ভ্রমণ কাহিনী

খোলা চিঠির পর

লালমনি এক্সপ্রেস ছাড়বে রাত ১০.১০ এ। সপ্তাহের শেষ তাই জানতাম ট্রেন লেট হবে। এসে পৌছেছিলাম তাই ১০.৩০টায়। সেই ট্রেন শেষমেশ ছাড়লো ৪টায়। স্টেশনে বিনিদ্র রজনীর শেষে হুড়োহুড়ি করে ৭০০ কম্বল আর ৪০০ সুয়েটারের বস্তা লোড করলাম মালগাড়ীতে মাত্র ৫ মিনিটে। আমাদের ১৫ জনের দল থাকতে আর কিসের কুলি। এরপর জায়গা খুঁজেপেতে বসা। শেষ রাত, তাই ফু-ওয়াং কেক, বিস্কুট আর পানি দিয়ে সেহরি। ট্রেনের সিটেই পড়লাম ফজরের নামায পালা করে। তারপর ৯০ ডিগ্রি এঙ্গেলে বসে এক অসম্ভব ঘুম। ছাড়া ছাড়া ঘুম শেষে বিকেল চারটায় নামলাম লালমনিরহাটের আদিতমারি। যুহর আর আসরের কসর জমা করে পড়লাম। দু’টো ট্রাক বসে ছিল সকাল থেকেই। একটায় অর্ধেক মাল উঠিয়ে পাঠিয়ে দেয়া হল হোসেন ভাইয়ের মাদ্রাসায়, আর আরেকটায় চড়ে আমরা চললাম চর ফুলিমারিতে।

মালপত্রের একাংশ

হোসেন আহমেদ ভাই সম্পর্কে একটু না বললেই নয়। তিনি বেশ অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে। বাড়ি কুমিল্লা। কওমি মাদ্রাসা থেকে পড়াশোনা শেষ করে মিশনারিদের দৌরাত্ম্য দেখে সপরিবারে কুড়িগ্রামে সদরে হিজরত করেছেন। সেখানে প্রায় ছটা মাদ্রাসার দেখভাল করেন। বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে সাহায্য এনে মাদ্রাসাগুলো চালানোর চেষ্টা করেন। খ্রীষ্টানদের বিভ্রান্তির বিরুদ্ধে মানুষকে সঠিক দ্বীন শেখানোর চেষ্টা করেন। কেউ বিপথে চলে গিয়েছে শুনে মোটর সাইকেল নিয়ে ছুটে যান। তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, সংশয় দূর করার চেষ্টা করেন। জীবন হাতে নিয়ে ঘোরেন। সাধারণ মানুষ তাকে এত ভালোবাসে যে যথাসম্ভব পাহারা দিয়ে রাখে। আর উনার ভরসা শুধুই আল্লাহর উপরে। স্টেশনের কুলিরা যখন খামোকা টাকা চেয়ে ঝামেলা করছিল তখনো তাকে ভদ্রভাবে কথা বলতে দেখেছি। আমাদের এই কম্বল বিতরণ উপলক্ষ্যে দিন পাঁচেক চরকির মত ঘুরেছেন থানায় থানায়, চরে চরে।

ট্রাক থামলো এসে ধরলা নদীর পারে। যারা গতবার এসেছিল তারাতো হতবাক। নদী একবছরে কতটা জায়গা ভেঙ্গেছে! ওখানে পানি দিয়ে ইফতার করে আমরা দু’শ কম্বলের চারটা বস্তা নিয়ে দাড়ালাম ঘাটে। নদীর পানিতে উযু করে মাঠের মাটিতে নামায পড়ে নিলাম সবাই। মাটির কাছাকাছি হলে বোধহয় আল্লাহর কাছাকাছি হতে সুবিধা হয়। মনে পড়ল লাইলাতুল ক্বাদরের রাতে রসুল(সাঃ) মসজিদে নববীতে কাদামাটিতে নামায পড়েছিলেন। সকালেও দেখা গিয়েছিল তার কপালের কাদার চিহ্ন। আর আমাদের দেশে পবিত্র রাতের ইবাদাত বলতে বোঝায় মোজাইকের মেঝেতে বসে বিদআতি মিলাদ আর বিদআতি যিকির!

যাইহোক নদী পার হয়ে আমরা ওপারে গেলাম। সাদা বালির তীর পার হতে গলদঘর্ম হতে হচ্ছিল আমাদের। যদিও একটা বস্তা চারজন মিলে বয়ে নিচ্ছিলাম! পরে গ্রামের বাজারে আসার পর সাধারণ মানুষরা আমাদের এই কষ্ট(!) থেকে উদ্ধার করে। তারা যখন একা একটা বস্তা মাথায় নিয়ে হাটা দিল, আমরা বেশ লজ্জাই পেলাম।

একটা মাত্র ঘর। তারই নাম মাদ্রাসা। আসলে ঈসায়ি ইসলামের নামে খ্রীষ্টান ধর্মের মিশনারিদের স্কুলের জবাবে খোলা হয়েছে এটি। তার প্রাঙ্গনে একটা মাইক লাগানো হয়েছে। দশমীর চাঁদের আলোতে উদ্ভাসিত অঙ্গনে দু-আড়াইশ মানুষ। নারী আর পুরুষেরা আলাদা সারিতে বসে আছে। আমরা ছোট্ট একটা বক্তব্যে উল্লেখ করলাম যে আমরা আল্লাহকে খুশী করতে এসেছি, তাদের নয়। আমরা এসেছি আমাদের দায়িত্ব পালন করতে, আমাদের সম্পদের হক আদায় করতে। তাদেরও উচিত তাদের দায়িত্ব পালন করা – মুসলিম হয়ে মৃত্যুবরণ করা। রসুল(সাঃ) যে অনেক গরিবী সত্ত্বেও ইসলাম থেকে সরে আসেননি সেই কথাও আমরা তাদের মনে করিয়ে দিলাম। এছাড়া ইসলাম সম্পর্কে সামান্য কিছু কথা শেষে কম্বল বিতরণ শুরু করলাম।

বিতরণের সময় বেগ পেতে হয়নি মোটেই। হোসেন ভাই যে কাজটি করে রেখেছিলেন তা হল বাড়ি বাড়ি গিয়ে গরীব মানুষদের ভিতর থেকে বেশি গরীবদের বাছাই করে তাদের একটা টোকেন দিয়ে এসেছিলেন। হিন্দুরাও তার লিস্ট থেকে বাদ যায়নি। তবে যেসব মুসলিমদের খ্রীষ্টান করার ধোঁকায় ফেলা হয়েছে তাদের বিশেষভাবে রাখা হয়েছিল তালিকায়। টোকেন হাতে নিয়ে কম্বল দিতে মিনিট বিশেকের বেশী লাগেনি।

মাদ্রাসায় ছাত্র-ছাত্রী জনা ত্রিশেক, সকাল থেকে আমাদের জন্য বসে আছে। ওরা বাংলা, ইংরেজি আর আরবি একসাথে শিখছে। ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চাগুলোর চেহারা দেখে, আধো মুখের পড়া শুনে আর মুক্তার মত হাতের লেখা দেখে এত আদর লাগলো যে বলার না। হাটহাজারি মাদ্রাসার মিজান ভাই যে কিভাবে জান দিয়ে পড়ান তাও আর বুঝতে বাকি রইলনা।

ছাপার হরফের মত লেখা

টিনের ঘর, তলা ফাঁকা। প্রচন্ড ঠান্ডায় মেঝেতে বসাই দায়। বাচ্চাগুলো কেমন করে বসে পড়ে আল্লাহই জানেন। আমাদের জন্য আপেল, আঙ্গুর, চানাচুর আর চায়ের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। পোলাউ নামে এক সুগন্ধী গাছের পাতা দেয়া চা – যেমন তার ঘ্রাণ তেমন স্বাদ। এই দীনহীন মানুষদের আন্তরিক আতিথেয়তা দেখে আবার লজ্জা পেলাম। আল্লাহ আমাদের এত দিয়েছেন অথচ মেহমান আসলে কী বিরক্তটাই না হই আমরা।

 

আমরা ফিরে চললাম। ধূ-ধূ বালুচর, পাড়ভাঙ্গা নদী, এবড়ো-খেবড়ো মাঠ পেরিয়ে। দল রওনা দিল মাদ্রাসার দিকে। আমরা দু’জন খাবারের খোজে দুটো মটর সাইকেলের পিছনে চড়ে গেলাম বাজারে। ভাত রাঁধা হবে মাদ্রাসায়। আমরা কিনলাম খালি তরকারি। হাড় কাপানো শীত থেকে বাঁচতে আমরা নাক-মুখ-কপাল ঢেকে নিয়েছি – খালি চোখ দু’টো খোলা। বেশ-ভুষায় নিজের কাছেই নিজেকে মনে হচ্ছিল আফগান মুজাহিদ।  প্রায় ১৩ কিলোমিটার রাস্তা পার হয়ে যখন ফিরছিলাম তখন কেন যেন একটা কথাই মাথায় ঘুরছিল – ‘I love islam, I love this way of life.’

রাতে হঠাৎ শীতের চোটে ঘুম ভেঙ্গে গেল। উঠে গরম কাপড় গায়ে জড়িয়ে তারপর কম্বলের নিচে ঢুকলাম। মনে মনে ভাবলাম – এই কম্বলে এদের আদৌ কি কোন উপকার হবে। পরক্ষণেই মনকে প্রবোধ দিলাম – সামথিং ইস বেটার দেন নাথিং।

আগের রাতের থেকে যাওয়া খাবার দিয়ে সেহরি করলাম। তারপর ফজরের নামায শেষে সুয়েটারগুলোকে নিয়ে পড়লাম। গার্মেন্টস থেকে আনা প্রায় ৩০০ নতুন সুয়েটারকে পুরুষ, মহিলা আর শিশু – তিনটা ভাগে ভাগ করে বস্তাবন্দী করলাম।

এসব করতে করতে সকাল হয়ে গেল। ক্যামেরা কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে দেখি বাঁশঝাড়ে ঝলমল করছে ভোরের শিশির।

শিশির কণা

ট্রাক আসার পর সব বস্তাগুলো তুলে ফেললাম ট্রাকে। এরপর একে একে গেলাম ভিতরকুঠি, হাজীগঞ্জ-জামতলা, ভাদাই আর চর কুলাঘাটে। সবখানেই এক রুটিন – লাইনে দাঁড়ানো মানুষদের দু’টো কথা বলে মিনিট দশেকের মধ্যে কম্বল দিয়ে ছেড়ে দিলাম। সবখানেই দেখা গেল কিছু উৎসাহী ছোট বাচ্চা ঘোরাফেরা করছে। এদের লাইন করে দাঁড়িয়ে গায়ের মাপমত গরম কাপড় পড়িয়ে দিলাম আমরা। সেটা পেয়েই এক ছুট দিয়ে তারা নিজেদের মা এবং পাশের বাসার বাচ্চাটাকে ডেকে আনতে লাগলো। বেগতিক দেখে আমরা দ্রুত পরের পয়েন্টে চলে গেলাম। বাচ্চারা যাতে বাসায় গিয়ে সুয়েটার খুলে রেখে আবার না আসতে পারে সেজন্য তাদের এক জায়গায় থাকতে বলা হয়েছিল, অজুহাত ছবি তুলবো। সেরকমই একটা ছবি –

ছোট বাচ্চারা

এত কাজের মধ্যেই আমি চেষ্টা করছিলাম মিশনারিদের কাজ সম্পর্কে যতটা সম্ভব তথ্য সংগ্রহ করতে। ‘গুণাহগারদের বেহেস্তে যাবার উপায়’ নামে একটা বই পেলাম – রেভারেন্ড এস বাড়ৈ এর লেখা। বইয়ের শুরু সুরা মায়িদার আয়াত দিয়ে। পাতায় পাতায় কুর’আনের আয়াত দিয়ে প্রমাণ করা হয়েছে ইঞ্জিল-তাওরাত আল্লাহর বাণী, সেটাতে পরিবর্তন করে এমন সাধ্য মানুষের নেই। এদের ধর্ম প্রচারটা অনেক শঠতায় ভরা। অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে এরা মানুষকে ধোঁকা দেয়। যেমন – এরা জিজ্ঞেস করে – ‘ঈসা(আঃ) কি জীবিত না মৃত?’ সাধারণ লোক বলে জীবিত, তিনি আল্লাহর কাছে আছেন। এরপর বলে – ‘মুহাম্মদ(সাঃ) কি জীবিত না মৃত?’ উত্তর মৃত। এবার ওরা বলে – এখন তোমরাই বল যে নবী বেঁচে আছেন তার কথা শোনা কি উচিত না? খ্রীষ্টান ধর্ম হল ঈসা (আঃ)- এর কথা।

অথচ ঈসা(আঃ) যে পৃথিবীতে ফিরে এসে মুহাম্মদ প্রেরিত শরিয়ত মেনে চলবেন এটা তারা চেপে যায়। এরা আরো লুকিয়ে রাখে এই সত্যটা যে ঈসা(আঃ) এর প্রচারিত দ্বীনের নাম ইসলাম, যা বিকৃত করে খ্রিস্টধর্ম নামে নতুন একটা ধর্মে বদলে ফেলা হয়েছে। আর আল্লাহ যে কুর’আনে তাওরাত এবং ইঞ্জিলের যাবতীয় জ্ঞান সংরক্ষণ করেছেন সেটাও এই ‘হানিফ ট্রাস্ট’- এর নামে খ্রীষ্টান ধর্মপ্রচারকরা জেনেও না জানার ভান করে থাকে। এদের ধোঁকা এতই মনোগ্রাহী যে আমি এমন এক মসজিদের ঈমামের দেখা পেলাম যিনি নামায শেষে বাইবেল পড়াতেন! পরে অবশ্য তিনি ভুল বুঝতে পেরে তাওবা করেন। কিন্তু তার এক ছেলে এখনো মিশনারীদের গোলামি করে চলছে। কাঁচা পয়সার নেশা কাটানো আসলেই খুব কষ্ট।

অনেক চেষ্টার পরেও দুর্গম চরগুলোতে যেখানে ট্রাক যায়না সেখানে আমরা কাপড় দিয়ে শেষ করতে পারিনি। সেখানে দেবার জন্য দেড়শ মত কম্বল আর কাপড় রেখে দিয়ে এসেছি হোসেন ভাইয়ের বাসায়। ইনশাল্লাহ উনত্রিশ তারিখে গিয়ে সেগুলোও দিয়ে দেবার ব্যবস্থা করবো।

এ সফরে রিজভি ভাইয়ের মত দলনেতার পাশাপাশি পেলাম সোহেল ভাইয়ের মত হিসাবরক্ষককে। এছাড়াও শুধু ফেসবুকেই চিনতাম এমন একজন ভাই আর দু’জন ছোট ভাইয়ের সাথে প্রথম দেখা হল এই সফরে। আলহামদুলিল্লাহ তারা আমাকে হতাশ করেননি আর খাওয়া-দাওয়ার কষ্ট নিয়েও অনুযোগ করেননি।

এ লেখার সেইসব ভাই/বোনদের জন্য যাদের শরীর পড়েছিল ঢাকায়, চট্টগ্রামে, যশোরে, সাভারে, ইউএসএ, সৌদি আরবে বা অস্ট্রেলিয়ায়; কিন্তু মন পড়েছিল আমাদের সাথে। তাদের মনের চোখে আল্লাহ আমাদের সফরটা ফুটিয়ে তুলবেন সেই আশাতেই লেখা। তাদের দান-দু’আ আল্লাহ কবুল করবেন, তাদের বার বার মুসলিম ভাইদের পাশে দাড়ানোর ক্ষমতা দেবেন এই দু’আ করি।

একটা জিনিস আমাদের মনে রাখা উচিত যে আমরা যে ভালো কাজই করিনা কেন সেটা আমাদের নিজেদের মুক্তির জন্যই করি। টাকা কিন্তু অনেকেরই আছে, কিন্তু আল্লাহর রাস্তায় কিছু দেয়ার মন আল্লাহ সবাইকে দেননি। এই মন যাদেরই আল্লাহ দিয়েছেন তাদের আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত। ‘দান করি’ – এই আত্মতৃপ্তির একটু আবেশ কিন্তু পুরো দানটাকে নষ্ট করে দিতে পারে। এ লেখাটা যারা পড়ছেন তারা আমাদের জন্য দু’আ করবেন যেন অহংকার আমাদের মনে জায়গা করে না নিতে পারে, আমাদের খুব তুচ্ছ কাজগুলোকে বরবাদ না করে দিতে পারে। কুর’আনের একটা আয়াত পড়লে আমার বুক কেঁপে যায় –

নিশ্চয়ই আমার সলাত, আমার ক্বুরবানি, আমার জীবন আমার মরণ সব আল্লাহর জন্য 

 আল্লাহ, তুমি আমাদের জীবনটা কবুল করে নাও। পৃথিবীর কত মানুষ কত কিছুর জন্য বাঁচে, আমাদের শুধু তোমার সন্তুষ্টির জন্য বাঁচার তৌফিক দাও। আমাদের মৃত্যুটাও যেন তোমাকে খুশি করার উপলক্ষ্যেই হয়।

– শরীফ আবু হায়াত অপু

মন্তব্য করুন

Back to top button