ভ্রমণ কাহিনী

পাহাড়ের বুকে অন্য বাংলাদেশ

আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব

স্বপ্নডানায় ভর করিয়া..

প্রতিবার কক্সবাজার যাওয়ার পথে দিগন্তরেখায় নীলবর্ণ সারি সারি পাহাড়ের নীল হাতছানি মনটা ব্যাকুল করে তুলত। মুগ্ধ বিহ্বলতা নিয়ে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকতাম সেদিকে দৃষ্টিসীমা যতদূর যায় ততদূর। তবে সশরীরে ঐ সুউচ্চ পাহাড়ের দেশে যাওয়া যায় বা পর্বতারোহনের সুযোগ কখনও মিলবে তা ভাবনাতেই আসেনি। বাসের জানালায় ধরা দেয়া এই রহস্যাবৃত নীল সৌন্দর্যরাশি কেবল কল্পনায় ডুবে ডুবে উপভোগ করতে হয়Ñএ পর্যন্তই ছিল অনুভূতির সীমানা। দু’বছর আগে মূসা ইবরাহীম নামের বাংলাদেশী পর্বতারোহী যখন হিমালয় চূড়া ছুঁলেন, তখন থেকে পত্র-পত্রিকায় পর্বতারোহনের বিষয়টি বেশ গুরুত্বের সাথে আসতে লাগল। আর সে সূত্রেই বেশকিছু ফিচার পড়লাম বাংলাদেশের সরকারীভাবে স্বীকৃত সর্বোচ্চ পর্বতচূঁড়া কেওকারাডং আরোহন সম্পর্কে। এসব পড়ে মনের ভিতর বার বার উঁকি দিতে লাগল কীভাবে ঐ নীল পাহাড়ের দেশকে পদানত করা যায়। একরাশ বিস্ময় হয়ে যে দুর্গম পাহাড় এতদিন শুধু কল্পনায় ধরা দিত, তাকে আপন করে পাওয়ার নেশা ভালমতই পেয়ে বসল।   

স্বপ্ন থেকে বাস্তবে :            
কেওকারাডং আরোহনের জন্য টানা ৫/৬ দিন সময় হাতে রাখা প্রয়োজন। একাধারে কয়েকদিন ছুটি মিলানো, উপযুক্ত ভ্রমণসঙ্গী পাওয়া বেশ কঠিন হয়ে পড়লেও শেষমেশ বর্ষা পরবর্তী সেপ্টেম্বর মাসকেই বেছে নেয়া হল সফরের জন্য। ঢাকায় আমাদের কর্মী সম্মেলন ২০ সেপ্টেম্বর’১২। পূর্ববর্তী ২ সপ্তাহ সম্মেলনের প্রস্তুতির জন্য খুব ব্যস্ততায় কেটেছে। ক’দিন বিশ্রাম প্রয়োজন। এই বিশ্রামের সময়টুকু সফরের জন্য উপযুক্ত পুঁজি মনে করে পরদিন ২১ সেপ্টেম্বর সায়দাবাদ থেকে বিকাল ৫টায় চট্টগ্রামের বাস ধরলাম। সফরসঙ্গী নাজীব ও কাফী ভাই। পরের দিন আসবে মাহফুজ। রাত প্রায় ১২টার দিকে পাহাড়তলীতে আত্মীয়ের বাসায় পৌঁছলাম। পরদিন বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ও সরঞ্জামাদি কিনে ফেললাম। সন্ধ্যায় রাস্তায় জ্যামে পড়ে পতেঙ্গা বীচের মিষ্টিরোদে ভাজা ঢেউয়ের তোড় দেখার সুযোগ না পেলেও রাতের চন্দ্রবিধুর সমুদ্র দর্শন বেশ উপভোগ্যই হল। বাসায় ফিরে জানতে পারলাম আগামীকাল হরতাল।
যাত্রা শুরু :
পরদিন ভোর ৫টার পূর্বেই আমরা ৪ জন বের হলাম বাসা থেকে। উদ্দেশ্য ঢাকা থেকে আসা নাইটকোচ ধরে বান্দরবান যাওয়া। কর্ণেলহাটে ঢাকা বাস কাউন্টারে গিয়ে জানা গেল ২০ মিনিট আগেই গাড়ি চলে গেছে। ফলে বহাদ্দারহাট বাস টার্মিনালে গিয়ে কাটা গাড়ি ধরা ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখি কোন ধরনের যানবাহন নেই। প্রায় ১ ঘণ্টা চলে গেল তবু কোন ব্যবস্থা হল না। শংকায় পড়ে গেলাম। পরে একটা বাস পাওয়া গেল কর্ণফুলী ব্রীজ পর্যন্ত। সেখান থেকে ভাগ্যক্রমে কেরাণীরহাটগামী একটি মাইক্রোবাস পেয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। সকাল ৮টার মধ্যেই কেরাণীরহাট পৌঁছলাম। কেরাণীরহাট থেকে বান্দরবান আরো প্রায় ২৫ কিলোমিটার। সিএনজিতে রওয়ানা হলাম। বেলা পৌনে ন’টার দিকে বান্দরবান শহরে পৌঁছলাম। সকালের নাস্তা সারলাম জামান হোটেলে। ছিমছাম ছোট্ট শহর বান্দরবান। দোকানপাটে উপজাতীয়দের আনাগোনা বেশ। এক দোকান থেকে অডোমস ক্রীম, স্যালাইন, গ্লুকোজ, ব্যাণ্ডেজ, চকলেট, বিস্কুট ইত্যাদি কিনে ফেললাম। সামনে ৩ দিন পাহাড়ে পাহাড়ে কাটাতে হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পাওয়া সেখানে দুষ্কর। বান্দরবান থেকে রুমা বাজার যেতে হবে। অটোবাইকে চড়ে রুমা বাসস্টাণ্ডে এসে বাসের অপেক্ষা। হরতালের দিন যাত্রী নেই বলে বাসও ছাড়ে না। অবশেষে ঘন্টাখানিক পর আসন পূর্ণ হলে বাস ছাড়ল। উঁচূ-নিচু পাহাড়ী রাস্তা। প্রায় ৩৫ কিঃমিঃ যেতে হবে এই সংকীর্ণ আঁকা-বাঁকা পথ ধরে। কয়েকমাস পূর্বে চাঁদের গাড়িই ছিল একমাত্র ভরসা। সেনাবাহিনী পীচের রাস্তা করে দেয়ায় এখন বাস চলাচল করছে। শীঘ্্রই কানে চাপ আর ব্যথা অনুভূত হতে লাগল। পাহাড়ী পথে এটা খুব সাধারণ উপসর্গ। রাস্তার দুই ধারে যতদূর চোখ যায় বিস্তীর্ণ ধূসর পাহাড়ী উপত্যকা। মনে হয় যেন বিমান থেকে ভূমির দৃশ্য দেখছি। শীতের শুরু হয়নি। কিন্তু কুয়াশার মত আবছা নীল দৃশ্যপট। অনেক নীচে পাহাড়ের বাক ঘুরে ঘুরে বয়ে চলেছে সাঙ্গুর ফিতের মত চিকন স্্েরাতধারা। বিশাল উপত্যাকায় কেবলই পাহাড়। বাড়ী-ঘর তেমন দেখাই যায় না। মাঝে মাঝে যখন দুই পাহাড়ের ভয়ানক দর্শন গিরিখাত দিয়ে ওপারের বিশাল উন্মুক্ত প্রান্তর দেখা যাচ্ছিল, তখন মনের অজান্তেই বারবার বেরিয়ে আসছিল সুহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি সুবহানাল্লাহিল আযীম। চিম্বুক রেঞ্জের উঁচু পাহাড়ের সারি বাসের জানালা দিয়ে ঘাড় নীচু করে দেখতে হচ্ছে। তারই এক চূঁড়ায় সুসজ্জিত অবকাশকেন্দ্রের ছাউনি দেখা গেল। মাহফুজ বলল, ওটাই নীলগিরি। চোখ ফিরাতে পারছি না জানালা থেকে। সর্বাধিক শক্তিশালী ক্যামেরারও সাধ্য নেই এই অনিন্দ্য সৌন্দর্যরাজির প্রকৃত রূপকে বন্দী করার। খুব কামনা করছিলাম গাড়ি থামুক কিছুক্ষণ। দু’চোখ ভরে প্রকৃতির এ রূপসুধা গলধঃকরণ করি। অবশেষে চাকা পাংচার হওয়ায় গাড়ি থামল বটে, তবে স্বপ্নরাজ্যের মত সেই ভ্যালিটি পার হয়ে এক জঙ্গলময় পাহাড়ঢাকা বাঁকের উপর থামল। গাড়ি থেকে নেমে রাস্তার পার্শ্বে গভীর খাদের কিনারে আসতে হাইটোফোবিয়ায় গা শির শির করে উঠল। গাড়ি সারাইয়ের পর আবার যাত্রা শুরু। বেলা পৌনে ২টার দিকে গাড়ী থামল কাইখ্যাংঝিরিতে। রাস্তা থেকে নীচে সাংগু নদী পর্যন্ত দীর্ঘ সিঁড়ি পার হয়ে ইঞ্জিন নৌকায় চড়লাম। সহযাত্রীরা অধিকাংশই উপজাতি। ভাষা কিছুই বোঝা যায় না। ২টার দিকে যাত্রা শুরু হল সাংগুর বুক চিরে। দুই তীরে পাহাড়ের সারি। বেশ খরস্্েরাতা কিন্তু অগভীর নদীর বুকে পাহাড়ের ছায়া আর রোদের লুকোচুরি চলছে। চারিদিকে সবুজের সমারোহ। জংলী কলা আর নাম না জানা গাছ ও লতাপাতায় ছেয়ে আছে পাহাড়গুলো। সামনে বহুদূরে নীল চাদর জড়িয়ে যেন পথরোধ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে দূরবর্তী পাহাড়গুলো। নদীর কিনার ঘেঁসে ভেসে যাচ্ছে থরে থরে সাজানো পাহাড়ী বাঁশের আটি। ছোট ছোট ক্যানুর মত দাড় বাওয়া নৌকাও দেখা যায়। প্রকৃতি সৌম শান্ত নীরব। এমনি মৌন পাহাড়ঘেরা দৃশ্যপটের সামনে দাঁড়িয়ে কল্পনায় কেবলই ভাসছে ডকুমেন্টারীতে দেখা দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন নদীর ভয়ংকর সব বাঁক আর সেখানকার কোন দুঃসাহসিক এ্যাডভেঞ্চার দৃশ্য। আমরা যেন আর আমরা নেই; অজানার পানে আজ আমরা যেন আবিষ্কারের নেশায় ধাবমান একদল অভিযাত্রী। পথিমধ্যে পড়ল নদীর উপর নবনির্মিত রুমা ব্রীজটি। জানতে পারলাম আগামী ১৫ অক্টোবর এটির উদ্বোধন হবে। তখন আর রুমা যেতে নৌকার এই মনোমুগ্ধকর যাত্রার প্রয়োজন হবে না। মনটা অকারণেই খারাপ হয়ে যায়। হয়তবা দেশের বাড়ীর যাত্রাপথে পদ্মার বুক চিরে ফেরী পার হওয়ার সেই হারানো স্মৃতি মনে করে। প্রায় ঘন্টাখানিক পথ চলার পর এক চমৎকার পাহাড়ঘেরা ইউটার্নের মুখে এসে নৌকা থামে। ঘাটে নেমে লম্বা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এলাম। এটাই বিখ্যাত রুমা বাজার। রুমা থানার আয়তন অনেক বড়। কেওকারাডং অতিক্রম করে সেই সুদূর তাজিনডং পাহাড় পর্যন্ত বিশাল এলাকার প্রাণকেন্দ্র এই রুমা বাজার। বাঙালীদের চেয়ে উপজাতীয়দেরই বেশী চোখে পড়ল। লম্বা পাহাড়ী পথ পাড়ি দিয়ে উপজাতীয়রা এই বাজারেই সদাই করে। মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডা, চার্চ কি নেই এই বাজারে। প্রবেশমুখেই তিনটি রেস্টহাউজ। নতুন ও তুলনামূলক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন দেখে ‘আরণ্যক রিসোর্টে’ উঠলাম আমরা। মালিকের বাড়ি সাতকানিয়া। আমাদের বেশ সমাদর করলেন। অফ সিজন হওয়ায় পর্যটকশূন্য হোটেল। নিরিবিলি পরিবেশ। আমাদের বেশ সুবিধাই হল। সাংগু নদীতে গোসল করব চিন্তা করেছিলাম। কিন্তু পানি ঘোলা দেখে বাদ দিলাম সে চিন্তা। বিকালে হোটেল মালিক আমাদেরকে একজন গাইড ঠিক করে দিলেন। কিন্তু গাইড চার্জ শুনে তো চক্ষু চড়কগাছ। ধারণার চেয়ে অনেক বেশী। যাইহোক উপায়ন্তর না দেখে রাজী হয়ে গেলাম। গাইড জানাল, নিয়মিত-অনিয়মিত মিলিয়ে তার মত প্রায় ৭০ জন গাইড এই দুর্গম পাহাড়ী পথে টুরিস্টদের সেবা দিয়ে জীবিকা অর্জন করছে। গাইডের পরামর্শ মোতাবেক পাহাড়ী পথে চলাচলের উপযোগী গ্রীপযুক্ত সস্তা রাবারের স্যান্ডেল কিনে নিলাম। রাতে স্থানীয় সাতকানিয়া হোটেলে খাওয়ার পর বাজার মসজিদে ছালাত আদায় করলাম। আমাদের ছালাত আদায়ের ভিন্ন ধরন দেখে মসজিদের মুছল্লীদের দৃষ্টি সব আমাদের দিকে। তবে পর্যটন এলাকা বলে হয়ত বিশেষ কিছু জিজ্ঞাসা করল না। মসজিদ থেকে বেরিয়ে হাটতে হাটতে সাংগুর ঘাটে আসলাম। শুক্লাপক্ষের আধফালি চাদের মৃদু আলো তখন নদী ও পাহাড়ে জেঁকে বসা আঁধারকে ঘোচানোর আপ্রাণ চেষ্টায় রত। মেঘের আনাগোনায় আকাশের দেশে ব্যস্ততার আভাস। সারি বেধে দাঁড়িয়ে থাকা নৌকাগুলোর একটার ছাদে উঠে প্রায় ঘন্টাখানিক নদী, পাহাড় ও চাঁদের মিলিত সম্ভাষণে সিক্ত হলাম। মাহফুয, নাজীব, কাফী ভাই ঘুমে ঢুলু ঢুলু। ওদেরকে ‘চন্দ্রাহত’ হওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে অনেকটা জোর করেই এনেছিলাম। সবাই মিলে পরিবেশটা খুব উপভোগ করলেও ঘুমের কাছে হার মেনে হোটেলে ফিরতে হল। রাতে খুব ভাল ঘুম হল। 

রুমাবাজারের সকাল :
এক ঘুমে রাত শেষ হল। দ্রুত অযু সেরে মসজিদে গেলাম। ছালাতে মুছল্লীদের উপস্থিতি তুলনামূলক ভালই মনে হল। মুনাজাতের পর একটি বই বের করে হাদীছ পড়া শুরু করলেন ইমাম সাহেব। আমরা বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আবার সাংগুর তীরে নেমে এলাম। ভোরের সাংগুকে দেখায় খুব শান্ত ও øিগ্ধ। আজ রবিবার হাটের দিন। পাহাড় থেকে নৌকাযোগে আনা শত শত কলার কাঁদি ও তরি-তরকারী নামানো হচ্ছে ঘাটে। ঘাট থেকে একটু দূরে ¯তূপীকৃত বাঁশের সারি সারি আঁটি। বিশেষ পদ্ধতিতে একটার একটা সাজিয়ে ভাসিয়ে আনা হয়েছে দূর-দূরান্ত থেকে। পানিতে পা ছুঁইয়ে হাঁটতে হাঁটতে উঁচূ পাহাড়ের উপর গ্রামটিতে উঠলাম। খাড়া ঢাল বেয়ে উপরে উঠতে পা ব্যথা হয়ে গেল। গ্রামের ভিতরটা দেখে চক্ষু চড়কগাছ। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে ঘর বেঁধে মাঝখান দিয়ে একেবারে প্রশস্ত রাস্তা তৈরী করে বিরাট শহরই যে বানিয়ে ফেলেছে গ্রামবাসীরা। বঙ্গবন্ধু, জিয়াউর রহমান, বিএনপি, আওয়ামী লীগ, ব্রাক, আশা, প্রশিকা কি নেই সেখানে! উপজাতীয়দের সদ্য ঘুম ভাঙ্গা কটমটে চোখের উঁকিবুকি দেখে আর বেশী না এগিয়ে নেমে এলাম নীচে।
বগালেক অভিমুখে যাত্রা : 
ঘাটে নেমে আসতেই গাইড আলমগীরের ফোন। তাড়াতাড়ি সকালের নাস্তা সেরে গোসল করে তৈরী হয়ে নিলাম ৭টার মধ্যে। চিরাচরিত পোষাক ছেড়ে নতুন বেশে পিঠে নতুন কেনা ব্যাকপ্যাক ঝুলিয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে এলাম। বাড়তি জিনিসপত্র সব হোটেল লবিতে রেখে এসেছি। বেশ অভিযাত্রী অভিযাত্রী মুডে আছি সবাই। বাজারের পিছনে পাহাড়ের উপরে অবস্থিত আর্মি ক্যাম্পে গিয়ে রিপোর্ট করলাম। উপস্থিত অফিসারদ্বয় আমাদের নাম-ঠিকানা লিখে নিলেন। তাদের আন্তরিক ব্যবহার ও শুভকামনায় বেশ ভাল লাগল। রিপোর্টিং সেরে নীচে নেমে বিখ্যাত সেই ফোর হুইলার চাঁদের গাড়িতে চড়ার জন্য স্ট্যান্ডে আসলাম। হুডখোলা লোকাল গাড়িতে চাপাচাপি করে ১৮/২০ জন বসেছি। সামনের দিকে বসলাম গাইডসহ আমরা পাঁচজন। বাকি সবাই উপজাতি। পৌনে আটটার সময় যাত্রা শুরু হল। খানিকবাদেই গাড়ি থামল। পুলিশ বক্সে আবার রিপোর্ট করতে হবে। গাড়ি থেকে নেমে আবার নাম-ঠিকানা, গন্তব্য সব লিখতে হল। স্থানীয়দের অবশ্য এসব প্রয়োজন হয় না। বগালেকের যাওয়ার জনপ্রিয় ট্রেইল ঝিরিপথ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার অনুমতি চাইলাম। কিন্তু পুলিশ অফিসারটি খুব শক্তভাবেই বারণ করল ওপথে যেতে। বর্ষা মৌসুমে নাকি সেখানে নানা বিপদের আশংকা। যাইহোক মনের ইচ্ছা চাপা দিয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম। সামনে ইট বসানো উঁচু পাহাড়ী পথ। গাড়ী প্রায় খাড়াভাবে উঠছে তো উঠছেই। মনে হল গাড়ী উল্টেই যাবে। শক্ত করে দু’হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে রয়েছি সামনের রড। পিছনের দিকে তাকালে ভয়ে শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যায়। অনেকক্ষণ ধরে উঠার পর এবার নামা শুরু হল। নামছে তো নামছেই। পুরোটা রাস্তাটাই এমন। রাস্তা থেকে অনেক নিচে সারি সারি পাহাড়। মেঘ, রৌদ্দুরের লুকোচুরিতে সবুজ পাহাড়ের রূপ অবশ্চর্যরকমভাবে ক্ষণে ক্ষণে বদলাচ্ছে। রাস্তার দুধারে ঘন নলখাগড়ার ঝাড় এমনভাবে ঝুকে আছে যে আমাদের গায়ে তা বার বার এসে লাগছে আর নানা জাতের পোকামাকড়ে শরীর ভরে যাচ্ছে। এভাবে বগামুখপাড়া পর্যন্ত বৈচিত্র্যময় ১৩ কিলোমিটার পাহাড়ী রাস্তা অতিক্রম করতে ১ ঘন্টারও বেশী সময় লেগে গেল। ৯টার দিকে বগামুখপাড়ায় গাড়ি থেকে নামলাম। এবার পায়ে হেঁটে যাত্রা শুরু। ১৫ মিনিট হাটার পর পাহাড়ী সরু ট্রেইলে ঢুকে পড়লাম। প্রকৃতির শোভা দেখতে দেখতে হাটছি। সামনে পিছনে ডানে বামে চারিদিকে শুধু পাহাড় আর পাহাড়। তন্ময় হয়ে সেসব দৃশ্য দেখছি আর বার বার হোচট খাচ্ছি। কিছুক্ষণ পর দেখি সাথীরা অনেকটা সামনে এগিয়ে গিয়েছে। ওদের দেখতে পাচ্ছি না। আঁকাবাঁকা খাড়া ট্রেইলে দৌড় দিয়ে এগিয়ে ওদেরকে ধরার চেষ্টা করলাম। এতেই বাধল বিপত্তি। ওদেরকে নাগালের মধ্যে পেতে পেতে এতটাই হাপ লেগে গেল যে, মাটিতে শুয়ে পড়ার দশা। সবাই মিলে কিছুক্ষণ রেস্ট নিলাম গাছের ছায়ায়। আবার উঠলাম। হাটা শুরু হল। কিন্তু না, পা চলতে চায় না। কিছুদূর এগিয়ে আবার রেস্ট। বুকটা এমন ধড়ফড় করছে যে তার আওয়াজ কানে শুনতে পাচ্ছি। মাহফুযেরও একই দশা। রোদের প্রখর তাপে ঘেমে নেয়ে হাঁস-ফাঁস অবস্থা। সামনের উঁচু পাহাড়টা পার হতে হবে জেনে একদম ভেঙ্গে পড়ার দশা। যাইহোক গাইড সাহস দিল। ঢাল বেয়ে উঠছি আর উঠছি। খানিকটা রেস্ট নেই, আবার এগুতে থাকি। কারো মুখে রা নেই। এভাবে কখন যেন পাহাড়ের মাথায় চলে এসেছি। নাজীব আর কাফী ভাই পাহাড় চূঁড়া থেকে ওপারে নেমে গেছে। আমি সবার পিছনে ভগ্নমনোরথে চূড়ায় উঠছি আর ভাবছি সামনে না জানি কত বড় পাহাড় অপেক্ষা করছে। কষ্টে মুখ ব্যাদান করে চূঁড়ায় উঠে দাড়ালাম। নিচে তাকিয়েই হতবাক। এ কি, আসমানের নীলাকাশ ভূমির বুকে আছড়ে পড়ল কিভাবে? পীতাভ সুউচ্চ পর্বতশ্রেণীর গর্ভে এমন মোহনীয় ঝকঝকে স্বর্গীয় নীল সরোবর? এ দৃশ্য দেখার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। চোখ রগড়ে নিলাম। স্বপ্ন দেখছি না তো। মাহফূয কাছে এসে বলল এটাই তো সেই বগালেক। আমি বাকরুদ্ধ। সেই বিখ্যাত বগা লেক যে এতকাছে, তা তো একবারও বলেনি ঐ গাইড ব্যাটা? পাহাড়ের উপরে স্থানুর মত কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে এই বিপুল সৌন্দর্যরাশিকে প্রাণভরে প্রতিটি নিঃশ্বাসের সাথে গিলতে লাগলাম। তারপর ধীরে ধীরে নেমে এলাম নিচের লোকালয়ে।                    
বগালেক পাড়ায় :
বগালেকের তীর ঘিরে বগালেকপাড়া। দক্ষিণ দিকে খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী ব্যোম পাড়া, উত্তর দিকে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মারমা পাড়া। ব্যোমপাড়ায় পাহাড়ের ঢালের উপর আর্মী ক্যাম্প। ক্যাম্পের ভিতরে মসজিদ আছে। আর্মীরা এখানে জুম‘আর ছালাতও আদায় করে। আমরা সোজা আর্মী ক্যাম্পে ঢুকে বসে পড়লাম। উপস্থিত অফিসারটি খুব আন্তরিকভাবে আমাদেরকে স্বাগত জানালেন এবং প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা দিলেন। নাম-ধাম লিখে তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বগালেকপাড়ায় ঢুকলাম। এ পাড়ায় ২৩টি পরিবার এবং ১৩২ জন অধিবাসী রয়েছে। লেকের অপর পাড়ে মারমা পাড়াতেও অনুরূপ জনসংখ্যা। গাইডের পরিচিত এক দোকানে ঢুকে গ্লাসের পর গ্লাস পানি সাবাড় করলাম আর পাহাড়ী কলা খেয়ে শক্তি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করলাম। কাফী ভাই স্যালাইন ও গ্লুকোজ গুলে সবাইকে দিল। প্রায় আধাঘন্টা রেস্ট নিয়ে একটু চাঙা হলে গাইড তাড়া দিল কেওকারাডং অভিমুখে যাত্রা শুরুর জন্য। ১১টা বেজে গেছে। রওনা হচ্ছি। এ সময় মাহফুয বেঁকে বসল। সে আর যাবেই না। এই লম্বা পথ ট্রেকিং-এর কষ্ট সহ্য করার মত বিন্দুমাত্র শক্তি তার অবশিষ্ট নেই। আগামী দু’দিন সে বগালেকেই থেকে যাবে। তার সিরিয়াস ভঙ্গি দেখে আমি সাফ জানিয়ে দিলাম,  ‘দেখ, আমরা কাউকে ছেড়ে যাওয়ার জন্য আসিনি, তোমাকে অবশ্যই যেতে হবে। প্রয়োজনে আরো ১ ঘন্টা পর যাব। তোমাকে বাঁশের আঁকড়ায় বহন করে হলেও নিয়ে যাব, যদি হাটতে না পার’। ধমক খেয়ে সে অবশেষে নরম হল আর কিছু ছেলেমানুষী শর্ত জুড়ে দিল। সব শর্ত মেনে নেয়ার আশ্বাস দিলাম। ওর জন্য ডবল দামে একটি রাবারের স্যাণ্ডেল কেনা হল। দোকানের সামনে বাঁশের লাঠি দেখে সবাই একটি করে নিলাম। পাহাড়ী অঞ্চল ভ্রমণে নবীশ ট্রেকারদের জন্য এই লাঠির কোন বিকল্প নেই। অথচ আমাদের গাইড কিছুই বলেনি। এজন্যই পিছনের পাহাড়টা অতিক্রম করে আসতে আমাদের এত কষ্ট হয়েছে। খুব রাগ হল গাইডের উপর।        

বাংলাদেশের হিমালয় অভিমুখে : 
বগালেকপাড়ার পূর্বদিকে আকাশছোঁয়া অন্তর হীম করা পাহাড়। ঘন অন্ধকারাচ্ছন্ন জঙ্গলে ছেয়ে আছে। মনে হচ্ছে সামনে গেলেই প্রকাণ্ড আনাকোণ্ডা বা কোন হিংস্র প্রাণী ঘাড়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। ভর দুপুরেও একটানা ঝিঝির কান ঝালাপালা করা চিৎকার। পাখির কলরবও তাতে ঢাকা পড়েছে। ঢুকে পড়লাম বিচিত্র সব লতা-গুল্মে ঢাকা ট্্েরইলে। বর্ষাকালে না আসলে প্রকৃতির এত রূপ বৈচিত্র্য হয়ত দেখা যেত না। শীতকালের ম্যাড়মেড়ে আবহাওয়ার সাথে এখনকার প্রাণবন্ত সবুজ প্রকৃতির কোন তুলনাই হয় না। মনে মনে আল্লাহ্র শুকরিয়া আদায় করলাম। এখনকার ট্রেইলটা আগের মত অতটা খাড়া নয়, বেশ সমতল। তাছাড়া হাতের লাঠিও বেশ উপকার দিচ্ছে। সরু পথ বেয়ে এগিয়ে চলেছি। কখনও ঘন জঙ্গল, কখনো পাহাড়ের একেবারে কিনার ধরে হাটার পথ, যেখান থেকে একেবারে খাড়াভাবে নেমে গেছে গভীর খাদ। নলখাগড়া আর লতা-গুল্মের ঝোপের আড়ালে খাদের গভীরতা তেমন বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু একটু খেয়াল করলে নীচে তাকালেই হৃদকম্প শুরু হয়ে যাচ্ছে। পথে বেশ কয়েকটি ঝর্ণা ও ঝিরি পড়ল। বিরাট বিরাট পাথরের ঢিবি ভেদ করে সেসব ঝর্ণা প্রবাহিত হচ্ছে। অন্ধকারাচ্ছন্ন জঙ্গলে প্রকাণ্ড পাথরগুলো সেখানে এক আধিভৌতিক আবহ তৈরী করে রেখেছে। ভগ্ন মাটির ঢিবিই হয়ত শত শত বছর ধরে ঝর্ণার অব্যাহত স্রোতের তোড়ে কোন এক সময় পাথরে পরিণত হয়েছিল। তারপর কত শত বছরের ইতিহাসের স্বাক্ষী হয়ে যে পাথরগুলো দাঁড়িয়ে আছে তা আল্লাহ্ই মা‘লূম। আজলা ভরে ঝর্ণার শীতল পানি খেলাম। শ্রান্ত পথিকের জন্য এর চেয়ে প্রশান্তিকর বিনোদন আর কিই বা হতে পারে। পথে সবচেয়ে বড় যে ঝর্ণাটি পড়ল তার নাম ‘চিনরি’ ঝর্ণা। গাইড জানালো আসার পথে এই ঝর্ণার উৎসস্থলের দিকে নিয়ে যাবে। প্রায় ঘন্টাখানিক হাটার পর রেস্ট নিলাম কিছুক্ষণ। যে মাহফুয কোন মতেই পাহাড়ে উঠবে না জানিয়ে দিয়েছিল, তাকে এখন দেখছি সবার আগে আগে। ও বলল, ‘তোমার ধমক আমাকে তাতিয়ে দিয়েছে’। আমরা হাসলাম। আবার হাটা শুরু হল। এক নাগাড়ে একের পর এক পাহাড় অতিক্রম করছি। প্রত্যেকের মাঝে বেশ ব্যবধান। কারো মুখে কোন কথা নেই। ট্রেকিং-এর সময় কথা বললে দম ফুরিয়ে আসে। চারিদিকে শত শত পাহাড়ের নির্বাক শোভা আর ঘন জঙ্গলের নৈঃশব্দ্য। কেমন যেন ঘোরের মধ্যে হাঁটছি আর হাঁটছি। আরো ঘন্টাখানিক পার হয়ে গেল। একটা মোড়ের মত জায়গায় এসে আমরা থেমে গেলাম। এখানে রেস্ট নেওয়ার জন্য একটা ছাউনী ঘেরা জায়গা আছে। আমাদের আগেই ১৫/১৬ জনের এই পর্যটক দল ফিরতি পথে এখানে এসে রেস্ট নিচ্ছে। কেওকারাডং হয়ে তারা জাদিপাই ঝর্ণা পর্যন্ত গিয়েছিল। আমাদেরকেও উৎসাহ দিল জাদিপাই যাওয়ার জন্য। ওদের সাথে আরো বেশ খানিকক্ষণ কথাবার্তা হল। তারপর পরস্পর শুভেচ্ছা বিনিময় করে আমরা আবার যার যার পথ ধরলাম। এখানে দাঁড়িয়েই সর্বপ্রথম কেওকারাডং শিখরের দেখা পেলাম। আকাশছোঁয়া কেওকারাডং রেঞ্জের ঢেউ খেলানো পর্বতশ্রেণীর সর্বশেষ ও সর্বোচ্চ শিখরটিই হল আমাদের বহু কাংখিত কেওকারাডং। মেঘের আড়ালে চূড়াটি বার বার হারিয়ে যাচ্ছে। মাঝের বিশাল উন্মুক্ত প্রান্তর জুড়ে এক অসাধারণ ভ্যালি। সেখানে সারি সারি পাহাড়ের উপর লতা-গুল্মের অলংকারে সুসজ্জিত লম্বা লম্বা রেইনট্রির ঘন সবুজ বন আর তার উপরে মেঘ ও রোদের অদ্ভুত খেলা। একদিকে আলোয় ভরা সবুজ তো আরেক দিকে কালো ছায়ার আলেয়া। কি যে অসাধারণ লাগছে ভ্যালিটাকে। চোখ ফেরানো দায়।

বিজয় কেওকারাডং :
চূড়া দেখার পর শরীরে যথেষ্ট শক্তি ফিরে এসেছে। অজানাকে জানার, অদেখাকে দেখার চাপা উচ্ছাসে মনটা উথাল-পাথাল করছে। ঠিক সে সময় বৃষ্টি নেমে এল। রিমঝিম বৃষ্টির শব্দ পাহাড়ের গায়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে শব্দের অপূর্ব ছন্দময় তান তুলছে। শো শো বাতাসে সে শব্দ কান পেতে শুনছি আর ঝংকৃত হচ্ছি। দুপাশ থেকে ভেজা লতা-পাতার অবুঝ ঝাপটা.. দূরের পাহাড়ে মেঘের দলের শান্ত-সমাহিত চলাচল.. আহা! এ পথ যদি শেষ না হত! অভিযাত্রী দলে সবার পিছনে ছিলাম আমি। প্রকৃতিকে আপন করে পেতে গিয়ে আরো পিছিয়ে পড়েছি। পাহাড়ের আড়ালে ওদের দেখা যায় না। নিঃসীম প্রকৃতির কোলে কেবল আমি আর আমি। নির্জনতার সবটুকু উপভোগ করছি একান্তই নিজের মত করে। হঠাৎ মনে হল কোথাও কেউ নেই। অজানা শিহরণে আৎকে উঠে দৌড় দিলাম। অবশেষে সহযাত্রীদের নাগাল যখন পেলাম তখন তারা দার্জিলিংপাড়ায় ঢুকছে। কেওকারাডং থেকে কয়েকশ গজ নিচে এই গ্রামের অবস্থান। বেশ শিক্ষিত মনে হল প্রায় শ’খানিক অধিবাসীর এই ছোট্ট গ্রামটি। আশে পাশের পাহাড়গুলো সব মেঘে ঢেকে গেছে। বৃষ্টি তখনও কমেনি। সেখানকার একমাত্র দোকানটিতে বসে চা খেলাম। তারপর বৃষ্টির মধ্যেই আবার রওয়ানা হলাম। আর বেশী পথ বাকি নেই। জোরে জোরে পা চালাচ্ছি। বৃষ্টিভেজা আবহাওয়ায় ক্লান্তির রেশ অনেকটা ধুয়ে গেছে। চূড়ার প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছি কিন্তু নাগাল পাই না। অবশেষে এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ছোটকাল থেকে বইয়ের পাতায় দেখে আসা সেই কেওকারাডংশীর্ষ উদ্ধতভাবে দণ্ডায়মান চোখের সামনে। পায়ে পায়ে উঠে এলাম বাংলাদেশের হিমালয়ের শীর্ষ চূড়ায়। হৃদয়জুড়ে খেলা করছে এভারেস্ট জয়ের অনুভূতি। শুণ্যের পানে মুষ্টিবদ্ধ হাত উচিয়ে কাজী নজরুলের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে ইচ্ছে হলÑ ‘আমি চির বিদ্রোহী বীর, বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা, চীর উন্নত শীর’। ঘন মেঘের উড়াউড়ি চূড়ার উপর। কুয়াশার মত বহমান ধোয়াশা আর ভেজা নিঃশ্বাস-এই হল মেঘ। হাতের কাছে পেলে অবাধ্য মেঘের দলকে ছুয়ে চেপে ধরার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু মেঘের রাজ্যে ঢুকে বোঝা গেল-এ কোন ধরার বস্তু নয়, কেবলই অনুভবের। ঘড়িতে তখন বেলা ৩টা বেজে পার হয়ে গেছে।
লালা বাবুর রেস্ট হাউজে :
চূড়ায় উঠে দেখি বেশ এলাহী কারবারই। এই এলাকা এখন সরকারী বনবিভাগের নয়, বরং ব্যক্তিমালিকানায় লীজ দেয়া হয়েছে। ব্যোম উপজাতিভুক্ত লাল মুন থন লালা পরিবারের মালিকানাধীন এই কেওকারাডং পাহাড়সহ পার্শ্ববর্তী  পাহাড়সমূহ। লালা সাহেবের বাবা এই বিশাল ভূ-সম্পত্তির মালিক হয়েছিলেন। তার নাকি কেবল পাহাড়ী গয়ালই ছিল ২/৩ হাজার। এখন সেই জাঁকজমক আর নেই। তবে ভূ-সম্পত্তিগুলো এখনও এই পরিবারের আয়ত্বে আছে। লালা সাহেব, তার স্ত্রী, পুত্র ও পুত্রবধু আর ১ বছর বয়সী চমৎকার এক নাতিÑএই ক’জন মিলেই পরিবারটি। কেওকারাডং চূড়া পর্যন্ত সরকারীভাবে যে সিঁড়িটি করা হয়েছে তার গোড়াতেই একটা দোতালা কাঠের বাড়িতে তাদের বাস। মাত্র মাসতিনেক পূর্বে ৩টি কাঠের কটেজ নির্মাণ করে লালা বাবু হোটেল ব্যবসা শুরু করেন। নামটাও দিয়েছেন বেশ গালভারিÑ‘কেওকারাডং মোটেল কমপ্লেক্স’। প্রতিটি কটেজে ১২ জন থাকতে পারে। দূরের কোন ঝিরিতে পাইপ বসিয়ে মেশিন দিয়ে সরাসরি পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাড়ির সামনে রাখা বিশাল গাজী ট্যাংক। লালা বাবুর স্ত্রী আমাদেরকে গোসলের আমন্ত্রণ জানিয়ে বললেন, ‘বাড়িতে যেয়ে গল্প করবেন কেওকারাডং-এ গোসল করেছি’। আমাদের অবশ্য তখন দীর্ঘ পথ হেটে ক্ষুধায় পেট চো চো করছে। গোসল না করে কোনমতে হাত-পা ধুয়েই খাওয়ার টেবিলে বসে পড়লাম। মেন্যু ডিম, সব্জি আর ডাল। গোগ্রাসে খেয়ে ফেললাম যদিও রান্না তেমন সুস্বাদু মনে হয়নি।
জোঁকের জোকারি :
খাওয়া শেষে চা পান করছি। হঠাৎ পায়ের পাতার উপর নরম কিছু পড়ল। তাকিয়ে দেখি ছোট্ট একটা সরিসৃপ। ফুলে ঢ্যাবঢেবে হয়ে আছে। সামনেই বসা ছিল গাইড। জোঁক, জোঁক বলে চেচিয়ে উঠে বলল, ইয়া আল্লাহ! এতবড় জোঁক আমি কখনও দেখিনি। আমি বেশ মজাই পেলাম জোঁকটি দেখে। ভাবছি ভাগ্য ভাল, সময় মত চোখে পড়েছে, নতুবা এত বড় জোঁক কামড়ালে কি বিপদেই না পড়তাম। ভ্রমণ কাহিনীগুলোতে জোঁক থেকে সতর্ক হওয়ার কথা অনেকবার পড়েছি। গাইড লবন নিয়ে এসে জোঁকটি মারতে বসল। সবাই সে দৃশ্য দেখছে। এ সময় নাজীব বলল, তোমার পায়ে কোথাও কামড়ালো না তো! আমি পাজামা একটু উচু করতেই দেখি রক্তের লম্বা স্রোত। ব্যাথার লেশমাত্র নেই, অথচ এত রক্ত! আঁৎকে উঠলাম। গাইড বাইরে থেকে দূর্বাঘাস এনে চিবিয়ে পায়ে লাগিয়ে দিল। কিন্তু মিনিট দশেক ধরে থাকার পরও রক্ত বন্ধ হয় না। এ অবস্থাতেই উপরে উঠে আমাদের জন্য নির্ধারিত কটেজের ব্যালকনিতে  বসে পড়লাম। মাহফুয ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিল। তাতেও কোন কাজ হল না। অবশেষে গামছা দিয়ে শক্ত করে পা বেঁধে বসে রইলাম। জোঁকের কামড় খাওয়ার অভিজ্ঞতা আমার ছিল না। এমন কি তার আকার-আকৃতিও মনে নেই। আর আমাকে দিয়েই শুরু হল জোঁকের জোকারি। পরে জানলাম সাধারণত ক্ষত থেকে এত রক্ত বের হয় না, অনেকক্ষণ কামড়ে ধরে রাখার ফলেই রক্তের প্রবাহ এত বেশী। আশ্চর্যের বিষয় হল প্রাণীটিকে আল্লাহ এমনভাবে সৃষ্টি করেছেন যে, এরা শরীরে কেবল ধমনীর উপরই ছিদ্র করে এবং শিকারকে কিছু বুঝতে না দিয়ে নীরবে রক্ত শুষে নেয়। এদের মুখে এমন এক লালা নিঃসরিত হয় যার ফলে রক্ত জমাট বাধতে চায় না, আবার ক্ষতস্থানে কোন ব্যথাও করে না।   
সুন্দরের রাজ্যে জীবন গদ্যময় :
বেলকনীতে বসে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ চূঁড়া থেকে নীচের পৃথিবী দেখছি। এখানকার পৃথিবীর সীমানা অনেক সুবি¯তৃত। বেলকনি থেকে উত্তর দিকটা পাহাড়ের এ মাথা ও মাথা পেরিয়ে বহুদূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। সদ্য বৃষ্টিøাত অবারিত পৃথিবী। যতদূর চোখ যায় কেবল সবুজে সবুজে অপরূপ পাহাড়ের সারি। পেজা তুলার মত শুভ্র মেঘের ভেলা সেসব পাহাড়ের কোলে পরম আদরে আশ্রয় পেতেছে। হঠাৎ রংধনুর আলোড়নে হেসে উঠল মেঘলা পূবাকাশে। সবমিলিয়ে প্রকৃতি কি যে এক মনোহর ঐন্দ্রজাল তৈরী করেছে এই পড়ন্ত বিকেলে, তার খবর প্রকৃতি নিজেও বুঝি রাখে না। ‘সুন্দরে সুন্দরে দেয় পাল্লা, জানি না কত সুন্দর তুমি আল্লাহ’Ñগানের কলিটি বাস্তবিকই আজ হাজির হয়েছে কেওকারাডং চূড়ায় আমাদের স্বাগত জানাতে। চোখ ধাঁধিয়ে আসে ভয়ংকর সে সৌন্দর্যে। মাগরিবের পূর্বে লম্বা সিঁড়ি বেয়ে আবার উঠলাম সর্বোচ্চ চূড়ার উপর যেখানে সেনাবাহিনী ফলক বসিয়েছে ১৯৯৩ সালে। পাশেই পাকা ছাউনী ঘেরা বসার জায়গা। ঝড়ো বাতাস আর মেঘের প্রবল আনাগোনার মধ্যে সেখানে বসে অনেকক্ষণ গল্পগুজব করলাম। দূরের কিছুই দেখা যাচ্ছে না মেঘের ধোয়াশায়। তুষার ঝড়ের মত আবহাওয়া। সূর্যাস্তের স্থানটিও ঠাওর করার উপায় নেই। ঘড়ি দেখে মাগরিবের সময় অনুমান করে কাফী ভাইকে বললাম আযান দিতে। ইথারে ভেসে ভেসে সে আযানের ধ্বনি বুঝি বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ল। আযান দিয়ে খুশীতে উজ্জ্বল কাফী ভাইয়ের চেহারা। উনার প্রবল বিশ্বাস কেওকারাডং চূড়ায় উনিই হলেন প্রথম এবং একমাত্র আযানদাতা। আমরাও সোৎসাহে সায় দিলাম। হতেও তো পারে…।

বাদ মাগরিব কিছুক্ষণ রেস্ট নিলাম। চারিদিকে শুনশান নীরবতা। পর্যটন মৌসুম নয় বলে পর্যটক বলতে আমরা ৪জনই। নতুবা এত নিরিবিলি থাকার সৌভাগ্য হত না। কাঠের ঘরে টিমটিমে প্রদীপের আলোয় এক ভিন্ন আমেজ অনুভব করছি। মাঝে মাঝেই স্বপ্নের মত মনে হচ্ছে পৃথিবী ছেড়ে বোধ হয় কোন এক অজানা গ্রহে আছি। রাতের খাবারের ডাক এল। লালা বাবুর ডাইনিং রুমে মুরগীর গোশত দিয়ে ভাত পরিবেশন করা হয়েছে। মাগরিবের পূর্বে নাজীব ও কাফী ভাইয়ের যৌথ প্রচেষ্টা জবাই করা হয়েছিল বিরাট পাহাড়ী মুরগীটি। রান্না যথারীতি সুস্বাদু মনে হল না। খাওয়া-দাওয়া সেরে লালা বাবুর টেলিটক নাম্বার থেকে বাসায় কথা বললাম। এখানে কেবল টেলিটকেরই নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়। ঘুমাতে যাওয়ার আগে সিঁড়ি বেয়ে চূড়ায় উঠলাম চন্দ্রকরোজ্জ্বল নিশুতি রাতের শোভা উপভোগ করার লোভে। কিন্তু ভাগ্য খারাপ। মেঘে ঢাকা আকাশ। চাঁদ নেই। নিশ্চিদ্র আঁধার জমে আছে পাহাড়ের রাজ্য। বহু দূরে রুমা বাজারের আর্মী গ্যারিসনের হাজারো লাইটের ফুটফুটি দেখা যাচ্ছে। অপরদিকে মিয়ানমার বর্ডারে বিজিবি ক্যাম্পের টিমটিমে আলো। এছাড়া কোথাও কোন আলোর কোন চিহ্ন নেই। পরিবেশটা জমল না। কিছুক্ষণ পর নাজীবরা নীচে নেমে ঘুমাতে গেল। আমি আর মাহফুয রয়ে গেলাম। গল্প করতে করতে আরও ঘন্টাখানিক পার হয়ে গেল। ইতিমধ্যে আকাশ প্রায় পরিষ্কার হয়ে চাঁদের আভাস মিলেছে। মৃদু আলোয় ইতিমধ্যে নিচের পাহাড়গুলো স্বচ্ছ হয়ে উঠছে। খাঁজে খাঁজে আটকে থাকা দুগ্ধ ফেনিল শুভ্র মেঘের সাথে চাঁদের মধুর মিতালীতে পৃথিবীটা তখন এক পরাবাস্তব সপ্নিল জগৎ হয়ে উঠল। সুবহানাল্লাহি ওয়াবিহামদিহি সুবহানাল্লাহিল আযীম! আহ, সাদা ভূষণে মোড়া এই স্বর্গ দেখার লোভেই তো এতক্ষণ জেগে থাকা! প্রকৃতির এই নির্বাক রূপরহস্য ভেদ করার জন্য এই মধ্যরাতে আমরা দুটি প্রাণী ছাড়া কেওকারাডং জুড়ে আর কেউ নেই। সুদূর থেকে ভেসে আসা শিকারে বের হওয়া কোন শিয়াল বা হুতুমের পিলে চমকানো হুংকারও কানে আসে না। কেবলই নিঝ্ঝুম স্তব্ধতা। পলে পলে সময় বয়ে যাচ্ছে। চাঁদের আলো গলে গলে পড়ছে পাহাড় বেয়ে অনেক নিচে, মেঘ সমুদ্রে। তন্ময় আমরা অভিভূত। একসময় ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি ১২টা বাজতে চলেছে। নাহ, এবার ঘরে যেতে হবে, নয়তো শুক্লাপক্ষের আধফালি চাঁদের আকর্ণ বি¯তৃত নরম হাসিতে বিমুগ্ধ এই মন মাতাল করা রাত যে কতক্ষণ নির্ঘুম আটকে রাখবে কেওকারাডং শীর্ষে, তা কে জানে! ঘরে ফিরে দুটো কম্বল গায়ে টেনে ঘুমিয়ে পড়লাম ক্লান্ত শরীরে।

জাদিপাই ক্লাসিক

২৫ সেপ্টেম্বর’১২ মঙ্গলবার। ঘুম থেকে উঠে দেখি সমস্ত শরীর ব্যথায় টনটন করছে। জোঁকে কামড়ানো স্থানটি থেকে সমানে রক্ত ঝরছে তখনও। ক্ষতের উপর নতুন টিস্যু পেপার বেঁধে দিলাম। মনে ভয় ঢুকে গেলেও কাউকে কিছু বললাম না। নইলে জাদিপাই ঝর্ণা দেখার পরিকল্পনা মাঠে মারা যেতে পারে। ফজরের ছালাত শেষে আবার কেওকারাডং শিখরে উঠলাম সূর্যোদয় দেখতে। শান্ত স্নিগ্ধ ভোর। রাতের আঁধার ফুঁড়ে ভোরের আলো কেবল ফুটতে শুরু করেছে। খন্ড খন্ড মেঘে ঢাকা আকাশ। সূর্য উঠার আগ মুহূর্তে পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে আশ্রয় নেয়া ভাসমান মেঘমালা যেন আক্ষরিক অর্থেই দুগ্ধ ফেনিল সাগর হয়ে দেখা দিল। মনে হচ্ছে এন্টার্কটিকার কোন এক দ্বীপে দাঁড়িয়ে আছি। কেবল পেঙ্গুইনের অপেক্ষা। এরই মাঝে রক্তিম আবেশে সূর্যিমামার শুভাগমন। কাচা রোদের মিষ্টি আলোয় পাহাড়ী ভুবনটা ভরে উঠল আর মেঘদলের শুভ্র বসনে প্রতিফলিত হতে লাগল বর্ণিল আলোকচ্ছটার এক অপূর্ব নাচন। কি যে এক মন্ত্রমুগ্ধকর ভোর! নীচ থেকে গাইডের ডাকে সম্বিত ফিরল। সকাল সকালই বের হতে হবে জাদিপাই ঝর্ণার উদ্দেশ্যে।

সাথে আনা বিস্কুট, পানি খেয়ে নাস্তা সারলাম। সাড়ে ৬টার দিকে যাত্রা শুরু হল। উত্তরমুখী রাস্তা দিয়ে যেতে হবে। ২ ঘণ্টার পথ। গাইড বলল, ‘সামনের পথ কিন্তু শুধুই নামার, সাবধানে আসেন’। আরে আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্নকে জয় করে শেষ করলাম এখন নীচে নামার সহজতম কাজে সাবধান হতে হবে? কি যে বলে লোকটা-মনে মনে হাসলাম। পথের দু’ধারে কুয়াশার মত মেঘে ঘেরা সারি সারি পাহাড়। ক্যাসকেডের মত ধাপে ধাপে নেমে গেছে কোন কোন স্থানে। এরই মাঝে খানিকক্ষণ হাটার পর শুরু হল বিরতিহীনভাবে নেমে যাওয়া ঢালু রাস্তা। বেশ রিলাক্সেই হাটছি। মাঝে মাঝে নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিয়ে নামছি দৌড়ের গতিতে। আধাঘণ্টার মধ্যে পৌঁছলাম পাসিংপাড়া বা সাইকতপাড়া। আগেই জেনেছিলাম দেশের সর্বোচ্চ গ্রাম এই পাসিংপাড়া। সেখানে লোকালয় ছুঁয়ে ফিরফিরে মেঘ উড়ে বেড়াচ্ছে নির্বিঘ্নে। দারুণ দৃশ্যপট। আড়ামোড়া ভাঙ্গা পাহাড়ী সকালে সদ্য তেতে ওঠা কাঁচা রোদের দুরন্ত খেলা বেশ জমে উঠেছে। কিন্তু গ্রামবাসীদের সকাল হয়নি তখনও। কেবল দু’একটি ঘরের জানালা দিয়ে ব্যোম শিশুদের উকিঝুঁকি নজরে পড়ছে। গ্রামের পথে শূকরের মলের ছড়াছড়ি বেশ বিরক্তিকর ঠেকল।

পাসিংপাড়া ছেড়ে আর কিছু দূর গেলেই কোরিয়ান অর্থায়নে পরিচালিত কানান রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলটির অবস্থান। পাহাড়ের উপর খেলার মাঠ আর তার এক প্রান্তে ‘এল’ শেপের এই স্কুলটি। ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত ক্লাস হয়। স্কুল থেকে কিছুটা নীচের এক পাহাড়ে ছাত্র-ছাত্রীদের আবাসন ব্যবস্থা। প্রায় ৬০-৭০ জন ছাত্র-ছাত্রী এখানে লেখাপড়া করে। সকলেই পাহাড়ী উপজাতি এবং অধিকাংশই আবাসিক। বাংলা মাধ্যমেই পড়ানো হয়। পড়াশোনার মানও যথেষ্ট উন্নত। ইউনিফর্ম দেখেই বোঝা যাচ্ছে এদের পিছনে ভাল রকম অর্থ ব্যয় করা হয়। চারিদিকে পাহাড় পরিবেষ্টিত স্নিগ্ধ প্রকৃতির কোলে শুনশান স্কুলটি দেখে মনে হল দার্জিলিং-এর সেই বিখ্যাত স্কুলটির কথা। যেখানে বহু অর্থ খরচ করে এ দেশের অর্থশালীরা তাদের   সন্তানদের পড়াশোনা করাচ্ছেন। বাংলাদেশ সরকারও ইচ্ছা করলে এই মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশকে ব্যবহার করে অনুরূপ উন্নতমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারত। ওখানকার শিক্ষকদের সাথে কথা হল। অধিকাংশেরই বয়স ২৫-এর নীচে এবং বাঙ্গালী। জেনে অবাক হলাম এই কোরিয়ান স্কুলের প্রধান শাখাটি দিনাজপুরে অবস্থিত। ছাত্র-ছাত্রীরা এখান থেকে পাশ করে সুদূর দিনাজপুরে যায় বাকী পড়াশোনা সম্পন্ন করার জন্য।

স্কুলটি পরিদর্শনের পর আবার ঢালু পথ বেয়ে নামতে শুরু করলাম। দুর্গম পাহাড়ী অঞ্চলগুলো প্রায় জনমানবশূন্য মনে হলেও চলতি পথে বহু পাহাড়ে চাষাবাদ হতে দেখছি। বিশেষ করে শৈল্পিক আর্টে বোনা আদা, হলুদ ও আনারসের গাছ পাহাড়ের ঢালগুলো চমৎকারভাবে শোভামন্ডিত করে রেখেছে। কেওকারাডং-এর চূড়াতেই তো দেখে আসলাম শীষে ভরা ধানের চারা। আজ এই দুর্গম এলাকাতেও দেখছি দূরের পাহাড়ের শীর্ষভাগে আদা ও হলুদ চারার সমাবেশ।     

এদিকে নামার পথ যে আর ফুরোয় না। খাড়াভাবে নামছি তো নামছিই। এক পর্যায়ে এত ক্লান্ত হয়ে পড়লাম যে মাহফুয বিশ্লেষণ করতে বসল পর্বতারোহণ নাকি অবরোহন-কোনটা বেশী কঠিন? ঘণ্টা পার হয়ে গেল তবুও যখন নামার পথ শেষ হল না মাহফূযের তখন রীতিমত কেঁদে ফেলার দশা। আর্তনাদের সুরে বলে উঠল, ‘এখন তো নামছি কোন রকমে, ফেরার পথে উঠব কীভাবে?’ লাঠিতে ভর দিয়ে পা টিপে টিপে হাটছি। তীব্র ব্যথায় পা জমে আসছে। হাটার চেয়ে তাই এখন মনে হচ্ছে দৌড়ানোই সহজ। একবার দৌড়ে, একবার হেটে এই কষ্টকর যাত্রার প্রায় শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেলাম। সামনেই দেখা যাচ্ছে পাহাড়ী ঢালের সবুজ পটভূমিতে ছবির মত সাজানো গ্রাম জাদিপাই পাড়া। সেখানে নেমে আসার পর কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে আবার যাত্রা। গোটা রাস্তায় পর্যটক বলতে কেবল আমরাই। আর কেউ নেই। ঝিঁঝিঁ ছাড়াও নাম না জানা কোন এক পোকার বাঁশীর মত তীক্ষ্ণ চিৎকারে কান ঝালাপালা হয়ে আসছে। চলতি পাথে মাঝে মাঝে দেখা মিলছে দু’এক জন পাহাড়ী জুম চাষীর। সবার সাথেই শুভেচ্ছা বিনিময় করছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই পাহাড়ী পথ ছেড়ে নেমে আসলাম এক সমতলভূমিতে। চারিদিকে শিহরণ জাগানো জমাট মৌনতায় ঢাকা সুউচ্চ পাহাড়। আর মাঝখানে ধানের ক্ষেত আর নিঃশব্দে বয়ে যাওয়া ঝর্ণার পানির ঝিরি। ক্ষেতের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলছি। আগের দিন বৃষ্টি হয়েছে বলে জোঁকের উৎপাত খুব। গতকাল আমাকে জোঁকে ধরায় এমনিতেই সবাই জোকাতঙ্কে ভুগছে, তার উপর সমতলে নামতেই আমি একসাথে ৩টি জোঁকের কামড় খেলাম। চারিদিকের অসাধারণ নৈসর্গিক শোভা উপভোগ বাদ দিয়ে সবার দৃষ্টি এবার কেবল জোঁকের দিকে। কর্দমাক্ত পথে হাটতে ২ মিনিট পর পর জোঁক ছাড়ানোর জন্য দাঁড়িয়ে যেত হচ্ছে। মনে হল জোঁকের কারখানায় এসে পড়েছি। এমনই জড়সড় অবস্থা আমাদের যে বাঘ-ভাল্লুকের ভয়েও বুঝি কেউ এত অস্থির হয় না। আরো কিছুক্ষণ চলার পর এক পাহাড়ের উপর উঠে আসলাম।

নিঃসঙ্গ ঝর্ণার সশব্দ আবির্ভাব

সমতলে নামার পর অনেকক্ষণ ধরেই ঝরণার শো শো পতন শব্দ কানে ভেসে আসছিল। এবার পাহাড়ে উঠে সে শব্দ ঝংকার অনেক জোরে শুনতে পাচ্ছি। গাইড বলল, ঝরণা পর্যন্ত পৌছতে পাহাড় থেকে এই বিপজ্জনক পথটি নেমে অতিক্রম করতে হবে। প্রায় খাড়াভাবে ৪৫ ডিগ্রি এঙ্গেলে পিচ্ছিল কর্দমাক্ত জঙ্গলময় ঢালু পথ। সঙ্গে জোঁকের আতঙ্ক। গাইডকে সামনে রেখে ধীরে ধীরে অধঃমুখী যাত্রা শুরু হল। খুব সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে। পিছন থেকে কেউ স্লিপ করে পড়লেই সবাই মিলে একসাথে জীবন হারাতে হবে। নীচে কিছুই দেখা যাচ্ছে না ঘন জঙ্গলের কারণে। কেবল ঝর্ণার শো শো প্রবল শব্দ। জোঁকের ভয়ে সযত্নে গাছের ডালপালা এড়িয়ে চলছি। তবুও রেহাই পেলাম না। আমার ঘাড়ে আর কনুইয়ের উপর বড় দুই জোঁক উঠে রক্ত খাওয়া শুরু করেছে। নিজেকে পতনের হাত থেকে বাঁচাব, না জোঁক ছাড়াব। মাহফুয এসে গামছা দিয়ে জোঁকগুলো ছাড়িয়ে দিল। আরো কিছুদূর নামার পর এক বিপজ্জনক বাঁকের উপর আছাড় খেয়ে পড়ে গেল মাহফুয। ভাগ্যক্রমে এক গাছের ডালে পা আটকাতে পেরে এ যাত্রায় বেঁচে গেল বটে, কিন্তু বেশ ভাল রকম আঘাত পেল। আরো অনেকদূর নামার পর হঠাৎ গাছপালার ফাঁক দিয়ে আবির্ভূত হল সেই কাংখিত জাদিপাই ঝর্ণা। পাশের পাহাড় ভেদ করে যেন আকাশ ফুঁড়ে ধেয়ে আসছে এক প্রবল স্রো্তধারা। উপরাংশে একধাপ নেমে ঝরণাটি প্রায় ৫০ ফুট প্রশস্ত হয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে অন্ততঃ ৬০/৭০ ফুট নিচে সবেগে আছড়ে পড়ছে। আরো কিছুটা নেমে আসার পর ঝর্ণার পূর্ণ ভিউটা নজরে এল। সুবহানাল্লাহ! কি যে এক বিস্তীর্ণ ভুবনজয়ী হাসি দিয়ে আমাদের স্বাগত জানাল আল্লাহর এই অসাধারণ সৃষ্টি! আমাদের তো আত্মহারা অবস্থা। চারিপাশ নজরে আসার পর মনে হল বহু বছর পূর্বে এখানে কোন এক দানবীয় ভূমিধ্বস হয়েছিল এবং তাতে পাহাড়ের একটা বিরাট অংশ বিধ্বস্ত হয়ে এই ঝর্ণার সৃষ্টি। ধ্বসে যাওয়া মাটির ঢিবি বিস্রস্তভাবে নিচে বহু দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বিশাল বিশাল পাথরে রূপ নিয়েছে। যার ফাঁক গলিয়ে স্বর্পিল গতিতে অব্যাহত স্রোতধারা হারিয়ে যাচ্ছে অজানার পানে। পাহাড়ের গায়ে ভূমিধ্বসের গভীর চিহ্নগুলো বেশ ভয়ংকর দেখাচ্ছে। যেন ডকুমেণ্টারীতে দেখা সহস্র বছরের অনাবিষ্কৃত কোন প্রাগৈতিহাসিক এলাকা। পাহাড়ের উপরে দাঁড়িয়েই বিভিন্ন এ্যাঙ্গেল থেকে ঝর্ণাটি ক্যামেরাবন্দী করে ফেললাম। দুর্গম হওয়ার কারণে এর নাগাল পেয়েছে দেশের খুব অল্পসংখ্যক মানুষই। ফলে ঝর্ণার আদিম অকৃত্রিমতা অক্ষুণ্ণ রয়ে গেছে। আজও এখানে আমরা ছাড়া আর দ্বিতীয়টি কেউ নেই। এডভেঞ্চার মুডে কাঁপা কাঁপা হৃদয়ে নীচে নেমে এলাম। এক দৃষ্টে দেখছি ঝর্ণার অবিরাম পতন দৃশ্য। বর্ষা মৌসুম শেষ হলেও ঝর্ণাটি এখনও পূর্ণ যৌবনা। আহা, জীবনটা যেন আজ স্বার্থক হয়ে গেল। এক নিমিষেই বুকটা বিশাল চওড়া করে দিল প্রকৃতির এই অকৃত্রিম বুনো উদ্যমতা। প্রতিধ্বনিত শব্দের প্রচন্ডতায় কেউ কারো কথা শুনতে পাচ্ছি না। বাতাসে ঝর্ণার ঝাপটা এসে চোখে-মুখে লাগছে! সে ঝাপটা রোধ করে ঝর্ণার দিকে সরাসরি স্থির চোখে তাকানো দুরূহ। সূর্যের আলো ঝর্ণার গায়ে পড়া মাত্রই নানা মাত্রায় বর্ণিল রংধনু হেসে উঠছে। মেঘমুক্ত দিনে এখানে সারাদিনই রংধনুর খেলা দেখা যায়। ঝর্ণার পতনস্থলে তৈরী হয়েছে এক পুকুর। সাতার জানি না। তাই পার্শ্বের বড় বড় কয়েকটি পাথর ডিঙিয়ে ঝর্ণার একেবারে নিকটে চলে এলাম। গাইড ভয় দেখিয়ে বলল, ‘ঝর্ণার নীচে যাবেন না, উপর থেকে নুড়িপাথর পড়তে পারে’। কে শোনে কার কথা। আক্ষরিক অর্থেই পর্বতসম বাধা জয় করে যখন এতপথ আসতে পেরেছি, শেষ বেলায় এতটুকু বাধা কেন অজেয় হয়ে উঠবে? নাই বা জানি সাতার, তাই বলে কি এই অপরূপ সৌন্দর্যকে নিজের মত করে উপভোগ করার স্বাদ অপূর্ণ রাখব? ঝর্ণার গা ঘেঁসে এক পা দু’পা করে নিজেকে সপে দিলাম অনেক উপর থেকে ধেয়ে আসা প্রবল জলধারার নীচে। পিঠের উপর যেন হাতুড়ির বাড়ি পড়ছে। তবুও কুছ পরোয়া নেহি। ভয়কে জয় করে বীর বেশে আরো সামনে এগুচ্ছি। বাকিরাও সাহস পেয়ে গেল। একে একে সবাই চলে এল ঝর্ণার নিচে। রঙধনু মেখে ঝুকিপূর্ণ পাথরের গা বেয়ে আমরা ঝর্ণাধারার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত চলে এলাম। মাথার উপর অবিরাম ঝাঁপিয়ে পড়া জলধারায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসছে, তবুও তাতে সিক্ত হচ্ছি বাধ না মানা অবোধ শিশুর মত। ঘণ্টাখানিক অনিন্দ্য সুন্দর এই ঝর্ণার কলকাকলীর সাথে কাটল এক অসাধারণ মুহূর্ত। শেষের বেলায় ঝর্ণার স্রো্তধারা যেদিক দিয়ে নিচে নেমে গেছে সেদিকে এগিয়ে কিছু দূর যাওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু সাহসে কুলালো না। এই নির্জনালোকের সর্বত্রই এক অদ্ভুত গা ছমছমে আবহ। একান্ত সাহসীও এখানে বীরত্ব দেখাতে দু’বার ভাববে।

দুর্বিষহ যন্ত্রণায় ওষ্ঠাগত জীবন

বেলা সাড়ে ৯টার দিকে জাদিপাই ঝর্ণাকে গহীন বনে একলা নিঃসঙ্গ রেখে আমাদের ফিরতি যাত্রা শুরু হল। আসার সময় সারা পথ নামতে নামতে মনটা বিষিয়ে ছিল। এবার উঠতি যাত্রায় তাই বেশ স্বস্তি বোধ করছি। তেমন বিপদ ছাড়াই উঠে এলাম পাহাড়ের মাথায়। সেখান থেকে নীচে নেমে আসতেই আবার সেই জোঁকের রাজ্যে। সমতল ভূমি না আসা পর্যন্ত জোঁকের ভয়ে একটানা দৌড়ে এই পথটুক অতিক্রম করলাম। কিছুক্ষণ পরই শুরু হল পাহাড়ে উঠার পালা। আসার সময় যে পথ বেয়ে বরাবর নেমে এসেছিলাম এবার সে পথে বরাবর উঠার পালা। গোটা সফরে এই অংশটিই ছিল আমাদের সবচেয়ে কষ্টকর পর্ব। সকালের সামান্য নাস্তাটুকু বহু আগেই হজম হয়ে গেছে। অতিরিক্ত কোন খাবার সাথে নিয়ে আসিনি। এ অবস্থায় উঠছি তো উঠছিই। শক্তি ক্রমেই নিঃশেষ হয়ে আসছে। আধাঘণ্টা হাঁটতেই সবার অবস্থা একেবারে কাহিল। কারো দিকে আর তাকানো যাচ্ছে না। বাংলা পাঁচের মত হয়ে উঠা করুণ চেহারাগুলোতে যেন গুমরে ফিরছে ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ হাহাকার রব। সেই সাথে সারা রাস্তায় শূকরের মলের উৎকট দূর্গন্ধে প্রাণটা ওষ্ঠাগত হওয়ার জোগাড়। কোনক্রমে জাদিপাই পাড়া পর্যন্ত পৌঁছতেই এক বাড়ীর উঠোনে মাটির বিছানায় শুয়ে পড়লাম। মনে হল সামনে আর না এগিয়ে আজকের দিনটা এখানেই থেকে যাই। এদিকে গতকালের ক্ষত থেকে রক্ত তখনও অনবরত ঝরছে। বন্ধ হওয়ার কোন লক্ষণ নেই। ব্যান্ডেজ আর পাজামা লালে লাল। গাইডের একটাই কথা, ধৈর্য ধরেন, জোঁকের কামড়ে এমনই হয়, এক সময় এমনিতেই বন্ধ হয়ে যাবে। যে বাড়ীর উঠোনে বসে চা পান করছিলাম, তাদেরকে বললাম আপনারা কি করেন জোঁকে কামড়ালে? ওরা প্রথমে তামাক পাতার পানি দিয়ে ধুতে বলল। তাই করলাম। কোন কাজ হল না। পরে ভিতর থেকে ছাই নিয়ে এসে এক মহিলা ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দিল। আল্লাহর কি রহমত, ২ মিনিটেই রক্ত বন্ধ হয়ে গেল। সবকিছুকে হারিয়ে দিয়ে শেষ পর্যন্ত এই তুচ্ছ ছাই যে মহৌষধ হয়ে উঠবে তা কে জানত! মনে মনে আল্লাহর অশেষ শুকরিয়া আদায় করে ওদেরকে ধন্যবাদ জানালাম। এই উপকারটা না করলে আগামীকাল রুমা বাজার পৌছে ডাক্তার না দেখানো পর্যন্ত হয়তবা রক্ত ঝরতেই থাকত। জোঁকের জন্য সবাই উপদেশ দেয় লবণ রাখার জন্য। এই অভিজ্ঞতার পর আমার তো মনে হল লবণের চেয়ে ছাই রাখাই অধিক যরূরী। কৃতজ্ঞতাস্বরূপ বাড়ির বাচ্চাদের হাতে চকলেট ধরিয়ে দিলাম। ওরা এতই খুশী হল যে, মনে হল পরবর্তীতে আর কখনো এদিকে এলে চকলেটের আলাদা ব্যাগ নিয়ে আসতে হবে। দুর্গম পাহাড়ে এসব ছোট্ট উপহারও এদের কাছে মহার্ঘ্যই। ব্যোম পরিবারটিকে বিদায় জানিয়ে আমরা আবার যাত্রা শুরু করলাম।

উফ্..কি বিভীষিকাময় এ যাত্রা। হাটার কোনই বিকল্প নেই। ক্লান্তিতে রাস্তার উপরই কয়েকবার শুয়ে পড়তে বাধ্য হলাম আমরা। মাহফুয বলল, ‘জীবনের কোন কোন সময় মৃত্যুকেই অধিক শ্রেয় মনে হয়, আজ আমার সেই অবস্থা’। পা লোহার মত ওজনদার হয়ে উঠেছে। চোখে দেখছি সর্ষে ফুল। এ অবস্থাতেই কোন রকমে হাচড়ে পাচড়ে যখন কোরিয়ান স্কুলে পৌঁছলাম তখন বেলা সাড়ে এগারোটা পার হয়ে গেছে। দোকানের সামনে বেঞ্চের উপর সটান শুয়ে পড়লাম অচেতনের মত। ‘এই তো আর সামান্য পথ’-গাইডের অভয়বাণী বড়ই পরিহাস্য শোনালো। ইস্, বাকি পথটা যদি কেউ স্ট্রেচারে নিয়ে যেত! বিরতির পর টলতে টলতে আবার যাত্রা শুরু। পাসিংপাড়ায় সামান্য বিরতি। আবার যাত্রা। ঠিক দুপুর সাড়ে বারোটায় কেওকারাডং শীর্ষে এসে পৌঁছলাম ফ্যাকাশে বিধ্বস্ত চেহারা নিয়ে। আমাদের করুণ দশা দেখে লালাবাবু যারপরনেই বেদনাহত বোধ করলেন।  

মিশন কেওকারাডং টু বগালেক

চূঁড়ায় উঠার পর পায়ের ব্যথা আর ক্ষুধায় মরণাপন্ন অবস্থা। হাত-পা ধুয়ে ডাইনিং-এ বসেই হাঙরের পেট নিয়ে গোগ্রাসে খাওয়া শুরু করলাম। মেন্যু খুব সাধারণ। বেগুনের তরকারী আর ডাল। আগের দু’বেলায় তেমন বেশী খায়নি। তাই ভাব বুঝে বাড়িওয়ালী ভাত অল্পই রান্না করেছে। কিন্তু ক্ষুধার প্রচন্ডতায় কয়েক মিনিটের মধ্যে সে ভাত সাবাড় হয়ে গেল। তখনও মাহফুয খেতে বসেনি। বাড়িওয়ালীর তো মাথায় হাত। অনভ্যস্ত বাংলায় রসিকতা করে বলল, ‘এত খেলে ২০০ টাকা করে নেব’। নাজীব যখন বলল আজ আপনার বাড়িতে যা কিছু আছে সব খেয়ে ফেলব, তখন তার সে কি হাসি! আমাদের টেবিলে রেখে মহিলা পাহাড়ে ফলানো বিন্নী ভাত চড়াতে গেল। আমরা এঁটো হাতে অধীর অপেক্ষায় বসে রইলাম। অবশেষে ভাত আসলে শুধু ডাল দিয়েই হাভাতের মত খেলাম। জীবনে এত খাওয়া আর খেয়েছি কি না মনে পড়ে না।

খাওয়ার পর গাইড বলল, দেড়টার মধ্যে বগালেকের উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হবে, নয়ত রাত হয়ে যাবে। কিন্তু কটেজে ঢুকে আমি অচেতনের মত ধপ করে শুয়ে পড়লাম। ক্লান্ত শরীর আর এক ইঞ্চিও নড়তে চাইছে না। ‘সর্বাঙ্গে ব্যথা, ঔষধ দেব কোথা’-প্রবাদটি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। প্রায় ৪০ মিনিট পর উঠে দু’টো পেইনকিলার আর কাফী ভাইয়ের বানানো শরবত-গ্লুকোজ খেয়ে একটু চাঙ্গা হওয়ার চেষ্টা করলাম। বাইরে তাকিয়ে দেখি ঘন কালো মেঘ। প্রবল ঝড়বৃষ্টি নামার পূর্বমুহূর্ত। মেঘ ধেয়ে আসছে ভয়ংকর দর্শনে। ব্যালকনিতে যেতেই অনুভব করলাম মেঘেরা আমাদের গা ছুয়ে অতিক্রম করছে। ঝুম বৃষ্টি নামল পাহাড়ে। সে এক দারূণ অভিজ্ঞতা। প্রায় আধাঘণ্টা একটানা বৃষ্টি হল (সম্ভবতঃ পাহাড়ের এত উপরে ঝড় হয় না, কেননা পরদিন রুমা বাজারে শুনি গতকালের প্রবল ঝড়ে সেই যে বিদ্যুৎ চলে গেছে আর আসেনি, অথচ কেওকারাডং-এ সামান্য বাতাস ছাড়া ঝড়ের লেশমাত্র ছিল না)। বৃষ্টির প্রকোপ কমলে বেলা ২টার দিকে আমরা কটেজ ছেড়ে বের হলাম। লালা বাবুকে ৫ জনের থাকা-খাওয়ার বিল বাবদ ২৭০০ টাকা মিটিয়ে দেয়া হল। বাবুর ছোট্ট একবছরের নাতিটার সাখে আমাদের খুব খাতির জমে গিয়েছিল। কিন্তু ঘুমিয়ে থাকায় ওর হাতে কিছু দেয়া হল না। লালা বাবু ও তার স্ত্রী আমাদেরকে আন্তরিকভাবে বিদায় জানালেন। উপহার হিসাবে পেলাম পাহাড়ে চাষ করা এক ব্যাগ আদা।

টিপটিপ বৃষ্টির মধ্যে আমাদের ট্রেকিং শুরু হল। অভিযাত্রী মুড অবশ্য অনেক আগেই বিদায় নিয়েছে। প্রতিটি পদক্ষেপে টনটন করে প্রতিবাদ জানাচ্ছে দুই হাটু। তবে ভেজা আবহাওয়ায় আগের মত কষ্টটা আর নেই। রাস্তাও বেশ সমতল। মাঝে মাঝেই অদৃশ্য ঝর্ণার দূরাগত গর্জন ভেসে আসছে। বৃষ্টির কারণে জেগে উঠেছে এসব ঝর্ণা। ভেজা কর্দমাক্ত রাস্তায় বার বার স্লীপ করছি। জোঁকের উৎপাতও বেড়েছে খুব। মাঝে মাঝেই স্যান্ডেল খুলে জোঁক ছাড়াতে হচ্ছে। তবে আগের মত আতংকে নেই। ছাইয়ের টোটকা পেয়ে আমাদের মনোবল এখন অনেক শক্ত। টানা হেঁটে মাঝে মাত্র ১ বার বিরতি নিয়ে বিকাল সাড়ে চারটার দিকে আমরা চিনরি ঝর্ণার কাছে পৌঁছলাম। বৃষ্টির কারণে ফুলে ফেপে উঠেছে ঝর্ণাধারা। ভিতরে ঢুকে ঝর্ণার আসল চেহারাটা দেখে তো আমরা একেবারে মুগ্ধ। দুই-তিন দিকে পাহাড়ী নালা দিয়ে পানি পতিত হয়ে দুটি ধাপে নিচে নেমে এসেছে। সেই সাথে শব্দের তুমুল ঝংকার। অসাধারণ এই ঝর্ণাটিতে বেশ কিছু সময় কাটালাম। সেখান থেকে বের হয়ে মাগরিবের কিছু পূর্বে সাড়ে ৫টার দিকে বগালেক পৌঁছে গেলাম। মাহফুয ততক্ষণে সিয়াম দিদির কটেজ ঠিক করে ফেলেছে। সেখানে ব্যাকপ্যাক রেখেই গোসলের জন্য ছুটলাম। পানিতে নামার সময় গাইড বলল, জীবনে অনেক জায়গায় গোসল করেছি; তবে বগালেকের মত এত প্রশান্তি কোথায় পাই না। সিঁড়ি বাধানো পুকুরে দু’পা ফেলতেই গাইডের কথার সত্যতা পেলাম। ঝকঝকে পানিতে গা ডুবাতেই সমস্ত ক্লান্তি যেন ঝরে পড়ল। চমৎকার ওম ওম গরম পানিতে এ যেন প্রাকৃতিক হটশাওয়ার। কাফী ভাই সাঁতরে অনেক দূর গেল। আর তীরে দাঁড়িয়ে আমরা অসহায় দৃষ্টিতে তার জলকেলি দেখলাম। জীবনের প্রায় মধ্য গগণে এসে আজ বগা লেকের পাশে দাঁড়িয়ে সাতার না শিখতে পারার আক্ষেপ বড্ড বেশী যন্ত্রণা দিল। লেকের পাড়ে অাঁধার নেমে এলে সিয়াম দিদির কাঠের দোতলা সরাইখানায় ফিরে আসলাম। মাগরিব-এশা পড়েই ঘুম। রাত সাড়ে আটটার দিকে খাওয়ার ডাক পড়ল। খুব সুস্বাদু ডিম ভূনা দিয়ে ভাত খেলাম। ডাইনিং-এ বসে দেখলাম পাড়ার নারী-পুরুষ ভিড় করে সৌরবিদ্যুত চালিত রঙ্গিন টেলিভিশনে মিজোরামের ভাষায় কোন সিনেমা দেখছে। সম্ভবত অত্র অঞ্চল জুড়ে এটাই একমাত্র টেলিভিশন। ভেবেছিলাম রাতের খাওয়ার পর বগালেকপাড়ে বসে চাঁদ দেখব, জমাট অন্ধকারে গহীন বনের পথে হেঁটে বেড়াব। কিন্তু সন্ধ্যার পর থেকে সেই যে নেমেছে বেরসিক বৃষ্টি, থামার কোন লক্ষণ নেই। শেষমেষ ব্যথার ডিপোতে পরিণত হওয়া শরীরটাকে বিশ্রাম দেয়ারই সিদ্ধান্ত নিলাম। ১৮ জনের জন্য বরাদ্দ ঘরটা আমাদের ৫ জনের দখলে। ইচ্ছেমত জায়গা করে নিয়ে মহা ঘুম। এ সুখ দেখলে পর্যটন মৌসুমে ভীড়ের মধ্যে এখানে আসার কথা কোন বোধহয় পাগলেও চিন্তা করত না!       

বগালেক টু চট্টগ্রাম                          

২৬ তারিখ ভোর। দীর্ঘ ঘুমের পর শরীরটা ঝরঝরে হবে কি তীব্র ব্যথায় পা মাটিতে ফেলতে পারছি না। কোনরকমে ছালাতটা আদায় করলাম। ছালাতের পর মাহফুয আবার গা এলিয়ে দিল। কিন্তু ভোরের বগালেক দেখার লোভ সামলাতে না পেরে শরীরের তীব্র ব্যথা নিয়েও আমরা বাইরে বেরিয়ে এলাম। আঁধার তখন প্রায় কেটে গেছে। স্বচ্ছ বগালেক প্রতিবিম্বিত পাহাড়ের সবুজে সবুজাভ। লেকের ওপারে মারমা পাড়া দেখা যাচ্ছে। হাতে সময় আছে দেখে লেকের ধার ঘেঁষে পাহাড়ী পথ ধরে মারমা পাড়ার দিকে এগুলাম। ওপারে পৌঁছে দেখি মূল গ্রামটি অনেক নীচে। সেখানে একটি প্যাগোডাও দেখা যাচ্ছে। পিচ্ছিল পথ ধরে অনেকটা পথ হেটে গ্রামের ভিতর নেমে এলাম। সেখানে দু’তিন জন লোকের সাথে কথা হল। একজন মাছ ধরতে যাচ্ছিল বগালেকে। তার কাছে অনেক তথ্য পেলাম। জানা গেল বগালেকে কখনও মাছ ছাড়া হয় না, এমনিতেই হয়। যে যার খুশী মত মাছ ধরে, কেউ বাধা দেয় না।

প্রকৃতির নিবিড় যত্নে এভাবেই লালিত-পালিত হচ্ছে পাহাড়ীরা। জীবন-জীবিকা সম্পর্কে তাদের মধ্যে কোন রকম অপ্রাপ্তি বা হতাশা নেই। বনের পাখির মত মনের আনন্দে দিন আনে দিন খায়। জীবনের ভেলা বয়ে যায় তাদের নিশ্চিন্তে, নির্বিঘ্নে। এ ক’দিনে পাহাড়ী অধিবাসীদের সহজ সরল প্রাণবন্ত জীবন-যাপন দেখে মনে হল প্রকৃতির রাজ্যে এরাই বুঝি সবচেয়ে সুখী মানুষ। কোন অভাব নেই, অনুযোগ নেই। বাচ্চাগুলোকে কী আদর-স্নেহেই না তারা মানুষ করে তুলছে। এমন কোন বাড়ি নেই যেখানে দু’চারটি শিশু দেখা যায় না। মা কিংবা বাবার কোলে-পিঠে পরম মমতায় দুধের শিশুগুলো বিশেষ পদ্ধতিতে ঝুলে আছে। সেখানে বসে কী সুন্দর টুক টুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। কোন কান্নাকাটি বা অস্বস্তির চিহ্ন নেই চেহারায়। ভোরের আলোতে দিনের শুরু আর সারাদিন হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের পর সন্ধ্যা নামতেই ঘুমের আয়োজন। নেই ভাববিলাসের এতটুকু ফুরসৎ। এভাবেই অতিবাহিত হয় পাহাড়ী জীবনের প্রতিটি দিন। পাসিংপাড়ার এক দোকানে বসে এসবই ভাবছিলাম আর বহু দূরের এক পাহাড়ে অবস্থিত রুমনা পাড়ার দিকে ইঙ্গিত করে গল্প করছিলাম। এসময় আমাদের কথার ফাঁকে নিছক ফকীরী বেশে উঠানে বসে থাকা মহিলাটি ভাঙা বাংলায় স্বগতোক্তি করল- রুমনার ঝর্ণাটি খুব সুন্দর। কেমন যেন অদ্ভুত শোনালো। বুঝতে পারলাম, সৌন্দর্যাভূতি জিনিসটা কতটা সহজাত, কতটা মানবীয়, কতটা সার্বজনীন। নইলে এই ভূস্বর্গের অপরূপ সৌন্দর্য কাননে যাদের নিত্য বসবাস, তাদের কাছে সুন্দরের আবেদন পৃথকভাবে ধরা পড়বে কেন!

এদের কষ্টসহিষ্ণুতার ইতিহাস তো প্রবাদবাক্যের মত। বাজারে যাওয়ার প্রয়োজন পড়লে দুর্গম পাহাড়ী পথে ঘন্টার পর ঘন্টা, মাইলের পর মাইল নির্বিবাদে হেটে যায়। এমনকি রুমা বাজার থেকে বগামুখপাড়া পর্যন্ত এই ১৩ কিঃমিঃ রাস্তা, যেখানে চাঁদের গাড়ি হরহামেশা মেলে, তাতে বিনা পয়সায় চড়ার আমন্ত্রণ জানালেও অনেকে উঠতে চায় না। মাথায় ভারী বোঝাবাহী তোরণ নিয়ে নারী-পুরুষ, ছেলে-বুড়ো নির্বিশেষে কীভাবে মাইলের পর মাইল পাহাড়ী পথ অতিক্রম করে চলে, চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। পুথিজ্ঞানহীন এসব প্রকৃতির সন্তানদের মধ্যে এখন এনজিওদের প্রচেষ্টায় শিক্ষার আলো ছড়াতে শুরু করেছে। কিন্তু বিনিময়ে তাদেরকে দিতে হচ্ছে চড়া মূল্য। পূর্বে তারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিল। কিন্তু অধিকাংশই এখন খৃষ্টান হয়ে গেছে। যাওয়া-আসার পথে যতগুলো গ্রাম পড়ে তার প্রায় সবগুলোতেই সুসজ্জিত চার্চের দেখা মেলে। কেবল বগালেকের মারমাপাড়াটি এখনো বৌদ্ধ রয়ে গেছে। এক দোকানী বলল, পাহাড়ীরা একসময় সবাই বৌদ্ধই ছিল। গত দু’এক পুরুষ থেকে তারা খৃষ্টান হয়ে গেছে। খৃষ্টান মিশনারীরা এসব এলাকায় খুব তৎপর। তাবলীগ জামাআত সারাবিশ্বে ইসলাম প্রচারের জন্য সময় লাগাচ্ছে। কিন্তু দেশের মধ্যে এই এলাকাগুলো কেন তাদের দৃষ্টির আড়ালে রয়ে গেল তা আল্লাহই মা‘লূম। এই সুন্দর মনের মানুষগুলোকে কীভাবে এই মিশনারীদের হাত থেকে রক্ষা করা যায় এবং কী উপায়ে ইসলামের সত্য দাওয়াত এদের কাছে পৌঁছানো যায়, এ বিষয়টিই বার বার মনে ধাক্কা দিয়েছে এদের সাথে সাক্ষাতকালে।             

মারমাপাড়ার প্রবেশমুখেই একটা প্যাগোডা। সেখানে ঢোকার পর দেখলাম ১৪/১৫ বছরের নাদুস-নুদুস ন্যাড়া মাথা একজন হবু ভিক্ষু শুয়ে আছে। মুখে কথা নেই। কেবল ইশারা করছে। সম্ভবত কোন ব্রত পালনে রত। ওর ভাবভঙ্গিতে মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। ছোট্ট একটি বুদ্ধ মূর্তির সামনে দেশী-বিদেশী টাকার নোট ঝুলছে। কৌতূহলবশত বিদেশী টাকাগুলো কোন দেশের তা বোঝার জন্য হাত দিয়ে দেখছিলাম। এসময় প্রধান ভিক্ষু ভিতরে প্রবেশ করে তাতে স্পর্শ করতে নিষেধ করল হাসিমুখেই। সাথে একটি বাটিতে বেশ কয়েকটি ভুট্টা নিয়ে এসেছেন। সেখান থেকে একটি বুদ্ধমূর্তির সামনে রেখে আমাদের তিনজনের হাতেও তিনটি দিলেন। আমরা না নিতে চাইলেও তার জোরাজুরিতে নিতে হল। ভিতরে টানানো অনেক ছবির মধ্যে রাখাইন স্টেটের একটি ক্যালেন্ডার দেখতে পেলাম। ক্যালেন্ডারটির ছবি তোলার জন্য ক্যামেরা হাতে নিয়েছি। হাত নাড়িয়ে বাধ সাধল ঐ পিচ্চি হবু ভিক্ষুটাই।

ঘড়িতে ৭টা বেজে গেছে। প্যাগোডা থেকে বের হয়ে হাটতে হাটতে ব্যোমপাড়ায় ফিরে এলাম। ঘন্টাখানিক পূর্বেই সূর্যোদয় হয়েছে। কিন্তু পাহাড়ের চূড়া পেরিয়ে সূর্য তখন কেবলই উঁকি দেয়া শুরু করেছে বগালেকপাড়ায়। শরতের মেঘমুক্ত ঝকঝকে নীল আকাশ। আর তার শোভাবর্ধনে নিয়োজিত কাচা রোদের আলো ঝলমলে টুকরো মেঘের অসংখ্য ফুটফুটি। দুর্দান্ত এই আকাশটাই কি কবিগুরুর কল্পনার সেই নীলাম্বরী! সত্যিই সভ্যতার কোলাহলমুক্ত শান্ত-সুনিবিড় পাহাড়ী ভুবনে কেবল এই স্বচ্ছ সুনীল আকাশ দেখতেই বুঝি বার বার আসা যায়।

বগালেকেই গোসল করলাম। গোসলের পর আলুভর্তা, ডিমভাজি আর ডাল দিয়ে খুব তৃপ্তিভরে নাস্তা সারলাম। চা পান করার সময় সিয়াম দিদি এসে হাজির। দিদির বাবা এই পাড়ার সর্দার। তার স্বামী বাঙালী এবং একজন ব্যাংক কর্মকর্তা। থাকেন নারায়ণগঞ্জে। শিক্ষিতা এই মহিলার আভিজাত্য ও অত্যন্ত অমায়িক আচরণ সত্যিই মুগ্ধ করার মত। আঁচ করতে পারলাম সিয়াম দিদির কেন এত নাম-ডাক কেওকারাডং ভ্রমণে আসা পর্যটকদের কাছে।

ফেরার বেলা

সিয়াম দিদির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেলা ৮টার দিকে আমরা এই পর্বের সর্বশেষ হন্টনযাত্রা শুরু করলাম। পাহাড়ের উপর উঠে আরেকবার দৃষ্টি ফিরালাম বগালেকের দিকে। রহস্যে ঘেরা সুনীল জলরাশির সাথে কিছুক্ষণ নিঃশব্দ বাক্যবিনিময়ের পর বিদায়ী দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাহাড়ের ওপারে নামতে লাগলাম। বগামুখপাড়া পৌঁছতে ৪০ মিনিট লাগল। সেখানে পাহাড়ী কমলা কেনার পর চাঁদের গাড়ীর স্টান্ডে এসে অপেক্ষা করতে থাকলাম। বেলা সাড়ে ৯টার দিকে দুটো চাঁদের গাড়ী আসল। একটি ছিল পর্যটকবাহী। সেটিতেই উঠলাম আমরা। গাড়ীতে যাত্রী কেবল আমরা ক’জনই। বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে উচু-নিচু পাহাড়ী রাস্তাটি অতিক্রম করে বেলা ১১টার দিকে রুমা বাজার পৌঁছলাম। আর্মী ক্যাম্পে রিপোর্ট করে ‘আরণ্যক রিসোর্টে’ রাখা আমাদের লাগেজগুলো গুছিয়ে নিলাম। হোটেল মালিক ও চেইন মাস্টারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সাঙ্গুর ঘাটে অপেক্ষমান নৌকায় উঠে বসলাম। ঘাটে আসার সময় নাজীব রুমাবাজার মসজিদের লাইব্রেরীতে ছালাতুর রাসূল (ছাঃ) বইটি ঢুকিয়ে দিল। নৌকা ছাড়ল ঠিক ১১.৫০ শে। ঘাট থেকে তখন হাত নাড়াচ্ছে আমাদের ৩ দিনের সাথী গাইড আলমগীর ভাই।             

ভাটির পথে মাত্র ৪০ মিনিটেই কাইখ্যাংঝিরি ঘাটে পৌঁছে গেলাম। সেখান থেকে বেলা ১টায় বান্দরবানের উদ্দেশ্যে গাড়ী ছাড়ল। বেলা ৩টার ২/৩মিনিট পূর্বে বান্দরবান পৌঁছেই চট্টগ্রামগামী পূর্বাণী বাস পেয়ে গেলাম। ঠিক ৩টায় গাড়ী ছাড়ল। চলতি পথে বাস থেকেই স্বর্ণমন্দির ও মেঘলা অবকাশকেন্দ্র দেখলাম। অতঃপর চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট বাসস্টান্ডে এসে নামলাম বিকাল সাড়ে পাঁচটায়। সেখান থেকে এক সিএনজি নিয়ে কর্ণেলহাটে পৌঁছে শ্যামলী কাউন্টার থেকে রাজশাহীগামী ৭টার বাসে টিকিট কাটলাম। বাসে উঠেই ঘুম। পরের দিন সকাল সাড়ে ৮টায় নিরাপদেই ফিরে এলাম চিরচেনা রাজশাহী শহরে ফালিল্লাহিল হামদ। কিন্তু ‘ব্যথার রাজ্যে জীবন গদ্যময়’ রয়ে গেল পরবর্তী আরো কয়েকটা দিন। আর মনের গহীনে ক্ষণে ক্ষণে উঁকি দিয়ে যেতে লাগল সদ্য ফেলে আসা পাহাড়ী রাজ্যের স্বপ্নালু স্মৃতিগুলো।

মন্তব্য করুন

Back to top button