ভ্রমণ কাহিনী

কম্বল কোলাজ

ভেবেছিলাম ভ্রমণকাহিনী লিখব। যারা আমাদের কম্বল বিতরণ অভিযানে সাথী হতে পারেননি তাদের জংলি বুনোফুলের টকটকে লাল রঙ দেখাব, ঝিরির শব্দ শোনাব, কল্পনার কার্পেটে উড়িয়ে আনব পাহাড় আর উপত্যকা থেকে। চেয়েছিলাম গল্প বলতে—শীতের চোটে ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ার গল্প, জলেকাদায় মাখামাখি হবার গল্প, ক্ষুধা লাগার গল্প, ক্ষুধা মেটার গল্প। ইচ্ছে ছিল পাহাড়ের গা খুঁড়ে বের করে আনা ঠান্ডা আলুর স্বাদটাও ভাগ করে নেব সবার সাথে। ভেবেছিলাম সেই হাসোজ্জ্বল মুখগুলোর গল্প বলব যারা কম্বলটা বুকে জড়িয়ে দৌড়ে বাড়ি ফিরেছিলেন। অথবা সেই কিয়াং বুড়ির কথা বলব যে বুকে আর পিঠে দু’টো কলসি বেঁধে পানির খোজে চলে এবেলা-ওবেলা। কিংবা সেই মসজিদের ইমামের কথা যার টিনের চাল চুইয়ে কুয়াশা বৃষ্টির পানির মত ফোটায় ফোটায় ঝরে ঘরের ভেতরে। ভেবেছিলাম গ্রামের মানুষদের জীবন সংগ্রামের কিছু দৃশ্য শহুরে চোখের সামনে তুলে ধরব। পারলাম না। রসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছিলেন আমি যা জানি তোমরা যদি না জানতে তাহলে হাসতে কম, কাঁদতে বেশী। পার্বত্য চট্টগ্রামের এবারের যাত্রাটাতে এমন কিছু দেখলাম, এমন কিছু জানলাম যা বুকের মধ্যে ভারী পাথরের মত চেপে বসে আছে।

বিজ্ঞানের সাথে থাকার ফলেই বোধহয় ব্যক্তিগতভাবে আমি একটু অবিশ্বাসী ধাঁচের, বিশেষত নানাবিধ কনসপিরেসি থিওরিতে আমার একেবারেই ঈমান আসেনা। পার্বত্য চট্টগ্রামকে কেন্দ্র করে পশ্চিমাদের নানা পরিকল্পনা রয়েছে, তারা একে বাংলাদেশ থেকে আলাদা করতে চায় – এমন একটা কথা হাওয়ায় ভাসছিল অনেকদিন ধরেই। আমার স্বভাবের দোষেই তেমন গায়ে মাখিনি। কিন্তু এবার নিজের চোখে যা দেখে আসলাম, যা শুনলাম তাতে হঠাৎ চোখের সামনে একটা মাকড়সার জাল দেখতে পেলাম। মাকড়সার জাল বলা আসলে ঠিক ইনসাফ হলোনা, মাকড়সা পেটের দায়ে জাল পাতে; এই জাল যারা পেতেছে তাদের পেটের ক্ষুধা মিটেছে বহু আগেই কিন্তু চোখের ক্ষুধা আজোবধি মেটেনি। ব্যাপারটা নিয়ে বিস্তারিত লিখতে পারছি না—পরিসংখ্যানের পরীক্ষায় পাশ করবে এমন তথ্যের অভাবে। লেখাটা যাদের বিরুদ্ধে যাবে তারা পনের হাজার মাইল দূর থেকে তামাশা করতে আসেনি, অনেক আঁট-ঘাঁট বেঁধেই এসেছে। আমাদের হুশ হয়েছে অতি অল্প দিন হলো। তবে আমরাও চেষ্টা করছি। আল্লাহ যদি সাহায্য করেন তবে আমরাও একদিন তাদের আসল চেহারাটা মানুষের সামনে তুলে ধরব। তবে সে অবস্থান পর্যন্ত যেতে আমাদের অনেক কাজ করতে হবে, আরো অনেক বেশী আত্মত্যাগ করতে হবে।

এ লেখাটা তাই কোন লেখা নয় বরং আমাদের সাথে যারা ১৪৩৪ হিজরিতে শীতার্তদের সাহায্যার্থে কাজ করেছেন তাদের কিছু টুকরো অভিজ্ঞতার সমাহার। সবারই বুক ফাটে কিন্তু মুখ ফাটে না বিধায় প্রায় চল্লিশজনের দলটির সবার কথা এখানে আসেনি। তবে সবার পক্ষ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি এ মর্মে যে আমাদের সীমাবদ্ধতার জন্য যে দেরীটা হয়েছে, আরো বেশি মানুষকে আরো ভালোভাবে শীতের কাপড় পৌছে দেওয়াতে যে কমতিটা হয়েছে—সেটা যেন দাতারা ক্ষমা করেন। আল্লাহ যেন আমাদের এবং দাতাদের উদ্দেশ্যটা কবুল করে নেন, আমাদের দান ও কাজগুলোর বিনিময়ে আমাদের ক্ষমা করে দেন। আমিন।

—————————————-

শাহিদ, বাংলাদেশ রেলওয়ে

শুক্রবার রাতের শ্যামলী বাসে চেপে রওনা হয়েছিলাম চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার বাবুপুরা গ্রামের উদ্দেশ্যে, সাথে ছিল ১৫০ কম্বল। গ্রামটি ছিল পদ্মা নদী তীরবর্তী। গ্রামের প্রায় সবাই নদী ভাঙ্গা মানুষ, তাই খুব দুস্থ প্রকৃতির। কম্বল বিতরণ কাজে স্থানীয় প্রতিনিধি ছিল আমিনুল ভাই, সকাল ১১ টার দিকে উনার বাড়ির কাছেই এক উঠানে বিতরণ কাজ শুরু হয়। যেহেতু পূর্বে লিস্ট ছিল তাই বিতরণে বিশেষ কোন সমস্যা হয়নি, তবে যেটা পীড়িত করেছে—অসংখ্য মানুষের জীর্ণ, শীর্ণ কাপড় গায়ে দাড়িয়ে থাকা যাদের নাম লিস্টে ছিল না। বিতরণের শেষে যখন আমি আমিনুল ভাই এর বাসার দিকে যাচ্ছিলাম তখন অনেক লোক আমার পিছনে পিছনে আসছিল প্রচণ্ড শীতের কষ্টকে ভুলে থাকার সম্বল, একটা কম্বলের জন্য। একটা মহিলা পিছুই ছাড়ছিল না, বারবার বলছিল নতুন একটা লিস্ট করার জন্য যেখানে তার নামটা থাকবে—তসলিমা। যখন সবাইকে ঐ বাড়ি থেকে সরিয়ে ফেলা হল, তখনো দেখি ঐ মহিলাকে, জানালা ধরে একই কথা বারবার বলছিল। লিস্টের মধ্যে যারা তখনো আসেনি (দূরবর্তী গ্রামে থাকে বিধায়) তাঁদের থেকে একটা কম্বল চাইছিল। কিন্তু আমি দেইনি কেননা তখন লিস্টে যাঁদের নাম আছে তারা পাবে না এবং নতুন সমস্যা শুরু হবে। এই ব্যথিত মন নিয়েই আমার ফিরতে হল। এর কিছুদিন পর যখন ঢাকায় প্রচণ্ড শীত পড়ল, আমি দুপস্তের মোটা কম্বল গায়ে যখন ঘুমাতে যেতাম তখন ঐ মহিলার কথা মনে পড়ত। নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয়, আবার এই বলে নিজেকে শান্তনা দেই যে কিছু ভাই-বোনের কষ্টার্জিত অর্থে কেনা কম্বল তো ১৫০ নারীপুরুষের মাঝে পৌঁছে দেয়া হয়েছে যেটা তাদের আল্লাহ্ এর তরফ থেকে দেয়া হক।

————————————————

সোহেল, বিমস

প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকা আছে গুলশান অফিসে, সেখান থেকে নিয়ে যেতে হবে বঙ্গবাজারে। একসাথে এত টাকা, ঢাকার রাস্তা–মানসিক চাপ ছিল অনেক। যেহেতু আমার নিজস্ব পরিবহন নেই তাই পাবলিক বাহন ছাড়া উপায় নেই। পিকআপ ভ্যান নিয়ে অপু ভাই আসবে রাত নটায়। মাদ্রাসা ছাত্রদের জন্য সিংগেল সাইজের কম্বল চাই, যেতে হবে গুলিস্থানে কম্বলের গুদামে। দুজন স্টাফকে ফোনে যোগাযোগ করতে হবে—অফিস থেকে পাঁচ বস্তা কাপড় নিয়ে আসবে বঙ্গবাজার। আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ সহায় হওয়ায় প্রতিরাতের মতো সেবারও কম্বল কেনার কাজ শেষ করতে পেরেছি ভালোয় ভালোয়। সব শেষ করে বাসায় গিয়ে পৌছাতে পৌছাতে রাত বারোটা। এমন রাত গত তিন মাসে কয়বার এসেছে? থাক, সেটা নাহয় শুধু আল্লাহই জানুক।

———————————————-

তিশাদ, বুয়েট

রাত সাড়ে ১০টা। গাবতলি বাস স্ট্যান্ডে টিকেট হাতে বসে আছি। কুড়িগ্রামের উলিপুর যাব কম্বল নিয়ে। বাস ছাড়তে ১৫ মিনিট বাকি আর কম্বলের ভ্যান তখনও শাহবাগ। বাধ্য হয়ে টিকেট ফেরত দিয়ে অন্য বাসের খোঁজে গেলাম। কিন্তু উলিপুরের বাস আর পাওয়া গেল না। অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর কুড়িগ্রামের একটা মুড়ির টিন টাইপ বাসের সন্ধান পেলাম। কম্বল আসছে, ওদিকে উলিপুরেও লোক বসে আছে তাই চোখ বন্ধ করে টিকেট নিয়ে ফেললাম। কম্বল এসে পৌছালো বাস ছাড়ার ঠিক আগে। তাড়াহুড়ো করে কম্বল বাসের ছাদে উঠিয়ে বাসে উঠে বসলাম আমরা দুইজন। সেই মুড়ির টিন তার রূপের সার্থকতা গুণের মাধ্যমে প্রমাণ করতে পথিমধ্যে তিনবার নষ্ট হয়ে শেষমেশ ভোরবেলা যমুনা সেতুর গোড়ায় শেষ গোঙানিটুকু দিয়ে থেমে গেল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ড্রাইভার হাওয়া গেল। তিন বস্তা কম্বল নিয়ে শুরু হল এক অদ্ভুত ভ্রমণ। বাসের হেল্পার আর সুপারভাইজার যাত্রীদের চাপে বাধ্য হয়ে রাস্তায় অন্য একটা বাস থামিয়ে তাতে করে আমাদের সেতুর ওপারে সিরাজগঞ্জ নিয়ে গেল। সেখান থেকে অন্য বাসের ব্যবস্থা করার আশ্বাস শুনে আমরা কম্বল নামিয়ে একপাশে রাখলাম। কিন্তু বাঙ্গালীকে দেওয়া আরও অনেক আশ্বাসের মত হেল্পার আর সুপারভাইজারও বিশ্বাসকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে সুযোগ বুঝে পালিয়ে গেল। অন্যান্য যাত্রীরা নিজেদের মতো করে বিভিন্ন বাসে উঠে গেলেও কোনো বাসই বস্তা সহ আমাদের নিতে রাজি হচ্ছিল না।

সকাল সাড়ে ১০টা। আমরা দুজন আর ইজতেমা ফেরত এক তাবলিগি ভাই বাদে আর কোনও যাত্রী নেই। অনেক চেষ্টার করে আরও এক-দেড় ঘন্টা পর সেই তাবলিগি ভাই (বাবু ভাই) একটা ট্রাকে করে রংপুর পর্যন্ত যাওয়ার ব্যবস্থা করলেন। ঠেলেঠুলে বস্তা উঠিয়ে শুরু হল এক নতুন অভিজ্ঞতা। ট্রাকের পেছনে করে উত্তর বঙ্গের ‘মফিজ’ স্টাইলে ঝাঁকুনি খেতে খেতে চারপাশ দেখা। এর মাঝে অনেক হাটুরে, ব্যবসায়ী, শ্রমিক উঠল, নামলো। একবার ড্রাইভারও বদল হয়। নানান কিসিমের মানুষের নানান সুরের কথাবার্তা শুনতে শুনতে বগুড়া, গাইবান্ধা পেরিয়ে বিকাল ৪টায় রংপুরে গিয়ে পৌছালাম। আবার বস্তা ডাউনলোডের পালা। রাস্তার একপাশে বস্তা রেখে একটা হোটেলে প্রায় ২০ ঘন্টা পর খাওয়া-দাওয়া করলাম। খাওয়া শেষে রংপুরের মডার্ন মোড় থেকে আরেক লোকাল বাসে করে কুড়িগ্রামের উদ্দেশ্যে যাত্রা। সন্ধ্যা পেরিয়ে কুড়িগ্রামে পৌছলাম। সেখানে দুইজনে মিলে বস্তা নামানোর পর কুলিরা এসে মজুরি চাইলো। মাল যেই নামাক টার্মিনালে নামালে মজুরি দিতেই হবে এই শিক্ষা অর্জন করে কুলির মজুরি দিয়ে উলিপুরে যাওয়ার উপায় খুঁজতে লাগলাম। বাবু ভাই কুড়িগ্রাম নেমে তার বাসায় চলে যান। আল্লাহ্ উনাকে মিলিয়ে দিয়েছিলেন বলেই কোনওক্রমে আমরা গন্তব্যে পৌছতে পারি। তারপর একটা অটো ভাড়া করে তাতে দুটো বস্তা ঠেসে ঢুকিয়ে আর একটাকে অটোর ওপরে বেঁধে আমরা ড্রাইভারের দু’পাশে উঠে বসি। গন্তব্য উলিপুর। অন্ধকার শীতের রাতে এবড়ো-খেবড়ো রাস্তা পেরিয়ে অবশেষে রাত ৯টা নাগাদ উলিপুর থেকে আরও ৮ কিমি. ভেতরে অনন্তপুর গ্রামে গিয়ে পৌঁছাই। Once in a lifetime অভিজ্ঞতা নিয়ে সকাল সাতটার বদলে আমরা গন্তব্যে পৌঁছাই রাত ৯টায়। শুনেছি আন্তরিক প্রচেষ্টা নাকি মানুষের অন্তর পর্যন্ত পৌঁছায়। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তাআলা যেন আমাদের পৌঁছানো কম্বলগুলো দিয়ে শারীরিক উষ্ণতা দেওয়ার পাশাপাশি সেই মানুষগুলোর অন্তরেও আল্লাহ্র প্রতি উষ্ণ কৃতজ্ঞতা সৃষ্টি করে দেন।

—————————————

জেবেল, চুয়েট

আকাশে পূর্ণিমা। সেই জোছনায় যতদূর দেখা যায় শুধু বালি আর কলাগাছ। আর কিচ্ছু নেই। ‘১০ সালের এক শীতের রাতে লালমনিরহাটের এক চরের এই দৃশ্য আমার মাথায় গেঁথে যায়। সেখানে ক্যারিয়ারের মূষিক দৌড় নেই, স্ট্যাটাস নিয়ে অহংবোধের কামড়াকামড়ি নেই। শুধু আছে কোনোক্রমে বেঁচে থাকার প্রতিযোগিতা। গিয়েছিলাম শীতার্তদের কম্বল দিতে। মনে ছিল মহত্ত্ববোধের আত্মপ্রসাদ। কিন্তু কম্বল পেয়ে সেখানের শিশু আর বৃদ্ধদের তৃপ্ত মুখ আর আতিথেয়তা আমাকে আমার ভেতরের দৈন্যতার মুখোমুখি করে দেয়। সেই কম্বল শীতের রাতগুলোয় তাদের কতটা আরাম দিয়েছে জানি না তবে সেই অভিজ্ঞতা আমাকে জীবন চিনতে শিখিয়েছে। আর সেই অভিজ্ঞতার জন্য আমি সেই নাম না-জানা মুখগুলোর প্রতি, আমাকে সাথে করে নিয়ে যাওয়া অসাধারণ কিছু ভাইদের প্রতি আর সর্বোপরি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞ।

——————————–

তাহিন, চেইঞ্জ টিম

গত ২৮ জানুয়ারী অপু ভাইয়ের মাধ্যমে আমি আর নিশান রাশেদ লালমনিরহাট গিয়েছিলাম শীতের কাপড় দিতে। ঢাকায় ঠান্ডা কম হলেও লালমনিতে এখনো বেশ ঠান্ডা। ওখানকার স্থানীয় এক মাদ্রাসার টিচার হুসেন ভাইয়ের সাথে মিলে প্রায় ৩০০ কম্বল দেয়া হল। আলহামদুলিল্লাহ, বেশ ভালোই হয়েছে পুরো কার্যক্রম।

শীতের কাপড় দিতে গিয়ে যেই জিনিসটা লালমনিতে বেশি চোখে পড়ল তা হলো খ্রিস্টান মিশনারীদের আধিপত্য। ‘ধর্ম নিরপেক্ষ’ বাংলাদেশে খ্রিস্টানরা তাদের ধর্মপ্রচার করতেই পারে। কিন্তু ব্যাপারটা শুধু এতটুকুতে সীমাবদ্ধ থাকলে হত। লালমনিতে দেখলাম খ্রিস্টানদের পরিচালিত নানারকম সংগঠন এমনকি ইসলামিক সেন্টার, মসজিদও আছে। সেখানে মুসলমানদের খ্রিস্টবাদ মিশ্রিত বিকৃত ইসলামের দাওয়াত দেয়া হয়। তাদের কিছু বই দেখে তো আমার চোখ কপালে। কুরআনের আয়াত আর হাদীসে ভরা কিছু কিছু বই দেখে অনেক মুসলিমই বোকা বনে যাবে। অথচ পুরা বই সেইসব কুরআন আর হাদীসের অপব্যাখ্যায় ভর্তি। আর বাকি বইগুলো ভরা শিরক-কুফরীতে। এইসব বই পড়লে আপনি জানতে পারবেন কিভাবে একজন ভালো মুসলিম হয়েও আপনি খ্রিস্টান হতে পারবেন, কিভাবে কুরআনে আল্লাহ মানুষকে পৃথিবীতে বাইবেল প্রতিষ্ঠা করতে বলেছেন, আরো কত কি!

কোটি কোটি টাকা খ্রিস্টানরা সেখানে খরচ করছে তাদের দাওয়াতের কাজে। টাকার লোভ দেখিয়ে সেখানে গরিব মুসলিমদের খিস্টান বানানো হচ্ছে। আর যথাযথ জ্ঞানের অভাবে টাকার বিনিময়ে সেখানকার গরিব লোকগুলো তাদের দ্বীন বিক্রি করে দিচ্ছে। বানানো হচ্ছে মিশনারী স্কুল যেখানে মুসলিম ছেলে-মেয়েরা পড়ছে। পড়ার ফাঁকে ধীরে ধীরে মিশিয়ে দেয়া হচ্ছে মিথ্যা ধর্মের বিষ। গরিব ছেলে-মেয়ের জন্য তাদের আরেক অভিনব আবিস্কার হলো ‘বন্ধু’! এখানে স্কুলের প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীকে পরিচিত করিয়ে দেয়া হয় এক বন্ধুর সাথে যে কিনা আমেরিকা, ইংল্যান্ড বা ইতালিতে বসে সেই ছেলে বা মেয়ের ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত থাকা, খাওয়া ও চিকিত্সা সহ সব খরচ বহন করবে। এসবের বিরুদ্ধে কিছু বললেই মিশনারীরা আপনার নামে জে.এম.বি মামলা ঠুকে দিবে। আর জে.এম.বি-র মামলার কথা শুনলে পুলিশদেরও চোখ বড় বড় হয়ে যায়।

তারপরও ঝুকি নিয়ে হুসেন ভাই লোকটা প্রায় একাই কাজ করে যাচ্ছেন। লালমনি শহরে একটা মাদ্রাসা দেয়ার টাকা না থাকলেও তিনি থেমে নেই। সাধ্যমত চেষ্টা করে যাচ্ছেন স্কুল-মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার, অজপাড়া গাঁয়ে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দেয়ার। ভাবি কী হলো আজ আমাদের যে আমরা কিছুই করতে পারি না? পারি না সেখানে গিয়ে মানুষদের ইসলামের দাওয়াত দিতে, পারি না কিছু টাকা দিয়ে লালমনি শহরে মাদ্রাসার জন্য একটু জমি কিনে দিতে। আফসোস লাগে …

——————————–

মাহমুদ হাসান কাওসার, ফ্রিল্যান্সার

আজকে সবগুলো কম্বল শেষ হয়েছে, আমি ১১০% চেষ্টা করেছি শুধুমাত্র গরীবদের খুজে বের করে দেয়ার জন্য। কিন্তু মাঠে কাজ করা সত্যিই কঠিন গ্রামে কয়েকজনকে দেয়ার পর জানতে পারি তারা মিথ্যা বলেছে, হয়তোবা তারা কম্বল পাওয়ার উপযুক্ত ছিল না, যাই হোক, অনিচ্ছাকৃত এ বিষয়ের জন্য আমি ক্ষমাপ্রাথী। কম্বলগুলো ভাল মানের হওয়ায় যাদের হাতে দিয়েছি তাদের হাতে দিয়ে একটা তৃপ্তি অনুভব করেছি, গ্রামে অনেক বৃদ্ধ মহিলারা কম্বলটি নিয়ে সাথে সাথে গায়ে জড়িয়ে দোয়া শুরু করে দিয়েছে। আল্লাহ তায়ালা তাদের দোয়াকে কবুল করুন, আমীন।

——————————–

পৃথু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

গাড়ির ভিতরে কেবল তিন জনের জায়গা হত। আমরা মানুষ ৬ জন ড্রাইভার আর হেলপার সহ। আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় যিনি, তিনি ভিতরে বসলেন ড্রাইভার এবং হেলপার এর সাথে। আমরা বাকি তিন জন বসলাম ট্রাকের পিছনে। কম্বল রাখার পরে জায়গা তেমন একটা ছিল না, তবে ৩ জন একটু চেপে চুপে বসা যায়। আগে থেকে জানতাম কোথায় বসতে হবে। সেভাবেই গরম কাপড় পড়ে তৈরি ছিলাম। ঢাকার মধ্যে ঠান্ডা তেমন ছিল না। তবে ঢাকা হতে বের হতে হতে ঠান্ডা লাগা শুরু হল। তিন জনে তিনটি কম্বল নিয়ে বসলাম।

কিছুক্ষণ পর পড়ল প্রচন্ড কুয়াশা। যত আগাই, যত রাত বাড়ে, কুয়াশা ততই বাড়ে। এক পর্যায় ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে দেয় এক পাম্পের সামনে। কারণ—কুয়াশা। কুয়াশা ছিল ঠিকই, তবে আরও গাড়ি ঠিকই চলছিল। আমরা তাকে বললাম এখানে দাঁড়ালে অনেক দেরি হয়ে যাবে। তাছাড়া, যত দেরিই করি না কেন, কুয়াশা তো কমবে না। কথার তেমন একটা গ্রাহ্য করল না ড্রাইভার। সে গাড়ি বন্ধ করে হেলপার এর সাথে দিল ঘুম। আমরা পিছনে বসে শীতে কাঁপি।

না পেরে একপর্যায়ে আমরা পেট্রোল পাম্পের এক ছাউনির নিচে একটা বেঞ্চে বসলাম। কিছুক্ষণ গল্প করে সময় কাটালাম। মাঝে উঠে একটু হাটাহাটি ও করলাম। ড্রাইভার এর ঘুম ভাঙ্গে নাকি খোঁজ নিচ্ছি খালি। জোর করে উঠিয়ে গাড়ি চালাতে বলার সাহসও পাই না আবার। কখন ঘুম এর ঘোরে গাড়ি নিয়ে কোন পুকুরে ফেলে দেয়। তাছাড়া কুয়াশাও তো কমে না। এভাবে ঘন্টা খানিক কাটে। অবশেষে সাখাওয়াত ভাই ড্রাইভার কে ডেকে বলে অনেক ঘুম হয়েছে, এবার উঠো। আমরা আবার যাত্রা শুরু করলাম।

——————————

শরীফ আবু হায়াত অপু, বিসিটিআই

ড. সাইফুল্লাহ কম্বল দিচ্ছেন স্টেজ থেকে। দুটো টিভি চ্যানেল থেকে ক্যামেরা এসেছে—তারা রেকর্ড করছে। সৌদি আরবের রিয়াদ প্রবাসী যে ভাইয়েরা টাকাটা পাঠিয়েছেন তাদের ইচ্ছে কম্বল দেওয়ার খবরটা যেন মিডিয়ায় আসে। হুজুররা যে শুধু হাত পেতে নেয় না, মানুষকে দেয়ও—এ ব্যাপারটা যেন সবাই জানে। সবাই যেন জানে দেশের মসজিদ ও মাদ্রাসাগুলোকে কেন্দ্র করে যে বিশাল ত্রাণকাজ চলে প্রতি বছর লোকের অগোচরে সেগুলো ভোট কামানোর জন্যেও না, দানবীর বলে নাম কুড়ানোর জন্যেও না।

আমি চকিতে বেরিয়ে এলাম—এক ভাই তার মাদ্রাসাটা এক নজর দেখার জন্য অনুরোধ করেছিলেন, সেখানে যাব। মটর সাইকেলের পিছনে চেপে বসলাম। মাটির রাস্তা ছেড়ে পিচঢালা পথ ধরে কিছুদূর যেতেই এক বৃদ্ধাকে দেখলাম। বয়স আন্দাজ করা শক্ত—আশি, নব্বুই, একশ… খুব কষ্ট করে লাঠিতে ভর দিয়ে কোনোভাবে শরীরটাকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। বুকে রাখা কম্বলটাকে আরেকহাতে মুঠো করে ধরে রেখেছেন। আমি জানি না এই বুড়িমার বাড়ী কোথায়, কতদূর রাস্তা তিনি এভাবে হেঁটে এসেছেন। আমাদের পৌছাতে অনেক দেরী হয়ে গিয়েছিল—হয়ত তিনি অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছেন কম্বলটি পাওয়ার জন্য। তার হাঁটার ভঙ্গীতে এমন একটা কিছু ছিলো যে চশমার কাঁচটা ঝাপসা হয়ে আসতে লাগল।

আমি জানি মিডিয়াতে, আমাদের মুসলিমদের খুব খারাপভাবে দেখানো হয়—আমাদের আদলে রাজাকারদের ছবি আঁকা হয়, কুরআন হাদিসের ভাষা ব্যবহার করে রঙ্গ-রস লেখা হয়। এও জানি মানুষ অন্যকে ভালো কাজে করতে দেখলে উৎসাহিত হয়, যে নিজে কখনো দান করেনি সেও পকেটের দিকে হাতটা বাড়ায়। সব জেনে, সব বুঝে, ঝাপসা চোখে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম ক্যামেরার সামনে কাজটা আমার জন্য নয়। দেশে বহু মানুষ আছে—নানা জনের নানা ধরণ আছে কাজ করার। আমি নাহয় সে ধরণটাই বেছে নিলাম যেখানে আমার ভাইয়েরা হেটে হেটে বাসায় গিয়ে কম্বল দিয়ে আসবে। যদি বাড়িতে সম্ভব না হয়, অন্তত পাড়ায় পাড়ায় যাবে। ছবি তোলার জন্য যে জমায়েত দরকার সেটা অন্যদের জন্য তোলা থাক—আমরা ছবি না তুলেই কাজ করব। আমাদের যারা টাকা দিয়েছেন তারা আমাদের শব্দ দেখে বিশ্বাস করে নেবেন যে টাকাগুলো জায়গামত গিয়ে পৌছেছে, ছবি চাইবেন না। তারা দূর থেকে দৃশ্য দেখে আত্মতুষ্টিতে ভুগবেন না, পরিকল্পনা করবেন পরের বার দেশে গেলে বেড়াতে গিয়ে তিন সপ্তাহের ছুটি থেকে কম্বল বিতরণের জন্য তিন দিন সময় রাখবেন। সবার সাথে সবার তো মেলে না, আমাদের কাজটা নাহয় আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য একটু অন্যরকমই থাক।

 

– শরীফ আবু হায়াত অপু

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

Back to top button