পরিবার ও দাম্পত্যসমাজ/সংস্কৃতি/সভ্যতা

বাল্যবিবাহ আইন সমাজের জন্য কতটা কল্যাণকর: একটি পর্যালোচনা

বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী, ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়ের সাথে ২১ বছরের কম বয়সী ছেলের বিয়েকেই বাল্যবিবাহ বলা হয়।  বাংলাদেশ সরকার নারী-পুরুষের বিয়ের বয়স (যথাক্রমে) ১৮ আর ২১ থেকে কমিয়েছে। কিন্তু দেশী-বিদেশি মানবাধিকার সংস্থা আর তথাকথিত সুশীল সমাজ প্রধানমন্ত্রীর এই উদ্যোগের তীব্র সমালোচনা করছে এবং জেনে না জেনে এর নানা খারাপ দিক তুলে ধরছেন। আর কিছু স্মার্ট (?) ব্লগার তো বাল্যবিবাহ ইস্যুতে ইসলামের বিষোদগার করে মুখে ফেনা তুলে ফেলছে। যেহেতু রাসুল (সা.) এর সাথে হযরত আয়িশা (রা.)’র বিয়ে হয় তখন মা আয়িশা (রা.) বর্তমান বাংলাদেশের আইন অনুসারে নাবালিকা ছিলেন। এইসব লোকেরা কোন বিষয় নিয়ে কথা বলার সময় অধিকাং  সময়ই তা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে না। আর চিন্তা করে না বলেই কোন কিছু নিজের মতের বিরুদ্ধে গেলেই গলাবাজি শুরু করে দেন।

যে কোন কিছুকে অপরাধ বলার আগে দেখতে হবে তা কেন অপরাধ, কখন থেকে অপরাধ, কোন আইনে অপরাধ আর কোন স্থানে অপরাধ। যেমন বাংলাদেশের আইনে বিবাহ না করে একজন নারী ও একজন পুরুষ একত্রে বসবাস করতে পারবে না। কিন্তু আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতেই কিন্তু এটি বৈধ। আবার বাংলাদেশে কোন ছেলে একসাথে ৩/৪টি প্রেম করছে তা শুনলে এখন আর গা জ্বালা করে না বরং এটাকে স্মার্টনেস হিসেবেই দেখা হচ্ছে। অথচ কোন ছেলে একাধিক বিয়ে করেছে তা শুনলে সবার চান্দি গরম হয়ে যায়।

এই বিষয়টিই সৌদি আরবে আবার উল্টো। সেখানকার মানুষ একজন পুরুষ একাধিক বিয়ে করে তাদের দায়িত্ব পালন করবে এটাকে অত্যন্ত স্বাভাবিক দৃষ্টিতে দেখা হয়। কিন্তু কোন পুরুষ বিয়ে না করে এক বা একাধিক মেয়ের সাথে প্রেম করলে তাকে অত্যন্ত গর্হিত কাজ বলে মনে করা হয়।

এবার বাল্যবিবাহ প্রসঙ্গে আসা যাক। বর্তমান যুগে অপ্রাপ্ত বয়স্ক কোন মেয়েকে বিয়ে করা একটা অপরাধ, যদি তা ঐ দেশের প্রচলিত আইনের বিরুদ্ধে যায়। একটা সময় ছিল যখন অপ্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েরাই ছিল বিয়ের জন্য প্রথম পছন্দ। ১২‘শ শতাব্দিতে (বায়জেন্টাইন সম্রাজ্য) আলেক্সাস-২ এক রুপবতীকে বিয়ে করে যার বয়স ছিল ৯ বছর । ১১৮৪ সারে হাঙ্গেরীয় রাজা ৯ বছর বয়সি কিশোরী বিয়ে করেন। ১৩ বছর বয়সের জুলিয়েট ছিলেন শেক্সপিয়রের নায়িকা। এতটা পেছনে যাবার দরকার কি।১৮৮৩ সালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ২২ বছর বয়সে বিয়ে করেছিলেন ১১ বছরের মৃণালিনী দেবীকে। পৃথিবীর অনেক স্থানে কিশোরী বিয়ে করা এখনো কোন অপরাধ নয়।

তবে এখন বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বেশিরভাগ রাষ্ট্রেই বাল্যবিবাহকে আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই আইনের মাধ্যমে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে বিবাহকে খুবই কঠিন করে ফেলেছে। মানুষ যেনো বিবাহের ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে সেজন্য সকল আয়োজন সম্পন্ন করা হয়েছে! সরকারী ও বেসরকারী উভয় ক্ষেত্র থেকেই একজন প্রাপ্ত বয়স্ক নারী ও পুরুষের বিবাহের দিকে অগ্রসর হওয়াকে খুবই কঠিন করে ফেলা হয়েছে।

বর্তমানে সাধারনত সবকিছু ঠিকঠাক চললে একজন পুরুষ বিয়ে করে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর, আর একজন নারী বিয়ে করে মোটামুটি গ্রাজুয়েশন শেষ হলে। এখন সময় আরও একটু পরিবর্তন হয়েছে মেয়েরাও বিয়ে করছে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর। আর পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় এই প্রতিষ্ঠিত হতে হতে ছেলে-মেয়ের বয়স হয়ে যায় ৩০ এর কাছাকাছি।কিন্তু এই ৩০ বছর পর্যন্ত তাদের বিয়ে করা থেমে থাকলেও তাদের জৈবিক চাহিদা কিন্তু থেমে থাকে না।তাই সমাজে দেখা যায় ১০/১২ বছর বয়স থেকেই ছেলে-মেয়েরা প্রেম করা শুরু করে। আর যে ছেলে প্রেমিকা জুটাতে ব্যর্থ হয় সে ব্লু-ফিল্ম দেখে বা পতিতা পাড়ায় গিয়ে তার সেই চাহিদা পূরণ করছে। আর পশ্চিমা বিশ্বেতো ছেলেরা মেয়েদেরকে হরহামেশা ধর্ষণ করছে। লিভ টু গেদারের কথা না হয় বাদই দিলাম। পৃথিবীতে পশ্চিমা দেশ গুলিতেই কিশোরী গর্ভপাতের হার সবচেয়ে বেশী। সাম্প্রতিক সময়ে সেখানে ১১ বছর বয়সে মা হওয়ার রেকর্ডও আছে। বাংলাদেশ এখন কিশোরী গর্ভপাতের হার অনেক বেশী। বাল্য বিবাহের কারণে এসব ঘটছে তা কিন্তু নয়। সমাজের মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত শ্রেনীর স্কুল পড়ুয়া কিশোরীরাই তা করছে। পরিবারে বাবা/মা, ভাই/বোনের চোখ ফাকি দিয়ে স্কুল পড়ুয়া কিশোরীরা তাদের অজান্তে এমন অপকর্ম করে বেড়াচ্ছে।

তার মানে হল ১৮ ’র মাপকাঠি মেনে বিয়ে করলেও জৈবিক চাহিদা পূরণ হচ্ছে ১৮’র অনেক আগে থেকেই। বিবাহ বহিরর্ভূত এই সম্পর্ককে ইসলামের পরিভাষায় বলে ‘জেনা’। একটু ভেবে দেখুন, এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা কি সুকৌশলে আল্লাহ সুবহানা হু ওয়া তায়ালার বরকতময় বিধান বিয়েকে কঠিন করে ইসলামের নিষিদ্ধ ‘জেনাকে’ সহজ করে দিয়েছে।যা যুব সমাজকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।সমাজে প্রতিনিয়ত বাড়ছে ইভটিজিং, ধর্ষণসহ নানা ধরণের নারী নির্যাতন।

আল্লাহ পাক আমাদের সৃষ্টি করেছেন আর তিনিই কি জানবেন না কখন বিয়ে করা উত্তম? নিশ্চয়ই তিনিই সর্বাপেক্ষা উত্তম জানেন। আর তাই ইসলাম বালেগ হওয়ার পর ছেলে-মেয়েদের বিবাহ দেয়ার ব্যাপারে অভিভাবকদেরকে নির্দেশ দিয়েছে।

এজন্যই মহানবী সা. স্ত্রীর ন্যূন্যতম ভরণ-পোষণ দিতে সক্ষম সকল যুবককে বিবাহের নির্দেশ দিয়ে বলেছেন,

“হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, মহানবী সা. বলেছেন, হে যুব সম্প্রদায়! তোমাদের মধ্যে যারা স্ত্রীদের ভরণ-পোষণের সক্ষমতা রাখে তারা যেন বিয়ে করে ফেলে। কেনন এটা চোখের প্রশান্তি দানকারী ও লজ্জা স্থানের হিফাজতকারী। আর যারা স্ত্রীদের ভরণ-পোষণের সামর্থ্য রাখে না, তারা যেন রোজা রাখে, কেননা এটা তাদের উত্তেজনাকে হ্রাস করবে।” (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৪৭৭৮)

পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে,

“তোমরা তাদের অভিবাবকদের অনুমতিক্রমে তাদের বিয়ে করো, যথাযথভাবে তাদের মোহর প্রদান করো, যেন তারা বিয়ের দুর্গে সুরক্ষিত হয়ে থাকতে পারে এবং অবাধ যৌন চর্চা ও গোপন বন্ধুত্বে লিপ্ত হয়ে না পড়ে।” (সূরা নিসা-২৫)

আবু সঈদ খুদরি (রা:) ও ইবনু আব্বাস (রা:) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন,

“যার কোনো সন্তান জন্মলাভ করে সে যেন তার সুন্দর নাম রাখে এবং তাকে উত্তম আদব-কায়দার শিক্ষা দেয়। যখন সে বালেগ হয় তখন যেন তার বিবাহ দেয়। যদি সে বালেগ হয় এবং তার বিবাহ না দেয় তাহলে সে কোনো পাপ করলে, সে পাপ তার পিতার ওপর বর্তাবে।” (বায়হাকি, মিশকাত হা-৩১৩৮)

ইসলামের এই বিধান কিছু নামধারী মুসলিম ব্যতীত সকল মুসলিমই কায়মনোবাক্যে কল্যাণকর মনে করেন।ইতিহাসও স্বাক্ষ দেয়, যখন বিয়েসহ সকল ক্ষেত্রে ইসলাম মানা হতো তখন সমাজে কতো শান্তি ছিল। কিন্তু তার পরেও অনেকের মনে একটি প্রশ্ন উঁকি দেয়-এত অল্প বয়সে বিয়ে করলে সংসার চালানোর খরচা আসবে কোথা থেকে? এ প্রশ্নের উত্তরে প্রথমেই বলা যায়, আল্লাহ কারো রিজিক কোন কারণে থামিয়ে রাখেন না। আর তাই অল্প বয়সে বিয়ে করলেও কারো রিজিক আটকে থাকবে না।কেননা আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন,

“আর যে আল্লাহকে ভয় করে, তিনি তার জন্য বিপদ উত্তরণের পথ তৈরী করে দেন এবং তিনি তাকে এমন উৎস থেকে রিজিক দেবেন, যা সে কল্পনাও করতে পারবে না। আর যে আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে, আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট।”(সূরা আত তালাক : ৩)

তিনি আরো বলেন,

“তোমাদের মধ্যে যারা অবিবাহিত (নরনারী), তাদের বিবাহ সম্পাদন কর এবং তোমাদের দাস-দাসীদের মধ্যে যারা সৎ -তাদেরও। তারা অভাবগ্রস্ত হলে আল্লাহ্ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে অভাবমুক্ত করে দেবেন। আল্লাহ্ তো প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।” (সূরা নূর :৩২)

রাসূল (সাঃ) বলেন,

“তিন ব্যক্তিকে সাহায্য করা আল্লাহর দায়িত্ব; ১) আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারী মুজাহিদ, ২) সেই ক্রীতদাস যে নিজেকে স্বাধীন করার জন্য তার মুনিবকে কিস্তিতে নির্দিষ্ট অর্থ দেওয়ার চুক্তি লিখে সেই অর্থ পরিশোধ করার ইচ্ছা করে, এবং ৩) সেই বিবাহকারী যে বিবাহের মাধ্যমে (অবৈধ যৌনাচার হতে) নিজের চরিত্রের পবিত্রা কামনা করে।” (আহমদ, তিরমিযী, নাসাঈ, বাইহাক্বী, হাকেম, সহীহুল জামে ৩০৫০ নং)

আর দ্বিতীয়ত, ইসলাম কোন তাত্ত্বিক (theoretical) ধর্ম নয়। ইসলাম ছেলে-মেয়েদের বালেগ হওয়ার পর যেমন বিয়ে করার নির্দেশ প্রদান করেছে ঠিক তেমনি কিভাবে ওই বয়সের মধ্যেই একটি ছেলে প্রতিষ্ঠিত হবে সেই উপায়ও বলে দিয়েছে । ইসলাম পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মতো প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রক্রিয়া এমন কঠিন করেনি।ইতিহাস থেকে দেখা যায়, যখন ইসলামী শাসন ব্যবস্থা পৃথিবীতে বাস্তবায়িত ছিল তখন ১৫/১৬ বছরের যুবকরা শুধু প্রতিষ্ঠিতই হয়নি বরং কেরিয়ারের চূড়ান্ত শিখরে আরোহণ করেছে। আমরা সবাই জানি মুসলিম বীর মুহাম্মদ বিন কাসিম যখন উমাইয়া সেনাপতির দায়িত্ব প্রাপ্ত হন তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৭ বছর এবং সেই বয়সেই তিনি সিন্ধু নদসহ সিন্ধু ও মুলতান অঞ্চল জয় করে উমাইয়া খিলাফতের অন্তর্ভুক্ত করেন।

একইভাবে ইখতিয়ার বিন বখতিয়ার খিলজি, তারেক বিন জিয়াদ, মুহাম্মদ বিন ফাতেহ সহ বহু মুসলিম যুবকের কথা ইতিহাসকে অলংকৃত করে রেখেছে যারা ছিল দ্বিগবিজয়ী সেনা। আর এখন তাদের বয়সের ছেলেদেরকে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা দুধের শিশু করে রেখেছে। অর্থাৎ তাঁদের উদাহরণই বলে দেয় ইসলামী শাসন ব্যবস্থা একজন যুবককে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথকে প্রসস্থ করে দিয়েছিল।কিন্তু আজ সে ব্যবস্থার অনুপুস্থিতির কারণে যুবকদের প্রতিষ্ঠিত হতে লেগে যাচ্ছে ৩০ বছর। তাই আইন অনুযায়ী ২১ বছর পূর্ণ হওয়া সত্বেও যুবকরা বিয়ে করতে পারছে না। মূলত এটি বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থার একটি চরম ব্যর্থতা। আর সেই ব্যর্থতা ঢাকতে তারা বাল্য বিবাহ আইনের মতো নানান জিনিস পয়দা করছে। সে আইন সমাজকে অকল্যাণকর ব্যতীত কল্যাণকর কিছু দিতে পারেনি। আল্লাহ্ আমাদের সত্য বুঝার ও মেনে চলার তৌফিক দিক। আমীন।।

উম্মে নুসাইবাহ

মন্তব্য করুন

Back to top button