরাশ হওয়া যাবে না। বরং দো‘আ কবুল হোক বা না হোক, আল্লাহর নিকট দো‘আ অব্যাহত রাখতে হবে এবং রাসূল (ছাঃ)-এর নিম্নোক্ত হাদীছটি স্মরণ রাখতে হবে। যেখানে তিনি বলেছেন, কোন মুসলিম দো‘আ করার সময় কোন গুনাহের অথবা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নের দো‘আ না করলে অবশ্যই আল্লাহ তা‘আলা তাকে এ তিনটির একটি দান করেন

(১) হয়তো তাকে তার কাঙ্ক্ষিত বস্ত্ত দুনিয়ায় দান করেন, অথবা

(২) তা তার পরকালের জন্য জমা রাখেন অথবা

(৩) তার কোন অকল্যাণ বা বিপদাপদকে তার থেকে দূর করে দেন’।

আল্লাহ তা‘আলা আমাদের প্রত্যেককে কবুলযোগ্য দো‘আ করার তওফীক দান করুন-আমীন!


১. মুসলিম হা/২৯৯৯; মিশকাত হা/৫২৯৭।
২. বারদুল আকবাদ ইন্দা ফাকদিল আওলাদ, ৩৮ পৃ.।
৩. মাদারিজুস সালিকীন ২/২১৫ পৃ.।
৪. উবুদিয়াত লি ইবনু তাইমিয়াহ ৮০ পৃ.।
৫. তিরমিযী হা/২৩৯৬; ছহীহাহ হা/১২২০; মিশকাত হা/১৫৬৫।
৬. আহমাদ হা/১১১৪৯; ছহীহুত তারগীব হা/১৬৩৩; মিশকাত হা/২২৫৯।

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button