সচেতনতা

শ্রদ্ধাবোধ পরিবারলব্ধ একটি ডিগ্রী

শ্রদ্ধাবোধ একটি পারিবার লব্ধ ডিগ্রী। যা হয়ত কিছুকাল পরে জাতীয় জাদুঘরে স্থান পাবে।

২০১০ সালের জুন মাসের ঘটনা। আমি তখন সেন্ট যোসেফ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। এক সন্ধ্যায় একুশে হলের এক বড় ভাই ফোন দিলেন। স্বাভাবিক কুশল বিনিময়ের পরে জানালেন ওনার এক ভাগিনা আমার প্রতিষ্ঠানে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে। উনি আমাকে খুব করে বললেন যেন ওকে দেখে রাখি এবং কোন সমস্যা থাকলে দেখিয়ে দেই। আমি ওনাকে বললাম, ভাই আপনার ভাগিনা তো আমারও ভাগিনা, ওকে দেখা করতে বলবেন আমি ছুটির পর ৩০-৬০ মিনিট শিক্ষক মিলনায়তনে ছাত্রদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান দেবার চেষ্টারত থাকি। ঐ সময়ে যেন এসে ওর বিষয় ভিত্তিক কিংবা অন্য যেকোনো সমস্যা দেখিয়ে যায়। ভাই ওকে পাঠাবে বলে ফোন রেখে দিলেন।

এখানে বলে রাখা ভালো আমি তখনো কলেজ সেকশনে ক্লাস নেই না। রাজনীতি এবং বহু কিছু সামাল দিতে পারলেই কলেজ সেকশনে ক্লাস পাওয়া সম্ভব। যেহেতু আমি নতুন তাই এই সকল দিকে মনযোগী হওয়ার চেয়ে যে ক্লাস পাচ্ছি তা ভালো করে নেয়ার চেষ্টারত ছিলাম। যাই হোক, সেই ছেলে পরদিন এসে দেখা করল। আমাকে কোন সম্বোধন না করেই বলল “‘ক’ আমার মামা, এখানে কোন বিষয় পড়ান আপনি।” আমি বললাম, ওহ তোমার মামার সাথে তো কাল কথা হয়েছিল, আমি রসায়ন এবং সাধারণ বিজ্ঞান মাঝে মাঝে পদার্থ বিজ্ঞান এই তো মোটামুটি এগুলোই পড়াই। জবাব শুনে ছেলে বলল, ও আপনি স্কুলে ক্লাস নেন, ‘খ’ স্যার বলছিল এই কলেজে সকল শিক্ষক তোমার শিক্ষক না, আচ্ছা আমি আজকে আসি ‘খ’ স্যার এর ক্লাস আছে।” আমি বললাম যাও।

এর প্রায় দুই মাস পরে একদিন গাড়িতে করে শাহাবাগ যাচ্ছি, গাড়ীর মধ্যে আমাদের প্রতিষ্ঠানের কিছু ছেলে খুব বাড়াবাড়ি রকমের চিৎকার চেঁচামেচি করতেছিল। যাত্রীদের বিরক্ত মুখগুলো দেখে আমি পিছনে তাকিয়ে দেখলাম ঐ ছেলে এবং তার বন্ধুবর দের কাজ এটা। ওকে ডেকে বললাম তুমি তো ‘ক’ ভাইয়ের ভাগিনা এবং সেন্ট যোসেফ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র? ও উত্তর করল “তো”! আমি বললাম এভাবে চিৎকার করলে লোকজন তোমার সাথে সাথে তোমার শিক্ষক পিতামাতাকেও বাজে কথা বলতে পারে। সুতরাং চিৎকার করিও না। সে যেতে যেতে বলল, “ভালই হইছে এমন শিখকরে কলেজ সেকশনে ক্লাস দেয় নাই”। ব্যাপারটা আমার ভালো লাগলো না, সেন্ট যোসেফ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী পরদিনই আমি ওকে টিসি দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিতে পারতাম। কিন্তু চিন্তা করলাম ‘ক’ ভাইকে জানাই কারন টিসি দিলে ছেলেটার শিক্ষা জীবনে একটা কলঙ্ক হয়ে থাকবে, কিংবা মানসিক ভাবে ভেঙে পড়তে পারে।

বিকালে ওনাকে ফোন দিয়ে বললাম ভাই কি অবস্থা আপনার ভাগিনার। উনি বলল “কি জন্য কল করেছ জানি, দেখ মাহাতাব আমাদের প্রত্যেকেরই নিজের পরিধি জানা উচিৎ। তুমি কলেজে ক্লাস নেও না এটা আমাকে আগে বলতে পারতে”। আমি বললাম ভাই আমি কি বলেছি আমি কলেজে ক্লাস নেই? কিংবা আপনার ভাগিনাকে আমার কাছে পাঠান? উনি বললেন “যাই হোক, ওকে আর কিছু বলতে যেও না, আজ কালকের ছেলে পেলে, যদি আরও খারাপ কিছু করে ফেলে তাহলে কিন্তু দোষ তোমারই, কারন তোমার কোন রাইট নাই ওকে কোন উপদেশ কিংবা জ্ঞান দেবার।”

আমি প্রমোদ গুনলাম। চিন্তা করলাম কাউকে জানাব না ব্যাপার টি। কারন যে পরিবারের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করা একজন সদস্যের জ্ঞান এবং অপরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এই লেভেলের সেই পরিবারের সন্তান গাজা, মদ, জুয়া কিংবা আরও খারাপ কিছু করাই স্বাভাবিক। যাই হোক এই ঘটনার ৩ মাস পরে ঐ ছাত্র অন্য আরেকটি কারনে টিসি নিয়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। তবে ওকে টিসি দেয়া হবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে আমি বলেছিলাম, এই ছেলেকে টিসি না দিয়ে ওর মামা, ‘খ’ স্যার, বাবা এবং মাকে যদি তিন মাস আমাদের প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করিয়ে ভ্যালু এডুকেশন এর বাচ্চাদের জন্য ডিজাইন করা কোর্স গুলো করতে পারতেন তাহলে এই ছেলে সাড়া জীবন উপকৃত হত।

কারো নিকট থেকে কিছু শিখতে কিংবা কিছু পেতে হলে তাকে শ্রদ্ধা করতে জানতে হয়। শ্রদ্ধা করতে না জানলে হয়ত ঐ ব্যাক্তি যদি হাজার চেষ্টাও করে আপনার কোন উপকার করতে পারবে না।

এমন অনেক হয়েছে, একজন সিনিয়র নির্জলা মিথ্যা কথা বলে চলেছেন আমার সামনেই কিন্তু পারিবারিক শিক্ষা আমাকে তাকে মিথ্যুক বলতে শিক্ষা দেয় নি, আমাকে শিক্ষা দিয়েছে তাকে এড়িয়ে চল। কিন্তু বর্তমানের জুনিয়র এবং ‘ক’ ভাইয়ের এর মত সিনিয়র লেভেলের লোক জন কিংবা ‘খ’ এর মত শিক্ষক সমাজ আসলেই ভাবায়। ভাবায় এই জন্য যে এরাই নাকি দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম!! তাহলে দেশের দশা কি?

আল্লাহ্‌ এই রমযানের উছিলাতে আমাদের সকলের সন্তানদের অন্তত মানুষকে মানুষ হিসেবে শ্রদ্ধা করতে শিক্ষা দেয়ার তৌফিক দিন। আমীন!

– শেখ মাহাতাব উদ্দিন

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button