আমার সবচেয়ে বড় শত্রু
পৃথিবীতে একজন অত্যন্ত জ্ঞানী এবং অভিজ্ঞ সত্ত্বা আছে, যে আমাদের সাইকোলজি নিয়ে খেলা করে আমাদেরকে প্রতিদিন না বুঝে অন্যায় কাজে ডুবিয়ে রাখে, নিজেদের সাথে প্রতারণা করায় এবং আমাদের পরিবারে মধ্যে আগুন জালিয়ে দেয়। আমাদের জলদি উপলব্ধি করা দরকার সে কে। কারণ যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা আমাদের প্রতি মুহূর্তের সঙ্গী, আমাদের সবচেয়ে বড় শত্রু শয়তান সম্পর্কে অজ্ঞ থাকবো; সে কিভাবে কাজ করে, কিভাবে সে মানুষকে ধোঁকা দেয়, কিভাবে আমাদের চিন্তাকে প্রভাবিত করে – এগুলো না বুঝবো; ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা না জেনে, না বুঝে প্রতিনিয়ত তারই পরিকল্পনাগুলো সফল করতে বিনা পারিশ্রমিকে তার হয়ে কাজ করতে থাকবো।
শয়তানের মানুষকে ধীরে ধীরে শেষ করার কয়েকটি প্রধান পদ্ধতি হলঃ
- নিজেকে যথেষ্ট ভালো মানুষ বলে বিশ্বাস করানো এবং নিজের অন্যায় কাজগুলো নিজেই যুক্তি দিয়ে ন্যায় কাজ বলে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া। যেমন – আপনি ঘুষ দিয়ে ভাবছেন সেটা কোনো দোষের কিছু না, কারণ আপনি নিজে তো ঘুষ খাচ্ছেন না। আর ঘুষ না দিলে তো আপনি কাজটা অন্য কোনো ভাবে করাতে পারতেন না। তাই এই ঘুষ দেওয়াটা নিশ্চয়ই হালাল। এভাবে আপনি ‘হালাল ঘুষ’ এর প্রচলন শুরু করেন। একইভাবে ধীরে ধীরে হালাল সুদ, হালাল লোণ, হালাল ইনস্যুরেন্স, হালাল লটারি – এরকম অনেক কিছুই হালাল হয়ে যাওয়া শুরু হয় আপনার কাছে। শয়তান যেভাবে আদমের (আ) সামনে নত না হওয়ার জন্য যুক্তিতর্ক দিয়ে আল্লাহকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল যে, সে যা করেছে সেটাই ঠিক, সেরকম আপনি যুক্তি দিয়ে আল্লাহকে বোঝানোর চেষ্টা করেন কোন হারামটা আসলে হারাম না। এভাবে আপনি শয়তানের দলের একজন হয়ে যান।
- আরেকটি পদ্ধতি হল – ধর্মে কোন বাধ্যবাধকতা নেই – এটা বিশ্বাস করানো। আল্লাহর উপর বিশ্বাস থাকলেই হল। ধর্মীয় রীতিনীতি গুলো আসলে কিছু আনুষ্ঠানিকতা। সবার জন্য নামায, রোযা করা লাগে না। হজ্জ করতে গেলে যদি দেশে দুর্যোগ হয়, তখন পরিবারকে বাঁচাবে কে? মানুষকে যাকাত দিয়ে কি হবে? তারা তো আর যাকাত পেয়ে সচ্ছল হয়ে যাচ্ছে না। শয়তান নিজে যেমন ঠিকই আল্লাহকে বিশ্বাস করে, কিন্তু নামায, রোযা, যাকাত ইত্যাদি ধর্মীয় রীতিনীতি গুলো কিছুই মানে না, ঠিক সেভাবে সে আপনাকেও মানুষরূপী শয়তান বানিয়ে ফেলে।
- চাকরি, ব্যবসা, পড়ালেখা ইত্যাদি দৈনন্দিন কাজগুলোকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে বিশ্বাস করানো এবং মনে করা যে – আল্লাহর সাথে আমার চুক্তি আছে, আল্লাহ আমাকে মাফ করে দিবে। যেমন – আমি একজন ডাক্তার! আমি মানুষের জীবন বাঁচাই! আমার নিশ্চয়ই পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ার দরকার নেই? আমি তো সেই সময়ে কয়েকজন রুগীর জীবন বাঁচাতে পারি। কোনটা বেশি জরুরি? নামায পড়া না মানুষের জীবন বাঁচানো? আল্লাহ নিশ্চয়ই আমাকে মাফ করে দিবে।
- সবসময় টাকা পয়সা, সম্পত্তি, সুখ হারানোর ভয়ের মধ্যে রাখা। যেমন, আপনার এক গরিব আত্মীয় চিকিৎসার জন্য আপনার কাছে টাকা চাইতে আসলো, কিন্তু আপনি ভাবা শুরু করলেন – এই লোকটাকে কয়েক হাজার টাকা দিলে তো আমার বাড়ি কেনার জন্য জমানো সত্তুর লাখ টাকা কমে যাবে, আমার বাড়ি কেনা পিছিয়ে যাবে! কালকে যদি আমার চাকরি চলে যায়, তাহলে তো আর আমার বাড়ি কেনা হবে না? যদি এক মাস পরে বাড়ির দাম হঠাৎ করে বেড়ে যায়?
- নিজেকে দিয়ে অন্যায় করাতে না পারলে, কাছের মানুষদেরকে দিয়ে ভুলিয়ে ভালিয়ে অন্যায় করানো। যেমন, আপনি বহুদিন চেষ্টার পর আজকে শেষ পর্যন্ত কু’রআন নিয়ে বসেছেন পড়ার জন্য, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনার স্বামী বা স্ত্রী এসে আপনাকে টিভিতে একটা অনুষ্ঠান দেখার জন্য তাগাদা দেওয়া শুরু করলো। অথবা আপনি অনেক আয়োজন করে বসেছেন একটা ইসলামিক আর্টিকেল পড়বেন, কিন্তু পড়া শুরু করতে না করতেই বন্ধুর ফোন – দোস্ত, চল্ কালকে ‘ইয়ে’ করতে যাই। শুরু হল আধা ঘণ্টা ফোনে কথা, তারপর রাতের খাওয়া, টিভি এবং ঘুম। আপনার আর সেদিন আর্টিকেল পড়া হল না। তার পর কয়েক সপ্তাহ পার হয়ে গেল, আপনি ভুলে গেলেন সেই আর্টিকেলের কথা।
- উপরের প্রত্যেকটা পদ্ধতি পড়ার সময় আপনার আশেপাশের কারও না কারও কথা মনে হচ্ছিল এবং আপনি মনে মনে ভাবছিলেন – তাইতো! এগুলো সবই দেখি ওর সাথে মিলে যায়! আপনার ভেতরে এই যে চিন্তাটা হচ্ছে, যেখানে আপনি মনে করছেন আপনার এই সমস্যাগুলোর কোনোটাই নেই, এগুলো সবই হচ্ছে আপনার আশেপাশের মানুষদের সমস্যা – এটা শয়তান আপনার ভেতরে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। সে সবদিক থেকে চেষ্টা করবে যেন আপনি কখনও মনে না করেন এই আর্টিকেলে যতগুলো সমস্যা আপনি শিখবেন, তার কোনটা আপনার ভেতরেও আছে।
শয়তানের মানুষকে বোকা বানানোর এই পদ্ধতি গুলো শয়তান হাজার হাজার বছর ধরে সফল ভাবে ব্যবহার করে আসছে। পৃথিবীতে বিলিয়ন মানুষকে সে প্রতিনিয়ত বোকা বানিয়ে যাচ্ছে। আপনি যদি তার সহযোগী হয়ে তার মহাপরিকল্পনা সফল করতে বিনা পারিশ্রমিকে তার হয়ে কাজ করতে না চান, তাহলে আসুন আমরা ভালো করে বোঝার চেষ্টা করি কিভাবে শয়তান কাজ করে।
শয়তান আসলে কি
প্রথমত, আমাদেরকে ভালো করে বুঝতে হবে ইবলিস এবং তার শয়তান বাহিনী আসলে কি ধরণের সত্তা এবং আল্লাহ তাদেরকে কতখানি ক্ষমতা দিয়েছেন এবং কি ধরণের খারাপ কাজ শয়তান আপনাকে দিয়ে করায়, আর কি ধরণের খারাপ কাজ আপনি নিজে আপনার নিজের প্রবৃত্তির কারণে করেন। প্রথমে শয়তানের সংজ্ঞা কি ভালো ভাবে জানা দরকারঃ
শয়তানঃ মানুষ বা জ্বিন, যারা ইবলিস এবং তার উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়ন করতে সাহায্য করে।
ইবলিস এক মহা জ্ঞানী সত্তা। সে একজন জ্বিন ছিল, যাদেরকে আল্লাহ ﷻ মানুষ সৃষ্টি করার অনেক আগেই সৃষ্টি করেছিলেন [আল-হিজর ১৫:২৭]। সে আল্লাহর ﷻ ইবাদত করে এতটাই উপরে উঠতে পেরেছিল যে, আল্লাহ ﷻ তার সাথে কথা বলতেন এবং আল্লাহর ﷻ মহাপরিকল্পনার অনেক কিছুই সে জানতো। এছাড়াও সে তার যোগ্যতার কারণে আল্লাহর ﷻ কাছের সন্মানিত ফেরেশতাদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছিল।[৪] কিন্তু তারপর ঘটলো এক বিস্ময়কর ঘটনা, যার পর এত সন্মানিত এবং জ্ঞানী এক সত্তা তার সবকিছু হারিয়ে ফেললো। আমরা অনেকেই ছোট বেলায় ইবলিসের এই অবাধ্যতার ঘটনাটা শুনেছি এবং ভেবেছি – “ছি, ইবলিস কি বোকা, সে এত বড় ভুল কিভাবে করলো।” আবার অনেকে ভেবেছি – “আহারে বেচারা ইবলিস। আল্লাহ ﷻ ইবলিসকে একটা ভুলের জন্য এত বড় শাস্তি দিল? এত বড় একজন সত্তাকে সারা জীবনের জন্য বের করে দিলো? শাস্তিটা বেশি হয়ে গেল না?” শুধু তাই না, এই ধারণা থেকে Devil Worshipper ‘শয়তান পূজারী ধর্ম’ তৈরি হয়ে গেছে, যার অনুসারীরা মনে করে সেদিন ইবলিসের সাথে অন্যায় করা হয়েছিল এবং তারা ইবলিসের উপাসনা করে এবং অপেক্ষা করছে কবে ইবলিসের সাথে ‘গডের’ শেষ যুদ্ধ হবে, যেদিন তারা ইবলিসের সহযোগিতা করবে।
আমাদের ভালো করে বোঝা দরকার সেদিন কী ঘটেছিল। ধরুন, আপনি আপনার চাকরি জীবনের প্রথম থেকে একটা কোম্পানিতে নিষ্ঠার সাথে কাজ করে আসছেন। গত ত্রিশ বছর কঠোর পরিশ্রম করে আপনি একজন মামুলি কেরানি থেকে আজকে কোম্পানির প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। আপনার সাথে কোম্পানির চেয়ারম্যানের অনেক ভালো সম্পর্ক, আপনি তার অনেক কাছের একজন মানুষ। কিন্তু হঠাৎ একদিন আপনার চেয়ারম্যান আপনাকে বলল যে, সদ্য অক্সফোর্ড থেকে গ্রাজুয়েট একজন তরুন ছেলে কালকে থেকে কোম্পানির প্রেসিডেন্ট হবে এবং আপনাকে তার অধীনে ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাজ করতে হবে। আপনার অবস্থা তখন কী হবে? একজন সদ্য গ্রাজুয়েট হবে প্রেসিডেন্ট, আর আপনি যেখানে ত্রিশ বছর ধরে কোম্পানিতে কাজ করছেন, সেখানে আপনি হবেন তার অধীনে একজন কর্মচারী! আপনার সাথে এতো বড় অন্যায়?
আপাতত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে, ইবলিসের এই প্রতিক্রিয়াটা স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু এখানে অনেক চিন্তার ব্যাপার আছে। প্রথমত, ইবলিসের আল্লাহর ﷻ অস্তিত্ব সম্পর্কে সম্পূর্ণ ধারণা ছিল। আপনি, আমি নিজের চোখে আল্লাহকে দেখিনি, নিজের কানে আল্লাহকে শুনিনি। আমরা কোনো ফেরেশতাকেও কোনোদিন দেখিনি। আপনার-আমার পক্ষে আল্লাহ্র ﷻ প্রতি সম্পূর্ণ অবিচল, অটুট বিশ্বাস রাখাটা যথেষ্ট কঠিন। কিন্তু ইবলিস নিজে আল্লাহর সাথে কথা বলতে পারতো। এমনকি সে সন্মানিত ফেরেশতাদের সাথেও থাকতো। তার জন্য আল্লাহকে ﷻ প্রভু হিসেবে মেনে, কোনো ধরণের প্রশ্ন না করে, তাঁর আদেশ মেনে চলাটাই স্বাভাবিক ছিল। আল্লাহর ﷻ অবস্থান কত উপরে এবং সে কত নিচে; আল্লাহর ﷻ অস্তিত্ব যে কত ব্যাপক, তাঁর ক্ষমতা যে কত বিশাল এবং সে আল্লাহর ﷻ তুলনায় কত দুর্বল একজন মামুলি সৃষ্টি—এগুলো তার খুব ভালো ভাবে জানা থাকার কথা। সৃষ্টি জগতের মধ্যে আল্লাহর ﷻ প্রতি সবচেয়ে বেশি বিশ্বাসী এবং সবচেয়ে বেশি অনুগতদের মধ্যে একজন হওয়ার কথা তার। কিন্তু এই সবকিছু দেখার, শোনার এবং জানার পরেও, সে কিভাবে আল্লাহর ﷻ আদেশের উপর সোজা ‘না’ করে দিল, সেটা এক বিস্ময়কর ঘটনা। কু’রআনে পরে কয়েকটি সূরায় আল্লাহ ﷻ ইবলিসের সাথে সেদিন তাঁর যে কথোপকথন হয়েছিল, তা আমাদেরকে জানিয়েছেনঃ
আল্লাহ বললেন, “ইবলিস, যাকে আমি নিজের হাতে সৃষ্টি করেছি, তার প্রতি তুমি অনুগত হতে পারলে না কেন? তুমি কি তখন অহংকার করছিলে, নাকি তুমি নিজেকে মহিমান্বিতদের একজন মনে করো?” – [সাদ ৩৮:৭৫]
স্রষ্টার কাছ থেকে এত কঠিন একটা প্রশ্ন সরাসরি শোনার পরে স্বাভাবিক ভাবেই ইবলিসের উচিৎ ছিল সাথে সাথে ক্ষমা চাওয়া এবং স্বীকার করা যে, সে বড় ভুল করে ফেলেছে, তাকে মাফ করে দেওয়া হোক। কিন্তু সে তা না করে উলটো আল্লাহকে ﷻ বোঝানোর চেষ্টা করলোঃ
সে বলল, “আমি ওর থেকে বড়। আপনি আমাকে আগুন থেকে বানিয়েছেন, আর ওকে বানিয়েছেন মাটি থেকে।” [সাদ ৩৮:৭৬]
ইবলিস কিন্তু বলতে পারতো, “আমি আপনার কত বছর থেকে ইবাদত করছি, আপনার কত কাছের আমি, আপনার প্রতি কত অনুগত, আর আপনি আমাকে বলছেন নতুন একজনের কাছে নত হতে?” অথবা সে বলতে পারতো, “আমাকে কেন ওই নতুন সৃষ্টির প্রতি অনুগত হতে হবে, তা আমাকে বুঝিয়ে বলবেন কি, যাতে আমি নিজেকে বোঝাতে পারি?” সে এর কোনোটাই করেনি। সে কার মুখের উপর ‘না’ বলছে, কাকে যুক্তি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করছে—সেটা সে ভুলে গিয়েছিল।
ইবলিসের এই মানসিকতা কিছু মানুষের মধ্যেও আছে। যেমন, চৌধুরী সাহেব মনে করেন: পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়া, ত্রিশটা রোজা রাখার আসলে কোনো দরকার নেই। এই সব নামায, রোজা শুধু ওই সব অর্ধ-শিক্ষিত, অল্প-জ্ঞানী ‘মোল্লা’ টাইপের মানুষদের জন্য দরকার, যারা এখনও তার মত চিন্তার গভীরতা এবং উপলব্ধির উচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেনি। সে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি পাওয়া একজন মানুষ। সৃষ্টিজগত, বিজ্ঞানের উপর কয়েক ডজন বই পড়েছেন। ডিসকভারি চ্যানেলে শখানেক ডকুমেন্টারি দেখেছেন। তিনি আল্লাহকে ﷻ যতটা গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারেন, সেটা সবাই পারে না। একারণেই তার মত মানুষদের এইসব গদ বাঁধা নামায, রোজার দরকার হয় না।
ইবলিস এবং এই চৌধুরী সাহেব টাইপের মানুষদের সমস্যা হচ্ছে: “আল্লাহ ﷻ প্রশ্নের ঊর্ধ্বে, সর্বশক্তিমান, একমাত্র প্রভু এবং আমি আল্লাহর ﷻ এক মামুলি দাস”—এটা তারা ঠিকভাবে নিজেকে বোঝাতে পারেনি। তারা আল্লাহকে ﷻ সৃষ্টিকর্তা মানে ঠিকই। কিন্তু তিনি যে প্রশ্নের ঊর্ধ্বে একজন প্রভু—এটা মানে না।
ইবলিস শুধু আল্লাহর ﷻ সাথে যুক্তিতর্কই করেই শেষ করেনি, তার মধ্যে কখনই কোনো ধরণের অনুশোচনা ছিল না। সে প্রথমত আল্লাহর ﷻ আদেশ অমান্য করল, তারপর আল্লাহকেই ﷻ সে যুক্তি দিয়ে বোঝানোর মতো ঔদ্ধত্য দেখাল, তারপর সারা জীবন মানুষকে ভুল পথে নেবার জন্য প্রতিজ্ঞা করলো। কিন্তু একবারও সে তার অহংকারকে দমিয়ে আল্লাহকে ﷻ বলতে পারলো না, “ও আল্লাহ্, আমি ভুল করে ফেলেছি, আমাকে মাফ করে দিন, আমাকে আর একটা বার সুযোগ দিন।” তার অহংকার এতই বেশি ছিল যে, সে চিরকালের জন্য জাহান্নামে যেতেও রাজি ছিল, কিন্তু তারপরেও সে কারো কাছে মাথা নত করবে না। এখানেই মানুষ এবং ইবলিসের মধ্যে পার্থক্য। মানুষ ভুল করে আল্লাহ্র ﷻ কাছে ক্ষমা চায়, যা আমরা আদম (আ) এর কাছ থেকে শিখেছি। কিন্তু একজন শয়তান ভুল করে আল্লাহ্র কাছে ক্ষমা চায় না।
আমরা ইবলিসের এই ঘটনা থেকে আর কিছু না শিখি, একটি জিনিস অন্তত আমাদের শেখা দরকার, সেটা হচ্ছে: অযৌক্তিক অহংকার না করা এবং অহংকারের চোটে অন্ধ হয়ে না যাওয়া। কত বার আমরা জীবনে মানুষের সাথে খামোখা তর্ক করেছি শুধুই তর্কে জেতার জন্য, এটা নিজের ভিতরে বোঝার পরেও যে, আমাদের যুক্তিতে, বোঝায় ভুল আছে? কতবার আমরা, বয়সে ছোট একজনের কাছে মাথা নত করবো না, এই অন্ধ অহংকারের ফলে অনেক ভালো উপদেশ, অনেক সাহায্য, সুযোগ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি? কতবার আমরা স্ত্রী বা ছেলে-মেয়েদের সাথে চরম দুর্ব্যবহার করেও, কোনোদিন তাদের কাছে একটি বারও মাফ চাইনি, পাছে আমাদের খানদানি সন্মান চলে যায় ভেবে? কতবার আমরা নিচের পদের কর্মচারী, বাসার কাজের লোক, ড্রাইভারদের সাথে অন্যায় ব্যবহার করেছি, কিন্তু সেটা পরে এক সময় বোঝার পরেও—“ওরা সস্তা মাটির তৈরি, আমি দামি মাটির তৈরি”—এই অহংকার বোধ থেকে একটি বারও তাদের কাছে গিয়ে নিজেদের দোষ স্বীকার করিনি? আমরা যদি নিজেদের অহংকারকে গিলে ফেলে যেটা করা উচিত সেটা করতে না পারি, মানুষের কাছে মাফ চাওয়ার জায়গায় গিয়ে মাফ চেতে না পারি, যেখানে নিজের দোষ মেনে নেওয়া দরকার সেখানে নিজের দোষ মেনে নিতে না পারি, তাহলে ইবলিস যে কাজ করেছিল, আমরাও সেটাই করছি। আল্লাহ্ ﷻ তাকে যেই পরিণতি দিয়েছেন, আমাদেরকেও সেই পরিণতি দিবেন। তাহলেই ইবলিস এবং আমাদের সাথে ন্যায়বিচার করা হবে।
শয়তান কিভাবে আপনাকে শেষ করে
শয়তান কখনও আপনাকে এসে বলবে না, “আমি শয়তান, আমি তোমাকে জাহান্নামে পুড়াতে চাই। আসো আমরা … করি।” ইবলিস এবং জ্বিন শয়তানরা মানুষের কাছে অদৃশ্য প্রাণী। তারা সাইন্স ফিকশনের ভাষায় কোন এক ‘প্যারালাল ইউনিভার্সে’ বা ‘অন্য ডাইমেনশনে’ থাকে, যেখান থেকে তারা ঠিকই আমাদেরকে দেখতে পায়, কিন্তু আমরা তাদেরকে দেখতে পাই না বা কোন বৈজ্ঞানিক যন্ত্র দিয়ে সনাক্ত করতে পারি না।
সে এবং তার অনুসারিরা তোমাদেরকে তাদের জায়গা থেকে দেখতে পায়, কিন্তু তোমরা তাদেরকে দেখতে পাওনা। [আ’রাফ ৭:২৭]
শয়তান মানুষের অবচেতন মনে কুচিন্তা বা কুমন্ত্রণা ঢুকিয়ে দেয়। আপনি সাবধানে লক্ষ না করলে বুঝতে পারবেন না আপনার মনের গভীরে যে চিন্তা গুলো চলছে তার কোনটা আপনি আর কোনটা শয়তান। সূরা নাসে আল্লাহ্ আমাদেরকে বলেছেন কিভাবে শয়তান কাজ করেঃ
তার অনিষ্ট থেকে, যে নিজেকে লুকিয়ে রেখে কুমন্ত্রণা দেয়, যে কুমন্ত্রণা দেয় মানুষের অন্তরে, জ্বিনের মধ্য থেকে এবং মানুষের মধ্য থেকে [নাস – ১১৪:৪-৬]
শয়তান এমন কৌশলে আপনার মনে কু-চিন্তা, অসুস্থ কামনা ঢুকিয়ে দেয় যে, আপনি মনে করবেন সেগুলো আসলে আপনার নিজেরই চিন্তা-ভাবনা, নিজের আবেগ এবং অনুভুতি। যেহেতু আপনি সবসময় শয়তানের ব্যাপারে সাবধান থাকেন না, তাই কখন যে শয়তান আপনার মধ্যে তার কুমন্ত্রণা ঢুকিয়ে দিয়ে আপনাকে দিয়ে তার কাজ করানো শুরু করে দেয়, তা আপনি ভুলে যান। একারণেই আল্লাহ্ আমাদেরকে সাবধান করেছেনঃ
যারা আল্লাহ্র প্রতি সচেতন থাকে, যখনি তাদের মনে শয়তান কোন কু-চিন্তা দেয়, তারা সাথে সাথে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং তখনি তারা পরিস্কার দেখতে পায় কি ঘটছে। [আ’রাফ ৭:২০১]
আল্লাহ্ আমাদেরকে একটা চমৎকার ফর্মুলা শিখিয়ে দিয়েছেন কিভাবে শয়তানকে প্রতিহত করতে হবে। যখনি অনুভব করা শুরু করবেন যে, আপনি যেই কাজটা করছেন তা করা ঠিক হচ্ছে না, সাথে সাথে আল্লাহ্র কথা মনে করুন, মনে মনে বলুন, “আউ’যু বিল্লাহি মিনাশ শাইতা’নির রাজিম” – “আমি আল্লাহ্র কাছে সাহায্য চাই বিতারিত শয়তানের কাছ থেকে”। দ্রুত কোন কু’রআনের আয়াত মনে করার চেষ্টা করুন যেটা আপনার পরিস্থিতির সাথে মিলে যায়। যেমন আপনি কারও প্রতি দুর্বলতা অনুভব করছেন, এমন দিকে তাকাচ্ছেন যেদিকে আপনার তাকানোর কথা না, সাথে সাথে নিজেকে মনে করিয়ে দিন-
বিশ্বাসী পুরুষদেরকে বল যেন তারা তাদের দৃষ্টি নত রাখে এবং তাদের গোপন অঙ্গকে সাবধানে রক্ষা করে, এটা তাদের জন্যই বেশি কল্যাণকর। আল্লাহ্ খুব ভালো করে জানেন তোমরা কি কর। বিশ্বাসী নারীদেরকে বল যেন তারা তাদের দৃষ্টি সংযত রাখে এবং তাদের গোপন অঙ্গকে সাবধানে রক্ষা করে … [নুর ২৪:৩০]
তবে দরকারের সময় জরুরি কোন আয়াত মনে করাটা খুব কঠিন, যদি না আপনি নিয়মিত কিছু জরুরি আয়াত ঝালিয়ে না নেন। সেজন্য আমার এই আর্টিকেলটি পড়তে পারেন, যেখানে দৈনন্দিন জীবনে কাজে লাগে এরকম কিছু অসাধারণ উপদেশ সহ আয়াতের তালিকা রয়েছে। তবে আপনি যেন আল্লাহ্র উপদেশ মনে রাখতে না পারেন, সে জন্য শয়তান যথাসাধ্য চেষ্টা করবে, কারণ তার প্রথম সাফল্যের ঘটনা ছিল আদম (আ) ভুলিয়ে দেওয়া আল্লাহ্ তাকে কি করতে মানা করেছিলেন। শয়তানের মানুষকে দিয়ে খারাপ কাজ করানোর একটি মোক্ষম উপায় হলঃ
আপনাকে ভুলিয়ে দিবে আপনার কি করা উচিত না
ইনসান শব্দটির একটি অর্থ হল – যে ভুলে যায়। মানুষ ভুলে যায়, এটা তার একটা বিরাট দুর্বলতা। মানুষ যদি সবসময় সবকিছু মনে রাখতে পারতো, তাহলে সে আল্লাহ্র বাণী জানার পরেও খারাপ কাজ কমই করতো। আপনি যখন টিভি ছেড়ে হিন্দি সিরিয়াল দেখা শুরু করেন, তখন যদি সাথে সাথে শখানেক কু’রআনের আয়াত হুবুহু মনে পড়ে যায়, তাহলে আপনি নিশ্চয়ই আর টিভি দেখা চালিয়ে যেতে পারবেন না। আপনি যখনি ফেইসবুকে বসে খুঁজে দেখছেন আপনার ফ্রেন্ড লিস্টে কয়জন মেয়ে আছে এবং তাদের ছবিতে কোন ছেলেকে সাথে দেখা যায় কি না, তখন যদি সাথে সাথে আপনার কানে বাজতে থাকতোঃ
বিশ্বাসী পুরুষদেরকে বল যেন তারা তাদের দৃষ্টি নত রাখে এবং তাদের গোপন অঙ্গকে সাবধানে রক্ষা করে, এটা তাদের জন্যই বেশি কল্যাণকর। [নুর ২৪:৩০]
তাহলে আপনি নিশ্চয়ই সেটা চালিয়ে যেতেন না। মানুষ ভুলে যায়। দরকারের সময় যেটা মনে করা দরকার সেটা মনে করতে পারে না। আর এটা শয়তানের একটা বিরাট সুযোগ মানুষকে দিয়ে খারাপ কাজ করানোর। শয়তান যতভাবে পারে চেষ্টা করে আপনাকে আল্লাহ্র নিষেধ মনে রাখতে না দেবার, আপনার মাথায় রাজনীতি, মারামারি, ধর্ষণ, মন্ত্রীদের কোটি টাকা আত্মসাৎ, গত দশটি সিরিজের কোন খেলোয়াড়ের স্কোর কত, কোন তারকা কোন ধরণের সালওয়ার-কামিজ পছন্দ করে ইত্যাদি হাজারো ধরণের আবর্জনা তথ্য দিয়ে আপনার মস্তিস্ক ভরিয়ে ফেলা, যাতে করে আল্লাহ্ আপনাকে কি করতে বলেছেন এবং কি করতে মানা করেছেন, সেটা মনে রাখতে না পারেন। শয়তান আপনাকে প্রতিদিন সকালে খবরের কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বলে – ‘যাও, মাথা ভর্তি ফালতু সব জিনিসপত্র ঢুকাও যেগুলো তোমার কোন কাজে আসবে না।’ আপনি হয়তো বছরে একটা ভালো আর্টিকেল বা বই পড়লেন, কিন্তু তারপর শয়তান আপনাকে দশটা মুভি দেখিয়ে আপনার ব্রেইনের কোটি কোটি নিউরন আবর্জনা দিয়ে ভরে ফেললো এবং যা কিছু ভালো শিখেছিলেন তার কিছুই যেন মস্তিষ্কে অবশিষ্ট না থাকে তার জন্য আরও বিশটা হিন্দি বা ইংরেজি সিরিয়াল ঢুকিয়ে দিলো। এরপর আপনি যখনি একা বসে থাকেন বা রাতে বিছানায় শুতে যান, আপনার তখন আর আল্লাহ্র কথা মনে পড়ে না বা কু’রআনের কোন বাণী কানে বাজে না বরং আপনার কানে বাজে মুভির ডায়ালগ, চোখ বন্ধ করলে কোন মুভির নাচ-গান বা মারামারির দৃশ্য ভেসে উঠে এবং আপনি মুখে কোন হিন্দি গান গুন গুন করতে থাকেন।
চেষ্টা করুন শয়তান যেন আপনাকে ভালো কথা, ভালো উপদেশ, কু’রআনের বাণী ভুলিয়ে দিতে না পারে। একারণেই আল্লাহ্ আমাদেরকে ৫ ওয়াক্ত নামায বুঝে শুনে, গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়তে বলেছেন, যাতে করে আমরা ভালো জিনিসগুলো ভুলে না যাই। কিন্তু আপনি সেটা করতে পারেন না, কারণ শয়তান আপনাকে –
বিনোদনে ডুবিয়ে রাখে
এই যুগের প্রজন্মের এক ভয়াবহ সমস্যা দেখা দিয়েছে, যেটা আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখন এতোটা খারাপ অবস্থা ছিল না। আজকালকার কিশোর, তরুণরা বাসায় এসে ঘণ্টা খানেক মোবাইল ফোনে গেম খেলে, তারপর ঘণ্টা খানেক এক্সবক্স/প্লেস্টেশন/নিন্টেন্ডো-উই, তারপর ঘণ্টা খানেক টিভি, তারপর ঘণ্টা খানেক ফেইসবুক, ইউটিউব, তারপর ঘণ্টা খানেক মোবাইলে বন্ধু-বান্ধবের সাথে বেহুদা আড্ডা মারে। এই সব শেষ হলে ঘুম, পরের দিন স্কুল/কলেজ/চাকরি এবং বাসায় এসে আবারো সেই মোবাইল ফোন, ভিডিও গেম, টিভি, কম্পিউটার, ফোন। এতো কিছু করার পড়ে তাদের আর ভালো কিছু করার সময় থাকবে কোথায়? আগের প্রজন্মের যেমন মাদকাসক্তি ছিল, সেরকম আজকের প্রজন্মের ‘বিনোদনাসক্তি’ মহামারির পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। একদিন টিভি না দেখে এরা থাকতে পারে না। সকালে, বিকালে, রাতে কখন ফেইসবুকে যাবে, তার জন্য জান আকুপাকু করতে থাকে। মোবাইল ফোন নষ্ট হয়ে গেলে এরা ডিপ্রেশনে চলে যায়।
আজকাল আর শয়তানদেরকে বেশি কষ্ট করতে হয় না। মানুষ নিজেই নিজেকে ধ্বংস করার জন্য এতো ব্যবস্থা করে ফেলেছে যে, শয়তানরা আরামে বসে উপভোগ করতে থাকে কিভাবে একজন বাবা-মা তার সন্তানদেরকে মোবাইল ফোন কিনে দিয়ে শয়তানের কাজ করে দিচ্ছে। কিভাবে বাবা-মারা সমাজে নাক উঁচু রাখার জন্য সন্তানদেরকে খুনাখুনির ভিডিও গেম, নিজের ঘরে যা খুশি করার জন্য ব্যক্তিগত কম্পিউটার এবং অবাধ ইন্টারনেটের সংযোগ এনে দিয়ে সন্তানদেরকে মানুষ থেকে শয়তান বানিয়ে দিচ্ছে। মানব জাতিকে নৈতিকভাবে ধ্বংস করে মানুষরূপী শয়তান দিয়ে পৃথিবী ভরিয়ে ফেলার যে মহাপরিকল্পনা শয়তানের রয়েছে, তা বাস্তবায়নে অধিকাংশ মানুষ নিয়মিত নিষ্ঠার সাথে বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করে যাচ্ছে।
আজকাল টিভি, কম্পিউটার, মোবাইল ফোন, ভিডিও গেম ছাড়া মানুষ নিজেদেরকে ছোট মনে করে। মাত্র ৩০ বছর আগেও মানুষের এগুলো কিছুই ছিল না। কিন্তু আজকাল এগুলো না থাকলে এমন অবস্থা হয় যে, মানুষ নিজেদেরকে নিচু শ্রেণীর মনে করা শুরু করে। এর কারণ হল শয়তানের আরেকটি অন্যতম কৌশল –
আল্লাহ্র প্রতি কৃতজ্ঞ হতে না দেয়া
আল্লাহ্ যখন শয়তানকে তার সান্নিধ্য থেকে বের করে দিচ্ছিলেন, তখন শয়তান একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ শপথ করেছিল, যা থেকে তার মানুষকে ধ্বংস করার অন্যতম একটি প্রধান পদ্ধতি সম্পর্কে জানা যায়ঃ
(শয়তান বলল) “আমি মানুষের কাছে আসব ওদের সামনে থেকে, ওদের পেছন থেকে, ওদের ডান দিক থেকে এবং ওদের বাম দিক থেকে। আপনি দেখবেন ওরা বেশিরভাগই কৃতজ্ঞ না। [আ’রাফ ৭:১৭]
কু’রআনে আল্লাহ্ প্রায় ৬০টি আয়াতে কৃতজ্ঞতার গুরুত্ব সম্পর্কে বলেছেন। এর মধ্যে একটি বিখ্যাত আয়াত হলঃ
মনে পড়ে তোমাদের প্রভু কথা দিয়েছিলেন, “যদি তোমরা কৃতজ্ঞ হও, তাহলে আমি তোমাদেরকে আরও দিতেই থাকবো। কিন্তু তোমরা যদি অকৃতজ্ঞ হও, তাহলে আমার শাস্তি কঠিন। [ইব্রাহিম ১৪:৭]
এখানে আল্লাহ্ আমাদেরকে কথা দিয়েছেন যে, যদি আমরা কৃতজ্ঞ হই, তাহলে আল্লাহ্ আমাদেরকে দিতেই থাকবেন।
নিশ্চয়ই শয়তান চাইবে না আপনি জীবনে আরও বেশি পান, আরও ভালো থাকেন। একারণে শয়তানের সবসময় চেষ্টা থাকে কিভাবে আপনাকে অসুস্থ বিনোদনে বুঁদ করে রাখা যায়, যেই বিনোদন আপনাকে কখনই পরিতৃপ্তি দেয় না। কিভাবে আপনাকে ভুলিয়ে দেওয়া যায় যে, আল্লাহ্র অনুগ্রহে আপনি জীবনে কত কিছুই না পেয়েছেন।
কেন আল্লাহ্ আমাদেরকে কৃতজ্ঞ হতে বলেন? তাঁর তো আমাদের কাছ থেকে কিছুই পাবার দরকার নেই। আমরা কৃতজ্ঞ হই আর না হই, তাতে তো তাঁর কোন লাভ নেই। তাহলে কৃতজ্ঞ হয়ে কি লাভ?
গত বছর টাইম ম্যাগাজিনের নভেম্বর সংখ্যায় একটি আর্টিকেল বের হয়েছে কৃতজ্ঞতার উপকারিতার উপরে। সেখানে বলা হয়েছে, ২০০৩ সালে ২৬১৬ প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের উপরে গবেষণা করে দেখা গেছে, যারা অপেক্ষাকৃত বেশি কৃতজ্ঞ, তাদের মধ্যে মানসিক অবসাদ, দুশ্চিন্তা, অমূলক ভয়-ভীতি, অতিরিক্ত খাবার অভ্যাস এবং মদ, সিগারেট ও ড্রাগের প্রতি আসক্তির ঝুঁকি অনেক কম। আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে মানুষকে নিয়মিত আরও বেশি কৃতজ্ঞ হতে অনুপ্রাণিত করলে, মানুষের নিজের সম্পর্কে যে হীনমন্যতা আছে, নিজেকে ঘৃণা করা, নিজেকে সবসময় অসুন্দর, দুর্বল, উপেক্ষিত মনে করা – ইত্যাদি নানা ধরণের সমস্যা ৭৬% পর্যন্ত দূর করা যায়।
২০০৯ সালে ৪০১ জন মানুষের উপর গবেষণা করা হয় যাদের মধ্যে ৪০% এর ক্লিনিকাল স্লিপ ডিসঅর্ডার অর্থাৎ জটিল ঘুমের সমস্যা আছে। তাদের মধ্যে যারা সবচেয়ে বেশি কৃতজ্ঞ, তারা বেশি ঘুমাতে পারেন, তাদের ঘুম নিয়মিত হয়, রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েন এবং দিনের বেলা ক্লান্ত-অবসাদ কম থাকেন।
নিউইয়র্কের Hofstra University সাইকোলজির অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর ডঃ জেফ্রি ফ্রহ ১০৩৫ জন ১৪-১৯ বছর বয়সি শিক্ষার্থীর উপর গবেষণা করে দেখেছেন যারা কৃতজ্ঞ বেশি, তাদের পরীক্ষায় ফলাফল অপেক্ষাকৃত বেশি ভালো, সামাজিক ভাবে বেশি মেলামেশা করে এবং হিংসা ও মানসিক অবসাদে কম ভোগে।
Wall Street Journal একটি আর্টিকেলে বলা হয়েছেঃ
Adults who frequently feel grateful have more energy, more optimism, more social connections and more happiness than those who do not, according to studies conducted over the past decade. They’re also less likely to be depressed, envious, greedy or alcoholics. They earn more money, sleep more soundly, exercise more regularly and have greater resistance to viral infections.
এবার বুঝতে পারছেন কেন আল্লাহ্ আমাদেরকে প্রতিদিন ৫ ওয়াক্তে কমপক্ষে ১৭ বার বলতে বলেছেনঃ
আলহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আ’লামিন – সমস্ত প্রশংসা এবং ধন্যবাদ আল্লাহ্র যিনি সৃষ্টি জগতের প্রভু। [ফাতিহা ১:২]
আল্লাহ্ আমাদের প্রত্যেককে অসংখ্য নিয়ামত দিয়েছেন, কিন্তু তারপরেও আমরা তার প্রতি কৃতজ্ঞ হই না। বরং সবসময় দুশ্চিন্তায় থাকি কখন সেগুলো হারিয়ে ফেলব। আর এই কাজটা শয়তান করে আমাদেরকে –
সবসময় সন্মান, সম্পত্তি হারানোর ভয়ে রাখে
মানুষকে অভাবের ভয় দেখানোর পদ্ধতিটি শয়তান হাজার হাজার বছর থেকে সফল ভাবে প্রয়োগ করে আসছে। আজো কোটি কোটি মানুষ কাজ করতে করতে তাদের জীবন শেষ করে ফেলে যত পারা যায় সম্পত্তি জমানোর জন্য, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কবরে যায় নগ্ন হয়ে একটা সাদা চাঁদর জড়িয়ে; সমস্ত সম্পত্তি, উপাধি, ক্ষমতা পিছনে ফেলে। যাদের ঈমান দুর্বল, শয়তান তাদেরকে সবসময় এসব কিছু হারানোর ভয়ে রাখে, যাতে করে তারা আল্লাহ্র উপর ভরসা হারিয়ে ফেলে। যার ফলে মানুষ হয় কিপটা হয়ে জীবন পার করে, না হয় সম্পত্তি ধরে রাখার জন্য এমন কোন খারাপ কাজ নাই যেটা করে না, এমন কি সেটা ছাত্রলীগ বা ছাত্রদলের সোনার ছেলেদেরকে পোষার মতো জঘন্য কাজ করে হলেও। শয়তানের এই পদ্ধতিকে আল্লাহ্ কু’রআনে বলেছেনঃ
শয়তান তোমাদেরকে অভাবের ভয় দেখায় এবং জঘন্য কাজের নির্দেশ দেয়, যেখানে আল্লাহ্ তোমাদেরকে তাঁর ক্ষমা এবং অনুগ্রহের নিশ্চয়তা দেন। আল্লাহ্ সীমাহীন এবং তিনি সবকিছু জানেন। [বাকারাহ ২:২৬৮]
মানুষ মনে প্রাণে যা চায়, তাকে সেটা পাওয়ার লোভ দেখিয়ে ফাঁদে ফেলার পদ্ধতিটি শয়তান একদম প্রথম মানুষ আদম (আ) এর উপর থেকে চালিয়ে আসছে। সে আদম (আ) কে লোভ দেখিয়েছিল ঠিক যা তার পাবার আকাঙ্ক্ষা ছিলঃ
তারপর শয়তান তাকে কুমন্ত্রণা দিয়ে বলল, “আদম, আমি কি তোমাকে অনন্ত জীবন লাভের জন্য এক বৃক্ষের সন্ধান দিব এবং এক রাজত্ব যা কখনও শেষ হয় না?” [তাহা ২০:১২০]
শয়তান ভালো করে জানতো তখন আদমের (আ) ঠিক কি দরকার ছিল। আল্লাহ্ আদমকে (আ) অফুরন্ত খাবার এবং শান্তি দিয়েছিলেন। কিন্তু তারপরেও তার দুটা জিনিস ছিল না – অমরত্ব এবং চিরস্থায়ী রাজত্ব। সে জানতো যে সে একজন মানুষ এবং তাকে একদিন মারা যেতে হবে এবং তখন সে তার এই সব সুখ, অফুরন্ত খাবার, তার সঙ্গি – সবকিছু সে হারিয়ে ফেলবে। শয়তান খুব ভালো করে বুঝতে পেরেছিল আদমকে কিসের কথা বললে সে আর লোভ সামলাতে পারবে না।
এখন আপনি মনে করতে পারেন – ‘আমি তো আর আদম না, আমাকে শয়তান কোন লোভ দেখায় না, আমি যা করি, নিজেই চিন্তা ভাবনা করে করি।’ কখনও এরকম হয়েছে – আপনি একটা নতুন গাড়ি বা বাড়ি কেনার জন্য সিদ্ধান্ত নিলেন। তার জন্য আপনি বাড়তি কাজ করা শুরু করলেন, চাকরির পাশাপাশি একটা ব্যবসা চালু করলেন, আপনার বাবা-মা, পরিবার, সন্তানদেরকে সময় না দিয়ে, তাদের চাওয়া-পাওয়া, আনন্দ, ভালবাসা উৎসর্গ করলেন আরেকটু বেশি আরাম, সুখ এবং নিরাপত্তার স্বপ্নের জন্য? দিনরাত কাজ করে নিজের শরীরের বারোটা বাজালেন, পরিবারে অশান্তি সৃষ্টি করলেন, আপনার সন্তানদেরকে যখন সময় দেওয়ার কথা তখন সময় না দিয়ে তাদেরকে নষ্ট হয়ে যেতে দিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গিয়ে দেখা গেল আপনার ব্যবসাটা আর সফল হল না বা আপনার বাড়তি চাকরিটা বেশিদিন থাকলো না। মাঝখান থেকে আপনার আমও গেল, ছালাও গেল। কিন্তু এসব কিছু না করে আপনি যদি আপনার প্রথম চাকরিটা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতেন, আল্লাহ্র প্রতি আস্থা রাখতেন, কাজের বাইরে যতটুকু সময় পাচ্ছেন তা ইসলাম শিখে, নিজের পরিবারকে সময় দিয়ে পার করতেন, তাহলে হয়তো প্রথম চাকরিতেই আপনি পদোন্নতি পেতেন, সংসারে শান্তি পেতেন, নিজের এবং পরিবারের জন্য জান্নাত নিশ্চিত করতে পারতেন।
মনে রাখবেন শয়তান সবসময় আপনাকে আরও চাওয়ার, আরও পাবার জন্য উৎসাহ দিবে। আপনার জীবনে যতই থাকুক, আপনি আরও চাইবেন, আপনার সবসময় আরও কিছু পাবার একটা জেদ থাকবে। কারণ আপনি যখন আপনার জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট হয়ে যাবেন, তখন আপনি ধিরস্থির হয়ে যাবেন এবং আল্লাহ্র কথা ভাবা শুরু করবেন। যার ফলে আপনার ভেতরে প্রশান্তি আসবে এবং তা আপনার পরিবারের মধ্যে ছড়িয়ে পরবে। তখন আপনার পরিবারের মধ্যে আর অশান্তি হবে না। আপনার ছেলে মেয়ে গুলো সুস্থ পরিবারে বড় হয়ে আদর্শ মানুষ হবে। তখন তারা সমাজের মধ্যে সুখ, শান্তি ছড়িয়ে দিবে। শয়তান কোনভাবেই চায় না এর কোনোটাই হোক। তাই যেভাবেই হোক শয়তান কখনও আপনাকে জীবনে ধিরস্থির হয়ে, নিজেকে নিয়ে ভাবার, আল্লাহকে নিয়ে ভাবার, পরিবারকে নিয়ে ভাবার সুযোগ হতে দিবে না। এর সবচেয়ে মোক্ষম উপায় হল, আপনাকে একটা নতুন মডেলের টয়োটা গাড়ি কেনার জন্য পাগল করে দেওয়া। একটা নতুন মডেলের Intel i7 ল্যাপটপ কিনে লোকজনকে দেখানোর জন্য অস্থির করে দেওয়া। ২০ ইঞ্চি টিভিটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফেলে দিয়ে একটা ৪০ ইঞ্চি টিভি কেনার জন্য তাগাদা দেওয়া, যেন আপনি আপনার প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধবের সামনে মুখ দেখাতে পারেন। শয়তানের আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে আপনাকে:
আল্লাহ্র কথা ভুলিয়ে দেওয়া
কিছু মানুষ আছে যাদের উপর শয়তান পুরোপুরি দখল করে নিয়েছে। এধরনের মানুষের চিন্তা-ভাবনা, কাজকর্ম, অনুভুতি, আবেগ – সবকিছুই শয়তানের দখলে চলে গেছে। এরা কথা বললে খারাপ কথা বলে যা শুনলে মানুষ কষ্ট পায়, বিভ্রান্ত হয়ে যায়, মানুষে মানুষে সমস্যা তৈরি হয়। এদের কাজগুলো বেশিরভাগই হারাম কাজ। যেমন টিভি দেখলে এরা দেখে তারকাদের সাক্ষাতকার, মিউজিক শো, ড্যান্স কম্পিটিশন, নানা ধরণের অসুস্থ সিরিয়াল। মুভি দেখলে দেখে সব মারামারি, খুনাখুনি, হরোর মুভি, না হয় হারাম প্রেম-ভালবাসা, পরকীয়ার মুভি। খবরের কাগজে এরা সব হারাম খবর পড়ে – কে কবে কাকে কি গালি দিলো, কে কাকে ধর্ষণ করলো, কোন মডেলের ছবিতে শরীরের কতখানি দেখা যায়। কম্পিউটারে বসলে এরা চুরি করা সফটওয়্যার ব্যবহার করে। ইন্টারনেটে গেলে এরা বেশিরভাগ সময় পর্ণ, সিনেমা, সিরিয়াল; না হয় ফেইসবুকে পরকীয়া, অবৈধ মেলামেশা, ডেটিং সাইটে মিথ্যা যোগ্যতা দিয়ে অন্যদেরকে পটানোর চেষ্টা করে। মোবাইল ফোনে বন্ধু বান্ধবের সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গীবত, এর নামে ওকে লাগানো, গোপন খবর ফাঁস করে দেওয়া। এভাবে এরা প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠার পর থেকে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত যত ধরণের শয়তানী কাজ করা যায়, তার সবই করে। এরা তাদের মস্তিস্কের নিয়ন্ত্রণ শয়তানের হাতে দিয়ে দিয়েছে। তাদের চালকের আসনে আর তার বিবেক বসে নেই, বসে আছে শয়তান। এদের সম্পর্কে আল্লাহ্ বলেছেনঃ
শয়তান এদের উপরে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে এবং তাদেরকে আল্লাহ্র কথা ভুলিয়ে দিয়েছে। এরা শয়তানের দল। সাবধান! এই শয়তানের দল একদিন ধ্বংস হয়ে যাবেই। [মুজাদিলা ৫৮:১৯]
এই ধরণের মানুষদের সম্পর্কে সাবধান। আল্লাহ্ এদেরকে শয়তানের দল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এরা আর সাধারণ মানুষ নেই। আল্লাহ্র দৃষ্টিতে এরা মানুষরূপী শয়তান। সে আপনার বাবা-মা, ভাইবোন, ছেলে-মেয়ে যেই হোক না কেন, সাবধানে থাকবেন যেন তাদেরকে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে বা তাদের সাথে তাল মিলিয়ে থাকতে গিয়ে আপনি আল্লাহকে সন্তুষ্ট রাখার কথা ভুলে না জান, আল্লাহ্র বিরুদ্ধে কাজ করা শুরু না করেন। আপনাকে সবসময় মনে রাখতে হবে, আপনি পৃথিবীতে এসেছেন আল্লাহকে খুশি রেখে নিজে ভালো থাকার জন্য। আল্লাহ্র বিনিময়ে অন্যদেরকে খুশি রাখার জন্য নয়। তাই কখনও আপনার নষ্ট হয়ে যাওয়া স্বামী বা স্ত্রীর জন্য নিজের জীবন শেষ করে দিবেন না। কখনও বাবা-মার অন্যায়ের সমর্থনে নিজেকে এবং নিজের পরিবারকে শেষ করবেন না। মানুষরূপী শয়তান বসের হয়ে জঘন্য কাজ করে নিজের উপরে আল্লাহ্র আক্রমণ ডেকে আনবেন না। এদের কাছ থেকে সসন্মানে সরে আসুন, কারণ আল্লাহ্ আমাদেরকে সাবধান করেছেন –
তুমি এমন কাউকে পাবে না যারা সত্যিই প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ এবং শেষ বিচার দিনে বিশ্বাস করে, কিন্তু একই সাথে তাদেরকেও ভালবাসে যারা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসুলের বিরুদ্ধে যায়, যদিও কিনা তারা তাদেরই বাবা, ছেলে, ভাই বা নিজেদের কোন দল বা জাতির হয়। [মুজাদিলা ৫৮:২২]
– ওমর আল জাবির