রিয়া বা লৌকিকতা
রিয়া বা লৌকিকতা সৎআমল বিধ্বংসী নীরব ঘাতক। মনের অজান্তেই মানুষের অন্তরে এই রোগ বাসা বাঁধে। এটি মুখোশধারী প্রতারক। যে অবগুণ্ঠনের আড়ালে তার বীভৎস চেহারা আড়াল করে রাখে। মানুষকে দেখানো বা শুনানোর জন্য যখন কোন সৎকর্ম বা ইবাদত সম্পাদিত হয়, তখন সেটি ইখলাছ ও অন্তসারশূন্য হয়ে পড়ে। আমলের খোলস থাকে বটে কিন্তু তার ভিতরে কোন সারবত্তা থাকে না। একজন পাক্কা মুছল্লী ও তাহাজ্জুদগুযার ব্যক্তিও যেকোন মুহূর্তে আক্রান্ত হ’তে পারে প্রদর্শনেচ্ছার এই দুরারোগ্য ব্যাধিতে। নানান বর্ণে ও রূপে ক্ষণে ক্ষণে রং পরিবর্তন করে এই জাতশত্রু হাযির হয় মুমিন-মুসলিমের মানস্পটে।
রিয়া (الرِّيَاءُ) আরবী শব্দ, যার অর্থ লৌকিকতা, প্রদর্শন, কপটতা প্রভৃতি। ‘কোন জিনিসের আসলের বিপরীত প্রকাশ করা’। অর্থাৎ, আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে ইবাদত সম্পাদন না করে লোক দেখানোর জন্য বা কোন দুনিয়াবী স্বার্থ হাছিলের জন্য কর্ম সম্পাদন করাকে রিয়া বলে।
প্রকাশগত দিক থেকে রিয়া পাঁচ প্রকার। যথা :-
১. দৈহিক রিয়া
মানুষ ইবাদতকারী ও পরকালের ভয়ে ভীত ভাববে মনে করে নিজের শরীরকে জীর্ণ-দুর্বল ও বিবর্ণ-ফ্যাকাশে হিসাবে প্রকাশ করা। মাথার চুলগুলোকে এলোমেলো রাখা। যাতে মানুষ মনে করে, এই ব্যক্তি দ্বীনের বিষয় নিয়ে এতই চিন্তামগ্ন যে, সে তার কেশ বিন্যাস করার সুযোগ পায়নি। এই ধরনের লৌকিকতাকে দৈহিক রিয়া বলা হয়। কণ্ঠস্বর নীচু করা, চোখ দু’টিকে গর্তে ঢুকিয়ে দেয়া, ঠোঁট দু’টিকে শুষ্ক দেখানোর প্রবণতার মাধ্যমেও রিয়া হতে পারে। যদি এর মাধ্যমে নিজেকে ছায়েম বা রোযাদার হিসাবে যাহির করার মনোবাসনা থাকে।
২. পোষাকী রিয়া
জীর্ণ-শীর্ণ ও জোড়া-তালি দেওয়া পোষাক পরিধান করা। যাতে মানুষ তাকে দুনিয়ার প্রতি নিরাসক্ত বা দুনিয়াত্যাগী বলে। অথবা আলেমদের পোষাক পরা। যেন মানুষ তাকে আলেম বলে। ইবনুল জাওযী এ ধরনের ভন্ড যাহেদ বা দরবেশ-সন্ন্যাসীদের সম্পর্কে বলেছেন, ‘আমাদের কালের দরবেশ-সন্ন্যাসীদের মধ্যে অহংকার, বাহ্যিক রীতি-নীতির প্রকাশ ও সাধারণ মানুষের অন্তরে স্থান করে নেওয়ার প্রবণতা দেখে আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি যে, এরা রিয়াকারী ও মুনাফিক’। তাদের কাউকে আপনি দেখবেন যে, মানুষ তাকে দরবেশ ও দুনিয়াত্যাগী মনে করবে এমন পোষাক পরিধান করে। অথচ ভালো ভালো খাবার খায়, দেশবাসীর উপর বড়াই করে, ধনীদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করে, গরীব-মিসকীনদেরকে এড়িয়ে চলে, মাওলানা সম্বোধনে ডাকা পসন্দ করে, হেলেদুলে হাঁটে, অনর্থক ক্রিয়াকলাপে সময় নষ্ট করে এবং মানুষের দয়া-দাক্ষিণ্যের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে’।
ইবনুল জাওযী আরো বলেন, ‘যদি তাদের কাজকর্ম তাদের পোষাকের সাথে মানানসই হত তাহলে হয়তো ব্যাপারটি স্বাভাবিক মনে হত। কিন্তু তারা এমন ব্যক্তির কাছে এসব ছদ্মবেশ ধারণ করেছে, যে তাদের সম্পর্কে সম্যক অবগত। তাহলে মহান স্রষ্টা তো তাদের সম্পর্কে আরো বেশী অবগত’?১
হাঁটার সময় মাথা নীচু করা, চেহারায় সিজদার চিহ্ন প্রকাশ করা, ছূফীদের মত মোটা, খসখসে ও নীল রংয়ের পোষাক পরিধান করা, কাপড় অত্যধিক গুটিয়ে পরা, জামার হাতা অতিরিক্ত খাটো করা প্রভৃতিও এ প্রকারের অন্তর্ভুক্ত।
৩. বাচনিক রিয়া
সাধারণত ধার্মিক ব্যক্তিরা মানুষকে ওয়ায-নছীহত করা, ইলমী গভীরতা প্রকাশ, বাহাছ-মুনাযারা ও বিতর্কে নিজেকে যাহির করার জন্য বিভিন্ন হাদীছ, আছার ও উদ্ধৃতি উল্লেখের মাধ্যমে বাচনিক রিয়ায় জড়িয়ে পড়েন। রাস্তা-ঘাটে এবং হাটে-বাজারে তাসবীহ হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো, জনসম্মুখে ঠোঁট নাড়িয়ে যিকির করা, দুনিয়াবাসীর উপর ক্ষোভ প্রকাশ করা, নিজের পাশে মানুষের উপস্থিতি টের পেয়ে কুরআন তেলাওয়াতের সময় স্বর নিম্ন ও নরম করা প্রভৃতি বাচনিক রিয়ার অন্তর্ভুক্ত। এজন্য আধুনিক লেখক ও গবেষক ড. সাইয়িদ বিন হুসাইন আল-‘আফফানী বলেন, ‘কথার মাধ্যমে নানা ধরনের রিয়া সংঘটিত হয়ে থাকে। এর প্রকার-প্রকরণ অগণিত’।২
৪. আমলগত রিয়া
লোক দেখানোর জন্য ছালাতে মুছল্লীর দীর্ঘ ক্বিয়াম বা দাঁড়িয়ে থাকা, রুকু-সিজদা লম্বা করা এবং বিনয়-নম্রতা প্রকাশ করা। এজন্য ইবনু কুদামা আল-মাকদেসী বলেছেন, ‘যদি মুছল্লী মানুষের সামনে সুন্দর করে ছালাত আদায় করে এজন্য যে, ছালাতের মধ্যে তার একাগ্রতা আছে বলে মানুষ মনে করবে, তাহলে এর মাধ্যমে সে নিজেকে রিয়াকারী হিসাবে প্রমাণ করবে’।৩
অনুরূপভাবে লোক দেখানোর জন্য দান-ছাদাক্বাহ করা এবং ছিয়াম ও হজ্জ পালন করা।
৫. সাহচর্যগত রিয়া
যেমন কোন ব্যক্তির কোন আলেমকে তার সাথে সাক্ষাতের আহবান জানানো। যাতে বলা হয়, অমুক আলেম অমুক ব্যক্তির সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। মানুষকে তার সাথে সাক্ষাতের জন্য দাওয়াত দেওয়া। যেন বলা হয়, দ্বীনদার-পরহেযগার ব্যক্তিরা তার বাড়িতে যাতায়াত করেন। অনুরূপভাবে অনেকে শায়েখ বা শিক্ষকের সংখ্যা বেশী হওয়া নিয়ে গর্ব করে।
তর্ক-বিতর্কের সময় নিজের ইলমী যোগ্যতা ও পান্ডিত্য যাহির করার জন্য বলে, আমি অমুক অমুক শায়েখের সাথে সাক্ষাৎ করেছি। আমার শিক্ষকের সংখ্যা বহু। তুমি কোন কোন শায়েখের সাথে সাক্ষাৎ করেছ? তোমার ওস্তাদের সংখ্যা কয়জন প্রভৃতি।৪ ইবনু কুদামা আল-মাকদেসী বলেন, ‘রিয়াকারীরা যে সকল বিষয় লোকদের দেখায় এগুলি হল তার সারনির্যাস। এর মাধ্যমে তারা মান-মর্যাদা লাভ ও মানুষের অন্তরে জায়গা করে নেওয়ার কামনা রাখে’।৫
পরিশেষে বলা যায়, অনুক্ষণ চরিত্র বদলের ফলে রিয়া বা লৌকিকতা থেকে আত্মরক্ষা করা অত্যন্ত দুঃসাধ্য ব্যাপার। বিভিন্নভাবে নানান মোড়কে রিয়ার আত্মপ্রকাশ ঘটে থাকে। রিয়ার প্রকারভেদ থেকে যা আমাদের কাছ পূর্ণিমা রাতে মেঘমুক্ত আকাশ উদিত চন্দ্রের ন্যায় সুস্পষ্ট। এজন্য হাদীছে রিয়াকে ‘গোপন শিরক’ এবং ‘ছোট শিরক’ বলা হয়েছে।৬ আল্লাহ আমাদেরকে এই গোপন শিরক থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক দান করুন! আমীন!!
১. ইবনুল জাওযী, ছায়দুল খাতের (বৈরূত : দারুল কুতুব আল-ইলমিইয়াহ, ১ম প্রকাশ, ১৪১২ হি./১৯৯২ খ্রি.), পৃ. ৩৭৫।
২. তা‘তীরুল আনফাস, পৃ. ৪৯৯।
৩. ইবনু কুদামা আল-মাকদেসী, মুখতাছার মিনহাজুল কাছেদীন, তা‘লীক : শু‘আইব আরনাঊত ও আব্দুল কাদের আরনাঊত (দামেশক : মাকতাবাতু দারিল বায়ান, ১৩৯৮ হি./১৯৭৮ খ্রি.), পৃ. ২১১।
৪. আলোচনা দ্র. আবূ হামিদ গাযালী, ইহয়াউ উলূমিদ্দীন (বৈরূত: দারুল মা‘রিফাহ, তাবি), ৩/২৯৭-২৯৯; মুখতাছার মিনহাজুল কাছেদীন, পৃ. ২১৪-২১৬; ড. ওমর সুলাইমান আল-আশকার, মাকাছিদুল মুকাল্লিফীন (কুয়েত : মাকতাবাতুল ফালাহ, ১ম প্রকাশ, ১৪০১হি./১৯৮১ খ্রি.), পৃ. ৪৪২-৪৪৩; ড. সাঈদ বিন আলী বিন ওয়াহাফ আল-কাহতানী, নূরুল ইখলাছ (১ম প্রকাশ : ১৪২০ হি./১০৯৯ খ্রি.), পৃ. ৩৬-৩৭; তা‘তীরুল আনফাস, পৃ. ৪৯৭-৫০১।
৫. মুখতাছার মিনহাজুল কাছেদীন, পৃ. ২১৬।
৬. ইবনু মাজাহ হা/৪২০৪; আহমাদ, বায়হাকী, মিশকাত হা/৫৩৩৩-৩৪; সনদ জাইয়িদ; সিলসিলা ছহীহা হা/৯৫১; ছহীহ তারগীব হা/৩২।