ভ্রমণ কাহিনী

সুন্দরবনের পথে

ট্রলার ছেড়ে দিলো। চার জনকে পাড়ে রেখেই..
রুপসা থেকে দিনে দুইটা ট্রলার যায় সুতারখালি। একটা বিকেল পাঁচটায়। পরের টা সাড়ে পাঁচটায়। আমরা তখনও রাস্তায়। দুপুরে খাইনি। মাওয়া ঘাটের ওপারে বসে ছিলাম দুই ঘন্টা। এপারে দেড় ঘন্টা। নদীতে দুই, আড়াই ঘন্টা।
রুপসা ব্রিজ পাড় হয়েই ঘাটে চলে এলো পিকআপ। এসে দেখি ট্রলার একটা ছেড়ে গেছে, আরেকটা ছাড়ার অপেক্ষায় আছে। তড়িৎ গতিতে বস্তাগুলো নামানো হলো। চৌদ্দটা বস্তা। একেকটা দুই মণের উপরে ওজন। আমি ট্রলারে উঠে বস্তাগুলো নামাতে সাহায্য করলাম। বাকি সবাই উপরে ব্যস্ত। পিকআপের ড্রাইভার সারাদিন কিছু খাননি, উনাকে নিয়ে সাইমুম ভাই খেতে গেছেন। এদিকে ট্রলারে বসা যাত্রিরা চরম বিরক্ত। ট্রলার প্রায় ছেড়েই দিচ্ছিলো, মাঝখান দিয়ে আমরা এসে বিলম্ব করে দিলাম।
সবাই খুব উত্তেজিত হয়ে চেঁচামেচি করতে লাগলো। ওদিকে সাইমুম ভাই এখনো আসেননি। বাকি দু’জন পাড়ে দাঁড়িয়ে ঘাটের ভাড়া মিটিয়ে দিচ্ছিলেন, পাশাপাশি সাইমুম ভাই এর জন্য অপেক্ষা করছেন। ট্রলারের যাত্রিদের ধৈর্যের সীমা অতিক্রম করে গেলো। তাঁরা এখন রীতিমত চিল্লাচিল্লি শুরু করে দিলো। ট্রলারের ড্রাইভার বিরক্ত হয়ে, ট্রলার ছেড়ে দিলো!

ট্রলারে আমি একলা। পাড়ে আরো তিনজন থেকে গেছে! পাড় থেকে আসিফ ভাই আর সাফা ভাই চোখ বিস্ফোরিত করে দাঁড়িয়ে আছে। এখন কি হবে?

আমি চিৎকার করে ড্রাইভার কে বলতে লাগলাম, “মামা ট্রলার থামান। ট্রলার থামান। ওদেরকে নিয়ে যান। এত্তগুলো বস্তা, আমি একলা কি করব?”
কে শোনে কার কথা?

অবস্থা বেগতিক দেখে আমি এবার চিৎকার করে বলা শুরু করলাম, “ফজরের পর নাস্তা না খেয়েই পিকআপ এ উঠেছি। মাওয়া ঘাটে ছিলাম ছয় ঘন্টা। আমরা জানি ট্রলার পাঁচটায়। কিন্তু কি করবো ঘাটে জ্যাম ছিলো। দুপুরে না খেয়েই বাকি রাস্তাটা এসেছি। এখন বলেন আপনারা দু’মিনিট সময়ও কি আমাদের দিবেন না!!”
ট্রলারের সবাই কথাগুলো মন দিয়ে শুনলো। তারপর ড্রাইভার কে বলা শুরু করলো, “আহারে, পোলাপানগুলোকে নিয়া আসো। এরা ঢাকা থেইক্কা সেই সকালে বের হইছে”

ঘাট থেকে বেশি দূর আগাইনি। ট্রলার তখন মাঝ নদীতে। রুপসা ব্রিজ সামনে। ড্রাইভার ট্রলার ঘুরালেন। যাত্রিরা বলাবলি করতে লাগলো, “এই ঘাটে এই প্রথম ট্রলার ঘুরলো। ইতিহাস। এমনটা আগে কখনো হয়নি।”
ঘাটে বাকি তিনজন দাঁড়ানো ছিলেন। ট্রলার ঘুরতে দেখে মুখে হাসি দেখা দিলো। আমরা সবাই ট্রলারে উঠে বসলাম। আস্তে আস্তে ট্রলার চলতে শুরু করলো।

5

হুহু বাতাস। অস্তমিত সূর্য। খোলা ডেকের উপর বসে আছি। চালনা, দাকোপ, কামারখালি, রামনগর হয়ে ট্রলার যাচ্ছে সুন্দরবনের দিকে। মাঝে মাগরিবের নামাজটা ট্রলারেই জামাত করে পড়ে ফেললাম। দুলতে দুলতে যখন রুকুতে যাচ্ছিলাম, মনে হচ্ছিল এই বুঝি পড়ে যাবো। যখন সিজদায় যাচ্ছিলাম, মনে হচ্ছিলো, এই বুঝি ট্রলার উলটে গেল।

অনেক পরে, দূরে হলুদ আলো দেখলাম। বলা হলো, “এটা মংলা বন্দর, ওখান থেকেই আলো আসছে” একটু পর দেখলাম, ভাসমান হাসপাতাল। তারও অনেক পরে তারার আলোয় দেখলাম সুন্দরবন।

সুন্দরবন! কতো ছবি দেখেছি, কথা শুনেছি। এই সেই সুন্দরবন। মনের চোখে বাঘ হরিণ ছুটতে দেখলাম। মনের কানে শুনলাম, রক্ত হিম করা বাঘের গর্জন। আকাশে চাঁদ ছিল না। কিন্তু তারার আলোয় ঠিকই পথ চিনে চিনে ট্রলার এগিয়ে চলল সুতারখালির দিকে।

ট্রলার এগুচ্ছে সুন্দরবনের পাশ ঘেষে। প্রায় চার ঘন্টা পর আমরা পৌছলাম সুতারখালি। তখন নদীতে জোয়ার চলছে। ট্রলার থামল একেবারে মাদ্রাসার পাশে।

3

নদীর পাড়েই মাদ্রাসা। পানি থেকে চার হাত দুরেই মাদ্রাসার বেড়া। আমরা নামলাম। বস্তাগুলো নামানো হলো। রাতে মসজিদে ছিলাম। রাতের খাবার খেলাম এক ভাই এর ঘরে। খাবারটা সুস্বাদু, টাটকা।

2

পরদিন। প্রায় দুই শত মাদ্রাসার ছাত্র ছাত্রিদের হাতে ইফতারের প্যাকেট দেওয়া হলো। শিক্ষকদেরও দেওয়া হলো। আনন্দমাখা মুখগুলো দেখে মনটা আনন্দে ভরে গেলো। ইফতার এর প্যাকেট হাতে মাদ্রাসার পিচ্চিকিচ্চিরা..

1

তাদেরকে বলা হলো, কেন আমরা রোজা রাখব। রোজা রাখলে আল্লাহ কী পুরস্কার দেবেন আমাদের। রিযক কীভাবে আসে আল্লাহর তরফ থেকে। রোজাদার ব্যক্তিকে আল্লাহ জান্নাত দিবেন। আরো কিছু ইন্সপিরেশনাল কথা। বাচ্চাগুলো সব মন দিয়ে কথা গুলো শুনেছিল।

4

মাদ্রাসাটার অবস্থা ভালো না। মেঝের মাটিটা কেমন যেন। উঠানে একটু বৃষ্টি হলেই আঠা-আঠা কাদা। ইট দিয়ে ব্রিজ বানাতে হয়। সেটাই হাঁটার রাস্তা।

তারপর, আমরা গেলাম কালাবগী। ঘূর্ণিঝড় অধ্যুষিত এলাকা। ঘূর্ণিঝড় আইল্যা এই গ্রামের কী পরিমাণ ক্ষতি করেছে একবার ঘুরে আসলে দেখতে পারতেন। তিন চার বছর পরও গ্রামবাসী সেই ধকল এখনও কাটিয়ে উঠতে পারে নি। ওখানেও ইফতার দেওয়া হবে। বস্তাগুলো ট্রলারে করে এসেছে। আমরা হেঁটেই গেলাম।

7

গাছে আবু হুরায়রা, নিচে ইখফা খেঁজুর কুড়াচ্ছে। আমাকেও একটু ভাগ দিল ওরা।

কালাবগী বাংলাদেশের ওই দিকের সর্বশেষ গ্রাম। তারপরই সুন্দরবন শুরু। প্রায় সত্তুর কিলোমিটার জুড়ে বন। তারপর সমুদ্র। এই গ্রামে খৃষ্টান মিশনারিরা ঢুকেছে সেই অনেক আগেই। গ্রামের পাঁচটা হিন্দু পরিবার খৃষ্টান হয়েছে। মিশনারিরা গ্রামের সহজ সরল মানুষগুলোর দুরবস্থার দিনে অল্প কিছু সাহায্য সহযোগীতা করে তাদেরকে খৃষ্টান বানিয়ে নিয়েছে। প্রকৃত দুর্যোগে এদেরকে খুঁজে পাওয়া ভার।

ওখানে কয়েকটা মসজিদ আর একটা স্কুল ঘূর্ণিঝড় এর সময় আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে। রোজার মাসে সব পুরুষরা মসজিদেই ইফতার করে। বাড়ি বাড়ি থেকে ইফতার সংগ্রহ করে একসাথে সবাই মসজিদে খায়।
পানির খুব অভাব। টিউবওয়েলগুলো সব পানি শুন্য। নদীর পানি লোনা। বৃষ্টির পানিই শেষ ভরসা। সবাই বৃষ্টির পানি ধরে রাখার চেষ্টা করে। সরোবর এর ‘পানি’ প্রযেক্ট থেকে গত কিছুদিন আগে পানির ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে দুইটি মসজিদ আর একটি মাদ্রাসায়। পাঁচ হাজার লিটারের পানির ট্যাংক আর মোটর জেনারেটর দিয়ে পানি উঠানোর ব্যবস্থা। ওগুলোও দেখে আসলাম।

8

বিকেলে রওনা দিলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে। পেছনে রেখে গেলাম স্মৃতিময় দুটো দিন।

কিছু শিক্ষা। কিছু উপলব্ধি।

১| প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষগুলো আসলেই কষ্টে আছে। নদীকেন্দ্রিক তাদের জীবন-জীবিকা। সুন্দরবনের পাশের গ্রামগুলোর মানুষের একমাত্র জীবিকা সুন্দরবন। মধু সংগ্রহ, মাছ ধরা তার পাশাপাশি গতর খেটে তাদের জীবিকা চলে।

২| নদীতে মাছ ধরা নিষিদ্ধ করে দিছে সরকার। জাল পাতলেই কোস্ট গার্ড এসে ধরে নিয়ে যায়।

৩| বনে ঢোকার পাস থাকা সত্যেও মৌয়ালিদের মাঝে মাঝে ঢুকতে দেয়া হয় না।

৪| কিছুদিন আগে করমজলে আগুন লেগেছিলো। টানা তিনবার নির্দিষ্ট সময় পরপর বনে আগুন লাগতো। ম্যাংগ্রোভ বনে আবার আগুন লাগে কীভাবে?

৫| রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের কাজ দেখে এলাম। পরিবেশের জন্য কতটা ক্ষতিকর একটি উদ্যোগ এটা একটা বাচ্চাও বোঝে।

৬| কিছুদিন আগে সুন্দরবনে তেলবাহী জাহাজের ট্যাংকি ফেটে হাজার হাজার গ্যালন তেল পরে যাওয়ার ঘটনা নিশচয়ই মনে আছে? স্থানীয়রা এটাকে নিছক একটি দুর্ঘটনা হিসেবেই দেখছেন না। তারা এটাকে ষড়যন্ত্র মনে করছে।

৭| জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়, জোয়ার ভাটা, বন্যার মতো দুর্ভিক্ষগুলো ঐসব এলাকার মেরুদন্ড বাঁকা করে দিয়েছে। প্রতি মূহুর্তে ভয় নিয়ে কাটায় এলাকার মানুষগুলো।
সর্বশেষ। প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষগুলোর কষ্ট দেখে এসে যখন ফেসবুকে ঢুকি, সভ্য মানুষগুলোর চলমান ইস্যুগুলো দেখে কষ্ট লাগে। আমরা কি একটু “চক্ষু” মেলিয়া দেখিবো না? সাহায্যের হাতটা কবে বাড়িয়ে দেব?
ওপাশ থেকে উত্তর আসল, “হাত বাড়ানো যাবে না। হাতে আমার স্মার্টফোন, ল্যাপটপ।”

– শরীফ আবু হায়াত অপু

১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

Back to top button