ছালাত, দো'আ ও যিকর

মসজিদে জামা‘আতে ছালাত আদায়ের ফযীলত, অপরিহার্যতা ও গুরুত্ব

মহান আল্লাহ বান্দার উপর যে সমস্ত ইবাদত ফরয করেছেন, তার মধ্যে অন্যতম হলো ছালাত। ছালাত এমন একটি ইবাদত, যা একজন মুসলিম ব্যক্তিকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিদিন কমপক্ষে পাঁচবার আদায় করতে হয়। এমনকি অসুস্থ অবস্থায় বসে বা শুয়ে হলেও আদায় করতে হয়, তবুও মাফ নেই। সাথে সাথে ইসলামে জামা‘আতের সঙ্গে ছালাত আদায়ের খুবই গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন,وَارْكَعُوا مَعَ الرَّاكِعِينَ ‘তোমরা রুকূ‘কারীদের সাথে রুকূ‘ কর’ (বাক্বারাহ, ৪৩)। অর্থাৎ ছালাত আদায়কারীগণের সাথে ছালাত আদায় কর।

১. জামা‘আতের সঙ্গে ছালাত আদায়ের ফযীলত :

(১) রাসূল (ছাঃ) বলেন,صَلاَةُ الجَمَاعَةِ تَفْضُلُ صَلاَةَ الفَذِّ بِسَبْعٍ وَعِشْرِينَ دَرَجَةً ‘জামা‘আতের সঙ্গে আদায়কৃত ছালাতের ফযীলত একাকী আদায়কৃত ছালাত অপেক্ষা সাতাশ’ গুণ বেশী’। অন্য বর্ণনায় এসেছে, صَلاَةُ الجَمَاعَةِ تَفْضُلُ صَلاَةَ الفَذِّ بِخَمْسٍ وَعِشْرِينَ دَرَجَةً ‘জামা‘আতের সঙ্গে আদায়কৃত ছালাতের ফযীলত একাকী আদায়কৃত ছালাত অপেক্ষা পঁচিশ গুণ বেশী’।

(২) মুছল্লীদের সংখ্যা যত বেশী হবে, জামা‘আতের সঙ্গে ছালাত আদায়ের ফযীলত তত বেশী হবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, إِنَّ صَلَاةَ الرَّجُلِ مَعَ الرَّجُلِ أَزْكَى مِنْ صَلَاتِهِ وَحْدَهُ، وَصَلَاتُهُ مَعَ الرَّجُلَيْنِ أَزْكَى مِنْ صَلَاتِهِ مَعَ الرَّجُلِ، وَمَا كَثُرَ فَهُوَ أَحَبُّ إِلَى اللَّهِ تَعَالَى ‘একজন ব্যক্তির একাকী ছালাত আদায় অপেক্ষা দু’জনের একত্রে ছালাত আদায় করা অধিক উত্তম এবং দু’জনের একত্রে ছালাত অপেক্ষা তিনজনের একত্রে ছালাত আদায় করা আরও অধিক উত্তম। এর অধিক জামা‘আতে যতই লোক বেশী হবে, ততই তা মহান আল্লাহর নিকট অধিক পসন্দনীয়’।

(৩) জামা‘আতের সঙ্গে একাধারে চল্লিশ দিন ছালাত আদায় করার বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, مَنْ صَلَّى لِلَّهِ أَرْبَعِينَ يَوْمًا فِي جَمَاعَةٍ يُدْرِكُ التَّكْبِيرَةَ الأُولَى كُتِبَ لَهُ بَرَاءَتَانِ: بَرَاءَةٌ مِنَ النَّارِ، وَبَرَاءَةٌ مِنَ النِّفَاقِ ‘কোন ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার সন্তোষ লাভের উদ্দেশ্যে একাধারে চল্লিশ দিন তাকবীরে তাহরীমাসহ জামা‘আতের সঙ্গে ছালাত আদায় করতে পারলে তাকে দু’টি নাজাতের ছাড়পত্র দেওয়া হয়- জাহান্নাম হতে নাজাত এবং মুনাফিক্বী হতে নাজাত’।

(৪) বিশেষ বিশেষ ওয়াক্তের ছালাত জামা‘আতের সঙ্গে আদায় করার বিভিন্ন ফযীলত হাদীছে বর্ণিত হয়েছে। যেমন, এশা ও ফজরের ছালাত জামা‘আতের সঙ্গে আদায় করার বিষয়ে রাসূল (ছাঃ) বলেন,مَنْ صَلَّى الْعِشَاءَ فِي جَمَاعَةٍ فَكَأَنَّمَا قَامَ نِصْفَ اللَّيْلِ، وَمَنْ صَلَّى الصُّبْحَ فِي جَمَاعَةٍ فَكَأَنَّمَا صَلَّى اللَّيْلَ كُلَّهُ ‘যে ব্যক্তি জামা‘আতের সঙ্গে এশার ছালাত আদায় করল, সে যেন অর্ধরাত পর্যন্ত ছালাত আদায় করল। আর যে ব্যক্তি জামা‘আতের সঙ্গে ফজরের ছালাত আদায় করল, সে যেন সারা রাত ছালাত আদায় করল’।

(৫) মসজিদে জামা‘আতের সঙ্গে ছালাত আদায়ের জন্য অপেক্ষাকারী ব্যক্তি ছালাতে রত বলে গণ্য করা হয়। রাসূল (ছাঃ) বলেন,لاَ يَزَالُ العَبْدُ فِي صَلاَةٍ مَا كَانَ فِي المَسْجِدِ يَنْتَظِرُ الصَّلاَةَ مَا لَمْ يُحْدِثْ ‘বান্দা যে সময়টা মসজিদে ছালাতের অপেক্ষায় থাকে, তার পুরো সময়টাই ছালাতের মধ্যে গণ্য হয়, যতক্ষণ না তার ওযূ ভঙ্গ হয়’।

(৬) মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে জামা‘আতের সঙ্গে ছালাত আদায় করতে দেখে খুবই খুশী হন। রাসূল (ছাঃ) বলেন, إِنَّ اللهَ لَيَعْجَبُ مِنَ الصَّلَاةِ فِي الْجَمِيعِ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা সকলের সাথে (জামা‘আতে) ছালাত আদায়ে খুশী হন’।

(৭) জামা‘আতে ছালাত আদায়ের সময় ইমাম যখন সূরা ফাতিহা শেষে ‘আমীন’ বলেন, তখন মুক্তাদিও যদি ‘আমীন’ বলেন এবং তার ‘আমীন’ ফেরেশতাদের ‘আমীন’-এর সাথে মিলে যায়, তাহলে মহান আল্লাহ তার সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেন। রাসূল (ছাঃ) বলেন,إِذَا أَمَّنَ الإِمَامُ، فَأَمِّنُوا، فَإِنَّهُ مَنْ وَافَقَ تَأْمِينُهُ تَأْمِينَ المَلاَئِكَةِ غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ ‘ইমাম যখন ‘আমীন’ বলেন তখন তোমরাও ‘আমীন’ বলো। কেননা যার ‘আমীন’ বলা ফেরেশতাদের ‘আমীন’ বলার সাথে একই সময় হয়, তার পূর্বের সব গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়’।

২. জামা‘আতের সঙ্গে ছালাত আদায়ের অপরিহার্যতা :

দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত জামা‘আতের সঙ্গে আদায় করা প্রত্যেক মুসলিমের উপর ওয়াজিব বা আবশ্যকীয়। এটি পবিত্র কুরআন, ছহীহ সুন্নাহ ও ছাহাবায়ে কেরামের বিভিন্ন আছার দ্বারা সাব্যস্ত হয়েছে। যেমন :

(১) ভয়-ভীতি অবস্থায়ও মহান আল্লাহ জামা‘আতের সঙ্গে ছালাত আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন,وَإِذَا كُنْتَ فِيهِمْ فَأَقَمْتَ لَهُمُ الصَّلَاةَ فَلْتَقُمْ طَائِفَةٌ مِنْهُمْ مَعَكَ وَلْيَأْخُذُوا أَسْلِحَتَهُمْ فَإِذَا سَجَدُوا فَلْيَكُونُوا مِنْ وَرَائِكُمْ وَلْتَأْتِ طَائِفَةٌ أُخْرَى لَمْ يُصَلُّوا فَلْيُصَلُّوا مَعَكَ وَلْيَأْخُذُوا حِذْرَهُمْ وَأَسْلِحَتَهُمْ ‘আর আপনি যখন তাদের মধ্যে অবস্থান করবেন, তারপর তাদের সাথে ছালাত আদায় করবেন, তখন তাদের একদল আপনার সাথে যেন দাঁড়ায় এবং তারা যেন সশস্ত্র থাকে। তাদের সিজদাহ করা হলে তারা যেন তোমাদের পিছনে অবস্থান করে; আর অপর একদল যারা ছালাতে শরীক হয়নি তারা আপনার সাথে যেন ছালাতে শরীক হয় এবং তারা যেন সতর্ক ও সশস্ত্র থাকে’ (নিসা, ১০২)

উক্ত আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা প্রচন্ড ভয়-ভীতিকালীন সময়েও জামা‘আতের সাথে ছালাত আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন। সুতরাং জামা‘আতের সঙ্গে ছালাত আদায় করা যদি সুন্নাত হত, তাহলে এরকম অবস্থায় একাকী ছালাত আদায়ে ছাড় থাকাই স্বাভাবিক ছিল।

(২) দুনিয়ায় যারা জামা‘আতের সঙ্গে ছালাত আদায়ের জন্য আহবানকারীর ডাকে সাড়া দেয়নি, ক্বিয়ামতের দিন তারা মহান আল্লাহর সামনে সিজদাহ করতে সক্ষম হবে না। তারা সিজদাহ করতে যাবে কিন্তু তাদের পিঠ বাঁকা হবে না। মহান আল্লাহ বলেন,يَوْمَ يُكْشَفُ عَنْ سَاقٍ وَيُدْعَوْنَ إِلَى السُّجُودِ فَلَا يَسْتَطِيعُونَ -خَاشِعَةً أَبْصَارُهُمْ تَرْهَقُهُمْ ذِلَّةٌ وَقَدْ كَانُوا يُدْعَوْنَ إِلَى السُّجُودِ وَهُمْ سَالِمُونَ ‘স্মরণ করুন সে দিনের কথা, যেদিন পায়ের গোছা উন্মোচিত করা হবে, সেদিন তাদেরকে ডাকা হবে সিজদাহ করার জন্য, কিন্তু তারা সক্ষম হবে না; তাদের দৃষ্টি অবনত, হীনতা তাদেরকে আচ্ছন্ন করবে অথচ যখন তারা নিরাপদ ছিল তখন তাদেরকে ডাকা হত সিজদাহ করতে’ (ক্বালাম, ৪২-৪৩)

(৩) রাসূল (ছাঃ) জামা‘আতের সঙ্গে ছালাত আদায় করতে নির্দেশ দিয়েছেন। মালিক ইবনু হুওয়াইরিছ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আমার গোত্রের কয়েকজন লোকের সঙ্গে নবী (ছাঃ)-এর নিকট এলাম এবং আমরা তাঁর নিকট বিশ দিন অবস্থান করলাম। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) অত্যন্ত দয়ালু ও বন্ধু বৎসল ছিলেন। তিনি যখন আমাদের মধ্যে নিজ পরিজনের নিকট ফিরে যাওয়ার আগ্রহ লক্ষ্য করলেন, তখন তিনি আমাদের বললেন, ارْجِعُوا فَكُونُوا فِيهِمْ، وَعَلِّمُوهُمْ، فَإِذَا حَضَرَتِ الصَّلاَةُ فَلْيُؤَذِّنْ لَكُمْ أَحَدُكُمْ، وَلْيَؤُمَّكُمْ أَكْبَرُكُمْ  ‘তোমরা পরিজনের নিকট ফিরে যাও এবং তাদের মধ্যে বসবাস কর। তাদেরকে দ্বীন শিক্ষা দিবে এবং ছালাত আদায় করবে। যখন ছালাতের সময় হবে, তখন তোমাদের কেউ আযান দিবে এবং তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি বড় সে ইমামতি করবে’।

(৪) আবুদ্দারদা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি,مَا مِنْ ثَلَاثَةٍ فِي قَرْيَةٍ وَلَا بَدْوٍ لَا تُقَامُ فِيهِمُ الصَّلَاةُ إِلَّا قَدِ اسْتَحْوَذَ عَلَيْهِمُ الشَّيْطَانُ، فَعَلَيْكَ بِالْجَمَاعَةِ فَإِنَّمَا يَأْكُلُ الذِّئْبُ الْقَاصِيَةَ ‘যখন কোন গ্রামে বা মরুভূমিতে তিনজন লোক একত্রিত হয় এবং জামা‘আতে ছালাত আদায় না করে, তখন শয়তান তাদের উপর প্রভাব বিস্তার করে। অতএব তোমরা অবশ্যই জামা‘আতের সাথে ছালাত আদায় কর। কেননা দলচ্যুত বকরীকে নেকড়ে বাঘে ভক্ষণ করে থাকে’।১০

(৫) রাসূল (ছাঃ) বলেন,لَيَنْتَهِيَنَّ أَقْوَامٌ عَنْ وَدْعِهِمُ الْجَمَاعَاتِ، أَوْ لَيَخْتِمَنَّ اللَّهُ عَلَى قُلُوبِهِمْ، ثُمَّ لَيَكُونُنَّ مِنَ الْغَافِلِينَ ‘লোকেরা অবশ্যই যেন জামা‘আতের সঙ্গে ছালাত ত্যাগ করা থেকে বিরত থাকে। অন্যথা আল্লাহ অবশ্যই তাদের অন্তরে সীলমোহর মেরে দিবেন, অতঃপর তারা বিস্মৃতদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়বে’।১১ বলা বাহুল্য, এরকম সতর্কবাণী শুধুমাত্র ওয়াজিব পরিত্যাগের ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে।

(৬) রাসূল (ছাঃ) বলেন,مَنْ سَمِعَ النِّدَاءَ فَلَمْ يَأْتِهِ، فَلَا صَلَاةَ لَهُ، إِلَّا مِنْ عُذْرٍ ‘যে ব্যক্তি আযান শুনলো এবং তার কোন ওযর না থাকা সত্ত্বেও জামা‘আতে উপস্থিত হলো না, তার ছালাত কবূল হবে না’।১২

(৭) ইবনে আব্বাস (রাঃ)-কে এক ব্যক্তি সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলো, সে দিনভর ছিয়াম রাখে এবং রাতভর ছালাত আদায় করে, কিন্তু জুমু‘আয় ও জামা‘আতের সঙ্গে ছালাতে উপস্থিত হয় না। তিনি বললেন, هُوَ فِي النَّار ‘সে জাহান্নামী’।১৩

(৮) জামা‘আতের সঙ্গে ছালাত আদায় ওয়াজিব মর্মে ছাহাবায়ে কেরামের ইজমা’ সংঘটিত হয়েছে। কারণ, এ বিষয়ে অনেক বিজ্ঞ ছাহাবীর বক্তব্য পাওয়া যায় এবং তাদের বক্তব্যের কেউ বিরোধিতা করেছেন বলে প্রমাণ নেই।১৪

৩. মসজিদে জামা‘আতের সঙ্গে ছালাত আদায়ের গুরুত্ব :

পূর্বের আলোচনা থেকে সুস্পষ্ট যে, জামা‘আতের সঙ্গে ছালাত আদায়ে একজন মুসলিমের জন্য যেমন রয়েছে অফুরন্ত ছওয়াব, তেমনি পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত জামা‘আতের সঙ্গেই আদায় করার রয়েছে বাধ্যবাধকতা। অর্থাৎ বিষয়টি তার ইচ্ছাধীন নয় যে, ইচ্ছা হলে জামা‘আতে পড়বে, আর না হলে একাকী পড়বে; বরং কোন প্রকার ওযর না থাকলে একজন মুসলিম জামা‘আতের সঙ্গে ছালাত আদায়ে বাধ্য। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যে কোন স্থানে জামা‘আত করলেই কি এ ওয়াজিব আদায় হয়ে যাবে, নাকি মসজিদে গিয়েই জামা‘আতের সঙ্গে ছালাত আদায় করতে হবে? কারণ, বর্তমানে বিভিন্ন অফিস-আদালত, সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, আবাসিক হল প্রভৃতি স্থানে মুছল্লা (ছালাত আদায়ের স্থান) বানিয়ে জামা‘আত আদায়ের প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। শুধু তাই নয়; বরং অনেক সময় একটি ভবনের প্রতি তলায় একটি করে মুছল্লা দেখা যায়। যদিও এ সমস্ত মুছল্লার কারণে সঠিক সময়ে ছালাত আদায় করা সহজ হয়, তদুপরি ইসলামী শরী‘আতে জামা‘আতের সঙ্গে ছালাত আদায়ের যে বিধান, সেটি কি পুরোপুরিভাবে পালিত হচ্ছে? মসজিদে গিয়ে জামা‘আতের সঙ্গে ছালাত আদায় করলে যে ছওয়াব হয়, বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক কল্যাণ সাধিত হয়, সাময়িকভাবে গ্রহণ করা এসব মুছল্লায় তা কি সম্ভব? বিষয়টি পরিষ্কারভাবে ফুটিয়ে তুলতে আরো কয়েকটি দিক আলোচনা করা প্রয়োজন বলে মনে করছি।

মসজিদ ও মুছল্লার মধ্যে পার্থক্য :

(১) মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত জামা‘আতের সঙ্গে নিয়মিত আদায় করা হয় এবং দারসসহ বিভিন্ন শিক্ষামূলক কর্মকান্ড পরিচালিত হয়। পক্ষান্তরে মুছল্লায় প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত আদায় করা হয় না; বরং নির্দিষ্ট কিছু ওয়াক্তের ছালাত আদায় করা হয়, তবুও প্রতিদিন নয়। যেমন, বিভিন্ন অফিস-আদালতে ছুটির দিনে স্বাভাবিকভাবে কোন ছালাতই  আদায় করা হয় না।

(২) মসজিদের জমি নির্দিষ্টভাবে মসজিদের নামেই রেজিষ্ট্রিকৃত হওয়া শর্ত। পক্ষান্তরে মুছল্লার ক্ষেত্রে এমনটি হওয়া শর্ত নয়।

(৩) পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে মসজিদের যেসব হুকুম-আহকাম সাব্যস্ত হয়েছে সেগুলো শুধু মসজিদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। যেমন, দুই রাক‘আত তাহিয়্যাতুল মসজিদ। পক্ষান্তরে মুছল্লায় মুসজিদের সকল বিধান প্রযোজ্য হবে না। যেমন, ঋতুগ্রস্ত মহিলাদের মসজিদে অবস্থানের বিধান।

শায়খ ইবনে উছায়মীন (রাহঃ)-কে মসজিদ ও মুছল্লার পার্থক্য সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, আমভাবে পৃথিবীর সকল স্থানকে মসজিদ বলা হয়। কেননা রাসূল  বলেছেন, جُعِلَتْ لِي الأَرْضُ مَسْجِدًا وَطَهُورًا ‘সমস্ত যমীন আমার জন্য মসজিদ ও পবিত্রতা অর্জনের মাধ্যম করা হয়েছে’।১৫ তবে খাছভাবে মসজিদ বলতে যে স্থানে নিয়মিত ছালাত আদায় করা হয় সে স্থানকে বুঝায়, চাই সেটি মাটির তৈরি হোক বা পাথরের তৈরি হোক অথবা ইটের তৈরি হোক। পক্ষান্তরে মুছল্লা হল, যে স্থানে ছালাত আদায় করা হয়, কিন্তু নিয়মিতভাবে ছালাতের জন্য সে স্থানকে নির্দিষ্ট করা হয়নি। তার প্রমাণ হলো, রাসূল (ছাঃ) বাড়ীতে নফল ছালাত আদায় করতেন, কিন্তু তার বাড়ী মসজিদ নয়।১৬


বিভিন্ন অফিস-আদালত, সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, আবাসিক হল প্রভৃতি স্থানে মুছল্লা বানিয়ে জামা‘আতের সঙ্গে ছালাত আদায় করলে ওয়াজিব আদায় হবে কি? নাকি জামা‘আতের সঙ্গে ছালাত আদায়ের যে বাধ্যবা(ছাঃ)কতা সেটি মসজিদের সাথেই নির্দিষ্ট? নিম্বে বর্ণিত কয়েকটি হাদীছ থেকে এর জবাব স্পষ্ট হবে ইনশাআল্লাহ।

(১) জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,

أُعْطِيتُ خَمْسًا لَمْ يُعْطَهُنَّ أَحَدٌمِنَ الأَنْبِيَاءِ قَبْلِي: نُصِرْتُ بِالرُّعْبِ مَسِيرَةَ شَهْرٍ، وَجُعِلَتْ لِي الأَرْضُ مَسْجِدًا وَطَهُورًا، وَأَيُّمَا رَجُلٍ مِنْ أُمَّتِي أَدْرَكَتْهُ الصَّلاَةُ فَلْيُصَلِّ، وَأُحِلَّتْ لِي الغَنَائِمُ، وَكَانَ النَّبِيُّ يُبْعَثُ إِلَى قَوْمِهِ خَاصَّةً، وَبُعِثْتُ إِلَى النَّاسِ كَافَّةً، وَأُعْطِيتُ الشَّفَاعَةَ

‘আমাকে এমন পাঁচটি বিষয় প্রদান করা হয়েছে, যা আমার পূর্বে কোন নবীকে দেয়া হয়নি: (১) আমাকে প্রবল প্রভাব দিয়ে সাহায্য করা হয়েছে যা এক মাসের দূরত্ব থেকে অনুভূত হয়। (২) সমস্ত যমীন আমার জন্য ছালাত আদায়ের স্থান ও পবিত্রতা অর্জনের মাধ্যম করা হয়েছে। কাজেই আমার উম্মতের যে কেউ যেখানে ছালাতের ওয়াক্ত হয় সেখানেই যেন ছালাত আদায় করে নেয়। (৩) আমার জন্য গনীমতের মাল হালাল করা হয়েছে। (৪) অন্যান্য নবী বিশেষভাবে নিজের গোত্রের নিকট প্রেরিত হতেন, আর আমাকে সকল মানুষের নিকট প্রেরণ করা হয়েছে। (৫) আমাকে সার্বজনীন সুপারিশের অধিকার প্রদান করা হয়েছে’।১৭

(২) আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি তাঁর দুই সাথীকে নিয়ে তার বাড়ীতেই জামা‘আতের সঙ্গে ছালাত আদায় করেছিলেন। যদিও মসজিদ তাঁর বাড়ী থেকে নিকটেই ছিল।১৮

(৩) আলা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি যোহরের ছালাত আদায় করার পর আনাস ইবনু মালিক (রাঃ)-এর বাছরার বাসস্থানে গেলেন। তাঁর বাড়ী মসজিদের পার্শ্বেই ছিল। আলা বলেন, যখন আমরা তাঁর নিকট উপস্থিত হলাম তিনি জিজ্ঞেস করলেন, أَصَلَّيْتُمُ الْعَصْرَ؟ ‘তোমরা কি আছরের ছালাত আদায় করেছ?’ আমরা বললাম, না। আমরা তো এইমাত্র যোহরের ছালাত আদায় করলাম। তিনি বললেন, فَصَلُّوا الْعَصْرَ ‘এখন আছরের ছালাত আদায় কর’। আলা (রাঃ) বলেন, আমরা ততক্ষণাৎ দাঁড়িয়ে গেলাম এবং ছালাত আদায় করলাম।১৯

উপর্যুক্ত হাদীছগুলো থেকে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, বাড়ী, অফিস-আদালত, আবাসিক-অনাবাসিক হল সহ যে কোন স্থানে জামা‘আতের সঙ্গে ছালাত আদায় করলে সেটি বিশুদ্ধ হবে, যদি ছালাতের রুকন, ওয়াজিব, শর্তগুলো যথাযথভাবে পালন করা হয়। তবে নিঃসন্দেহে মসজিদে গিয়ে জামা‘আতের সঙ্গে ছালাত আদায় করার অনেক গুরুত্ব ও ফযীলত রয়েছে, যা সামনের আলোচনা থেকে পরিষ্কার হবে বলে আশা করছি।

মসজিদে জামাআতের সঙ্গে ছালাত আদায়ের গুরুত্ব ও ফযীলত :

(১) মহান আল্লাহ বলেন,

فِي بُيُوتٍ أَذِنَ اللَّهُ أَنْ تُرْفَعَ وَيُذْكَرَ فِيهَا اسْمُهُ يُسَبِّحُ لَهُ فِيهَا بِالْغُدُوِّ وَالْآصَالِ – رِجَالٌ لَا تُلْهِيهِمْ تِجَارَةٌ وَلَا بَيْعٌ عَنْ ذِكْرِ اللَّهِ وَإِقَامِ الصَّلَاةِ وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ يَخَافُونَ يَوْمًا تَتَقَلَّبُ فِيهِ الْقُلُوبُ وَالْأَبْصَارُ

‘সেসব মসজিদে, যাকে সমুন্নত করতে এবং যাতে তাঁর নাম স্মরণ করতে আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন। সকাল ও সন্ধ্যায় তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে সেসব লোক, যাদেরকে ব্যবসা-বাণিজ্য ও ক্রয়-বিক্রয় কোনটিই আল্লাহর স্মরণ থেকে এবং ছালাত ক্বায়েম ও যাকাত প্রদান থেকে বিরত রাখে না, তারা ভয় করে সে দিনকে, যেদিন অনেক অন্তর ও দৃষ্টি উল্টে যাবে’ (সূরা নূর, ৩৬-৩৭)।

অধিকাংশ মুফাসসির আয়াতে বর্ণিত بُيُوتٍ কে মসজিদ অর্থে গ্রহণ করেছেন। উক্ত আয়াত দুটিতে মসজিদে জামা‘আতের সঙ্গে ছালাত আদায়ে মনোযোগী হওয়ার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।

(২) আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন,

إِنَّ أَثْقَلَ صَلَاةٍ عَلَى الْمُنَافِقِينَ صَلَاةُ الْعِشَاءِ، وَصَلَاةُ الْفَجْرِ، وَلَوْ يَعْلَمُونَ مَا فِيهِمَا لَأَتَوْهُمَا وَلَوْ حَبْوًا، وَلَقَدْ هَمَمْتُ أَنْ آمُرَ بِالصَّلَاةِ، فَتُقَامَ، ثُمَّ آمُرَ رَجُلًا فَيُصَلِّيَ بِالنَّاسِ، ثُمَّ أَنْطَلِقَ مَعِي بِرِجَالٍ مَعَهُمْ حُزَمٌ مِنْ حَطَبٍ إِلَى قَوْمٍ لَا يَشْهَدُونَ الصَّلَاةَ، فَأُحَرِّقَ عَلَيْهِمْ بُيُوتَهُمْ بِالنَّارِ

‘এক অন্ধ ব্যক্তি রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে এসে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার এমন কেউ নেই, যে আমাকে মসজিদে নিয়ে আসবে। তারপর তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে নিজ ঘরে ছালাত আদায়ের অনুমতি চাইলেন। তিনি তাকে অনুমতি দিলেন। অন্ধ ব্যক্তিটি যখন চলে যাচ্ছিলেন, তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে ডাকলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কি ছালাতের আযান শুনতে পাও’? তিনি বললেন, হ্যাঁ। রাসূল (ছাঃ) বললেন, ‘তবে তুমি মসজিদে হাযির হবে’।২০

আমরা জানি, রাসূল (ছাঃ)-কে যখনই দুটি জিনিসের একটি গ্রহণের স্বাধীনতা দেয়া হতো, তখন তিনি সহজটিই গ্রহণ করতেন যদি তা গুনাহ না হত।২১ অথচ অন্ধ ব্যক্তির কষ্ট সত্ত্বেও তিনি তার মসজিদে যাওয়াকেই বেছে নিয়েছেন। অন্ধ ব্যক্তির জন্যও যদি ছাড় না থাকে, তাহলে মহান আল্লাহ যাদেরকে দুটি চোখ সহ অসংখ্য নে‘মত দান করেছেন, সুস্থতা দান করেছেন, তাদের ক্ষেত্রে কী হুকুম হতে পারে?

(৩) আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,

إِنَّ أَثْقَلَ صَلَاةٍ عَلَى الْمُنَافِقِينَ صَلَاةُ الْعِشَاءِ، وَصَلَاةُ الْفَجْرِ، وَلَوْ يَعْلَمُونَ مَا فِيهِمَا لَأَتَوْهُمَا وَلَوْ حَبْوًا، وَلَقَدْ هَمَمْتُ أَنْ آمُرَ بِالصَّلَاةِ، فَتُقَامَ، ثُمَّ آمُرَ رَجُلًا فَيُصَلِّيَ بِالنَّاسِ، ثُمَّ أَنْطَلِقَ مَعِي بِرِجَالٍ مَعَهُمْ حُزَمٌ مِنْ حَطَبٍ إِلَى قَوْمٍ لَا يَشْهَدُونَ الصَّلَاةَ، فَأُحَرِّقَ عَلَيْهِمْ بُيُوتَهُمْ بِالنَّارِ

‘মুনাফিক্বদের জন্য সবচেয়ে ভারী ছালাত হলো এশা ও ফজরের ছালাত। তারা যদি এই দুই ছালাতে কী মর্যাদা আছে তা জানতে পারত; তবে হামাগুড়ি দিয়ে হলেও উপস্থিত হত। আমি মনস্থ করেছিলাম যে, ছালাতের ইক্বামত দেয়ার নির্দেশ দিয়ে একজনকে ইমামতির দায়িত্ব দিই, সে লোকদের নিয়ে ছালাত শুরু করুক। আর আমি লাকড়ীর বোঝাসহ একদল লোক নিয়ে সেসব লোকের ঘরে চলে যাই, যারা ছালাতে উপস্থিত হয় না। অতঃপর তাদের ঘর আগুন দিয়ে তাদের সহ জ্বালিয়ে দিই’।২২

উক্ত হাদীছে মসজিদে জামা‘আতের সঙ্গে ছালাত আদায়ের গুরুত্ব প্রমাণিত হয়। কারণ, যারা মসজিদে উপস্থিত হয়নি, হতে পারে তারা বাড়ীতে জামা‘আতের সঙ্গে ছালাত আদায় করেছে। কিন্তু রাসূল (ছাঃ) তাদেরকে এটি জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন মনে করেননি; বরং যারাই মসজিদে উপস্থিত হয়নি তাদের সকলের বাড়ী জ্বালিয়ে দিতে চেয়েছেন, চাই তারা ছালাত আদায় করুক বা না করুক। কিন্তু বাড়ীতে মহিলা, শিশু থাকার কারণে তিনি এটি করেননি। কারণ, তাদের মসজিদে যাওয়া বাধ্যতামূলক নয়।

(৪) মসজিদে জামা‘আতের সঙ্গে ছালাত আদায়ের গুরুত্ব প্রসঙ্গে সালাফে-ছালেহীনের অনেক বক্তব্য পাওয়া যায়। যেমন :

(ক) ইবনে মাসঊদ (রাঃ) বলেন,

لَقَدْ رَأَيْتُنَا وَمَا يَتَخَلَّفُ عَنِ الصَّلَاةِ إِلَّا مُنَافِقٌ قَدْ عُلِمَ نِفَاقُهُ، أَوْ مَرِيضٌ، إِنْ كَانَ الْمَرِيضُ لَيَمْشِي بَيْنَ رَجُلَيْنِ حَتَّى يَأْتِيَ الصَّلَاةَ، إِنْ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَّمَنَا سُنَنَ الْهُدَى، وَإِنَّ مِنْ سُنَنَ الْهُدَى الصَّلَاةَ فِي الْمَسْجِدِ الَّذِي يُؤَذَّنُ فِيهِ

‘আমরা দেখেছি, চিহ্নিত মুনাফিক্ব এবং অসুস্থ ব্যক্তি ছাড়া কেউ জামা‘আতে অনুপস্থিত থাকে না। এমনকি যেসব রোগী দুই জনের কাঁধে ভর করে চলতে সক্ষম তারাও জামা‘আতে শরীক হতো। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদেরকে হেদায়াতের পন্থা শিক্ষা দিয়েছেন। তার মধ্যে একটি পন্থা হলো, যে মসজিদে আযান দেয়া হয়েছে, সেখানে ছালাত আদায় করা’।২৩  তিনি আরো বলেছেন,

وَلَوْ أَنَّكُمْ صَلَّيْتُمْ فِي بُيُوتِكُمْ كَمَا يُصَلِّي هَذَا الْمُتَخَلِّفُ فِي بَيْتِهِ، لَتَرَكْتُمْ سُنَّةَ نَبِيِّكُمْ، وَلَوْ تَرَكْتُمْ سُنَّةَ نَبِيِّكُمْ لَضَلَلْتُمْ

‘তোমরা যদি ঘরে ছালাত আদায় কর, যেমন একদল লোক জামা‘আত ছেড়ে ঘরে ছালাত করে, তাহলে তোমরা তোমাদের নবীর সুন্নাতকে পরিত্যাগ করলে। আর তোমরা যদি নবীর সুন্নাত পরিত্যাগ কর, তাহলে অবশ্যই পথভ্রষ্ট হয়ে যাবে’।২৪

(খ) ইবনে ওমর য বলেন, ‘আমরা যখন কোন ব্যক্তিকে এশা এবং ফজরের জামা‘আতে দেখতে পেতাম না, তখন তার সম্পর্কে খারাপ ধারণা পোষণ করতাম’।২৫

(গ) আবুশ শা‘ছা (রহিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা একদিন আবু হুরায়রা (রাঃ)-এর সঙ্গে মসজিদে উপবিষ্ট ছিলাম। মুআযযিন আযান দিলেন। তখন এক ব্যক্তি মসজিদ থেকে উঠে চলে যেতে লাগল। আবু হুরায়রা (রাঃ) তার দিকে দৃষ্টি দিলেন। লোকটি মসজিদ থেকে বেরিয়ে গেলে তিনি বললেন, أَمَّا هَذَا، فَقَدْ عَصَى أَبَا الْقَاسِمِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ‘লোকটি রাসূল (ছাঃ)-এর নাফারমানী করল’।২৬

(৫) মসজিদে জামা‘আতের সঙ্গে ছালাত আদায়ের জন্য যে ব্যক্তি সবসময় উদগ্রীব থাকে, ক্বিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ তাকে তাঁর ছায়ায় আশ্রয় দিবেন। রাসূল (ছাঃ) বলেন,سَبْعَةٌ يُظِلُّهُمُ اللَّهُ فِي ظِلِّهِ، يَوْمَ لاَ ظِلَّ إِلَّا ظِلُّهُ ‘সাত প্রকার মানুষকে আল্লাহ তা‘আলা ক্বিয়ামতের দিন তাঁর ছায়ায় আশ্রয় দিবেন’। তার মধ্যে এক প্রকার হল, رَجُلٌ قَلْبُهُ مُعَلَّقٌ فِي المَسَاجِدِ ‘যে ব্যক্তির অন্তর মসজিদের সাথে সম্পৃক্ত থাকে’।২৭

(৬) যে ব্যক্তি মসজিদে জামা‘আতের সঙ্গে ছালাত আদায়ের জন্য বেশী বেশী গমন করবে, আল্লাহ তা‘আলা তার পাপ ক্ষমা করে দিবেন এবং তার মর্যাদা বাড়িয়ে দিবেন।

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «أَلَا أَدُلُّكُمْ عَلَى مَا يَمْحُو اللهُ بِهِ الْخَطَايَا، وَيَرْفَعُ بِهِ الدَّرَجَاتِ؟» قَالُوا بَلَى يَا رَسُولَ اللهِ قَالَ: «إِسْبَاغُ الْوُضُوءِ عَلَى الْمَكَارِهِ، وَكَثْرَةُ الْخُطَا إِلَى الْمَسَاجِدِ، وَانْتِظَارُ الصَّلَاةِ بَعْدَ الصَّلَاةِ، فَذَلِكُمُ الرِّبَاطُ

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘আমি কি তোমাদেরকে এমন আমলের কথা বলব না, যা দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা পাপরাশি দূর করে দিবেন এবং মর্যাদা উঁচু করে দিবেন’? ছাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) বললেন, হ্যাঁ, অবশ্যই ইয়া রাসূলাল্লাহ! তিনি বললেন, ‘তা হলো, অসুবিধা ও কষ্ট সত্ত্বেও পরিপূর্ণভাবে ওযূ করা, মসজিদে আসার জন্য বেশী পদচারণা এবং এক ছালাতের পর অন্য ছালাতের জন্য অপেক্ষা করা। জেনে রাখ, এটাই হলো ‘রিবাত’ তথা নিজেকে পাপ থেকে হিফাযত করা এবং শয়তানের মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকা’।২৮

(৭) মসজিদে হেঁটে যাওয়ার যেমন মর্যাদা রয়েছে, তেমনি ফিরে আসাও আমলনামায় যুক্ত হবে। উবাই ইবনে কা‘ব (রাঃ) বলেন, এক ব্যক্তি ছিল, যার বাড়ী অপেক্ষা কারো বাড়ী মসজিদ থেকে অধিক দূরে ছিল বলে আমার জানা নেই। কিন্তু তার কোন ছালাত বাদ যেত না। তাকে বলা হলো অথবা আমি তাকে বললাম, তুমি যদি একটি গাধা ক্রয় কর, তাহলে তাতে চড়ে অন্ধকারে এবং গরমের সময় মসজিদে আসতে পারবে। সে বলল, আমার বাড়ী মসজিদের নিকটবর্তী হোক, তাতে আমি খুশি নই। আমি চাই যে, মসজিদে হেঁটে যাওয়া এবং ফিরে আসা আমার আমলনামায় লিখা হোক। রাসূল (ছাঃ) বলেন, إِنَّ لَكَ مَا احْتَسَبْتَ ‘তুমি যা আশা করেছ, তা তুমি পাবে’।২৯

(৮) আবু হুরায়রা প থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ غَدَا إِلَى المَسْجِدِ وَرَاحَ، أَعَدَّ اللَّهُ لَهُ نُزُلَهُ مِنَ الجَنَّةِ كُلَّمَا غَدَا أَوْ رَاحَ ‘যে ব্যক্তি সকালে বা সন্ধ্যায় যতবার মসজিদে যায়, আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য জান্নাতে ততবার মেহমানদারির ব্যবস্থা করে রাখেন’।৩০

(৯) জামা‘আতের সঙ্গে ছালাত আদায়ের জন্য মসজিদে গমনকারী ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার যিম্মায় থাকে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ثَلَاثَةٌ كُلُّهُمْ ضَامِنٌ عَلَى اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ ‘তিন প্রকার লোকের প্রত্যেকেই মহান আল্লাহর যিম্মাদারিতে থাকে’। তার মধ্যে এক প্রকার হলো, رَجُلٌ رَاحَ إِلَى الْمَسْجِدِ، فَهُوَ ضَامِنٌ عَلَى اللَّهِ حَتَّى يَتَوَفَّاهُ فَيُدْخِلَهُ الْجَنَّةَ، أَوْ يَرُدَّهُ بِمَا نَالَ مِنْ أَجْرٍ وَغَنِيمَةٍ ‘যে ব্যক্তি জামা‘আতে ছালাত আদায়ের উদ্দেশ্যে সমজিদের দিকে ধাবিত হয়, সে আল্লাহর যিম্মায় থাকে। এমতাবস্থায় সে যদি মারা যায় তবে আল্লাহ তা‘আলা তাকে জান্নাত দান করেন। আর মসজিদ থেকে ফিরে এলে তার প্রাপ্য পুণ্য ও যুদ্ধলব্ধ সম্পদের অংশীদার করেন’।৩১

(১০) কোন ব্যক্তি ওযূ করে মসজিদে গেলে মহান আল্লাহ খুবই খুশি হন। রাসূল (ছাঃ) বলেন,

لَا يَتَوَضَّأُ أَحَدٌ فَيُحْسِنُ وُضُوءَهُ وَيُسْبِغُهُ ثُمَّ يَأْتِي الْمَسْجِدَ لَا يُرِيدُ إِلَّا الصَّلَاةَ إِلَّا تَبَشْبَشَ اللَّهُ بِهِ كَمَا يَتَبَشْبَشُ أَهْلُ الْغَائِبِ بِطَلْعَتِهِ ‘কেউ যদি সুন্দরভাবে পরিপূর্ণরূপে ওযূ করে শুধুমাত্র ছালাতের উদ্দেশ্যে মসজিদে আসে, তাহলে আল্লাহ আ‘আলা এতটাই খুশি হন, যেমন পরিবার ছেড়ে বাইরে যাওয়া ব্যক্তি পরিবারের কাছে ফিরে আসলে খুশি হয়’।৩২

(১১) রাসূল (ছাঃ)-এর যুগে মসজিদ ছিল দ্বীন শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র। বর্তমানে যদি এ সুন্নাত জীবিত করা হয়, তাহলে সাধারণ মানুষ যেমন পাবে ইসলামের হুকুম-আহকাম শিখার সুবর্ণ সুযোগ, তেমনিভাবে হতে পারবে অশেষ ছওয়াবের অধিকারী। রাসূল (ছাঃ) বলেন

, مَا اجْتَمَعَ قَوْمٌ فِي بَيْتٍ مِنْ بُيُوتِ اللهِ، يَتْلُونَ كِتَابَ اللهِ، وَيَتَدَارَسُونَهُ بَيْنَهُمْ، إِلَّا نَزَلَتْ عَلَيْهِمِ السَّكِينَةُ، وَغَشِيَتْهُمُ الرَّحْمَةُ وَحَفَّتْهُمُ الْمَلَائِكَةُ، وَذَكَرَهُمُ اللهُ فِيمَنْ عِنْدَه

‘যখন কোন সম্প্রদায় আল্লাহর ঘরসমূহের কোন একটিতে সমবেত হয়ে আল্লাহর কিতাব তেলাওয়াত করে এবং পরস্পরে তার পর্যালোচনায় নিয়োজিত থাকে, তখন তাদের উপর প্রশান্তি অবতীর্ণ হয়। রহমত তাদের আচ্ছাদিত করে এবং ফেরেশতাগণ তাদের পরিবেষ্টন করে রাখেন। আর আল্লাহ তা‘আলা তার নৈকট্যধারী ফেরেশতাদের মাঝে তাদের বিষয়ে আলোচনা করেন’।

(১২) প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত মসজিদে গিয়ে সকলে একসাথে আদায় করার মাধ্যমে ঈমানী ভাতৃত্বের বন্ধন দৃঢ় হয়।

ধনী-গরীব, সাদা-কালো, সব শ্রেণীর মানুষ একই কাতারে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ছালাত আদায় শেষে একে অপরে সালাম-মুছাফাহা করে পরিচিত হয় এবং কুশল বিনিময় করার মাধ্যমে পরস্পরের ভালবাসা বৃদ্ধি পায়, অন্তর থেকে দূর হয় বিদ্বেষ, কুটিলতা, যার মাধ্যমে ঈমান পরিপূর্ণতা লাভ করে। মুছল্লীদের মধ্যে কেউ অভাবী হলে অথবা কোন সমস্যায় পড়লে সকলে মিলে সাধ্যমত সহযোগিতার হাত প্রসারিত করলে সার্বিক শক্তি বৃদ্ধি পায়, সমাজে ফিরে আসে শান্তি, দূর হয় দ্বন্দ্ব-বিভেদ।

উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত খেয়াল-খুশী মত আদায় করার সুযোগ ইসলামে নেই; বরং পুরুষদেরকে মসজিদে গিয়ে জামা‘আতের সঙ্গে ছালাত আদায় করতে কঠোরভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যদিও অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়োজনে যে কোন স্থানে জামা‘আত করা যায়, তবুও একজন মুসলিম মসজিদে জামা‘আতের সঙ্গে ছালাত আদায়ে যত্নবান হবেন। কেননা এর মাধ্যমে যেমন রাসূল (ছাঃ)-এর প্রকৃত আদর্শ বাস্তবায়ন করা যাবে, তেমনি হওয়া যাবে অফুরন্ত ছওয়াবের অধিকারী।

– আব্দুল্লাহিল কাফী আল-মাদানী
(মাসিক আল-ইতিছাম)


  • ১. ছহীহ বুখারী, হা/৬৪৫।
  • ২. ছহীহ বুখারী, হা/৬৪৬।
  • ৩. আবুদাঊদ, হা/৫৫৪, শায়খ আলবানী হাদীছটিকে ‘হাসান’ বলেছেন।
  • ৪. তিরমিযী, হা/২৪১, সিলসিলা ছহীহাহ, হা/২৬৫২।
  • ৫. ছহীহ মুসলিম, হা/৬৫৬।
  • ৬. ছহীহ বুখারী, হা/১৭৬।
  • ৭. সিলসিলা ছহীহাহ, হা/১৬৫২।
  • ৮. ছহীহ বুখারী, হা/৭৮০।
  • ৯. ছহীহ বুখারী, হা/৬২৮।
  • ১০. আবুদাঊদ, হা/৫৪৭, হাদীছটিকে ইমাম হাকেম, ইমাম যাহাবী এবং শাইখ আলবানী ছহীহ বলেছেন।
  • ১১. ইবনে মাজাহ, হা/৭৯৪, হাদীছটি ছহীহ মুসলিমেও বর্ণিত হয়েছে, তবে সেখানে الْجَمَاعَاتِ শব্দের পরিবর্তে الْجُمُعَاتِ এসেছে।
  • ১২. ইবনে মাজাহ, হা/৭৯৩; আবুদাঊদ, হা/৫৫১, শায়খ আলবানী হাদীছটিকে ছহীহ বলেছেন।
  • ১৩. তিরমিযী, হা/২১৮, আলস্নামা আহমাদ শাকের হাদীছটিকে ছহীহ বলেছেন। তিনি আরো বলেন, হাদীছটি বাহ্যত মাওকূফ হলেও এটি মারফূ‘র হুকুমে। কেননা এমন মতামত ইজতিহাদ তথা গবেষণাপ্রসূত হওয়ার কথা না।
  • ১৪. ইবনুল ক্বাইয়িম, আছ-ছালাতু ওয়া তারিকু আহকামিহা, পৃঃ ১১১।
  • ১৫. ছহীহ বুখারী, হা/৪৩৮।
  • ১৬. মাজমূ‘ ফাতাওয়া ইবনে উছায়মীন, ১৫/৩৫।
  • ১৭. ছহীহ বুখারী, হা/৪৩৮, ছহীহ মুসলিম, হা/৫২১।
  • ১৮. ছহীহ মুসলিম, হা/১০৭৪।
  • ১৯. ছহীহ মুসলিম, হা/৬২২।
  • ২০. ছহীহ মুসলিম, হা/৬৫৩।
  • ২১. ছহীহ বুখারী, হা/৩৫৬০; ছহীহ মুসলিম, হা/২৩২৭।
  • ২২. ছহীহ মুসলিম, হা/৬৫১।
  • ২৩. ছহীহ মুসলিম, হা/৬৫৪।
  • ২৪. ছহীহ মুসলিম, হা/৬৫৪।
  • ২৫. ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত-তারহীব, ৭/২০৯।
  • ২৬. ছহীহ মুসলিম, হা/৬৫৫।
  • ২৭. ছহীহ বুখারী, হা/৬৬০; ছহীহ মুসলিম, হা/১০৩১।
  • ২৮. ছহীহ মুসলিম, হা/২৫১।
  • ২৯. ছহীহ মুসলিম, হা/১৩৯০।
  • ৩০.  ছহীহ বুখারী, হা/৬৬২; ছহীহ মুসলিম, হা/৬৬৯।
  • ৩১.  আবুদাঊদ, হা/২৪৯৪, শায়খ আলবানী হাদীছটিকে ছহীহ বলেছেন।
  • ৩২. ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত-তারহীব, ১/১২৩।

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button