ইমান/আখলাক

যুব সমাজের আদর্শ হিসেবে রাসূল (সাঃ)

মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) যেমন ছিলেন পরিপূর্ণ মানুষ, তেমনই ছিলেন একজন পরিপূর্ণ আদর্শ যুবক৷ পৃথিবীতে যত ভালো গুণ আছে এর সব গুণের সমাবেশ ঘটেছিল হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর মধ্যে৷ এককথায়, তিনি ছিলেন সর্বগুণের আধার৷

রাসুল (সা.)-এর চরিত্র সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আপনি অবশ্যই মহান চরিত্রের অধিকারী’ (সুরা কালাম-৪)।

ফরাসি খেক আলফ্রেড তার তুর্কির ইতিহাসের প্রথম খন্ডে লিখেছেন, ‘দার্শনিক, বক্তা, ধর্ম প্রচারক, যোদ্ধা, আইন রচয়িতা, ধর্মমতের ও প্রতিমাবিহীন ধর্ম পদ্ধতির সংস্থাপক মুহাম্মদ (সা.) কে মানুষের মহত্তের যতগুলো মাপকাঠি আছে তা দিয়ে মাপলে, কোনো লোক তাঁর চেয়ে মহত্ হতে পারবে না৷’

মহামানব মুহাম্মদ (সা.) যৌবনে পদার্পণ করে চরম নোংরা পরিবেশে লালিত-পালিত হয়েও নিজের যৌবনকে কলঙ্কমুক্ত রাখতে সক্ষম হন৷ যে সমাজে অবৈধ প্রেম, কুদৃষ্টি বিনিময় ও ব্যভিচার যুবকদের জন্য ছিল গর্বের ব্যাপার, সে সমাজে এ অসাধারণ যুবক নিজের দৃষ্টিকেও কলুষিত হতে দেননি৷ যেখানে অলিগলিতে ছিল মদ তৈরির কারখানা এবং ঘরে ঘরে ছিল পানশালা, বসত মদ্যপানের জমজমাট কবিতা পাঠের আসর, সেখানে এ যুবক এক ফোঁটা মদও মুখে তোলেননি৷ যেখানে জুয়া জাতীয় অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল, সেখানে আপাদমস্তক পবিত্রতায় মন্ডিত এ যুবক (সা.) জুয়া স্পর্শও করেননি৷ নষ্ট গানবাজনা যেখানে সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ, সেখানে তিনি এসব অপসংস্কৃতির ধারেকাছেও ঘেঁষেননি৷

তাই তার জীবনের শৈশব-কৈশোর, যৌবন-বার্ধক্য প্রতিটি মুহুর্তেই তিনি ছিলেন সমগ্র মানবতার জন্য উত্তম আদর্শ৷ এর সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, যারা আল্ল্নাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্যে রসূলুল্লাহর মধ্যে উত্তম নমুনা রয়েছে (৩৩-সুরা আহযাব: ২১)৷

আজকের যুব সমাজ কিভাবে রাসূল (সাঃ) এর আদর্শ থেকে শিক্ষাগ্রহণ করে একজন আলোকিত মানুষে পরিণত হতে পারে কিভাবে রাসূল (সাঃ) এর মতো একটি আদর্শ সমাজ বির্নিমাণে ভূমিকা রাখতে পারে তা তাঁর (সাঃ) এর জীবন থেকে আমরা আলোচনা করবো৷

১৷ ন্যায়ের পক্ষে হোক নিজের অবস্থান যৌবনেই :

তখন রাসূল (সাঃ) এর বয়স ছিলো মাত্র ২০ বছর৷ কুরাইশ ও কাইস গোত্রের মাঝে পুরানো শত্রুতার কারণে যুদ্ধ বাঁধে৷ এই যুদ্ধে কুরাইশগণ ন্যায়ের উপর ছিলো৷ মুহাম্মাদ (সা) কুরাইশদের পÿে যুদ্ধে যান৷ যুদ্ধে কুরাইশদের জয়ী হয়৷ এই যুদ্ধেরই নাম ফিজারের যুদ্ধ৷

এ সম্পর্কে রাসূল (সাঃ) বলেন, আমি আমার চাচাগণের দিকে শত্রুদের ছুঁড়ে মারা তীর ও বর্শাগুলো কুড়িয়ে তাদের কাছে দিতাম৷ [1]

২৷ সমাজ সংস্কারে যুবকদের দফা কর্মসূচী :

একটি শান্তির সমাজ প্রতিষ্ঠায় সে সমাজের অশান্তি দূর করা, জানমালের নিরাপত্তা বিধান করা, দারিদ্র বিমোচনের উদ্যোগ নেওয়া, বিপদগ্রস্থদের সাহায্য করা এবং কোন অন্যায়কারীকে প্রশ্রয় না দেওয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে৷

রাসূল (সাঃ) যৌবনকালীন সময়ে যুদ্ধ ছিলো আরবদের নেশা৷ শত শত পরিবার ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিলো৷ মানুষের কোন নিরাপত্তা ছিলো না৷ সবাই আতংকের মধ্যে দিন কাটাতো৷ আয যুবাইর ইবনু আবদিল মুত্তালিব ছিলেন একজন কল্যাণকামী ব্যক্তি৷ তিনি এই অবস্থার পরিবর্তনের লÿ্যে বিভিন্ন ব্যক্তির সাথে মত বিনিময় করেন৷ অনুকুল সাড়াও পেলেন৷ শিগগিরই গড়ে উঠলো একটি সাংগঠন৷ নাম তার হিলফুল ফুদুল৷ মুহাম্মাদের (সা) বয়স তখন সতর বছর৷ তিনি সানন্দে এই সংগঠনের অন্তর্ভূক্ত হন৷ এটি হয়ে ৫৯১ সালে যখন রাসূল (সাঃ) এর বয়স মাত্র ২১৷ [2]

হিলফুল ফুদুলের পাঁচ দফা –

১৷ আমরা দেশ থেকে অশান্তি দূর করবো৷

২৷ পথিকের জান-মালের হিফাজাত করবো৷

৩৷ অভাবগ্রস্থদের সাহায্য করবো৷

৪৷ মাযলুমের সাহায্য করবো৷

৫৷ কোন যালিমকে মক্কায় আশ্রয় দেবো না৷

অনেক দশক পরে হিলফুল ফুদুল গঠন বিষয়ে স্বয়ং রাসূল (সাঃ) বলেছিলেন –

‘‘ আমি আবদুল্লাহ ইব্‌ন জুদ’আন-এর ঘরে সম্পাদিত অঙ্গীকারের সময় উপস্থিত ছিলাম৷ এর বদলে অনেকগুলো লাল উট অর্জন করাও আমি পছন্দ করব না৷ ইসলামেও যদি এ জাতীয় কোন অঙ্গীকারে আমাকে ডাকা হয় তবে অবশ্যই তাতে আমি সাড়া দেব৷’’ [3]

৩৷ বিশ্বস্থতাই যৌবনে করে জনপ্রিয়ঃ

হিলফুল ফুযূল গঠন ও তার পরপরই যবরদস্ত কুরায়েশ নেতার কাছ থেকে বহিরাগত মযলূমের হক আদায়ের ঘটনায় চারিদিকে তরুণ মুহাম্মাদের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল৷ সবার মুখে মুখে তিনি ‘আল-আমীন’ অর্থাত্ বিশ্বস্ত ও আমানদার বলে অভিহিত হ’তে থাকেন ৷ অল্পবয়স হওয়া সত্ত্বেও কেউ তার নাম ধরে ডাকতো না৷ সবাই শ্রদ্ধাভরে ‘আল-আমীন’ বলে ডাকত ৷ তাঁর বিশ্বস্ততার বিষয়ে প্রসিদ্ধ সীরাতগ্রন্থ ইবনু হিশাম এ বর্ণিত আছে- ‘‘আব্দুল্লাহ বিন আবুল হামসা বলেন, নবুঅত পূর্বকালে আমি রাসূল (ছাঃ) এর নিকট থেকে কিছু খরীদ করেছিলাম৷ সেখানে মূল্য পরিশোধে আমি কিছু বাকী রাখি৷ অতঃপর আমি তাকে ওয়াদা করি যে, এই স্থানেই আমি উক্ত মূল্য নিয়ে আসছি৷ পরে আমি ভুলে যাই৷ তিন দিন পরে স্মরণ হলে আমি এসে দেখি রাসূল (সাঃ) সেখানেই দাঁড়িয়ে আছেন৷ অতঃপর তিনি আমাকে বললেন, তুমি আমাকে কষ্ট দিলে৷ তিন দিন ধরে আমি এখানে তোমার অপেক্ষায় আছি’ [4]

৪৷ সম্প্রতি ঐক্য বজায় রাখার চর্চা যৌবনে শুরু :

পাহাড়ের উপত্যকায় অবস্থিত কাবা৷ একবার পাহাড়ের পানি এসে তার দেয়াল ভেঙ্গে ফেলে৷ কুরাইশদের নতুনভাবে গড়ে তোলে কাবার দেয়াল৷ নির্মাণ কালে হাজরে আসওয়াদ কাবার কোণ থেকে সরিয়ে রাখা হয়৷ দেয়াল নির্মাণের পর পাথরটি আবার স্বাস্থানে বসাতে হবে৷

কুরাইশদের সব খান্দান এই মহান কাজ করার ইচ্ছা ব্যক্ত করলো৷ এই নিয়ে শুরু হলো বিবাদ৷ যুদ্ধ বেঁধে যাবার উপক্রম৷ আবু উমাইয়াহ ইবনুল মুগীরাহ প্রস্তাব দেন যে, যেই ব্যক্তি সবার আগে প্রাঙ্গণে পৌঁছাবে তার উপর এই বিরোধ মীমাংসার ভার দেয়া হবে৷ সে যেই সিদ্ধান্তে দেবে তা সবাই মেনে নেবে৷ সকলে এই প্রস্তাব মেনে নেয়৷

অতপর দেখা গেলো সকলের ধীর পদে এগিয়ে আসছেন এক যুবক মুহাম্মদ (সা) সবাই ছুটে এলো তাঁর কাছে৷ ফায়সালার দায়িত্ব তুলে দিলো তাঁর হাতে৷ তিনি একটি চাদর আনার নির্দেশ দেন৷ চাদর এনে ছিলো হলো৷ মুহাম্মাদের (সা) নিজ হাতে হাজরে আসওয়াদ তুলে চাদরের মাঝখানে রাখলেন৷ হাজরে আসওয়াদ স্থাপন করতে ইচ্ছুক প্রত্যেক খান্দানের এক একজন প্রতিনিধকে চাদর ধরে উপরে তুলতে বললেন৷ সকলে মিলে পাথরটি নিয়ে এলো কাবার দেয়ালের কাছে৷ মুহাম্মাদের (সা) চাদর থেকে পাথরটি তুলে যথাস্থানে বসিয়ে দিলেন৷ সবাই খুশী৷ এড়ানো গেলো একটি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ৷ [5]

এই ঘটনাটি ঘটেছিলো ৬০৫ সালে যখন রাসূল (সাঃ) এর বয়স ছিলো ৩৫৷ গবেষক কন্সট্যানটিন গোর্গুয়ের মতে ‘ মুহাম্মদ (সাঃ) যেভাবে চিন্তা করেছে সেটা তারা সৃজনী ক্ষমতার ইঙ্গিত দেয়৷ তার মধ্যে যদি এ ধরনের ক্ষমতা না থাকত, তাহলে সে নবী হতে পারত না৷’ [6]

৫৷ কর্ম সততা চর্চার শুরু হোক যৌবনেইঃ

বহুদিন ধরে রাসূল (সাঃ) ব্যবসায়ী হিসেবে কাজ করেছেন৷ প্রতারনা, লোক-ঠকানো, নিজের স্বার্থ উদ্ধারে অন্যকে ব্যবহার তত্কালীন সমাজের নিত্যদিনের চিত্র৷ তাই বলে রাসূল (সাঃ) ব্যবসা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেননি নিজেকে৷ আবার সমাজের মূলধারার সাথে মিশেও যাননি৷ সমাজের বিবেকহীন চর্চায় লিপ্ত হননি, বরং তিনি মন্দ পরিবেশ থেকে খুঁজে নিয়েছেন ভালোকে৷ আল-সা’ইব নামক সত্ ব্যবসায়ীর সাথে সফল ব্যবসায়িক জুটি গড়ে তুলেছেন৷ নিজের পণ্যের খারাপ দিক তিনি অবলীলায় বলে দিতেন৷ এ ব্যাপারে তাঁর সুনাম ছিলো৷ দাম নিয়ে বাদানুবাদ করতেন না৷ রাসূল (সাঃ) আল-সা’ইরে কাছ থেকে শিখেছেন দুর্নীতির হাতছানি যে-সমাজে সুলভ, সেখানে কিভাবে সত্ভাবে জীবিকা উপার্জন করা যায়৷ [7]

৬৷ আদর্শ স্বামী হবার উপযুক্ত সময় এই যৌবনঃ

মাত্র ২৫ বছর যৌবনেই বিশ্বস্ততা ও চারিত্রিক মাধুর্যতার জন্য খাদিজা (রাঃ) সাথে রাসূল (সাঃ) এর বিয়ে হয়৷ খাদিজা (রাঃ) আনহা বলেছিলেন, তিনি তাঁকে ভালোবাসেন তাঁর (রাসূল (সাঃ) এর দয়া, সততা ও সত্যবাদিতার জন্য৷ অথচ রাসূল (সাঃ) স্ত্রীর প্রতি দায়িত্ব আর স্ত্রীর অধিকার থেকে তিনি খাদিজার সাথে আচরণ করেননি বরং ব্যবহার ছিলো নিজের পূণ্যগুণে৷ এই মমতাময় বৈবাহিক সম্পর্কের ইংগিতেই পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে –

(২-সুরা বাক্বারা: ২৩৭) পারস্পরিক ব্যাপারে তোমরা উদারতা ও সহৃদয়তার নীতি ভুলে যেয়ো না৷[8]

৭৷ যৌবনেই হোক আদর্শ বন্ধুত্ব নির্বাচনঃ

তত্কালীন আরব সমাজেও আজকের মতো বিদেশী, মূর্তিপূজারী ও খ্রিস্টান সব মতের মানুষ ছিলো৷ রাসূল (সাঃ) যুবক বয়সে বন্ধু হিসেবে বেছে নিয়েছেন সুশিক্ষিত ও শ্রদ্ধাবান লোকদের৷ যৌবনে রাসূল (সাঃ এর ৩জন বন্ধুর কথা উল্লেখ করা যেতে পারে যেমন-

আবু বকর আসসিদ্দীকঃ যিনি কখনো মন পান করেননি, মূর্তিপূজা করেননি৷ তারপরও সামাজিক ছিলেন ছিলেন জনপ্রিয় মানুষ৷

হাকিম ইবন্‌ হিযামঃ বুদ্ধিমান ও দানশীল নেতা যিনি হাজীদের মেহমানদারি করতেন৷

জাবরা আররুমিঃ সুশিক্ষিত, বহুভাষী, বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থের সম্পর্কে ছিলো তার অগাধ জ্ঞান৷

মহানবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সা.) [৫৭০-৬৩২ খ্রি.] এক মহামানবের জীবন৷ যিনি সমগ্র মানবতার জন্য প্রেরিত হয়েছিলেন রহমত হিসেবে৷ যার জীবনের প্রতিটি মুহুর্তে আমাদের জন্য রয়েছে শিক্ষা৷ তা শিশু, যুবক, প্রবীণ সবার জন্য৷ আর রাসূল (সাঃ) নিজেই বলেছেন তাকে প্রেরণ করা হয়েছে শিক্ষক হিসেবে৷ তাই আজকের যুব সমাজ যদি তাদের আদর্শ হিসেবে রাসূল (সাঃ) এর যৌবনের আদর্শ লালন করে তবে তা প্রত্যেক যুবকের জন্য সম্মাণ ও গৌরবের৷ আর এই আদর্শের বলিয়ান যুব সমাজই পারবে একদিন এই বাংলাদেশকে মদীনার ইসলামী সমাজের মতো একটি ইসলামী সমাজ বিনির্মাণে ভূমিকা রাখতে৷

– মোঃ আতিকুর রহমান


[1]  সিরাত ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ১৭৫ (ইফাবা)।

[2] বি স্মার্ট উইথ মুহাম্মদ (সাঃ), ড. হিশাম আল-আওয়াদী, পৃষ্ঠা- ৮৬-৮৭

[3] সিরাত ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ১৩৮ (ইফাবা)।

[4] (সীরাত ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ১৯৮ (আবু দাউদ)

[5] সিরাত ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ১৮৪-১৮৫ (ইফাবা)।

[6] বি স্মার্ট উইথ মুহাম্মদ (সাঃ), ড. হিশাম আল-আওয়াদী, পৃষ্ঠা- ৮৮

[7] বি স্মার্ট উইথ মুহাম্মদ (সাঃ), ড. হিশাম আল-আওয়াদী, পৃষ্ঠা- ৯০

[8] বি স্মার্ট উইথ মুহাম্মদ (সাঃ), ড. হিশাম আল-আওয়াদী, পৃষ্ঠা- ৯৩

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

আরও দেখুন
Close
Back to top button